সমাজতন্ত্রী শিল্পায়নের সমাজতান্ত্রিক জটিলতা


গত দুটি পোস্টে (, ) বলেছি সোভিয়েত ইউনিয়নকে দুর্যোগের সময় কিভাবে বিশাল সহায়তা করে মার্কিন সরকার ও পশ্চিমা কম্পানিগুলি। শেষ খন্ড বলা বাকি আছে। তবে আলোচনার এ পর্যায়ে একটা সেগোয়ে করতে চাই। সোভিয়েত প্রযুক্তিবিপ্লবের অর্থসংস্থান কোত্থেকে কিভাবে হল? আর কতটুকুই সফলকাম হয় সোভিয়েতরা?

স্তালিনের দাবি ছিল, তিনি নাকি রুশ জনতাকে খুঁজে পান জমিতে কাঠের লাঙল দিয়ে চাষাবাদরত, আর তাদের রেখে যাচ্ছেন পারমাণবিক চুল্লীর মালিক হিসাবে। এটা বাস্তবিক কথা নয়। রুশ বিপ্লবের আগেই ৎসারপন্থী রাশিয়ায় শিল্পায়ন চলছিল। পশ্চিমা দেশগুলির তুলনায় মাথাপিছু আয় কম হলেও স্টীল উৎপাদনে রাশিয়ার স্থান ছিল বিশ্বের চার নম্বর। বিপ্লব ও যুদ্ধের ডামাডোল আর তারপর কম্যুনিস্টদের অনভিজ্ঞ বাস্তবতাবিবর্জিত অর্থনৈতিক পরিকল্পনার কারণেই ৎসার আমলের শিল্পগুলি জীর্ণ দশায় নিপতিত হয়। সেসব ঘটনা না ঘটলে ৎসারের সিস্টেমে রাশিয়া শিল্পায়িত হতে পারত।

ৎসারের আমলের রুশ টেক্সটাইল মিল, ১৯০৫

মার্কিন সাহায্যে লব্ধ স্তালিনী শিল্পায়নের জন্য যে সোভিয়েত জনগণকে মূল্য দিতে হয়নি তা কিন্তু নয়! মার্কিন প্রকৌশলীদের উচ্চ বেতন দেয়া হত কিভাবে, সেটা আন্দাজ আছে কারো?

মস্কোতে নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিনিধি ডুরান্টির মত পুলিৎজারবিজয়ী সাংবাদিক যখন সোভিয়েতদের প্রগতির প্রশংসায় পঞ্চমুখ, তখন গ্যারেথ জোনস নামে এক ব্রিটিশ সাংবাদিক সোভিয়েতদের চোখ এড়িয়ে চলে যান ইউক্রেনের গ্রামাঞ্চলে। সেখানে দেখেন আরেক মহাদুর্ভিক্ষের চিত্র, যেটি আজও হলোদমর নামে স্বীকৃত। কিন্তু আগের মত কোন সহায়তার অনুরোধ যায়নি সেবার। ৫০ লাখের মত মানুষ তাতে মারা যায়। এর কারণ, ইউক্রেনের ঊর্বরভূমির খাদ্যশস্য কৃষকদের থেকে জোর করে কেড়ে শহরের শিল্পায়নরত শ্রমিকদের খাওয়াচ্ছে স্তালিন সরকার, নয়ত রপ্তানি করেছে। উদ্দেশ্য, ঐ শিল্পায়নের মূলধন জোগাড়।

নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক ওয়াল্টার ডুরান্টি। ত্রিশের দশকে সোভিয়েত প্রগতিশীলতার ওপর রিপোর্ট লিখে পুলিৎজার জিতেন। কিন্তু সোভিয়েত শোষণের বিরুদ্ধে লেখেননি কিছু।
কিয়েভের নিকট গৃহহীন ইউক্রেনীয় কৃষক, ১৯৩৪
ইউক্রেনের পলতাভার নিকট দুর্ভিক্ষে মৃত নারী, ১৯৩৪
খার্কিভের রাস্তায় এসে স্থান নিয়েছে দুর্ভিক্ষপীড়িত ইউক্রেনীয় কৃষক, ১৯৩৩
ব্রিটিশ সাংবাদিক গ্যারেথ জোনসের ১৯৩৩ সালের ইউক্রেনীয় হলোদমর দুর্ভিক্ষের ওপর রিপোর্ট, ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকা
ব্রিটিশ সাংবাদিক গ্যারেথ জোনস, ১৯৩৩-৩৪এ ইউক্রেনীয় হলোদমর দুর্ভিক্ষের ওপর রিপোর্ট করেন। কম্যুনিস্ট সরকার এ দুর্ভিক্ষের কথা অস্বীকার করে।

তাছাড়া শিল্পায়নে ব্যবহৃত রুশ শ্রমিকদের একটা বিশাল অংশ ছিল অনৈচ্ছিক শ্রমিক। অনেকে ছিল গুলাগের রাজনৈতিক বন্দী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও অধ্যাপক। এসকল শ্রমে অনভিজ্ঞ মানুষ হাজারে হাজারে মারা যায় স্তালিনের প্রকল্পগুলিতে কাজ করতে গিয়ে।

কারখানার শ্রমিকদের ওয়ার্কিং ও লিভিং কন্ডিশন এমন ছিল যে সেটা ব্রিটেনের শিল্পায়নের যুগের ডিকেনজিয়ান ডিসটোপিয়াকেও হার মানায়। সাধারণ শ্রমিকরা নিয়ম না মানলে তাদের আইনসিদ্ধ শাস্তি ছিল ভয়াবহ। কিন্তু সরকারের মালিকানায় পরিচালিত কারখানায়গুলো থেকে শ্রমিকরা অন্যত্র গেলে কাজ করবে কে? কেন্দ্রীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা তো ভেস্তে যাবে। এ কারণে ১৯৩২ সাল থেকে স্তালিন ইন্টারনাল পাসপোর্ট সিস্টেম চালু করেন। দেশের এক শহর থেকে আরেক শহরে গেলে অনুমতি ব্যতিরেকে যাওয়া অসম্ভব। আয়রনির ব্যাপার হল, ৎসারের সময়ে শেষ এ সিস্টেম চালু ছিল, লেনিন এই আইনকে পশ্চাদমুখী স্বৈরাচারী ইত্যাদি অভিধা দিয়ে উঠিয়ে দিয়েছিলেন। শ্বেত ৎসার নিকোলাসের জায়গা নিলেন এবার রেড ৎসার স্তালিন।

১৯৩২ সালে বাল্টিক-শ্বেতসাগর খাল নির্মাণে নিযুক্ত গুলাগের বন্দী অনৈচ্ছিক শ্রমিক
১৯৩২ সালে বাল্টিক-শ্বেতসাগর খাল নির্মাণে নিযুক্ত গুলাগের বন্দী অনৈচ্ছিক শ্রমিক
সাইবেরিয়ার প্রিজন ক্যাম্পের চিত্র
১৯৩৬এ গুলাগের বিছানাগুলির দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছে পোস্টারের যুগল মার্ক্স ও স্তালিন
১৯৩২ সালে গুলাগের সর্দারদের গ্রুপ ছবি
দার্শনিক পাভেল ফ্লরেন্সকি ১৯৩৩ সালে সোভিয়তবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে গ্রেপতার হন। স্তালিনের গুলাগে তার ১০ বছরের নির্বাসন হয়। তিন বছরের মাথায় গুলাগে গুলি করে মারা হ্য় তাকে।
গুলাগ সর্দার স্তেপান গারানিন। ১৯৩৭ সালে নির্যাতনের মাধ্যমে স্বীকরোক্তি আদায়ের অভিযোগে তার নিজেরই বন্দীদশা শুরু হয়। গুলাগে মারা যায় কয়েক বছর পর।
১৯৩৭ সালে অনৈচ্ছিক শ্রম দিয়ে তৈরি মস্কো খাল পরিদর্শনে স্তালিন, পেছনে মলোতভ
গুলাগের মহিলা সেকশন, সাইবেরিয়ার ঠান্ডায় নেই কোন হীটিং ব্যবস্থা, ত্রিশের দশক
ৎসারের আমলের ইন্টারনাল পাসপোর্ট। এ কাগজ ব্যতিরেকে স্বদেশের এক জায়গা থেকেই আরেক জায়গায় কেউ যেতে পারত না।

রাশিয়ায় টেইলরিজম চালুর অনেক সমস্যাও ছিল। পশ্চাদপসর রুশ কর্মীদের ঘড়ি ছিল না। সময়মত শিফটে এসে হাজির হত না। তারপর কম্যুনিস্ট পার্টির হর্তাকর্তারা কারখানার এক জায়গায় দক্ষতা বাড়ালে দেখা যেত বটলনেক অন্যত্র, যেখানে বিন্দুমাত্র নজর দেয়া হয়নি। কর্মীরা আমদানিকৃত দামী যন্ত্র ব্যবহার করত খুব অদক্ষভাবে। সেগুলি প্রায়ই বিকল হয়ে যেত। তৈরি পণ্যের গুণগত মানের অবস্থা ছিল শোচনীয়। এসবের দোষ পড়ত প্রকৌশলী ও ম্যানেজারদের ঘাঁড়ে। কখনো কখনো তাদের সাবোটাজের অভিযোগে কর্মচ্যুত করে নির্বাসনে পাঠানো হত শাস্তি হিসাবে।

কোন কারণ ছাড়াই ওপরমহল থেকে নির্দেশ আসত কাজ দ্রুত করার নয়ত প্রডাকশন কোটা বাড়ানোর। উদাহরণস্বরূপ, লেনিনের তড়িতায়ন স্বপ্নে তাড়িত সোভিয়েত পার্টিকর্মীরা সারা দেশে তামার স্যালভেজ অপারেশন চালায়। অশিক্ষিত চাষারা নিয়ে আসে বিভিন্ন মানের তামার দ্রব্য, যেগুলি থেকে ভালমানের বৈদ্যুতিক তার বানানো লাভজনক নয়। এরাই ফ্যাক্টরিতে কাজ করে এবং তাদের তৈরি গাড়ি ও ট্র্যাক্টর হয় বেশ নিম্নমানের।

ফোর্ডের তৈরি দশ বছরের গ্যারান্টিওয়ালা ট্র্যাক্টর সোভিয়েত চাষার ব্যবহারে তিন মৌসুমের মধ্যে অকেজো হয়ে পড়ে থাকত। পড়ে থাকলে বরং রুশ চাষার লাভ, সরকারী যৌথখামারের কাজে ফাঁকি দিতে পারে! ট্র্যাক্টর ঠিক করানোর পার্টস ও রিপেয়ার শপ ছিল নামে মাত্র। মেশিন টুলসের যন্ত্র সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অকেজো হয়ে পড়ত। ফোর্ডসন ট্র্যাক্টর জনপ্রিয় হলেও ইউক্রেন ও ভল্গা অববাহিকার মাটি গভীরভাবে কর্ষণের উপযুক্ত ছিল না। আর এদের জ্বালানী ছিল বেনজিন, যেটা রাশিয়ায় সহজলভ্য নয়।

১৯৩৭ নাগাদ এর্ন্সট মের ডিজাইন করা মাগনিতোগোর্স্কের অ্যাপার্টমেন্টগুলো হয়ে পড়ে নোংরা, জনাকীর্ণ বস্তি। মে’র ডিজাইনের সাথে মিল না রেখে অ্যাপার্টমেন্টগুলির এত পরিবর্তন সাধন করে সোভিয়েতরা, যে তিনি বেশ অসন্তুষ্ট হন। একেকটি ফ্ল্যাটে দেখা যেত পাঁচ ছ’জন গাঁদাগাঁদি করে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকছে। বাথটাব ব্যবহৃত হচ্ছে স্টোরেজের জন্য।

সোভিয়েত ব্লক অ্যাপার্টমেন্টের রান্নাঘর, ৫০/৬০এর দশক
স্তালিনগ্রাদ ট্র্যাক্টর প্ল্যান্টের নারীকর্মী, তিরিশের দশক
স্তাখানোভাইট আন্দোলনের পোস্টার। এরা ছিল “অতিমানবিক” শ্রমিক। এদের কাজ ছিল ক্রমাগত কাজ করে রেকর্ড ভাঙা। সহকর্মীরা এদের দেখতে পারত না। এদের কাজের গুণগত মানও ছিল কম।
পোস্টারে লেখা কয়লা শিল্পায়নের পাঁচ বছরের পরিকল্পনা শেষ হবে তিন বছরে।

বাস্তবতাবিবর্জিত পরিকল্পনার কারণে দেখা যায় স্তালিনের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় যে সব কাজ সমাধা হবার কথা ছিল, সেগুলি পিছিয়ে দিতে হয় পরের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার শেষভাগে। ওদিকে পোস্টার সেঁটে চলেছে পার্টিকর্মীরা, “পাঁচ বছরের কাজ শেষ করি চলো তিন বছরে!” মাগনিতোগোর্স্কে দেখা দিল সাপ্লাই চেইন সমস্যা। যে পরিমাণ ক্যাপাসিটি তৈরি হয়েছে, সে পরিমাণ উৎপাদনের কাঁচামাল সাপ্লাইয়ে বটলনেক। এত বড় স্টীল মিল হওয়া সত্ত্বেও সে কমপ্লেক্সটির ভেতরের সকল রেললাইন বানানোর উপযুক্ত উৎপাদনই মিলটিতে নেই। গত পোস্টে বলেছি ডিমান্ড বিল্ডাপ না করেই সবকিছু বিশাল বিশাল বানানোর সোভিয়েত শখের কারণে দ্নিপ্রোগেসের মত বিদ্যুতকেন্দ্রও ক্ষতিতে চলেছিল কয়েক বছর।

স্তালিন এ অবস্থা দেখে নতুন ফতোয়া দিলেন “ডিজী উইথ সাক্সেস” নামে। তার এক্সকিউজ, এত দ্রুত সোভিয়েতরা সাফল্যের মুখ দেখছে যে সেটা হজম করতে পারছে না! এবার আনতে হবে ধীরতা।

ডিজী উইথ সাক্সেস, পার্টির উদ্দেশ্যে স্তালিনের লেখা ফতোয়া, ১৯৩০

স্তালিনের ফ্যাক্টরি ম্যানেজাররা তো আরো এক কাঠি ওপরে। তারা সচেষ্ট ছিলই পার্টি বসদের কাছে নিজেদের জাহির করতে। ফোলানো-ফাঁপানো প্রডাকশন নাম্বার যেত ফাইনাল রিপোর্টে। কোটা পূরণ করতে না পারলে গর্দান যায়, আর কোটা পূর্ণ করেও বেশি দেখাতে পারলে মেডেল আছে কপালে! সোভিয়েত ব্যবস্থাপকদের চয়েস খুবই ক্লীয়ার।

সাধারণ মানুষ যে এই দ্রুত অগ্রগতির থেকে লাভবান হয়েছিল তাও নয়। ভারিশিল্পের ওপর বেশি জোর দেবার কারণে ভোক্তাশিল্প ছিল অবহেলিত। খাদ্য-বস্ত্রের মত মৌলিক চাহিদা পূরণের দিকে সরকারের নজর ছিল কম। অসঙ্গতিপূর্ণ নোট ছাঁপানোর কারণে ভোক্তাপণ্যে মুদ্রাস্ফীতি ছিল অত্যাধিক। দেখা যেত, যেসকল ব্যক্তিমালিকানার খামার তখনও অবশিষ্ট ছিল, সেসবের কৃষক শস্য বিক্রির পরিবর্তে স্টক করে রাখছে। সরকার এসে সেগুলি কেড়ে না নেওয়া পর্যন্ত সেগুলি বিক্রি করত না। শেষ পর্যন্ত সে রাস্তাই নিতে হত কম্যুনিস্ট পার্টিকে। তাতেও যখন চাহিদা না মেটে, তখন শহরের মানুষকে আনা হয় রেশনের আওতায়। রুটির জন্য লম্বা লাইন ছিল সোভিয়েত শহরগুলির দৈনন্দিন দৃশ্য।

তিরিশের দশকে মস্কোতে রুটির জন্য লম্বা লাইন

ওদিকে তথাকথিত সাম্যবাদের দেশের শিল্পায়ন হয় কিন্তু পুঁজিবাদী আদলেই! রাষ্ট্র ছিল সকলের বেতনভাতার নির্ধারক। সোভিয়েত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশকরা ডিপ্লোমা ইনজিনিয়াররা পেত সাধারণ অদক্ষ কর্মীর ৬ থেকে ৮ গুণ। উপরের লেভেলের ম্যানেজাররা পেত ৩০ গুণ। মার্কিন বিশেষজ্ঞদের বেতনভাতা ছিল সর্বোচ্চ। তারা থাকত বিশেষ বিদেশী এলাকায় ভাল বাসস্থানে। আমদানিকৃত বিলাসদ্রব্য আনা হত তাদের জন্য। ছিল সুইমিং পুল গল্ফ কোর্স। বিনিময়ে কর্নেল কুপারের মত মানুষ সোভিয়েতের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রে সফল লবিইং করেন। গ্রেট ডিপ্রেশনের যুগে সোভিয়েত ইউনিয়নে যদি মার্কিন পণ্যের রপ্তানি হয়, মার্কিন মানুষের কর্মসংস্থান হয়, তো মন্দ কি?

সব মিলিয়ে বুঝতে পারছেন হয়ত, সোভিয়েত সিস্টেমে পুঁজিবাদী শোষণের পরিবর্তে সেটি হয়ে গেছে রাষ্ট্রীয়-সরকারী শোষণ। স্টেট সেখানে এক্সপ্লয়টার, ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টের জায়গায়। বরং আরো বাজে এক্সপ্লয়টার। ফোর্ড-টেইলরের মত মানুষ যেখানে শ্রমিকদের ভাল বেতন দেবার পক্ষপাতী ছিলেন, সেখানে সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্র শ্রমিকদের বেতন তো বটেই, যাতায়াতও ফিক্স করে রেখে দিয়েছে। ফলশ্রুতিতে স্তালিনের আমলে বেশ কিছু শ্রমিক ধর্মঘটও হয়, সমাজতন্ত্রী ওয়ার্কার্স প্যারাডাইজ প্রলেতারিয়াত ডিক্টেটরশিপ রাষ্ট্রে যেটা অভাবনীয়। অবশ্য যথারীতি সেসব ধর্মঘটের বিনাশও করে সোভিয়েত গুপ্ত পুলিশ।

স্তালিনের আমলের অগণিত শ্রমিক ধর্মঘটের একটি স্তালিনের মৃত্যুর পর সোভিয়েত পোস্টারে স্থান নেয়

যাই হোক, ত্রিশের দশকের শেষ নাগাদ নানা ভুল রাস্তায় টক্কর মেরে সোভিয়েত একটা স্থিতিশীল শিল্পায়নের অবস্থায় এসে দাঁড়ায়। তবে লেনিন-স্তালিনের এই ডিজী উইথ সাক্সেস শিল্পায়নের পেছনে বলেছি একটা প্যারানয়া কাজ করত। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির আগ্রাসনের ভয়ে এর আরম্ভ বিশের দশকে। ত্রিশের দশকে যখন সত্যি সত্যি সে সময়টা এল, তখন কি সোভিয়েত রাষ্ট্র তৈরি ছিল প্রতিরক্ষার জন্য? সে কাহিনী বলে সাড়ব আগামী খন্ডে।

হার্বার্ট হুভার ও ক্ষুধার্ত রাশিয়া


১৯২১ সালের জুলাই মাস। রুশ সাহিত্যিক মাক্সিম গোর্কির একটি ছোট্ট লেখা প্রকাশিত হল নিউ ইয়র্ক টাইমসে—

“অন্নদাত্রী স্তেপভূমি খরাগ্রস্ত। কোটি মানুষের রুশ জনপদ দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন। উপর্যুপরি যুদ্ধ ও বিপ্লবে জনগণ ক্লান্ত, রোগজরার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ নেই। … দুনিয়ার সকল সৎ ও সংস্কৃতিবান ইউরোপীয় ও মার্কিন মানুষের নিকট আমার প্রার্থনাঃ তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি, মেন্দেলেভ, পাভলভ, মুসর্গস্কি, হ্লিংকার দেশের মানুষকে দ্রুত রুটি আর ওষুধ দিয়ে সাহায্য করুন।…”

ম্যাক্সিম গোর্কি ও ১৯২১এ নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত তার আর্জি

এই আকুল আবেদনটি আরো অনেকের মত নজর কাড়ে মার্কিন কমার্স সেক্রেটারি হার্বার্ট হুভারের। তিনি পরবর্তীতে হন যুক্তরাষ্ট্রের ৩১তম প্রেসিডেন্ট। গোর্কির এই আবেদনে সাড়া দেবার মত বিশ্বে আর কেউ সেসময় থেকে থাকলে ছিল আমেরিকা — আর হার্বার্ট হুভার।

গোটা ইউরোপ তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত। গোর্কির আবেদনে সাড়া দেবার মত অবস্থায় নেই। ওদিকে হার্বার্ট হুভারের নেতৃত্বেই ইউরোপে বিপুল পরিমাণে খাদ্যবন্টন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ১৯১৪ সালে বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পর থেকেই তিনি বিভিন্ন মার্কিন ত্রাণকর্মের নেতৃত্ব দেন। যুদ্ধ চলাকালে বেলজিয়ামে, যুদ্ধের পর অস্ট্রিয়া-পোল্যান্ড ও পূর্ব ইউরোপে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষকে রক্ষা করে তার বদান্যতা।

হার্বার্ট হুভার, পশ্চিম ইউরোপে প্রেরিত ত্রাণসাহায্যের সামনে, ১৯১৯

অবশ্য এসবের পেছনে গূঢ় একটা লক্ষ্য তো ছিলই। যুদ্ধে পরাজিত দেশগুলি এত দুর্বল যে নাগরিকদের দেখভালের যথেষ্ট সামর্থ তাদের নেই। উল্টো ভের্সাই চুক্তিতে তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে বিশাল ক্ষতিপূরণের বোঝা। এ ব্যাপারে উইলসনের সাথে দ্বিমত ছিল হুভারের। তিনি নিলেন অন্য পথ। এসব দেশের ন্যুব্জ অর্থনীতি থেকে যদি খাদ্যাভাব সাধারণ মানুষকে পীড়িত করে, তাহলে আর দেখতে হবে না! রুশ দেশের মত পূর্ব ও মধ্য ইউরোপের প্রতিটি দেশ একে একে বলশেভিক ধাঁচের বিপ্লবের সম্মুখীন হবে। যেমনটা প্রায় হয়ে গেছিল হাঙেরিতে।

আমেরিকায় তখন চলছে “রেড স্কেয়ার।” মার্কিন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সুযোগে সেখানেও আছে কম্যুনিস্ট ও লেবার পার্টি। রাশিয়ায় বলশেভিকদের বিজয়ে উদ্বুদ্ধ হয়ে কারখানা শ্রমিকরা এদের সাথে যোগসাজশে ধর্মঘট, রায়ট, ভাঙচুর শুরু করে। মার্কিন সাধারণ নাগরিকদের সমর্থন এতে খুব বেশি ছিল না। তাদের আশা ছিল সরকার এ অরাজকতা বন্ধ করবে। তাই হয়।

বিশের দশকের প্রথমার্ধে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ সন্ত্রস্ত ছিল কারখানার শ্রমিকদের ধর্মঘট ও অরাজকতা দেখে, রাশিয়ার বিপ্লবপরবর্তী পরিণতির কথা চিন্তা করে এ ধরনের কার্টুনচিত্রও অংকিত হয়
হাঙেরিতে খাদ্যত্রাণ পাঠানোর জন্যে আমেরিকায় প্রচারিত হার্বার্ট হুভারের সংস্থার পোস্টার, ১৯১৯

সে কারণে গোর্কির এই আবেদন দেখার পর হুভার একটু সাবধানতার সাথে জবাব দেন। রুশদেশে বলশেভিকদের বন্দী মার্কিনদের মুক্তি দেয়া হলে ত্রাণকার্য পরিচালনা করবে তার সংস্থা। তিনি ছিলেন প্রাইভেট নন প্রফিট এ আর এ — আমেরিকান রিলীফ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের প্রধান।

তাছাড়া গোর্কির থেকে আনঅফিশাল এ চিঠিটি আসলেও সোভিয়েত ইউনিয়নের পালের গোদা লেনিনের থেকে তো কোন আনুষ্ঠানিক অনুরোধ আসেনি। তবে নেগোসিয়েশনের পাল্টা প্রস্তাব আসল গোর্কির মধ্যস্থতাতেই — লেভ কামেনেভের কাছ থেকে। আগস্টে বন্দীমুক্তির পর শুরু হল সে আলাপ।<

হুভার প্রথম প্রথম দোনমনায় ছিলেন। তার চিন্তা ছিল কম্যুনিজমের মত আদর্শের দ্রুত পতন জরুরী। এসময় তাকে টিকিয়ে দেয়া ঠিক নয়। আবার উইলসনের সরকার যেমন বলশেভিকদের বিরুদ্ধে ১৩,০০০ মার্কিন সৈন্য পাঠিয়ে রাশিয়ায় গণতন্ত্র পুনর্প্রতিষ্ঠার পশ্চিমা অভিযানে অংশ নিয়েছিল, সেটার পক্ষেও সম্পূর্ণরূপে ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত তিনি ঠিক করেন, সোভিয়েতদের বিনাশ করতে হবে, তবে অস্ত্র দিয়ে নয়, ত্রাণ ও দয়াদাক্ষিণ্য দিয়ে।

রাশিয়ার পেত্রোগ্রাদে দুর্ভিক্ষপীড়িত অনাথ ও পরিত্যক্ত শিশু, ১৯২১
রাশিয়ার পেত্রোগ্রাদে এআরএ পরিচালিত চিলড্রেনজ হাউজে রুশ শিশুর দল, ১৯২১

প্রথম দিকে ত্রাণকার্যের লক্ষ্য ছিল কেবল সোভিয়েত শহরগুলির অনাথাশ্রম। যুদ্ধ ও বিপ্লবের ডামাডোলে যে সকল শিশু এতিম হয়েছে, নয়ত পরিত্যাজ্য হয়েছে, তাদের জন্য শুরু হল ফান্ড কালেকশন। শুরুতে বেসরকারী পৃষ্ঠপোষকতায়। পত্রিকা, সিনেমা হলে রীতিমত বিজ্ঞাপন দিয়ে সংগৃহীত হল বিশাল অংকের অনুদান। সামান্য কয়েক সেন্ট থেকে শুরু করে কয়েক হাজার ডলার পর্যন্ত দান করেন বহু মার্কিন।

সে দানে কেনা খাদ্য, বস্ত্র ও ওষুধ নিয়ে পেত্রোগ্রাদ — পরবর্তী লেনিনগ্রাদ — শহরে হাজির হল হুভারের প্রতিনিধিরা। সেখানে শিশুদের কংকালসার অবস্থা দেখে তাদের চক্ষু চড়কগাছ! শুধু যে দু্র্ভিক্ষপীড়িত এরা তা নয়, অনেক ভুগছে মরণব্যাধি টাইফাসে। এসকল শিশুদের দিয়েই ক্লান্ত গলার স্বাগতম গীতি গাওয়ালো আশ্রমের সরকারী কর্মচারীরা। ভেজা চোখে অন্যদিকে চাইলেন এআরএ কর্মকর্তা বিল শ্যাফ্রথ ও তার সহকর্মীরা।

শিশুটির দাঁড়ানোর শক্তি নেই, হামাগুঁড়ি দিতে দিতে মাটি থেকে পোকামাকড়, ময়লা কুঁড়িয়ে কুঁড়িয়ে খাচ্ছে, রুশ মহাদুর্ভিক্ষ, ১৯২১
টাইফয়েডে আক্রান্ত রুশ শিশু, রুশ মহাদু্র্ভিক্ষ, ১৯২১

শহরের এ করুণ অবস্থা দেখে গ্রামাঞ্চলের ব্যাপারে কৌতূহল হল শ্যাফ্রথের। যথাযোগ্য কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে ভল্গা নদীর উপত্যকায় সামারা, কাজান, উরাল, উফা প্রভৃতি বিস্তীর্ণ দুর্গম অঞ্চলে স্কাউটিংয়ের জন্য পাড়ি জমালো তার দলের লোকজন। যেমনটা সন্দেহ ছিল তার থেকে খারাপ অবস্থা গ্রাম্য মানুষের। তাদের নিজেদের ফলানো যা শস্য ছিল তা রিকুইজিশন করে নিয়ে গেছে লালবাহিনী, নিয়ে গেছে পরের মৌসুমে ব্যবহারের জন্য বেছে রাখা গমের দানা।

এ অঞ্চলের অধিবাসী শুধু রুশ নয়, কাজাখ-বাশকির প্রভৃতি মুসলিমপ্রধান জনপদও। সকলে কমবেশি দুর্ভিক্ষগ্রস্ত। গাছের ছাল, গুঁড়োকরা হাঁড়, খড় প্রভৃতি কাঁদার সাথে মিশিয়ে স্যুপ বানিয়ে খাচ্ছে এরা। নোংরা বাসস্থানের উঁকুন আর অপুষ্টি থেকে টাইফাস রোগের প্রাদুর্ভাব। যত দিন যাচ্ছে, তত রিপোর্ট আসছে ক্যানিবালিজমের — কোন ক্ষেত্রে কবর খুঁড়ে টাইফয়েডে মারা যাওয়া মৃতদেহের অবশেষ খাচ্ছে দুর্ভিক্ষপীড়িতরা। যাদের বাড়িতে বাচ্চা আছে তারা সন্ধ্যার পর তালা মেরে দরজা লক করে রক্ষা করছে বাচ্চাদের। কারণ ক্যানিবালিজমের প্রথম শিকার এরা। দুয়েকটা এমন কেসও বেরিয়েছে যেখানে মা তার অন্য শিশুর খাদ্যসংস্থানের জন্য হত্যা করেছে বড় সন্তানকে। এসকল হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছিল আসলেই। প্রপাগান্ডা নয়। রুশ রিপোর্ট আবিষ্কৃত হয়েছে পরে।

কংকালসার রুশ শিশু, রুশ মহাদুর্ভিক্ষ, ১৯২১
দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারানো শিশুদের কংকালসার মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ঠেলাগাড়ি করে, রুশ মহাদুর্ভিক্ষ, ১৯২১
দুর্ভিক্ষপীড়িত ভল্গার মুসলিম জনপদ, রুশ মহাদুর্ভিক্ষ, ১৯২১

এ রিপোর্ট যখন হুভারের কাছে গেল তখন তার আর বুঝতে বাকি রইল না যে শুধু শহরের শিশুদের সাহায্য করে খাদ্যের চাহিদা মিটবে না। খাওয়াতে হবে কয়েক কোটি জনগণকে, রোপন করতে হবে পরবর্তী মৌসুমের বীজ। কংগ্রেসে দ্রুত রাশান ফ্যামিন রিলীফ অ্যাক্ট পাশ হল ডিসেম্বর ১৯২১এ। প্রথম ধাঁপে অনুমোদন হল ২০ মিলিয়ন ডলারের সাহায্য। পরের বছরে সেটি বেড়ে হল ৬০ মিলিয়ন ডলার। এখনকার হিসাবে সব মিলিয়ে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার।

প্রায় ৩০০ জন মার্কিন কর্মকর্তা আর ১,২০,০০০ ইংরেজীতে পারদর্শী স্থানীয় রুশ সহকারীদের নিয়ে মধ্য রাশিয়ার বিশাল এলাকাকে কয়েকটি ডিস্ট্রিক্টে ভাগ করে কাজ শুরু করল এআরএ। বাল্টিক সাগরে মার্কিন জাহাজে করে এল টনকে টন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বৃত্ত গম ও ভুট্টা। কৃষ্ণসাগরের বন্দরেও নোঙর করল খাদ্যবাহী জাহাজ। ট্রেনে করে ভল্গার উজানে যেতে শুরু করল ত্রাণ। প্রতিদিন প্রায় ১.১ কোটি মানুষের খাদ্যসংস্থান হল আট-নয় মাসব্যাপী। লঙ্গরখানা খোলা হল ১৯ হাজার।

নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত ১৯২১ সালের রিপোর্টে বলা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ছাত্ররা এক বেলা না খেয়ে থেকে সে টাকা দান করেছে হুভারের রুশ ত্রাণ তহবিলে
হুভারের এআরএ পোস্টার প্রচারণায় বলা হচ্ছে ১০ ডলারের একটি অনুদান পেলে তারা কি ধরনের খাবার রাশিয়ায় পাঠাবে, ১৯২১
যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের ভোটে তদকালীন মুদ্রামানের ২০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ হয় রুশ মানুষের ত্রাণে, ১৯২১
তদকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন বর্তমান বেলারুশের মিনস্কে অবস্থিত এআরএ অফিসের সামনে তার মার্কিন কর্মকর্তারা, ১৯২১
কৃষ্ণসাগরের নভোরসিস্ক বন্দরে এআরএ’র খাদ্যত্রাণ খালাস হচ্ছে, ১৯২১-২২
এআরএ’র ত্রাণবাহী ট্রাকের সামনে তার কর্মচারীরা, ১৯২১-২২
ভল্গার পূর্ব তীরের দুর্গম স্তেপে রেল ছিল না, ছিল না গাড়ি চলার রাস্তা। দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের কাছে খাদ্য পৌঁছাতে এআরএ’কে ব্যবহার করতে হয় ঊটের কাফেলা। ১৯২১-২২।
এআরএ’র উফা-উরাল ডিস্ট্রিক্টের পরিসংখ্যান বোর্ডে দেখানো হয়েছে হিসাব, নিয়মিত ত্রাণ যাচ্ছে দেড় মিলিয়নের বেশি মানুষের কাছে। ১৯২১-২২।
এআরএ’র উফা-উরাল ডিস্ট্রিক্টের পরিসংখ্যান বোর্ডে দেখানো হয়েছে হিসাব, নিয়মিত ত্রাণ যাচ্ছে দেড় মিলিয়নের বেশি মানুষের কাছে। ১৯২১-২২।

হুভারের এই ত্রাণকার্য যে কোন প্রকার বাঁধা ব্যতিরেকে হয়েছে তা কিন্তু নয়। স্মরণ করুন যে গোর্কি স্বয়ং হাটে হাঁড়ি না ভেঙে দিলে এ খবর পশ্চিমে বেরুতও না। দুর্ভিক্ষের আভাষ পাওয়া সত্ত্বেও অহেতুক বিলম্ব করে সোভিয়েত কেন্দ্রীয় প্রশাসন। ততদিনে মানুষ মারা যেতে শুরু করেছে। তারপর ট্রেনে করে কৃষ্ণসাগর থেকে এআরএ’র খাদ্য আনতে গিয়ে দেখা গেল অনেকগুলি কার লাপাত্তা। রাস্তাতেই গায়েব করে দিয়েছে রেলশ্রমিকেরা। সে ব্যাপারে অভিযোগ তুলতে রেল ইউনিয়ন পুরো রেলব্যবস্থায় এমন একটা জ্যাম তৈরি করে রাখল যে কয়েক সপ্তাহ ত্রাণ যেতে পারল না ভল্গায়। ট্রেনে উল্টো রাস্তায় ইউক্রেনে আসতে শুরু করল ক্ষুধার্ত মানুষ। ভল্গায় খাবার না পেয়ে মারা গেল কয়েক লাখ।

এ অবস্থায় শ্যাফ্রথ হুভারকে একটি আনএনক্রিপটেড চিঠি পাঠান। এর বক্তব্য সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ ঠিকমত সাহায্য করছে না, যতদিন সে সাহায্য না আসে ত্রাণ পাঠানোতে যেন বিরতি দেয়া হয়। এটি পাঠানোর পরপরই লেনিন তদকালীন রেল কমিসারকে পদচ্যুত করে তার জায়গায় আসীন করেন ফেলিক্স জেরঝিনস্কিকে। রেল ব্যবস্থা আয়রন ফেলিক্সের ভয়ে আবার ঠিকমত চালু হয়। পুরো দুর্ভিক্ষে এভাবে প্রায় ৬ থেকে ১০ মিলিয়ন প্রাণ হারায়, যদিও এআরএ তার থেকে বেশি প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হয়।

শুধু যে এ ধরনের লজিস্টিকাল সমস্যার সম্মুখীন হয় এআরএ, তা নয়। গোর্কির সুপারিশে তাদের রাশিয়ায় ঢুকতে দিলেও লেনিন এদের ব্যাপারে ভীষণ সন্দেহগ্রস্ত ছিলেন। ত্রাণ বিলানোর অন্তরালে এরা গুপ্তচরবৃত্তি করছে কিনা, সাধারণ মানুষকে “প্রতিবিপ্লবী” বানানোর ষড়যন্ত্র করছে কিনা — এসব চোখে চোখে রাখার জন্য গুপ্ত পুলিশ চেকা থেকে লোক এসে তদারকি শুরু করে।

এআরএ অফিসে কার্যরত রুশ শিক্ষিত অভিজাত নারী। বিপ্লবে এরা সর্বস্ব খোয়ায়, কিন্তু ৎসারের আমলের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কাজে লেগে যায় মার্কিনদের সাহায্য করতে। বলশেভিকদের সন্দেহ পড়েছিল এ সকল “প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিবিপ্লবীদের” ওপর। ১৯২১-২২।
খাদ্য বিতরণরত এআরএ কর্মকর্তা, ত্রাণ নিচ্ছে দাঁড়ি-টুপিওয়ালা এক কসাক গোছের রুশ। ১৯২১-২২।
এআরএ পরিচালিত চিলড্রেনজ হাউজ ও কিচেনে রুশ শিশুর দল, ১৯২১-২২।

অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় রুশদের সাথেই চেকার টক্কর লেগে যায়। যেহেতু এআরএ’এর দরকার ছিল ইংরেজীভাষী ফীল্ড এজেন্ট এবং একমাত্র ৎসারের আমলের শিক্ষিত অভিজাত মানুষদের মধ্যেই এদের সংখ্যা বেশি, সেহেতু চেকার সাথে একটা সংঘাত লেগে থাকত এআরএ’র। এ ধরনের রাজনীতির ফাঁকে গোপনে এআরএ’র একটি জেলার ত্রাণকার্যের নিয়ন্ত্রণ চেকা নিয়ে নেয়। এবং এআরএ’র পুরো ত্রাণপ্রচেষ্টাকে বলশেভিক সরকারের বদান্যতা হিসাবে প্রচার করে। এই অপপ্রচার হটাতে এআরএ’কে তৈরি করতে হয় প্রচারণা পোস্টার। যাতে সাধারণ মানুষ বোঝে এই ত্রাণ বলশেভিকদের কিংবা তথাকথিত “মার্কিন প্রলেতারিয়াতের” কাছ থেকে আসেনি।<

লেনিন শেষ পর্যন্ত এতটা ক্ষিপ্ত হন যে মলোতভকে চিঠি লিখে বলেন যে কোন মূল্যে হুভারকে শাস্তি দিতে হবে। গুপ্তচর বলে কোন কিছু এআরএ’র মধ্যে তো ছিলই না, বরং স্থানীয় রুশদের সাথে তাদের এত সখ্যতা ছিল যে খুব সহজে গুপ্তচরবৃত্তির বানোয়াট দোষ চাপিয়ে তাদের উৎপাটন সম্ভব নয়। তখন নতুন দোষারোপ করা হল এআরএ’র ওপর। তারা নাকি অর্থডক্স চার্চের সোনায় বাঁধানো আইকন ও অন্যান্য মূল্যবান বস্তু লুট করে নিয়ে যাচ্ছে, বিনিময়ে আনছে খাদ্য। চার্চগুলোর ওপর এই আক্রমণও আসলে বলশেভিকদের কাজ। কিন্তু ধার্মিক সাধারণ মানুষকে এআরএ বিমুখ করাটাই উদ্দেশ্য।

এআরএ’র প্রচারণা পোস্টার। রুশে লেখা দুর্ভিক্ষপীড়িত রাশিয়ার নিকট আমেরিকা। বলশেভিকদের অপপ্রচারণা খন্ডন করতে এগুলি ছাপাতে হয়। ১৯২১-২২।
এআরএ’র প্রচারণা পোস্টার। রুশে লেখা আমেরিকার জনগণের উপহার। বলশেভিকদের অপপ্রচারণা খন্ডন করতে এগুলি ছাপাতে হয়। ১৯২১-২২।
রুশ শিশুদের টাইফয়েডের টীকা দিচ্ছে এআরএ’র ডাক্তার, ১৯২১-২২।

লেনিনের আশা ছিল যে এআরএ’এর সাথে এই “সহযোগিতার” বিনিময়ে মার্কিনদের থেকে তার সরকারের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন সম্ভব হবে। ১৯২২এ এসে যখন পরিষ্কার হল সেটা হবে না, তখন এআরএ বিরোধিতা আরো তুঙ্গে উঠল। ততদিনে এআরএ ৩.৪ কোটি টন খাদ্যত্রাণ সরবরাহ করেছে। টাইফাস, প্যারাটাইফয়েডের বিরুদ্ধে টীকা দিয়েছে কয়েক মিলিয়ন শিশুকে। পরবর্তী মৌসুমের গমের বীজ বপন শেষ।

এর ওপর বেরুল যে সোভিয়েত সরকার ইউক্রেন থেকে গোপনে শস্য বিদেশে রপ্তানি শুরু করেছে। অর্থাৎ একদিকে করছে রপ্তানি, আরেকদিকে চলছে দুর্ভিক্ষ। এ পর্যায়ে এসে এআরএ মিশনের আর কোন অর্থ হয় না। ফেব্রুয়ারি ১৯২৩ সালে তারা অফিস গুঁটিয়ে ফিরে যায় মার্কিন দেশে। রেখে যায় দুর্ভিক্ষ থেকে বাঁচানো এক পুরো জেনারেশন, তাদের সাহায্য করতে এসে টাইফয়েডে মৃত্যুবরণ করা স্বেচ্ছাসেবকদের কবর, আর কেউ কেউ যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যায় রুশ ভার্যা। সোভিয়েত সরকার তাদের পুরো কার্যক্রমকে ডিসক্রেডিট করে মার্কিন গুপ্তচরবৃত্তি অপারেশন হিসাবে।

তবে এআরএ’এর স্মৃতি রয়ে গেছিল রুশদের মাঝে। কর্নেল বেল নামে এক এআরএ কর্মকর্তা উরালের নিকটবর্তী রুশ, বাশকির ও কাজাখদের এতটাই স্নেহভাজন হন যে স্থানীয় মুসলিম ইমামরা তাকে অনুমতি দেন তাদের মসজিদে থাকা বহু শতকের পুরনো একটি কুরআনে চোখ বুলানোর। বহির্বিশ্বের আর কেউ, এমনকি কোন রুশও এ সম্মানের অংশীদার কখনো হয়নি। বহুদিন ভল্গা উপত্যকার মানুষ খাদ্যত্রাণের নাম মনে রেখেছে “আমেরিকা” নামে। কারণ ঐ লেবেলেই ত্রাণ আসত। খাদ্য মানে আমেরিকা, আমেরিকা মানে খাদ্য।

দুর্ভিক্ষপীড়িত বাশকির পরিবার, উফা অঞ্চল, ১৯২১-২২।
বাশকির-তাতার মুসলিম ধর্মীয় নেতাদের সাথে করমর্দন করছেন এআরএ’র কর্নেল বেল, ১৯২১-২২।

এভাবে মধ্যযুগের ব্ল্যাক প্লেগের পর ইউরোপের সবচেয়ে মরণঘাতী দুর্যোগ থেকে উত্তরণ ঘটে রাশিয়ার। হুভার ভেবেছিলেন, উই উইল কিল দ্য বলশিজ উইথ কাইন্ডনেস। তা কিন্তু হ্য়নি! পরবর্তীতে তিনি আক্ষেপ করেছিলেন যে, সোভিয়েতদের বরং দাঁড়া করে দিয়ে গেছে তার মানবিক ত্রাণকর্ম।

আরেকটা ব্যাপার মনে করুন। আজকের যুগে অনেকে ভাবেন যুক্তরাষ্ট্রের টাকার কি অভাব! যতখুশি সাহায্য করতে পারে! ডলার ফরেন রিজার্ভ কারেন্সি হবার কারণে যত খুশি তারা তো “টাকা ছাপাতেই” পারে! সত্য এত সোজাসাপ্টা নয়। বর্তমানে তো নয়ই, অতীতেও ছিল না। সে যুগে ইউএস ডলার ফরেন রিজার্ভ ছিল না, আর আমেরিকার জনগণ প্রবেশ করতে যাচ্ছে গ্রেট ডিপ্রেশনের অনিশ্চয়তার যুগে। তার মধ্যেও আজকের মানের প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার সাহায্য এবং স্বদেশী এক্সপার্টদের মার্কিনরা পাঠায় সোভিয়েত ইউনিয়নে। এভাবে সে যাত্রা মার্কিন বদান্যতায় বেঁচে যায় লেনিনের ইউটোপিয়ার স্বপ্ন আর পাকাপোক্ত হয় স্তালিনের স্বৈরাচারের ভবিষ্যৎ।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!