হাইতি – ২, রাষ্ট্রনির্মাণ, ১৮১০-১৮৬০

হাইতির স্বাধীনতার ঘোষণায় দেসালিন প্রজাদের জন্যে একরকম সাবধানবাণী লিখে রেখে গিয়েছিলেন। যেদিন নেতাদের আদেশ পালনের দায়িত্ব হাইতির জনগণ বিস্মৃত হবে, সেদিন আবার ভিনদেশের পরাধীনতার শৃংখল পরবে তারা। একরকম প্রচ্ছন্ন হুমকি আর কি!

হাইতিতে যুক্তরাষ্ট্রের মত জনপ্রতিনিধি-সম্মেলন ডেকে সংবিধানপ্রনয়ণ না হয়ে দেসালিনের অঙ্গুলিহেলনেই সব কিছু চলতে থাকল। লুভেরত্যুরের আমলেও ফ্রান্সের প্রজাতান্ত্রিক সম্মেলনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি পাঠিয়েছিল হাইতি। সেসবের ধার না ধেরে সহসা সম্রাট বনে বসেন দেসালিন। এ যেন প্রতিপক্ষ ফরাসী সম্রাট নাপোলেওঁকে কাঁচকলা দেখানো!

নাপোলেওনের সময়েও ফরাসীর পাশাপাশি স্থানীয় ক্রেওল ভাষায় সরকারী ঘোষণা প্রকাশ করা হত। দেসালিন জনসাধারণের বোধগম্য এই ভাষাটাও পরিত্যাগ করেন। ভাবটা এমন যে, হাইতির অধিকাংশ মানুষ গ্রাম্য মূর্খ, তাদের এত দাম দিয়ে কোন ফায়দা নাই! ফরাসীভাষী শহুরে এলিট আর প্রাদেশিক সামরিক শাসকদের কথামতই দেশ চলবে।

হাইতির প্রথম রাষ্ট্রপতি ও সম্রাট দেসালিন (জীবৎকাল: ১৭৫৮-১৮০৬, শাসনকাল: ১৮০৪-০৬)। ফরাসী ছিন্নমস্তক হাতে। তাঁর আমলে হাইতির অবশিষ্ট ফরাসী শ্বেতাঙ্গদের ওপর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চলে। ১৮০৪ সালের এনগ্রেভিং।
দেসালিনের স্বাধীনতার ঘোষণার পোস্টার, ১৮০৪। হাইলাইটেড অংশের অনুবাদ: “If you ever refused or grumbled while receiving those laws that the spirit guarding your fate dictates to me for your own good, you would deserve the fate of an ungrateful people.”
সম্রাট দেসালিনের রাজ্যাভিষেক, ১৮০৪।
দেসালিনের সম্রাট হবার প্রেরণা ফরাসী সম্রাট নাপোলেওনের থেকে এসে থাকতে পারে। তিনি ১৮০৪ সালে নিজেকে ফ্রান্সের সম্রাট ঘোষণা করেন।

স্বেচ্ছাচারী শাসন করতে গিয়ে অবশ্য শীঘ্রই জনরোষের শিকার হন সম্রাট দেসালিন। প্রথমত, ভূমিদাসভিত্তিক খামার ব্যবস্থার কোন সংস্কার তিনি করেননি। দ্বিতীয়ত, দোআঁশলা মুলাটো শিক্ষিতশ্রেণীর সাথে তাঁর বেশি দহরমমহরম হাইতির মানুষ ভাল দৃষ্টিতে দেখেনি। তৃতীয়ত, প্রাদেশিক সেনাপ্রধানদের বিরাগভাজন হয়ে পড়েন তিনি।

১৮০৬ সালে তাঁরই দুই সহযোদ্ধা আলেকসন্দ্র পেতিওঁ আর অঁরি ক্রিস্তোফ আঁতাত করে অনুগত সেনাদল নিয়ে রাজধানী পোর্তোপ্র্যাঁসে প্রবেশ করেন। বিদ্রোহী জনগণ রাষ্ট্রীয় প্রাসাদ থেকে সম্রাটকে রাস্তায় টেনে বের করে গুলি করে হত্যা করে। শুধু তাতেই তারা ক্ষান্ত হয়নি, দেসালিনের মৃতদেহকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে ফেলে তারা।

রাষ্ট্রের স্থপতির এমন পরিণতি হাইতির ভবিষ্যতের জন্যে একটি খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। দেসালিনের প্রাক্তন দোসররা তাঁর সৎকারের বালাই না করে ডাকলেন জনপ্রতিনিধির সম্মেলন। যুক্তরাষ্ট্রের আদলে দ্বিকক্ষ সংসদ আর ত্রিমুখী ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রস্তাব করা হল। সেনেটের হাতে বেশি ক্ষমতা চলে যাবার ব্যাপারটা আবার ক্রিস্তফের পছন্দ হলো না। ছোটখাট একটা গৃহযুদ্ধ বেঁধে গেল পেতিওঁ-ক্রিস্তফের মধ্যে, কিন্তু কেউ কাউকে হারাতে পারলেন না।

দেসালিনের ছিন্নবিচ্ছিন্ন মৃতদেহ কবরস্থ করার আর কেউ ছিল না, কেবল এক পাগলিনী দেফিলে সহমর্মী হয়ে সে দায়িত্বপালন করে, ১৮০৬।

ক্রিস্তফ তার দলবল নিয়ে হাইতির উত্তরাংশে গিয়ে নিজেকে রাজা দাবি করে বসলেন। বনেদী পদবীগুলি দেয়া শুরু করলেন কাছের মানুষদের। প্রজাদের শিক্ষাদীক্ষায় অবশ্য তার মনোযোগ ছিল। রাজধানী ল্যকাপে একটা মেডিকাল স্কুলও চালু করেন তিনি।

প্রাক্তন গৃহপালিত চাকর, আর এখন রাজা, ক্রিস্তফ বিশাল সঁসুসি প্রাসাদ তৈরি করেন। আরো তৈরি হয় সিতাদ্যাল লাফেরিয়ের বলে এক দুর্ভেদ্য দুর্গ। ইউরোপীয় পর্যবেক্ষকরা লিখে যান, শেকলপরা কৃষ্ণাঙ্গ ‘দাসের দল’ কঠোর পরিশ্রম করে নাকি এগুলি তৈরি করেছে। হাজারে হাজারে নাকি মারাও গেছে সে কাজে। ‘দাস’ কথাটা সম্ভবত সত্য নয়, কিন্তু ‘কোর্ভে লেবার’ বা সরকারের ‘উন্নয়নকাজে’ বাধ্যতামূলক শ্রমপ্রদানের ব্যাপারটা ক্রীতদাসপ্রথামুক্ত হাইতির সকল শাসকই সমানে ব্যবহার করেছেন। এ শ্রমিকরা বেতন পেত না, খুব একটা ভাল ব্যবহার তদারককারী সৈন্যদের কাছে পেতও না, বন্দুকের বাঁট কিংবা বেয়নেটের ব্যবহার চলত সমানে। আর লেবারক্যাম্পে বন্দীজীবন কাটাতে হত।

উত্তর হাইতির রাজা অঁরি ক্রিস্তফ (জীবৎকাল: ১৭৬৮-১৮২০, শাসনকাল: ১৮১১-২০)।
সিতাদ্যাল দ্যফেরিয়ের ক্রিস্তফের আদেশবলে তৈরি করে কৃষ্ণাঙ্গ ‘দাসের দল’, এটি এখনো একটি পর্যটন আকর্ষণ।
রাজা ক্রিস্তফের রাজ্যে প্রচলিত মুদ্রা, ১৮২০।

ওদিকে পেতিওঁ দ্বীপের দক্ষিণে গিয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন হাইতি প্রজাতন্ত্র। সেখানে সেনেটের সাথে ভাগবাটোয়ারা করেই শাসন শুরু করলেন, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে শাসনতন্ত্র পরিবর্তন করে সেনেটরদের মনোনয়নের ব্যাপারটা নিজের এখতিয়ারে নিয়ে আসলেন। বিরুদ্ধমতের সেনেটরদের কূটচাল চেলে সরিয়ে দিলেন। তবে প্রজাতন্ত্রের সকল পুরুষকে ভোটাধিকার দেয়া হল।

কর ও ভূমিসংস্কারও দক্ষিণে কিছুটা হলো। প্রথমে খামারব্যবস্থা চালু থাকলেও জনগণের দাবির মুখে বড় জমি ভাগ করে বিলিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু পেতিওনের সৈন্যরাই এসব সুবিধার ভাগীদার হল। তাদের মালিকানার জমিতে ভাড়াটে হিসাবে চাষাবাদ করত গরিব ভূমিদাস চাষী।

পেতিওঁ দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন স্প্যানিশ কলোনির স্বাধীনতাকামী নেতাদেরকেও সাহায্য করতে শুরু করলেন। এভাবে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে সিমন বলিভারের সাথে। এতে অবশ্য হাইতির সাধারণ করদাতার টাকাপয়সাই খরচ হলো।

দক্ষিণ হাইতির প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি আলেকসন্দ্র পেতিওঁ (জীবৎকাল: ১৭৭০-১৮১৮, শাসনকাল: ১৮০৭-১৮১৮)।

উত্তর-দক্ষিণের দুই রাজ্যই অবশ্য ভূরাজনৈতিক অঙ্গনে সেসময়কার যুক্তরাষ্ট্রের মতই একরকম অচ্ছুৎ ছিল। ইউরোপীয়দের কাতারে যোগদানের জন্যে পেতিওঁ-ক্রিস্তফ দুজনই বেশ মুখিয়ে ছিলেন। কৃষ্ণাঙ্গরা রাষ্ট্রপরিচালনায় কোন অংশে কম নয়, এটা দেখাতে অবশ্য পেতিওনের থেকে ক্রিস্তফ বেশি আগে বাড়া ছিলেন, তাই অর্থনীতির খাতিরে খামারব্যবস্থাকে আগের মত রেখে দেন।

দুই হাইতিতেই এসময় যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা মুক্ত কালোদের অভিবাসন চলে। একই সময়ে পশ্চিম আফ্রিকার লাইবেরিয়ারও গোড়াপত্তন হয় — আগে লিখেছি এ নিয়ে। এভাবে হাইতিতে একটা মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল। তবে মার্কিন থেকে আসা কালো কৃষক ও কারিগরদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই হাইতিতে খাপ না খাওয়াতে পেরে ফিরে যায়। এর মূল কারণ ছিল ভূমিদাসপ্রথা আর পাসপোর্টছাড়া মুক্ত যাতায়াতের অভাব।

১৮২০ সালে উত্তরে রাজা ক্রিস্তফ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর প্রজা আর দরবারের অভিজাত উভয়েরই সমর্থন এতদিনে মিইয়ে এসেছে। তাঁর অসুস্থতার সুযোগে অভ্যুত্থানের মুখে ক্রিস্তফ আত্মহত্যা করেন। কিছুদিনের মধ্যে দক্ষিণের প্রজাতন্ত্রের সৈন্যরা উত্তরের নেতৃত্বহীন সেনাবাহিনীকে হারিয়ে দুই হাইতিকে আবার একত্রিত করে।

ততদিনে দক্ষিণে পেতিওনের মৃত্যু হয়েছে। আর সেখানে ক্ষমতাসীন তারই সহচর জেনারেল বোয়াইয়ের। শুধু উত্তর-দক্ষিণ হাইতি নয়, প্রতিবেশী ডমিনিকান রিপাবলিকের স্প্যানিশবিরোধী স্বাধীনতাসংগ্রামের সুযোগে সে দেশেও দখলদার সৈন্য পাঠিয়েছেন তিনি। এভাবে দুই দশকের জন্যে পুরো হিসপানিওলা দ্বীপটি একই রাষ্ট্রের দখলে আসে।

পেতিওনের উত্তরসূরী জেনারেল জঁপিয়ের বোয়াইয়ের (জীবৎকাল: ১৭৭৬-১৮৫০, শাসনকাল: ১৮১৮-৪৩)। একনায়কতন্ত্র চালান দেশে।

বোয়াইয়েরের শাসনামল ছিল প্রজাতন্ত্রের নামে একনায়কতন্ত্র। সংসদ ছিল কেবল রাষ্ট্রপতির আদেশাবলীতে সীল-ছাপ্পর মারার জন্যে। নিজেকে আজীবন রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন তিনি। প্রদেশগুলির শাসনভার ছিল সেনাসামন্তদের হাতে। প্রতিবাদ-বিরুদ্ধাচারের কোন সুযোগই ছিল না, ধরপাকড় আর বিরোধীদের ফায়ারিং স্কয়াডে মৃত্যুদন্ডপ্রদান চলত নিয়মিত। শিক্ষাক্ষেত্রেও পিছিয়ে পড়ে হাইতি। ক্রিস্তফের গড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ হয়ে যায়। সারা হাইতিতে এসময় ছিল মোটে দশটা পাবলিক স্কুল। আর প্রাইভেট স্কুলগুলিও জোর করে বন্ধ করে দেয়া হয়। বোয়াইয়েরের হিসাবে, শিক্ষা মানেই বিপ্লব আর ক্ষমতার গদি ধরে টানাটানি।

কিন্তু এভাবেই ১৮৪৩এ আরেকটা বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। শহুরে মধ্যবিত্ত গ্রাম্যসমাজ আর ডমিনিকান রিপাবলিকের স্বাধীনতাকামী গুপ্তসংস্থার সাথে যোগ দিয়ে বোয়াইয়েরকে তাঁড়াতে সক্ষম হয়। এই ডামাডোলের সুযোগে ডমিনিকান রিপাবলিক হাইতি থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ডমিনিকানরা হাইতিতে খুব একটা সুখে ছিল না। বিশেষত সেখানে প্রচুর শ্বেতাঙ্গের বসবাস ছিল, হাইতির রাষ্ট্রতন্ত্র অনুযায়ী তারা ছিল সম্পত্তির মালিকানা থেকে বঞ্চিত।

হাইতির নতুন উদারপন্থী সরকার আরেকটা সংবিধান রচনা করল। কিন্তু হাইতির প্রবাদেই রয়েছে, ‘শাসনতন্ত্র ছাঁপানো কাগজে, আর বেয়নেট তৈরি ইস্পাতে!’ সরকার যতই সংস্কারপন্থী হোক না কেন, ক্ষমতায় আসামাত্র গদি পাকাপোক্ত করতে তারা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। নতুন সরকারের ওপর রক্ষণশীল সেনাবাহিনীর চাপ এক দিক থেকে, আরেকদিকে গ্রাম্য পপুলিস্ট মিলিশিয়াও দাঁড়িয়ে গেছে শহুরে এসট্যাবলিশমেন্টের প্রভাবের বিরুদ্ধে। এসকল বিদ্রোহ-বিপ্লবেই কেটে যায় কয়েক বছর।

শেষমেষ ১৮৪৭এ আপোষের ভিত্তিতে কৃষাঙ্গ বয়োবৃদ্ধ রাজনীতিবিদ ফাউস্ত্যাঁ সুলুককে রাষ্ট্রপতি হিসাবে গ্রহণ করে নেয় বিবাদমান দলগুলি। তারা ভেবেছিল, নমনীয় কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট দোআঁশলা এলিটদের কথা যেমন শুনবেন, তেমন গ্রামাঞ্চলের কৃষ্ণাঙ্গ জনসাধারণও তুষ্ট হবে স্বগাত্রবর্ণের নেতা পেয়ে।

কিন্তু এদের সব পরিকল্পনা ভন্ডুল করে দিলেন সুলুক — ১৮৪৯এ তিনি হয়ে বসলেন হাইতির দ্বিতীয় সম্রাট! এবার বোধহয় তাঁর রাস্তা ধরেই ১৮৫১তে ফ্রান্সের সম্রাট বনলেন তৃতীয় নাপোলেওঁ। নাপোলেওঁকে নিয়ে সরাসরি হাস্যকৌতুক করতে বাঁধা থাকায় ফরাসী থিয়েটারে সম্রাট সুলুক তাঁর স্থানপূরণ করেন! সুলুকের দরবারের হাস্যকর সব পদবীর অভিজাত, যেমন ডিউক অফ লেমনেড আর ডিউক অফ মারমালেডের কথোপকথন শুনে ফরাসীরা নাপোলেওনকে স্মরণ করেই হেসে গড়িয়ে পড়ত।

হাইতির দ্বিতীয় সম্রাট ফাউস্ত্যাঁ সুলুক (জীবৎকাল: ১৭৮২-১৮৬৭, শাসনকাল: রাষ্ট্রপতি, ১৮৪৭-৪৯, সম্রাট, ১৮৪৯-৫৯)।
ফ্রান্সের সম্রাট তৃতীয় নাপোলেওঁ সুলুকের মতই প্রথমে ছিলেন রাষ্ট্রপতি (১৮৪৮-৫২), তারপর সম্রাট (১৮৫২-৭০)।

ক্রিস্তফ-পেতিওঁ-বোয়াইয়ের-সুলুক সবার আমলেই হাইতিতে অ্যাবলিশনিস্টদের যাতায়াত হয়েছে। এরা সকলেই হাইতির স্বাধীনতাপরবর্তী অবস্থা দেখে যারপরনাই বিব্রত হয়েছেন। দাসপ্রথা যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যে অবশ্যপ্রয়োজনীয় নয়, তা প্রমাণ করতে গিয়ে উল্টো চিত্র দেখেন তারা। ক্যারিবিয়ানের অন্যান্য দ্বীপের দাসদের থেকে হাইতির কৃষ্ণাঙ্গদের অর্থনৈতিক অবস্থা এমন কিছু ভাল হয়নি। পঞ্চাশ বছর আগে ফরাসীদের ছেড়ে যাওয়া চিনির খামার আগাছাভরা। মানুষজন গাত্রাচ্ছাদন ছাড়াই ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের বাসস্থান কুঁড়েঘরে, ইত্যাদি। সামান্য মুক্তি পেয়ে তারা সুখী বটে কিন্তু নিজেদের বৈষয়িক উন্নতির কোন চিন্তা তাদের নেই।

তাদের এ পর্যবেক্ষণ অবশ্য সম্পূর্ণ নয়। হাইতির শুরুতে নগর ও গ্রামের বৈষম্যের বীজ রোপিত হয়েছিল। তার ফলে কৃষিখামারে উৎপন্ন শস্য রপ্তানি থেকে উপার্জিত রাজস্বে শহুরে ফরাসীভাষী মানুষ উন্নতি করেছে। আর ক্ষতি হয়েছে ক্রেওলভাষী কৃষ্ণাঙ্গ চাষাদের। বাণিজ্যে করারোপ করেই হাইতির রাষ্ট্রপরিচালনার সিংহভাগ খরচ উঠত, আর ১৮৮১ নাগাদ এই নির্ভরতা গিয়ে ঠেকে ৯৮ শতাংশে। অর্থাৎ শহুরে বণিকগোষ্ঠীর সমৃদ্ধি যুগিয়েছে খামারের ভূমিদাস কৃষক। এদের উপার্জন একদিকে কমেছে, আর ভোগ্যপণ্যের খরচ বেড়েছে। খামারে কাজ করার পাশাপাশি রাস্তাঘাট তৈরি আর অন্যান্য সরকারী উন্নয়ন প্রকল্পেও চাষাদের জোর করে কাজে লাগানো হত। সরকারী চাকুরে বা খামারের শ্রমিক না হলে যে কারো গ্রেপ্তার ও খামারে সোপর্দ ছিল অনিবার্য।

হাইতি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত ছিল সামরিক বাহিনী আর শহুরে উচ্চমধ্যবিত্তের হাতে, এদের অধিকাংশ ছিল মুলাটো বা দোআঁশলা বর্ণের। গ্রামের মানুষের সাথে এদের ছিল বিস্তর ফারাক।
গ্রাম্য হাইতিয়ানদের ভুডু ধর্মকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা হত শহুরে সমাজে। সরকারের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও গ্রামের মানুষ ভুডু চর্চা করত। এরা নাকি নরবলি দিত। এ চিত্রে ১৮৬৪ সালের একটি চাঞ্চল্যকর ভুডু নরবলির মামলার গ্রেপ্তারকৃত আসামীদের দেখানো হয়েছে।
হাইতির গ্রাম্যসমাজে লাকু বা পঞ্চায়েতব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষ সরকারের চোখের আড়ালে নিজেদের স্বাধীন জীবনযাত্রা চালিয়ে যায়।

নগরভিত্তিক সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে বাঁচতে অভিনব পদ্ধতি বের করে হাইতির গ্রামগুলি। ‘লাকু্’ বলে একটা সিস্টেম তৈরি করে তারা, অনেকটা পঞ্চায়েতের মত। বড় যৌথ পরিবার নিয়ে ছোট আবাদী জমির মাঝে কুঁড়েঘরের গ্রুপ বানিয়ে তারা থাকত। সরকারী খামারে নামমাত্র কাজ করে এসে নিজ জমিতেই কফি-তামাক ফলাত, সেসবের একাংশ বেঁচত নিজেদের আভ্যন্তরীণ বাজারে, বাকিটা নিকটস্থ বন্দরশহরে। সরকার ঘুণাক্ষরেও জানতে পারত না লাকুর বার্টার ইকনমিতে কি পরিমাণ শ্রম আর রাজস্ব ফাঁকি যাচ্ছে। বাধ্যতামূলেক শ্রমের ডাক পড়লেও সেখানে না গিয়ে কাছের পাহাড়ে লুকিয়ে থাকত গ্রামবাসী।

এভাবে স্বদেশের শোষক সরকারই হয়ে দাঁড়ায় হাইতিবাসীর মূল প্রতিপক্ষ। কিন্তু নিজেরাই একটা লিবার্টারিয়ান-এগালিটারিয়ান সমাজ তৈরি করে ফেলে হাইতিবাসী, বাইরের সাহায্য ছাড়াই। সরকার থেকে নিষেধ থাকা সত্ত্বেও লাকুগুলিতে ভুডু ধর্মের চর্চা চলতে থাকে, ক্রেওল ভাষাও উত্তরোত্তর জনপ্রিয়তা পেতে থাকে।

কিন্তু এ ব্যবস্থা ছিল বেশ প্রিমিটিভ আর ভঙ্গুর। সরকারের হাত হাইতিবাসীর করের পয়সাতেই আরো যত লম্বা হতে থাকল, তত তাদের যাতায়াত ও জীবনযাপনের স্বাধীনতা আরো সংকুচিত হতে শুরু করল। পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এই ক্ষণস্থায়ী কার্যকরী সমাজব্যবস্থা শীঘ্রই তাসের ঘরের মত ধ্বসে পড়বে উত্তাল সময়ের ঝড়ে।

বুডিকার বিদ্রোহ ও অন্যান্য

Featured Video Play Icon

গেম অফ থ্রোনস সিরিজের ভক্তদের নিশ্চয় মনে করিয়ে দিতে হবে না, ওয়েস্টেরোসের উত্তর সীমান্তের ‘দ্য ওয়াল’ দেয়ালের কথা। হোয়াইট ওয়াকার আর ওয়াইল্ডলিংদের আক্রমণ থেকে প্রতিরক্ষার জন্যে সুউচ্চ দেয়ালটা তৈরি করেন নেড স্টার্কের পূর্বপুরুষ ব্র্যান দ্য বিল্ডার।

ওয়ালের মত থ্রোনসের অনেক কিছুই কিন্তু ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের ভূগোল-ইতিহাসের সাথে মিলে যায়!

এই ধরুন হেড্রিয়ান’স ওয়াল। স্কটিশ ‘হাইল্যান্ডসের’ দক্ষিণে — ইংল্যান্ডের ‘নর্থে’(!) — প্রস্তরনির্মিত এই দেয়াল উত্তর সাগর থেকে আইরিশ সাগর পর্যন্ত ৭৩ মাইলব্যাপী বিস্তৃত। রোমসম্রাট হেড্রিয়ান ১২২ খ্রীষ্টাব্দে এর নির্মাণকার্য শুরু করেন।

এর আগে রোমের সেনাপতি জুলিয়াস সীজ়ার ৫৫ ও ৫৪ খ্রীষ্টপূর্বে যুদ্ধজাহাজের বহর নিয়ে ব্রিটেনে এসেছিলেন। সেটা ফ্রান্সে কেল্টদের সম্মিলিত সেনাদলকে পরাজিত করারও দু’বছর আগে। কেল্টিক ব্রিটন উপজাতি কাতুভেলাউনিদের রাজা কাসিভেলাউনাস সীজ়ারের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। কিন্তু গলের বিদ্রোহদমনের জন্যে সীজ়ারকে ইউরোপের মূল ভূখন্ডে ফিরে যেতে হয়। ব্রিটনরা তারপর আবার আগের মত স্বাধীন।

এ স্বাধীনতা বেশিদিন টেকেনি। একশ’ বছরের মধ্যেই — খ্রীষ্টীয় চল্লিশের দশকে — সম্রাট ক্লডিয়াসের আদেশে নতুন করে রোমের সেনাবাহিনী যুদ্ধ নতুবা মিত্রতার চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটেনের গোত্রগুলিকে একে একে বশ করা শুরু করে। স্বাধীনতাসংগ্রামীদের মধ্যে সেসময়ের একজন ব্রিটিশ লোক-ইতিহাসে এখনও সুপরিচিত, এবং তিনি একজন নারী। নাম বুডিকা

কেল্টিক ইসেনি গোত্রের রাণী ছিলেন বুডিকা, আরেক নাম বুডিসিয়া। রাজা প্রাসুটেগাস ছিলেন রোমানদের মিত্র, উত্তরসূরী হিসাবে দুই কন্যার সাথে সম্রাট নিরোকে সহ-শাসক ঘোষণা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর রোমান সামরিক শাসক সেই উইল অ‌গ্রাহ্য করে নিরোকে একমাত্র শাসক দাবি করেন। দাবি অমান্য করায় বুডিকাকে জনসম্মক্ষে চাবুকপেটা করা হয়, দুই রাজকন্যা হন রোমসৈন্যদের দ্বারা ধর্ষিত। তারপর প্রতিশোধপরায়ণ বুডিকা ইসেনিসহ অন্যান্য স্বাধীনতাকামী কেল্টিক গোত্রের সৈন্যদলকে একতাবদ্ধ করে ফিরে আসেন।

সংখ্যায় ভারি বুডিকার সেনাশক্তি কয়েকটি খন্ডযুদ্ধে জয়লাভ করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রোমের অভিজ্ঞ, নিয়মিত সৈন্য ও রণকৌশলে পারদর্শী সেনানায়কদের কাছে তিনি হেরে যান। এরপর প্রায় চারশ’ বছরের জন্যে বর্তমান ইংল্যান্ড, ওয়েলস আর কর্নওয়াল রোম সাম্রাজ্যের অধীন হয়ে থাকে।

ও হ্যাঁ, ইতিহাস ‘সবসময়’ বিজয়ীরা লিখলেও অনেকসময় সঠিকটাই লেখেন। কারণ বুডিকার বিদ্রোহের ন্যায্য কারণ ও আনুষঙ্গিক ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ আমরা ট্যাসিটাস আর ক্যাসিয়াস ডিও বলে দুই সমসাময়িক রোমান ইতিহাসবিদের কাছে পাই। ট্যাসিটাসের শ্বশুর আবার ছিলেন রোমের সেনাপতি।

দুটো এলাকা অবশ্য রোমের শাসন থেকে বেঁচে যায়। আয়ারল্যান্ড, যা আলাদা দ্বীপ, আর স্কটল্যান্ড — ‘আলবিয়ন’ দ্বীপের পাহাড়ী উত্তরভাগ। রোমানদের কাছে ক্যালিডোনিয়া নামে পরিচিত স্কটল্যান্ডের এ অংশে বাস ছিল পিক্ট বলে একটি গোত্রের। তারা কেল্টিক জনগোষ্ঠীরই একটি অংশ বলে ধারণা করা হয়।

পিক্টরা ‘সভ্য’ রোমানদের কাছে ছিল বর্বর — অনেকটা থ্রোনসের ওয়াইল্ডলিংদের মত। যুদ্ধক্ষেত্রে তারা আবির্ভূত হত খালি গায়ে, আর সারা শরীরে ছিল রঙীন উল্কি। পিক্টরা ছিল রক্তপিপাসু, হিংস্র। এদের কোন নগর ছিল না, যদিও লৌহনির্মিত অস্ত্রপ্রযুক্তি তাদের নখদর্পণে ছিল।

এই পিক্ট আর তাদের আইরিশ মিত্ররা প্রায়ই ব্রিটেনের ভেতরে এসে লুটতরাজ করে রোমান পুলিশ আসার আগেই পর্বতাঞ্চলে ভেগে পড়ত। হেড্রিয়ান’স ওয়াল বানানোর এটাই মূল কারণ। একটা সময় হেড্রিয়ান’স ওয়ালেরও উত্তরাংশ রোমের আয়ত্তে চলে আসে, তখন তারা আরেকটু উত্তরে অ্যান্টোনিন ওয়াল বলে আরেকটি দেয়াল তুলে নিজেদের আরও সুরক্ষিত করে।

আয়ারল্যান্ড-স্কটল্যান্ডের তুলনায় ইংল্যান্ড একটু কম সুরক্ষিত। কারণ, ইংলিশ চ্যানেল ডোভারে মোটে ২০ মাইল চওড়া। পঞ্চম শতকের ‘গ্লোবাল ক্রাইসিসের’ সময় রোমানরা জার্মানিক গথ ‘মাইগ্র্যান্ট’ গোত্রদের আক্রমণে যখন ব্যতিব্যস্ত, তখন তারা ইংল্যান্ড থেকে ধীরে ধীরে সেনাবাহিনী সরিয়ে নেয়। প্রতিরক্ষার অভাবে ডেনমার্ক-জার্মানি থেকে সাগরপথে অ্যাঙ্গল, স্যাক্সন, জুট নামক অন্যান্য জার্মানিক গোত্র এসে হাজির হয়ে যায় ইংল্যান্ডে। অ্যাঙ্গল থেকেই ইংল্যান্ডের নামকরণ। পরবর্তীতে ভাইকিংরাও হানা দেয় সেখানে। শেষ সফল সমুদ্রাভিযান করেন নর্ম্যান ডিউক উইলিয়াম দ্য কনকারার। সে সালটা একটা ইংরেজী সংখ্যা দিয়ে সুপরিচিত — টেন-সিক্সটি-সিক্স। অধুনাকালে নাপোলেঁওহিটলারও অবশ্য সমুদ্রাভিযানের চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সফল হননি।

অপরদিকে স্কটল্যান্ড-আয়ারল্যান্ড বাইরের ‘সভ্য-শিক্ষিত’ বিশ্ব থেকে বহুদিন বিচ্ছিন্ন ছিল। নবম শতাব্দীতে ভাইকিংদের আক্রমণ প্রতিহত করার লক্ষ্যে পিক্টরা উত্তর আয়ারল্যান্ডের গেল নামক কেল্টিক গোত্রদের সাথে মিলে নতুন এক রাজ্যমন্ডলীর গোড়াপত্তন করে, তার নাম ছিল ডেল রিয়াটা। গেলদের ভাষা-সংস্কৃতি গ্রহণ করে স্কটিশ হাইল্যান্ডের পিক্ট অধিবাসীরাও হয়ে যায় গেলিক। আজকের স্কটল্যান্ডের অন্যতম ভাষা স্কটিশ গেলিক আর আইরিশ গেলিক একই ভাষাপরিবারের অংশ।

পিক্ট-গেলদের পরবর্তী রাজ্য আলবার রাজনীতি ছিল আর সব কেল্টদের মত পরিবার-গোত্র-ট্রাইব ভিত্তিক। তারা ভ্রাতৃঘাতী অনেক যুদ্ধ করেছে গোচারণভূমির অধিকার নিয়ে। কখনো একে অন্যের গবাদিপশু চুরির কারণে শতাব্দীব্যাপী পারিবারিক শত্রুতার সূচনা হত। শেক্সপীয়ারের ট্র্যাজিক নায়ক ম্যাকবেথ আসলে ছিলেন আলবার রাজা। অন্য রাজবংশের ডানকানকে যুদ্ধে হত্যা করে সিংহাসনে আসীন হন তিনি। অবশ্য শেক্সপীয়ারের বর্ণনাগুলি একটু রঙচড়ানো।

উইলিয়ামের নর্ম্যান কনকোয়েস্টের পরে স্কটদের কিছু গোত্র ইংল্যান্ডের নর্ম্যান-ফরাসী বনেদী পরিবারে বিয়েশাদীর মাধ্যমে নিজেদের আভিজাত্য বাড়ানোর চেষ্টা করে। তাই গেলিক ভাষার পাশাপাশি মিডল ইংলিশ ভাষারও প্রচলন শুরু হয়। স্কটস নামক ইংরেজীর উপভাষা তাই আজ স্কটল্যান্ডে গেলিকের থেকে বেশি প্রচলিত।

বনেদী সম্পর্কের অজুহাতে ত্রয়োদশ শতকে যুধ্যমান ক্লান লীডাররা ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম এডওয়ার্ডকে অনুরোধ করে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে রাজা ঠিক করে দিতে। এডওয়ার্ড সে সুযোগে স্কটল্যান্ডের শাসনভার নিজের হাতে কুক্ষিগত করেন। তখন প্রায় ষাট বছরব্যাপী স্বাধীনতাসংগ্রাম শুরু হয়ে যায়, যাতে হলিউডি মুভির সুপরিচিত উইলিয়াম ওয়ালেস, রবার্ট দ্য ব্রুস আর অন্যান্যরা ইংলিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে শেষ পর্যন্ত জয়ী হন। ১৬০৩এ স্কটল্যান্ডের রাজা ষষ্ঠ জেমস পারিবারিক উত্তরাধিকারসূত্রে ইংল্যান্ডেরও রাজা অভিষিক্ত হন। এই সময়েও স্কটল্যান্ড আলাদা স্বাধীন দেশ ছিল। সে স্বাধীনতা খর্ব হয় ১৭০৭এ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মন্দার সম্মুখীন স্কটিশরা অ্যাক্ট অফ দ্য ইউনিয়নের শর্তানুযায়ী ইংল্যান্ড-স্কটল্যান্ডের অবিভক্ত রাজ্য ‘গ্রেট ব্রিটেনকে’ মেনে নেয়।

এসব ইতিহাসের সাথে সঙ্গে দেয়া গানটির সম্পর্ক একরকম আছে। ঐ যে বলছিলাম, দুর্গম পাহাড় ও দ্বীপপুঞ্জের দেশ স্কটল্যান্ড বহুদিন ‘সভ্যতা’ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। ইংল্যান্ড তার কেল্টিক ঐতিহ্য কালে কালে হারিয়ে ফেলে, সে জায়গা নেয় লাতিন-জার্মানিক-নর্ম্যান-ফরাসী ভাষা ও কেতা। যখন ইংলিশরা সেপথে শিক্ষা-দীক্ষা নিচ্ছে, তখনও স্কটল্যান্ড আর আয়ারল্যান্ডে অনেক ‘গাঁইয়া’ ব্যাপারস্যাপার প্রচলিত ছিল। তাই তাদের প্রচুর লোকসংস্কৃতি বেঁচে গেছে। নানাসময় খারাপ অবস্থায় নিপতিত হলেও এখন স্কটিশরা আদি ভাষা-গান শিখে আত্মপরিচয় পুনরাবিষ্কার করছে। অবশ্য সন্দেহাতীতভাবে বলতে পারি যে, ভিডিওর স্কটিশ গায়কদের কারো ধমনীতে সম্পূর্ণ পিক্টিশ বা গেলিক রক্ত নেই, যেমনটা আমাদের দেশেরও কারো শতভাগ ‘শুদ্ধ-শুচি’ বংশপরিচয় নেই।

স্কটিশ গেলিক ভাষায় গাওয়া এ গানটি এক ধরনের ‘ওয়াকিং সং’ — দলগত শ্রমসঙ্গীতের একটি উদাহরণ। তিন দশক আগেও আমার বাবাকে দেখেছি উলের তৈরি টুইডের কোট পড়তে। স্কটিশদের স্কার্টের মত জামা ‘কিল্ট’ এ কাপড়েই তৈরি, ঠান্ডা আবহাওয়ায় তা আরামদায়ক। টুইড একসময় হাতেই বানাত স্কটল্যান্ডের গ্রামের মেয়েরা। সেটা বানানোর একটা পর্যায়ে বড় এক চক্র করে বসে নানাবয়েসী কর্মী কাপড়ের কুন্ডলীকে চেপে চেপে কম্প্রেস করত, তাতে টুইডের ঘনত্ব বাড়ত। এই প্রক্রিয়াটাকে বলা হয় ওয়াকিং বা ফুলিং।

কাজটা ছিল পুনরাবৃত্তিপূর্ণ আর একঘেঁয়ে। তাই কাজের সাথে তাল মেলাতে ওয়াকিং সংয়ের উৎপত্তি। কাজের দ্রুততার সাথে গানের বিষয়-তালও পরিবর্তিত হত। এতে কাজটা আনন্দদায়ক হত, নৈপুণ্যও বাড়ত। গানের বিষয় ছিল নারীমহলের দৈনন্দিন ছোটবড় দুঃখ-সুখ-আশা-নিরাশার প্যাঁচাল, কখনো কানাঘুষা-কুৎসারটনা। যেমন, এই গানটায় বর্ণিত হচ্ছে আনা নামে এক মেয়ের কথা। সে অন্তঃস্বত্ত্বা, সন্তানের বাবা যেনতেন কেউ নয়, স্বয়ং নৌবাহিনীর লর্ডের পুত্র! আনার প্রতিটা বড়াইয়ের পরে সখীরা কোরাস করে তার প্রতি মমতা প্রকাশ করছে। গানের কথা সবসময় এক থাকত না, ইম্প্রভাইজ় হত প্রতিবারে। আরেকরকম ওয়াকিং সং আছে যার ভাষার কোন মানে নেই, তালের সাথে আবোলতাবোল। এদেরকে বলে পোর্টা বিঅল

বাংলাদেশের লোকগীতির সাথে যারা পরিচিত, তারা হয়ত সারিগান শুনেছেন। দক্ষিণপূর্ব বাংলার ভাটি অঞ্চলে নৌকাবাইচের সাথে সারিগান হয়। এগুলোও কিন্তু মূলে শ্রমসঙ্গীত! দৈনন্দিন কাজের একঘেঁয়েমি কাটাতেই এর উৎপত্তি, নৌকাবাইচের ঐতিহ্যে বেঁচে রয়ে গেছে। সারিগানেরও বিষয়বস্তু ওয়াকিং সংয়ের মত। যেমন, ‘শাম পীরিতির এত যন্ত্রণা’ নামে গানটিতে এক তরুণী অভিযোগ করেছেন শাশুড়ীর খোঁটা দেয়া নিয়ে। এরকম শাশুড়ী-বউয়ের পারিবারিক বিরোধ নিয়ে স্কটিশ ওয়াকিং সংও আছে।

ফকির আলমগীরের হেনরির হাতুড়ি গানটাও আমেরিকার রেলশ্রমিকদের শ্রমসঙ্গীত। আমেরিকার শিল্পায়নের সময় হাজার হাজার মাইল রেললাইন বসিয়েছিল সাদা-কালো-চীনা নানা জাতের শ্রমজীবী মানুষ। স্টীল-ড্রাইভিং বলে একটা ধাঁপ ছিল, তাতে তাল ঠিক রেখে টীমওয়ার্ক করতে হত। কৃষ্ণাঙ্গ জন হেনরির লেজেন্ডের উৎস এখানেই। মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ দাসেদেরও তুলোর ক্ষেতে কাজের সময় গাওয়া গানগুলি থেকে এখনকার অনেক ‘স্পিরিচুয়াল’ গস্পেলগীতির আবির্ভাব। ওয়াকিং সংয়ের মত এদেরও বৈশিষ্ট্য ‘কল অ্যান্ড রেসপন্স’ — একটা সোলো ‘কল’ লাইনের পর সবাই মিলে ‘কোরাস’ রেসপন্স।

লোকসংস্কৃতি বেঁচে থাকে চিরন্তন একটা মানবিক ভিত্তির ওপর। সেটার জন্যে ‘সভ্য’ শিক্ষাদীক্ষার কোন দরকার নেই, আভিজাত্য আর ক্লাস মেইনটেইন করার কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। খুবই তুচ্ছ ব্যাপারস্যাপার নিয়ে গানগুলি হতে পারে। কিন্তু চিন্তা করে দেখুন, মানুষ কত জাতি-ধর্ম-দেশে বিভক্ত, তারপরও অশিক্ষিত গেঁয়ো চাষী, তাঁতি বা মাঝির মধ্যে কত শক্তিশালী একটা সার্বজনীন মানবিক পরিচয় লুকিয়ে আছে!

আজ আমাদের মনে হতে পারে যে, এসব সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে — আগের ‘ভালো’ জিনিসগুলো আর নেই। সে নিয়ে আক্ষেপ করে প্রোটেকটিভ-প্রোটেকশনিস্ট-ন্যাশনালিস্ট ইত্যাদি হবার কিছু নেই। সেসবকে একশ’ ভাগ ফেরানো যাবে না। আমি বলবো, মানুষের সার্বজনীন সাংস্কৃতিক পরিচয় বিবর্তিত হয়ে বেঁচে থাকবে নতুন কোন মাধ্যমে। ‘সভ্যতার পতন’ ঘটলেও সরল মাধ্যমগুলির সার্বজনীন আকর্ষণ রয়ে যাবে, আর তা ক্রমাগত বিকশিত হতে থাকবে আমাদের ভবিষ্যতপ্রজন্মের মানসে।

ৰালুম আদ্রিয়ানি বা হেড্রিয়ান’স ওয়াল রোমান প্রদেশ ব্রিটানিয়ার উত্তরে ১২২ খ্রীষ্টাব্দে তৈরি শুরু হয়। নর্থ সীর পারে টাইন নদীর তীর থেকে শুরু করে আইরিশ সীর পারে সলওয়ে ফার্থে গিয়ে শেষ। প্রতি পাঁচ মাইলে একটি করে দুর্গ ছিল। রোমান সাম্রাজ্যের সবচে’ উত্তরের সীমানা। এরও উত্তরে বাস করত প্রাচীন ব্রিটনদের নানা ‘জংলী’ গোষ্ঠী, যাদের একটি পিক্ট।
জুলিয়াস সীজ়ার আর ট্যাসিটাসের মত ‘প্যাট্রিশিয়ানরা’ ছিল প্রাচীন রোমের অভিজাতশ্রেণী। এদের পূর্বপুরুষরা রোমনগরীর গোড়াপত্তনের সময় সেখানকার অধিবাসী ছিলেন। সাম্রাজ্যে রূপান্তরিত হবার আগে রোম ‘প্রজাতন্ত্র’ ছিল। প্রজাতন্ত্রের সেনেটের সকল সদস্য ছিল প্যাট্রিশিয়ান, আর সাধারণ মানুষদের প্রতিনিধিত্ব ছিল প্লিবিয়ান কাউন্সিলের মাধ্যমে। আমেরিকার সেনেট-হাউজ সে আদলেই গড়া। ধনাঢ্য প্রভাবশালী রোমান প্যাট্রিশিয়ানরা বংশগৌরবের বড়াই করত, ভাল-খারাপ বংশের ভিত্তিতে জাতপাত মানত। এই ছবিতে এক প্যাট্রিশিয়ানের মূর্তিতে দেখা যাচ্ছে তিনি তাঁর দুই পূর্বপুরুষের আবক্ষ মূর্তি হাতে নিয়ে বংশগরিমা জাহির করছেন।
বেলজিয়ান কমিক্স সিরিজ অ্যাস্টেরিক্স দ্য গলের অ্যাস্টেরিক্স ইন ব্রিটেন পর্বে ব্রিটেনের গোত্রপতি কাসিভেলাউনাসকে চিত্রিত করা হয়েছে এভাবে। সম্ভবত টেমস নদীর উত্তরপারে তাঁর গোত্র কাতুভেলাউনির আবাস ছিল। অন্যান্য সব কেল্ট উপজাতির মত এরাও তাদের অন্যান্য তুতোভাইদের সাথে সবসময় মারামারিতে লেগে থাকত।
৪৮ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের রোমান মুদ্রায় গলের কেল্টিক আর্ভের্নি গোত্রাধিপতি ভারসিন্জেটরিক্সের চিত্র। জার্গোভিয়া শহরে ৫২ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে রাজা নির্বাচিত হবার পর রোমসাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে গল প্রদেশের বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন। কেল্টিক উপজাতিগুলি আসলে ঐক্যবদ্ধ ছিল না, জুলিয়াস সীজ়ার তার সুযোগ নিয়ে রোমের কর্তৃত্ব বহাল করেছিলেন গলে। ভারসিন্জেটরিক্স যেটুকু ঐক্য আনতে পেরেছিলেন, তা দিয়ে তৈরি সৈন্যদল শেষবারের মত আলেসিয়াতে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু সীজ়ারের চতুর যুদ্ধকৌশলের কাছে পরাস্ত হয়। ভারসিন্জেটরিক্সকে বন্দী করে রোমে নিয়ে যাওয়া হয়, বিজয়যাত্রায় তাঁকে শৃংখলাবদ্ধ অবস্থায় রোমানদের সামনে প্রদর্শন করা হয় আর কয়েক বছর পরে বন্দীদশায় তাঁর মৃত্যু হয়। নিচে ডানের মুদ্রাপিঠে তাই চিত্রিত হয়েছে। এসব কাহিনী লিপিবদ্ধ করাটাও অবশ্য রোমান ইতিহাসবিদদের কৃতিত্ব, কারণ কেল্টিকদের সিংহভাগ লিখতে-পড়তে জানত না। যারা জানত, তারা রোমানদেরই পৃষ্ঠপোষকতায় তা শিখে, আর ধীরে ধীরে লাতিনভাষীই হয়ে যায়। বর্তমান ফরাসী ভাষা লাতিনেরই অপভ্রংশ। ও আরেকটা ব্যাপার হল, কেল্টদের একটা গোত্র সেনোনেস আলেসিয়ার যুদ্ধের তিনশ’ বছর আগে রোম নগরী লুন্ঠন করে। তখন রোম সীজারের সময়কার মত শক্তিশালী ছিল না। তাই আলেসিয়ার বিজয় ছিল রোমানদের একরকম প্রতিশোধ।
ব্রিটিশ চিত্রশিল্পী জন ওপি বুডিকাকে এঁকেছেন এভাবে। তাঁর পোশাকআশাক রোমান ধাঁচের দেখানো হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে এমনটা ছিল না। বুডিকা তাঁর সমব্যথী ব্রিটনদেরকে আহ্বান করছেন রোমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে ধরার জন্য। রোমান ইতিহাসবিদ ট্যাসিটাস বুডিকার অগ্নিবর্ষী সেই ভাষণের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। বুডিকার নেতৃত্বে ব্রিটনরা বেশ কিছু রোমান সেটলমেন্ট জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়, আর রোমান সাধারণ নাগরিকরা নিহত-নিগৃহীত হয়। যুদ্ধে পরাজয়ের পরে ধরা না পড়লেও পলাতক বুডিকা শেষ পর্যন্ত নাকি বিষপানে আত্মহত্যা করেন।
অস্ট্রিয়ার পার্লামেন্ট ভবনের সামনে রোমান ইতিহাসবিদ ট্যাসিটাসের প্রতিকৃতি। রোমের সেনেটরও ছিলেন। অ্যানালস আর হিস্টরিস নামে তাঁর দুটি বইয়ের অংশবিশেষ এখনো বিদ্যমান। সেগুলিতে ট্যাসিটাস অগাস্টাস সীজারের স্থাপিত রোমান সাম্রাজ্যের প্রথম চার সম্রাটের রাজত্বকালের বর্ণনা লিখে গেছেন। ট্যাসিটাস তাঁর শ্বশুর আগ্রিকোলারও জীবনী লিখেন, আগ্রিকোলা ব্রিটেনবিজয়ের পুরোধা সেনাপতি ছিলেন। রোমান ইতিহাসবিদদের মধ্যে ট্যাসিটাস সর্বকালের সবচে’ পরিচিত ও সম্মানিত।
দ্বিতীয় শতাব্দীর মিশরী-গ্রীক ভূগোলবিশারদ টলেমির বর্ণনানুযায়ী মধ্যযুগে আঁকা মানচিত্র। প্রাচীন গ্রীকদের কাছে গ্রেট ব্রিটেন দ্বীপের নাম ছিল আলবিয়ন। পরে ব্রিটানিয়া নামেও পরিচিত হয়। এর উত্তরাংশের নাম ট্যাসিটাসের ইতিহাসে পাওয়া যায় ক্যালেডোনিয়া হিসাবে, সেখানের অধিবাসী ক্যালেডোনিঈ নামে এক গোত্রের নামানুসারে। মধ্যযুগের ‘ইতিহাসবিদদের’ ধারণা ছিল যে আদিকালে আলবিয়নে দৈত্যদের বসবাস ছিল।
ট্যাসিটাসের হিংস্র পিক্টদের বর্ণনা থেকে ষোড়শ শতাব্দীর চিত্রকর তাদের একজনকে কল্পনা থেকে এঁকেছেন এভাবে। এরা নাকি যুদ্ধে হেডহান্টিং করত। দশম শতাব্দীতে পিক্টদের জাতিপরিচয় তাদের রাজনৈতিক মিত্র গেলদের সাথে মিশে যায়। স্কটল্যান্ডে এখনও বড় বড় পাথরে পিক্টদের খোদাই করা নানা নকশা, জীবজন্তুর চিত্র দেখা যায়। ভাষালিপির উদাহরণ পাওয়া গেছে কম।
জার্মানির এক জাদুঘরে ঐতিহাসিক বর্ণনা থেকে কেল্ট যোদ্ধার পোশাক রিকন্স্ট্রাক্ট করা হয়েছে এভাবে। কেল্টরা ইউরোপের অন্যতম আদিবাসী ইন্দো-ইউরোপীয়ভাষী জাত, যেমনটা গ্রীকরা। চেকারড জামা কেল্টদের ট্রেডমার্ক। এখনো আয়ারল্যান্ড-স্কটল্যান্ডের অনেক ঐতিহ্যবাহী ডিজাইনে কেল্টিক মোটিফ চেনা যায়। কেল্টদের প্রাচীনতম উল্লেখ কমপক্ষে ষষ্ঠ খ্রীষ্টপূর্ব শতাব্দীতে। এরা নগরবাসী না হলেও চামড়া আর ধাতুর কাজ, অস্ত্র তৈরি, পোশাক বানানো — এসবে পারদর্শী ও স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। স্বাধীনচেতা কেল্টরা রোমানদের বশীভূত হলেও তাদের পূর্ববর্তী সংস্কৃতির ছাপ স্পেনের গ্যালিসিয়া, ফ্রান্সের ব্রিটানি, যুক্তরাজ্যের ওয়েলস, কর্নওয়াল, স্কটল্যান্ড ও আইল অফ ম্যান, হেব্রাইডসের মত ছোট দ্বীপগুলো এবং আয়ারল্যান্ডের মত দূর অঞ্চলের ভাষা, চিত্রকলা আর সঙ্গীতের মধ্যে এখনও রয়ে গেছে।
জার্মানিক বলতে ইতিহাসে ইন্দোইউরোপীয়ভাষী এক বিশাল জনগোষ্ঠীকে বোঝানো হয়। তাদের নামেই জার্মানির ইংরেজী নাম, যা এসেছে লাতিন হয়ে। ভাইকিং বা নর্স, অ্যাঙ্গল, স্যাক্সন, জুট, গথ — এরা সবাই জার্মানিক। ফ্রান্সের বর্তমান নাম যাদের নামে, সেই ফ্রাংকরাও জার্মানিক। খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিসহস্র সাল থেকে জার্মানিকদের উল্লেখ পাওয়া যায়। পঞ্চম শতকের উথালপাথাল সময়ে হুনরা এশিয়া থেকে মাইগ্রেট করে আসে পূর্ব ইউরোপে, তাদের চাপে জার্মানিক গোত্রগুলি আরো পশ্চিমে সরা শুরু করে। এসব গোত্রের আক্রমণে রোম সাম্রাজ্যের শোচনীয় দশা দাঁড়ায়। রোমানরা এর আগে জার্মানিক গোত্রদের আক্রমণ সফলভাবে মোকাবিলা করেছিল। কিন্তু ৪১০ খ্রীষ্টাব্দে রোম লুন্ঠন করে ভিসিগথ নামে এক গোত্র, তাদের রাজার নাম ছিল আলারিক। সেরকম সময়েই রোমান ব্রিটেনও জার্মানিক অ্যাঙ্গলো-স্যাক্সনদের দ্বারা ধীরে ধীরে ‘বিজিত’ হয়। ইংরেজী ভাষা ও ইংরেজ জাতিস্বত্ত্বার যাত্রা শুরু এ সময়েই। ম্যাপে দেখানো হয়েছে অষ্টম শতকের ইংরেজ ইতিহাসবিদ বীডের বর্ণনানুযায়ী ইংল্যান্ডে জার্মানিক গোত্রদের মাইগ্রেশনের আনুমানিক চিত্র।
১৯৪০এর গ্রীষ্মে ফ্রান্স-বেলজিয়াম দখল করে নেয় জার্মান আর্মি। বিশেষত, ফ্রান্সের বিরুদ্ধে দ্রুত বিজয় ছিল অভাবনীয়। হিটলার ভেবেছিলেন, হয়ত ইংল্যান্ড এতে শান্তি-আলোচনায় আগ্রহী হবে। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি! ১৯৪০এর গ্রীষ্মেই ব্যাটল অফ ব্রিটেন বলে আকাশযুদ্ধে ব্রিটিশ রয়েল এয়ার ফোর্স নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে সমর্থ হয়। এ যুদ্ধের শহীদদের ব্যাপারেই চার্চিল বলেছিলেন, ‘নেভার ওয়াজ সো মাচ ও’ড বাই সো মেনি টু সো ফিউ’। যদি জার্মান লুফটভাফা সফল হত ব্রিটিশ আকাশশক্তিকে পরাস্ত করতে, তাহলে ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে ব্রিটেনে সেনা ও নৌ আক্রমণের বন্দোবস্ত প্রস্তুত ছিল, এর কোডনেম ছিল অপারেশন সীলায়ন। এ ছবিতে জার্মান সৈন্যরা তারই মহড়া দিচ্ছে। ব্রিটেনের চ্যানেল আইল্যান্ডসও জার্মানদের দখলে ছিল বিশ্বযুদ্ধের বাকি পাঁচ বছর। ১৭৯০এর দশকে ইউরোপব্যাপী অনেক যুদ্ধাভিযান করেন নাপোলেওনও। ব্রিটেন ছিল তাঁর সবচে’ বড় শত্রু। ১৮০৩ থেকে ১৮০৫এর মধ্যে ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে ইংল্যান্ড আক্রমণের পাঁয়তারা তাঁরও ছিল। আমেরিকার কাছে লুইজিয়ানা এলাকা বিক্রি করে এ অভিযানের অর্থসংগ্রহ করে ফ্রান্স। আইরিশ বিদ্রোহীদেরও একটা অংশ ফরাসীদের সাথে যোগ দেয়। কিন্তু ফরাসীদের নৌশক্তি ব্রিটিশদের তুলনায় ছিল কম ও অনভিজ্ঞ, তাই শেষ পর্যন্ত এসব প্ল্যান নাপোলেওঁ এগজেকিউট করেননি।
মধ্যযুগে তৈরি বেইয়ো টেপেস্ট্রিতে নরম্যানদের ডিউক দিগ্বিজয়ী উইলিয়ামকে দেখানো হয়েছে এভাবে। ১০৬৬ সালে হেস্টিংসের যুদ্ধক্ষেত্রে হঠাৎ শোরগোল ওঠে যে তিনি নাকি নিহত হয়েছেন। তখন উইলিয়াম এক টিলার উপরে দাঁড়িয়ে নিজের মস্তকাবরণ সরিয়ে নিজের চেহারা দেখান, পলায়নপর সৈন্যদের উজ্জীবিত করতে, এটাই এ ছবিতে দেখানো হচ্ছে। সে যুদ্ধে তাঁর জয়লাভের আরেক কারণ ছিল অ্যাঙ্গলো-স্যাক্সন রাজা হ্যারল্ড গডউইনসন প্রায় আড়াইশ’ মাইল উত্তরে আরেক যুদ্ধে নরওয়ের ভাইকিং রাজা হ্যারল্ড হারদ্রাদার সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করেন। সেই এক‌ই রণক্লান্ত সেনাবাহিনীকে নিয়ে পাঁচদিনের মধ্যে দক্ষিণ ইংল্যান্ডে আসেন উইলিয়ামকে রুখতে। দুই হ্যারল্ডই দুই যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন। উইলিয়ামের নরম্যান রাজ্যের অবস্থান ছিল উত্তর ফ্রান্সের নরম্যান্ডিতে। এরা আসলে ভাইকিং লুটেরা-সেটলার আর জার্মানিক ফ্রাংকদের সংকর। এদের ভাষা নর্ম্যান ছিল পুরনো ফরাসীর কাছাকাছি।
গেল হচ্ছে ইন্দোইউরোপীয় একটি ভাষাগোত্র, যাদের মধ্যে ম্যাংক্স, আইরিশ ও স্কটিশ গেলিক পড়ে। ষষ্ঠ-সপ্তম শতকের ডেল রিয়াটা রাজ্যমন্ডলীর গোড়াপত্তনের মাধ্যমে তাদের রাজনৈতিক পরিচয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ওয়েলস আর কর্নওয়ালের ওপরও এদের প্রভাব ছিল। ডেল রিয়াটার স্কটিশ উত্তরসূরীর নাম আলবা রাজ্য। ম্যাকবেথ সে রাজ্যের রাজা ছিলেন ১০৫৭ সাল পর্যন্ত। রাজা হবার আগে মোরে বলে এক সুদূর এলাকার ‘মোরমেয়ার’ ছিলেন, সেপদ মূলত রাজার মতই সার্বভৌম ছিল। স্কট রাজা প্রথম ডানকান ম্যাকবেথের সাথে যুদ্ধে মারা যান আর ম্যাকবেথ হন পরবর্তী রাজা। তাঁর শাসনামল মোটামুটি শান্তিপূর্ণ ছিল। শেষ পর্যন্ত তৃতীয় ম্যালকমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাঁর মৃত্যু হয়। শেক্সপীয়ার তাঁর ম্যাকবেথ নাটক লিখেছেন মধ্যযুগীয় ‘ইতিহাসবিদদের’ বানোয়াট বিবরণের ওপর ভিত্তি করে, তবে তিনি যেভাবে স্কটদের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব তুলে ধরেছেন, সেটা মোটামুটি সত্য। (ছবিতে ম্যাকবেথ)
১২৮৬ সালে স্কটিশ রাজা তৃতীয় আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর সিংহাসনের দাবিদার হন তাঁর নাতনী মার্গারেট। কিন্তু মার্গারেট অপরিণতবয়স্ক হওয়ায় স্কটল্যান্ডের অভিজাতরা একটা গার্ডিয়ান কাউন্সিলের মাধ্যমে দেশশাসন শুরু করে। মার্গারেটও মারা যান ১২৯০এ। তখন বিভিন্ন বনেদী পরিবার রাজসিংহাসনের জন্যে নিজেদের মধ্যে মারামারি শুরু করে দেয়। গৃহযুদ্ধের ভয়ে শেষে তারা ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম এডওয়ার্ডকে নিমন্ত্রণ করে তাদের মধ্যে মীমাংসা করতে। এডওয়ার্ড ‘লংশ্যাংকস’ শর্ত দেন যে আগে তাঁকে ‘লর্ড প্যারামাউন্ট’ হিসাবে তাঁর আনুগত্যস্বীকার করতে হবে। তার পরে তিনি জন ব্যালিওল বলে এক দুর্বলচিত্ত অভিজাতকে রাজা ঘোষণা করেন। যথেষ্ট সমর্থন না থাকা সত্ত্বেও ব্যালিওল এডওয়ার্ডের প্রতি আনুগত্য অস্বীকার করেন। এরই সুযোগে ছিলেন এডওয়ার্ড, এই অজুহাতে তিনি স্কটল্যান্ডে আক্রমণ করেন। জন বালিওল সিংহাসন ছাড়তে বাধ্য হন আর সব অভিজাতদেরকে এডওয়ার্ডকে রাজা হিসাবে মেনে নেবার শপথে বাধ্য করা হ্য়। ১২৯৭-৯৮তে প্রথম স্বাধীনতাযুদ্ধের নেতৃত্ব দেন গার্ডিয়ান উইলিয়াম ওয়ালেস। প্রথম কয়েকটা যুদ্ধে জেতার পরে ফলকার্কের যুদ্ধে পরাজিত ও বন্দী হন। ওয়ালেসের পরে রবার্ট ব্রুস একাধিক ইংলিশ ষড়যন্ত্রকে সফলভাবে প্রতিহত করতে সমর্থ হন, আর তাদের নাকের ডগা দিয়ে পার্থে রাজ্যাভিষেক করে স্কটল্যান্ডের রাজা হন। এরপর বেশ ক’টি যুদ্ধে হারার পরে পলাতক জীবনযাপন করতে হয় তাঁকে, তাঁর পরিবারও একসময় ইংরেজদের কাছে রাজবন্দী ছিল। স্কটরা সফল গেরিলাযুদ্ধ চালানোর পর ১৩২৭এ তখনকার ইংলিশ রাজা তৃতীয় এডওয়ার্ড স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা স্বীকার করে নেন। (ছবিতে রবার্ট দ্য ব্রুস)
১৭৭০এর এই এনগ্রেভিংয়ে দেখা যাচ্ছে গান গাইতে গাইতে স্কটিশ গ্রাম্য নারীদের উলের তৈরি টুইড কাপড় ওয়াকিংয়ের চিত্র। গানের তাল কাজের অগ্রগতির সাথে আরো দ্রুত হত, কারণ শেষের দিকে কাপড়ের ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ায় তাকে আরো দ্রুততার সাথে কম্প্রেস করতে হত। কাপড়ের কুন্ডলীটা ঘড়ির কাঁটার দিকে হাতে হাতে ঘুরত, উল্টোদিকে ঘুরানো ছিল অমঙ্গলজনক। এখনকার যুগে আর এধরনের কাজ কেউ করে না। পঞ্চাশের দশকে শেষ সত্যিকারের ওয়াকিং হয়েছিল বলে লোকসংস্কৃতি বিশেষজ্ঞদের ধারণা। তবে ওয়াকিং সংয়ের ঐতিহ্য বেঁচে রয়েছে স্কটিশ হাইল্যান্ডস, আউটার হেব্রাইডস দ্বীপপুঞ্জ আর কানাডার নোভা স্কশিয়ার কেপ ব্রেটন আইল্যান্ডের স্কটিশ সেটলারদের বংশধরদের মাঝে।
ষষ্ঠ জেমসের মা ছিলেন স্কটল্যান্ডের রাণী মেরি, তাছাড়াও জেমস ইংল্যান্ডের রাজা, আয়ারল্যান্ডের লর্ড, সপ্তম হেনরির বংশধর ছিলেন। ১৫৬৭ সালে তের মাস বয়েসে স্কটল্যান্ডের রাজা হন, আর ইংল্যান্ডের টিউডর বংশের রাণী প্রথম এলিজাবেথ সন্তানহীন অবস্থায় মারা যাবার পরে ১৭০৭এ ইংল্যান্ডের প্রথম জেমস হিসাবে তাঁর অভিষেক হয়। তিনি ইউরোপের ক্যাথলিক-প্রটেস্ট্যান্টদের যুদ্ধ থেকে যুক্তরাজ্যকে দূরে রাখতে সক্ষম হন। মধ্যপন্থী শান্তিপ্রিয় জেমস অবশ্য সেই উত্তাল সময়ে ইংল্যান্ডের ক্যাথলিক আর প্রটেস্ট্যান্ট দু’পক্ষেরই ঘৃণার পাত্রে পরিণত হন। ক্যাথলিকরা তাঁকে মারার চেষ্টা করে (গানপাউডার প্লট), আর অ্যাংলিকান চার্চের সদস্যরা ভাবত জেমস ক্যাথলিকদের প্রতি প্রয়োজনাতিরিক্ত সহানুভূতিশীল। এসব কারণে ১৬৪২এর ইংলিশ গৃহযুদ্ধের বীজবপন হয়। আয়ারল্যান্ড ও স্কটল্যান্ড জেমসের আইনানুগ উত্তরসূরীকে সমর্থন করে, আর ইংল্যান্ড হল্যান্ডের প্রিন্স অফ অরেন্জ উইলিয়ামকে। জেমসের সময়েই আমেরিকায় ব্রিটিশ কলোনাইজেশন শুরু হয়। আর তাঁর পৃষ্ঠপোষকতাতেই কিং জেমস বাইবেল সংকলিত হয়, যা থেকে আজকের বেশির ভাগ ইংরেজী বাইবেলের সংস্করণ এসেছে, ছবিতে তার মুখবন্ধ।
জন হেনরি সম্ভবত ঐতিহাসিক চরিত্র নন, অনেকের অবশ্য ধারণা তাঁর কাহিনী আসলেই ঘটেছিল ১৮৭০ সালের দিকে। কৃষ্ণাঙ্গ জন হেনরি ছিলেন ‘স্টীল-ড্রাইভিং ম্যান’ — তাঁর দায়িত্ব ছিল স্টীলের তৈরি একটা ড্রীলকে হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি মেরে পাথরে ঢুকিয়ে গর্ত তৈরি করা। সে গর্তে বিস্ফোরক ভরে পাহাড় ভেঙে রেললাইনের জন্যে সুড়ঙ্গ তৈরি করা হত। জন হেনরির চাকরি খাবার জন্যে অবশ্য স্টীমচালিত হাতুড়ি চলে এসেছে। তার সাথে প্রতিযোগিতা করে জিতলেন জন হেনরি, কিন্তু বিজয়শেষে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন — গানের মূল বিষয়বস্তু এই। আমেরিকা আর বহির্বিশ্বে এ গান শ্রমজীবীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে, সিভিল রাইটস মুভমেন্টে ব্যবহৃত হয়েছে। কৃষ্ণাঙ্গদের আরেকরকম গান ‘স্পিরিচুয়াল’ হলো মূলত ধর্মীয় গীত। এতে প্রকাশ পেয়েছে তাদের দুঃখকষ্টের বর্ণনা আর সেসবের পরে যে পরকালে তাদের জন্যে স্বর্গ রয়েছে, তার আশা। এগুলিও মূলত শ্রমসঙ্গীত বা ওয়ার্ক সং। বর্তমানের ব্লুজ়ের উৎপত্তি কৃষ্ণাঙ্গ স্পিরিচুয়াল থেকে। চিত্রে জন হেনরির কাহিনী।
বাংলাদেশী নৃতত্ত্ববিদ ও লোকসংস্কৃতির গবেষক ড. মাহবুব পিয়ালের এই ইন্টারভিউতে তিনি সারিগান নিয়ে অনেক তথ্য দিয়েছেন, সাথে গান গেয়েছেন। তাঁর কথাগুলো ভাল করে শুনবেন, বিশেষ করে ইতিহাসের ডিটেইলের বদলে তার অর্থটা আসলে কি, এটা বোঝার ওপর তিনি ভদ্রভাবে জোর দিয়েছেন — উপস্থাপিকার ইতিহাসের রেফারেন্সের বিপরীতে। আরো সুন্দরভাবে বুঝিয়েছেন কেন লোকসংস্কৃতি ‘হারিয়ে যাবার’ কারণে আক্ষেপের কিছু নেই। আমি উনার সাথে সম্পূর্ণ একমত। সময় পেলে অনুষ্ঠানটি দেখুন। আর লোমাক্স দ্য সংহান্টার ডকুমেন্টারি দেখলে বুঝবেন লোকসঙ্গীতপ্রেমীরা কিভাবে সেগুলি খুঁজে বের করে রেকর্ড করে রাখেন, কালের আবর্তে হারিয়ে যাবার আগে।
close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!