কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকা সমাচার – ২

কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকার সাথে যুক্তরাজ্যের কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন সরাসরি সম্পর্ক নেই। কম্পানিটি নিবন্ধিত যুক্তরাষ্ট্রের ডেলাওয়্যারে, আর লন্ডন, নিউ ইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে তাদের অফিস আছে। প্রধান নির্বাহী আলেকজান্ডার নিক্স এখন সাসপেন্ডেড, তিনি ‘ম্যানসিস্টার’ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। কম্পানিটির কাজ হলো ‘ড্যাটা-মাইনিং’ আর ‘বিগ ড্যাটা অ্যানালিসিস’-এর সাহায্যে কর্পোরেট আর রাজনৈতিক মক্কেলের স্বপক্ষে মানুষের চিন্তাধারা আর আচরণ পরিবর্তন করা। সোজা কথায় ‘মস্তিষ্ক-প্রক্ষালন’! কম্পানিটির যাত্রা শুরু ২০১৩ সালে, এস,সি,এল বলে আরেক কম্পানির অধীনে। এসসিএলের ব্যবসাও একই রকম, তারা অ্যানালিটিকার মূলধনের ১০% দেয়, আর বাকি ৯০% আসে রবার্ট মার্সারের থেকে।

যারা মার্সার পরিবারের নাম শুনেননি, একটু খুঁজে দেখুন! রবার্ট আর তার মেয়ে রেবেকা চরম রক্ষণশীল আর ট্রাম্প-ব্যাননের সবচে’ বড় পৃষ্ঠপোষক। মার্সার ছিলেন আইবিএমের নামকরা কৃত্রিম-বুদ্ধিমত্তা বিশেষজ্ঞ, পরে নিজে একটা স্টকে বিনিয়োগের ব্যবসা শুরু করেন, যেখানে তার আবিষ্কৃত প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে রাতারাতি বিলিওনিয়ার বনে যান। পরে ব্যাননকে ব্রাইটবার্ট নিউজ দাঁড়া করাতেও সাহায্য করেন অর্থ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে। রেবেকাই ব্যাননকে মোলাকাত করিয়ে দেন ট্রাম্পের সাথে। এখানেই শেষ নয়, ব্যানন ছিলেন অ্যানালিটিকার ভিপি, ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণার দায়ভার নেয়ার আগে। ট্রাম্পের প্রাক্তন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইকেল ফ্লিন, যিনি রুশদের সাথে দহরম মহরম করে রবার্ট ম্যুলারের কাছে ধরা খেয়ে বসে আছেন, তিনি ছিলেন এসসিএলেরও উপদেষ্টা। আটলান্টিকের ওপারে ব্রেক্সিটের সমর্থনকারী তিনজন ক্ষমতাসীন টোরি পার্টির রাজনীতিবিদেরও অ্যানালিটিকাতে ‘অর্থলগ্নি’ আছে। বুঝতেই পারছেন যে এই কম্পানি গভীর জলের তিমিমাছ!

কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকা তাদের ওয়েবসাইটে দাবি করছে যে, তাদের কাছে ২২ কোটিরও বেশি মার্কিনবাসীর প্রত্যেকের ৫ হাজার শ্রেণীর তথ্য আছে। আর সেগুলি ব্যবহার করে তারা সমমনা পাঠক-দর্শক-শ্রোতাদের গণমাধ্যম ও ইন্টারনেটে টার্গেট করতে পারে, আর কি ধরনের ইনপুটে তাদের সামগ্রিক প্রতিক্রিয়া কিরকম হবে তা আন্দাজ করতে পারে। তারা ভেঙে না বললেও ধরে নিতে পারি যে তাদের কর্মচারীদের মধ্যে ড্যাটা সায়েন্টিস্ট, মনস্তত্ত্ববিদ, ডিজিটাল ওয়েবপেজ, ছবি, ভিডিও ও অন্যান্য কন্টেন্ট সৃজনবিশারদ আছেন। এস,ই,ও জিনিসটাও খুঁজে দেখবেন, এটা হলো গুগল আর অন্যান্য সার্চ ইঞ্জিনে কিভাবে আপনার ‘প্রডাক্টটা’ (সেটা নির্বাচনপ্রার্থীও হতে পারে) আর সব প্রতিযোগীর থেকে উপরে উঠে আসবে, তার শিল্প। আরও যেটা না বললেই নয়, রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবুর্গেও পুতিনের ‘বাবুর্চির’ পরিচালিত একই রকম একটা ট্রোল ফার্ম আছে, যার তেরজন কর্মকর্তাকে রবার্ট ম্যুলার দোষীসাব্যস্ত করেছেন ২০১৬ নির্বাচনে অবৈধ হস্তক্ষেপের দায়ে।

অ্যানালিটিকা এত তথ্য পেলো কীভাবে?

এটা মনে রাখবেন যে ফেসবুক-গুগলের কাছে আপনি হয়ত সোশ্যাল সিক্যুরিটি বা ক্রেডিট কার্ড নাম্বার দেননি, কিন্তু তাদের কাছে যে অস্ত্র আছে সেটা আরো মোক্ষম, সেটা হলো আপনার অন্তরের অন্তস্তলে পৌঁছানোর চাবিকাঠি!

অ্যানালিটিকা যোগসাজশ করে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক রুশ-মলদোভান বংশোদ্ভূত লেকচারার আলেকসান্দ্র্ কোগানের সাথে। এই লোক রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষকতা করেন (উপরের ঐ একই শহরে!) আর রুশ সরকার থেকেও ‘গবেষণার’ টাকা পেয়েছেন। ২০১৪ সালে একটা ফেসবুক অ্যাপ বানান, যার নাম ThisIsYourDigitalLife। গবেষণার উসিলায় ফেসবুক তাকে অনুমতি দেয় অ্যাপটির মাধ্যমে শুধু অ্যাপের ব্যবহারকারী নয়, তাদের ফ্রেন্ডদেরও প্রোফাইল ঘাঁটানোর। মনে মনে ভাবুন, আপনি সেই অ্যাপ, অনেক ‌অপরিচিত মানুষের প্রোফাইল-ছবি-ভিডিও-নোটস দেখছেন, তারা সাদা না কালো, কোথাকার বাসিন্দা, জন্ম কবে, বয়স কত, একলা না দোকলা, কিসে কিসে লাইক দিল, স্ট্যাটাস আপডেট অনুযায়ী সে সুখী না দুখী, গেদের দুচোক্ষে দেখতে পারে কি পারে না, কোন গ্রুপে যাতায়াত, হোক্সনিউজ দেখে না চিকেন নুডুল, মাসে কয়বার কোন রেস্টুরেন্টে চেকিন করে, মাকড়সা ভয় করে নাকি আরশোলা, তারা কার বা কিসের প্রতি দুর্বল, যদি আইপি অ্যাড্রেস পান তাহলে তাদের জিপকোড, ইত্যাদি। সেগুলি দেখে আপনি নিজে যা যা আন্দাজ করবেন, এই তথ্যগুলো দিয়ে মেশিন লার্নিংয়ের সাহায্যে তার থেকে শতগুণ বেশি আর শতগুণ দ্রুত আন্দাজ করা সম্ভব। কোগানের এই অ্যাপ মানুষ নিজেদের ব্যক্তিত্ব কিরকম তা জানার জন্য ব্যবহার করে, অর্থাৎ আরো বেশি কিছু তথ্যও দিয়ে দেয়। এভাবে তিনি দু’মাসের মধ্যে ২,৬০,০০০ মানুষের তথ্য সরাসরি পান, আর তাদের ফ্রেন্ড যারা অ্যাপটা কখনো ব্যবহারও করেনি, তাদের মিলিয়ে সে সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি! এর সাথে তুলনা করুন মার্কিনে ফেসবুক ব্যবহারকারী প্রায় ২৫ কোটি। ফেসবুককে কেউ হ্যাক করেনি, আমরাই ফেসবুককে এসব তথ্য দিয়েছি, আর তাই নিয়ে তারা ব্যবসা ফেঁদেছে, ‘গবেষণার’ খেলা খেলেছে।

শুধু ফেসবুক না, আপনি যদি গুগলও ব্যবহার করেন লগ্ডইন অবস্থায়, আপনি কি খুঁজাখুঁজি করছেন, গুগল তা জানবে, এবং পরের বার আন্দাজ করে আপনার পছন্দসই রেজাল্ট আপনাকে দেখাবে। তাছাড়া দুনিয়ার বেশিরভাগ ওয়েবসাইটে তাদের কোড বসানো আছে, অর্থাৎ আপনি সেসব সাইটে যাচ্ছেন কিনা, তার আগে-পরে আর কি খোঁজাখুঁজি করেছেন, সেসব তথ্য তারা সংগ্রহ করছে। চিন্তা করুন অ্যানালিটিকা যদি পারত সেটাও কব্জা করতে!

আর এর উপরে আছে কনজিউমার ড্যাটাসেট! আর রাজনৈতিক ‘প্যাক’! কনজিউমার ড্যাটা হলো বিভিন্ন দোকানপাটের সিস্টেমে তাদের খদ্দেরদের নাম-ঠিকানা-ফোন-ইমেলসহ অন্যান্য তথ্য, যেগুলি তারা আপনার কাছ থেকে আপনাকে জানিয়েই সংগ্রহ করে। আপনি ফাইনপ্রিন্ট না পড়েই লিস্টে নাম লিখিয়ে ফেললেন, যার বিনিময়ে হয়ত তারা আপনাকে ডিসকাউন্ট দিল। ইন্টারনেটের কারণে একাজ এখন অনেক সহজ। আর ‘প্যাক’ হলো যুক্তরাষ্ট্রের পলিটিক্যাল অ্যাকশন কমিটি, যারা কোন নির্বাচনপ্রার্থীর সমর্থক, তাদের পক্ষে প্রচারণা চালায়, জনে জনে ফোনকল করে, কলিংবেল চেপে ঘরে এসে কথা বলে। তারা সরাসরি প্রার্থীর সাথে জড়িত না হওয়ায় বিপুল পরিমাণ অর্থসংগ্রহ ও খরচ করতে পারে। এদের কাছেও আছে কোটি কোটি মানুষের তথ্য। আপনি হয়ত যেটা জানেন না বা গা করেন না, সেটা হলো এই সব স্টোর, প্যাক, এমনকি দাতব্য প্রতিষ্ঠানও, আপনারসহ আরো অনেকের খুঁটিনাটি জানে এবং এগুলির কেনাবেচা করে। যেকোন মার্কেটিং-অ্যাডভার্টাইজিং কর্মকর্তা বুঝবেন যে এ এক সোনার খনি!

কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকার মত সংস্থার ড্যাটা সায়েন্টিস্টের পক্ষে খুবই সম্ভব এসব সাধারণ তথ্য সংগ্রহ করে ফেসবুক থেকে পাওয়া অসাধারণ তথ্যের সাথে লাইন ধরে মেলানো। অর্থাৎ তারা জানে আপনার জটিল কোন রোগ আছে কিনা, সর্পতৈলের প্রতি দুর্বলতা আছে কিনা, আর আপনার সাথে যোগাযোগের উপায়। বাকি থাকলো মান্নান মিয়াকে গিয়ে ধরে তার পয়সা উসুল করা।

বলা বাহুল্য, এসকল তথ্য আপনি স্বেচ্ছাতেই কাউকে না কাউকে দিয়েছেন। ইউরোপে না হলেও, যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী বৈধভাবেই এসব তথ্য কেনাবেচা সম্ভব। এই কারণেই প্রতি সপ্তাহে আপনি ভুড়ি-ভুড়ি জাংক চিঠি ও ইমেল ডাস্টবিনে ফেলেন আর অনাহূত ফোনকল-টেক্স্ট পেয়ে বিরক্ত হন!

কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকা সমাচার – ১

ধরুন আপনি জেমসের গানের মান্নান মিয়া, আপনার তিতাস মলমের বিজনেস। আপনি নিজেও লিস্ট করে বলতে পারেন না, আপনার স্বপ্নে পাওয়া মলমের কত হাজার রোগ সারানোর গুণ। কিন্তু আপনার বিক্রি-বাট্টা কোন ভাবেই বাড়ছে না, অথচ বউকে প্রমিজ করে বসে আছেন যে নেক্স্ট মডেলের টেসলাটা আপনি আগামী মাসে কিনে দিচ্ছেন। কিভাবে করবেন এই অসাধ্যসাধন? চিন্তার কিছু নেই, আছে ফেসবুক! টার্গেটেড অ্যাড দাঁড়া করিয়ে দেন, দুনিয়ার যত উজবুক যারা দোয়াপড়া-ছ্যাপফেলা পানি খাওয়া থেকে শুরু করে সাপের তেল মালিশ করেছে (সাথে সাথে সেগুলির গুণকীর্তন করে ফেসবুকে পোস্টাইছে নয়তো লাইকাইছে), সবগুলোকে একসাথে পেয়ে যাবেন ফেসবুকে। বিশ্বাস করুন, দুনিয়াতে উজবুকের সংখ্যাই বেশি, যে জাত-ধর্মেরই হোক না কেন। অতএব, ফেসবুককে দিলেন অ্যাডের পয়সা, আর সাথে ক’টা একটু চাল্লু উজবুককে দুটো পয়সা দিয়ে বললেন একটা করে লাইক ফেলার জন্য (নইলে আল্লার গজব পড়বে!), আর চটকদার পজিটিভ কমেন্টের জন্য চার পয়সা, হাজার ফ্রেন্ডওলা প্রোফাইল থেকে শেয়ার হলে দশ পয়সা। যদি আপনার মলমের শিশিটা দেখতে জব্বর হয় (অনন্ত জলিলের ছবিওলা লেবেল লাগিয়ে), আর দুয়েকটা ‘ফেকবুক ডাক্তারের’ ভাল ‘প্লাগ’ পান, তাহলে টেসলা না হলেও একটা টাটা মহীন্দ্র তো হয়েই যাবে!

আর যদি আপনি ডোনাল্ড ট্রাম্প হন, অথবা কোন আফ্রিকান ‘প্রিন্স’, আর আপনি চান একটা দেশের প্রেসিডেন্ট হতে, তাহলে আপনার দরকার কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকার ইস্পেশাল নির্বাচনী প্যাকেজ! একটা ছোট উদাহরণের পরে করছি অ্যানালিটিকার অ্যানালিসিস।

বছর দশেক আগে আমি দু-তিনজন অ্যামেচারকে জানতাম, যারা এক সপ্তাহের মধ্যে ফেসবুকের দু-একটা গ্রুপের সদস্যদের শুধু নাম-পরিচয় না, তাদের রাজনৈতিক চিন্তাধারা-মতামত কোন ধরনের, এসব তথ্যসংগ্রহের উপায় বের করেছিল। শুধু তাই না, কমপক্ষে পাঁচশ সদস্যের এসব তথ্য তাদের অজান্তে সংগ্রহও করেছিল। কয়েকটা ফেক প্রোফাইল আর ফেক ওয়েবসাইট বানিয়ে তারা পরের স্তরে কিছুদূর গিয়েছিল, সেটা হলো ঐ তথ্য কাজে লাগিয়ে গ্রুপের সদস্যদের চিন্তাধারাকে নির্দিষ্ট পথে পরিচালিত করা। এই কাজ বেশ কঠিন, কিন্তু পুরোপুরি অসম্ভব নয়। হাতে অঢেল সময় থাকলে, একজন ভাল বিহেভিয়োরাল সাইকোলজিস্টকে দলে পেলে আর ফেসবুক অ্যাডে ঢালার মত যথেষ্ট পয়সা থাকলে সেটাও এই একহাতে গোনা অ্যামেচাররা পারতো বলে আমার বিশ্বাস। আর ফেসবুকও এটা সহজে ধরতেই পারতো না। যাই হোক, নানাকারণে সেই অ্যামেচাররা বেশিদূর না এগিয়ে কেটে পড়ে।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!