হাইতি – ৪, দখলদার মার্কিন, ১৯১৫-৩৪

বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ হাইতির একটি কালো অধ্যায় শুধু নয়, ঔপনিবেশিকতাবিরোধী আদর্শের ধ্বজাধারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্যেও একটা লজ্জাজনক সময়।

এ সময়ে হাইতির উত্তরের ‘দানব’ যুক্তরাষ্ট্র পরাশক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করছে। ইউরোপীয় শক্তিগুলো ক্রমশঃ আমেরিকা মহাদেশ থেকে হাত গুঁটিয়ে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পরদেশনীতির নির্দেশক হয়েছে মনরো ডক্ট্রিন, তার মূল লক্ষ্য দুই আমেরিকার নবজাত স্বাধীন দেশগুলি যেন আবার ইউরোপীয়দের পদানত না হয়। ১৯০১ সালে রাষ্ট্রপতি থিওডর (টেডিবিয়ার!) রোজাভেল্ট এতে যোগ করেন আরেকটি করোলারি। আমেরিকার স্বাধীন কোন দেশে অস্থিতিশীলতার কারণে যদি ইউরোপীয় হস্তক্ষেপের আশংকা দেখা দেয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র সেদেশের নিয়ন্ত্রণ নিজ হাতে তুলে নেবে।

মনরো ডক্ট্রিনের লেজুড় ধরে ১৮৯৮এ কিউবার স্বাধীনতাকামীদের স্প্যানিশবিরোধী যুদ্ধে মার্কিনরা অংশ নেয়। স্পেনের পরাজয়ের সাথে সাথে যুক্তরাষ্ট্রের এখতিয়ারে এসে পড়ে গুয়াম, ফিলিপাইনস, পোর্তোরিকো, কিউবা। নতুন সুযোগের সন্ধানে কাউবয় মানসিকতার মার্কিন ব্যবসায়ীরা এসব জায়গায় আসতে শুরু করে। স্বাধীনতার বদলে উল্টো নতুন মনিব পায় দেশগুলি।

সারা বিশ্বেই অবশ্য তখন সময়টা বেশ উত্তাল। ব্রিটেন ও জার্মানির মধ্যে নতুন প্রযুক্তির দূরপাল্লার কামান আর ড্রেডনট যুদ্ধজাহাজ নিয়ে আর্মস রেস চলছে। আফ্রিকার উপকূলের স্প্যানিশ আর ফরাসী বন্দরগুলিকে বিপন্ন করে তুলছে জার্মানদের নতুন নৌশক্তি। রুশরা মধ্য এশিয়া জয় করে আফগানিস্তানের সীমান্তে এসে ব্রিটিশ ভারতকে স্নায়ুচাপে রেখেছে। ইউরোপে তুরস্ক আর এশিয়ায় চীন, দুই সিক ম্যান ভেঙে প্রতি বছর নতুন স্বাধীন দেশ তৈরি হচ্ছে, তাদের কেউ সংযুক্ত হচ্ছে নবাগত আঞ্চলিক শক্তিগুলির সাথে।

১৯০২ সালে ঋণখেলাপি ভেনিজুয়েলার বন্দরগুলি অবরোধ করে ব্রিটিশ ও জার্মান জাহাজ। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় সে সমস্যার সমাধান হয়।

যুক্তরাষ্ট্রেরও বসে থাকার কোন অবকাশ ছিল না। ঊনবিংশ শতকে অস্ট্রিয়া-হাঙেরি মেক্সিকোতে এক তাঁবেদার সম্রাট বসিয়েছিল। মার্কিনসমর্থিত স্থানীয়রা তাদেরকে হঠায়। তারপর থেকে মেক্সিকোর আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে প্রায়শই নাক গলাত যুক্তরাষ্ট্র। জার্মানিও দক্ষিণ আমেরিকাতে সাম্রাজ্যবিস্তারের চেষ্টা চালায়। পানামায় খাল করার পরিকল্পনা পৃথিবীর অনেক পরাশক্তিরই ছিল। জার্মানরা সে চিন্তা থেকে ক্যারিবিয়ান ও মধ্য আমেরিকায় ঘাঁটি গাড়তে শুরু করে। তাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণের গোপন পরিকল্পনাও একটা ছিল। পুরো ব্যাপারটা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। জার্মানির সাবমেরিন বেস বানানো ঠেকাতেই মার্কিনরা ডেনিশ ওয়েস্ট ইন্ডিজ কিনে নেয় ডেনমার্কের কাছ থেকে। কলোম্বিয়া থেকে পানামা আলাদা দেশে পরিণত হয় মার্কিন ইন্ধনেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এসব কাজকর্ম দেখেশুনেই মেক্সিকোর তদকালীন রাষ্ট্রপতি পরফিরিও দিয়াজ বলেছিলেন, খোদা থাকেন আকাশ ‘পরে, আর মার্কিন আছে ঘাঁড়ের ‘পরে!

হাইতির অবস্থাও এসময় বেশি ভাল নয়। ১৯১১ থেকে ১৯১৫র মধ্যে এসেছে-গেছে ৭জন প্রেসিডেন্ট। হাইতির বন্দরগুলিতে প্রচুর জার্মান অভিবাসী বণিক। আমদানি-রপ্তানি ব্যবসার আশি ভাগ তাদের হাতে। দেশের সরকার ও এলিট শ্রেণীর ওপর তাদের টাকার বেশ প্রভাব। অন্যদিকে হাইতির ৭০% রপ্তানী বাণিজ্য মার্কিনের সাথে। জার্মান, মার্কিন ও ফরাসী ব্যাংকের কাছেও বিশাল ঋণ হাইতির। বছরে বছরে প্রশাসন পরিবর্তনের কারণে ঋণপরিশোধে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

অস্ট্রিয়া-হাঙেরির সম্রাট ফ্রানৎস ইয়োসেফের ছোট ভাই ম্যাক্সিমিলিয়ান হন মেক্সিকোর প্রথম সম্রাট (১৮৬৪-৬৭)। মার্কিন মনরো ডক্ট্রিনকে ইউরোপীয় পরাশক্তিগুলো শুরুতে তাচ্ছিল্য করত।
মার্কিন রাষ্ট্রপতি টেডি রোজাভেল্টের কার্টুনচিত্র, হাইতিসহ ক্যারিবিয়ান সাগরের দেশগুলি থেকে ঋণ আদায়ের জন্যে মুগুর নিয়ে টহল দিচ্ছেন, ১৯০২ সাল।

১৯১৪ সালে দুই বিবাদমান দলের সশস্ত্র বিরোধের মাঝে মার্কিন মেরিন সেনা পোর্তোপ্র্যাঁসে অবতরণ করে। সবার চোখের সামনে দিয়ে তারা জাতীয় ব্যাংক থেকে প্রায় পাঁচ লাখ ডলারের সোনা নিয়ে চলে যায়। এই ‘লুট’ ছিল অস্থিতিশীলতার মুখে কেবল মার্কিন ব্যাংকের হাইতিস্থিত রাষ্ট্রীয় শাখা থেকে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের শাখায় টাকা বিনিময়! হাইতির মানুষের জন্যে এ ছিল এক অশনিসংকেত।

১৯১৪তে বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্র হাইতিতে জার্মান প্রভাব ও বিপ্লবের আশংকা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে। ১৯১৫তে প্রেসিডেন্ট উলসন বলেন, হাইতিকে ‘ঠিকঠাক’ করার সময় এখনই। এর পরই হাইতির প্রেসিডেন্ট স্যাম ১৬৭জন রাজনৈতিক বন্দীর একতরফা মৃত্যুদন্ডাদেশ দেন। তার প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ জনতা স্যামকে সম্রাট দেসালিনের মত রাজপ্রাসাদ থেকে টেনে বের করে মেরে কেটে টুকরোটুকরো করে ফেলে। আর দেরি না করে ২০০০ মেরিনের একটি দল পাঠিয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। তারা পোর্তোপ্র্যাঁসে নেমে সরকারী ভবনগুলোর দখল নেয়। ধীরে ধীরে তারা ছড়িয়ে পড়ে প্রদেশগুলিতে।

হাইতির ব্যাপারে কড়ানীতির ঘোষণা করেন প্রেসিডেন্ট উইলসন, নিউ ইয়র্ক টাইমসের রিপোর্ট, ১৯১৫

রক্তাক্ত সংঘাত ছাড়াই হাইতির সম্পূর্ণ দখল নিয়ে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। হাইতির মানুষ সম্ভবত অবাক হয়নি। এমনটারই অপেক্ষায় ছিল অনেক শিক্ষিতজন ও ব্যবসায়ী। তাদের আশা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের কিছুদিনের কড়া শাসন হাইতিকে স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরিয়ে আনবে, জার্মান বণিকদের অশুভ প্রভাবও কমে যাবে। হাইতিদখলের তারিখটা ১৯১৫র ২৮শে জুলাই — বিশ্বযুদ্ধ শুরুর ঠিক এক বছর পূর্তির দিন।

দখলদার মার্কিন সেনাপতিদের সাথে সংলাপে বসেন হাইতির রাজনীতিবিদরা। তাদের মধ্যে সবচে বেশি সমর্থন ছিল বোবো বলে এক মার্কিনবৈরী নেতার। তাকে সরাসরি পদাসীন করার পরিবর্তে মার্কিন সেনাপ্রধান সেনেটরদের বললেন সংসদের নিয়মানুযায়ী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবে। বোবোর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মত আরেক রাজনীতিবিদ দার্তিনেগাভকে খুঁজে বের করল মার্কিনরা। সেনেটের ভোটে দার্তিনেগাভই জিতলেন।

হাইতির মার্কিনসমর্থিত প্রেসিডেন্ট দার্তিগেনাভ, মেরিনসেনাপরিবেষ্টিত, ১৯১৬

ধারের অংক কড়ায়গন্ডায় বুঝে নেয়ার লক্ষ্যে হাইতির শুল্ক ও রাজস্বের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ নেয় মেরিনরা। হাইতির সংসদ মার্কিন প্রশাসনকে সাংবিধানিক বৈধতা দেয়। গুরুত্বপূর্ণ সরকারী পদের নিয়োগ অনুমোদন আসতে হত স্বয়ং মার্কিন রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে। সারা দেশে মার্শাল ল’ জারি হয়, খর্ব হয় সাংবাদিকদের স্বাধীনতা। দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসার ওপর অন্যান্য বিদেশী রাষ্ট্রের মালিকানা নিষিদ্ধ করা হয়। এক সংবাদপত্র সম্পাদক যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে উইলসনের সাথে সাক্ষাত করে তাকে বলেন যে হাইতিকে ঠিক করার রাস্তা এটা নয়। কিন্তু কে শোনে কার কথা! মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ ক্ষমতায়নের নতুন নেতা বুকার টি ওয়াশিংটন পর্যন্ত মার্কিনের হাইতিদখল নিয়ে উচ্চাশা প্রকাশ করেন যে, এভাবেই দেশটির কৃষ্ণাঙ্গরা দ্রুত ‘সভ্য’ হয়ে উঠবে।

মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ শিক্ষাবিদ বুকার টি ওয়াশিংটন (১৮৫৬-১৯১৫), হাইতিতে মার্কিন দখলদারিত্ব সমর্থন করে বিবৃতি দেন।

মার্কিন প্রশাসন হাইতির সেনাবাহিনীকে নতুন করে ঢেলে সাজায়। নতুন প্রতিরক্ষাবাহিনীর নাম দেয়া হয় জন্দার্ম। বহু হাইতিয়ান সেনাসদস্য পালিয়ে পাহাড়ী অঞ্চলে গিয়ে গেরিলা সংগ্রাম চালাতে থাকে। এরা অবশ্য খাদ্যসহ অন্যান্য প্রয়োজনে আশপাশের গ্রামগুলোর ওপর লুটতরাজ চালাত। শীঘ্রই এদেরকে ‘ডাকাত’ আখ্যায়িত করে কঠোরভাবে দমন করে মেরিন সৈন্যরা। হাইতির মানুষ বছরের পর বছর বিপ্লব আর গৃহযুদ্ধে ক্লান্ত। মেরিনদের শুরুতে ভালভাবেই গ্রহণ করে নেয় তারা, এমনকি স্বদেশী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সাহায্যও করে অনেক ‘রাজাকার’।

কিন্তু মেরিনসেনাদেরও অত্যাচার শুরু হয়ে যায় এর পর। বিদ্রোহী ‘ডাকাত’ সন্দেহে নির্বিচারে ধরপাকড়, বিচারবহির্ভূত হত্যা, ধর্ষণ, ইত্যাদিতে জড়িয়ে পড়ে তারা। হাইতির মানুষের সংস্কৃতি তারা বুঝত না, তাদের ভুডু আচার আর ক্রেওল ভাষাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখত। বোয়াইয়েরের আমলের কোর্ভে দাসশ্রমের আইনেরও বেপরোয়া ব্যবহার করে মেরিন আর জন্দার্ম। গ্রামের জোয়ানদের লেবার ক্যাম্পে পাঠিয়ে অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ শুরু হয়। এসব শ্রমের বিনিময়ে মজুরি ছিল স্বল্প। দুয়েকটা জায়গায় ক্রীতদাসের মত গলায় দড়ি পরিয়ে এসব শ্রমিকদের কর্মস্থল নেয়া হয়েছিল।

বিদ্রোহী ক্যাকোদের সন্ধানে হাইতির পাহাড়ী এলাকায় অভিযান চালাচ্ছে মার্কিন মেরিন সেনারা, তাদের গাইড হাইতিবাসী কৃষ্ণাঙ্গ ছবির ডানপাশে, ১৯১৯
মার্কিন মেরিন ও হাইতির জন্দার্ম বিদ্রোহী দলগুলিকে পরাজিত করতে সমর্থ হয়, ১৯১৯

অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে হাইতির আধুনিকায়ন শুরু হয় মার্কিন শাসনামলে। হাইতির কোস্ট গার্ড তৈরি হয় মেরিনদের সহায়তায়। চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নতি হয় মার্কিন রেডক্রসের সাহায্যে। কয়েকটি কারিগরি প্রশিক্ষণ কলেজও শুরু হয়, সেসবে পড়াতেন মার্কিন থেকে মোটা বেতনে আনা অধ্যাপকের দল। সব মিলিয়ে হাইতির শহুরে মধ্যবিত্তের একটি মিশ্র অনুভূতি ছিল মার্কিন শাসন নিয়ে। উন্নয়নের ব্যাপারে মার্কিনদের প্রতি সমর্থন থাকলেও প্রদেশ ও গ্রামাঞ্চলের মানুষদের ওপর যে ধরনের জুলুম তারা প্রত্যক্ষ করে, তাতে অতীতে নিজেদের জুলুমেরই প্রতিফলন তারা দেখতে পায়। হীনমন্যতাবোধ থেকে নতুন একটি আত্মপরিচয়ের সূচনা হতে থাকে।

প্রাদেশিক প্রশাসনে সেনাশাসকদের যে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল, সেটা খর্ব করে কেন্দ্রীয় শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। স্থানীয় কর আদায়ের কাজটা এসে পড়ে মেরিনদের হাতে। কিন্তু যে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে প্রদেশে শাসক-শাসিতের সম্পর্ক ছিল আগে, তা পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার যে শক্তিটা ছিল প্রদেশগুলিতে, সেটা বিনষ্ট হয়ে যায়।

মার্কিন মেরিনদের প্রশিক্ষিত হাইতির নতুন প্রতিরক্ষাবাহিনী জন্দার্মের সদস্য, ১৯১৯
হাইতিতে মার্কিন মেরিন সেনাদল বিদ্রোহী কাকোদের বিরুদ্ধে অভিযানে স্থানীয় গাইডদের সহায়তা লাভ করে (ডান পাশে), ১৯১৫

মার্কিন উপদেষ্টাদের সাহায্যে নতুন একটি সংবিধানও প্রবর্তিত হয়। হাইতির সম্পত্তিমালিকানা শুধুমাত্র কালোদের অধিকার, সেই প্রাচীন সাংবিধানিক ধারাটি রহিত করা জন্যে সংসদে প্রস্তাব আনেন দার্তিনেগাভ। এতে সাড়া না পেয়ে তিনি সংসদ স্থগিত করেন। তারপর গণভোটের মাধ্যমে সংবিধানের এই ‘সেকেলে’ নিয়মগুলি পরিবর্তিত হয়। রাষ্ট্রপতি পদের মেয়াদও তুলে নেয়া হয়। সব মিলিয়ে ১৯১৮র সংবিধান হাইতির রাজনীতির চেক-অ্যান্ড-ব্যালান্সকে কয়েক দশক পিছিয়ে দেয়।

একই সময়ে হাইতিতে মার্কিন কম্পানিগুলোর প্রবেশ শুরু হয়। বিশেষ করে আখ-চিনি, আনারস আর অন্যান্য গ্রীষ্মমন্ডলীয় ফলমূলের চাষাবাদ ও রপ্তানির জন্যে জায়গাজমি তারা কিনতে শুরু করে। বিনিয়োগ বাড়ার সাথে সাথে রাস্তাঘাট ও রেললাইনও তৈরি শুরু হয়। কিন্তু এসব প্রকল্পের কারণে অনেক ক্ষুদ্র চাষী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেসব কম্পানিতে চাকরির সুযোগ এদেরকে দেয়া হলেও তারা সে কাজ করতে চাইত না। শ্রমের অভাবে মার্কিন কম্পানিগুলির ব্যবসা ক্রমে পরিত্যক্ত হয়। মার্কিন প্রশাসন চেষ্টা করেও হাইতির অর্থনৈতিক সম্ভাবনাগুলি পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করতে পারেনি। তবে পশ্চিমাঞ্চলে কফি চাষ ও রপ্তানির সুবাদে বেশ প্রবৃদ্ধি আসে।

মার্কিনবিরোধী স্বাধীনতাযোদ্ধা শার্লমেইন পেরল্তের মৃতদেহের ছবি মেরিনরা প্রকাশ করে হাইতির সংবাদপত্রে। তার স্মৃতি থেকেই এ চিত্রকর্ম ‘দ্য ক্রুসিফিকশন অফ শার্লমেইন পেরল্ত ফর ফ্রীডম ১৯৭০’ আঁকেন হাইতির শিল্পী ফিলোমে ওব্যাঁ।
হাইতির অবকাঠামো উন্নয়নের কাজে মেরিনরা গ্রামাঞ্চলের যুবকদের বাধ্যতামূলক কোর্ভে শ্রমে নিযুক্ত করে, ১৯২০

১৯২২ সাল নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ হাইতিতে মেরিনদের কার্যকলাপের ব্যাপারে প্রচুর খবর পেতে থাকে। হাইতিতে কোর্ভে দাসশ্রমের ব্যবহার আর বিদ্রোহীদের কঠোরভাবে দমনের ব্যাপারে মার্কিন সেনেট তদন্ত শুরু করে। এর রেশ ধরে হাইতির মার্কিন প্রশাসনের জবাবদিহিতা বাড়ানো হয়। ততদিনে বিদ্রোহ স্তিমিত হয়ে এসেছে।

কিন্তু যে দেশের মানুষ নিজেদের সরকারকেই বছরে বছরে উচ্ছেদ করে এসেছে, তাদের কতদিন দমিয়ে রাখা সম্ভব! ১৯২৯ সালে মার্কিনদেরই প্রতিষ্ঠিত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বৃত্তি কমানোর প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে পড়ে। তাদের আরো অনেক অভিযোগের মধ্যে ছিল মার্কিন অধ্যাপকদের স্থানীয় ভাষায় পড়ানোর অপারগতা, হাইতির কোষাগার থেকে তাদেরকে প্রদত্ত মোটা বেতন, স্থানীয় শিক্ষকদের নিচু পদ, ইত্যাদি।

মার্কিন রেড ক্রসের ডাক্তার-নার্সদের সহযোগিতায় হাইতির চিকিৎসাব্যবস্থার বেশ উন্নয়ন হয়, ১৯২৫
হাইতিতে মেরিনসেনাদের ক্ষমতার অপব্যবহারের খবর মার্কিন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতে শুরু করলে সেনেট এ ব্যাপারে একটি তদন্ত শুরু করে, নিউ ইয়র্ক টাইমসের রিপোর্ট, ১৯২১

একটি সমাবেশে গুলিবর্ষণে এক ছাত্রের মৃত্যু হলে সারা হাইতিতে জনবিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও মার্কিনদের নিন্দা শুরু হয়ে যায়। ১৯৩০ সংবিধানের বর্ধিত ভোটাধিকারে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ভ্যাঁসঁর বৈরী মনোভাব যুক্ত হয় তার সাথে। সমাজের সর্বস্তরে এরকম বিরোধের মুখে থেকে মার্কিনরা হাইতি ছাড়ার পাঁচ বছরের সময়সীমা নির্ধারণ করে। সে মেয়াদ উত্তীর্ণ হবার আগেই নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ১৯৩৪এ কেটে পড়ে মেরিনরা। তবে মার্কিন অর্থনৈতিক উপদেষ্টা থেকে যায় ১৯৪১ পর্যন্ত। ১৯৪৭এ সকল ঋণ পরিশোধিত না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণও মার্কিনদের হাতে থাকে।

১৯২৯ সালে ছাত্রবিক্ষোভের মুখে হাইতি ছাড়ার পরিকল্পনা ঘোষণা করে মার্কিন প্রশাসন

মার্কিন দখলে থাকা অন্যান্য দেশে মার্কিন সংস্কৃতি জনপ্রিয়তা পেলেও হাইতিতে সেরকমটা হয়নি। এর মূল কারণ হাইতিবাসীর আদিম সন্দেহপ্রবণ স্বভাব। যেমন, পোর্তোরিকো, কিউবা ইত্যাদি জায়গায় মার্কিন খেলা বেসবল এখনও জনপ্রিয়, কিন্তু হাইতিতে নয়। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ সঙ্গীত-বাদ্যের প্রভাব পড়ে অবশ্য। প্রথমদিকের গানবাজনায় মার্কিনদের প্রশংসা ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে যায় প্রতিবাদসঙ্গীতে। ভুডুচর্চার স্বাধীনতা না থাকায় প্রচুর হাইতিবাসী প্রতিবেশী দেশগুলিতে পাড়ি জমায়।

মার্কিনদের ওপরও হাইতির কম প্রভাব পড়েনি। ত্রিশের দশকের হলিউডি হরর ফিল্মে মামি, ড্রাকুলার পাশাপাশি জোম্বি বা অর্ধমৃত গোলামের যে ক্যারেক্টার বেশ জনপ্রিয় হয়, সেটা আসলে হাইতিরই রপ্তানি! ভুডু ম্যাজিকে মন্ত্র পড়ে সাইকেডেলিক গুণসম্পন্ন গাছের শেকড়-বাকর খাইয়ে শত্রুকে আজ্ঞাবহ দাসে পরিণত করার একটা মিথ প্রচলিত ছিল। এর ক্রেওল নাম জোনবি — জোম্বি নামটা সেখান থেকেই। হাইতিদখলের ইতিহাস মার্কিনরা ভুলে গেছে, কিন্তু এখনো রয়ে গেছে জোম্বি।

হাইতির ভুডু চর্চা সম্পর্কে মার্কিন জনসাধারণ এ সময় অবহিত হতে শুরু করে, তার প্রভাব পড়ে হলিউডি ছবিতেও। প্রথম জোম্বি মুভি ১৯৩২ সালের হোয়াইট জোম্বির দৃশ্য।

দখলদারিত্বের দুই দশকে হাইতির শিক্ষিত সমাজে ব্যাপক সোল-সার্চিং চলে। মার্কিন আমলে বৈদেশিক বাণিজ্য আর বিনিয়োগের পুরোদস্তুর স্বাদ পেয়েছে দেশের বিশাল একটা জনগোষ্ঠী। পেছন ফেরার কোন সম্ভাবনা আর নেই। স্বাধীনতাপরবর্তী রাষ্ট্রনেতারা সেকারণে মার্কিনদের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলেন।

দ্বিতীয় এ স্বাধীনতার তাৎপর্য কি হতে পারে সে নিয়ে কোন একক ধ্যানধারণা অবশ্য হাইতিবাসীর গড়ে ওঠেনি। তারা না পারে মার্কিন ধ্যানধারণা নিয়ে সামনে পা বাড়াতে, না পারে তাদের আগের অবস্থায় ফিরে যেতে। বলতে পারি, মার্কিনরা হাইতি ছেড়ে যাবার পর দেশটির মানুষদের অবস্থা দাঁড়ায় জোম্বির মত। নতুন আরম্ভ কিভাবে হবে সে প্রশ্নের জবাব সন্ধান করতে করতেই তারা তলিয়ে যেতে শুরু করে আরেক অতল গহ্বরে।

হাইতি – ৩, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, ১৮৬০-১৯১০

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে হাইতি, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেরও, সম্মানজনক অবস্থান ঊনবিংশ শতকে ছিল না। দুটি দেশই দুই পরাশক্তির বিরুদ্ধে রক্তাক্ত স্বাধীনতাযুদ্ধ করেছে। বিশেষত, হাইতিতে ফরাসী শ্বেতাঙ্গ খামারমালিকরা সপরিবারে গণহত্যার শিকার হয়। ফ্রান্স তাই হাইতিকে তাদের উপনিবেশই ধরত, আর বাকি ইউরোপীয় শক্তিগুলি ফ্রান্সের আগ বাড়িয়ে কূটনৈতিক সম্পর্কস্থাপনে আগ্রহী ছিল না।

তাই হাইতির বন্দরগুলিতে মার্কিন, জার্মান আর ব্রিটিশ জাহাজের আনাগোনা থাকলেও বড় ধরনের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যচুক্তি করার সামর্থ্য হাইতি সরকারের ছিল না। এই দুর্বলতার সুযোগ নিতে ফ্রান্স হাইতিতে দূত পাঠায়। তাদের শর্ত, স্বাধীনতাযুদ্ধে যে ফরাসী সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার জরিমানা দিলে ফ্রান্স হাইতিকে স্বীকৃতি দেবে।

উত্তর হাইতির রাজা ক্রিস্তফ ফরাসীদের একদমই বিশ্বাস করতেন না। তার দরবারে পাঠানো ফরাসী দূতকে হত্যার নির্দেশ দেন তিনি। ঠিক তখনই দূতের হাত থেকে গোপন ফরাসী সরকারী নির্দেশনা এসে পড়ে ক্রিস্তফের কাছে। তার ভয় অমূলক ছিল না! দূতের কাছে নির্দেশ ছিল, শর্তে রাজি না হলে নিকটস্থ ফরাসী নৌবাহিনীকে সংকেত পাঠাতে, যেন তারা ক্রিস্তফের বন্দরগুলিতে আক্রমণ চালায়।

এসব নাটকীয়তার ফলে ফরাসীদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির ব্যাপারটা পিছিয়ে এসে পড়ে ১৮২৫ সালে। রাষ্ট্রপতি বোয়াইয়েরের কাছে ফরাসীরা আবার দূত পাঠায়। ক্ষতিপূরণের অংক তারা ঠিক করে পনের কোটি ফ্রাংক — আজকের হিসাবে ৩৫০ কোটি ডলার! সামর্থ্যে না কুলালে ফরাসী ব্যাংকও প্রস্তুত রয়েছে দীর্ঘকালীন ঋণ দিতে!

হাইতির সরকারী বাজেট কমিশন এই ব্যাপারে না আগাতে বোয়াইয়েরকে সুপারিশ করে। কিন্তু একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রপতি বোয়াইয়ের তার তোয়াক্কা না করে এতে রাজি হয়ে যান। এই একতরফা সিদ্ধান্তের মাশুল হাইতিবাসীকে গুনতে হবে প্রায় একশ বিশ বছর! সুদে-মূলে যত টাকা এতে খরচ হবে, তাতে হাইতিতে উন্নতমানের জনপথ-নৌবন্দর-বিশ্ববিদ্যালয়-হাসপাতাল হতে পারত অনেক।

ফরাসী দূতের সাথে ইনডেমনিটি সম্মেলনে রাষ্ট্রপতি বোয়াইয়ের, ১৮২৫। ১৮৬৪ সালে প্রকাশিত ফরাসী বইয়ে দেখানো চিত্র।

হাইতির সরকারী কোষাগারের সীমিত সম্পদের সিংহভাগই খরচ হয়ে যেত সেনাবাহিনী পালতে। তাদের মূল কাজটা আবার দেশরক্ষার চেয়ে বেশি বিপ্লবীদের ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করা। হাইতির বাজেটের ১ শতাংশেরও কম খরচ হত শিক্ষাক্ষেত্রে। বোয়াইয়ের চাইলে ফরাসী দাবি কানে না তুলে সরাসরি তাদের প্রতিযোগী জার্মানি আর আমেরিকার সাথে সম্পর্কস্থাপনে মনোযোগ দিতে পারতেন। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির রাস্তা কার্যত তৈরি হয়ে যেত।

বোয়াইয়েরের তো জাতীয়তাবাদী অহংকার ছিলই, তাছাড়াও তিনি হিসাব কষেছিলেন যে ফ্রান্সের স্বীকৃতি পেলে হাইতিতে বৈদেশিক বিনিয়োগ ও বাণিজ্য বাড়বে। তা বেড়েছিল কিছুটা, কিন্তু তার সাথে সাথে নতুন নতুন সমস্যার সম্মুখীন হয় হাইতি। মুক্তবাণিজ্যের রাস্তা ধরে হাইতিতে বিভিন্ন দেশ থেকে অভিবাসন বৃদ্ধি পায়। জার্মান বণিকরা হাইতির বন্দরগুলিতে আমদানি-রপ্তানির কারখানা খুলে বসে। আইনানুযায়ী তারা সম্পত্তির মালিক হতে না পারলেও, স্থানীয় নাগরিক বিয়ে করে সে আইন পাশ কাটানো সম্ভব ছিল।

তাও যদি হাইতিতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকত, মুক্তবাণিজ্য আর শিক্ষাদীক্ষার মাধ্যমে নাগরিকদের মুক্তি আর সমৃদ্ধি আসতে পারত। কিন্তু রাষ্ট্রপতি বোয়াইয়েরকে তাড়িয়ে সম্রাট সুলুক, তারপর ১৮৫৯এ তাঁকেও খেদিয়ে রাষ্ট্রপতি জেফ্রার — এভাবে ১৮৪৩ থেকে ১৮৮৯এর মধ্যে ১২জন রাষ্ট্রনায়ক দেশ পরিচালনা করেন, আর গঠনতন্ত্র পরিবর্তিত হয় ৮বার। কিন্তু আসল সমস্যাগুলির কোন পরিবর্তন হয় না।

মার্কিন ম্যাগাজিন হার্পারস উইকলিতে হাইতির নতুন প্রেসিডেন্ট সালনাভের ছবি, ১৮৬৭। একই পৃষ্ঠার নিচে ডানের চিত্রঃ আমেরিকায় প্রথম কৃষ্ণাঙ্গরা ভোট দিচ্ছে ওয়াশিংটন ডিসির একটি স্থানীয় নির্বাচনে।

প্রদেশগুলিতে সেনাশাসকরাই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিল। বড় খামারগুলো তাদের অফিসারদের দখলে। নির্বাচন হলেও সেগুলি নামেমাত্র, আর ফলাফল পছন্দ না হলে তো বিপ্লব আর অভ্যুত্থানের রাস্তা আছেই! রাষ্ট্রপতি গদিতে বসামাত্রই প্রাসাদে গিয়ে সৈন্যসামন্ত নিয়ে এমন ঘাঁটি গাড়তেন, যেন স্বদেশীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছেন তিনি!

এসব গোলমালের ফলে বৈদেশিক সম্পত্তির ক্ষতি হওয়া ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। জার্মান বা ব্রিটিশ বাণিজ্যিক স্বার্থের ক্ষতি সাধিত হলে, সেসব দেশের যুদ্ধজাহাজ হাইতির সাগরে টহল দিত আর বন্দরগুলির দিকে কামান তাগ করে থাকত। ক্ষতিপূরণ আদায় না হওয়া পর্যন্ত হুমকির মুখে থাকত হাইতির বন্দর ও বাণিজ্য।

হাইতির আরও বড় মাথাব্যথার কারণ ছিল আন্তর্জাতিক ঋণ। ফ্রান্সের সেই ইনডেমনিটির কিস্তি শোধ করতে গিয়ে আরো পর্যায়ক্রমিক ঋণ হাইতি নেয় যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও ব্রিটেনের কাছ থেকে। ১৮৬০এর দশকে বাজেটের ৩০% যেত সামরিক খাতে আর ২৫% ধারের কিস্তি পরিশোধ করতে। ১৮৯৮ নাগাদ ধারশোধের ভাগ হয়ে দাঁড়ায় ৫০%, ১৯১৩ নাগাদ ৬৭%। এক পর্যায়ে ফরাসী একটি ব্যাংক হাইতির কোষাগারের ‘ইজারা’ নেয়, তারাই ছাঁপাত হাইতির ব্যাংকনোট, আর সেভাবে দেশটির অর্থনীতিতে একটা বড় প্রভাব বিস্তার করে ফ্রান্স।

জার্মান অ্যালবামে ছাঁপানো হাইতির অনুপম দৃশ্যাবলী, ঊনবিংশ শতকে বহু জার্মান অভিবাসী হাইতিতে আবাস গাড়ে। ১৮৯৭ সালে ছাঁপানো এনগ্রেভিং।
১৮৯৭ সালে জার্মান এক নাগরিককে হাইতির আইনশৃংখলাবাহিনী চুরির দায়ে গ্রেপ্তার করলে জার্মানি শার্লট নামে এই যুদ্ধজাহাজ পাঠায় হাইতিতে, শক্তিপ্রয়োগের ভয় দেখিয়ে তার নাগরিককে মুক্ত করার প্রয়াস। ইউরোপীয় পরাশক্তিগুলি এরকম নানাভাবে ব্ল্যাকমেইল করে এসেছে হাইতিকে। ফিরম্যাঁর মত কূটনীতিবিদদের লক্ষ্য ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের মত শক্তিশালী দেশের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্কস্থাপন করে ইউরোপীয়দের প্রভাবহ্রাস।

এ সময়টা অবশ্য পৃথিবীর আরো অন্যান্য জায়গার মত হাইতির শিল্প-সংস্কৃতির জন্যেও একটা রেনেসাঁর যুগ ছিল। আমেরিকা-ইউরোপে শিক্ষিত গুণীজন আর অভিবাসীদের সমাগমে হাইতির শহরগুলিতে একটা মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে ওঠে। এরাই নানা সময়ে হাইতির একনায়কদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, যদিও তাদের বিপ্লবগুলিতেই নিহিত ছিল নতুন কোন একনায়কতন্ত্রের বীজ।

১৮৭০এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কৃষ্ণাঙ্গ ধর্মপ্রচারক জোসেফ হোলি দানের টাকায় মুক্তিপ্রাপ্ত ক্রীতদাসদের হাইতিতে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলবায়ুতে অভ্যাস না থাকায় রোগে-জরায় এদের অনেকে মারা যায়।

একই সময়ে ইউরোপীয় খ্রীষ্টান মিশনারিরা পশ্চিমা শিক্ষাব্যবস্থাও নিয়ে আসেন হাইতিতে। গ্রামাঞ্চলের দিকে তারা ছড়িয়ে পড়তে থাকলে সংঘাতের ক্ষেত্র তৈরি হয় সনাতন বিশ্বাসীদের সাথে। সহজ-সরল গ্রাম্য হাইতিবাসী ছিল কুসংস্কারাচ্ছ্ন্ন, ভুডুতে বিশ্বাসী। বহুবিবাহেরও প্রচলন ছিল। খ্রীষ্টান পাদ্রীরা এসবের পরিবর্তনের চেষ্টা করেন। ভুডুবিশ্বাসীদের নরবলি-নরমাংসভক্ষণের গুজব হাইতির শহরগুলিতেও শোরগোল তোলে। স্বদেশের পশ্চাদপসরতা নিয়ে একটা হীনমন্যতা গড়ে ওঠে শহরবাসী দোআঁশলা সুধীসমাজের মধ্যে। তারাও উঠে পড়ে লাগে অবস্থার পরিবর্তনের জন্যে। রাজনীতিতেও সেসবের প্রভাব এসে পড়ে।

হাইতির নতুন শিক্ষিত কাতারের একজন ছিলেন অঁতেনর ফিরম্যাঁ। পেশায় সাংবাদিক, ফ্রান্সে কাটিয়েছেন যুবাবয়স। ইউরোপে তখন ‘রেইস থিওরি’ নামে একটি সিউডোসায়েন্টিফিক তত্ত্ব বেশ চালু। এ তত্ত্বের প্রবক্তরা যৌক্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রমাণের চেষ্টা করেন যে, ককেশিয়ান আর্যজাত মানবজাতির শ্রেষ্ঠতম, আর কৃষ্ণাঙ্গরা গায়েগতরে শক্তি ধরলেও মগজের জোরে সকলের অধম। ফিরম্যাঁ কয়েকটি প্রবন্ধ ও একটি বই প্রকাশ করে এদের যুক্তিখন্ডন করেন। এসব গবেষণা করতে গিয়ে হাইতির বহু লোকসংস্কৃতির সাথে পরিচিত হন তিনি। এভাবে পুরোদস্তুর নৃতত্ত্ববিদ বনে যান।

১৮৮৯ সালে ফিরম্যাঁ দেশে ফিরে রাজনীতিতে জড়িত হয়ে পড়েন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে হাইতির বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক আরো দৃঢ় করতে আগ্রহী ছিলেন। কৃষ্ণাঙ্গ সংস্কৃতির পুরোধা হলেও ফিরম্যাঁ পপুলিস্ট রাজনীতিতে একদম বিশ্বাস করতেন না। তার দর্শন ছিল, দেশ পরিচালনার জন্যে দরকার হাতেগোনা কিছু অভিজ্ঞ দেশপ্রেমী নেতা। ফিরম্যাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারা হাইতির শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে।

অঁন্তেনর ফিরম্যাঁ (১৮৫০-১৯১১), হাইতিয়ান রাজনীতিবিদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, দার্শনিক, নৃতত্ত্ববিদ, সাংবাদিক।

যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য ১৮৮০র দশকের আগে হাইতিকে নিয়ে খুব একটা আগ্রহী ছিল না। পার্শ্ববর্তী ডমিনিকান রিপাবলিকের ঋণলাঘবের বিনিময়ে নতুন স্টেট হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রে যোগদানের একটা কথাবার্তা অনেকদিন চলে। কিন্তু মার্কিন সেনেট সে প্রস্তাবনা ১৮৭৪এ নাকচ করে দেয়।

হিস্পানিওলা দ্বীপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ আরো বাড়তে শুরু করে স্টীমশিপের কারণে। স্টীমশিপ তখনকার বিশ্বকে সংযুক্ত করে ফেলেছে, আরেক গ্লোবালাইজেশনের যুগ চলছে তখন (জুল ভার্নের ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেইজ’ রচনার সময়কাল ১৮৭২)। আটলান্টিক অতিক্রম করতে সময় লাগে মোটে ৭ দিন! কিন্তু স্টীমশিপের জন্যে যেটা বেশ জরুরী সেটা হল কোলিং স্টেশন — এঞ্জিনে কয়লা ভরার বন্দর। প্রশান্ত মহাসাগরে এর প্রয়োজন থেকেই জাপানের বন্দরগুলি উন্মুক্ত করতে ১৮৫৪তে মার্কিন অ্যাডমিরাল পেরিকে পাঠানো হয়। হাইতিও ছিল ক্যারিবিয়ান এলাকায় কোলিং স্টেশনের একটা উত্তম অবস্থান।

ওদিকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে টাকা ধার করে হাইতি সময়মত পরিশোধ করতে পারছে না। বছরে বছরে বিপ্লবের ফলে বিনিয়োগকারীদেরও কোন নিশ্চয়তা নেই। সব মিলিয়ে হাইতির রাজনীতিতে নাক না গলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোলিং স্টেশনের চাহিদাপূরণের তেমন কোন উপায় ছিল না, বিশেষ করে যখন ফিরম্যাঁর মত রাজনীতিবিদ ও তাঁর সমর্থকরা যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সমর্থন চাইছে। হাইতিতে হস্তক্ষেপের যত অজুহাত ও লেভারেজ দরকার, সবই যুক্তরাষ্ট্রের ছিল।

১৮৮৯ সালে হাইতির মোল-স্যাঁ-নিকোলা দ্বীপে নৌঘাঁটি করার জন্যে যুক্তরাষ্ট্র রাষ্ট্রপতি লেজিতিমকে পীড়াপিড়ি করে। তাতে কাজ না হওয়ায়, উত্তর হাইতির বিদ্রোহীদেরকে তারা ইন্ধন দিতে শুরু করে — ফিরম্যাঁ ছিলেন এদলে। উত্তরের সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে আন্দোলনের মুখে সরকারের পতন হয়। নির্বাচিত নতুন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন অঁতেনর ফিরম্যাঁ।

যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিবিদরা ফিরম্যাঁকে বেশ সম্মান করত। দ্বিপাক্ষিক সংলাপে সরাসরি অংশ নেন ফিরম্যাঁ ও মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ মুক্তির পথিকৃত ফ্রেডরিক ডগলাস। প্রাক্তন দাস ডগলাস হাইতিতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন। শুধু হাইতির সাথে ভ্রাতৃপ্রতিম কূটনৈতিক সম্পর্ক নয়, ডমিনিকান রিপাবলিক মার্কিন স্টেট হলে কিংবা ক্যারিবিয়ানের কৃষ্ণাঙ্গপ্রধান ছোট দ্বীপগুলোর নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্র নিলেই তাদের মঙ্গল হবে, এটা ছিল ডগলাসের দৃঢ় বিশ্বাস। অর্থাৎ এসব কৃষ্ণাঙ্গপ্রধান দেশগুলির একরকম মার্কিন ‘উপনিবেশায়ন’ ফ্রেডরিক ডগলাস নিজেই সমর্থন করতেন।

ফ্রেডরিক ডগলাস (১৮১৭-৯৫), প্রাক্তন দাস, মার্কিন কূটনীতিক, বিশিষ্ট বক্তা, লেখক, অ্যাবলিশনিস্ট, ১৮৭২ সালের নির্বাচনে ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী, হাইতিতে প্রেরিত মার্কিন দূত (১৮৮৯-৯১)।

ফিরম্যাঁ ডগলাসের সাথে সংলাপ চালিয়ে গেলেও তাকে মিথ্যে আশ্বাস দেননি, কারণ সংবিধান অনুযায়ী হাইতির সীমানায় বিদেশীদের কাছে জমিবিক্রি বারণ। ডগলাসও ওয়াশিংটনে বার্তা পাঠান হাইতিকে চাপাচাপি না করার জন্যে। সে কথা গায়ে না মেখে যখন যুক্তরাষ্ট্রের হর্তাকর্তারা সাতটি যুদ্ধজাহাজ পাঠান হাইতির সাগরে, তখন ফিরম্যাঁই প্রথম মার্কিন নৌবন্দরের প্রস্তাব নাকচ করে দেন। তার লেখা প্রতিবাদলিপির বাগ্মীতার কাছে হার মেনে মার্কিন নৌবাহিনী জাহাজ ফিরিয়ে নেয়। ডগলাসও বেশ মনোক্ষুন্ন হন।

এরপর ফিরম্যাঁ রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্রে বেশ কিছু সংস্কারের প্রস্তাব আনেন। মার্কিনদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের খাতিরে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সহজ করার জন্যে কিছু প্রস্তাবও তোলা হয়। তার একটি ছিল শ্বেতাঙ্গদের সম্পত্তির মালিকানার ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার। রাষ্ট্রপতির সেনেটর মনোনয়নের ক্ষমতা রহিত করা হয়। আরো বহু মানুষকে ভোটাধিকারের আওতায় আনা হয়।

সংস্কারের বিষয়গুলিতে সামরিক বাহিনীর অবশ্য সায় ছিল না। শীঘ্রই আবার হাইতির উত্তরাঞ্চলে গোলমাল শুরু হয়ে যায়। ১৯০২ সালে নতুন নির্বাচনের দাবিতে সরকার অপসারিত হয়। এবার ফিরম্যাঁ স্বয়ং নির্বাচনে দল নিয়ে অংশ নিলেন। তার সমর্থকরা অধিকাংশ ছিল যুবাবয়সী ও পেশাজীবী শহুরে মানুষ। তার মূল প্রতিপক্ষ উত্তরের সেনাশাসক জেনারেল নোর্-অ্যালেক্সিসের বিরুদ্ধে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ ওঠে। তার রেশ ধরে অ্যালেক্সিস ফিরম্যাঁপন্থীদের মার্কিন তাঁবেদার আখ্যা দিয়ে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাদখল করেন।

ফিরম্যাঁপন্থীদের সাথে একদফা সংঘর্ষে জয়লাভ করে অ্যালেক্সিসপন্থীরা। ফিরম্যাঁ প্রাণভয়ে নিকটবর্তী সেন্ট টমাস দ্বীপে পালিয়ে যান। তাঁর বসতবাড়ি-লাইব্রেরি তছনছ করে ফেলে অ্যালেক্সিসের সৈন্যরা। নির্বাচনের যেটুকু ফলাফল বেরিয়েছিল, তাতে ফিরম্যাঁর দল বিশাল ব্যবধানে এগিয়ে ছিল। ১৯১১ সালে ফিরম্যাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে এক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গুণীজনের সম্ভাবনাময় নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হয় হাইতির জনগণ।

জেনারেল পিয়ের নোর্-অ্যালেক্সিস (১৮২০-১৯১০), হাইতির রাষ্ট্রপতি (১৯০২-১৯০৮), যুদ্ধ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ফিরম্যাঁকে জোর করে রাষ্ট্রপতি হতে না দিলেও শেষমেশ বিপ্লবের মুখে গদি ছাড়তে হয় তাকেও।

আসলে হাইতির জন্মলগ্ন থেকেই বাইরের মানুষকে তাদের গভীর অবিশ্বাস। তারা প্রচন্ড স্বাধীনচেতা, এতটাই যে স্বদেশী সরকারের শাসনেও অবদমিত হয় না তারা। নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্ব আর অহংকারী অকর্মণ্য নেতাদের কারণে দায়িত্বশীল পররাষ্ট্র ও বাণিজ্য নীতি হাইতির ছিল না। এসবের কর্মফল ফিরম্যাঁ নিজেই ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিলেন।

ফিরম্যাঁ বলেছিলেন, উত্তরের ‘দানব’ যুক্তরাষ্ট্রই হাইতির ভবিষ্যতের চাবিকাঠি। হাইতিবাসীর সামনে একটাই পথ: নিজেদের বিবাদ-বিভক্তি ছেড়ে সময় থাকতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সহযোগিতা-সহমর্মিতার সম্পর্ক গড়ে তোলা। যদি তারা তা করতে না পারে, তাহলে সে দানবই হাইতিকে আপাদমস্তক গিলে খাবে। ফিরম্যাঁপন্থীদের বিফলতায় প্রমাণ হয়ে গেল, হাইতি বেছে নিয়েছে দ্বিতীয় পথটিই।

১৯০১ সালে রাজধানী পোর্তোপ্র্যাঁসের দৃশ্য।
১৯০১ সালে রাজধানী পোর্তোপ্র্যাঁসের দৃশ্য, একশ বছরেও খুব একটা পরিবর্তন হয়নি।
বন্দরে মার্কিন বাণিজ্যজাহাজ থেকে ময়দার বস্তা নামাচ্ছে খালাসীরা, ১৮৯০ থেকে ১৯০০র মধ্যে তোলা ছবি।

হাইতি – ২, রাষ্ট্রনির্মাণ, ১৮১০-১৮৬০

হাইতির স্বাধীনতার ঘোষণায় দেসালিন প্রজাদের জন্যে একরকম সাবধানবাণী লিখে রেখে গিয়েছিলেন। যেদিন নেতাদের আদেশ পালনের দায়িত্ব হাইতির জনগণ বিস্মৃত হবে, সেদিন আবার ভিনদেশের পরাধীনতার শৃংখল পরবে তারা। একরকম প্রচ্ছন্ন হুমকি আর কি!

হাইতিতে যুক্তরাষ্ট্রের মত জনপ্রতিনিধি-সম্মেলন ডেকে সংবিধানপ্রনয়ণ না হয়ে দেসালিনের অঙ্গুলিহেলনেই সব কিছু চলতে থাকল। লুভেরত্যুরের আমলেও ফ্রান্সের প্রজাতান্ত্রিক সম্মেলনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি পাঠিয়েছিল হাইতি। সেসবের ধার না ধেরে সহসা সম্রাট বনে বসেন দেসালিন। এ যেন প্রতিপক্ষ ফরাসী সম্রাট নাপোলেওঁকে কাঁচকলা দেখানো!

নাপোলেওনের সময়েও ফরাসীর পাশাপাশি স্থানীয় ক্রেওল ভাষায় সরকারী ঘোষণা প্রকাশ করা হত। দেসালিন জনসাধারণের বোধগম্য এই ভাষাটাও পরিত্যাগ করেন। ভাবটা এমন যে, হাইতির অধিকাংশ মানুষ গ্রাম্য মূর্খ, তাদের এত দাম দিয়ে কোন ফায়দা নাই! ফরাসীভাষী শহুরে এলিট আর প্রাদেশিক সামরিক শাসকদের কথামতই দেশ চলবে।

হাইতির প্রথম রাষ্ট্রপতি ও সম্রাট দেসালিন (জীবৎকাল: ১৭৫৮-১৮০৬, শাসনকাল: ১৮০৪-০৬)। ফরাসী ছিন্নমস্তক হাতে। তাঁর আমলে হাইতির অবশিষ্ট ফরাসী শ্বেতাঙ্গদের ওপর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চলে। ১৮০৪ সালের এনগ্রেভিং।
দেসালিনের স্বাধীনতার ঘোষণার পোস্টার, ১৮০৪। হাইলাইটেড অংশের অনুবাদ: “If you ever refused or grumbled while receiving those laws that the spirit guarding your fate dictates to me for your own good, you would deserve the fate of an ungrateful people.”
সম্রাট দেসালিনের রাজ্যাভিষেক, ১৮০৪।
দেসালিনের সম্রাট হবার প্রেরণা ফরাসী সম্রাট নাপোলেওনের থেকে এসে থাকতে পারে। তিনি ১৮০৪ সালে নিজেকে ফ্রান্সের সম্রাট ঘোষণা করেন।

স্বেচ্ছাচারী শাসন করতে গিয়ে অবশ্য শীঘ্রই জনরোষের শিকার হন সম্রাট দেসালিন। প্রথমত, ভূমিদাসভিত্তিক খামার ব্যবস্থার কোন সংস্কার তিনি করেননি। দ্বিতীয়ত, দোআঁশলা মুলাটো শিক্ষিতশ্রেণীর সাথে তাঁর বেশি দহরমমহরম হাইতির মানুষ ভাল দৃষ্টিতে দেখেনি। তৃতীয়ত, প্রাদেশিক সেনাপ্রধানদের বিরাগভাজন হয়ে পড়েন তিনি।

১৮০৬ সালে তাঁরই দুই সহযোদ্ধা আলেকসন্দ্র পেতিওঁ আর অঁরি ক্রিস্তোফ আঁতাত করে অনুগত সেনাদল নিয়ে রাজধানী পোর্তোপ্র্যাঁসে প্রবেশ করেন। বিদ্রোহী জনগণ রাষ্ট্রীয় প্রাসাদ থেকে সম্রাটকে রাস্তায় টেনে বের করে গুলি করে হত্যা করে। শুধু তাতেই তারা ক্ষান্ত হয়নি, দেসালিনের মৃতদেহকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে ফেলে তারা।

রাষ্ট্রের স্থপতির এমন পরিণতি হাইতির ভবিষ্যতের জন্যে একটি খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। দেসালিনের প্রাক্তন দোসররা তাঁর সৎকারের বালাই না করে ডাকলেন জনপ্রতিনিধির সম্মেলন। যুক্তরাষ্ট্রের আদলে দ্বিকক্ষ সংসদ আর ত্রিমুখী ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রস্তাব করা হল। সেনেটের হাতে বেশি ক্ষমতা চলে যাবার ব্যাপারটা আবার ক্রিস্তফের পছন্দ হলো না। ছোটখাট একটা গৃহযুদ্ধ বেঁধে গেল পেতিওঁ-ক্রিস্তফের মধ্যে, কিন্তু কেউ কাউকে হারাতে পারলেন না।

দেসালিনের ছিন্নবিচ্ছিন্ন মৃতদেহ কবরস্থ করার আর কেউ ছিল না, কেবল এক পাগলিনী দেফিলে সহমর্মী হয়ে সে দায়িত্বপালন করে, ১৮০৬।

ক্রিস্তফ তার দলবল নিয়ে হাইতির উত্তরাংশে গিয়ে নিজেকে রাজা দাবি করে বসলেন। বনেদী পদবীগুলি দেয়া শুরু করলেন কাছের মানুষদের। প্রজাদের শিক্ষাদীক্ষায় অবশ্য তার মনোযোগ ছিল। রাজধানী ল্যকাপে একটা মেডিকাল স্কুলও চালু করেন তিনি।

প্রাক্তন গৃহপালিত চাকর, আর এখন রাজা, ক্রিস্তফ বিশাল সঁসুসি প্রাসাদ তৈরি করেন। আরো তৈরি হয় সিতাদ্যাল লাফেরিয়ের বলে এক দুর্ভেদ্য দুর্গ। ইউরোপীয় পর্যবেক্ষকরা লিখে যান, শেকলপরা কৃষ্ণাঙ্গ ‘দাসের দল’ কঠোর পরিশ্রম করে নাকি এগুলি তৈরি করেছে। হাজারে হাজারে নাকি মারাও গেছে সে কাজে। ‘দাস’ কথাটা সম্ভবত সত্য নয়, কিন্তু ‘কোর্ভে লেবার’ বা সরকারের ‘উন্নয়নকাজে’ বাধ্যতামূলক শ্রমপ্রদানের ব্যাপারটা ক্রীতদাসপ্রথামুক্ত হাইতির সকল শাসকই সমানে ব্যবহার করেছেন। এ শ্রমিকরা বেতন পেত না, খুব একটা ভাল ব্যবহার তদারককারী সৈন্যদের কাছে পেতও না, বন্দুকের বাঁট কিংবা বেয়নেটের ব্যবহার চলত সমানে। আর লেবারক্যাম্পে বন্দীজীবন কাটাতে হত।

উত্তর হাইতির রাজা অঁরি ক্রিস্তফ (জীবৎকাল: ১৭৬৮-১৮২০, শাসনকাল: ১৮১১-২০)।
সিতাদ্যাল দ্যফেরিয়ের ক্রিস্তফের আদেশবলে তৈরি করে কৃষ্ণাঙ্গ ‘দাসের দল’, এটি এখনো একটি পর্যটন আকর্ষণ।
রাজা ক্রিস্তফের রাজ্যে প্রচলিত মুদ্রা, ১৮২০।

ওদিকে পেতিওঁ দ্বীপের দক্ষিণে গিয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন হাইতি প্রজাতন্ত্র। সেখানে সেনেটের সাথে ভাগবাটোয়ারা করেই শাসন শুরু করলেন, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে শাসনতন্ত্র পরিবর্তন করে সেনেটরদের মনোনয়নের ব্যাপারটা নিজের এখতিয়ারে নিয়ে আসলেন। বিরুদ্ধমতের সেনেটরদের কূটচাল চেলে সরিয়ে দিলেন। তবে প্রজাতন্ত্রের সকল পুরুষকে ভোটাধিকার দেয়া হল।

কর ও ভূমিসংস্কারও দক্ষিণে কিছুটা হলো। প্রথমে খামারব্যবস্থা চালু থাকলেও জনগণের দাবির মুখে বড় জমি ভাগ করে বিলিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু পেতিওনের সৈন্যরাই এসব সুবিধার ভাগীদার হল। তাদের মালিকানার জমিতে ভাড়াটে হিসাবে চাষাবাদ করত গরিব ভূমিদাস চাষী।

পেতিওঁ দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন স্প্যানিশ কলোনির স্বাধীনতাকামী নেতাদেরকেও সাহায্য করতে শুরু করলেন। এভাবে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে সিমন বলিভারের সাথে। এতে অবশ্য হাইতির সাধারণ করদাতার টাকাপয়সাই খরচ হলো।

দক্ষিণ হাইতির প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি আলেকসন্দ্র পেতিওঁ (জীবৎকাল: ১৭৭০-১৮১৮, শাসনকাল: ১৮০৭-১৮১৮)।

উত্তর-দক্ষিণের দুই রাজ্যই অবশ্য ভূরাজনৈতিক অঙ্গনে সেসময়কার যুক্তরাষ্ট্রের মতই একরকম অচ্ছুৎ ছিল। ইউরোপীয়দের কাতারে যোগদানের জন্যে পেতিওঁ-ক্রিস্তফ দুজনই বেশ মুখিয়ে ছিলেন। কৃষ্ণাঙ্গরা রাষ্ট্রপরিচালনায় কোন অংশে কম নয়, এটা দেখাতে অবশ্য পেতিওনের থেকে ক্রিস্তফ বেশি আগে বাড়া ছিলেন, তাই অর্থনীতির খাতিরে খামারব্যবস্থাকে আগের মত রেখে দেন।

দুই হাইতিতেই এসময় যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা মুক্ত কালোদের অভিবাসন চলে। একই সময়ে পশ্চিম আফ্রিকার লাইবেরিয়ারও গোড়াপত্তন হয় — আগে লিখেছি এ নিয়ে। এভাবে হাইতিতে একটা মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল। তবে মার্কিন থেকে আসা কালো কৃষক ও কারিগরদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই হাইতিতে খাপ না খাওয়াতে পেরে ফিরে যায়। এর মূল কারণ ছিল ভূমিদাসপ্রথা আর পাসপোর্টছাড়া মুক্ত যাতায়াতের অভাব।

১৮২০ সালে উত্তরে রাজা ক্রিস্তফ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর প্রজা আর দরবারের অভিজাত উভয়েরই সমর্থন এতদিনে মিইয়ে এসেছে। তাঁর অসুস্থতার সুযোগে অভ্যুত্থানের মুখে ক্রিস্তফ আত্মহত্যা করেন। কিছুদিনের মধ্যে দক্ষিণের প্রজাতন্ত্রের সৈন্যরা উত্তরের নেতৃত্বহীন সেনাবাহিনীকে হারিয়ে দুই হাইতিকে আবার একত্রিত করে।

ততদিনে দক্ষিণে পেতিওনের মৃত্যু হয়েছে। আর সেখানে ক্ষমতাসীন তারই সহচর জেনারেল বোয়াইয়ের। শুধু উত্তর-দক্ষিণ হাইতি নয়, প্রতিবেশী ডমিনিকান রিপাবলিকের স্প্যানিশবিরোধী স্বাধীনতাসংগ্রামের সুযোগে সে দেশেও দখলদার সৈন্য পাঠিয়েছেন তিনি। এভাবে দুই দশকের জন্যে পুরো হিসপানিওলা দ্বীপটি একই রাষ্ট্রের দখলে আসে।

পেতিওনের উত্তরসূরী জেনারেল জঁপিয়ের বোয়াইয়ের (জীবৎকাল: ১৭৭৬-১৮৫০, শাসনকাল: ১৮১৮-৪৩)। একনায়কতন্ত্র চালান দেশে।

বোয়াইয়েরের শাসনামল ছিল প্রজাতন্ত্রের নামে একনায়কতন্ত্র। সংসদ ছিল কেবল রাষ্ট্রপতির আদেশাবলীতে সীল-ছাপ্পর মারার জন্যে। নিজেকে আজীবন রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন তিনি। প্রদেশগুলির শাসনভার ছিল সেনাসামন্তদের হাতে। প্রতিবাদ-বিরুদ্ধাচারের কোন সুযোগই ছিল না, ধরপাকড় আর বিরোধীদের ফায়ারিং স্কয়াডে মৃত্যুদন্ডপ্রদান চলত নিয়মিত। শিক্ষাক্ষেত্রেও পিছিয়ে পড়ে হাইতি। ক্রিস্তফের গড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ হয়ে যায়। সারা হাইতিতে এসময় ছিল মোটে দশটা পাবলিক স্কুল। আর প্রাইভেট স্কুলগুলিও জোর করে বন্ধ করে দেয়া হয়। বোয়াইয়েরের হিসাবে, শিক্ষা মানেই বিপ্লব আর ক্ষমতার গদি ধরে টানাটানি।

কিন্তু এভাবেই ১৮৪৩এ আরেকটা বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। শহুরে মধ্যবিত্ত গ্রাম্যসমাজ আর ডমিনিকান রিপাবলিকের স্বাধীনতাকামী গুপ্তসংস্থার সাথে যোগ দিয়ে বোয়াইয়েরকে তাঁড়াতে সক্ষম হয়। এই ডামাডোলের সুযোগে ডমিনিকান রিপাবলিক হাইতি থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ডমিনিকানরা হাইতিতে খুব একটা সুখে ছিল না। বিশেষত সেখানে প্রচুর শ্বেতাঙ্গের বসবাস ছিল, হাইতির রাষ্ট্রতন্ত্র অনুযায়ী তারা ছিল সম্পত্তির মালিকানা থেকে বঞ্চিত।

হাইতির নতুন উদারপন্থী সরকার আরেকটা সংবিধান রচনা করল। কিন্তু হাইতির প্রবাদেই রয়েছে, ‘শাসনতন্ত্র ছাঁপানো কাগজে, আর বেয়নেট তৈরি ইস্পাতে!’ সরকার যতই সংস্কারপন্থী হোক না কেন, ক্ষমতায় আসামাত্র গদি পাকাপোক্ত করতে তারা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। নতুন সরকারের ওপর রক্ষণশীল সেনাবাহিনীর চাপ এক দিক থেকে, আরেকদিকে গ্রাম্য পপুলিস্ট মিলিশিয়াও দাঁড়িয়ে গেছে শহুরে এসট্যাবলিশমেন্টের প্রভাবের বিরুদ্ধে। এসকল বিদ্রোহ-বিপ্লবেই কেটে যায় কয়েক বছর।

শেষমেষ ১৮৪৭এ আপোষের ভিত্তিতে কৃষাঙ্গ বয়োবৃদ্ধ রাজনীতিবিদ ফাউস্ত্যাঁ সুলুককে রাষ্ট্রপতি হিসাবে গ্রহণ করে নেয় বিবাদমান দলগুলি। তারা ভেবেছিল, নমনীয় কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট দোআঁশলা এলিটদের কথা যেমন শুনবেন, তেমন গ্রামাঞ্চলের কৃষ্ণাঙ্গ জনসাধারণও তুষ্ট হবে স্বগাত্রবর্ণের নেতা পেয়ে।

কিন্তু এদের সব পরিকল্পনা ভন্ডুল করে দিলেন সুলুক — ১৮৪৯এ তিনি হয়ে বসলেন হাইতির দ্বিতীয় সম্রাট! এবার বোধহয় তাঁর রাস্তা ধরেই ১৮৫১তে ফ্রান্সের সম্রাট বনলেন তৃতীয় নাপোলেওঁ। নাপোলেওঁকে নিয়ে সরাসরি হাস্যকৌতুক করতে বাঁধা থাকায় ফরাসী থিয়েটারে সম্রাট সুলুক তাঁর স্থানপূরণ করেন! সুলুকের দরবারের হাস্যকর সব পদবীর অভিজাত, যেমন ডিউক অফ লেমনেড আর ডিউক অফ মারমালেডের কথোপকথন শুনে ফরাসীরা নাপোলেওনকে স্মরণ করেই হেসে গড়িয়ে পড়ত।

হাইতির দ্বিতীয় সম্রাট ফাউস্ত্যাঁ সুলুক (জীবৎকাল: ১৭৮২-১৮৬৭, শাসনকাল: রাষ্ট্রপতি, ১৮৪৭-৪৯, সম্রাট, ১৮৪৯-৫৯)।
ফ্রান্সের সম্রাট তৃতীয় নাপোলেওঁ সুলুকের মতই প্রথমে ছিলেন রাষ্ট্রপতি (১৮৪৮-৫২), তারপর সম্রাট (১৮৫২-৭০)।

ক্রিস্তফ-পেতিওঁ-বোয়াইয়ের-সুলুক সবার আমলেই হাইতিতে অ্যাবলিশনিস্টদের যাতায়াত হয়েছে। এরা সকলেই হাইতির স্বাধীনতাপরবর্তী অবস্থা দেখে যারপরনাই বিব্রত হয়েছেন। দাসপ্রথা যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যে অবশ্যপ্রয়োজনীয় নয়, তা প্রমাণ করতে গিয়ে উল্টো চিত্র দেখেন তারা। ক্যারিবিয়ানের অন্যান্য দ্বীপের দাসদের থেকে হাইতির কৃষ্ণাঙ্গদের অর্থনৈতিক অবস্থা এমন কিছু ভাল হয়নি। পঞ্চাশ বছর আগে ফরাসীদের ছেড়ে যাওয়া চিনির খামার আগাছাভরা। মানুষজন গাত্রাচ্ছাদন ছাড়াই ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের বাসস্থান কুঁড়েঘরে, ইত্যাদি। সামান্য মুক্তি পেয়ে তারা সুখী বটে কিন্তু নিজেদের বৈষয়িক উন্নতির কোন চিন্তা তাদের নেই।

তাদের এ পর্যবেক্ষণ অবশ্য সম্পূর্ণ নয়। হাইতির শুরুতে নগর ও গ্রামের বৈষম্যের বীজ রোপিত হয়েছিল। তার ফলে কৃষিখামারে উৎপন্ন শস্য রপ্তানি থেকে উপার্জিত রাজস্বে শহুরে ফরাসীভাষী মানুষ উন্নতি করেছে। আর ক্ষতি হয়েছে ক্রেওলভাষী কৃষ্ণাঙ্গ চাষাদের। বাণিজ্যে করারোপ করেই হাইতির রাষ্ট্রপরিচালনার সিংহভাগ খরচ উঠত, আর ১৮৮১ নাগাদ এই নির্ভরতা গিয়ে ঠেকে ৯৮ শতাংশে। অর্থাৎ শহুরে বণিকগোষ্ঠীর সমৃদ্ধি যুগিয়েছে খামারের ভূমিদাস কৃষক। এদের উপার্জন একদিকে কমেছে, আর ভোগ্যপণ্যের খরচ বেড়েছে। খামারে কাজ করার পাশাপাশি রাস্তাঘাট তৈরি আর অন্যান্য সরকারী উন্নয়ন প্রকল্পেও চাষাদের জোর করে কাজে লাগানো হত। সরকারী চাকুরে বা খামারের শ্রমিক না হলে যে কারো গ্রেপ্তার ও খামারে সোপর্দ ছিল অনিবার্য।

হাইতি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত ছিল সামরিক বাহিনী আর শহুরে উচ্চমধ্যবিত্তের হাতে, এদের অধিকাংশ ছিল মুলাটো বা দোআঁশলা বর্ণের। গ্রামের মানুষের সাথে এদের ছিল বিস্তর ফারাক।
গ্রাম্য হাইতিয়ানদের ভুডু ধর্মকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা হত শহুরে সমাজে। সরকারের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও গ্রামের মানুষ ভুডু চর্চা করত। এরা নাকি নরবলি দিত। এ চিত্রে ১৮৬৪ সালের একটি চাঞ্চল্যকর ভুডু নরবলির মামলার গ্রেপ্তারকৃত আসামীদের দেখানো হয়েছে।
হাইতির গ্রাম্যসমাজে লাকু বা পঞ্চায়েতব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষ সরকারের চোখের আড়ালে নিজেদের স্বাধীন জীবনযাত্রা চালিয়ে যায়।

নগরভিত্তিক সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে বাঁচতে অভিনব পদ্ধতি বের করে হাইতির গ্রামগুলি। ‘লাকু্’ বলে একটা সিস্টেম তৈরি করে তারা, অনেকটা পঞ্চায়েতের মত। বড় যৌথ পরিবার নিয়ে ছোট আবাদী জমির মাঝে কুঁড়েঘরের গ্রুপ বানিয়ে তারা থাকত। সরকারী খামারে নামমাত্র কাজ করে এসে নিজ জমিতেই কফি-তামাক ফলাত, সেসবের একাংশ বেঁচত নিজেদের আভ্যন্তরীণ বাজারে, বাকিটা নিকটস্থ বন্দরশহরে। সরকার ঘুণাক্ষরেও জানতে পারত না লাকুর বার্টার ইকনমিতে কি পরিমাণ শ্রম আর রাজস্ব ফাঁকি যাচ্ছে। বাধ্যতামূলেক শ্রমের ডাক পড়লেও সেখানে না গিয়ে কাছের পাহাড়ে লুকিয়ে থাকত গ্রামবাসী।

এভাবে স্বদেশের শোষক সরকারই হয়ে দাঁড়ায় হাইতিবাসীর মূল প্রতিপক্ষ। কিন্তু নিজেরাই একটা লিবার্টারিয়ান-এগালিটারিয়ান সমাজ তৈরি করে ফেলে হাইতিবাসী, বাইরের সাহায্য ছাড়াই। সরকার থেকে নিষেধ থাকা সত্ত্বেও লাকুগুলিতে ভুডু ধর্মের চর্চা চলতে থাকে, ক্রেওল ভাষাও উত্তরোত্তর জনপ্রিয়তা পেতে থাকে।

কিন্তু এ ব্যবস্থা ছিল বেশ প্রিমিটিভ আর ভঙ্গুর। সরকারের হাত হাইতিবাসীর করের পয়সাতেই আরো যত লম্বা হতে থাকল, তত তাদের যাতায়াত ও জীবনযাপনের স্বাধীনতা আরো সংকুচিত হতে শুরু করল। পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এই ক্ষণস্থায়ী কার্যকরী সমাজব্যবস্থা শীঘ্রই তাসের ঘরের মত ধ্বসে পড়বে উত্তাল সময়ের ঝড়ে।

হাইতি – ১, স্বাধীনতাসংগ্রাম, ১৭৯০-১৮১০

হাইতির ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক বিবরণী, বড় করে দেখার জন্যে ক্লিক করুন।

মানচিত্রে ক্যারিবিয়ান সাগরের দিকে নজর দিলে যে তিনটি বড় দ্বীপ প্রথমেই চোখে পড়বে, সেগুলি হলো কিউবা, জামেইকা আর হিস্পানিওলা। শেষটি অনন্য, কারণ একটি দ্বীপের মধ্যে দুটি রাষ্ট্র — পূর্ব ৫/৮ অংশে ডমিনিকান রিপাবলিক, আর পশ্চিম ৩/৮ অংশে হাইতি।

হাইতি অনেক দিক থেকেই বাকিদের থেকে আলাদা। দুনিয়ার মানুষ তাকে চেনে ভুডু ম্যাজিকের আখড়া হিসাবে। তাছাড়াও এ অঞ্চলের অল্প যে কটি দেশে ফরাসী ভাষা চলে, হাইতি তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। দোআঁশলা ক্রেওল ভাষাও এখন সরকারী স্বীকৃতিপ্রাপ্ত।

হাইতির যাত্রা শুরুও ব্যতিক্রমী। চিনি উৎপাদক ফরাসী উপনিবেশে ক্রীতদাসদের অভ্যুত্থান থেকে তার অভ্যুদয় অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগে। যুক্তরাষ্ট্রের পর পরই আমেরিকা মহাদেশে দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জনকারী রাষ্ট্র হাইতি।

হাইতির জনসংখ্যার অধিকাংশ কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের বংশধর আর একটা বড় অংশ দোআঁশলা মুলাটো জাত। মূল আমেরিকান অধিবাসী উপজাতিগুলি কলোম্বাসের পদার্পণের কয়েক দশকের মধ্যে মহামারী আর যুদ্ধের কবলে বিলুপ্ত হয়ে যায়।

১৭৯১এ শুরু স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে এখন পর্যন্ত হাইতি প্রচুর উত্থানপতন দেখেছে। দেখেছে জনসংগ্রাম আর যুদ্ধের মুখে দুজন সম্রাট আর ডজনখানেক রাষ্ট্রপতির অপসারণ। পার্শ্ববর্তী দেশ ডমিনিকান রিপাবলিককে দখল করে রেখেছে কয়েক বছর। আর নিজে দখলীকৃত হয়েছে দু’বার।

ক্যারিবিয়ানের অন্যান্য কৃষ্ণাঙ্গপ্রধান দ্বীপরাষ্ট্রের সাথে তুলনা করলে আজকের হাইতি বিফল রাষ্ট্র বলা চলে। হাইতি যে উচ্চাভিলাষ নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল, তার থেকে ক্রমাগত দূরে সরে গেছে। পশ্চিম গোলার্ধের দরিদ্রতম দেশ হাইতি। এমনকি পর্যটনের আকর্ষণ প্রতিবেশী দেশ ডমিনিকান রিপাবলিকের মানুষের মাথাপিছু আয় হাইতির পাঁচ-ছয় গুণ — যদিও দেশ দুটি প্রায় একই ধরনের ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে গেছে।

পঞ্চাশের দশক থেকে আশির দশক পর্যন্ত পাপাডক-বেবিডকের পরিবারতান্ত্রিক স্বৈরাচারী শাসনের পরবর্তী অরাজকতা আর ২০১০এ ৭ রিখটারের সর্বনাশা ভূমিকম্পের পর জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর সাথে বাংলাদেশী সেনাদলও হাইতিতে গিয়েছিল। সেখানকার অভিজ্ঞতা যে খুব একটা সুখপ্রদ নয়, এটা শান্তিরক্ষীদের অসামাজিক কর্মকান্ড নিয়ে একটি সাম্প্রতিক রিপোর্টে উঠে এসেছে। শ্রীলংকা সরকার একটি ক্ষেত্রে আর্থিক ক্ষতিপূরণও দেয়।

অর্থাৎ দেশটা এমন হয়ে গেছে যেখানে অমানবিকতা প্রতিদিনকার ব্যাপার। সেখানে বিদেশীরা বেশিদিন থাকলে তাদেরও অধঃপতন অবশ্যম্ভাবী।

কিভাবে হাইতি এমন অবস্থায় এসে পড়লো, তাই নিয়ে পাঁচখন্ডের এবারের সিরিজ।

প্রথম পর্ব: স্বাধীনতাসংগ্রাম, ১৭৯০-১৮১০

দ্বিতীয় পর্ব: রাষ্ট্রনির্মাণ, ১৮১০-১৮৬০

তৃতীয় পর্ব: আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, ১৮৬০-১৯১০

চতুর্থ পর্ব: দখলদার মার্কিন, ১৯১০-৫০

পঞ্চম পর্ব: রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, ১৯৫০-


হিস্পানিওলা নামের যে দ্বীপটিতে হাইতি অবস্থিত, ১৪৯২ সালে আমেরিকা অভিযানের শেষভাগে কলোম্বাস সেখানে অবতরণ করেন। কলোনিস্থাপনের প্রথম কয়েক দশকে আদিবাসীরা স্প্যানিশদের সাথে সংঘর্ষে, মহামারীতে আর দাসত্বশৃংখলের কঠোর পরিশ্রমে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ধীরে ধীরে স্প্যানিশদের মনোযোগ মূল ভূখন্ডের দিকে যত বেশি নিবিষ্ট হয়, হিস্পানিওলার সান্তো দোমিংগো কলোনির গুরুত্ব তত কমতে থাকে। সপ্তদশ শতকের শেষ নাগাদ দ্বীপটির পশ্চিমাংশ থেকে স্প্যানিশরা সরে যায়, তার জায়গা নেয় ফরাসী-ইংরেজ জলদস্যুরা। এই জলদস্যুদের রাস্তা ধরেই ফ্রান্স পশ্চিম হিস্পানিওলার পূর্ণ দখল নেয় ১৬২৫ সালে।

কলাম্বাসের হিস্পানিওলাতে অবতরণের দৃশ্য উডকাট করেছেন ডাচ শিল্পী থিওডর দ্য ব্রি, ১৫৯৪
ক্যারিবিয়ানের ফরাসী বাকেনিয়ার (জলদস্যু) ফ্রঁসোয়া লোলোনোয়া স্প্যানিশ জাহাজ লুটতরাজ করতেন, ১৬৮৪ সালের চিত্র

নতুন নামকৃত স্যাঁ-দোম্যাঙ্গ উপনিবেশটি ফরাসীদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পত্তিতে পরিণত হয়। ক্যারিবিয়ানের গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলবায়ুতে আখ, তামাক, কফি ইত্যাদি অর্থকরী শস্যের চাষাবাদ ও ফলন ভালই হয়। স্যাঁ-দোম্যাঙ্গের খামারে খাঁটুনির কাজের জন্যে হাজারে হাজারে আফ্রিকান ক্রীতদাস আনা শুরু হয়।

ফরাসীরা ক্রীতদাসদের অমানবিকভাবে খাঁটাত। অন্যান্য ইউরোপীয় উপনিবেশগুলিতে ক্রীতদাসরা কিছুটা হলেও মূল্য পেত। কিন্তু ফরাসী রাজতন্ত্রের সেকেলে নিয়মে ক্রীতদাসরা বলতে গেলে ছিল একটিবার ব্যবহারের পণ্য। ফলে প্রতি বছর স্যাঁ-দোম্যাঙ্গে হাজার হাজার জওয়ান ক্রীতদাস মৃত্যুবরণ করত। ১৭৯০ সাল নাগাদ সেখানে ছিল প্রায় পাঁচ লাখ দাস আর হাজার পঞ্চাশেক ফরাসী শ্বেতাঙ্গ খামার মালিক।

আরো একটি ‘বর্ণ’ ছিল, যাদের নাম মুলাটো বা মিশ্রজাত। আর ছিল অল্প কিছু মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গ। এরা মূলত কারিগর, খেতশ্রমিকের তদারককারী, পুলিশ, পেয়াদা, ইত্যাদি অবকাঠামোভিত্তিক পেশায় জড়িত ছিল।

স্পেনের আমেরিকান কলোনিগুলিতে শ্বেতাঙ্গ খামারমালিকের সাথে কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের মিলনে প্রচুর মুলাটো বা মিশ্র সন্তানের জন্ম হয়, কারণ ভদ্র পরিবারের ইউরোপীয় মেয়েরা সাধারণত আমেরিকায় যেতে চাইত না, ১৭৭৫এর ‘কাস্তা’ চিত্র, স্প্যানিশ চিত্রকার ফ্রান্সিস্কো ক্লাপেরা, ১৭৪৬-১৮১০, ডেনভার আর্ট মিউজিয়াম
১৮২৩ সালে ক্যারিবিয়ান সাগরের দ্বীপ অ্যান্টিগাতে ক্রীতদাসদের আখ খামারে কাজ করার অ্যাকুয়াটিন্ট বানিয়েছেন ব্রিটিশ শিল্পী উইলিয়াম ক্লার্ক

ফ্রান্সে ১৭৮৯ সালে রক্তক্ষয়ী বিপ্লব শুরু হয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে রাজা-রাজড়া আর অভিজাত বংশগুলির শোষণের প্রতিবাদে জেগে ওঠে পেশাজীবী মধ্যবিত্ত থেকে দরিদ্র কৃষক। বাস্তিল দুর্গের পতন হয়। রাজা ষোড়শ লুইকে প্রথমে গদি ছাড়তে হয়, তারপর তার আর রাণী মারি অঁতোয়ানেতের গর্দান যায় গিলোটিনে। দশ বছরব্যাপী অন্তর্ঘাতে নিমজ্জিত হয়ে যায় ইউরোপের শক্তিশালী দেশটি।

এই অরাজকতার সুযোগ নিয়ে স্যাঁ-দোম্যাঙ্গের অবস্থাপন্ন মুলাটো ও মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গ যারা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক, তারা আরো রাজনৈতিক অধিকার দাবি করে বসে। প্রথমে তাদের লক্ষ্য স্বাধীন দেশ কিংবা দাসপ্রথার উচ্ছেদ ছিল না। এমনকি এদের অনেকে কালে খামার মালিক বনেছে, দাসদেরও মনিব হয়েছে, তুলা-নীল-কফি রপ্তানী করে বেশ সম্পদশালী হয়েছে। কিন্তু রক্ষণশীল রাজতন্ত্রবাদী ফরাসী খামারমালিকদের প্রশাসন তাদের দাবি প্রত্যাখ্যান করলে, এরা হাত মেলায় সাধারণ কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের সাথে।

এই দাসরা কিন্তু আফ্রিকার আবাসভূমিতে ছিল সশস্ত্র যোদ্ধা! আফ্রিকার গৃহযুদ্ধগুলিতে পরাজিত হবার পর শত্রুরা এদেরকে বেচে দিয়েছিল ইউরোপীয়দের কাছে। এসকল কৃষ্ণাঙ্গ যোদ্ধাদের সাহায্যে একটা শক্তিশালী সামরিকতন্ত্র দাঁড়া হয়ে যায় স্যাঁ-দোম্যাঙ্গে।

১৭৯৪ সালে ফরাসী জনতা তাদের প্রাক্তন রাজা ষোড়শ লুইকে গিলোটিনে মৃত্যুদন্ড দেয়, লুই ব্লঁ-এর ইস্তোয়ার দ্য লা রেভোল্যুসিওঁ বইএর এনগ্রেভিং
হাইতির ১৭৯৩ সালের রক্তাক্ত বিপ্লবের চিত্র দেখানো হয়েছে ১৮২০ সালের ফরাসী বইয়ে
১৮৩৩ সালে ফ্রঁস মিলিতের বইয়ে অংকিত হাইতি বিপ্লবের হত্যাকাণ্ডের চিত্র

স্যাঁ-দোম্যাঙ্গে ত্রিমুখী গোলমাল চলে ১৭৯১ থেকে ১৮০৪ পর্যন্ত। প্রথমে কৃষ্ণাঙ্গসংগ্রামের একক কোন নেতা ছিল না। বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন দল একেক প্রদেশে স্বাধীন শাসন কায়েম করে বসেছিল। ক্রমে এদের নেতা হিসাবে আবির্ভূত হন তুস্যাঁ লুভেরত্যুর নামে এক মুক্ত মুলাটো। বাল্যকালে দাসত্ব থেকে মুক্তি পাবার পর কোচচালক পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। তারপর শিক্ষিত হয়ে নিজেই খামার দেন, দাস পালেন। বিপ্লবের সময় বিদ্রোহী সেনাপ্রধান হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। স্বাধীন হাইতির প্রতিষ্ঠাতা ধরা হয় লুভেরত্যুরকেই।

১৮০৪/০৫ সালে ফরাসী শিল্পী জিরার্দ্যাঁর আঁকা তুস্যাঁ ল্যুভেরতুরের পোর্ট্রেট

১৭৯৪ সালে ফ্রান্সে প্রজাতন্ত্রবাদীরা ক্ষমতাদখল করে ফরাসীশাসিত সকল দেশে দাসপ্রথা রদ করে দেয়। বিদ্রোহী লুভেরত্যুর তখন পক্ষপরিবর্তন করে ফরাসী সরকারের গভর্নর হিসাবে নামেমাত্র ফরাসীঅধীন কলোনিটির শাসনভার দখল করেন। প্রজাতন্ত্রবিরোধী খামার মালিকদের প্রতিরোধযুদ্ধ তখনও চলছিল। তাদের আহ্বানে ব্রিটিশ নৌবাহিনী পাঁচ বছর স্যাঁ-দোম্যাঙ্গের অধিকাংশ এলাকা দখল করে রাখে।

কিছু দাসপ্রথাবিরোধী শ্বেতাঙ্গ অবশ্য লুভেরত্যুরের সাথে যোগ দেয়। লুভেরত্যুর ছিলেন সাদা-কালোর মধ্যে আপোষকামী, তাঁর অধীনে শ্বেতাঙ্গ সেনাপ্রধান ও সচিবও ছিল। সাদা বন্দীদের সাথে ভাল আচরণের উদাহরণও প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।

কিন্তু ফরাসী বিপ্লবের লাগাম টেনে ধরেন নাপোলেওঁ বোনাপার্ত স্বয়ং। ফ্রান্সে ১৭৯৯ সালে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে প্রথমে কনসাল ও পরে সম্রাট পদবী গ্রহণ করেন তিনি। স্যাঁ-দোম্যাঙ্গকে পুনরায় কব্জা করার জন্যে এক বিশাল নৌবাহিনী পাঠানো হয় ক্যারিবিয়ান সাগরে। তাদের সেনাপ্রধান লক্লের্কের চালাকির শিকার হয়ে লুভেরত্যুর ফ্রান্সে বন্দী হিসাবে প্রেরিত হন, সেখানেই মৃত্যু হয় তার। তার সহযোদ্ধা জঁ-জাক দেসালিন ও অন্যান্যরা উপায়ান্তর না দেখে নাপোলেওনের পক্ষে যোগ দেন আর লড়াই চালান স্বাধীনতাকামীদের বিরুদ্ধে।

অবশ্য নাপোলেওনের দাসপ্রথা পুনর্বহাল করার গোপন পরিকল্পনা যখন ফাঁস হয়ে যায়, তখন আবার দেসালিন পক্ষপরিবর্তন করেন। স্পেন ও ব্রিটেন থেকে আমদানি করা অস্ত্রের সাহায্যে কঠিন গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে ফরাসীদের ১৮০৩ সালে তাঁড়াতে সক্ষম হয় দেসালিনের সেনাদল। সে যুদ্ধের খরচ ওঠাতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে লুইজিয়ানা টেরিটোরির বিশাল ভূখন্ড বিক্রি করে দেয় ফ্রান্স।

১৮০৪ সালে ফরাসী জেনারেল নাপোলেওঁ বোনাপার্ত নিজের মাথায় নিজেই মুকুট পরে ফ্রান্সের সম্রাট বনে বসেন, জাক লুই-দাভিদের অংকিত চিত্র, ১৮০৮।
নাপোলেওনের পাঠানো সেনাদলের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত হাইতির সেনাদল। পেছনে মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গের নির্দেশনায় সামনে এগিয়ে যাচ্ছে সশস্ত্র দাসের দল, ১৮০৩। ১৮৩৯ সালে প্রকাশিত ইস্তোয়ার দ্য নাপলেওঁ বই থেকে
নাপোলেওনের পাঠানো সেনাদল প্রচন্ড নিষ্ঠুরতার সাথে মুক্তিকামী কৃষ্ণাঙ্গদের হত্যা করে, ১৮০০। ১৮০৫ সালে প্রকাশিত অ্যান ইস্টরিকাল অ্যাকাউন্ট অফ দ্য ব্ল্যাক এম্পায়ার অফ হেইতি বই থেকে।
নাপোলেওনের হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ হাইতির কৃষ্ণাঙ্গরাও নেয় খুব নৃশংসতার সাথে, ১৮০০। ১৮০৫ সালে প্রকাশিত অ্যান ইস্টরিকাল অ্যাকাউন্ট অফ দ্য ব্ল্যাক এম্পায়ার অফ হেইতি বই থেকে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

দেসালিন ১৮০৪ সালে স্বাধীনতা ঘোষণা করে স্যাঁ-দোম্যাঙ্গকে নতুন নাম দেন হাইতি। এ ছিল লোককথা অনুযায়ী দ্বীপটির জন্যে আমেরিকান আদিবাসীদের ব্যবহৃত নাম। দেসালিন লুভেরত্যুরের মত আপোষকামী ছিলেন না, তার আমলে হাজার হাজার শ্বেতাঙ্গ খামারমালিককে সপরিবারে হ্ত্যা করা হয়। গর্ব করে হাইতিকে ফরাসীদের সমাধি ডাকনাম দেন দেসালিন। কিছু শ্বেতাঙ্গ মিত্রের প্রতিরক্ষার নিশ্চয়তা অবশ্য দেয়া হয়।

স্বাধীন হাইতির গঠনতন্ত্রে দাসপ্রথা রহিত করার পাশাপাশি দেশের সকল নাগরিককে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘কৃষ্ণাঙ্গ’ ঘোষণা করা হয়, যদিও কিছু পোলিশ শ্বেতাঙ্গ সেনা অফিসারকে নাগরিকত্ব দেয়া হয়। আরো যে ধারাটি লেখা হয়, সেটি হাইতিকে অনেক দিন ভোগাবে। সেধারা হলো, হাইতিতে বহির্দেশীয়, বিশেষত শ্বেতাঙ্গ কারো সম্পত্তির মালিকানা নিষিদ্ধ।

দাসপ্রথা রহিত করা হলে কি হবে, লুভেরত্যুর-দেসালিন দু’জনই পূর্ববর্তী খামার ব্যবস্থাকে অটুট রাখেন! তাদের হিসাবে বড় প্ল্যান্টেশনের মাধ্যমে চিনি রপ্তানি করে অর্থনীতিকে সচল রাখতে না পারলে আবার হাইতির স্বাধীনতা বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়বে। আর বাকি বিশ্বকে দেখাতে হবে না, কৃষ্ণাঙ্গরা রাষ্ট্রপরিচালনায় কোন অংশে শ্বেতাঙ্গদের থেকে কম নয়?

স্বাধীন হাইতির প্রথম নেতা ও সম্রাট জঁ-জাক দেসালিন, পোর্তো প্র্যান্সের ম্যুরাল চিত্র
নাপোলেওনের সেনাবাহিনী থেকে বিদ্রোহ করে কৃষ্ণাঙ্গদের সাথে যোগ দেয় অধিকৃত পোল্যান্ডের সৈন্যদল, ১৮০০

 

 

 

 

 

 

 

 

ফরাসীদের কাছ থেকে লুইজিয়ানা টেরিটরি কিনে যুক্তরাষ্ট্রের আকার প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়, ১৮০৩

ফলশ্রুতিতে, সাধারণ কৃষ্ণাঙ্গরা ক্রীতদাস থেকে এবার পরিণত হলো ভূমিদাসে! খামার ছেড়ে অন্য কোথাও যাবার ও বসবাস করার অনুমতি এদের ছিল না। শহরে যেতে হলে তাদের লাগত পাসপোর্ট। খামার থেকে পালালে দেসালিনের পুলিশবাহিনী খুঁজে এনে আবার খামারে সোপর্দ করত। বলা বাহুল্য, খামারগুলোর মালিক তখন দেসালিনের সেনাবাহিনীর অফিসার আর সৈন্যের দল। আর যেসকল চাষী তাদের ক্ষুদ্র জমিতে স্বাধীনভাবে চাষাবাদ করত, তাদেরও যাতায়াতের স্বাধীনতা ছিল না। উৎপন্ন ফসলের এক-চতুর্থাংশ কর হিসাবে সরকারকে দিয়ে দিতে হত।

অন্যদিকে প্রজাদের উন্নয়নের জন্যে যে শিক্ষা আর অবকাঠামো যেকোন নতুন রাষ্ট্রের প্রয়োজন, তার দিকে কোন নজর দেসালিন দেননি। সাধারণ হাইতিয়ানদের জন্যে দরকার ছিল ভূমিসংস্কার আর বড় খামারগুলো ভেঙে ছোট স্বাবলম্বী চাষাবাদযোগ্য জমি তৈরি। সেসব না করার কারণে প্রাক্তন দাসরা লুভেরত্যুর আর দেসালিন দুজনের বিরুদ্ধেই সংগ্রাম করেছিল। এগুলি কঠোর হাতে দমন করেন দুজনেই।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও স্বীকৃতি অর্জন করতে ব্যর্থ হয় হাইতি। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলির সাথে প্রাইভেট সেক্টরে বাণিজ্য চললেও ফ্রান্স স্বাধীনতার স্বীকৃতি না দেয়ায় পাশ্চাত্যের বাকি সরকারগুলিও একই পথ অবলম্বন করে। বিশেষ করে ‘অগ্রজ’ যুক্তরাষ্ট্রের এহেন আচরণে সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত হয়ে পড়ে হাইতির শাসকগোষ্ঠী। ‘স্লেভ লেবারের’ ব্যবহারে উৎপন্ন চিনি-কফির রপ্তানির পয়সায় দেসালিন বিপুল অস্ত্রশস্ত্র কিনেন, আর স্থানে স্থানে দুর্গ তৈরি করা হয় ভবিষ্যত কোন এক যুদ্ধের প্রতিরক্ষার জন্যে।

স্বাধীনতার পর হাইতির শহুরে জনগণ কয়েক বছর উৎসব করে। গ্রামের কর্মঠ কৃষক জনগণের থেকে এদের দূরত্ব ক্রমশ বাড়তে থাকে।
স্বাধীনতার পর খামার বা প্ল্যান্টেশন ব্যবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। ক্রীতদাসরা পরিণত হয় ভূমিদাসে, তাদের খামারের নতুন মালিক বনে দেসালিন-লুভেরত্যুরের অনুগত সেনা অফিসাররা। আর তাদের খাঁটনির পয়সায় সরকার সারা দেশে গড়ে তোলে অনেকগুলি অস্ত্রাগার ও দুর্গ।

এভাবে হাইতির সামরিকতান্ত্রিক শাসকগোষ্ঠী আর প্রাক্তন দাস প্রজাদের মধ্যে একটা বিশাল দূরত্ব তৈরি হতে থাকে। সাধারণ হাইতিয়ানরাও সন্দেহবাতিকে ভুগতে শুরু করে, যুক্তরাষ্ট্র বা ফ্রান্সকে নিয়ে নয়। নিজের স্বাধীন জীবনাচরণ নিয়ে, আর তাতে ক্রমাগত স্বৈরাচারী রাষ্ট্রের নাকগলানো নিয়ে।

দেসালিনের ইচ্ছে ছিল দুনিয়াবাসীকে দেখিয়ে দেবেন যে কৃষ্ণাঙ্গরা রাজনীতি-অর্থনীতি ও কর্মক্ষেত্রে শ্বেতাঙ্গদের থেকে কোন অংশেই কম নয়। কিন্তু তার এই তত্ত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে জনসাধারণের যে স্বাধীনতাটা বিসর্জন দিতে হলো, তাই হাইতির অরিজিনাল সিন। আর সেই পাপের ভার আরেক দফা বাড়ালেন দেসালিন নিজেই — হাইতির স্বাধীনতার নয় মাসের মাথায় নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করে!

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!