রোজাভা

ইরাকী কুর্দিস্তান যেমন মার্কিন কোয়ালিশনের যুদ্ধের কারণে উপকৃত হয়েছে, তেমনি আরেকটি দেশের কুর্দীরাও সেখানকার গৃহযুদ্ধ থেকে লাভবান হয়েছে। সে দেশটি সিরিয়া। সেখানে মার্কিনরা তেমন কোন বড় মাপের হস্তক্ষেপ করেনি। তারপরও কুর্দীরা নিজেদের একটা স্বায়ত্ত্বশাসিত এলাকার নিয়ন্ত্রণ পেয়েছে।

সিরিয়ায় কুর্দী জনসংখ্যা খুব বেশি নয়। অধিকাংশ বিংশ শতকের শুরুতে তুরস্কের কুর্দীনিধন অভিযান থেকে পালিয়ে আসা অভিবাসী। সিরিয়ার উত্তরের স্বল্প জনঘনত্বের পাহাড়ী এলাকাগুলিতে বসবাসের অনুমতি তারা পায় ফরাসী ম্যান্ডেট সরকারের কাছ থেকে। স্বাধীনতার পরিবর্তে ফরাসীদের অধীনে স্বায়ত্ত্বশাসনের আকাংক্ষা ছিল তাদের বেশি, আলাউয়ীদের মতই। কারণ সিরিয়ার স্বাধীনতা মানে সংখ্যাগুরু আরবদের লাথি-গুঁতো খাওয়া!

সিরিয়া স্বায়ত্ত্বশাসিত কুর্দী অঞ্চল রোজাভার পতাকা ও প্রতীক
কুর্দী নারী মিলিশিয়া ওয়াই,পি,জের পতাকা হাতে কুর্দী মহিলা
২০১৯ সালে সিরিয়ার বিভিন্ন এলাকার নিয়ন্ত্রণের চিত্র

সিরিয়ায় কুর্দী ভাষা দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ, কিন্তু দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি নেই। ১৯৬২ সালে বাথিস্ট ক্যুএর পর দেশটির কুর্দী জনগোষ্ঠীর ২০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় দেড় লাখ মানুষকে নাগরিকতাবঞ্চিত করা হয়। কারণ তারা নাকি তুরস্ক থেকে আগত “বিদেশী।” ফরাসী ঔপনিবেশিক প্রশাসনের দেয়া বৈধ কাগজ ছিল অগ্রহণযোগ্য। এর ফলে বহু রাষ্ট্রীয় অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত হয়। শিক্ষা, রাজনীতি, সম্পত্তির মালিকানা, পাসপোর্টের আবেদন — ইত্যাদি সব কিছুই জটিল হয়ে যায় তাদের জন্যে। তাদের “পতিত জমি” বেহাত করে সুন্নী আরব ও অ্যাসিরীয় খ্রীষ্টানরা।

তুরস্কের সীমানা থেকেও কুর্দীদের উচ্ছেদ করে সেখানে একটি “আরব বেল্ট” তৈরির চেষ্টা করে বাথিস্ট সরকার। অজুহাত যে সীমান্তে শত্রুভাবাপন্ন “বিদেশী” থাকাটা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য ভাল নয়। বহু স্থানের নাম কুর্দী থেকে আরবী করা হয়। জোরপূর্বক স্থানান্তরিত করা হয় সাধারণ কৃষকদেরকে। কেন্দ্রীয় সরকার থেকে নিষেধাজ্ঞা আসে নবজাতকের কুর্দী নামকরণের ওপর। জনসমক্ষে কুর্দী ভাষা ব্যবহার আর প্রাইভেট স্কুল পরিচালনাও হয় নিষিদ্ধ।

২০১২ সালে সিরিয়ার কামিশলি শহরে কুর্দী সমাবেশ

আশির দশকেও সিরিয়ায় কুর্দী বই, ক্যাসেট ইত্যাদি প্রকাশ ছিল শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বিয়ের অনুষ্ঠানে কুর্দী ঐতিহ্যবাহী পোশাকপরিধান বা গান গাওয়া ছিল নিষেধ। ১৯৮৬ সালে কুর্দী নববর্ষ নওরোজের জনসমাবেশে এমন নিষেধাজ্ঞা না মানার কারণে সিরীয় পুলিশ গুলি চালিয়ে কয়েকজনকে হত্যা করে।

ইরাক যুদ্ধ শুরুর পরপরই ২০০৪ সালে কামিশলি শহরে কুর্দী ও আরবদের মধ্যে বুশ বনাম সাদ্দামকে সমর্থন নিয়ে দাঙ্গা বেঁধে যায়। কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপে আবারও রক্ত দিয়ে অসম মূল্য দিতে হয় কুর্দী সাধারণ মানুষকে। ২০১১ সালে সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু হলে কুর্দী নেতাদের শুরুতেই গুপ্তহত্যার মাধ্যমে নিকেশ করে আসাদবাহিনী। কিন্তু দেশের অন্যত্র আরো ভয়াবহ বিদ্রোহ ঠেকাতে কুর্দী অঞ্চল থেকে সৈন্য সরিয়ে নিয়ে আসতে হ্য় বাশার আসাদকে।

সেই শূন্যতার সুযোগেই উত্তর সিরিয়ার বিশাল এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয় কুর্দী ন্যাশনাল কাউন্সিল। আমুদা-কামিশলি-আফরিন-কোবানি প্রভৃতি শহরে সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন স্থাপিত হয় তাদের নব্যপ্রতিষ্ঠিত সামরিক বাহিনী ওয়াই,পি,জি’র সহায়তায়। এই ডি ফ্যাক্টো স্বায়ত্ত্বশাসিত কুর্দী অঞ্চলের নাম “রোজাভা।”

নিজের লেজিটিমেসি ধরে রাখার জন্যেই হয়ত বাশার আসাদ রোজাভায় শক্ত হাতে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করেনি। ২০১১ সাল থেকে কুর্দীদের পাসর্পোট ও নাগরকিত্বের সনদও দিতে শুরু করে তার সরকার। অন্যান্য শত্রুর থেকে কুর্দীরা তার কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য। তাই রোজাভার বেশ কিছু শহরে আসাদ সরকারের সাথে সহাবস্থান করতে সংকোচ করছে না কুর্দী প্রশাসন।

২০১৪ সালে আইসিসের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত কুর্দী স্নাইপার, কোবানি
বিধ্বস্ত কোবানি শহরে ওয়াই পিজি ও ওয়াই পিজে মিলিশিয়া
কোবানি শহরে আইসিসের আক্রমণ চলাকালে সীমান্তের অপর পাশে তুরস্কে আশ্রয় নেয় কোবানির অধিকাংশ সাধারণ কুর্দী জনগণ

২০১৪ সালে কোবানি শহরের কুর্দী অবস্থানের চারদিকে অবরোধ বসায় আইসিস। শহরটির স্বল্পসংখ্যক ওয়াই,পি,জি সদস্য রিইনফোর্সমেন্ট না আসা পর্যন্ত তাদের অবস্থান ধরে রাখে। রক্ষা করে শহরটির সিভিলিয়ানদের। শেষ পর্যন্ত কুর্দী পাল্টা আক্রমণে আইসিস পিছু হটতে বাধ্য হয়। তাদের ধাওয়া দিয়ে রাক্কা পর্যন্ত দখল করে নেয় ওয়াই,পি,জি। এ কাজে তাদের সাথে শরিক ছিল ওয়াই,পি,জে নামে নারীযোদ্ধাদের মিলিশিয়াও। পুরো সিরিয়াতে যদি কোন প্রশিক্ষিত ডিসিপ্লিনড ফোর্স থেকে থাকে তো সে এই ওয়াই,পি,জি, এটা মার্কিন ডিফেন্স ডিপার্টমেন্টের মন্তব্য। এয়ারস্ট্রাইকের মাধ্যমে কোবানির অবরোধ ভাঙতে তাদের সহায়তা করে মার্কিন বিমানবাহিনী।

আইসিসের পতনের পর সিরিয়ার আরো বিশাল এলাকা আসে রোজাভার নিয়ন্ত্রণে। শুধু কুর্দী নয়, আরব, অ্যাসিরীয়, ইয়াজিদী প্রভৃতি বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সাথে সমঝোতা করতে হয় তাদের। রোজাভার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় অটোনমাস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অফ নর্থ এন্ড ঈস্ট সিরিয়া (আনেস)।

বহুজাতিক এই স্বায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চলে লিবার্টারিয়ান সোশালিজম হচ্ছে আদর্শ। প্রতিটা শহরের স্থানীয় মানুষ স্থানীয় সরকারের নেতৃত্বে। আনেস কাগজেকলমে কুর্দী জাতীয়তাবাদ সমর্থন করে না, আর সিরিয়ার মাঝেই ফেডারেল সিস্টেমে স্বায়ত্ত্বশাসন চায়। অর্থাৎ ইরাকি কুর্দিস্তানের মত। ইরাকী কুর্দীদের মত এরা রক্ষণশীল না হলেও দজলা নদের ওপারের বন্ধুদের থেকে রসদ সরবরাহ তারা পায়।

ইতালির বোলোনা শহরে কোবানিতে কুর্দী বাহিনীর সমর্থনে গ্রাফিটি
২০১৪ সালে কোবানিতে আইসিস আক্রমণের বিরুদ্ধে তুরস্কের সেনাবাহিনী কোন হস্তক্ষেপ না করায় তুরস্কের দিয়ারবাকির শহরে কুর্দীরা সহিংস বিক্ষোভ করে

ইরাকের মত সিরিয়াতে আরেকটি স্বায়ত্ত্বশাসিত কুর্দিস্তান হয়ে যার বাড়া ভাতে ছাঁই ঢেলেছে সে হল তুরস্ক। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান স্বয়ং মার্কিনদের দোষারোপ করেন “ভুল ফরেন পলিসির” জন্য। এটা যতটা না ইরাক যুদ্ধের সাথে জড়িত, তার থেকে বেশি তুরস্কের কুর্দী সমস্যাটিকে বাড়িয়ে দেবার জন্য। ওদিকে সিরিয়ার কুর্দীরা আইসিস বা আসাদকে যতটা শত্রু ভাবে, তার থেকে অনেক বেশি ভাবে তুরস্ক ও “সুলতান” এরদোয়ানকে। কারণ ২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত একাধিক তুর্কী সামরিক অভিযানে প্রাণ হারিয়েছে অগণিত সাধারণ সিরিয়ান কুর্দী।

গত পোস্টে বলেছি ইরাকের বাথিস্ট সরকার কি পরিমাণ অত্যাচার কুর্দীদের ওপর করেছে। আরেকটি যে দেশে দশকের পর দশক এমন অত্যাচার চলেছে সেটি তুরস্ক। ১৯২৩ সালে ওসমানী খেলাফতের সমাপ্তি হয়। সে জায়গায় কামাল আতাতুর্ক যে আদর্শের ওপর ভিত্তি করে আধুনিক তুরস্কের গোড়াপত্তন করেন সেটা তুর্কী জাতীয়তাবাদ। তাতে তুর্কী ব্যতীত অন্য জাতিসত্তার পরিচয়ের স্থান ছিল না। আগে অন্তত যে মুসলিম পরিচয়ের কারণে “খলীফা” তার কুর্দী প্রজাদের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম ছিলেন, সেটি রাতারাতি বিলুপ্ত হল। যে মিল্লি সিস্টেমের মাধ্যমে বিভিন্ন উপজাতি ও ধর্মের মানুষকে নিজেদের সমাজে নিজেদের অনুশাসন অনুযায়ী চলার স্বাধীনতা দেয়া ছিল, তার জায়গা নিল কেন্দ্রীয় সরকারের আরোপিত সেক্যুলার সিস্টেম।

কামালিস্ট তুরস্কের বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন শেখ সাঈদ নামে এই সুফী নেতা, ফাঁসিতে ঝোলানোর আগের চিত্র
বিংশ শতকের শুরুর ভাগে স্বঘোষিত তিনটা কুর্দীপ্রধান রিপাবলিকের অবস্থান
দেরসিম গণহত্যার অভিযানের সময়ে কুর্দী শিশুদের “উদ্ধার” করেছে তুর্কী সেনাদল, পরে এদের অনেকে নিহত হয়, অনেকে তুর্কী বোর্ডিং স্কুলে গিয়ে কুর্দী পরিচয় হারিয়ে ফেলে, ১৯৩৭

কামাল আতাতুর্কের প্রগতিশীল কিন্তু স্বৈরতান্ত্রিক শাসনে একের পর এক মাদ্রাসা, সুফী দরগা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, কুর্দী সংবাদপত্র প্রভৃতি বন্ধ হতে শুরু করে। তার প্রতিক্রিয়ায় ১৯২৫এ সুফী ঘরানার একটি কুর্দী বিদ্রোহ হয়। সেটিকে কঠোর হাতে দমন করে তুর্কী বাহিনী। স্বল্প কয়েকটি উপজাতির বাইরে অবশ্য এ আন্দোলনের নেতার গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। যুদ্ধবিমান ও মেশিন গানের সাহায্যে তার মধ্যযুগীয় সৈন্যদের কচুকাটা করে তুর্কীরা। বিদ্রোহের পতনের পর হাজারে হাজারে কুর্দীদের বিচারের প্রহসনে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়।

১৯২৭ সালে আরো বিশাল আকারে বিদ্রোহের সূচনা করেন আরেক নেতা ইহসান নুরী, তার সমর্থনে ছিল খয়বুন নামে কুর্দী জাতীয়তাবাদী একটি দল। আগের ধর্মীয়-উপজাতীয় মোটিভটাকে ধর্ম ও জাতিনিরপেক্ষ রূপ দেয়ায় তাদের সমর্থন আরো জোরালো হয়। “রিপাবলিক অফ আরারাত” নামে একটি স্বঘোষিত কুর্দী দেশ তৈরি হয় দক্ষিণপূর্ব তুরস্কে। আগেরবারের থেকে বেশি প্রখরতায় এদের ওপর বিমানহামলা চালানো হয়। মোস্তাফা কামালের মেয়ে সাবিহা গুকচেন স্বয়ং ফাইটার থেকে বোমানিক্ষেপ করে এসকল “দস্যুর” ওপর। ১৯৩০ সালে এ বিদ্রোহের সমাপ্তি হয়।

রিপাবলিক অফ আরারাতের ওপর বোমাবর্ষণের আগে বৈমানিক দলসহ সাবিহা গুকচেন, ১৯৩০
তুরস্কের কুর্দীনিধন নীতির বিরুদ্ধে জওহরলাল নেহরুর বক্তব্য

এরপর ১৯৩৭এ দেরসিম (বর্তমান তুঞ্জেলি) প্রদেশের সীমান্তবাসী কুর্দীদের সিরিয়ার মত “তুর্কীকরণের” প্রচেষ্টা চলে। সেসব স্থানে কুর্দীদের সরিয়ে কসোভার আলবেনিয়ান ও বসনিয়ানদেরকে পুনর্বাসন করা হয়। কুর্দী শিশুদের বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে তাদের তুর্কী নাম দিয়ে তুর্কী শিখিয়ে কুর্দী পরিচয় বিলোপের চেষ্টা চলে। সেখানে যে পরিমাণ হত্যাযজ্ঞ চলে, তা আর্মেনি গণহত্যাকেও হার মানায়। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান আর্মেনী গণহত্যা স্বীকার না করলেও ২০১১ সালে দেরসিম গণহত্যার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমাপ্রার্থনা করেছেন।

ষাটের দশক পর্যন্ত দক্ষিণপূর্ব তুরস্ক ছিল বিদেশীদের জন্য অফ লিমিট। কারণ সে অঞ্চলে সামরিক শাসন জারি ছিল। দমবন্ধকরা একটা পরিস্থিতি। ত্রিশের দশক থেকেই কুর্দী নামকরণ, ভাষা, উপকথা, ঐতিহ্যবাহী পোশাক, রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ। ডিকশনারি থেকেও কুর্দ-কুর্দিশ-কুর্দিস্তান শব্দগুলি এক্সপাঞ্জ! তুর্কী নেতারা কুর্দীদের সম্বোধন করত “মাউন্টেন টার্ক” অর্থাৎ পাহাড়ী তুর্কী নামে। সোজা কথায়, কুর্দী বলে কোন কিছু নেই, ছিল না — থাকবে না।

অধুনা তুরস্কে কুর্দী প্রদেশগুলির মাথাপিছু জিডিপি সবচে কম
দক্ষিণপূর্ব তুরস্কের একটি গ্রামে পিকেকে ও তুর্কী বাহিনীর সংঘর্ষে বিধ্বস্ত সাধারণ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান

এ ধরনের পরিস্থিতিতে নেটো সদস্য তুরস্কের মধ্যে গন্ডগোল পাকানোর মালমশলা হিসাবে কুর্দী জননেতৃত্ব সোভিয়েতের জন্য রেডি হয়ে বসে ছিল। সত্তরের দশকে তুরস্কে অতিবাম অতিডান দুই দলের মধ্যে ভয়াবহ রকমের সড়কযুদ্ধ চলত। এ পটভূমিতে আব্দুল্লাহ ওজালান নামে অর্ধ-কুর্দী এক ইউনিভার্সিটি ড্রপআউট শুরু করেন তার কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি বা পিকেকে দলটি। প্রথম প্রথম তাদের লক্ষ্য ছিল কুর্দীদের সমাধিকারের জন্য লড়াই। পরে সেটা হয়ে যায় সমাজতন্ত্রের ওপর ভিত্তি করে স্বাধীন কুর্দিস্তান প্রতিষ্ঠা। বলা বাহুল্য, তার বামপন্থী রাজনীতি সকল কুর্দীকে আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হয়।

তবে ১৯৮০র তুর্কী সামরিক অভ্যুত্থানের পর পিকেকে’র সুযোগ আসে আবেদন বৃদ্ধির। সামরিক জান্তার ধরপাকড় থেকে বাঁচতে কুর্দী তো বটেই বহু তুর্কী লেখক-সাহিত্যিক-গায়কও ইউরোপ-আমেরিকায় পাড়ি জমায়। এ শূন্যস্থানে পিকেকে সামরিক বাহিনীর ওপর চোরাগোপ্তা সন্ত্রাসী হামলা করে নিজেদের নেতৃত্বের একটা স্থান তৈরি করে নেয়। এমন না যে তারা ধোয়া তুলসী পাতা, কুর্দী বহু ল্যান্ডওনার আর উপজাতীয় নেতারাও তাদের জিঘাংসার শিকার হয়। পিকেকের চোখে এরা ছিল রাজাকার, শ্রেণীশত্রু।

পিকেকে নেতা আবদুল্লাহ ওজালানকে গ্রেপ্তার করে তুরস্কে নিয়ে যাবার সময়, ১৯৯৯
পিকেকের আক্রমণে নিহত তুর্কী সৈন্যের কফিনের সামনে তার বাবা, ২০১৭
২০২২এ ইস্তাম্বুলে বোমাহামলার বদলা নিতে তুর্কী বিমানবাহিনী সিরিয়ার কুর্দী এলাকায় হামলা চালালে শিশুসহ একাধিক সাধারণ কুর্দী নিহত হয়

১৯৮৪ সালে পিকেকের শুরু করা ইনসার্জেন্সিতে এ পর্যন্ত পয়ত্রিশ হাজারের মত তুর্কী মানুষ মারা গেছে যাদের সিংহভাগ কুর্দী সাধারণ নাগরিক। বহু সন্ত্রাসবাদী হামলা চলেছে তুরস্ক-ইস্তাম্বুলের ট্রেন-বাস টার্মিনাল, এয়ারপোর্ট, বাজার, ট্যুরিস্ট স্পটে। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত স্নায়ুযুদ্ধ ছিল পিকেকে বনাম তুরস্কের বিবাদের পটভূমি। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে তাই তখন থেকেই পিকেকে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসাবে স্বীকৃত। আয়রন কার্টেন ধ্বসে পড়তে শুরু করলে তুরস্ক ধীরে ধীরে কুর্দী ভাষা-সংস্কৃতির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে শুরু করে। রাষ্ট্রপতি তুরগুত ওজালের সাথে একটা শান্তি আলোচনা শুরু হলেও তার অকালমৃত্যুতে আবার ছক উল্টে যায়।

১৯৯৯ সালে মোসাদ স্টাইলে কেনিয়া থেকে আব্দু্ল্লাহ ওজালানকে ধরে নিয়ে আসে তুর্কী গোয়েন্দাবাহিনী এম,আই,টি। তখন প্রথম যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে পিকেকে। তারপরও থেমে থেমে এখনো সংঘাত চলছে। পিকেকে পালিয়ে ইরাকী কুর্দিস্তানের দুর্গম কান্দিল পর্বতে আশ্রয় নিয়েছে। তবে প্রায়শই ইরাকী কুর্দিস্তানের সরকার পিকেকে উচ্ছেদে তুর্কীদের সহায়তা করে।

পিকেকে তুরস্কের কুর্দী সংগ্রামের হেডলাইন কেড়ে নিলেও আসলে বহু ঘরানার রাজনীতি প্রচলিত আছে সেখানের কুর্দীদের মাঝে। তবে ১৯৯০ পর্যন্ত কুর্দী জাতীয়তাবাদী রাজনীতি সেখানে ছিল নিষিদ্ধ। প্রায়ই কোন না কোন কুর্দীপ্রধান দলকে বিচ্ছিন্নতাবাদের দায়ে তুরস্কের সুপ্রীম কোর্ট নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। জনপ্রিয় নেতা সালাউদ্দিন দেমিরতাশ সেই অভিযোগে দশ বছর ধরে জেলে। আরেক সংসদসদস্য লেলা জানা শপথ গ্রহণের শেষে তুর্কী-কুর্দী ভ্রাতৃত্বের আকাংক্ষা প্রকাশ করেন। ফলঃ দশ বছরের জেল।

২০১৭ সালে আঙ্কারায় সন্ত্রাসী বোমাহামলা
সিরিয়ার রোজাভার সমাবেশগুলিতে ওজালানের মুখচ্ছবি অংকিত ব্যানার ও পতাকা শোভা পায়
উত্তর সিরিয়ায় পরিচালিত তুর্কী গ্রাউন্ড অপারেশন, ২০১৯

তাই ২০০৪ সালে প্রথম কুর্দী টি,আর,টি টিভি চ্যানেল যাত্রা শুরু করলেও তাতে প্রচারিত ইরানী দল রাস্তাকের সঙ্গীতের কথায় “কুর্দিস্তান” শব্দটি প্রতিস্থাপন করতে হয় “হাউরামান” প্রদেশের নাম দিয়ে। মোটে সে বছরই নবজাতকদের কুর্দী নামকরণের ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয়া হয়।

আয়রনিক ব্যাপার হল, ২০০৩ সালে প্রধানমন্ত্রী হবার পর এরদোয়ানই এমন উদারপন্থা অবলম্বন শুরু করেন। মার্কেট রিফর্মের পাশাপাশি কুর্দী-তুর্কী সম্পর্ক নর্মালাইজেশনের একটা চেষ্টা চলে। সেসব ওলট পালট হয়ে যায় সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের কারণে। অতীতে সিরিয়ার সরকার পিকেকে দলটিকে নানা সময় আশ্রয় দিয়েছে। রোজাভার কুর্দীরাও ওজালানের অনুসারী বামপন্থী আদর্শে অনুপ্রাণিত। গৃহযুদ্ধের পর সিরিয়া থেকে আগত অভিবাসীদের সাথে স্বাধীনতাকামী সন্ত্রাসবাদীরাও তুরস্কে ঢুকে পড়েছে। অন্তত এমনটাই এরদোয়ানের দাবি।

তুরস্কে ২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত তিরিশটির মত সন্ত্রাসী বোমা হামলায় মারা গেছে সাড়ে পাঁচশর বেশি মানুষ। আক্রমণের দাবিদারদের মধ্যে ইসলামিক স্টেটের সন্ত্রাসবাদী আছে যেমন, তেমন বিভিন্ন ক্ষুদ্র অপরিচিত কুর্দী জাতীয়তাবাদী দলও আছে। তবে তুরস্কের সরকার প্রায়ই ঢালাওভাবে পিকেকে’কে এসবে মূল হোতা হিসাবে দাবি করে। আর যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র সিরিয়ার ওয়াই,পি,জি নাকি পিকেকেরই একটা শাখা, এটা তাদের দাবি।

এ কিছুটা সত্য। ওয়াই,পি,জির সমাবেশের ব্যানারে-পোস্টারে ওজালানের ছবি শোভা পায়। এ সকল কারণে ট্রাম্প প্রশাসন আইসিস উৎপাটন অভিযান সফল হবার পরপর সিরিয়ান কুর্দিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্যদের আংশিক প্রত্যাহার করে নেয়। তবে এখনো একটা ভাল মার্কিন উপস্থিতি সেখানে রয়েছে।

উত্তর সিরিয়ায় তুর্কী দখলদারিত্বের চিত্র
ইস্তাম্বুলের ইস্তিকলাল সড়কে বোমা বিস্ফোরণের ঠিক আগ মুহূর্তের দৃশ্য সিক্যুরিটি ক্যামেরায় ধারণকৃত

মার্কিনরা সরে আসার পরপরই তুর্কীরা তিনটি বড় সামরিক অভিযান চালিয়ে সিরিয়ার উত্তরাংশ দখল করে রেখেছে। কুর্দী সন্ত্রাসবাদী দল যাতে তুরস্কে ঢুকতে না পারে সে কারণে বর্ডারের দশ-পনেরো কিলোমিটারে তারা সেফ জোন বানাচ্ছে। হয়তবা ভবিষ্যতে সিরিয়ান রেফ্যুজিদের সেখানে ফেরত পাঠাবে। আবার এক দফা কুর্দীদের সম্পত্তি বেদখল হবে।

এসব কারণে সিরিয়ার রোজাভার জনমানসে আইসিস নয়, বরং তুর্কীবিদ্বেষ। সীমানার অপর পারে তুর্কী কুর্দীরাও অসন্তুষ্ট। এদের সকলের ধারণা কুর্দীবিরোধী অভিযানে তুর্কী সেনাবাহিনীর সাথে আইসিস শরীক রয়েছে। ২০১৪ সালে কোবানি অবরোধের সময় যুক্তরাষ্ট্রই তাদের সাহায্য করে, আইসিসবিরোধী জজবা তুলেও এরদোয়ান কোন সাহায্য করেনি।

এই রোববার বোঝা যাবে এরদোয়ানের ভবিষ্যৎ কি, আর রোজাভার অধিকৃত এলাকার ভবিষ্যতও। তার বিরুদ্ধে যে প্রার্থী জনমত জরিপে এগিয়ে আছেন তার নাম কামাল ক্রিচদারোউলু। একাধিক কুর্দী রাজনৈতিক দলও তাকে সমর্থন দিচ্ছে।

এরদোয়ানের বিরুদ্ধে মে ২০২৩এ নির্বাচনে প্রধান প্রতিপক্ষ কামাল ক্লিচদারোউলু
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কুর্দী ডায়াস্পোরার চিত্র
সুইডেনে তুরস্কের সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশ করছে কুর্দী জনতা, ২০১৯

এরদোয়ান যে সুইডেন-ফিনল্যান্ডের নেটো সদস্যপদ ঝুলিয়ে রেখেছেন, তার মূলেও এ কুর্দী সংঘাত। কুর্দীদের একটা বড় জনসংখ্যা ইউরোপে অভিবাসী। এরা সেসব দেশ থেকে অর্থ সাহায্য পাঠায় ইরাক-সিরিয়া-তুরস্ক-ইরানের কুর্দীদের। অনেক বিরোধী মতের কুর্দী নেতারাও রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে রয়েছে সেসব দেশে। সুইডেনে-ফিনল্যান্ডের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদীদের আশ্রয়প্রদানের অভিযোগের মূল সেটাই। ওদিকে তুরস্কের বহু গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা এখন প্রশ্নবিদ্ধ, বিশেষ করে বিচারব্যবস্থার। সে কারণে তুরস্কের কোর্ট কাউকে “সন্ত্রাসবাদী” তকমা দিলেও সুইডেন-ফিনল্যান্ডের মত দেশ সাথে সাথে সেটা বিশ্বাস করবে না।

এই একই কারণে তুরস্ক সহজে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য হতে পারবে না। প্রথম পোস্টে আমি বলেছিলাম কেন কিভাবে মাইনরিটি রাইটস এর ব্যাপারটা ইউরোপীয় রাষ্ট্রসংজ্ঞার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে গেছে। তার মূলে রয়েছে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রক্তস্নাত ইতিহাস। ইইউএর সদস্যপদ লাভের জন্য একটি দেশকে অবশ্যই স্বদেশের জাতিগত, ধর্মীয় ও ভাষাগত সংখ্যালঘুদের অধিকার ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে হবে। ঐ লেঠা না চুকিয়ে ইইউতে ঢুকলে আবারও সে পুরনো ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা। তাই যতদিন না কুর্দী প্রশ্নের একটা যথাযথ উত্তর তুরস্ক বের করতে না পারছে ততদিন ইউরোপীয় দেশ তারা নয়।

আর এ প্রসঙ্গে আমার মত যারা পশ্চিমা দেশে আরামে শান্তিতে বসবাস করছেন, তাদেরও মনে করিয়ে দিতে চাই যে আমরা কিন্তু ঐ মাইনরিটি রাইটসের সংজ্ঞাটির সুবিধাভোগী হয়েই উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি পাচ্ছি! যদি ভাবেন স্বদেশে বাঙালী বা মুসলমানরাই হবে সব ক্ষমতার মালিক, কিংবা ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী নস্টালজিয়াই সকল সমস্যার উত্তর, তো সেটা হবে চরম হিপোক্রেসি!

ইউরোপ-আমেরিকা উন্নতি করেছে শুধু টেকনোলজির বদৌলতে নয়, তারা স্বদেশের মানুষকে, আই মীন আপামর সকল মানুষকে, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একটা গ্রহণযোগ্য সমাধিকার দেয়। স্বদেশের অর্থনৈতিক-সামরিক সকল প্রকার নিরাপত্তা ও উন্নতির জন্য সে ডাইভার্সিটিটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যতদিন সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে এটা সঠিকভাবে স্বীকৃত না হবে, ততদিন জনগোষ্ঠীর একটা বড় পটেনশিয়াল থেকে বঞ্চিত হবে দেশ ও জাতি। সোভিয়েতের পতন হয়েছে, কিন্তু এখানে এখনও একটা বিশাল মানসিক ডিভাইড রয়ে গেছে ঈস্ট আর ওয়েস্টের মধ্যে। এই আয়রন কার্টেনের পতন না ঘটলে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি কোথাও নেই।

পুরানো সেই দিনের কথা…

Featured Video Play Icon

“পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়।
ও সেই চোখের দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়।
আয় আর-একটিবার আয় রে সখা, প্রাণের মাঝে আয়।
মোরা সুখের দুখের কথা কব, প্রাণ জুড়াবে তায়।”

রবিঠাকুরের এই গানটির সুর যে মৌলিক নয়, তা প্রবাসী বাঙ্গালীমাত্রেরই জানা। কারণ, প্রতি ৩১শে ডিসেম্বর লন্ডনের বিগ বেন থেকে নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কয়ার, সিডনি অপেরা হাউস থেকে এমনকি প্রাচ্যের জাপান পর্যন্ত একই সুরে গান করে নতুন বছরকে স্বাগত জানায় বিপুলসংখ্যক জনতা।

রবীন্দ্রনাথ গানটি লিখেছিলেন ১৮৮৫ সালে। তাঁর প্রথম বিলাতযাত্রা হয় সতেরো বছর বয়েসে ১৮৭৮ সালে। সে যাত্রা আর বিলাতজীবনের কাহিনী তিনি লিখে রেখে গেছেন য়ুরোপ-বাসীর পত্রে। সে বই পড়লে জানবেন যে, ব্রাইটন আর সংলগ্ন এলাকার বিভিন্ন পার্টি, সোশ্যাল গ্যাদারিং আর নাচগানের দাওয়াতে রবীন্দ্রনাথের হরদম যাওয়া-আসা ছিল। রবার্ট বার্নসের আসল গানটা ততদিনে কমপক্ষে একশ’ বছর ধরে স্কটল্যান্ড আর অন্যান্য ব্রিটিশ রাজ্যের পানশালাগুলিতে জনপ্রিয়তা কুড়িয়ে আসছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রথম বিলাতজীবনে কোন না কোন জায়গায় গানটি অবশ্যই শুনে থাকবেন। ও হ্যাঁ, যারা তদ্কালীন ব্রিটেনের মানুষের ‘কলোনিয়াল’ দৃষ্টিভঙ্গি সম্বন্ধে খুবই অরাজনৈতিক বিবরণী জানতে চান, তারা বিশ্বকবির এই বইটি পড়ে দেখুন।

সুরটির ‘মূল রচয়িতা’ রবার্ট বার্নস ছিলেন স্কটিশ কবি ও গীতিকার। লিখতেন ইংরেজীর স্কটিশ উপভাষা স্কটসে। ১৭৮৮ সালে এডিনবরার ‘স্কটস মিউজিকাল মিউজিয়াম’ নামে এক প্রকাশনার কাছে ‘ফর অল্ড ল্যাং সাইন’ নামক এই গানটি সুরসহ পাঠান, নামটির ইংরেজী শব্দান্তর হল ‘ফর ওল্ড টাইম’স সেইক’ — পুরনো স্মৃতির খাতিরে। বার্নস যদিও নিজের কিছু কাব্য এতে জুড়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু সুর ও মূল কথাগুলি যে একটি স্কটিশ লোকগীতি থেকে ধার করেছিলেন সে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছিলেন। অর্থাৎ রবিঠাকুরের সুপরিচিত গানটি বার্নসের ধারেরও ধার।

আমরা যদিও জানুয়ারির এক তারিখকে বলি ইংরেজী নববর্ষ, আসলে ইংল্যান্ড-স্কটল্যান্ডসহ ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের রাজ্যগুলি, এবং তাদের প্রাক্তন কলনী আমেরিকা, ১৭৫২ সালের আগে ২৫শে মার্চকে মানত বছরের শুরু। ২৫শে মার্চের তারিখটা স্প্রিং ইকুইনক্সের সাথে জড়িত। আরব-পারসিকদের নওরোজও উদযাপিত হয় একই দিনের ধারকাছ দিয়ে।

পয়লা জানুয়ারিটা মূলে রোমান ঐতিহ্য, কারণ প্রাচীন রোমের শাসনভার নবনির্বাচিত কনসালরা তুলে নিতেন ঐ তারিখে। আসলে, রোমসহ প্রাচীন নিকটপ্রাচ্যে দশটি মাসে বছর গোনা হত, শীতকালে কোন মাস গোনা হত না, আর বছর শুরু হত মার্চে। সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মাসগুলির নাম তাই এখনো লাতিনের সাত থেকে দশ পর্যন্ত সংখ্যার স্মৃতিবহন করে চলেছে। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি যোগ হয় রোমশহরের আদিকালে, পুরো বছরকে বারটি চান্দ্রমাস দিয়ে পরিপূর্ণতা দিতে। জানুয়ারির নামকরণ তখন হয় দু’মুখো দেবতা জানুসের নামে। জানুস হলেন কাল, আরম্ভ, শেষ — সোজা কথায় ট্রানজিশনের দেবতা। এজন্য তাঁর এক মুখ ফেরানো অতীতের দিকে, আরেকটা ভবিষ্যদ্মুখী।

সুদূর স্কটল্যান্ডে অবশ্য প্রাচীন রোমান সভ্যতার ছোঁয়া কখনোই লাগেনি (‘বুডিকার বিদ্রোহ ও অন্যান্য’ দ্রষ্টব্য)। স্কটিশদের ঐতিহ্য এখনো বেশ গ্রাম্য ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন। অবশ্য একই কারণে তাঁরা অতিথিপরায়ণ আর বন্ধুবৎসল। আমার প্রাক্তন কর্মক্ষেত্রের ম্যানেজার ছিলেন স্কটিশ এবং খুবই অমায়িক। অবশ্য কিপ্টা আর গুলবাজ বলেও স্কটদের দুর্নাম আছে। অতীতে ৩১শে ডিসেম্বর আর পয়লা জানুয়ারিতে স্কটিশরা নববর্ষের বদলে ‌অন্য এক উৎসব পালন করত। একে স্কটস ভাষায় বলে হগমানে। একটা সময় স্কটল্যান্ডের প্রেসবাইটারিয়ান চার্চ ক্রিসমাস পালন করতে মানুষকে নিরুৎসাহিত করত। প্রাক-খ্রীষ্টান হগমানেই ছিল ক্রিসমাসের পরিবর্তে বছরের সবচে’ বড় উৎসব।

এদিনে স্কটিশ বাচ্চাকাচ্চারা হ্যালোইনের মত বাড়ি বাড়ি গিয়ে কড়া নাড়ে, আর চকলেট-মিষ্টি উপহার পায়। ফার্স্ট-ফুটিং বলে একটা কুসংস্কার মানে যারা, তারা চেষ্টা করে কারো বাসায় প্রথম পদার্পণ করে সৌভাগ্য আর সর্বোৎকৃষ্ট আতিথেয়তা অর্জন করতে। বন্ধুরা একে অন্যের বাড়িতে যায় লবণ, কয়লা, শর্টব্রেড, হুইস্কি, ব্ল্যাকবান রুটি ইত্যাদি ঐতিহ্যবাহী উপহার নিয়ে। পুরনো আমলে শীত কাটানোর জন্যে এসবের দরকার ছিল, সেসব উপহারের প্রথা এখনো রয়ে গেছে। আর রবার্ট বার্নসের গানটি থেকে বুঝতে পারছেন যে সারা বছরের ব্যস্ততার কারণে বহুদিন যোগাযোগ না থাকার পরেও এদিন হয়তবা বাল্যবন্ধুদের একটা সুযোগ হয় কুশলবিনিময়ের। সেটাই বার্নস বলছেন এভাবেঃ
“We twa hae run about the braes,
and pou’d the gowans fine;
But we’ve wander’d mony a weary fit,
sin’ auld lang syne.”
অর্থাৎ বন্ধু বা বান্ধবী দু’জন মিলে ছোটবেলায় পাহাড়ে পাহাড়ে কত দৌড়ে বেরিয়েছে, সুন্দর সুন্দর কত ডেইজি ফুল তুলেছে একসাথে। সময়ে দু’জনের পথ হয়ে গেছে সুদূর, পদযুগল হয়ে পড়েছে ক্লান্ত। কিন্তু হতাশার কিছু নেই! বর্ষবরণের সুযোগে আবার মিলিত হবে দু’জনার হৃদয়, পানপাত্র তুলে একে অপরের সৌভাগ্য কামনা করবে দু’জনে। অর্থাৎ ‘পুরানো সেই দিনের কথার’ মতই নস্টালজিয়ার সাথে সাথে বান্ধব-আলিঙ্গন আর শুভকামনা।

এখনো স্কটল্যান্ডের এডিনবরায় বিশ্বের সবচে’ ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণের উৎসব পালিত হয় ৩১শে ডিসেম্বর। এ ভিডিওটিতে দর্শকরা যেভাবে ক্রস করে একে অন্যের হাত ধরে গান করছেন, সেভাবে এডিনবরায় সমবেত জনতা হাতে হাত মিলিয়ে নাচে-গায়। বহ্ন্যুৎসবও হয় স্কটল্যান্ডের কোথাও কোথাও। সেসব জায়গায় শীতের শুকনো কাঁটালতা পেঁচিয়ে তৈরি বলে আগুন জ্বালিয়ে রাতের বেলায় আনন্দসমাবেশ করে শহরের অধিবাসীরা, উৎসবশেষে সেসব জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ড সমুদ্রের ঢেউয়ে বিসর্জিত হয়।

আজকের যুগে নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কয়ারে যে ‘বলড্রপ’ হয়, তার অনুপ্রেরণা স্কটল্যান্ডের সেসব ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান থেকে আসাটা বিচিত্র নয়। ৩১শে ডিসেম্বর টাইমস স্কয়ারে প্রতি বছর বর্ষবরণের কনসার্ট হয়, আর বছরের শেষ মিনিটকে বিদায় জানানো হয় ওয়ান টাইমস স্কয়ারের স্কাইস্ক্র্যাপারের শীর্ষের ফ্ল্যাগপোল থেকে আলোকসজ্জিত একটি ‘টাইম বলের’ ৬০ ফীট ‘অধঃগমনের’ মাধ্যমে। প্রচুর জনসমাগমের মাধ্যমে ১৯০৭ সাল থেকে টাইমস স্কয়ারের এই ঐতিহ্য পালিত হচ্ছে। ‌এ উৎসবে সবার আগে যে গানটি বাজানো হয় সেটি অল্ড ল্যাং সাইন। ‌অবশ্য আমেরিকায় গানটি জনপ্রিয় হয় তিরিশের দশকে, গাই লমবার্ডো নামে কানাডীয় এক সঙ্গীতশিল্পীর নিউইয়ারস ঈভের বিশেষ রেডিও অনুষ্ঠানের খাতিরে।

শুধু্মাত্র রবিঠাকুরই যে বার্নসের ‘রচিত’ গানটিকে ভাষান্তর করেছেন তা কিন্তু নয়! জাপানের একটি জনপ্রিয় গান ‘হোতারু নো হিকারি’ — সেটিও অল্ড ল্যাং সাইনের সুরে, বিষয়বস্তুও একইরকম। আর একসময় দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় সঙ্গীতেরও ছিল একই সুর। একে আজকের সংবেদনশীল শিল্পসমঝদাররা হয়ত আখ্যা দিবেন কালচারাল অ্যাপ্রোপ্রিয়েশন হিসাবে। যেমনটা চীনের জনপ্রিয় লোকসঙ্গীতজ্ঞ লোবিন ওয়াং নব্বইয়ের দশকে উইগুর লোকগীতির অনুপ্রেরণায় রচিত কিছু গান কপিরাইট করতে গিয়ে কঠোর সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিলেন (সে ব্যাপারে শীঘ্রই লিখবো)।

আমার হিসাবে, লোকগীতি তো আসলে কোন জাতিগোষ্ঠীর কপিরাইট করার মত কিছু নয়, কারণ কোন একজনমাত্র শিল্পী একদিনে বা একমাসে ‘শিল্পটি’ তৈরি করেননি। সুর আর কথাগুলি শতবছর ধরে মুখে মুখে বিবর্তিত হয়েছে, অন্য দেশ-ভাষাতেও গিয়েছে অরগ্যানিকভাবে লোকমুখেই। যদি এগুলোকে অন্য দেশের কোন স্বনামধন্য কবি বা গীতিকার যথাযথ কৃতজ্ঞতাস্বীকার করে স্বভাষায় অ্যাডপ্ট করেন, তাতে ক্ষতি নেই। বরং মূল জাতিগোষ্ঠীর গৌরবই তাতে। অবশ্য ‘ইন্সপায়ারড’ শিল্পীর কপিরাইট করার চেষ্টাটা আর্টিস্টিক লাইসেন্সের থেকে একটু বেশি হয়ে যেতে পারে। আমি যতদূর জানি, রবীন্দ্রনাথ যথাযথ ক্রেডিট দিয়েছিলেন, কিন্তু বার্নসের নাম উল্লেখ করেননি কারণ তা হয়ত সেসময় জানা ছিল না তাঁর। জনপ্রিয় ফোকগানই ভেবে নিয়েছেন আর তাই লিখেছেন পাদটীকায়। আপাতদৃষ্টে তা ভুল নয়, কারণ বার্নসের ‘মূলটিও’ আসলে ‘নকল’!

অল্ড ল্যাং সাইনের স্মৃতিস্পর্শে নতুন বছর সবার ভালো কাটুক, বন্ধুবান্ধব আর পরিবারের সকলের সাথে আনন্দময় হোক — এ শুভকামনা রইল। হ্যাপি নিউ ইয়ার!

শুভ নববর্ষ ১৪২৫

শুভ বাংলা নববর্ষ!

পহেলা বৈশাখ যারা মনে করেন ‘হিন্দুয়ানি অপসংস্কৃতি’, আশা করি তাদের জন্যে এই পোস্টটি কিছুটা শিক্ষামূলক হবে।

অনেকে বলেন রাজা শশাংকের সময়ে, সপ্তম শতকে, নাকি বঙ্গাব্দের যাত্রা শুরু। তা হতে পারে, কিন্তু সনাতনী হিন্দু জ্যোতিষশাস্ত্রের সাথে সে সময়কার সব ভারতীয় রাজত্বের হিসাবই ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল, সম্ভবত আলাদা করে বঙ্গাব্দ ব্যাপারটা ছিল না। এই অব্দের প্রচলনের মূল তাই অনেকে ধরেন আমাদের দেশের হিন্দু রাজ-রাজড়াদের ইতিহাসে প্রথিত।

কিন্তু সেটা প্রমাণ করা কষ্টসাপেক্ষ, আর রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট।

যেটুকু আমরা প্রমাণসহ বলতে পারি, সেটা হলো সম্রাট আকবরের সময় যখন দেখা গেল আরবী চান্দ্র হিজরী সন ধরে কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল প্রজাদের কর আদায় করা কঠিন (কারণ তাতে ঋতু ওলটপালট হয়ে যায়), তখন সম্রাটের নির্দেশে পুরনো মাসগুলি রেখেই সৌর সন তৈরি করা হয়। তাতে কৃষকদের সুবিধা হয় সময়মত কর দিতে, আর বাংলা সেসময় ভারতের অন্যতম কৃষিপ্রধান অঞ্চল ছিল।

অনেকে বলেন মঙ্গল শোভাযাত্রা এসব হিন্দু ঐতিহ্য। পুরোপুরি সত্য নয়, এর সাথে জড়িত বাংলার নবাব মুর্শিদকুলী খানের সময় প্রচলন করা রাজপুন্যাহের পহেলা বৈশাখের ‘করপ্রদানযাত্রা’। সকল প্রজারা তাদের যা যা বাৎসরিক কর দেয়ার মত আছে, তাই নিয়ে রাজা বা রাজকীয় প্রতিনিধির কাছে যেত, এরই জাতিস্মৃতি আমি মঙ্গল শোভাযাত্রার মধ্যে দেখতে পাই। এখনো চট্টগ্রামের পাহাড়ী অঞ্চলে এরকম রাজপুন্যাহ উৎসব হয়।

রাজপ্রতিনিধিরাও এসময় প্রজাদের আদর করে দু’বেলা আপ্যায়ন করতেন। এই আপ্যায়নের ঐতিহ্যটা মুর্শিদকুলী খান করতেন ইসলামী বা আরবী ঐতিহ্যের অতিথিপরায়ণতার খাতিরেই। এর জাতিস্মৃতি আমাদের রমনার বটমূল আর পান্তা-ইলিশ খাওয়ার মাঝে।

হিন্দুধর্মাবলম্বীরা অনেকে ধর্মীয়ভাবে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করেন, কিন্তু সেটা পরে এসেছে, কারণ যারা বণিক, তারা নতুন হালখাতা খুলতেন লক্ষ্মী-গণেশের আশীর্বাদ নিয়ে। অর্থাৎ নতুন বছরটা আগে এসেছে, পরে তার ধর্মীয় যোগাযোগ।

যারা চৈত্রসংক্রান্তির সাথে পহেলা বৈশাখকে জোড়া লাগানোর চেষ্টা করেন, তাদের জন্যে বলি যে এটা চৈত্রের শেষ দিনে পালন করা হলেও, এর সাথে স্প্রিঙ ইকুইনক্স বলে বহু প্রাচীনকাল থেকে পালিত আরেক পরব জড়িত। সেটার আসল তারিখ মার্চের ২০ হলেও সেটা কিভাবে চৈত্রের শেষে চলে আসল সে এক ঐতিহাসিক গবেষণার বিষয়।

আরো বলি যে এখনকার ইরান, যেটা কিনা ইসলামী গণপ্রজাতন্ত্র, তাদের নববর্ষ বা নওরোজ পালন হয় ঠিকঠাক মার্চের ২০ তারিখ। অর্থাৎ খাস চৈত্রসংক্রান্তিতে। এ তাদের প্রাক-ইসলামী ঐতিহ্য, কিন্তু কেউ সেটার ‘বিধর্মী’ শিকড় ঘাঁটাতে যায় না।

আপনার নববর্ষ আনন্দময় আর প্রাচুর্যপূর্ণ হোক!

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!