রোজাভা

ইরাকী কুর্দিস্তান যেমন মার্কিন কোয়ালিশনের যুদ্ধের কারণে উপকৃত হয়েছে, তেমনি আরেকটি দেশের কুর্দীরাও সেখানকার গৃহযুদ্ধ থেকে লাভবান হয়েছে। সে দেশটি সিরিয়া। সেখানে মার্কিনরা তেমন কোন বড় মাপের হস্তক্ষেপ করেনি। তারপরও কুর্দীরা নিজেদের একটা স্বায়ত্ত্বশাসিত এলাকার নিয়ন্ত্রণ পেয়েছে।

সিরিয়ায় কুর্দী জনসংখ্যা খুব বেশি নয়। অধিকাংশ বিংশ শতকের শুরুতে তুরস্কের কুর্দীনিধন অভিযান থেকে পালিয়ে আসা অভিবাসী। সিরিয়ার উত্তরের স্বল্প জনঘনত্বের পাহাড়ী এলাকাগুলিতে বসবাসের অনুমতি তারা পায় ফরাসী ম্যান্ডেট সরকারের কাছ থেকে। স্বাধীনতার পরিবর্তে ফরাসীদের অধীনে স্বায়ত্ত্বশাসনের আকাংক্ষা ছিল তাদের বেশি, আলাউয়ীদের মতই। কারণ সিরিয়ার স্বাধীনতা মানে সংখ্যাগুরু আরবদের লাথি-গুঁতো খাওয়া!

সিরিয়া স্বায়ত্ত্বশাসিত কুর্দী অঞ্চল রোজাভার পতাকা ও প্রতীক
কুর্দী নারী মিলিশিয়া ওয়াই,পি,জের পতাকা হাতে কুর্দী মহিলা
২০১৯ সালে সিরিয়ার বিভিন্ন এলাকার নিয়ন্ত্রণের চিত্র

সিরিয়ায় কুর্দী ভাষা দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ, কিন্তু দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি নেই। ১৯৬২ সালে বাথিস্ট ক্যুএর পর দেশটির কুর্দী জনগোষ্ঠীর ২০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় দেড় লাখ মানুষকে নাগরিকতাবঞ্চিত করা হয়। কারণ তারা নাকি তুরস্ক থেকে আগত “বিদেশী।” ফরাসী ঔপনিবেশিক প্রশাসনের দেয়া বৈধ কাগজ ছিল অগ্রহণযোগ্য। এর ফলে বহু রাষ্ট্রীয় অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত হয়। শিক্ষা, রাজনীতি, সম্পত্তির মালিকানা, পাসপোর্টের আবেদন — ইত্যাদি সব কিছুই জটিল হয়ে যায় তাদের জন্যে। তাদের “পতিত জমি” বেহাত করে সুন্নী আরব ও অ্যাসিরীয় খ্রীষ্টানরা।

তুরস্কের সীমানা থেকেও কুর্দীদের উচ্ছেদ করে সেখানে একটি “আরব বেল্ট” তৈরির চেষ্টা করে বাথিস্ট সরকার। অজুহাত যে সীমান্তে শত্রুভাবাপন্ন “বিদেশী” থাকাটা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য ভাল নয়। বহু স্থানের নাম কুর্দী থেকে আরবী করা হয়। জোরপূর্বক স্থানান্তরিত করা হয় সাধারণ কৃষকদেরকে। কেন্দ্রীয় সরকার থেকে নিষেধাজ্ঞা আসে নবজাতকের কুর্দী নামকরণের ওপর। জনসমক্ষে কুর্দী ভাষা ব্যবহার আর প্রাইভেট স্কুল পরিচালনাও হয় নিষিদ্ধ।

২০১২ সালে সিরিয়ার কামিশলি শহরে কুর্দী সমাবেশ

আশির দশকেও সিরিয়ায় কুর্দী বই, ক্যাসেট ইত্যাদি প্রকাশ ছিল শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বিয়ের অনুষ্ঠানে কুর্দী ঐতিহ্যবাহী পোশাকপরিধান বা গান গাওয়া ছিল নিষেধ। ১৯৮৬ সালে কুর্দী নববর্ষ নওরোজের জনসমাবেশে এমন নিষেধাজ্ঞা না মানার কারণে সিরীয় পুলিশ গুলি চালিয়ে কয়েকজনকে হত্যা করে।

ইরাক যুদ্ধ শুরুর পরপরই ২০০৪ সালে কামিশলি শহরে কুর্দী ও আরবদের মধ্যে বুশ বনাম সাদ্দামকে সমর্থন নিয়ে দাঙ্গা বেঁধে যায়। কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপে আবারও রক্ত দিয়ে অসম মূল্য দিতে হয় কুর্দী সাধারণ মানুষকে। ২০১১ সালে সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু হলে কুর্দী নেতাদের শুরুতেই গুপ্তহত্যার মাধ্যমে নিকেশ করে আসাদবাহিনী। কিন্তু দেশের অন্যত্র আরো ভয়াবহ বিদ্রোহ ঠেকাতে কুর্দী অঞ্চল থেকে সৈন্য সরিয়ে নিয়ে আসতে হ্য় বাশার আসাদকে।

সেই শূন্যতার সুযোগেই উত্তর সিরিয়ার বিশাল এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয় কুর্দী ন্যাশনাল কাউন্সিল। আমুদা-কামিশলি-আফরিন-কোবানি প্রভৃতি শহরে সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন স্থাপিত হয় তাদের নব্যপ্রতিষ্ঠিত সামরিক বাহিনী ওয়াই,পি,জি’র সহায়তায়। এই ডি ফ্যাক্টো স্বায়ত্ত্বশাসিত কুর্দী অঞ্চলের নাম “রোজাভা।”

নিজের লেজিটিমেসি ধরে রাখার জন্যেই হয়ত বাশার আসাদ রোজাভায় শক্ত হাতে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করেনি। ২০১১ সাল থেকে কুর্দীদের পাসর্পোট ও নাগরকিত্বের সনদও দিতে শুরু করে তার সরকার। অন্যান্য শত্রুর থেকে কুর্দীরা তার কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য। তাই রোজাভার বেশ কিছু শহরে আসাদ সরকারের সাথে সহাবস্থান করতে সংকোচ করছে না কুর্দী প্রশাসন।

২০১৪ সালে আইসিসের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত কুর্দী স্নাইপার, কোবানি
বিধ্বস্ত কোবানি শহরে ওয়াই পিজি ও ওয়াই পিজে মিলিশিয়া
কোবানি শহরে আইসিসের আক্রমণ চলাকালে সীমান্তের অপর পাশে তুরস্কে আশ্রয় নেয় কোবানির অধিকাংশ সাধারণ কুর্দী জনগণ

২০১৪ সালে কোবানি শহরের কুর্দী অবস্থানের চারদিকে অবরোধ বসায় আইসিস। শহরটির স্বল্পসংখ্যক ওয়াই,পি,জি সদস্য রিইনফোর্সমেন্ট না আসা পর্যন্ত তাদের অবস্থান ধরে রাখে। রক্ষা করে শহরটির সিভিলিয়ানদের। শেষ পর্যন্ত কুর্দী পাল্টা আক্রমণে আইসিস পিছু হটতে বাধ্য হয়। তাদের ধাওয়া দিয়ে রাক্কা পর্যন্ত দখল করে নেয় ওয়াই,পি,জি। এ কাজে তাদের সাথে শরিক ছিল ওয়াই,পি,জে নামে নারীযোদ্ধাদের মিলিশিয়াও। পুরো সিরিয়াতে যদি কোন প্রশিক্ষিত ডিসিপ্লিনড ফোর্স থেকে থাকে তো সে এই ওয়াই,পি,জি, এটা মার্কিন ডিফেন্স ডিপার্টমেন্টের মন্তব্য। এয়ারস্ট্রাইকের মাধ্যমে কোবানির অবরোধ ভাঙতে তাদের সহায়তা করে মার্কিন বিমানবাহিনী।

আইসিসের পতনের পর সিরিয়ার আরো বিশাল এলাকা আসে রোজাভার নিয়ন্ত্রণে। শুধু কুর্দী নয়, আরব, অ্যাসিরীয়, ইয়াজিদী প্রভৃতি বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সাথে সমঝোতা করতে হয় তাদের। রোজাভার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় অটোনমাস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অফ নর্থ এন্ড ঈস্ট সিরিয়া (আনেস)।

বহুজাতিক এই স্বায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চলে লিবার্টারিয়ান সোশালিজম হচ্ছে আদর্শ। প্রতিটা শহরের স্থানীয় মানুষ স্থানীয় সরকারের নেতৃত্বে। আনেস কাগজেকলমে কুর্দী জাতীয়তাবাদ সমর্থন করে না, আর সিরিয়ার মাঝেই ফেডারেল সিস্টেমে স্বায়ত্ত্বশাসন চায়। অর্থাৎ ইরাকি কুর্দিস্তানের মত। ইরাকী কুর্দীদের মত এরা রক্ষণশীল না হলেও দজলা নদের ওপারের বন্ধুদের থেকে রসদ সরবরাহ তারা পায়।

ইতালির বোলোনা শহরে কোবানিতে কুর্দী বাহিনীর সমর্থনে গ্রাফিটি
২০১৪ সালে কোবানিতে আইসিস আক্রমণের বিরুদ্ধে তুরস্কের সেনাবাহিনী কোন হস্তক্ষেপ না করায় তুরস্কের দিয়ারবাকির শহরে কুর্দীরা সহিংস বিক্ষোভ করে

ইরাকের মত সিরিয়াতে আরেকটি স্বায়ত্ত্বশাসিত কুর্দিস্তান হয়ে যার বাড়া ভাতে ছাঁই ঢেলেছে সে হল তুরস্ক। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান স্বয়ং মার্কিনদের দোষারোপ করেন “ভুল ফরেন পলিসির” জন্য। এটা যতটা না ইরাক যুদ্ধের সাথে জড়িত, তার থেকে বেশি তুরস্কের কুর্দী সমস্যাটিকে বাড়িয়ে দেবার জন্য। ওদিকে সিরিয়ার কুর্দীরা আইসিস বা আসাদকে যতটা শত্রু ভাবে, তার থেকে অনেক বেশি ভাবে তুরস্ক ও “সুলতান” এরদোয়ানকে। কারণ ২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত একাধিক তুর্কী সামরিক অভিযানে প্রাণ হারিয়েছে অগণিত সাধারণ সিরিয়ান কুর্দী।

গত পোস্টে বলেছি ইরাকের বাথিস্ট সরকার কি পরিমাণ অত্যাচার কুর্দীদের ওপর করেছে। আরেকটি যে দেশে দশকের পর দশক এমন অত্যাচার চলেছে সেটি তুরস্ক। ১৯২৩ সালে ওসমানী খেলাফতের সমাপ্তি হয়। সে জায়গায় কামাল আতাতুর্ক যে আদর্শের ওপর ভিত্তি করে আধুনিক তুরস্কের গোড়াপত্তন করেন সেটা তুর্কী জাতীয়তাবাদ। তাতে তুর্কী ব্যতীত অন্য জাতিসত্তার পরিচয়ের স্থান ছিল না। আগে অন্তত যে মুসলিম পরিচয়ের কারণে “খলীফা” তার কুর্দী প্রজাদের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম ছিলেন, সেটি রাতারাতি বিলুপ্ত হল। যে মিল্লি সিস্টেমের মাধ্যমে বিভিন্ন উপজাতি ও ধর্মের মানুষকে নিজেদের সমাজে নিজেদের অনুশাসন অনুযায়ী চলার স্বাধীনতা দেয়া ছিল, তার জায়গা নিল কেন্দ্রীয় সরকারের আরোপিত সেক্যুলার সিস্টেম।

কামালিস্ট তুরস্কের বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন শেখ সাঈদ নামে এই সুফী নেতা, ফাঁসিতে ঝোলানোর আগের চিত্র
বিংশ শতকের শুরুর ভাগে স্বঘোষিত তিনটা কুর্দীপ্রধান রিপাবলিকের অবস্থান
দেরসিম গণহত্যার অভিযানের সময়ে কুর্দী শিশুদের “উদ্ধার” করেছে তুর্কী সেনাদল, পরে এদের অনেকে নিহত হয়, অনেকে তুর্কী বোর্ডিং স্কুলে গিয়ে কুর্দী পরিচয় হারিয়ে ফেলে, ১৯৩৭

কামাল আতাতুর্কের প্রগতিশীল কিন্তু স্বৈরতান্ত্রিক শাসনে একের পর এক মাদ্রাসা, সুফী দরগা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, কুর্দী সংবাদপত্র প্রভৃতি বন্ধ হতে শুরু করে। তার প্রতিক্রিয়ায় ১৯২৫এ সুফী ঘরানার একটি কুর্দী বিদ্রোহ হয়। সেটিকে কঠোর হাতে দমন করে তুর্কী বাহিনী। স্বল্প কয়েকটি উপজাতির বাইরে অবশ্য এ আন্দোলনের নেতার গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। যুদ্ধবিমান ও মেশিন গানের সাহায্যে তার মধ্যযুগীয় সৈন্যদের কচুকাটা করে তুর্কীরা। বিদ্রোহের পতনের পর হাজারে হাজারে কুর্দীদের বিচারের প্রহসনে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়।

১৯২৭ সালে আরো বিশাল আকারে বিদ্রোহের সূচনা করেন আরেক নেতা ইহসান নুরী, তার সমর্থনে ছিল খয়বুন নামে কুর্দী জাতীয়তাবাদী একটি দল। আগের ধর্মীয়-উপজাতীয় মোটিভটাকে ধর্ম ও জাতিনিরপেক্ষ রূপ দেয়ায় তাদের সমর্থন আরো জোরালো হয়। “রিপাবলিক অফ আরারাত” নামে একটি স্বঘোষিত কুর্দী দেশ তৈরি হয় দক্ষিণপূর্ব তুরস্কে। আগেরবারের থেকে বেশি প্রখরতায় এদের ওপর বিমানহামলা চালানো হয়। মোস্তাফা কামালের মেয়ে সাবিহা গুকচেন স্বয়ং ফাইটার থেকে বোমানিক্ষেপ করে এসকল “দস্যুর” ওপর। ১৯৩০ সালে এ বিদ্রোহের সমাপ্তি হয়।

রিপাবলিক অফ আরারাতের ওপর বোমাবর্ষণের আগে বৈমানিক দলসহ সাবিহা গুকচেন, ১৯৩০
তুরস্কের কুর্দীনিধন নীতির বিরুদ্ধে জওহরলাল নেহরুর বক্তব্য

এরপর ১৯৩৭এ দেরসিম (বর্তমান তুঞ্জেলি) প্রদেশের সীমান্তবাসী কুর্দীদের সিরিয়ার মত “তুর্কীকরণের” প্রচেষ্টা চলে। সেসব স্থানে কুর্দীদের সরিয়ে কসোভার আলবেনিয়ান ও বসনিয়ানদেরকে পুনর্বাসন করা হয়। কুর্দী শিশুদের বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে তাদের তুর্কী নাম দিয়ে তুর্কী শিখিয়ে কুর্দী পরিচয় বিলোপের চেষ্টা চলে। সেখানে যে পরিমাণ হত্যাযজ্ঞ চলে, তা আর্মেনি গণহত্যাকেও হার মানায়। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান আর্মেনী গণহত্যা স্বীকার না করলেও ২০১১ সালে দেরসিম গণহত্যার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমাপ্রার্থনা করেছেন।

ষাটের দশক পর্যন্ত দক্ষিণপূর্ব তুরস্ক ছিল বিদেশীদের জন্য অফ লিমিট। কারণ সে অঞ্চলে সামরিক শাসন জারি ছিল। দমবন্ধকরা একটা পরিস্থিতি। ত্রিশের দশক থেকেই কুর্দী নামকরণ, ভাষা, উপকথা, ঐতিহ্যবাহী পোশাক, রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ। ডিকশনারি থেকেও কুর্দ-কুর্দিশ-কুর্দিস্তান শব্দগুলি এক্সপাঞ্জ! তুর্কী নেতারা কুর্দীদের সম্বোধন করত “মাউন্টেন টার্ক” অর্থাৎ পাহাড়ী তুর্কী নামে। সোজা কথায়, কুর্দী বলে কোন কিছু নেই, ছিল না — থাকবে না।

অধুনা তুরস্কে কুর্দী প্রদেশগুলির মাথাপিছু জিডিপি সবচে কম
দক্ষিণপূর্ব তুরস্কের একটি গ্রামে পিকেকে ও তুর্কী বাহিনীর সংঘর্ষে বিধ্বস্ত সাধারণ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান

এ ধরনের পরিস্থিতিতে নেটো সদস্য তুরস্কের মধ্যে গন্ডগোল পাকানোর মালমশলা হিসাবে কুর্দী জননেতৃত্ব সোভিয়েতের জন্য রেডি হয়ে বসে ছিল। সত্তরের দশকে তুরস্কে অতিবাম অতিডান দুই দলের মধ্যে ভয়াবহ রকমের সড়কযুদ্ধ চলত। এ পটভূমিতে আব্দুল্লাহ ওজালান নামে অর্ধ-কুর্দী এক ইউনিভার্সিটি ড্রপআউট শুরু করেন তার কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি বা পিকেকে দলটি। প্রথম প্রথম তাদের লক্ষ্য ছিল কুর্দীদের সমাধিকারের জন্য লড়াই। পরে সেটা হয়ে যায় সমাজতন্ত্রের ওপর ভিত্তি করে স্বাধীন কুর্দিস্তান প্রতিষ্ঠা। বলা বাহুল্য, তার বামপন্থী রাজনীতি সকল কুর্দীকে আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হয়।

তবে ১৯৮০র তুর্কী সামরিক অভ্যুত্থানের পর পিকেকে’র সুযোগ আসে আবেদন বৃদ্ধির। সামরিক জান্তার ধরপাকড় থেকে বাঁচতে কুর্দী তো বটেই বহু তুর্কী লেখক-সাহিত্যিক-গায়কও ইউরোপ-আমেরিকায় পাড়ি জমায়। এ শূন্যস্থানে পিকেকে সামরিক বাহিনীর ওপর চোরাগোপ্তা সন্ত্রাসী হামলা করে নিজেদের নেতৃত্বের একটা স্থান তৈরি করে নেয়। এমন না যে তারা ধোয়া তুলসী পাতা, কুর্দী বহু ল্যান্ডওনার আর উপজাতীয় নেতারাও তাদের জিঘাংসার শিকার হয়। পিকেকের চোখে এরা ছিল রাজাকার, শ্রেণীশত্রু।

পিকেকে নেতা আবদুল্লাহ ওজালানকে গ্রেপ্তার করে তুরস্কে নিয়ে যাবার সময়, ১৯৯৯
পিকেকের আক্রমণে নিহত তুর্কী সৈন্যের কফিনের সামনে তার বাবা, ২০১৭
২০২২এ ইস্তাম্বুলে বোমাহামলার বদলা নিতে তুর্কী বিমানবাহিনী সিরিয়ার কুর্দী এলাকায় হামলা চালালে শিশুসহ একাধিক সাধারণ কুর্দী নিহত হয়

১৯৮৪ সালে পিকেকের শুরু করা ইনসার্জেন্সিতে এ পর্যন্ত পয়ত্রিশ হাজারের মত তুর্কী মানুষ মারা গেছে যাদের সিংহভাগ কুর্দী সাধারণ নাগরিক। বহু সন্ত্রাসবাদী হামলা চলেছে তুরস্ক-ইস্তাম্বুলের ট্রেন-বাস টার্মিনাল, এয়ারপোর্ট, বাজার, ট্যুরিস্ট স্পটে। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত স্নায়ুযুদ্ধ ছিল পিকেকে বনাম তুরস্কের বিবাদের পটভূমি। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে তাই তখন থেকেই পিকেকে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসাবে স্বীকৃত। আয়রন কার্টেন ধ্বসে পড়তে শুরু করলে তুরস্ক ধীরে ধীরে কুর্দী ভাষা-সংস্কৃতির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে শুরু করে। রাষ্ট্রপতি তুরগুত ওজালের সাথে একটা শান্তি আলোচনা শুরু হলেও তার অকালমৃত্যুতে আবার ছক উল্টে যায়।

১৯৯৯ সালে মোসাদ স্টাইলে কেনিয়া থেকে আব্দু্ল্লাহ ওজালানকে ধরে নিয়ে আসে তুর্কী গোয়েন্দাবাহিনী এম,আই,টি। তখন প্রথম যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে পিকেকে। তারপরও থেমে থেমে এখনো সংঘাত চলছে। পিকেকে পালিয়ে ইরাকী কুর্দিস্তানের দুর্গম কান্দিল পর্বতে আশ্রয় নিয়েছে। তবে প্রায়শই ইরাকী কুর্দিস্তানের সরকার পিকেকে উচ্ছেদে তুর্কীদের সহায়তা করে।

পিকেকে তুরস্কের কুর্দী সংগ্রামের হেডলাইন কেড়ে নিলেও আসলে বহু ঘরানার রাজনীতি প্রচলিত আছে সেখানের কুর্দীদের মাঝে। তবে ১৯৯০ পর্যন্ত কুর্দী জাতীয়তাবাদী রাজনীতি সেখানে ছিল নিষিদ্ধ। প্রায়ই কোন না কোন কুর্দীপ্রধান দলকে বিচ্ছিন্নতাবাদের দায়ে তুরস্কের সুপ্রীম কোর্ট নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। জনপ্রিয় নেতা সালাউদ্দিন দেমিরতাশ সেই অভিযোগে দশ বছর ধরে জেলে। আরেক সংসদসদস্য লেলা জানা শপথ গ্রহণের শেষে তুর্কী-কুর্দী ভ্রাতৃত্বের আকাংক্ষা প্রকাশ করেন। ফলঃ দশ বছরের জেল।

২০১৭ সালে আঙ্কারায় সন্ত্রাসী বোমাহামলা
সিরিয়ার রোজাভার সমাবেশগুলিতে ওজালানের মুখচ্ছবি অংকিত ব্যানার ও পতাকা শোভা পায়
উত্তর সিরিয়ায় পরিচালিত তুর্কী গ্রাউন্ড অপারেশন, ২০১৯

তাই ২০০৪ সালে প্রথম কুর্দী টি,আর,টি টিভি চ্যানেল যাত্রা শুরু করলেও তাতে প্রচারিত ইরানী দল রাস্তাকের সঙ্গীতের কথায় “কুর্দিস্তান” শব্দটি প্রতিস্থাপন করতে হয় “হাউরামান” প্রদেশের নাম দিয়ে। মোটে সে বছরই নবজাতকদের কুর্দী নামকরণের ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয়া হয়।

আয়রনিক ব্যাপার হল, ২০০৩ সালে প্রধানমন্ত্রী হবার পর এরদোয়ানই এমন উদারপন্থা অবলম্বন শুরু করেন। মার্কেট রিফর্মের পাশাপাশি কুর্দী-তুর্কী সম্পর্ক নর্মালাইজেশনের একটা চেষ্টা চলে। সেসব ওলট পালট হয়ে যায় সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের কারণে। অতীতে সিরিয়ার সরকার পিকেকে দলটিকে নানা সময় আশ্রয় দিয়েছে। রোজাভার কুর্দীরাও ওজালানের অনুসারী বামপন্থী আদর্শে অনুপ্রাণিত। গৃহযুদ্ধের পর সিরিয়া থেকে আগত অভিবাসীদের সাথে স্বাধীনতাকামী সন্ত্রাসবাদীরাও তুরস্কে ঢুকে পড়েছে। অন্তত এমনটাই এরদোয়ানের দাবি।

তুরস্কে ২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত তিরিশটির মত সন্ত্রাসী বোমা হামলায় মারা গেছে সাড়ে পাঁচশর বেশি মানুষ। আক্রমণের দাবিদারদের মধ্যে ইসলামিক স্টেটের সন্ত্রাসবাদী আছে যেমন, তেমন বিভিন্ন ক্ষুদ্র অপরিচিত কুর্দী জাতীয়তাবাদী দলও আছে। তবে তুরস্কের সরকার প্রায়ই ঢালাওভাবে পিকেকে’কে এসবে মূল হোতা হিসাবে দাবি করে। আর যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র সিরিয়ার ওয়াই,পি,জি নাকি পিকেকেরই একটা শাখা, এটা তাদের দাবি।

এ কিছুটা সত্য। ওয়াই,পি,জির সমাবেশের ব্যানারে-পোস্টারে ওজালানের ছবি শোভা পায়। এ সকল কারণে ট্রাম্প প্রশাসন আইসিস উৎপাটন অভিযান সফল হবার পরপর সিরিয়ান কুর্দিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্যদের আংশিক প্রত্যাহার করে নেয়। তবে এখনো একটা ভাল মার্কিন উপস্থিতি সেখানে রয়েছে।

উত্তর সিরিয়ায় তুর্কী দখলদারিত্বের চিত্র
ইস্তাম্বুলের ইস্তিকলাল সড়কে বোমা বিস্ফোরণের ঠিক আগ মুহূর্তের দৃশ্য সিক্যুরিটি ক্যামেরায় ধারণকৃত

মার্কিনরা সরে আসার পরপরই তুর্কীরা তিনটি বড় সামরিক অভিযান চালিয়ে সিরিয়ার উত্তরাংশ দখল করে রেখেছে। কুর্দী সন্ত্রাসবাদী দল যাতে তুরস্কে ঢুকতে না পারে সে কারণে বর্ডারের দশ-পনেরো কিলোমিটারে তারা সেফ জোন বানাচ্ছে। হয়তবা ভবিষ্যতে সিরিয়ান রেফ্যুজিদের সেখানে ফেরত পাঠাবে। আবার এক দফা কুর্দীদের সম্পত্তি বেদখল হবে।

এসব কারণে সিরিয়ার রোজাভার জনমানসে আইসিস নয়, বরং তুর্কীবিদ্বেষ। সীমানার অপর পারে তুর্কী কুর্দীরাও অসন্তুষ্ট। এদের সকলের ধারণা কুর্দীবিরোধী অভিযানে তুর্কী সেনাবাহিনীর সাথে আইসিস শরীক রয়েছে। ২০১৪ সালে কোবানি অবরোধের সময় যুক্তরাষ্ট্রই তাদের সাহায্য করে, আইসিসবিরোধী জজবা তুলেও এরদোয়ান কোন সাহায্য করেনি।

এই রোববার বোঝা যাবে এরদোয়ানের ভবিষ্যৎ কি, আর রোজাভার অধিকৃত এলাকার ভবিষ্যতও। তার বিরুদ্ধে যে প্রার্থী জনমত জরিপে এগিয়ে আছেন তার নাম কামাল ক্রিচদারোউলু। একাধিক কুর্দী রাজনৈতিক দলও তাকে সমর্থন দিচ্ছে।

এরদোয়ানের বিরুদ্ধে মে ২০২৩এ নির্বাচনে প্রধান প্রতিপক্ষ কামাল ক্লিচদারোউলু
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কুর্দী ডায়াস্পোরার চিত্র
সুইডেনে তুরস্কের সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশ করছে কুর্দী জনতা, ২০১৯

এরদোয়ান যে সুইডেন-ফিনল্যান্ডের নেটো সদস্যপদ ঝুলিয়ে রেখেছেন, তার মূলেও এ কুর্দী সংঘাত। কুর্দীদের একটা বড় জনসংখ্যা ইউরোপে অভিবাসী। এরা সেসব দেশ থেকে অর্থ সাহায্য পাঠায় ইরাক-সিরিয়া-তুরস্ক-ইরানের কুর্দীদের। অনেক বিরোধী মতের কুর্দী নেতারাও রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে রয়েছে সেসব দেশে। সুইডেনে-ফিনল্যান্ডের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদীদের আশ্রয়প্রদানের অভিযোগের মূল সেটাই। ওদিকে তুরস্কের বহু গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা এখন প্রশ্নবিদ্ধ, বিশেষ করে বিচারব্যবস্থার। সে কারণে তুরস্কের কোর্ট কাউকে “সন্ত্রাসবাদী” তকমা দিলেও সুইডেন-ফিনল্যান্ডের মত দেশ সাথে সাথে সেটা বিশ্বাস করবে না।

এই একই কারণে তুরস্ক সহজে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য হতে পারবে না। প্রথম পোস্টে আমি বলেছিলাম কেন কিভাবে মাইনরিটি রাইটস এর ব্যাপারটা ইউরোপীয় রাষ্ট্রসংজ্ঞার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে গেছে। তার মূলে রয়েছে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রক্তস্নাত ইতিহাস। ইইউএর সদস্যপদ লাভের জন্য একটি দেশকে অবশ্যই স্বদেশের জাতিগত, ধর্মীয় ও ভাষাগত সংখ্যালঘুদের অধিকার ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে হবে। ঐ লেঠা না চুকিয়ে ইইউতে ঢুকলে আবারও সে পুরনো ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা। তাই যতদিন না কুর্দী প্রশ্নের একটা যথাযথ উত্তর তুরস্ক বের করতে না পারছে ততদিন ইউরোপীয় দেশ তারা নয়।

আর এ প্রসঙ্গে আমার মত যারা পশ্চিমা দেশে আরামে শান্তিতে বসবাস করছেন, তাদেরও মনে করিয়ে দিতে চাই যে আমরা কিন্তু ঐ মাইনরিটি রাইটসের সংজ্ঞাটির সুবিধাভোগী হয়েই উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি পাচ্ছি! যদি ভাবেন স্বদেশে বাঙালী বা মুসলমানরাই হবে সব ক্ষমতার মালিক, কিংবা ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী নস্টালজিয়াই সকল সমস্যার উত্তর, তো সেটা হবে চরম হিপোক্রেসি!

ইউরোপ-আমেরিকা উন্নতি করেছে শুধু টেকনোলজির বদৌলতে নয়, তারা স্বদেশের মানুষকে, আই মীন আপামর সকল মানুষকে, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একটা গ্রহণযোগ্য সমাধিকার দেয়। স্বদেশের অর্থনৈতিক-সামরিক সকল প্রকার নিরাপত্তা ও উন্নতির জন্য সে ডাইভার্সিটিটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যতদিন সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে এটা সঠিকভাবে স্বীকৃত না হবে, ততদিন জনগোষ্ঠীর একটা বড় পটেনশিয়াল থেকে বঞ্চিত হবে দেশ ও জাতি। সোভিয়েতের পতন হয়েছে, কিন্তু এখানে এখনও একটা বিশাল মানসিক ডিভাইড রয়ে গেছে ঈস্ট আর ওয়েস্টের মধ্যে। এই আয়রন কার্টেনের পতন না ঘটলে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি কোথাও নেই।

ইরাকী কুর্দিস্তান

“ইরাক ওয়ার ওয়াজ এ গুড থিং!” ইরাক যুদ্ধ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে আপনি নিশ্চয় এমন উত্তর দেবেন না? কিন্তু ইরাকের কেউ না কেউ এমন উত্তর আপনাকে দেবেই। এবং নব্বই শতাংশ সম্ভাবনা সে একজন কুর্দী!

ইরাকের বাথিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ রেজোল্যুশন ১৪৪১ লংঘনের অভিযোগে যে যুদ্ধটি ২০০৩এ শুরু হয়, তার সবচেয়ে বড় বেনেফিশিয়ারি ইরাকী কুর্দিস্তান আর তার পলিটিকাল ক্লাস। সাদ্দামের আমলে যে আরবিল ছিল মফস্বলের অনুন্নত প্রাদেশিক একটি শহর, সেটি আজ তেলের পয়সায় সম্পদশালী। বাকি ইরাকের তুলনায় কুর্দিস্তান রিজিওন তুলনামূলক নিরাপদ এলাকা। কুর্দী যে সকল নেতারা ইরাক-ইরানের সীমান্ত বরাবর ‌অতীতে পালিয়ে বেড়াত, তারা আজ বাগদাদে শক্তিমান পাওয়ার ব্রোকার। যে ইরাকে কখনো সুন্নি আরব ছাড়া রাজা বা রাষ্ট্রপতি কেউ হয়নি, সেখানে এখন অলিখিত আইন যে রাষ্ট্রপতি হবেন একজন কুর্দী। আর একজন নয় চারজন রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রে সে নিয়ম ‌অনুসরণ করা হয়েছে।

প্রতিবেশী দেশের কুর্দীদের জন্যে ইরাকী কুর্দিস্তান আশার আলোকবর্তিকা, কিন্তু তাদের সরকারগুলির জন্যে একটা গাত্রদাহের ব্যাপার। যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে ইরাকী কুর্দীদের সমর্থন পেয়েছে ও দিয়েছে, সেটা আশপাশের দেশগুলিকে, বিশেষ করে তুরস্ককে, মার্কিন মিত্রতা নতুন করে মূল্যায়ন করতে বাধ্য করেছে।

আরবিল শহর, ইরাকী কুর্দীস্তান, ২০২১

ইরাকী কুর্দিস্তানের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মাসুদ বারজানি যে উপজাতির নেতা, সেটিই বহু দশক ইরাকে কুর্দী স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রভাগে ছিল। ত্রিশের দশকে মাসুদের চাচা আহমেদ বারজানি রাজতন্ত্রী সরকারের কেন্দ্রীকরণ আর উপজাতীয় অধিকার হরণ নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে বিফল হয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মাসুদের বাবা মুস্তাফা নতুন করে আরেকটি বিদ্রোহের সূচনা করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পালিয়ে সীমান্তের অপর পারে ইরানী কুর্দীদের সাথে হাত মেলান।

গত পোস্টে বলা সোভিয়েত পাপেট রাষ্ট্র রিপাবলিক অফ মাহাবাদকে মু্স্তাফা বারজানির উপজাতীয় সৈন্যদল সামরিক সহায়তা দেয়। কিন্তু সোভিয়েতরা কেটে পড়লে তাদের সাথে সাঙ্গপাঙ্গসহ আজারবাইজানে চলে যান মু্স্তাফা। কম্যুনিস্ট পার্টির পৃষ্ঠপোষকতায় সমাজতন্ত্রে দীক্ষা নেন তিনি ও তার অনুগতরা। তাঁর লক্ষ্য স্বাধীন কুর্দিস্তান। আর সোভিয়েতের লক্ষ্য, যদি স্বাধীন কুর্দিস্তান হয়ই তো তা হবে সমাজতান্ত্রিক রুশঅনুগত কুর্দিস্তান।

বারজানি পরিবার, সামনে আহমেদ, পেছনে মুস্তাফা ও ভাইয়েরা
বারজানি ক্ল্যান

বিভিন্ন রুশ নেতাদের সাথে মোলাকাত করলেও দ্রুত বারজানির সাথে পৃষ্ঠপোষকদের বিরোধ দেখা দেয়। উজবেকিস্তানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে একরকম নির্বাসনে পাঠানো হয় স্বাধীনতাযোদ্ধাদের। সোভিয়েতরা এরপর বারজানির উপযোগিতা পায় ১৯৫৮ সালে ইরাকে আরব জাতীয়তাবাদী সামরিক অভ্যুত্থান ও রাজতন্ত্রের রক্তক্ষয়ী পতনের পর।

নতুন প্রধানমন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার আব্দুল করিম কাসিমের আশ্বাসে বারজানি নির্বাসন থেকে ফিরে আসেন। কুর্দিস্তানের স্বায়ত্ত্বশাসনের ব্যাপারে কাসিমের সাথে সমঝোতাও হয়। কুর্দিস্তান ডেমোক্রাটিক পার্টিকে বৈধতা দেয়া হয়। কিন্তু কাসিম বারজানির ক্রমবর্ধমান শক্তিতে অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে শুরু করেন। বারজানি শুধু সোভিয়েত নয়, মার্কিন, ইরানী, ইসরায়েলী যে কোন উৎস থেকে সহায়তা গ্রহণের পক্ষপাতী ছিলেন। অপরদিকে বারজানিবিরোধী সোভিয়েতসমর্থিত কুর্দী নেতাদেরকে ইরাকের কেন্দ্রীয় সরকার গুরুত্বপূর্ণ পদ দেয়। ফলে ১৯৬১ সালে ইরাকী-কুর্দী যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। কুর্দী মিলিশিয়া গেরিলা কৌশলের আশ্রয় নিয়ে কাসিমের সেনাবাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখে। তারা সমর্থন পায় ইরান ও ইসরায়েল থেকে। বহু সাধারণ কুর্দী এ সংঘাতে ইরাকী সেনাবাহিনীর কনভেনশনাল অস্ত্রের ব্যবহারে মারা যায়।

ইরাকী প্রধানমন্ত্রী আব্দুল করিম কাসিমের সাথে মুস্তাফা বারজানি
প্রথম ইরাকী-কুর্দী যুদ্ধ, ১৯৬১-৭০

কিন্তু এই কুর্দী অভিযান নিয়েই কাসিমের সাথে তার সেনানায়কদের বিরোধ দেখা দেয়। ক্যুতে তিনি নিহত হন। পরবর্তী রাষ্ট্রপতি কর্নেল আব্দুস সালাম আরিফ আর তার ভাই লেফটেনেন্ট জেনারেল আব্দুর রহমান আরিফ কেউই কুর্দী পেশমের্গা গেরিলার বিরুদ্ধে সফলতা অর্জন করতে পারেননি। বাধ্য হয়ে ১৯৬৬ সালে একটি শান্তিচুক্তির মাধ্যমে নতুন করে স্বায়ত্ত্বশাসনের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়ে বারজানিকে।

কিন্তু তাতে বাদ সাধে ১৯৬৮ সালে ইরাকে বাথ পার্টির ক্যু। আরব জাতীয়তাবাদীদের সরিয়ে ক্ষমতায় আসে বাথ সমাজতন্ত্রী জাতীয়তাবাদীরা। এ পার্টির আদর্শ নাৎসি পার্টির থেকে এমন কিছু ভিন্ন নয়। সাদ্দাম হোসেন তখন বড় মাপের বাথিস্ট নেতা না হলেও তাকে ১৯৭০এ পাঠানো হয় কুর্দীদের সাথে নতুন করে শান্তিস্থাপনের জন্যে। স্বায়ত্ত্বশাসন আর কুর্দীকে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসাবে মর্যাদার দেবার প্রস্তাবে ইরাক রাজি হয়।

কিন্তু সে চুক্তি বাস্তবায়নেও কেন্দ্রীয় সরকার নানা টালবাহানা করে। ততদিনে কুর্দী এলাকার মসুল ও কিরকুক শহরের আশপাশে তেলের খনি আবিষ্কৃত হয়েছে। সেসবের ওপর শক্ত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্যে কেন্দ্রীয় সরকার এলাকাটির “আরবীকরণ” শুরু করে। এর অর্থ হল, আদি অধিবাসী কুর্দী, অ্যাসিরীয়, ইয়াজিদী এদেরকে সরিয়ে সে জায়গায় আরব বেদুইন উপজাতিগুলিকে প্রতিস্থাপন করা। এতে করে গুরুত্বপূর্ণ এলাকাটি বাথ পার্টির একদলীয় নিয়ন্ত্রণে থাকবে।

দ্বিতীয় ইরাকি-কুর্দী যুদ্ধ, ১৯৭৪-৭৫
সাদ্দামসহ মুস্তাফা বারজানি

বারজানি এ নীতির বহু প্রতিবাদ করেও ফল পাননি। তার ওপর একটি ব্যর্থ আততায়ী হামলা হয় বারজানির ওপর, যার পেছনে সাদ্দামের হাত ছিল। দ্বিতীয় যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় কুর্দিস্তানে। বারজানিকে ইরান ভারি অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে। কিন্তু গেরিলা যুদ্ধে অভ্যস্ত পেশমের্গা কনভেনশনাল অস্ত্র দিয়ে ইরাকের সুপেরিয়র সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তেমন কিছু করতে পারেনি। ওদিকে ১৯৭৫এ ইরাক-ইরানের শাত-ইল-আরব ভূমিবিরোধ আলজিয়ার্স চুক্তির মাধ্যমে মীমাংসা হয়ে যায়। ইরানের শাহ তখন সহায়তা বন্ধ করে দিলে বারজানিকে আবার পালাতে হয়ে সীমান্তের ওপারে।

এ সময় বারজানির অবর্তমানে কেডিপির প্রগতিশীল সদস্যদের নিয়ে নতুন পার্টি পেট্রিওটিক ইউনিয়ন অফ কুর্দিস্তান পি,ইউ,কে সংগঠিত করেন তারই সহযোদ্ধা জালাল তালাবানি। ১৯৭৬এ লো-লেভেল ইনসার্জেন্সি চালু রাখে তারা। কিন্তু শীঘ্রি কেডিপির সাথে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করেন সাদ্দাম হোসেন। উত্তর ইরাকের বড় শহরগুলিতে সামরিক শক্তিবলে পুরোদমে চলে আরবীকরণ অভিযান।

১৯৭৯ সালে ইরানের বিপ্লবের পর পরই মৃত্যুবরণ করেন মুস্তাফা বারজানি। তার স্থান নেন ছেলে মাসুদ। পরের বছরই শাত-আল আরবের পুরনো বিবাদের দোহাই দিয়ে ইরান আক্রমণ করে বসেন সাদ্দাম। সুযোগ পেয়ে কেডিপি ও পিইউকে উভয়েই উত্তর ইরাকে আবার বিদ্রোহ শুরু করে দেয়। অপেক্ষাকৃত রক্ষণশীল বারজানির দল সরাসরি ইরান থেকে সাহায্য পায়। আর তালাবানির দল সাহায্য পায় বাথিস্ট সিরিয়া আর লিবিয়ার থেকে।

কিন্তু ইরানের সাথে যুদ্ধরত অবস্থাতেও ইরাকের কেন্দ্রীয় সেনাবাহিনীর যথেষ্ট অস্ত্রবল ছিল উত্তরের বিদ্রোহ সামাল দেবার। ১৯৮৩ সালে বিশাল অভিযান চালিয়ে আরবিল প্রদেশে মাসুদের উপজাতি বারজানিদেরকে প্রায় নিঃশেষ করে দেয়া হয়। তার পরিবারের বহু সদস্যকে অপহরণ করে নিয়ে যায় ইরাকী বাহিনী। পরবর্তীতে সেসময়ে নিহত পাঁচশর ওপর মানুষের গণকবর খুঁজে পায় কুর্দীরা।

হালাবজায় রাসায়নিক আক্রমণে নিহত বাবা-শিশু, ১৯৮৮
ইরান ইরাক ফ্রন্টলাইনে গ্যাসমাস্কপরা ইরানী সৈন্য
কেমিকাল আলি

১৯৮৮ সালে ইরানঅধিকৃত হালাবজা শহরে গোলানিক্ষেপ করে সাদ্দামের বাহিনী। আন্তর্জাতিক আইনের থোড়াই কেয়ার করে মার্চে সে শহরে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে তারা। স্থানীয় ইরাকী কুর্দী বৃদ্ধ-নারী-শিশু হাজারে হাজারে কঠিন মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে। “কেমিকাল আলি” ডাকনাম দেয়া হয় সে ঘটনার নেতৃত্বে থাকা সাদ্দামের তুতোভাইকে। মানব ইতিহাসে এই প্রথম ঘটনা যেখানে স্বদেশী নাগরিকদের বিরুদ্ধে উইপন অফ মাস ডিস্ট্রাকশন ব্যবহার করল কোন একটি দেশ। বৃহত্তর “আল-আনফাল” অভিযানের ‌অংশ ছিল এ আক্রমণ। কুরআনের একটি সূরার নামে অভিযানটির নামকরণ। সব মিলিয়ে প্রায় এক লাখ কুর্দী মানুষের মৃত্যু হয় এ অভিযানে, যাকে এখন অনেকে কুর্দী জেনোসাইড নামে অভিহিত করে। একই কারণে ইসরাইলের সাথে কুর্দীরা একটা ঐতিহাসিক সংযোগ বোধ করে।

দাবার ছক পাল্টাতে শুরু করে ১৯৯১ সালে। সাদ্দামের কুয়েত দখলের কারণে যুক্তরাষ্ট্র বিশাল কোয়ালিশন নিয়ে ইরাকে আক্রমন চালায়। উত্তর ইরাকে ঘোষিত হয় নো ফ্লাই জোন। নিজেদের বিবাদ মিটিয়ে তালাবানি ও বারজানিরা সেখানে ডি ফ্যাক্টো স্বায়ত্ত্বশাসন শুরু করেন। বুশের আহ্বানে দক্ষিণে শিয়া-সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাতেও সাদ্দামবিরোধী গণআন্দোলন শুরু হয়ে যায়। দু জায়গাতেই নিষ্ঠুরভাবে সামরিক বাহিনীর সাহায্যে বিদ্রোহ মোকাবেলা করে নিজের গদি রক্ষা করেন সাদ্দাম। কিরকুক থেকে হটে পাহাড়ী এলাকায় আশ্রয় নেয় কুর্দী স্বায়ত্ত্বশাসিত কাউন্সিল।

হালাবজা মেমোরিয়াল, ইরাকী কুর্দিস্তান
কুর্দী বিদ্রোহ, ১৯৯১

একতাবদ্ধ ইরাকী কুর্দিস্তান নিজেদের অধিকৃত এলাকায় সংসদ নির্বাচন করে ১৯৯২ সালে। উত্তরে বারজানির কেডিপি আর দক্ষিণে তালাবানির পিইউকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। ইরাকী সরকার এদের ওপর অবরোধ আরোপ করে। পিকেকে নির্মূলের লক্ষ্যে তুরস্কের সেনাবাহিনীও পশ্চিমে একটি অভিযান চালায়। কঠিন এ সময়টিতে কুর্দীরা বিভক্ত হয়ে পড়ে। গৃহযুদ্ধ চলে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত। কেন্দ্রীয় ইরাক সরকার ও ইরান যথারীতি উভয় পক্ষকে নিজের সুবিধার জন্যে ব্যবহার করে। ১৯৯৭এ যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় সহিংসতা বন্ধ করে দুই কুর্দী পক্ষ।

২০০৩এ বুশ দুই’য়ের ইরাক আক্রমণে শরিক হয় কুর্দী সৈন্যরাও। এ সময় যুক্তরাষ্ট্র আগের বারের মত মিত্র দেশগুলির সহায়তা পায়নি। বিশেষত তুরস্ক তাদের ভূমি ব্যবহারের অনুমতি দেয়নি। এ কারণেই উত্তর ইরাকে কুর্দীদের ওপর নির্ভর করতে হয় মার্কিনদের। আয়রনিকালি তুরস্ক এভাবেই “শত্রু” জাতিটিকে সাহায্য করে বসে, যেখানে একটা সুযোগ ছিল “ক্লীনাপ অপারেশন” চালানোর। সাদ্দামসমর্থিত বাহিনীগুলির ওপর কুর্দী পেশমের্গা সহজেই বিজয় পায়। কিরকুক ও ‌অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শহর ফিরে আসে তাদের হাতে।

আরবিল শহরে ইরাকী কুর্দী ও অ্যাসিরীয়দের সমাবেশ
বিভিন্ন দেশের মাঝে কুর্দী জাতিগোষ্ঠীর বিভাজন

২০০৬এ দখলদার মার্কিনদের বিরুদ্ধে যখন ইরাকের বাকি সকল ‌‌অংশে ইনসারজেন্সি চলেছে, তখন কুর্দিস্তান ও দক্ষিণের শিয়া-অধ্যুষিত অঞ্চল ছিল তুলনামূলকভাবে শান্ত। নির্বাচনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার নির্ধারিত হয় গৃহযুদ্ধচলাকালীন সময়েই। তাতে ইরাকী প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেন কুর্দী নেতা জালাল তালাবানি স্বয়ং। ২০১১-১২র দ্বিতীয় সুন্নি ইনসারজেন্সি আর ২০১৩-১৭র আইসিস যুদ্ধ ইরাকি কুর্দিস্তানের একাংশে হলেও নিজেদের শহরগুলির নিয়ন্ত্রণ হারায়নি কুর্দিস্তান রিজওনাল সরকার।

তবে কেন্দ্রের সাথে তেল-উত্তোলন ও পরিবহন নিয়ে পরবর্তীতে নানা বিবাদে জড়িয়েছে কুর্দীরা। সে নিয়ে সংঘাত হয়েছে উভয় পক্ষের মধ্যে। কেন্দ্রের শাসানি আর মার্কিনসহ অন্যান্য মিত্রদের সাবধানবাণী সত্ত্বেও ২০১৭ সালে স্বাধীনতা নিয়ে গণভোট করেন বারজানি। ৯২ শতাংশ ভোট পড়ে স্বাধীনতার পক্ষে। তবে এটা কোন বাইন্ডিং রেফারেন্ডাম ছিল না। স্বাধীনতা দূরে থাক, উল্টো কেন্দ্রীয় সেনাবাহিনী কুর্দিস্তানের অধিকৃত এলাকার ২০ শতাংশের পুনর্দখল নেয়। এ ছিল বারজানির আদর্শিক কিন্তু ভুল একটি পদক্ষেপ।

ইরাকী কুর্দিস্তানে তেলগ্যাসের চিত্র
আর্বিল, ইরাকী কুর্দিস্তান, বর্তমানকাল
কুর্দিস্তান স্বাধীনতা রেফারেন্ডামের প্রাক্কালে সমাবেশ, ২০১৭
কুর্দিস্তান স্বাধীনতা রেফারেন্ডামের প্রাক্কালে সমাবেশ, ২০১৭

সাদ্দাম বা কাসিমের সময়কার থেকে ইরাকী কুর্দীদের বর্তমান চিত্র বেশ উন্নত। কিন্তু এখনো সেই পুরনো কেন্দ্রবিরোধী সংঘাতের বীজ রয়ে গেছে। তবে কেন্দ্রীয় সরকারে তাদের যথাযথ গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্ব আছে। কুর্দিশ পাইপলাইনের তেলগ্যাস থেকে ভাল আয় আছে। আর স্বায়ত্ত্বশাসন এখন সরকারীভাবে স্বীকৃত। যতদিন এমন একটা পাওয়ার ব্যালান্স টিকিয়ে রাখতে পারবে কুর্দীরা, ততদিন ভবিষ্যতের একটা আশা আছে স্বাধীন রাষ্ট্রের।

আশা করি এখন বুঝতে পারছেন, কেন একজন ইরাকী জাতীয়তাবাদী কুর্দী আপনাকে বলবে ইরাক ওয়ার ওয়াজ এ গুড থিং! আরও বুঝেছেন, আশপাশের দেশগুলির কেন কুর্দী ইস্যু নিয়ে গাত্রদাহ বেড়েছে।

রাষ্ট্রবিহীন জাতি

আগের পোস্টে বলছিলাম রাষ্ট্রবিহীন এক বিপুল জনসংখ্যার জাতির কথা। কুর্দীরা সে জাতি। বর্তমান তুরস্কের জনসংখ্যার বিশ শতাংশ কুর্দী, ইরাকের বিশ শতাংশ, সিরিয়ার দশ, আর ইরানের দশ। সব মিলিয়ে তিন থেকে সাড়ে চার কোটির মত। সঠিক সংখ্যাটা বলা খুবই মুশকিল কারণ তারা যেসব রাষ্ট্রের বাসিন্দা সেসবের জাতীয়তাবাদী নীতির কারণে অনেকে তাদের মূল পরিচয় হারিয়ে ফেলেছে, নয়ত খোলাখুলি প্রকাশ করে না। আর সরকারি গণশুমারিতে কুর্দীদের জাতিগত অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় না।

মধ্যপ্রাচ্যের কুর্দীঅধ্যুষিত এলাকার মানচিত্র

কুর্দীদের আবাসস্থল ঐ চারটি দেশের সীমানায় একটি পাহাড়ী অঞ্চলে, যার নাম জাগ্রোস মাউন্টেনস। কুর্দী প্রবাদে, পাহাড় ছাড়া তাদের কোন বন্ধু নেই। পাহাড় তাদের পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ। হয়ত পাহাড়ের দুর্গমতার কারণেই কুর্দীদের বৈচিত্রপূর্ণ ভাষাগত বিবর্তন ঘটে। সোরানি, কুরমাঞ্জি আর খওয়ারিন বলে কুর্দির অন্তত তিনটি উপভাষা। কিন্তু এদের মধ্যে মুচুয়াল ইন্টেলিজিবিলিটি বেশি নয়। ফার্সীর সাথেও নেই, যদিও কুর্দী ফার্সীর মতই ইন্দোইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত। তুরস্ক ও সিরিয়ায় কুর্দী লিখিত হয় লাতিন হরফে, ইরাক-ইরানে ফার্সী-আরবী হরফে। আজকের কুর্দী জনসংখ্যার মধ্যে ভাষার মত ধর্মের বৈচিত্রও লক্ষণীয়। শিয়া-সুন্নী ইসলামের পাশাপাশি খ্রীষ্টান, ইহুদী, জোরোয়াস্ট্রিয়ান আর আলাউয়ী, ইয়াজিদী, ইয়ারসানী প্রভৃতি সুফী ও সুফীপ্রভাবিত ধর্মবিশ্বাস কুর্দীরা অনুসরণ করে।

ইরাকী কুর্দিস্তান রোডসাইন, তিন ভাষায়
সিরিয়ার ডি ফ্যাক্টো স্বায়ত্ত্বশাসিত রোজাভা এলাকায় লাতিন হরফে কুর্দী সিনিয়েজ

অনেকের হয়ত জানা আছে, একাদশ শতকে লেভ্যান্ট ও জেরুজালেম থেকে ক্রুসেডারদের বিতাড়িত করতে সক্ষম হন যে মুসলিম সেনাপতি, সে সালাহ-আল-দ্বীনও জাতিগত কুর্দী। আইয়ুবী রাজপরিবারের সূচনা করেন তিনি। ক্রুসেডারদের বিতাড়িত করাটা ছিল সোজা কাজ, কিন্তু তাদের দূরে রাখাটা ছিল অপেক্ষাকৃত জটিল কাজ। পূর্ববতী শিয়া ফাতিমী শাসকদের রিলিজিয়াস ইনটলারেন্স পলিসি আইয়ুবীরা পরিত্যাগ করে। ক্রুসেডারদের সাথেও খ্রীষ্টানদের অধিকার নিয়ে একটা সমঝোতায় আসা হয়। জেরুজালেমে পুনরায় ইহুদীদের বসবাসের অধিকার দেয়া হয়। আইয়ুবী শাসনামলে পরে বেশ কিছু ক্রুসেড হলেও সেগুলি নানা কারণে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। শিল্প ও বিজ্ঞানেও ইসলামী জগতে একটা পুনরুজ্জীবন আসে আ‌ইয়ুবী শাসনামলে।

সালাউদ্দিনের চিত্রসম্বলিত আইয়ুবী মুদ্রা

প্রাক-আধুনিক যুগে অবশ্য কুর্দীরা দুটি বড় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে, যদিও নানা সময়ে তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামও চলে। একটি ‌অটোমান সাম্রাজ্য, অন্যটি ইরানের সাফাভী সাম্রাজ্য। সেটা ষোড়শ-সপ্তদশ শতকের কথা। ধর্মীয়ভাবে সুন্নী হওয়ায় অটোমানরা শিয়া সাফাভীদের দুর্বল করার জন্য নানাভাবে কুর্দীদের ব্যবহার করে। সেভাবে সাফাভী ইরানের পশ্চিমের একটা বড় এলাকা কব্জা করতে সক্ষম হয় অটোমান তুরস্ক। কয়েক বছর পর পর বিভিন্ন কুর্দী বিদ্রোহেরও সম্মুখীন হয় সাফাভীরা। তবে সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় তারা। জোরপূর্বক শিয়া মতবাদ চাপিয়ে দেয়া হয় দেশের ‌অন্যান্য জাতির মত।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগ দিয়ে বিশ্বের ‌অন্যান্য ‌অনেক জাতির মত শিক্ষিত কুর্দীরাও জাতীয়তাবাদী আদর্শের দিকে ঝুঁকে পড়ে। তবে তাদের জনসংখ্যার একটা বিপুল অংশ তখনও ট্রাইবাল লয়ালটির অনুসারী। সে কারণে দুয়েকটি জাতীয়তাবাদী কুর্দী বিদ্রোহ হলেও সেগুলি ছিল স্বল্প কিছু উপজাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ। তবে বিশ্বযুদ্ধের সময়ে দুটি বড় বিদ্রোহে গোপন সমর্থন দেয় তুর্কীদের শত্রু রুশরা। সেগুলির মূল কারণ ছিল যুদ্ধের জন্যে করবৃদ্ধি ও কনস্ক্রিপশন।

তবে কুর্দীদের একটা বড় অংশের মূল সমর্থন ছিল তুর্কী অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতি। মূলত সুন্নী ধর্মবিশ্বাসের কারণে। আর তাছাড়া তুরস্কে ১৯০৮এর ক্যু পরবর্তী সংস্কারের কারণে কুর্দী উপজাতীয় নেতাদের ছিল ভাল সম্মানজনক অবস্থান।

‌আরব ছাড়াও অটোমান তুরস্কে কুর্দী এবং আর্মেনীরা ছিল আরো দুটি বড় জাতি। এদের মধ্যে রুশদের সাহায্য করার অভিযোগে ১৯১৫তে অটোমানরা আরমেনীদের ওপর গণহত্যা চালায়। কুর্দী সৈন্যদের এ কাজে ব্যবহার করে অটোমান তুর্কীরা। প্রচুর তুর্কী-কুর্দী নাগরিক এ সংঘাতে প্রাণ হারায়।

অটোমানদের পরাজয়ের পর উইলসনের জাতিগত ভাগ্য স্বনির্ধারণ তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে আরবদের জন্যে আলাদা আবাসভূমি প্রস্তাবিত হয়। আরব ট্রাইবাল নেতারা প্যারিসে আলোচনায় অংশ নেয়।

প্যারিস শান্তি সম্মেলনে আরব প্রতিনিধি ভবিষ্যৎ জর্দানী রাজা ফয়সাল, সৌদী নন, হাশেমী

যুদ্ধ শেষে ১৯১৯এ স্যাভর্ চুক্তির আলোচনায় কুর্দী-আরমেনীদের প্রতিনিধিরাও অংশ নেয়। ১৯১৭তে রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবের ডামাডোলে একটি স্বাধীন আর্মেনিয়া রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে ইতিমধ্যে। পূর্ব তুরস্কবাসী আর্মেনিয়ানদের তার সাথে যুক্ত করে নতুন একটি বৃহত্তর আরমেনিয়ার পরিকল্পনা দেন উইলসন।

প্যারিস শান্তি আলোচনার ‌অংশ হিসাবে ১৯১৯এ যুক্তরাষ্ট্র থেকে দুই সেনেটর কিং এবং ক্রেন সিরিয়া-ইরাকে আসেন জাতিগত অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে। ১৯২২এ প্রকাশিত তাদের রিপোর্টে আশা প্রকাশ করা হয় যে, একসময় এ এলাকায় বহুজাতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সার্বভৌম রাষ্ট্র স্থাপন সম্ভব। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে তাদের স্বাধীনতা দেয়া হবে ভুল। মূল কারণ জাতিগত ও উপজাতীয় দ্বন্দ্ব, আর আধুনিক শিক্ষা ও সাক্ষরতার অভাব। ফিলিস্তিনে ইহুদী আবাসভূমি পুনর্স্থাপনের ব্যাপরটাও তারা সমর্থন করেননি। কারণ সেখানে ইতিমধ্যে অইহুদী একাধিক জাতি রয়েছে যাদের ডিসএনফ্রাঞ্চাইজ করা সম্ভব নয়। সামরিক জোর ব্যতিরেকে সে কাজ অসম্ভব। তবে কুর্দিস্তানের ব্যাপারে কিং-ক্রেন আলাদা আবাসভূমির পক্ষে মত দেন।

উইলসনিয়ান আরমেনিয়া
কিং ক্রেন কমিশনের রিপোর্ট

কিং-ক্রেন বা উইলসন যাই বলুন বা ভাবুন না কেন, ইতিহাসের চাকা ঘোরে নিজের ইচ্ছেমত। কুর্দী-আরমেনীদের জাতিগত ভাগ্য স্বনির্ধারণের আগেই দুটো ব্যাপার ঘটে যায়। উইলসন পরাজিত হন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে, যুক্তরাষ্ট্র সকল আন্তর্জাতিক এনগেজমেন্ট থেকে গুঁটিয়ে আইসোলেশনিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত হয়। লীগ অফ নেশনসে যোগদান দূরের কথা, ‌অটোমান সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের আলোচনা থেকেও সরে আসে।

আর দ্বিতীয় ঘটনাটা হল, তুরস্কে তুর্কী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে স্বাধীনতা যুদ্ধ। এই নতুন তুর্কী পুনরজ্জীবনের জোয়ারে পশ্চিম উপকূল থেকে গ্রীক দখলদার সেনাবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। আর পূর্বে কুর্দী-আর্মেনী এলাকাও আতাতুর্কের তুর্কী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ততদিনে খোদ রাশিয়া এবং রুশ আর্মেনিয়াতেও বলশেভিকরা ক্ষমতা পুনর্দখল করতে সমর্থ হয়েছে। তারা তুরস্কের সাথে পৃথক শান্তি আলোচনার মাধ্যমে ককেশাসের জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, আজারবাইজানের সীমানা নির্ধারণ করে নেয়। বলা বাহুল্য এর ফলে আরমেনীদের যুক্তিসংগত দাবিটিও মাটিচাপা পড়ে যায় আর তুরস্কের আরমেনিয়ান অধ্যুষিত এলাকাটি তুরস্কের অধীনস্থই রয়ে যায়।

এই নতুন পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে স্যাভরে অটোমানদের সাথে সইকৃত চুক্তিটি রদ করতে বাধ্য হয় মিত্রশক্তি। নতুন করে লোজান চুক্তি হয়। যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতিতে ফ্রান্স-ব্রিটেন ফিরে যায় তাদের পুরনো সাম্রাজ্যবাদী চেহারায়। যুদ্ধ চলাকালীন সময়েই ১৯১৫তে একটা গোপন চুক্তি করেছিল তারা। সে চুক্তি অনুযায়ী সিরিয়া-ইরাকের মাঝ বরাবর একটা সোজা লাইন টেনে সীমানা নির্ধারিত হয়। তার একপাশে সিরিয়া-লেবানন থাকবে ফরাসী অধিকৃত। মেসোপটেমিয়া-প্যালেস্টাইন-ট্রান্সজর্দান হবে ব্রিটিশদের অধীন।

লোজান চুক্তি পরবর্তী মানচিত্রে উইলসনিয়ান আর্মেনিয়া ও কুর্দীস্তান অনুপস্থিত

১৯১৭ সালে সোভিয়েতরা হাঁটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছিল এ গোপন সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রের। মার্কিনরাও এটি পুরোপুরি অবগত ছিল না। শুধু রুশ ও ইতালীয়রা জানত। ১৯২১ নাগাদ নতুন পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সেই গোপন চুক্তিই প্রকারান্তরে বাস্তবায়িত হয়। ফরাসী-ব্রিটিশরা সিরিয়ার উত্তর ও ইরাকের উত্তরের মোসুলে কুর্দীদের জন্যে জায়গা ছাড়তে ছিল নারাজ। আর আতাতুর্কও তুরস্কের কুর্দী অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণে। বিশ্বযুদ্ধে অংশ না নেয়ায় ইরানের কুর্দিস্তানেরও ভাগ্য আলোচনার বিষয়বস্তু নয়। এভাবে কুর্দী আবাসভূমির স্বপ্নটা শুরুতেই ধূলিসাৎ হয়ে যায়।

ব্রিটিশ ম্যান্ডেটরি ইরাকে ব্রিটিশদের সাথে মিত্রতায় আবদ্ধ কুর্দীরা ব্রিটিশদের পয়সায় দ্রুত শক্তিবৃদ্ধি করে। কিন্তু তাদের উপজাতীয় নেতা স্বাধীনতা ঘোষণা করে একটি রাজতন্ত্রী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে ব্রিটিশরা দ্রুত সে বিদ্রোহ দমন করে।

মাহমুদ বারজানজী — “কিং ‌অফ কুর্দীস্তান”

বিশ ও ত্রিশের দশকে ম্যান্ডেটরি ও রাজতন্ত্রী ইরাক উভয় রেজিমের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ হয়। একাধিক কুর্দী বিদ্রোহ দমন করতে হয় ইরান ও তুরস্ক উভয়কেই। সিরিয়ায় অবশ্য ফরাসীরা কুর্দীদের স্বাগত জানায়, তাদের আরব সংখ্যাগুরু জনসংখ্যার বিপরীতে ব্যালান্স আনার জন্য।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত কুর্দী স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল ট্রাইবাল লয়ালটির ওপর ভিত্তি করে। জাতীয়তাবাদী আদর্শের প্রভাব শিক্ষিত মানুষের ওপর থাকলেও উপজাতীয় নেতারা নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধির জন্যই স্বাধীনতার পক্ষে বিপক্ষে অবস্থান নেয়। বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে প্রতিযোগিতাও চলে এ ব্যাপারে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে কুর্দী বিচ্ছিন্নতাবাদের চরিত্র পাল্টে যেতে শুরু করে। উপজাতীয় চরিত্রের জায়গা নিতে শুরু করে জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থী আদর্শবাদের রাজনীতি। আর তাদের স্বপ্নপূরণের পথে আরও বেশি শক্ত অবস্থান নেয় উপনিবেশপরবর্তী আরব ও তুর্কী রাষ্ট্রগুলি। পরবর্তী খন্ডে তুলে ধরব আধুনিক কালে কুর্দী স্বাধিকার সংগ্রামের খন্ডচিত্র।

ব্যালান্স অফ গ্রেট পাওয়ারস

১৯১৪ সালে সার্বিয়া নামের ছোট্ট, কিন্তু দাম্ভিক, স্লাভিক জাতীয়তাবাদী রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রটিকে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির যৌথ সাম্রাজ্য আক্রমণ করে বসে। আর তার ফলে শুরুতে ইউরোপ, পরে বিশ্বব্যাপী ইউরোপীয় কলোনিগুলি, আর শেষে নব্যপরাশক্তি জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র, জড়িয়ে পড়ে সাড়ে তিন বছর দীর্ঘ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে (১৯১৪-১৯১৮)।

ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধে ইউরোপে এথনিক-লিংগুইস্টিক জাতীয়তাবাদ ছিল বেশ জনপ্রিয়। এর ফলশ্রুতিতে ছোট-মাঝারি কয়েকটি রাজ্য নিয়ে উত্তরে ও দক্ষিণে দু’টি নতুন সাম্রাজ্যের সূচনা হয় — বিসমার্কের জার্মানি (১৮৭১) ও গারিবাল্দির ইতালি (১৮৬১)।

ডানপন্থী জাতীয়তাবাদের পাশাপাশি বামপন্থী অ্যানার্কিজ়ম, বিপ্লবী কম্যুনিজ়মও যে জনপ্রিয় হচ্ছিল বলা বাহুল্য। পুরনো সাম্রাজ্যগুলির দুর্বলতার সুযোগে তাদেরও সফল ও বিফল উত্থান ঘটে বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে (বলশেভিক বিপ্লব, ১৯১৭; সোভিয়েত হাঙ্গেরি, ১৯১৯; জার্মানির স্পার্টাসিস্ট বিদ্রোহ, ১৯১৯)। আর জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে মুলত অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি ও রাশিয়া ভেঙ্গে নতুন কয়েকটি দেশ ইউরোপের মানচিত্রে স্থান পায় (চেকোস্লোভাকিয়া, ইউগোস্লাভিয়া, পোল্যান্ড, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া)।

ঊনবিংশ শতকে ইউরোপের রাজপরিবারগুলি নাপোলেওনের সময়কার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ (১৮০৩-১৮১৫) এড়ানোর জন্যে একে অন্যের সাথে সামরিক সমঝোতা চুক্তি করা শুরু করে। নানা চুক্তির জালের বুনটে সংরক্ষিত হয় ছোট রাজ্যগুলির নিরাপত্তা, স্ফেয়ার অফ ইনফ্লুয়েন্স, ইত্যাদি। তার ওপর রাজপরিবারগুলি একে অন্যের সাথে আত্মীয়তার বন্ধনে জড়িয়ে আরেক লেভেলের ‘নিরাপত্তা’ তৈরি করে। যেমন, রুশ ৎসার নিকোলাস ছিলেন ব্রিটিশরাজ পঞ্চম জর্জের আপন খালাত ভাই, তাঁদের ছবি দেখলে তাঁদের আলাদা করে চেনার উপায় নেই। এধরনের ভূরাজনৈতিক ব্যবস্থা পরিচিত ছিল ‘ব্যালান্স অফ গ্রেট পাওয়ারস’ বলে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থামানো তো দূরের কথা, এ ব্যবস্থা একদিক থেকে দায়ী ছিল যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরির জন্যে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মূল কারণ অনেক গভীর, একটি কারণ জার্মানির উচ্চাকাংক্ষা। উডরো উইলসনের ভাষায় “ব্রিটেন হ্যাজ় দ্য আর্থ, এন্ড জার্মানি ওয়ান্টস ইট।” এটুকু কথার পিছনে অনেক লম্বা ইতিহাস রয়েছে। শিল্পায়ন যুগের শেষভাগে কাঁচামাল আর বাজারের জন্যে প্রতিযোগিতা, বাণিজ্যিক ও সামরিক সাম্রাজ্য গড়ার প্রচেষ্টা, ইত্যাদি। সে চিত্রে জার্মানি ছিল লেইটকামার। শেষে এসেও যুদ্ধবিগ্রহের সুযোগ নিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়ে নেয়া ছিল জার্মান শাসকগোষ্ঠীর মূল লক্ষ্য। এধরনের “রেয়ালপলিটিক” (“বাস্তবতাভিত্তিক কূটনীতি”) জার্মানির রূপকার বিসমার্কেরই সিগনেচার কৌশল। এর সফলতার কারণেই প্রুশিয়া নামক সামরিক রাষ্ট্র থেকে জার্মান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ হয় (১৮৭১-১৯১৯)।

অর্থাৎ বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকেই তার যথেষ্ট বারুদ তৈরি ছিল।

আর সে বারুদে যে স্ফূলিঙ্গটি বিস্ফোরণ সৃষ্টি করে, তা হলো বসনিয়ায় সার্ব আততায়ীর হাতে ডাকটিকেটে দেখানো অস্ট্রীয় যুবরাজ আর্চডিউক ফ্রানৎস ফেরডিনন্ড ও তাঁর স্ত্রী সোফিয়ার মৃত্যু (জুন ২৪, ১৯১৪)।

১৯১৭ সালে বসনিয়ায় অস্ট্রীয় সামরিকবাহিনীর ব্যবহারের জন্য প্রকাশিত এই ডাকটিকেটে স্মরণ করা হয়েছে ১৯১৪ সালে সার্ব আততায়ীর হাতে নিহত আর্চডিউক ফ্রানৎস ফেরডিনন্ড ও তাঁর স্ত্রী সোফিয়াকে — ব্যক্তিগত সংগ্রহ

ফ্রানৎস ফেরডিনন্ডের যুবরাজ হবার কথা ছিল না। অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির রক্ষণশীল সম্রাট ফ্রানৎস ইয়োসেফের একমাত্র পুত্র রুডল্ফ ত্রিশ বছর বয়সে পরকীয়া প্রেমের সূত্র ধরে প্রেমিকার সাথে আত্মহত্যা করেন ১৮৮৯ সালে। সেসময় নাকি তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন। ফলশ্রুতিতে, ফ্রানৎস ইয়োসেফের ছোট ভাই কার্ল লুডভ়িগ হন সিংহাসনের উত্তরাধিকারী। ১৮৯৬ সালে তাঁরও মৃত্যু হয় — প্যালেস্টাইনের ‘পবিত্র’ জর্দান নদীর নোংরা পানি খেয়ে টাইফয়েডে ভুগে। তখন তাঁরই ছেলে ফ্রানৎস ফেরডিনন্ডের ওপর যুবরাজ হবার গুরুদায়িত্ব বর্তায়।

ফ্রানৎস ফেরডিনন্ড সেকারণে অনেক দেরিতে রাজশাসনের উপযোগী শিক্ষালাভ শুরু করেন। বৃদ্ধ সম্রাট ফ্রানৎস ইয়োসেফের সাথেও ঝগড়াঝাঁটি লেগে থাকত। ‘বুড়ো ভামকে’ অতিরিক্ত রক্ষণশীল ভাবতেন তিনি। বিয়েও করেন রাজপরিবারের ঐতিহ্যের বাইরে। তাতে সম্রাট সায় দেন শুধুমাত্র একটি শর্তে, যে বিয়েটি হবে ‘মর্গানিটিক’। অর্থাৎ রাজকার্য, উপাধি, ইত্যাদিতে সোফিয়া আর তাঁর ছেলেমেয়েদের কোন দাবি থাকবে না। ফ্রানৎস ফেরডিনন্ড মারা গেলে তাঁর বংশধরের পরিবর্তে সম্রাট হবেন ফ্রানৎস ইয়োসেফের আরেক ভাতিজা কার্ল।

শিকারপাগল ফ্রানৎস ফেরডিনন্ডের ১৮৯২-৯৩এর ভারতভ্রমণের সময়কার ছবি। — ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

জার্মানির সমস্যা ছিল তার শাসকগোষ্ঠীর জার্মান-জাতীয়তাবাদী ঔদ্ধত্য, আর অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির সমস্যা ছিল তার উল্টো। জাতিগতভাবে জার্মান, আর ধর্মে ক্যাথলিক, হাবসবুর্গ গোষ্ঠীর সম্রাটরা কয়েক শতাব্দী ধরে সার্ব, ক্রোয়েশিয়ান, স্লোভেনিয়ান, চেক, স্লোভাক, ইউক্রেনিয়ান, রোমানিয়ান, পোলিশ, ইতালিয়ান, ইত্যাদি নানা ভাষা ও জাতের প্রজাদেরকে শক্ত হাতে শাসন করে চলছিল। ১৮৪৮ সালে সে ব্যবস্থার ওপর আঘাত আসে হাঙ্গেরির মাগিয়ার জাতিগোষ্ঠীর বিপ্লবের মাধ্যমে। অস্ট্রিয়ার শাসকরা রাজি হন সাম্রাজ্যকে দু’টি সমকক্ষ রাজত্বে ভাগ করে একভাগের শাসনভার মাগিয়ারদের দিতে, অবশ্য রাজা-সম্রাট থাকবেন একই হাবসবুর্গ উত্তরসূরী।

এতে সমস্যার তেমন কোন সমাধান হয়নি। কারণ মাগিয়াররা আরো ক্ষমতাবান হয়ে অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীকে তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করা শুরু করে। অপরদিকে অস্ট্রীয় জার্মানরাও সামরিক অভিযানের মাধ্যমে প্রাক্তন তুর্কী প্রদেশ বসনিয়া-হারজেগোভিনাকে হস্তগত করে তাকে ‘প্রতিরক্ষার’ নামে (বসনিয়া-হারজেগোভিনা প্রটেক্টোরেট, ১৮৭৮)।

অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরিকে প্রদেশে ভাগ করে কিভাবে ফেডারেল পদ্ধতিতে শাসন করা সম্ভব, ১৯০৬এ তার একটা প্রস্তাবনা করেছিলেন এক রোমানিয়ান বুদ্ধিজীবী আউরেল পপভিৎস। ফরাসী ভাষার মানচিত্রে এই বৃহত্তর অস্ট্রিয়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রাদেশিক বিভাগ দেখানো হয়েছে। — ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

এসব কারণে জার্মান-মাগিয়ার বাদে বাকি সকল এথনিক জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে স্লাভরা, যারপরনাই অসন্তুষ্ট ছিল। আর দু-দু’টো বল্কান যুদ্ধে ‘ইউরোপের সিক ম্যান’ তুরস্ককে পরাজিত করে সার্বিয়া-বুলগেরিয়ার মত দেশগুলি সে এলাকার সামরিক পরাশক্তিগুলির মাঝে যথোপযুক্ত স্থান করে নেয়। সার্বিয়ার পরবর্তী লক্ষ্য হলো আরেক ‘সিকম্যান’ অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরীর ‘নিষ্পেষিত’ স্লাভিক জনগোষ্ঠীদের ‘মুক্ত’ করে উত্তরের তুতো ভাই রুশদের মত দক্ষিণেও সর্ব-স্লাভিক দেশ ‘ইউগোস্লাভিয়া’ কায়েম করা। সে লক্ষ্যে বসনিয়ার সার্ব স্বাধীনতাসংগ্রামীদের (বা সন্ত্রাসবাদীদের) গোপনে রসদ সরবরাহ করে সার্বিয়া। সংগঠিত হয় ইয়ং বসনিয়া আর ব্ল্যাক হ্যান্ডের মত গুপ্তদল।

১৯১৪ সালের ২৪শে জুন ফ্রানৎস ফেরডিনন্ড সস্ত্রীক বসনিয়ার সারায়েভো পরিদর্শনে আসেন। সকালেই তাঁর মোটর শোভাযাত্রার ওপর পরিকল্পিত গ্রেনেড হামলা করে ইয়ং বসনিয়ার এক সদস্য। সে যাত্রা বেঁচে যান অস্ট্রিয়ার যুবরাজ, শুধু পিছনের গাড়ির কয়েকজন আহত হয়। ফ্রানৎস ফেরডিনন্ড গভর্নরের প্রাসাদে পৌঁছে বেশ হম্বিতম্বি করেন, তারপর দুঃসাহস দেখিয়ে দিনের বাকি কর্মসূচীপালনের জন্যে আবার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। কিছু বিভ্রান্তির কারণে গাড়িবহর পথে বিলম্বিত হয়। ভাগ্যের ফেরে সেপথের পাশেই এক কাফেতে বসে কফি খাচ্ছিল গাভ্রিলো প্রিন্সিপ বলে ইয়ং বসনিয়ার আরেক সদস্য। সকালের বিফল সাথীর কার্যসিদ্ধি করবে কি করবে না সে নিয়ে দোনমনা করতে করতেই গাভ্রিলো কাফে থেকে বের হয়ে সাথে থাকা রিভলভার দিয়ে ক্লোজ রেঞ্জে ফ্রানৎস ফেরডিনন্ড আর সোফিয়াকে গুলি করে বসে। যথোপযুক্ত পরিচর্যা সাথে সাথে না পাওয়ায় দু’জনেই কয়েক মিনিটের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন।

এরপরে সূচনা হয় ১৯১৪এর জুলাই সংকট — অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি কঠিন শর্তের আল্টিমেটাম দেয় সার্বিয়াকে। আক্রান্ত হলে সার্বিয়াকে তাদের তুতোভাই রুশরা সাহায্য করবে, এ ভরসায় সার্বরা আল্টিমেটামকে পাশ কাটিয়ে যায়। ফলে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় দুজনের মধ্যে। রুশরা ঠিকই আসে সার্বদের সাহায্যে। জার্মানিও আরো সাম্রাজ্যের লোভে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দেয়। আর রুশদের মিত্র, ত্রিপল-অঁতঁতের অপর দুই দেশ ব্রিটেন-ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয়। তুরস্কও অক্ষশক্তির সাথে যোগ দেয় এই ভেবে যে রুশ আর স্লাভদের কাছে খোঁয়া যাওয়া আগের সাম্রাজ্য পুনরোদ্ধার হবে।

ফ্রানৎস ফেরডিনন্ডের মৃত্যুতে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলো, এ ভাগ্যের পরিহাস! কারণ, ফ্রানৎস ফেরডিনন্ড অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির সাম্রাজ্যে জার্মান-মাগিয়ারদের একাধিপত্য খর্ব করে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীকে সমাধিকার দেয়ার ব্যাপারে উদারপন্থী ছিলেন। তাতে নিজের সর্বময় ক্ষমতা অবশ্য অটুট রাখতে পিছপা ছিলেন না। বেঁচে থাকলে আর রাজসিংহাসনে বসলে হয়ত কোন না কোন উপায়ে নিজ রাজ্যের সমস্যাগুলি সমাধানের চেষ্টা করতেন।

এখানে আরেকটা তুলনা উল্লেখযোগ্য। ওসমানি তুরস্ক আর হাবসবুর্গ অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি — এ দুটি দেশের সমস্যাগুলি একই রকম ছিল। দুটোতেই সম্রাট সর্বেসর্বা — সংসদ নামেমাত্র। তাছাড়াও অস্ট্রিয়ার কাইজ়ার একই সাথে হোলি রোমান এম্পেরর — অর্থাৎ ক্যাথলিককূলের ধ্বজাধারী রক্ষক। তুরস্কের সুলতানও সেরকম নমিনাল ‘আমিরুল মুমিনীন’ — তাবৎ মুসলিমদের ঈমানের রক্ষক। দুটো দেশেই ইহুদী-খ্রীষ্টান-মুসলিম আরব-তুর্কী-আর্মানী-ফার্সী চেক-স্লোভাক-ক্রোয়েশীয়-পোলিশ ইত্যাদি নানা জাতি ও ভাষার জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। দুটোই ছিল একরকম ‘সিক ম্যান’ — অর্থাৎ সামরিক প্রযুক্তি আর অর্থনৈতিক-সামাজিক প্রগতিশীলতার বিচারে পশ্চাদপর। আর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে দুটো দেশই টুকরো টুকরো হয় যায়।

তফাত হলো, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির টুকরোগুলি দেশে পরিণত হয় তাদের জাতিস্বত্ত্বার ইচ্ছানুযায়ী। সেসব আত্মসমর্পণের চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র ও উডরো উইলসন জড়িত ছিলেন, যাঁর মূল লক্ষ্য ছিল যেন সেসব নতুন দেশে কোন না কোন ধাঁচের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়। কিছুটা সফলও হয়েছিল সে উদ্দেশ্য, চেকোস্লোভাকিয়া ভাল উদাহরণ। আবার উল্টোদিকে ইউগোস্লাভিয়ায় গণতন্ত্রের বদলে সার্বীয় রাজার ৎসারতন্ত্র কায়েম হয়।

তুরস্কের ক্ষেত্রে আত্মসমর্পণের চুক্তিতে মার্কিনদের আসন ছিল না। তুরস্কের জাতিস্বত্ত্বাগুলির নিজস্ব সিদ্ধান্তের বদলে বিজয়ী ঔপনিবেশিক শক্তি ব্রিটেন ও ফ্রান্স নিজেদের ইচ্ছেমত ম্যাপ কাটাকুটি করে ভাগ করে নেয়। যার ফলে সিরিয়া ও ইরাকের মত দুটি ‘আর্টিফিশিয়াল’ দেশের উদ্ভব ঘটে, যার প্রজাদের জাতিগত পরিচয়ের মধ্যে কোন সামঞ্জস্য ছিল না। এখানেই কিন্তু তাদের পরবর্তী দুর্ভোগের বীজের বপন। সাথে কুর্দিস্তান-সৌদি-প্যালেস্টাইন-লিবিয়া ইত্যাদিরও ভাগ্যলিখন চূড়ান্ত হয়ে যায়। (সাইকস-পিকো অ্যাগ্রিমেন্ট, ১৯১৬)।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে এত কিছু লেখার জন্যে শুরুতে বসিনি। চেয়েছিলাম আমার সংগ্রহের ঐ ডাকটিকেটটা জাহির করে ফ্রানৎস ফেরডিনন্ডের গল্প বলতে। কান টানতে মাথা চলে এল!


পুনশ্চ: চিন্তা করে দেখলাম সাইকস-পিকোকে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে নির্দোষ বলা যায় কিনা। মনে হয় যায়। কারণ, সিরিয়া-ইরাকের যেসকল সমস্যা, সেসকল সমস্যা ইউগোস্লাভ জনপদগুলিরও ছিল, আর তাদেরও কপালে একই লিখন ছিল (নব্বই দশকের একাধিক যুদ্ধ ও প্রচুর পৈশাচিকতা ও লোকক্ষয়)। ইউগোস্লাভিয়া সেসকল তুর্কী সমস্যা ইনহেরিট করেছিল, গ্রীক-আলবেনীয়দের প্রচুর পকেট ছিল তাদের রাজ্যে যাদের তেমন কোন অধিকার স্লাভরা দেয়নি। অর্থাৎ সমস্যা একই — সাইকস-পিকো ছাড়াই।

আর ইউরোপের জাতিগোষ্ঠীগুলির জাতীয়তাবাদের কারণে তাদের ইতিমধ্যে স্বদেশের মানচিত্রের ধারণা ছিল। ইরাক-সিরিয়ার আলাউয়ী, শিয়া, সুন্নি, দ্রুজ, ইয়াজিদি, তুর্কমেন, এদের জাতীয়তাবাদের তেমন কোন ধারণাই ছিল না — আরব, আর্মনী আর কুর্দ বাদ দিলে। তাদের জনপদগুলিও ছিল ছড়ানো-ছিটানো, আলাদা করে অর্থবহ ভৌগোলিক ম্যাপ আঁকা মনে হয় না সম্ভব ছিল। পরবর্তীতে যখন জনসংখ্যা বাড়তে বাড়তে একেক জনপদের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়, তখন থেকেই অধুনাযুগের টেনশনগুলির শুরু।

অর্থাৎ সেসময়ের নিরিখে হয়ত সাইকস-পিকো ছিল আরব স্বদেশভূমির একটি গ্রহণযোগ্য, কিন্তু ঔপনিবেশিক, সমাধান। আর তা না হলেও সাইকস-পিকোর সাধ্যি ছিল না এত কিছু বুঝে (বা না বুঝে) ভবিষ্যদ্দর্শনের।

(আর সাইকস-পিকোর আরেক পার্টনর ছিল রুশরা, পরবর্তী বলশেভিক সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সাইকস-পিকোর হাড়ি হাঁটে ভেঙে দেয়।)

[Sykes–Picot Agreement]


close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!