সমাজতন্ত্রী শিল্পায়নের সমাজতান্ত্রিক জটিলতা


গত দুটি পোস্টে (, ) বলেছি সোভিয়েত ইউনিয়নকে দুর্যোগের সময় কিভাবে বিশাল সহায়তা করে মার্কিন সরকার ও পশ্চিমা কম্পানিগুলি। শেষ খন্ড বলা বাকি আছে। তবে আলোচনার এ পর্যায়ে একটা সেগোয়ে করতে চাই। সোভিয়েত প্রযুক্তিবিপ্লবের অর্থসংস্থান কোত্থেকে কিভাবে হল? আর কতটুকুই সফলকাম হয় সোভিয়েতরা?

স্তালিনের দাবি ছিল, তিনি নাকি রুশ জনতাকে খুঁজে পান জমিতে কাঠের লাঙল দিয়ে চাষাবাদরত, আর তাদের রেখে যাচ্ছেন পারমাণবিক চুল্লীর মালিক হিসাবে। এটা বাস্তবিক কথা নয়। রুশ বিপ্লবের আগেই ৎসারপন্থী রাশিয়ায় শিল্পায়ন চলছিল। পশ্চিমা দেশগুলির তুলনায় মাথাপিছু আয় কম হলেও স্টীল উৎপাদনে রাশিয়ার স্থান ছিল বিশ্বের চার নম্বর। বিপ্লব ও যুদ্ধের ডামাডোল আর তারপর কম্যুনিস্টদের অনভিজ্ঞ বাস্তবতাবিবর্জিত অর্থনৈতিক পরিকল্পনার কারণেই ৎসার আমলের শিল্পগুলি জীর্ণ দশায় নিপতিত হয়। সেসব ঘটনা না ঘটলে ৎসারের সিস্টেমে রাশিয়া শিল্পায়িত হতে পারত।

ৎসারের আমলের রুশ টেক্সটাইল মিল, ১৯০৫

মার্কিন সাহায্যে লব্ধ স্তালিনী শিল্পায়নের জন্য যে সোভিয়েত জনগণকে মূল্য দিতে হয়নি তা কিন্তু নয়! মার্কিন প্রকৌশলীদের উচ্চ বেতন দেয়া হত কিভাবে, সেটা আন্দাজ আছে কারো?

মস্কোতে নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিনিধি ডুরান্টির মত পুলিৎজারবিজয়ী সাংবাদিক যখন সোভিয়েতদের প্রগতির প্রশংসায় পঞ্চমুখ, তখন গ্যারেথ জোনস নামে এক ব্রিটিশ সাংবাদিক সোভিয়েতদের চোখ এড়িয়ে চলে যান ইউক্রেনের গ্রামাঞ্চলে। সেখানে দেখেন আরেক মহাদুর্ভিক্ষের চিত্র, যেটি আজও হলোদমর নামে স্বীকৃত। কিন্তু আগের মত কোন সহায়তার অনুরোধ যায়নি সেবার। ৫০ লাখের মত মানুষ তাতে মারা যায়। এর কারণ, ইউক্রেনের ঊর্বরভূমির খাদ্যশস্য কৃষকদের থেকে জোর করে কেড়ে শহরের শিল্পায়নরত শ্রমিকদের খাওয়াচ্ছে স্তালিন সরকার, নয়ত রপ্তানি করেছে। উদ্দেশ্য, ঐ শিল্পায়নের মূলধন জোগাড়।

নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক ওয়াল্টার ডুরান্টি। ত্রিশের দশকে সোভিয়েত প্রগতিশীলতার ওপর রিপোর্ট লিখে পুলিৎজার জিতেন। কিন্তু সোভিয়েত শোষণের বিরুদ্ধে লেখেননি কিছু।
কিয়েভের নিকট গৃহহীন ইউক্রেনীয় কৃষক, ১৯৩৪
ইউক্রেনের পলতাভার নিকট দুর্ভিক্ষে মৃত নারী, ১৯৩৪
খার্কিভের রাস্তায় এসে স্থান নিয়েছে দুর্ভিক্ষপীড়িত ইউক্রেনীয় কৃষক, ১৯৩৩
ব্রিটিশ সাংবাদিক গ্যারেথ জোনসের ১৯৩৩ সালের ইউক্রেনীয় হলোদমর দুর্ভিক্ষের ওপর রিপোর্ট, ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকা
ব্রিটিশ সাংবাদিক গ্যারেথ জোনস, ১৯৩৩-৩৪এ ইউক্রেনীয় হলোদমর দুর্ভিক্ষের ওপর রিপোর্ট করেন। কম্যুনিস্ট সরকার এ দুর্ভিক্ষের কথা অস্বীকার করে।

তাছাড়া শিল্পায়নে ব্যবহৃত রুশ শ্রমিকদের একটা বিশাল অংশ ছিল অনৈচ্ছিক শ্রমিক। অনেকে ছিল গুলাগের রাজনৈতিক বন্দী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও অধ্যাপক। এসকল শ্রমে অনভিজ্ঞ মানুষ হাজারে হাজারে মারা যায় স্তালিনের প্রকল্পগুলিতে কাজ করতে গিয়ে।

কারখানার শ্রমিকদের ওয়ার্কিং ও লিভিং কন্ডিশন এমন ছিল যে সেটা ব্রিটেনের শিল্পায়নের যুগের ডিকেনজিয়ান ডিসটোপিয়াকেও হার মানায়। সাধারণ শ্রমিকরা নিয়ম না মানলে তাদের আইনসিদ্ধ শাস্তি ছিল ভয়াবহ। কিন্তু সরকারের মালিকানায় পরিচালিত কারখানায়গুলো থেকে শ্রমিকরা অন্যত্র গেলে কাজ করবে কে? কেন্দ্রীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা তো ভেস্তে যাবে। এ কারণে ১৯৩২ সাল থেকে স্তালিন ইন্টারনাল পাসপোর্ট সিস্টেম চালু করেন। দেশের এক শহর থেকে আরেক শহরে গেলে অনুমতি ব্যতিরেকে যাওয়া অসম্ভব। আয়রনির ব্যাপার হল, ৎসারের সময়ে শেষ এ সিস্টেম চালু ছিল, লেনিন এই আইনকে পশ্চাদমুখী স্বৈরাচারী ইত্যাদি অভিধা দিয়ে উঠিয়ে দিয়েছিলেন। শ্বেত ৎসার নিকোলাসের জায়গা নিলেন এবার রেড ৎসার স্তালিন।

১৯৩২ সালে বাল্টিক-শ্বেতসাগর খাল নির্মাণে নিযুক্ত গুলাগের বন্দী অনৈচ্ছিক শ্রমিক
১৯৩২ সালে বাল্টিক-শ্বেতসাগর খাল নির্মাণে নিযুক্ত গুলাগের বন্দী অনৈচ্ছিক শ্রমিক
সাইবেরিয়ার প্রিজন ক্যাম্পের চিত্র
১৯৩৬এ গুলাগের বিছানাগুলির দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছে পোস্টারের যুগল মার্ক্স ও স্তালিন
১৯৩২ সালে গুলাগের সর্দারদের গ্রুপ ছবি
দার্শনিক পাভেল ফ্লরেন্সকি ১৯৩৩ সালে সোভিয়তবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে গ্রেপতার হন। স্তালিনের গুলাগে তার ১০ বছরের নির্বাসন হয়। তিন বছরের মাথায় গুলাগে গুলি করে মারা হ্য় তাকে।
গুলাগ সর্দার স্তেপান গারানিন। ১৯৩৭ সালে নির্যাতনের মাধ্যমে স্বীকরোক্তি আদায়ের অভিযোগে তার নিজেরই বন্দীদশা শুরু হয়। গুলাগে মারা যায় কয়েক বছর পর।
১৯৩৭ সালে অনৈচ্ছিক শ্রম দিয়ে তৈরি মস্কো খাল পরিদর্শনে স্তালিন, পেছনে মলোতভ
গুলাগের মহিলা সেকশন, সাইবেরিয়ার ঠান্ডায় নেই কোন হীটিং ব্যবস্থা, ত্রিশের দশক
ৎসারের আমলের ইন্টারনাল পাসপোর্ট। এ কাগজ ব্যতিরেকে স্বদেশের এক জায়গা থেকেই আরেক জায়গায় কেউ যেতে পারত না।

রাশিয়ায় টেইলরিজম চালুর অনেক সমস্যাও ছিল। পশ্চাদপসর রুশ কর্মীদের ঘড়ি ছিল না। সময়মত শিফটে এসে হাজির হত না। তারপর কম্যুনিস্ট পার্টির হর্তাকর্তারা কারখানার এক জায়গায় দক্ষতা বাড়ালে দেখা যেত বটলনেক অন্যত্র, যেখানে বিন্দুমাত্র নজর দেয়া হয়নি। কর্মীরা আমদানিকৃত দামী যন্ত্র ব্যবহার করত খুব অদক্ষভাবে। সেগুলি প্রায়ই বিকল হয়ে যেত। তৈরি পণ্যের গুণগত মানের অবস্থা ছিল শোচনীয়। এসবের দোষ পড়ত প্রকৌশলী ও ম্যানেজারদের ঘাঁড়ে। কখনো কখনো তাদের সাবোটাজের অভিযোগে কর্মচ্যুত করে নির্বাসনে পাঠানো হত শাস্তি হিসাবে।

কোন কারণ ছাড়াই ওপরমহল থেকে নির্দেশ আসত কাজ দ্রুত করার নয়ত প্রডাকশন কোটা বাড়ানোর। উদাহরণস্বরূপ, লেনিনের তড়িতায়ন স্বপ্নে তাড়িত সোভিয়েত পার্টিকর্মীরা সারা দেশে তামার স্যালভেজ অপারেশন চালায়। অশিক্ষিত চাষারা নিয়ে আসে বিভিন্ন মানের তামার দ্রব্য, যেগুলি থেকে ভালমানের বৈদ্যুতিক তার বানানো লাভজনক নয়। এরাই ফ্যাক্টরিতে কাজ করে এবং তাদের তৈরি গাড়ি ও ট্র্যাক্টর হয় বেশ নিম্নমানের।

ফোর্ডের তৈরি দশ বছরের গ্যারান্টিওয়ালা ট্র্যাক্টর সোভিয়েত চাষার ব্যবহারে তিন মৌসুমের মধ্যে অকেজো হয়ে পড়ে থাকত। পড়ে থাকলে বরং রুশ চাষার লাভ, সরকারী যৌথখামারের কাজে ফাঁকি দিতে পারে! ট্র্যাক্টর ঠিক করানোর পার্টস ও রিপেয়ার শপ ছিল নামে মাত্র। মেশিন টুলসের যন্ত্র সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অকেজো হয়ে পড়ত। ফোর্ডসন ট্র্যাক্টর জনপ্রিয় হলেও ইউক্রেন ও ভল্গা অববাহিকার মাটি গভীরভাবে কর্ষণের উপযুক্ত ছিল না। আর এদের জ্বালানী ছিল বেনজিন, যেটা রাশিয়ায় সহজলভ্য নয়।

১৯৩৭ নাগাদ এর্ন্সট মের ডিজাইন করা মাগনিতোগোর্স্কের অ্যাপার্টমেন্টগুলো হয়ে পড়ে নোংরা, জনাকীর্ণ বস্তি। মে’র ডিজাইনের সাথে মিল না রেখে অ্যাপার্টমেন্টগুলির এত পরিবর্তন সাধন করে সোভিয়েতরা, যে তিনি বেশ অসন্তুষ্ট হন। একেকটি ফ্ল্যাটে দেখা যেত পাঁচ ছ’জন গাঁদাগাঁদি করে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকছে। বাথটাব ব্যবহৃত হচ্ছে স্টোরেজের জন্য।

সোভিয়েত ব্লক অ্যাপার্টমেন্টের রান্নাঘর, ৫০/৬০এর দশক
স্তালিনগ্রাদ ট্র্যাক্টর প্ল্যান্টের নারীকর্মী, তিরিশের দশক
স্তাখানোভাইট আন্দোলনের পোস্টার। এরা ছিল “অতিমানবিক” শ্রমিক। এদের কাজ ছিল ক্রমাগত কাজ করে রেকর্ড ভাঙা। সহকর্মীরা এদের দেখতে পারত না। এদের কাজের গুণগত মানও ছিল কম।
পোস্টারে লেখা কয়লা শিল্পায়নের পাঁচ বছরের পরিকল্পনা শেষ হবে তিন বছরে।

বাস্তবতাবিবর্জিত পরিকল্পনার কারণে দেখা যায় স্তালিনের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় যে সব কাজ সমাধা হবার কথা ছিল, সেগুলি পিছিয়ে দিতে হয় পরের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার শেষভাগে। ওদিকে পোস্টার সেঁটে চলেছে পার্টিকর্মীরা, “পাঁচ বছরের কাজ শেষ করি চলো তিন বছরে!” মাগনিতোগোর্স্কে দেখা দিল সাপ্লাই চেইন সমস্যা। যে পরিমাণ ক্যাপাসিটি তৈরি হয়েছে, সে পরিমাণ উৎপাদনের কাঁচামাল সাপ্লাইয়ে বটলনেক। এত বড় স্টীল মিল হওয়া সত্ত্বেও সে কমপ্লেক্সটির ভেতরের সকল রেললাইন বানানোর উপযুক্ত উৎপাদনই মিলটিতে নেই। গত পোস্টে বলেছি ডিমান্ড বিল্ডাপ না করেই সবকিছু বিশাল বিশাল বানানোর সোভিয়েত শখের কারণে দ্নিপ্রোগেসের মত বিদ্যুতকেন্দ্রও ক্ষতিতে চলেছিল কয়েক বছর।

স্তালিন এ অবস্থা দেখে নতুন ফতোয়া দিলেন “ডিজী উইথ সাক্সেস” নামে। তার এক্সকিউজ, এত দ্রুত সোভিয়েতরা সাফল্যের মুখ দেখছে যে সেটা হজম করতে পারছে না! এবার আনতে হবে ধীরতা।

ডিজী উইথ সাক্সেস, পার্টির উদ্দেশ্যে স্তালিনের লেখা ফতোয়া, ১৯৩০

স্তালিনের ফ্যাক্টরি ম্যানেজাররা তো আরো এক কাঠি ওপরে। তারা সচেষ্ট ছিলই পার্টি বসদের কাছে নিজেদের জাহির করতে। ফোলানো-ফাঁপানো প্রডাকশন নাম্বার যেত ফাইনাল রিপোর্টে। কোটা পূরণ করতে না পারলে গর্দান যায়, আর কোটা পূর্ণ করেও বেশি দেখাতে পারলে মেডেল আছে কপালে! সোভিয়েত ব্যবস্থাপকদের চয়েস খুবই ক্লীয়ার।

সাধারণ মানুষ যে এই দ্রুত অগ্রগতির থেকে লাভবান হয়েছিল তাও নয়। ভারিশিল্পের ওপর বেশি জোর দেবার কারণে ভোক্তাশিল্প ছিল অবহেলিত। খাদ্য-বস্ত্রের মত মৌলিক চাহিদা পূরণের দিকে সরকারের নজর ছিল কম। অসঙ্গতিপূর্ণ নোট ছাঁপানোর কারণে ভোক্তাপণ্যে মুদ্রাস্ফীতি ছিল অত্যাধিক। দেখা যেত, যেসকল ব্যক্তিমালিকানার খামার তখনও অবশিষ্ট ছিল, সেসবের কৃষক শস্য বিক্রির পরিবর্তে স্টক করে রাখছে। সরকার এসে সেগুলি কেড়ে না নেওয়া পর্যন্ত সেগুলি বিক্রি করত না। শেষ পর্যন্ত সে রাস্তাই নিতে হত কম্যুনিস্ট পার্টিকে। তাতেও যখন চাহিদা না মেটে, তখন শহরের মানুষকে আনা হয় রেশনের আওতায়। রুটির জন্য লম্বা লাইন ছিল সোভিয়েত শহরগুলির দৈনন্দিন দৃশ্য।

তিরিশের দশকে মস্কোতে রুটির জন্য লম্বা লাইন

ওদিকে তথাকথিত সাম্যবাদের দেশের শিল্পায়ন হয় কিন্তু পুঁজিবাদী আদলেই! রাষ্ট্র ছিল সকলের বেতনভাতার নির্ধারক। সোভিয়েত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশকরা ডিপ্লোমা ইনজিনিয়াররা পেত সাধারণ অদক্ষ কর্মীর ৬ থেকে ৮ গুণ। উপরের লেভেলের ম্যানেজাররা পেত ৩০ গুণ। মার্কিন বিশেষজ্ঞদের বেতনভাতা ছিল সর্বোচ্চ। তারা থাকত বিশেষ বিদেশী এলাকায় ভাল বাসস্থানে। আমদানিকৃত বিলাসদ্রব্য আনা হত তাদের জন্য। ছিল সুইমিং পুল গল্ফ কোর্স। বিনিময়ে কর্নেল কুপারের মত মানুষ সোভিয়েতের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রে সফল লবিইং করেন। গ্রেট ডিপ্রেশনের যুগে সোভিয়েত ইউনিয়নে যদি মার্কিন পণ্যের রপ্তানি হয়, মার্কিন মানুষের কর্মসংস্থান হয়, তো মন্দ কি?

সব মিলিয়ে বুঝতে পারছেন হয়ত, সোভিয়েত সিস্টেমে পুঁজিবাদী শোষণের পরিবর্তে সেটি হয়ে গেছে রাষ্ট্রীয়-সরকারী শোষণ। স্টেট সেখানে এক্সপ্লয়টার, ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টের জায়গায়। বরং আরো বাজে এক্সপ্লয়টার। ফোর্ড-টেইলরের মত মানুষ যেখানে শ্রমিকদের ভাল বেতন দেবার পক্ষপাতী ছিলেন, সেখানে সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্র শ্রমিকদের বেতন তো বটেই, যাতায়াতও ফিক্স করে রেখে দিয়েছে। ফলশ্রুতিতে স্তালিনের আমলে বেশ কিছু শ্রমিক ধর্মঘটও হয়, সমাজতন্ত্রী ওয়ার্কার্স প্যারাডাইজ প্রলেতারিয়াত ডিক্টেটরশিপ রাষ্ট্রে যেটা অভাবনীয়। অবশ্য যথারীতি সেসব ধর্মঘটের বিনাশও করে সোভিয়েত গুপ্ত পুলিশ।

স্তালিনের আমলের অগণিত শ্রমিক ধর্মঘটের একটি স্তালিনের মৃত্যুর পর সোভিয়েত পোস্টারে স্থান নেয়

যাই হোক, ত্রিশের দশকের শেষ নাগাদ নানা ভুল রাস্তায় টক্কর মেরে সোভিয়েত একটা স্থিতিশীল শিল্পায়নের অবস্থায় এসে দাঁড়ায়। তবে লেনিন-স্তালিনের এই ডিজী উইথ সাক্সেস শিল্পায়নের পেছনে বলেছি একটা প্যারানয়া কাজ করত। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির আগ্রাসনের ভয়ে এর আরম্ভ বিশের দশকে। ত্রিশের দশকে যখন সত্যি সত্যি সে সময়টা এল, তখন কি সোভিয়েত রাষ্ট্র তৈরি ছিল প্রতিরক্ষার জন্য? সে কাহিনী বলে সাড়ব আগামী খন্ডে।

হাইতি – ৪, দখলদার মার্কিন, ১৯১৫-৩৪

বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ হাইতির একটি কালো অধ্যায় শুধু নয়, ঔপনিবেশিকতাবিরোধী আদর্শের ধ্বজাধারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্যেও একটা লজ্জাজনক সময়।

এ সময়ে হাইতির উত্তরের ‘দানব’ যুক্তরাষ্ট্র পরাশক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করছে। ইউরোপীয় শক্তিগুলো ক্রমশঃ আমেরিকা মহাদেশ থেকে হাত গুঁটিয়ে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পরদেশনীতির নির্দেশক হয়েছে মনরো ডক্ট্রিন, তার মূল লক্ষ্য দুই আমেরিকার নবজাত স্বাধীন দেশগুলি যেন আবার ইউরোপীয়দের পদানত না হয়। ১৯০১ সালে রাষ্ট্রপতি থিওডর (টেডিবিয়ার!) রোজাভেল্ট এতে যোগ করেন আরেকটি করোলারি। আমেরিকার স্বাধীন কোন দেশে অস্থিতিশীলতার কারণে যদি ইউরোপীয় হস্তক্ষেপের আশংকা দেখা দেয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র সেদেশের নিয়ন্ত্রণ নিজ হাতে তুলে নেবে।

মনরো ডক্ট্রিনের লেজুড় ধরে ১৮৯৮এ কিউবার স্বাধীনতাকামীদের স্প্যানিশবিরোধী যুদ্ধে মার্কিনরা অংশ নেয়। স্পেনের পরাজয়ের সাথে সাথে যুক্তরাষ্ট্রের এখতিয়ারে এসে পড়ে গুয়াম, ফিলিপাইনস, পোর্তোরিকো, কিউবা। নতুন সুযোগের সন্ধানে কাউবয় মানসিকতার মার্কিন ব্যবসায়ীরা এসব জায়গায় আসতে শুরু করে। স্বাধীনতার বদলে উল্টো নতুন মনিব পায় দেশগুলি।

সারা বিশ্বেই অবশ্য তখন সময়টা বেশ উত্তাল। ব্রিটেন ও জার্মানির মধ্যে নতুন প্রযুক্তির দূরপাল্লার কামান আর ড্রেডনট যুদ্ধজাহাজ নিয়ে আর্মস রেস চলছে। আফ্রিকার উপকূলের স্প্যানিশ আর ফরাসী বন্দরগুলিকে বিপন্ন করে তুলছে জার্মানদের নতুন নৌশক্তি। রুশরা মধ্য এশিয়া জয় করে আফগানিস্তানের সীমান্তে এসে ব্রিটিশ ভারতকে স্নায়ুচাপে রেখেছে। ইউরোপে তুরস্ক আর এশিয়ায় চীন, দুই সিক ম্যান ভেঙে প্রতি বছর নতুন স্বাধীন দেশ তৈরি হচ্ছে, তাদের কেউ সংযুক্ত হচ্ছে নবাগত আঞ্চলিক শক্তিগুলির সাথে।

১৯০২ সালে ঋণখেলাপি ভেনিজুয়েলার বন্দরগুলি অবরোধ করে ব্রিটিশ ও জার্মান জাহাজ। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় সে সমস্যার সমাধান হয়।

যুক্তরাষ্ট্রেরও বসে থাকার কোন অবকাশ ছিল না। ঊনবিংশ শতকে অস্ট্রিয়া-হাঙেরি মেক্সিকোতে এক তাঁবেদার সম্রাট বসিয়েছিল। মার্কিনসমর্থিত স্থানীয়রা তাদেরকে হঠায়। তারপর থেকে মেক্সিকোর আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে প্রায়শই নাক গলাত যুক্তরাষ্ট্র। জার্মানিও দক্ষিণ আমেরিকাতে সাম্রাজ্যবিস্তারের চেষ্টা চালায়। পানামায় খাল করার পরিকল্পনা পৃথিবীর অনেক পরাশক্তিরই ছিল। জার্মানরা সে চিন্তা থেকে ক্যারিবিয়ান ও মধ্য আমেরিকায় ঘাঁটি গাড়তে শুরু করে। তাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণের গোপন পরিকল্পনাও একটা ছিল। পুরো ব্যাপারটা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। জার্মানির সাবমেরিন বেস বানানো ঠেকাতেই মার্কিনরা ডেনিশ ওয়েস্ট ইন্ডিজ কিনে নেয় ডেনমার্কের কাছ থেকে। কলোম্বিয়া থেকে পানামা আলাদা দেশে পরিণত হয় মার্কিন ইন্ধনেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এসব কাজকর্ম দেখেশুনেই মেক্সিকোর তদকালীন রাষ্ট্রপতি পরফিরিও দিয়াজ বলেছিলেন, খোদা থাকেন আকাশ ‘পরে, আর মার্কিন আছে ঘাঁড়ের ‘পরে!

হাইতির অবস্থাও এসময় বেশি ভাল নয়। ১৯১১ থেকে ১৯১৫র মধ্যে এসেছে-গেছে ৭জন প্রেসিডেন্ট। হাইতির বন্দরগুলিতে প্রচুর জার্মান অভিবাসী বণিক। আমদানি-রপ্তানি ব্যবসার আশি ভাগ তাদের হাতে। দেশের সরকার ও এলিট শ্রেণীর ওপর তাদের টাকার বেশ প্রভাব। অন্যদিকে হাইতির ৭০% রপ্তানী বাণিজ্য মার্কিনের সাথে। জার্মান, মার্কিন ও ফরাসী ব্যাংকের কাছেও বিশাল ঋণ হাইতির। বছরে বছরে প্রশাসন পরিবর্তনের কারণে ঋণপরিশোধে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

অস্ট্রিয়া-হাঙেরির সম্রাট ফ্রানৎস ইয়োসেফের ছোট ভাই ম্যাক্সিমিলিয়ান হন মেক্সিকোর প্রথম সম্রাট (১৮৬৪-৬৭)। মার্কিন মনরো ডক্ট্রিনকে ইউরোপীয় পরাশক্তিগুলো শুরুতে তাচ্ছিল্য করত।
মার্কিন রাষ্ট্রপতি টেডি রোজাভেল্টের কার্টুনচিত্র, হাইতিসহ ক্যারিবিয়ান সাগরের দেশগুলি থেকে ঋণ আদায়ের জন্যে মুগুর নিয়ে টহল দিচ্ছেন, ১৯০২ সাল।

১৯১৪ সালে দুই বিবাদমান দলের সশস্ত্র বিরোধের মাঝে মার্কিন মেরিন সেনা পোর্তোপ্র্যাঁসে অবতরণ করে। সবার চোখের সামনে দিয়ে তারা জাতীয় ব্যাংক থেকে প্রায় পাঁচ লাখ ডলারের সোনা নিয়ে চলে যায়। এই ‘লুট’ ছিল অস্থিতিশীলতার মুখে কেবল মার্কিন ব্যাংকের হাইতিস্থিত রাষ্ট্রীয় শাখা থেকে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের শাখায় টাকা বিনিময়! হাইতির মানুষের জন্যে এ ছিল এক অশনিসংকেত।

১৯১৪তে বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্র হাইতিতে জার্মান প্রভাব ও বিপ্লবের আশংকা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে। ১৯১৫তে প্রেসিডেন্ট উলসন বলেন, হাইতিকে ‘ঠিকঠাক’ করার সময় এখনই। এর পরই হাইতির প্রেসিডেন্ট স্যাম ১৬৭জন রাজনৈতিক বন্দীর একতরফা মৃত্যুদন্ডাদেশ দেন। তার প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ জনতা স্যামকে সম্রাট দেসালিনের মত রাজপ্রাসাদ থেকে টেনে বের করে মেরে কেটে টুকরোটুকরো করে ফেলে। আর দেরি না করে ২০০০ মেরিনের একটি দল পাঠিয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। তারা পোর্তোপ্র্যাঁসে নেমে সরকারী ভবনগুলোর দখল নেয়। ধীরে ধীরে তারা ছড়িয়ে পড়ে প্রদেশগুলিতে।

হাইতির ব্যাপারে কড়ানীতির ঘোষণা করেন প্রেসিডেন্ট উইলসন, নিউ ইয়র্ক টাইমসের রিপোর্ট, ১৯১৫

রক্তাক্ত সংঘাত ছাড়াই হাইতির সম্পূর্ণ দখল নিয়ে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। হাইতির মানুষ সম্ভবত অবাক হয়নি। এমনটারই অপেক্ষায় ছিল অনেক শিক্ষিতজন ও ব্যবসায়ী। তাদের আশা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের কিছুদিনের কড়া শাসন হাইতিকে স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরিয়ে আনবে, জার্মান বণিকদের অশুভ প্রভাবও কমে যাবে। হাইতিদখলের তারিখটা ১৯১৫র ২৮শে জুলাই — বিশ্বযুদ্ধ শুরুর ঠিক এক বছর পূর্তির দিন।

দখলদার মার্কিন সেনাপতিদের সাথে সংলাপে বসেন হাইতির রাজনীতিবিদরা। তাদের মধ্যে সবচে বেশি সমর্থন ছিল বোবো বলে এক মার্কিনবৈরী নেতার। তাকে সরাসরি পদাসীন করার পরিবর্তে মার্কিন সেনাপ্রধান সেনেটরদের বললেন সংসদের নিয়মানুযায়ী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবে। বোবোর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মত আরেক রাজনীতিবিদ দার্তিনেগাভকে খুঁজে বের করল মার্কিনরা। সেনেটের ভোটে দার্তিনেগাভই জিতলেন।

হাইতির মার্কিনসমর্থিত প্রেসিডেন্ট দার্তিগেনাভ, মেরিনসেনাপরিবেষ্টিত, ১৯১৬

ধারের অংক কড়ায়গন্ডায় বুঝে নেয়ার লক্ষ্যে হাইতির শুল্ক ও রাজস্বের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ নেয় মেরিনরা। হাইতির সংসদ মার্কিন প্রশাসনকে সাংবিধানিক বৈধতা দেয়। গুরুত্বপূর্ণ সরকারী পদের নিয়োগ অনুমোদন আসতে হত স্বয়ং মার্কিন রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে। সারা দেশে মার্শাল ল’ জারি হয়, খর্ব হয় সাংবাদিকদের স্বাধীনতা। দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসার ওপর অন্যান্য বিদেশী রাষ্ট্রের মালিকানা নিষিদ্ধ করা হয়। এক সংবাদপত্র সম্পাদক যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে উইলসনের সাথে সাক্ষাত করে তাকে বলেন যে হাইতিকে ঠিক করার রাস্তা এটা নয়। কিন্তু কে শোনে কার কথা! মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ ক্ষমতায়নের নতুন নেতা বুকার টি ওয়াশিংটন পর্যন্ত মার্কিনের হাইতিদখল নিয়ে উচ্চাশা প্রকাশ করেন যে, এভাবেই দেশটির কৃষ্ণাঙ্গরা দ্রুত ‘সভ্য’ হয়ে উঠবে।

মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ শিক্ষাবিদ বুকার টি ওয়াশিংটন (১৮৫৬-১৯১৫), হাইতিতে মার্কিন দখলদারিত্ব সমর্থন করে বিবৃতি দেন।

মার্কিন প্রশাসন হাইতির সেনাবাহিনীকে নতুন করে ঢেলে সাজায়। নতুন প্রতিরক্ষাবাহিনীর নাম দেয়া হয় জন্দার্ম। বহু হাইতিয়ান সেনাসদস্য পালিয়ে পাহাড়ী অঞ্চলে গিয়ে গেরিলা সংগ্রাম চালাতে থাকে। এরা অবশ্য খাদ্যসহ অন্যান্য প্রয়োজনে আশপাশের গ্রামগুলোর ওপর লুটতরাজ চালাত। শীঘ্রই এদেরকে ‘ডাকাত’ আখ্যায়িত করে কঠোরভাবে দমন করে মেরিন সৈন্যরা। হাইতির মানুষ বছরের পর বছর বিপ্লব আর গৃহযুদ্ধে ক্লান্ত। মেরিনদের শুরুতে ভালভাবেই গ্রহণ করে নেয় তারা, এমনকি স্বদেশী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সাহায্যও করে অনেক ‘রাজাকার’।

কিন্তু মেরিনসেনাদেরও অত্যাচার শুরু হয়ে যায় এর পর। বিদ্রোহী ‘ডাকাত’ সন্দেহে নির্বিচারে ধরপাকড়, বিচারবহির্ভূত হত্যা, ধর্ষণ, ইত্যাদিতে জড়িয়ে পড়ে তারা। হাইতির মানুষের সংস্কৃতি তারা বুঝত না, তাদের ভুডু আচার আর ক্রেওল ভাষাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখত। বোয়াইয়েরের আমলের কোর্ভে দাসশ্রমের আইনেরও বেপরোয়া ব্যবহার করে মেরিন আর জন্দার্ম। গ্রামের জোয়ানদের লেবার ক্যাম্পে পাঠিয়ে অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ শুরু হয়। এসব শ্রমের বিনিময়ে মজুরি ছিল স্বল্প। দুয়েকটা জায়গায় ক্রীতদাসের মত গলায় দড়ি পরিয়ে এসব শ্রমিকদের কর্মস্থল নেয়া হয়েছিল।

বিদ্রোহী ক্যাকোদের সন্ধানে হাইতির পাহাড়ী এলাকায় অভিযান চালাচ্ছে মার্কিন মেরিন সেনারা, তাদের গাইড হাইতিবাসী কৃষ্ণাঙ্গ ছবির ডানপাশে, ১৯১৯
মার্কিন মেরিন ও হাইতির জন্দার্ম বিদ্রোহী দলগুলিকে পরাজিত করতে সমর্থ হয়, ১৯১৯

অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে হাইতির আধুনিকায়ন শুরু হয় মার্কিন শাসনামলে। হাইতির কোস্ট গার্ড তৈরি হয় মেরিনদের সহায়তায়। চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নতি হয় মার্কিন রেডক্রসের সাহায্যে। কয়েকটি কারিগরি প্রশিক্ষণ কলেজও শুরু হয়, সেসবে পড়াতেন মার্কিন থেকে মোটা বেতনে আনা অধ্যাপকের দল। সব মিলিয়ে হাইতির শহুরে মধ্যবিত্তের একটি মিশ্র অনুভূতি ছিল মার্কিন শাসন নিয়ে। উন্নয়নের ব্যাপারে মার্কিনদের প্রতি সমর্থন থাকলেও প্রদেশ ও গ্রামাঞ্চলের মানুষদের ওপর যে ধরনের জুলুম তারা প্রত্যক্ষ করে, তাতে অতীতে নিজেদের জুলুমেরই প্রতিফলন তারা দেখতে পায়। হীনমন্যতাবোধ থেকে নতুন একটি আত্মপরিচয়ের সূচনা হতে থাকে।

প্রাদেশিক প্রশাসনে সেনাশাসকদের যে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল, সেটা খর্ব করে কেন্দ্রীয় শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। স্থানীয় কর আদায়ের কাজটা এসে পড়ে মেরিনদের হাতে। কিন্তু যে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে প্রদেশে শাসক-শাসিতের সম্পর্ক ছিল আগে, তা পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার যে শক্তিটা ছিল প্রদেশগুলিতে, সেটা বিনষ্ট হয়ে যায়।

মার্কিন মেরিনদের প্রশিক্ষিত হাইতির নতুন প্রতিরক্ষাবাহিনী জন্দার্মের সদস্য, ১৯১৯
হাইতিতে মার্কিন মেরিন সেনাদল বিদ্রোহী কাকোদের বিরুদ্ধে অভিযানে স্থানীয় গাইডদের সহায়তা লাভ করে (ডান পাশে), ১৯১৫

মার্কিন উপদেষ্টাদের সাহায্যে নতুন একটি সংবিধানও প্রবর্তিত হয়। হাইতির সম্পত্তিমালিকানা শুধুমাত্র কালোদের অধিকার, সেই প্রাচীন সাংবিধানিক ধারাটি রহিত করা জন্যে সংসদে প্রস্তাব আনেন দার্তিনেগাভ। এতে সাড়া না পেয়ে তিনি সংসদ স্থগিত করেন। তারপর গণভোটের মাধ্যমে সংবিধানের এই ‘সেকেলে’ নিয়মগুলি পরিবর্তিত হয়। রাষ্ট্রপতি পদের মেয়াদও তুলে নেয়া হয়। সব মিলিয়ে ১৯১৮র সংবিধান হাইতির রাজনীতির চেক-অ্যান্ড-ব্যালান্সকে কয়েক দশক পিছিয়ে দেয়।

একই সময়ে হাইতিতে মার্কিন কম্পানিগুলোর প্রবেশ শুরু হয়। বিশেষ করে আখ-চিনি, আনারস আর অন্যান্য গ্রীষ্মমন্ডলীয় ফলমূলের চাষাবাদ ও রপ্তানির জন্যে জায়গাজমি তারা কিনতে শুরু করে। বিনিয়োগ বাড়ার সাথে সাথে রাস্তাঘাট ও রেললাইনও তৈরি শুরু হয়। কিন্তু এসব প্রকল্পের কারণে অনেক ক্ষুদ্র চাষী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেসব কম্পানিতে চাকরির সুযোগ এদেরকে দেয়া হলেও তারা সে কাজ করতে চাইত না। শ্রমের অভাবে মার্কিন কম্পানিগুলির ব্যবসা ক্রমে পরিত্যক্ত হয়। মার্কিন প্রশাসন চেষ্টা করেও হাইতির অর্থনৈতিক সম্ভাবনাগুলি পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করতে পারেনি। তবে পশ্চিমাঞ্চলে কফি চাষ ও রপ্তানির সুবাদে বেশ প্রবৃদ্ধি আসে।

মার্কিনবিরোধী স্বাধীনতাযোদ্ধা শার্লমেইন পেরল্তের মৃতদেহের ছবি মেরিনরা প্রকাশ করে হাইতির সংবাদপত্রে। তার স্মৃতি থেকেই এ চিত্রকর্ম ‘দ্য ক্রুসিফিকশন অফ শার্লমেইন পেরল্ত ফর ফ্রীডম ১৯৭০’ আঁকেন হাইতির শিল্পী ফিলোমে ওব্যাঁ।
হাইতির অবকাঠামো উন্নয়নের কাজে মেরিনরা গ্রামাঞ্চলের যুবকদের বাধ্যতামূলক কোর্ভে শ্রমে নিযুক্ত করে, ১৯২০

১৯২২ সাল নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ হাইতিতে মেরিনদের কার্যকলাপের ব্যাপারে প্রচুর খবর পেতে থাকে। হাইতিতে কোর্ভে দাসশ্রমের ব্যবহার আর বিদ্রোহীদের কঠোরভাবে দমনের ব্যাপারে মার্কিন সেনেট তদন্ত শুরু করে। এর রেশ ধরে হাইতির মার্কিন প্রশাসনের জবাবদিহিতা বাড়ানো হয়। ততদিনে বিদ্রোহ স্তিমিত হয়ে এসেছে।

কিন্তু যে দেশের মানুষ নিজেদের সরকারকেই বছরে বছরে উচ্ছেদ করে এসেছে, তাদের কতদিন দমিয়ে রাখা সম্ভব! ১৯২৯ সালে মার্কিনদেরই প্রতিষ্ঠিত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বৃত্তি কমানোর প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে পড়ে। তাদের আরো অনেক অভিযোগের মধ্যে ছিল মার্কিন অধ্যাপকদের স্থানীয় ভাষায় পড়ানোর অপারগতা, হাইতির কোষাগার থেকে তাদেরকে প্রদত্ত মোটা বেতন, স্থানীয় শিক্ষকদের নিচু পদ, ইত্যাদি।

মার্কিন রেড ক্রসের ডাক্তার-নার্সদের সহযোগিতায় হাইতির চিকিৎসাব্যবস্থার বেশ উন্নয়ন হয়, ১৯২৫
হাইতিতে মেরিনসেনাদের ক্ষমতার অপব্যবহারের খবর মার্কিন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতে শুরু করলে সেনেট এ ব্যাপারে একটি তদন্ত শুরু করে, নিউ ইয়র্ক টাইমসের রিপোর্ট, ১৯২১

একটি সমাবেশে গুলিবর্ষণে এক ছাত্রের মৃত্যু হলে সারা হাইতিতে জনবিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও মার্কিনদের নিন্দা শুরু হয়ে যায়। ১৯৩০ সংবিধানের বর্ধিত ভোটাধিকারে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ভ্যাঁসঁর বৈরী মনোভাব যুক্ত হয় তার সাথে। সমাজের সর্বস্তরে এরকম বিরোধের মুখে থেকে মার্কিনরা হাইতি ছাড়ার পাঁচ বছরের সময়সীমা নির্ধারণ করে। সে মেয়াদ উত্তীর্ণ হবার আগেই নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ১৯৩৪এ কেটে পড়ে মেরিনরা। তবে মার্কিন অর্থনৈতিক উপদেষ্টা থেকে যায় ১৯৪১ পর্যন্ত। ১৯৪৭এ সকল ঋণ পরিশোধিত না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণও মার্কিনদের হাতে থাকে।

১৯২৯ সালে ছাত্রবিক্ষোভের মুখে হাইতি ছাড়ার পরিকল্পনা ঘোষণা করে মার্কিন প্রশাসন

মার্কিন দখলে থাকা অন্যান্য দেশে মার্কিন সংস্কৃতি জনপ্রিয়তা পেলেও হাইতিতে সেরকমটা হয়নি। এর মূল কারণ হাইতিবাসীর আদিম সন্দেহপ্রবণ স্বভাব। যেমন, পোর্তোরিকো, কিউবা ইত্যাদি জায়গায় মার্কিন খেলা বেসবল এখনও জনপ্রিয়, কিন্তু হাইতিতে নয়। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ সঙ্গীত-বাদ্যের প্রভাব পড়ে অবশ্য। প্রথমদিকের গানবাজনায় মার্কিনদের প্রশংসা ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে যায় প্রতিবাদসঙ্গীতে। ভুডুচর্চার স্বাধীনতা না থাকায় প্রচুর হাইতিবাসী প্রতিবেশী দেশগুলিতে পাড়ি জমায়।

মার্কিনদের ওপরও হাইতির কম প্রভাব পড়েনি। ত্রিশের দশকের হলিউডি হরর ফিল্মে মামি, ড্রাকুলার পাশাপাশি জোম্বি বা অর্ধমৃত গোলামের যে ক্যারেক্টার বেশ জনপ্রিয় হয়, সেটা আসলে হাইতিরই রপ্তানি! ভুডু ম্যাজিকে মন্ত্র পড়ে সাইকেডেলিক গুণসম্পন্ন গাছের শেকড়-বাকর খাইয়ে শত্রুকে আজ্ঞাবহ দাসে পরিণত করার একটা মিথ প্রচলিত ছিল। এর ক্রেওল নাম জোনবি — জোম্বি নামটা সেখান থেকেই। হাইতিদখলের ইতিহাস মার্কিনরা ভুলে গেছে, কিন্তু এখনো রয়ে গেছে জোম্বি।

হাইতির ভুডু চর্চা সম্পর্কে মার্কিন জনসাধারণ এ সময় অবহিত হতে শুরু করে, তার প্রভাব পড়ে হলিউডি ছবিতেও। প্রথম জোম্বি মুভি ১৯৩২ সালের হোয়াইট জোম্বির দৃশ্য।

দখলদারিত্বের দুই দশকে হাইতির শিক্ষিত সমাজে ব্যাপক সোল-সার্চিং চলে। মার্কিন আমলে বৈদেশিক বাণিজ্য আর বিনিয়োগের পুরোদস্তুর স্বাদ পেয়েছে দেশের বিশাল একটা জনগোষ্ঠী। পেছন ফেরার কোন সম্ভাবনা আর নেই। স্বাধীনতাপরবর্তী রাষ্ট্রনেতারা সেকারণে মার্কিনদের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলেন।

দ্বিতীয় এ স্বাধীনতার তাৎপর্য কি হতে পারে সে নিয়ে কোন একক ধ্যানধারণা অবশ্য হাইতিবাসীর গড়ে ওঠেনি। তারা না পারে মার্কিন ধ্যানধারণা নিয়ে সামনে পা বাড়াতে, না পারে তাদের আগের অবস্থায় ফিরে যেতে। বলতে পারি, মার্কিনরা হাইতি ছেড়ে যাবার পর দেশটির মানুষদের অবস্থা দাঁড়ায় জোম্বির মত। নতুন আরম্ভ কিভাবে হবে সে প্রশ্নের জবাব সন্ধান করতে করতেই তারা তলিয়ে যেতে শুরু করে আরেক অতল গহ্বরে।

লাইবেরিয়া – ৫, গৃহযুদ্ধ, ১৯৩০-

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত লাইবেরিয়ার ইতিহাসকে দু’ভাগে ভাগ করতে পারি। ১৯৮০ পর্যন্ত প্রথমভাগে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসে মার্কিন ও ডাচ বিনিয়োগের ফলে। ফায়ারস্টোন টায়ারের রাবারশিল্প, ডাচ ও রাষ্ট্রায়ত্ত সোনা ও লৌহআকরিক উত্তোলনশিল্প, আর মার্কিনদের তৈরি গভীর সমুদ্রবন্দর ও বিমানবন্দরের সুবাদে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি আসে লাইবেরিয়াতে। সরকারী পয়সায় পশ্চিম আফ্রিকার তথাকথিত ‘সুইজারল্যান্ডের’ প্রচুর যুবক উচ্চশিক্ষার্থে মার্কিনে পাড়ি জমায়।

প্রেসিডেন্ট টাবম্যান ১৯৪৪ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত দেশশাসন করেন। টাবম্যান চাটুকারপরিবেষ্টিত থাকতে পছন্দ করতেন। তার আমলে যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়, সবের কৃতিত্ব নিজে দাবি করতেন। মতবিরোধীদের যৎসামান্য কৃতজ্ঞতাবোধও নেই, একথা বলে বেড়াতেন সবার কাছে। তার জন্মদিন পরিণত হয় রাষ্ট্রীয় ছুটির দিনে। আমেরিকো সেটলার ঐতিহ্যের প্রতীকগুলির ‘পূজো’ তো চলতই।

লাইবেরিয়ার ঊনিশতম প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম টাবম্যান (১৮৯৫-১৯৭১)। রাষ্ট্রপতি ছিলেন ১৯৪৪ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত।
ডাচ রাজপরিবারের সাথে প্রেসিডেন্ট টাবম্যান, ১৯৫৫।

মার্কিন সিভিল রাইটস আন্দোলনের জোয়ারে অবশ্য টাবম্যান ১৯৬৪তে ‘ইউনিফিকেশন অ্যাক্ট’ স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন। ফলে দেশের যে ৯৮ শতাংশ মানুষ এতদিন ভোটাধিকারবঞ্চিত ছিল, তারা সে অধিকার পায়। ইতিহাসের কী নির্মম পরিহাস, যে দেশ ছেড়ে আমেরিকোদের লাইবেরিয়ায় আসা মুক্তির সন্ধানে, সেদেশের উদাহরণ অনুসরণ করেই সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিত করতে হয়, স্বাধীনতার একশ’ কুড়ি বছর পর!

১৯৭১এ টাবম্যানের মৃত্যুর পর তার উপরাষ্ট্রপতি টলবার্ট হন প্রেসিডেন্ট। এসময় ভিন্নমুখী পরিবর্তন আসতে শুরু করে লাইবেরিয়াতে। মার্কিনফেরত ছাত্ররা লাইবেরিয়ায় ফিরে চাকরি পেতে বেশ বেগ পায়। কারণ ততদিনে ইকনমির বুম শেষ হয়ে বাস্টের দিকে চলছে। এসকল ছাত্রদের অনেকেই মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে বামপন্থী রাজনীতিতে দীক্ষিত হয়।

তাছাড়া আফ্রিকার অন্যান্য অনেক দেশও তখন ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্তি পাচ্ছে। প্রতিবেশী দেশ ঘানার নেতা কওয়ামে ন্ক্রুমা সোভিয়েত সমর্থিত ছিলেন, স্বদেশে তিনি সমাজতন্ত্র আর বিদেশে প্যান-আফ্রিকানিজমের জজবা তোলেন। লাইবেরিয়ার যুবসমাজ সমাজতন্ত্র আসলে কতটুকু বুঝত, তা প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু দেশের বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্যে মার্কসবাদের বাণীতেই তারা থিওরিটিকাল সমাধান খুঁজে ফেরে।

ষাটের দশকে লগিং ছিল লাইবেরিয়ার বিদেশী বিনিয়োগের অন্যতম শিল্প।
লৌহআকরিক উত্তোলনে লাইবেরিয়া ষাটের দশকে ছিল অগ্রগণ্য একটি দেশ।
সত্তরের দশকে আখমাড়াই করে চিনি প্রস্তুত ও রপ্তানি হত লাইবেরিয়া থেকে।

দু’টি ‘প্রগতিশীল’ সংগঠন গড়ে ওঠে রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্যে। সত্তরের দশকের শেষে চালের দামবৃদ্ধির প্রতিবাদ করতে গিয়ে এদের একটির সমর্থকরা মনরোভিয়াতে ব্যাপক লুটতরাজ চালায়। তাদের প্রতিবাদ মিছিলে গুলিবর্ষণ করলে সত্তরজনের মত মারা যায়।

পুরো দেশে থমথমে একটা অবস্থা বিরাজ করছিল। টলবার্ট ভেবেছিলেন একটা বামপন্থী বিপ্লব হবে আর তার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। যেটা হল, তা বোধহয় কারো আন্দাজে ছিল না। বামপন্থী সংগঠনগুলি স্বজাতির মজলুমদের কথা বললেও গ্রামাঞ্চলে তাদের তেমন কোন প্রভাব ছিল না। শহরকেন্দ্রিক রাজনীতির অঙ্গন থেকে তারা একটা পরাবাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গোত্রীয় উপজাতিগুলিকে বিচার করত। আর লাইবেরিয়ান আর্মির অর্ধশিক্ষিত উপজাতীয় পেটি অফিসার, জওয়ান এদেরকে দীক্ষিত করত প্রগতিশীল চেতনায়। এসকল সেনাসদস্য বেশির ভাগই ছিল ক্রান গোত্রের।

বিদেশী অর্থায়নে মনরোভিয়া আধুনিক রাজধানীতে পরিণত হলেও ১৯৬৯এ এটি ছিল বিশ্বের সবচে কম জনবহুল রাজধানী।
লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট টলবার্ট (বামে) জাইর বা বর্তমান ডিআর কংগোর একনায়ক প্রেসিডেন্ট মবুতুর সাথে। এদের মাথায় সিভিল রাইটস আন্দোলনের প্রতীকী টুপি।
১৯৭৩এর মনরোভিয়া।

এই সেনাবাহিনীর একটা দল ১৯৮০র এপ্রিলে দেশের ক্রান্তিলগ্নে রক্তাক্ত একটি ক্যুদেতা করে বসে। প্রেসিডেন্ট টলবার্টকে তার প্রাসাদে হত্যা করা হয়। জনসমক্ষে তার ক্যাবিনেটের তেরজন সদস্যকে মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা করে ফেলে সেনাসদস্যরা। সেটা দেখে স্থানীয় জনগণ আনন্দ-উল্লাস করে। স্যামুয়েল ডো বলে এক মাস্টার সার্জ্যান্ট হয়ে বসেন দেশের রাষ্ট্রপতি। তিনি হন স্থানীয় উপজাতীয় গোত্রগুলো থেকে নিযুক্ত প্রথম রাষ্ট্রপতি।

সংবিধান রহিত করে সামরিক শাসন জারি করেন ডো। বামপন্থী দলগুলির একটিকে নিজের আজ্ঞাবহ রাজনৈতিক দলে পরিণত করলেও আসলে তিনি ছিলেন মার্কিন আর সিআইএর সাথে বেশি ঘনিষ্ঠ। ক্রান উপজাতীয়রা এসময় তার পৃষ্ঠপোষকতায় সরকারী চাকরি থেকে শুরু করে সব জায়গায় অগ্রাধিকার পায়। একটি বিফল ক্যু সংঘটিত হয় তার বিরুদ্ধে। ১৯৮৫তে কারচুপির নির্বাচন করে ডো রাষ্ট্রপতির আসনে পাকাপোক্তভাবে বসেন।

লাইবেরিয়াতে ১৯৭৯ সালে চালের দাম নিয়ে রায়টে সত্তরের মত মানুষ পুলিশের গুলিতে মারা যায়।
১৯৮০তে ক্ষমতার দখল করে ক্রান উপজাতীয় সেনানায়ক স্যামুয়েল ডো
যুক্তরাষ্ট্রের পেন্টাগনের সামনে লাইবেরিয়ার রাষ্ট্রপতি ডো

এরও ফল যা হবার হলো। ১৯৮৯ সালে চার্লস টেইলর বলে আরেক ওয়ারলর্ড অন্যান্য উপজাতির সহায়তায় আইভরি কোস্ট থেকে বিদ্রোহীবাহিনী নিয়ে লাইবেরিয়াতে ঢোকেন। পুরো দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। টেইলর ডো’র সরকারকে হঠাতে সক্ষম হন। ডো’র ভাগ্যও হয় তার পূর্বসূরীর মত। তার নগ্ন মৃতদেহ প্রদর্শিত হয় জনপথে।

টেইলর হয়ে বসেন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু যে ‘ক্যান অফ ওয়ার্মস’ একবার খোলা হয়ে গেছে, তা আর বন্ধ করার উপায় নেই। টেইলরের বিরুদ্ধেও দু’তিনটি ভিন্নগোত্রীয় উপজাতি যুদ্ধ শুরু করে। ১৯৯৭ পর্যন্ত ত্রিমুখী প্রথম যুদ্ধটি চলার পর আবার ১৯৯৯এ শুরু হয় দ্বিতীয় গৃহযুদ্ধ। ২০০৩এ চার্লস টেইলর নাইজেরিয়ায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। তারপর জাতিসংঘের পীসকিপিং মিশনের মাধ্যমে দেশটিতে শান্তি আসে। সেটা এখনো চলছে।

মনরোভিয়া, ২০০৯
চার্লস টেইলর, আইসিসির ট্রিব্যুনালে বিচারকালে, ২০০৯
২০১৮ সাল পর্যন্ত লাইবেরিয়ার রাষ্ট্রপতি ছিলেন নোবেল শান্তিজয়ী এলেন জনসন সারলীফ

চৌদ্দ বছরের গৃহযুদ্ধের শুরুতেই যারা দেশটি ছেড়ে প্রথমে ভাগে, তারা হলো আমেরিকো পরিবারগুলি। দেড়শ বছর ধরে নানাভাবে যে দেশটিকে তারা শাসন করে এসেছে, তার থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে যেখানে আশ্রয় নেয় তারা, সে তাদের ক্রীতদাস পূর্বপুরুষদের মনিবের ভিটা আমেরিকা! ঈস্ট কোস্টের যেসব প্ল্যান্টেশন থেকে তাদের বাপদাদাদের মুক্তি ও লাইবেরিয়া যাত্রা, ভাগ্যচক্রে সেখানেই তারা ফিরে যায় দেড়শ বছর পর।

আর আমেরিকোরা পেছনে ফেলে রেখে যায় অন্ধকারে নিমজ্জমান একটি দেশ। ষোলটি যুধ্যমান উপজাতি, পনের হাজার শিশুসৈন্য, আড়াই থেকে নয় লাখ মৃত, ষাট থেকে নব্বই শতাংশ নারী জনসংখ্যা ধর্ষিত — এসব পরিসংখ্যান দিয়ে ঢাকা পড়ে যায় আমেরিকো ক্রীতদাসবংশধরদের অত্যাচারের কাহিনী, স্বজাতিকে অধিকারবঞ্চিত করার ইতিহাস, আর গণতান্ত্রিক প্রথার আড়ালে-আবডালে ক্ষমতালিপ্সা আর দুর্নীতির খেলা।

তাদের এই অধঃপতনের পেছনে কোন পশ্চিমা সরকার, কোন ঔপনিবেশিক শক্তির তেমন কোন হাত ছিল না। পুরো দেড়শ বছর ধরে মু্ক্ত দাসের বংশধররাই স্বাধীন দেশে নিজেদের পতন ডেকে এনেছে একটু একটু করে।

লাইবেরিয়া – ৩, স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রগঠন, ১৮৪০-১৮৬০

১৮৪৭ সালে আমেরিকো-লাইবেরিয়ানদের একাধিক উপকূলীয় কলোনি একত্রিত হয়ে সংবিধান প্রনয়ণের মাধ্যমে লাইবেরিয়া প্রজাতন্ত্রের স্বাধীনতা ঘোষণা করে।

এই ঘোষণার পেছনে এসিএস থেকে স্বাধীনতালাভের আদর্শগত অনুপ্রেরণা যতটা না ছিল, তার থেকে বেশি ছিল প্রয়োজন। কারণ, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত রাষ্ট্র না হওয়া পর্যন্ত লাইবেরিয়া তার বন্দর ও সাগরসীমায় বাণিজ্যজাহাজ থেকে শুল্ক আদায়ের চেষ্টা যদি চালায়, আন্তর্জাতিক আইনে তা হবে জলদস্যুতার শামিল!

এভাবে প্রয়োজনের তাগিদে চার রকমের মার্কিনবংশোদ্ভূত কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়ে লাইবেরিয়ার যাত্রা শুরু হয়: যাদের জন্ম মুক্তমানুষ হিসাবে, যারা নিজেদের স্বাধীনতা টাকার বিনিময়ে ফিরে পেয়েছে, যারা লাইবেরিয়াযাত্রার জন্যে মুক্তিপ্রাপ্ত, আর যারা ‘রিক্যাপচারড স্লেভ’ (২য় খন্ড দ্রষ্টব্য)।

১৮৫৭ সালে লাইবেরিয়ার সাথে সংযুক্ত হয় মেরিল্যান্ড রিপাবলিক নামে দক্ষিণের আরেক আমেরিকোঅধ্যুষিত কলোনি। বহির্শক্তির কোন হস্তক্ষেপ আর সাহায্য ছাড়াই একটা প্রশাসনিক কাঠামো দাঁড়া হয়ে যায়। প্রথম রাষ্ট্রপতি রবার্টস দক্ষতার সাথে ইউরোপীয় দেশগুলির সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। রাজনৈতিক জটিলতার কারণে মার্কিনদের স্বীকৃতি আসতে আরো দেরি হয়।

লাইবেরিয়ার প্রথম রাষ্ট্রপতি জে জে রবার্টস, ১৮০৯-১৮৭৬। জন্ম ভার্জিনিয়ার নরফোকে।
লাইবেরিয়ার একটি আমেরিকো প্ল্যান্টেশন। আমেরিকার সাদার্ন স্টাইলে তৈরি। বিশাল খামারের মাঝখানে গেরস্তের বড় বাড়ি। বহু দাস, চাকর, শ্রমিক, এক্সটেন্ডেড ফ্যামিলি, ইত্যাদি।

নিয়মমত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে থাকে, যদিও পার্টি ছিল মোটে একটি, ঠিক যুক্তরাষ্ট্রের শুরুর মত। পরে দ্বিতীয় আরেকটি পার্টিও তৈরি হয়, তাদের নাম ট্রু হুইগ। শত বছরের বেশি সময় লাইবেরিয়ার রাজনীতির ওপর কর্তৃত্ব করে আমেরিকো কৃষ্ণাঙ্গদের এই পার্টি। বড় পদে আসীন ব্যক্তিরা অবশ্য গুটিকয় প্রভাবশালী পরিবারের সদস্য ছিল। এসকল পরিবার ছিল নিজেদের মধ্যে নানারকম আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ। এভাবে একটা শাসকশ্রেণী গড়ে ওঠে। এদের অনেকে ছিল ফ্রিমেসন।

লাইবেরিয়ার শাসনতন্ত্রে উল্লেখিত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বাধিকার আর আইনের শাসনের অঙ্গীকার মার্কিন ধাঁচে হলেও একটা ব্যাপারে বিশাল ফারাক ছিল। মার্কিনদেশের প্রতিষ্ঠাতারা যেখানে সাবধানতার সাথে ধর্মকে রাজনীতি থেকে পৃথক করে রাখেন, সেটা লাইবেরিয়ার রাজ্যপালরা করেননি। দাসত্বজীবনে যীশুখ্রীষ্টের বাণী তাদেরকে আশার আলো দেখিয়েছে। স্বভাবতই খ্রীষ্টান ঈশ্বর আর ধর্মের দয়াশীল চেহারা লাইবেরিয়ার শাসনতন্ত্রের পাতায় পাতায়।

লাইবেরিয়ার মনরোভিয়া গ্র্যান্ড মেসনিক লজ। প্রতিষ্ঠা ১৮৬৭ সালে। লাইবেরিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় পরিণত হয় রেফ্যুজি ক্যাম্পে।

সেই খ্রীষ্টান ঈশ্বরের অনুপ্রেরণা থেকেই আমেরিকোরা স্থানীয় কৃষ্ণাঙ্গ গোত্রগুলিকে সভ্য বানানোর অভিযানে নামে। দুর্গম এলাকায় মিশনারী স্কুল আর চার্চ তৈরি হয়। কোন জায়গায় বৈরিতার মুখোমুখি হয় এরা, আবার কোথাও দুর্বল গোত্রের রাজারা আমেরিকোদের প্রতিরক্ষা আশ্বাসের বিনিময়ে তাদের সন্তানাদিকে স্কুলে-চার্চে পাঠাতে শুরু করে।

শীঘ্রই ব্যাপারটা অন্যদিকে মোড় নিতে শুরু করে। সামন্তযুগের রীতি অনুযায়ী গোত্রপতিরা তাদের একটি সম্তানকে আমেরিকো কোন পরিবারের কাছে ‘বন্ধক’ রাখে, বা দত্তক দেয়। একে বলে ওয়ার্ড সিস্টেম। ভারতীয় উপমহাদেশে, ইউরোপে, ইন ফ্যাক্ট মধ্যযুগের যেকোন সভ্যদেশে এ রীতি প্রচলিত ছিল। পশ্চিম আফ্রিকার সভ্য জাতিগুলিও এর ব্যতিক্রম ছিল না।

এছাড়া গৃহপালিত চাকরের ব্যাপারটাও পশ্চিম আফ্রিকার সমাজে একেবারে বোনা, আমাদের দেশের মত। ধারদেনা শোধের জন্যে নিজ গোত্রের গরীব-গুর্বোদেরও গোত্রপতিরা আমেরিকো পরিবারগুলোর কাছে পাঠাতে শুরু করে। এসকল সারভ্যান্ট আর ওয়ার্ডদেরকে নিজেদের পরিবারের অংশ করে নেয় আমেরিকোরা। কোন ক্ষেত্রে গোত্রপতিরা আমেরিকোদের দাবি অনুযায়ী কোর্ভে লেবার অর্থাৎ বাধ্যতামূলক শ্রমিকের দলও পাঠায়।

এ শ্রমের অবশ্য ভীষণ দরকার ছিল আমেরিকোদের। আমেরিকোদের যে জনসংখ্যা, তাতে খেতখামারে একলা কাজ করে বেশি উৎপাদন সম্ভব নয়। ১৮৬২তে সিভিল ওয়ারের শুরুতে লিংকন লাইবেরিয়াকে স্বীকৃতি দিয়ে দেন। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে মুক্ত কালোদের অভিবাসন একেবারে শূন্যে গিয়ে ঠেকে। যুদ্ধের কারণে তো বটেই, এছাড়া খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই তখন কালোদের স্বাধিকারের রাস্তা তৈরি হচ্ছে। মার্কিন অভিবাসীদের অভাব পূরণ করে স্থানীয় কালো শ্রমিক আর ক্যারিবিয়ান থেকে আসা নতুন অভিবাসীরা।

কফি, তামাক, ধান, চিনি, তুলো, পামওয়েল ইত্যাদির প্ল্যান্টেশন গড়ে ওঠে আমেরিকান সাউথের ধাঁচে। পাম ওয়েল প্রেসের যন্ত্রও আবিষ্কার করেন লাইবেরিয়ার এক উদ্ভাবক। এসব কাঁচামাল ও শস্য রপ্তানির পাশাপাশি জাহাজশিল্প গড়ে ওঠে। এখনো ছোটদেশ লাইবেরিয়া সারা বিশ্বে জাহাজের ফ্ল্যাগ অফ কনভেনিয়েন্স ও রেজিস্ট্রেশনে অগ্রগণ্য একটি নাম।

লাইবেরিয়ার পতাকা এখনো সারা বিশ্বে জাহাজের ফ্ল্যাগ অফ কনভেনিয়েন্স হিসাবে সুপরিচিত।

এসব উন্নয়নের বিপরীতে স্থানীয় কালোরা আমেরিকোদেরই ক্রীতদাসে পরিণত হতে শুরু করে! দু’একটা অপ্রীতিকর ঘটনার পর সরকার আইন করে সেসব বন্ধ করার চেষ্টা করে। আইনানুযায়ী ঘরে ও খামারে কাজ করা কালোদের জামাকাপড় আর শিক্ষার ব্যাপারটা আমেরিকো গেরস্তকে দেখভাল করতে হবে। নাহলে বড় জরিমানা। আদতে যেটা দাঁড়াল, তা হলো আমাদের দেশের চাকরদের মত সামান্য খাদ্যবস্ত্র আর ধর্মশিক্ষা দিয়ে সোশাল সেগ্রেগেশন।

লাইবেরিয়া পরিদর্শনে আসা মার্কিন দূত যারা অ্যাবোলিশনিস্ট মুভমেন্টের সাথে জড়িত ছিলেন, তারা তাদের রিপোর্টে লাইবেরিয়ার এ শ্রমব্যবস্থাকে সরাসরি ‘স্লেভারি’ হিসাবে বর্ণনা করেন। আমেরিকোরা তাচ্ছিল্য করে স্থানীয় কালোদের ডাকত ‘বয়’ বলে, ঠিক যেমনটা সাদার্ন স্টেটগুলিতে তাদেরকে ডাকত শ্বেতাঙ্গরা! আর দেশের অভ্যন্তরের গোত্রগুলোর নাম তারা দেয় ‘অ্যাবোরিজিনি’! অ্যাবোরিজিনিদের যারা তাদের খামারে থাকত, তাদের প্রত্যেককে মাতৃভাষার নাম ছেড়ে গ্রহণ করতে হত পালক পরিবারের নাম। এটিও ঠিক মার্কিন দেশে গোলাম-মনিবের সম্পর্কের মত!

লাইবেরিয়ার গেরস্ত পরিবারের সাথে তাদের ‘ওয়ার্ড’ বা গৃহপালিত দাস, ঊনবিংশ শতকের শেষভাগ। দাসেদের বস্ত্র তুলনামূলক কম, কিন্তু মনিবরা ঠিকই ক্রান্তীয় এলাকার গরমের মধ্যেও মার্কিন ঘরানায় আচ্ছাদিত।

সব মিলিয়ে নতুন দেশ লাইবেরিয়া মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গদের মুক্তির স্বপ্নপূরণ করলেও এর মূল্য দিতে হয় তাদেরই স্বগোত্রীয়দের — হয় তাদের দাসের মত নিজেকে বিকিয়ে দিতে হয় নয়ত স্বকীয় পরিচয় পরিত্যাগ করে হতে হয় সভ্য ‘আমেরিকো’।

লাইবেরিয়া – ১, শুরুর কথা, ১৮০০-১৮২০

জালিম ও মজলুমের কোন গাত্রবর্ণ নাই, জাতপাত নাই। মানুষ এমন একটা প্রাণী যে সামাজিক ঠিকই, কিন্তু কেবলমাত্র প্রাকৃতিক কিংবা কৃত্রিমভাবে তৈরি নিজস্ব আইডেন্টিটি গ্রুপের মধ্যে। পারিপার্শ্বিকতা ও প্রয়োজন তৈরি করে দেয় তার এই পরিচয়।
আফ্রিকার মানচিত্রে লাইবেরিয়ার স্থান
লাইবেরিয়ার পতাকার অনুপ্রেরণা মার্কিন পতাকা
এ কথাগুলি মনে এল লাইবেরিয়া দেশটির কথা চিন্তা করে। ছোট করে শুরুতে বলি, ঊনবিংশ শতকে মার্কিন থেকে আগত মুক্তিপ্রাপ্ত কৃষ্ণাঙ্গ প্রাক্তন দাস ও দাসদের বংশধরদের আবাসস্থল হিসাবে দেশটির যাত্রা শুরু। তাদের শাসনতন্ত্র প্রায় হুবহু মার্কিন শাসনতন্ত্রের ভিত্তিতে লেখা, তিনটি প্রশাসনিক বিভাগ, মতপ্রকাশের-ধর্মপালনের স্বাধীনতা, ইত্যাদি।

আর গোড়াপত্তনের দেড়শ বছরের মাথায় লাইবেরিয়াতে হয়ে যায় দু’-দু’টি গৃহযুদ্ধ। ষোলটি জাতিগোষ্ঠী চিন্তাতীত নির্মমতার সাথে একে-অপরের ওপর চড়াও হয়। লাইবেরিয়ার যুদ্ধের খবর ঘাঁটালেই হত্যা-ধর্ষণের পাশাপাশি চোখে পড়বে চাইল্ড সোলজার, ব্লাড ডায়মন্ড, ইত্যাদি হেডলাইন। ১৯৮৯ থেকে শুরু করে ২০০৩ পর্যন্ত বিরতি দিয়ে দিয়ে গৃহযুদ্ধ হয়, আর তাতে প্রাণ হারায় নয় লাখেরও বেশি মানুষ। ২০০৩এ বেশ কিছু বাংলাদেশী সেনাসদস্যও সেদেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে যোগ দেয়, সেটা ছিল এযাবত জাতিসংঘের সর্ববৃহৎ শান্তিরক্ষা মিশন। মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রিপ্রাপ্ত চার্লস টেইলর নামক এক লাইবেরিয়ান ওয়ারলর্ড ও প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি হন হেগের আন্তর্জাতিক কোর্টে বিচারপ্রাপ্ত প্রথম কোন প্রাক্তন রাষ্ট্রনেতা।

কেন কিভাবে এ অধঃপতন তার কাহিনীই লিখতে বসেছি।

লাইবেরিয়ার স্বাধীনতাঘোষণার প্রাক্কালে কনস্টিটিউশনাল কনভেনশনে স্পষ্টভাবে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকদের আসল পরিচয় যে মার্কিন, তা উল্লেখ করা হয় (১৮৪৭)।
লাইবেরিয়ান গৃহযুদ্ধের চাইল্ড সোলজার
লাইবেরিয়ান গৃহযুদ্ধের চাইল্ড সোলজার

লাইবেরিয়া কনসেপ্টটার যাত্রাশুরু ১৮১০এর দশকে। ইংরেজ ও মার্কিনরা আন্তর্জাতিক দাসবাণিজ্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ১৮০৭ সালে। যেসকল কৃষ্ণাঙ্গ ইতিমধ্যে দক্ষিণের স্টেটগুলিতে ক্রীতদাস, তাদের মুক্তি আসে আরো পরে। কিন্তু উত্তরে তখন যথেষ্ট মুক্তিপ্রাপ্ত ও শিক্ষিত কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের বসবাস। সেসময় মিসৌরী নদী থেকে আটলান্টিক পর্যন্ত যে প্রায় ৯.৬ মিলিয়ন জনসংখ্যা, তাদের প্রায় ১.৭৫ মিলিয়ন কৃষ্ণাঙ্গ, আর এদের প্রায় ২৩০,০০০, অর্থাৎ ১৩ শতাংশ, মুক্ত মানুষ। এদের অনেকে ‘মুলাটো’ বা মিশ্রজাত। কারো বাবা কৃষ্ণাঙ্গ দাস, তো মা শ্বেতাঙ্গ আইরিশ ইনডেঞ্চারড সারভ্যান্ট — যার স্টেটাস ক্রীতদাসের থেকে এমন একটা উঁচুতে নয়। ১৮০০ শতকের শুরুতে মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গরা ছিল আমেরিকার ফাস্টেস্ট গ্রোয়িং ডেমোগ্রাফি।

মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গদের অনেকে ব্যবসাবাণিজ্যে সাফল্য পায়। এদের অনেকেই ছিল শিক্ষিত, কর্মঠ, অন্টরপ্রনরশিপে বিশ্বাসী, এমনকি অ্যাডাম স্মিথপড়া পুঁজিবাদী লোক। পল কাফি বলে এদের একজন, কৃষ্ণাঙ্গ তিমিশিকারী বণিক তিনি, ঠিক করেন যে কৃষ্ণাঙ্গদের আফ্রিকায় পুনর্বাসিত হওয়াটাই সমীচীন। সে লক্ষ্যে একটি জাহাজে করে প্রায় আশিজন মুক্তমানুষ পরিবারসহ আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে পশ্চিম আফ্রিকার সিয়েরা লিওনে এসে হাজির হয়। সিয়েরা লিওন ছিল ব্রিটিশ কলোনি, এবং ব্রিটিশরা এর গোড়াপত্তনই করে ব্রিটেনের মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গদের স্বেচ্ছাপুনর্বাসনের স্থান হিসাবে।

পল কাফি, ১৭৫৯-১৮১৭
নিউ ইয়র্কের কলোনাইজেশন সোসাইটির মেম্বারশিপ সার্টিফিকেট, ১৮৩৭

কাফির চিন্তাটা অবশ্য নতুন নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফাউন্ডিং ফাদাররাও ভেবেছিলেন, মালিকদের মৃত্যুর পর যেসকল ক্রীতদাস মুক্তি পাচ্ছে, কিংবা নিজেদের উপার্জনের মাধ্যমে স্বাধীনতা কিনে নিচ্ছে, তাদের স্বদেশে ফিরিয়ে দেয়াটাই উত্তম। আমেরিকায় যদি তারা থেকে যায়, তাহলে শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ দু’জাতের মধ্যে অত্যাচার ও অপব্যবহারের যে সম্পর্কের শত বছরের ইতিহাস, সেটা ফিরে ফিরে এসে রাষ্ট্রীয় সমস্যা তৈরি করবে। তাছাড়াও মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকাংশ সহায়-সম্বলহীন হওয়ার কারণে ভবিষ্যতে যে তারা আবার ক্রীতদাসে পরিণত হবে না, তারও গ্যারান্টি নেই।

জেফারসন-মনরো প্রমুখ গোপনে এ ব্যাপারে কথাবার্তা চালান, তাদের ইচ্ছে ছিল কৃষ্ণাঙ্গদের জন্যে কলোনিস্থাপনের। সেটা আমেরিকার নতুন ওহাইয়ো টেরিটরিতেও হতে পারে, কিংবা লাতিন আমেরিকা নতুবা আফ্রিকাতেও। এমনকি লিংকনও মধ্য আমেরিকা কিংবা হাইতিতে কৃষ্ণাঙ্গপুনর্বাসনের চিন্তা করেন। কিন্তু তাদের এসকল আইডিয়া নিয়ে বেশিদূর না আগানোর কারণ, ঐ ‘কলোনি’ শব্দটা! মার্কিনরা হবে কিনা তাদের প্রাক্তন মালিক ব্রিটেনের মত সাম্রাজ্যবাদী! এ ব্যাপারটা সে আমলে কারোরই মনঃপূত হয়নি।

এ অবস্থার একটা সুরাহা হয় আমেরিকান কলোনাইজেশন সোসাইটি (এসিএস) নামে একটি দাতব্য সংস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। সাদার্ন স্টেটগুলির কিছু নামীদামী ধর্মপরায়ণ ব্যক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় এটি শুরু হয়। এদের কারো কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি সত্যিকার সহানুভূতি, আবার কারো কারো জাতিগত মিশ্রণ নিয়ে অ্যালার্জি থাকায় তারা চান কৃষ্ণাঙ্গরা ‘ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাক!’

যে উদ্দেশ্যেই এসিএসের যাত্রা শুরু হোক না কেন, বেশ কিছু মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গ আইডিয়াটা গ্রহণ করে নেয়।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!