রাষ্ট্রবিহীন জাতি

আগের পোস্টে বলছিলাম রাষ্ট্রবিহীন এক বিপুল জনসংখ্যার জাতির কথা। কুর্দীরা সে জাতি। বর্তমান তুরস্কের জনসংখ্যার বিশ শতাংশ কুর্দী, ইরাকের বিশ শতাংশ, সিরিয়ার দশ, আর ইরানের দশ। সব মিলিয়ে তিন থেকে সাড়ে চার কোটির মত। সঠিক সংখ্যাটা বলা খুবই মুশকিল কারণ তারা যেসব রাষ্ট্রের বাসিন্দা সেসবের জাতীয়তাবাদী নীতির কারণে অনেকে তাদের মূল পরিচয় হারিয়ে ফেলেছে, নয়ত খোলাখুলি প্রকাশ করে না। আর সরকারি গণশুমারিতে কুর্দীদের জাতিগত অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় না।

মধ্যপ্রাচ্যের কুর্দীঅধ্যুষিত এলাকার মানচিত্র

কুর্দীদের আবাসস্থল ঐ চারটি দেশের সীমানায় একটি পাহাড়ী অঞ্চলে, যার নাম জাগ্রোস মাউন্টেনস। কুর্দী প্রবাদে, পাহাড় ছাড়া তাদের কোন বন্ধু নেই। পাহাড় তাদের পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ। হয়ত পাহাড়ের দুর্গমতার কারণেই কুর্দীদের বৈচিত্রপূর্ণ ভাষাগত বিবর্তন ঘটে। সোরানি, কুরমাঞ্জি আর খওয়ারিন বলে কুর্দির অন্তত তিনটি উপভাষা। কিন্তু এদের মধ্যে মুচুয়াল ইন্টেলিজিবিলিটি বেশি নয়। ফার্সীর সাথেও নেই, যদিও কুর্দী ফার্সীর মতই ইন্দোইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত। তুরস্ক ও সিরিয়ায় কুর্দী লিখিত হয় লাতিন হরফে, ইরাক-ইরানে ফার্সী-আরবী হরফে। আজকের কুর্দী জনসংখ্যার মধ্যে ভাষার মত ধর্মের বৈচিত্রও লক্ষণীয়। শিয়া-সুন্নী ইসলামের পাশাপাশি খ্রীষ্টান, ইহুদী, জোরোয়াস্ট্রিয়ান আর আলাউয়ী, ইয়াজিদী, ইয়ারসানী প্রভৃতি সুফী ও সুফীপ্রভাবিত ধর্মবিশ্বাস কুর্দীরা অনুসরণ করে।

ইরাকী কুর্দিস্তান রোডসাইন, তিন ভাষায়
সিরিয়ার ডি ফ্যাক্টো স্বায়ত্ত্বশাসিত রোজাভা এলাকায় লাতিন হরফে কুর্দী সিনিয়েজ

অনেকের হয়ত জানা আছে, একাদশ শতকে লেভ্যান্ট ও জেরুজালেম থেকে ক্রুসেডারদের বিতাড়িত করতে সক্ষম হন যে মুসলিম সেনাপতি, সে সালাহ-আল-দ্বীনও জাতিগত কুর্দী। আইয়ুবী রাজপরিবারের সূচনা করেন তিনি। ক্রুসেডারদের বিতাড়িত করাটা ছিল সোজা কাজ, কিন্তু তাদের দূরে রাখাটা ছিল অপেক্ষাকৃত জটিল কাজ। পূর্ববতী শিয়া ফাতিমী শাসকদের রিলিজিয়াস ইনটলারেন্স পলিসি আইয়ুবীরা পরিত্যাগ করে। ক্রুসেডারদের সাথেও খ্রীষ্টানদের অধিকার নিয়ে একটা সমঝোতায় আসা হয়। জেরুজালেমে পুনরায় ইহুদীদের বসবাসের অধিকার দেয়া হয়। আইয়ুবী শাসনামলে পরে বেশ কিছু ক্রুসেড হলেও সেগুলি নানা কারণে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। শিল্প ও বিজ্ঞানেও ইসলামী জগতে একটা পুনরুজ্জীবন আসে আ‌ইয়ুবী শাসনামলে।

সালাউদ্দিনের চিত্রসম্বলিত আইয়ুবী মুদ্রা

প্রাক-আধুনিক যুগে অবশ্য কুর্দীরা দুটি বড় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে, যদিও নানা সময়ে তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামও চলে। একটি ‌অটোমান সাম্রাজ্য, অন্যটি ইরানের সাফাভী সাম্রাজ্য। সেটা ষোড়শ-সপ্তদশ শতকের কথা। ধর্মীয়ভাবে সুন্নী হওয়ায় অটোমানরা শিয়া সাফাভীদের দুর্বল করার জন্য নানাভাবে কুর্দীদের ব্যবহার করে। সেভাবে সাফাভী ইরানের পশ্চিমের একটা বড় এলাকা কব্জা করতে সক্ষম হয় অটোমান তুরস্ক। কয়েক বছর পর পর বিভিন্ন কুর্দী বিদ্রোহেরও সম্মুখীন হয় সাফাভীরা। তবে সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় তারা। জোরপূর্বক শিয়া মতবাদ চাপিয়ে দেয়া হয় দেশের ‌অন্যান্য জাতির মত।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগ দিয়ে বিশ্বের ‌অন্যান্য ‌অনেক জাতির মত শিক্ষিত কুর্দীরাও জাতীয়তাবাদী আদর্শের দিকে ঝুঁকে পড়ে। তবে তাদের জনসংখ্যার একটা বিপুল অংশ তখনও ট্রাইবাল লয়ালটির অনুসারী। সে কারণে দুয়েকটি জাতীয়তাবাদী কুর্দী বিদ্রোহ হলেও সেগুলি ছিল স্বল্প কিছু উপজাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ। তবে বিশ্বযুদ্ধের সময়ে দুটি বড় বিদ্রোহে গোপন সমর্থন দেয় তুর্কীদের শত্রু রুশরা। সেগুলির মূল কারণ ছিল যুদ্ধের জন্যে করবৃদ্ধি ও কনস্ক্রিপশন।

তবে কুর্দীদের একটা বড় অংশের মূল সমর্থন ছিল তুর্কী অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতি। মূলত সুন্নী ধর্মবিশ্বাসের কারণে। আর তাছাড়া তুরস্কে ১৯০৮এর ক্যু পরবর্তী সংস্কারের কারণে কুর্দী উপজাতীয় নেতাদের ছিল ভাল সম্মানজনক অবস্থান।

‌আরব ছাড়াও অটোমান তুরস্কে কুর্দী এবং আর্মেনীরা ছিল আরো দুটি বড় জাতি। এদের মধ্যে রুশদের সাহায্য করার অভিযোগে ১৯১৫তে অটোমানরা আরমেনীদের ওপর গণহত্যা চালায়। কুর্দী সৈন্যদের এ কাজে ব্যবহার করে অটোমান তুর্কীরা। প্রচুর তুর্কী-কুর্দী নাগরিক এ সংঘাতে প্রাণ হারায়।

অটোমানদের পরাজয়ের পর উইলসনের জাতিগত ভাগ্য স্বনির্ধারণ তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে আরবদের জন্যে আলাদা আবাসভূমি প্রস্তাবিত হয়। আরব ট্রাইবাল নেতারা প্যারিসে আলোচনায় অংশ নেয়।

প্যারিস শান্তি সম্মেলনে আরব প্রতিনিধি ভবিষ্যৎ জর্দানী রাজা ফয়সাল, সৌদী নন, হাশেমী

যুদ্ধ শেষে ১৯১৯এ স্যাভর্ চুক্তির আলোচনায় কুর্দী-আরমেনীদের প্রতিনিধিরাও অংশ নেয়। ১৯১৭তে রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবের ডামাডোলে একটি স্বাধীন আর্মেনিয়া রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে ইতিমধ্যে। পূর্ব তুরস্কবাসী আর্মেনিয়ানদের তার সাথে যুক্ত করে নতুন একটি বৃহত্তর আরমেনিয়ার পরিকল্পনা দেন উইলসন।

প্যারিস শান্তি আলোচনার ‌অংশ হিসাবে ১৯১৯এ যুক্তরাষ্ট্র থেকে দুই সেনেটর কিং এবং ক্রেন সিরিয়া-ইরাকে আসেন জাতিগত অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে। ১৯২২এ প্রকাশিত তাদের রিপোর্টে আশা প্রকাশ করা হয় যে, একসময় এ এলাকায় বহুজাতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সার্বভৌম রাষ্ট্র স্থাপন সম্ভব। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে তাদের স্বাধীনতা দেয়া হবে ভুল। মূল কারণ জাতিগত ও উপজাতীয় দ্বন্দ্ব, আর আধুনিক শিক্ষা ও সাক্ষরতার অভাব। ফিলিস্তিনে ইহুদী আবাসভূমি পুনর্স্থাপনের ব্যাপরটাও তারা সমর্থন করেননি। কারণ সেখানে ইতিমধ্যে অইহুদী একাধিক জাতি রয়েছে যাদের ডিসএনফ্রাঞ্চাইজ করা সম্ভব নয়। সামরিক জোর ব্যতিরেকে সে কাজ অসম্ভব। তবে কুর্দিস্তানের ব্যাপারে কিং-ক্রেন আলাদা আবাসভূমির পক্ষে মত দেন।

উইলসনিয়ান আরমেনিয়া
কিং ক্রেন কমিশনের রিপোর্ট

কিং-ক্রেন বা উইলসন যাই বলুন বা ভাবুন না কেন, ইতিহাসের চাকা ঘোরে নিজের ইচ্ছেমত। কুর্দী-আরমেনীদের জাতিগত ভাগ্য স্বনির্ধারণের আগেই দুটো ব্যাপার ঘটে যায়। উইলসন পরাজিত হন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে, যুক্তরাষ্ট্র সকল আন্তর্জাতিক এনগেজমেন্ট থেকে গুঁটিয়ে আইসোলেশনিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত হয়। লীগ অফ নেশনসে যোগদান দূরের কথা, ‌অটোমান সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের আলোচনা থেকেও সরে আসে।

আর দ্বিতীয় ঘটনাটা হল, তুরস্কে তুর্কী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে স্বাধীনতা যুদ্ধ। এই নতুন তুর্কী পুনরজ্জীবনের জোয়ারে পশ্চিম উপকূল থেকে গ্রীক দখলদার সেনাবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। আর পূর্বে কুর্দী-আর্মেনী এলাকাও আতাতুর্কের তুর্কী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ততদিনে খোদ রাশিয়া এবং রুশ আর্মেনিয়াতেও বলশেভিকরা ক্ষমতা পুনর্দখল করতে সমর্থ হয়েছে। তারা তুরস্কের সাথে পৃথক শান্তি আলোচনার মাধ্যমে ককেশাসের জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, আজারবাইজানের সীমানা নির্ধারণ করে নেয়। বলা বাহুল্য এর ফলে আরমেনীদের যুক্তিসংগত দাবিটিও মাটিচাপা পড়ে যায় আর তুরস্কের আরমেনিয়ান অধ্যুষিত এলাকাটি তুরস্কের অধীনস্থই রয়ে যায়।

এই নতুন পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে স্যাভরে অটোমানদের সাথে সইকৃত চুক্তিটি রদ করতে বাধ্য হয় মিত্রশক্তি। নতুন করে লোজান চুক্তি হয়। যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতিতে ফ্রান্স-ব্রিটেন ফিরে যায় তাদের পুরনো সাম্রাজ্যবাদী চেহারায়। যুদ্ধ চলাকালীন সময়েই ১৯১৫তে একটা গোপন চুক্তি করেছিল তারা। সে চুক্তি অনুযায়ী সিরিয়া-ইরাকের মাঝ বরাবর একটা সোজা লাইন টেনে সীমানা নির্ধারিত হয়। তার একপাশে সিরিয়া-লেবানন থাকবে ফরাসী অধিকৃত। মেসোপটেমিয়া-প্যালেস্টাইন-ট্রান্সজর্দান হবে ব্রিটিশদের অধীন।

লোজান চুক্তি পরবর্তী মানচিত্রে উইলসনিয়ান আর্মেনিয়া ও কুর্দীস্তান অনুপস্থিত

১৯১৭ সালে সোভিয়েতরা হাঁটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছিল এ গোপন সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রের। মার্কিনরাও এটি পুরোপুরি অবগত ছিল না। শুধু রুশ ও ইতালীয়রা জানত। ১৯২১ নাগাদ নতুন পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সেই গোপন চুক্তিই প্রকারান্তরে বাস্তবায়িত হয়। ফরাসী-ব্রিটিশরা সিরিয়ার উত্তর ও ইরাকের উত্তরের মোসুলে কুর্দীদের জন্যে জায়গা ছাড়তে ছিল নারাজ। আর আতাতুর্কও তুরস্কের কুর্দী অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণে। বিশ্বযুদ্ধে অংশ না নেয়ায় ইরানের কুর্দিস্তানেরও ভাগ্য আলোচনার বিষয়বস্তু নয়। এভাবে কুর্দী আবাসভূমির স্বপ্নটা শুরুতেই ধূলিসাৎ হয়ে যায়।

ব্রিটিশ ম্যান্ডেটরি ইরাকে ব্রিটিশদের সাথে মিত্রতায় আবদ্ধ কুর্দীরা ব্রিটিশদের পয়সায় দ্রুত শক্তিবৃদ্ধি করে। কিন্তু তাদের উপজাতীয় নেতা স্বাধীনতা ঘোষণা করে একটি রাজতন্ত্রী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে ব্রিটিশরা দ্রুত সে বিদ্রোহ দমন করে।

মাহমুদ বারজানজী — “কিং ‌অফ কুর্দীস্তান”

বিশ ও ত্রিশের দশকে ম্যান্ডেটরি ও রাজতন্ত্রী ইরাক উভয় রেজিমের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ হয়। একাধিক কুর্দী বিদ্রোহ দমন করতে হয় ইরান ও তুরস্ক উভয়কেই। সিরিয়ায় অবশ্য ফরাসীরা কুর্দীদের স্বাগত জানায়, তাদের আরব সংখ্যাগুরু জনসংখ্যার বিপরীতে ব্যালান্স আনার জন্য।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত কুর্দী স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল ট্রাইবাল লয়ালটির ওপর ভিত্তি করে। জাতীয়তাবাদী আদর্শের প্রভাব শিক্ষিত মানুষের ওপর থাকলেও উপজাতীয় নেতারা নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধির জন্যই স্বাধীনতার পক্ষে বিপক্ষে অবস্থান নেয়। বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে প্রতিযোগিতাও চলে এ ব্যাপারে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে কুর্দী বিচ্ছিন্নতাবাদের চরিত্র পাল্টে যেতে শুরু করে। উপজাতীয় চরিত্রের জায়গা নিতে শুরু করে জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থী আদর্শবাদের রাজনীতি। আর তাদের স্বপ্নপূরণের পথে আরও বেশি শক্ত অবস্থান নেয় উপনিবেশপরবর্তী আরব ও তুর্কী রাষ্ট্রগুলি। পরবর্তী খন্ডে তুলে ধরব আধুনিক কালে কুর্দী স্বাধিকার সংগ্রামের খন্ডচিত্র।

লেগিওন ফ্রাইয়েস ইন্ডিয়েন

আজকে আজাদ হিন্দ ফৌজ সম্পর্কে যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লিখবো, সেটা সকলের মনঃপূত না হতে পারে। আমরা ছোটবেলা থেকে নেতাজি সুভাষ বসুকে ভারত-বাংলার স্বাধীনতাসংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা হিসাবে দেখে এসেছি। ব্যক্তিগতভাবে আমি জাতিগত, ধর্মীয় কোন জাতীয়তাবাদকে সুদৃষ্টিতে দেখি না। সে আমলের বৈশ্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয়তাবাদ হয়ত গ্রহণযোগ্য ছিল, কিন্তু আজাদ হিন্দ ফৌজের উৎপত্তি ও যুদ্ধকালীন কার্যক্রম অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। জাতীয়তাবাদের ও জাতীয় নেতাদের পূজো যারা করতে ভালবাসেন, তারা দয়া করে খোলা মন নিয়ে পড়ুন। নয়ত নাই পড়ুন।

আমার সংগ্রহের কয়েকটি ডাকটিকেট দিয়ে শুরু করি। প্রথম জোড়াটি ১৯৪২ সালের ক্রোয়েশিয়ার। বিভিন্ন স্লাভিক জাতির সমন্বয়ে গঠিত রাষ্ট্র ইউগোস্লাভিয়া দখলের পর নাৎসি বাহিনী ক্রোয়েশিয়া রাষ্ট্রকে ‘মু্ক্ত’ করে। সেদেশের সরকার গঠিত হয় উশতাসে নামক উগ্র জাতীয়তাবাদী একটি ক্রোয়েশীয় রাজনৈতিক দলের দ্বারা। তারা নাৎসিদের থেকেও অধিক জাতিগত হত্যা সংঘটন করে। উশতাসে সরকার নামে ‘স্বাধীন’ হলেও আদতে জার্মান তাঁবেদার ছিল।

নাৎসি তাঁবেদার রাষ্ট্র ক্রোয়েশিয়ার ডাকটিকেট, ১৯৪১-৪৩ সাল

সেরকম চেকোস্লোভাকিয়া রাষ্ট্রটিকেও জার্মানরা ত্রিখন্ডিত করে। সুডেটেনল্যান্ড খাস জার্মানির অন্তর্ভুক্ত হয়। বর্তমান চেকিয়ার বাকি অংশ হয় বোহেমিয়া-মোরাভিয়া নামক জার্মান প্রটেক্টরেট। আর স্লোভাকিয়া হয় ক্রোয়েশিয়ার মত চেকদের শাসন থেকে ‘স্বাধীনতাপ্রাপ্ত’। হ্লিংকা পার্টির উগ্র জাতীয়তাবাদী সরকার জার্মান রাষ্ট্রের পাপেট ছিল এবং তাদের সকল যুদ্ধাপরাধী কর্মকান্ডে হাত মেলায়। দ্বিতীয় ছবিতে স্লোভাকিয়ার স্ট্যাম্প।

নাৎসি তাঁবেদার রাষ্ট্র স্লোভাকিয়ার ডাকটিকেট, ১৯৩৯

তৃতীয় ছবির ডাকটিকেটগুলি বেশ দুর্লভ আর বেশির ভাগ সংগ্রহকারীর কাছে অপরিচিত। অপারেশন বারবারোসার মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নকে চকিত আক্রমণ করে বসে জার্মানি। সেটা ১৯৪১ সাল। স্তালিনের একাধিক শুদ্ধি অভিযানের কারণে সোভিয়েত সেনাদল ছিল অপিরপক্ব অফিসারদের নেতৃত্বে পরিচালিত। এদের অনেকে জার্মানদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। হিটলারের বর্ণবাদী থিওরিতে রাশান আর বেশিরভাগ স্লাভিক মানুষ নিচুস্তরে পরিগণিত। তাই এসকল যুদ্ধবন্দীদের বেশ অত্যাচার সহ্য করতে হয়। প্রায় অর্ধেকের মত যুদ্ধবন্দী ক্যাম্পে মৃত্যুমুখে পতিত হয়।

কিন্তু ‘৪২এ স্তালিনগ্রাদে হারার পর হিটলারের সভাসদরা তাঁকে রাজি করান যে এসকল যুদ্ধবন্দীদের নিয়ে একটি ‘লিবারেশন আর্মি’ বানালে সোভিয়েতবিরোধী প্রপাগান্ডায় কাজে দেবে। সোভিয়েত ইউনিয়নে সাধারণ রাশিয়ান মানুষ স্তালিনের ভয়ে প্রকম্পিত হত, যেমনটা হত সেদেশের জাতিগত সংখ্যালঘুরা।

জেনারেল ভ্লাসভ নামে এক রাশান অফিসার জার্মানদের সাথে আঁতাত করে ঠিক করেন যে, যুদ্ধবন্দীদের একাংশ নিয়ে একটি ‘মুক্তিবাহিনী’ গঠিত হবে, যারা রাশিয়া ও সোভিয়েত অধিকৃত অঞ্চল থেকে কমুনিস্ট শাসন উচ্ছেদের জন্যে জার্মানদের সহায়তা করবে। ডাকটিকেট দুটি এই ভ্লাসভ আর্মির ইস্যুকৃত।

রাশিয়ান “রাজাকার” ভ্লাসভ আর্মির ডাকটিকেট, ১৯৪৪

পরের তিনটি ছবিতে দেখিয়েছি নাৎসি জার্মানির ডাকটিকেটের গতানুগতিক বিষয়বস্তু, ডিজাইন ইত্যাদি। আর শেষ ডাকটিকেটগুলো ‘আজাদ হিন্দের’। ডাকটিকেটগুলির বিষয়বস্তু, ডিজাইন ও প্রিন্টিং একটু ভাল করে দেখুন।

নাৎসি জার্মানির ডাকটিকেট, ১৯৪৪
নাৎসি জার্মানির ডাকটিকেট, ১৯৪৫ ও ১৯৪১। ডানের টিকেটটির ডিজাইনার আক্সটার-হয়টলাস আজাদ হিন্দের ডাকটিকেটের নকশা করেন।
নাৎসি জার্মানির ডাকটিকেট, ১৯৪৪ ও ১৯৪৩। নিচের টিকেটটির ডিজাইনার আক্সটার-হয়টলাস আজাদ হিন্দের ডাকটিকেটের নকশা করেন।
আজাদ হিন্দের ডাকটিকেট, ১৯৪৩। জার্মানিতে নকশা করা। নাৎসি জার্মানির রাষ্ট্রীয় ছাপাখানায় মুদ্রিত।

এতগুলি ডাকটিকেট দেখানোর মূল লক্ষ্য এটা বোঝানো যে, জার্মান তাঁবেদার রাষ্ট্রগুলির সরকার থেকে শুরু করে এমনকি ডাকটিকেট ডিজাইন ও প্রিন্টিং পর্যন্ত ছিল নাৎসি আনুকূল্যের ওপর নির্ভরশীল। আমার দেখানো স্ট্যাম্পগুলির সকলের ডিজাইন ও বিষয়বস্তু প্রায় এক।

আজাদ হিন্দের ডাকটিকেটগুলি তার ব্যতিক্রম নয়। জার্মানির যে ডাকটিকেটগুলি দেখিয়েছি তার ডিজাইনার স্বামী-স্ত্রীযুগল আক্সটার-হয়টলাস। আবার এরাই আজাদ হিন্দের ডাকটিকেটেরও ডিজাইনার! আর এ টিকিটগুলো ছাঁপা হয়েছিল জার্মানির সরকারি প্রিন্টিং হাউজ রাইখসড্রুকারিতে। অর্থাৎ তাঁবেদার অন্যান্য সরকারগুলির থেকে এই ‘আজাদ হিন্দ’ খুব একটা আলাদা ছিল না।

পরে এ ডাকটিকেটের বিশাল পরিমাণ সুভাষ বসু ও তার অনুগত অফিসাররা নিয়ে যান জাপানে ও বার্মায়।

আজাদ হিন্দের যাত্রা শুরু ‘আজাদ হিন্দ’ হিসাবে নয়। উত্তর আফ্রিকায় তবরুক আর আল-আলামিনে ১৯৪০-৪১এর যুদ্ধের পর একটা বড় ব্রিটিশ সেনাদল জার্মান ও ইতালীয়দের যুদ্ধবন্দী হয়। এদের মধ্যে ছিল ব্রিটিশ ভারতের অনেক সৈন্য। প্রথমে ইতালিতে ও পরে জার্মানিতে স্থানান্তরিত হয় এরা।

ভ্লাসভ আর্মির মত ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডার অস্ত্র হিসাবে এই ভারতীয়দের ব্যবহারের বুদ্ধি আসে জার্মান ও ইতালীয়দের মাথায়। ইতালীয়রা ১৯৪২এ তিনশর মত ‘স্বেচ্ছাসেবক’ ভারতীয় সৈন্য নিয়ে গঠন করে বাতালিওনি আজাদ হিন্দুস্তান। কিন্তু যথেষ্ট কাঠখড় পুড়িয়ে প্রশিক্ষণ দেবার পরে এদের বিশ্বস্ততা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়ায় দলটিকে ভেঙে দেয়া হয়।

এখানে বলে রাখা ভাল, যুদ্ধবন্দীদের নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করাটা সাধারণত সামরিক বিবেচনায় ভাল নয়। কারণ যে মুহূর্তে তারা যুদ্ধক্ষেত্রে স্বদেশীদের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হবে, সে মুহূর্তে আবার দল পরিবর্তন করতে পারে। এরপরেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানরা বহুজাতিক ভাফেন এসএস নামে প্যারামিলিটারি বাহিনীতে ভিনদেশী স্বেচ্ছাসেবকদের জায়গা দেয়। এদের মধ্যে ছিল ডাচ, বেলজিয়ান, ডেনিশ, নরওয়েজিয়ান, ব্রতোঁ, তাতার, আর্মানী, আজারবাইজানী, জর্জিয়ান, লাটভিয়ান, এস্তোনিয়ান, ফিনিশ, প্রভৃতি জাতির সৈন্য। আরবদের নিয়ে সংগঠিত হয়েছিল লেগিওন ফ্রাইয়েস আরাবিয়েন — ফ্রী আরাবিয়ান আর্মি। সাধারণত ফ্রন্টলাইনে এদের ব্যবহার করা হত না, সিভিলিয়ান অধিকৃত এলাকাতেই বিভিন্ন কাজে লাগানো হত এদের।

মূল কথা হলো, ইন্ডিয়ান লিবারেশন আর্মির শুরুটা সুভাষ বসুর মাধ্যমে নয়। তাঁর সশস্ত্র সংগ্রামের লক্ষ্যের সাথে ভাগ্যক্রমে অক্ষবাহিনীর এসকল প্রপাগান্ডাধর্মী কর্মকান্ড মিলে যায়।

ইতালির মতই জার্মানরা ১৯৪১ নাগাদ উত্তর আফ্রিকা থেকে সাতাশ জন ভারতীয় যুদ্ধবন্দীকে উড়িয়ে নিয়ে আসে ফ্রী ইন্ডিয়ান আর্মির অফিসার বানানোর উদ্দেশ্যে। ধীরে ধীরে জার্মানিতে আফ্রিকা-ইউরোপ থেকে অধিকৃত প্রায় হাজার পনেরো ব্রিটিশ ভারতীয় যুদ্ধবন্দীর সমাবেশ গড়ে ওঠে। হিটলার অবশ্য এসএসপ্রধান হিমলারের ফ্রী ইন্ডিয়ান আর্মি আইডিয়াটাকে পছন্দ করেননি। তাঁর হিসাবে ভারতীয়রা অতীতে আর্য থেকে থাকলেও এখন মিশ্রিত নিচু শ্রেণীর জাত।

হিটলারকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে হিমলার ১৯৪২এর জানুয়ারি নাগাদ লেগিওন ফ্রাইয়েস ইন্ডিয়েন বলে একটা ছোটখাটো ‘স্বেচ্ছাসেবক’ সৈন্যদল গড়ে তোলেন। কিন্তু পক্ষপরিবর্তনে যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে তেমন একটা সাড়া মিলছিল না। জার্মান অধিনায়কত্বের পরিবর্তে দরকার হয়ে পড়ে বিশ্বাসযোগ্য ভারতীয় নেতৃত্ব। এখানেই নেতাজির সফল আবির্ভাব।

ব্রিটিশ ভারতীয় সিআইডির চোখে ধূলো দিয়ে নেতাজি কলকাতা থেকে দুঃসাহসিক এক যাত্রা করেন ১৯৪২এর শুরুতে। পুরো ভারত অতিক্রম করে আফগানিস্তানের সীমানা দিয়ে রাশিয়াতে ঢোকেন ছদ্মবেশে। তারপর নতুন নাম নিয়ে সোজা মস্কো। তাঁর যাত্রার ঠিকানা ছিল মস্কোই, জার্মানি নয়। তাঁর হিসাবে, স্বাধীন ভারতের জন্যে দরকার ছিল বিশ বছরের সমাজতন্ত্রী একনায়কতন্ত্র, ঠিক সোভিয়েত রাশিয়ার আদলে।

কিন্তু মস্কোতে সাড়া জাগাতে ব্যর্থ হন নেতাজি। সোভিয়েতরা তখন জার্মানদের নিয়ে ভীত। যেকোন মুহূর্তে আক্রমণ আসতে পারে। এমতাবস্থায় ব্রিটেন-আমেরিকার মত সম্ভাব্য মিত্রদের চটানোর কোন মানে হয় না। বিফলমনোরথ নেতাজিকে তারা বার্লিনমুখী ট্রেনে তুলে দেয়। কারণ জার্মানদেরই তখন প্রয়োজন ছিল সুভাষ বসুর মত কারো।

পাঠক হয়ত আঁচ করতে পারছেন, নেতাজি স্বদেশপ্রেম আর ব্রিটিশবিদ্বেষে এতটাই অন্ধ আর ‘দ্য এনেমি অফ মাই এনেমি ইজ মাই ফ্রেন্ড’ এ তত্ত্বে এতটাই মশগুল যে যুদ্ধকালীন রাজনীতির সাধারণ জ্ঞান হয় তাঁর বিলুপ্ত হয়েছে, নয়ত তিনি সজ্ঞানেই ব্রিটিশের তদকালীন শত্রু জার্মান-সোভিয়েতদের বাণিজ্যপণ্যে পরিণত হয়েছেন। যদি এ শত্রুরা সমঝোতার মাধ্যমে একটি যুদ্ধবিরতি ও শান্তিচুক্তি করে ফেলত তাহলে আজাদ হিন্দের কি হত? নানা কৌশলগত কারণেই ‘এনেমি অফ মাই এনেমি…’ এ তত্ত্বের এমন সাদাসিধা প্রয়োগ মূলত অকার্যকর।

যাহোক, এপ্রিল ‘৪২এ জার্মানিতে এসে পড়েন নেতাজি। হিটলারের সাথে দেখা করতে চেয়েও তা মেলে কয়েক মাস পর। এর মধ্যেই তাঁকে কাজে লাগিয়ে নেন হিমলার।

ফ্রী ইন্ডিয়ান লেজিওনে যোগ দেয়ার ব্যাপারে ব্রিটিশ ভারতীয় যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে সাড়া না মেলার মূল কারণ একমাত্র দেশী নেতৃত্বের অভাব নয়। এসকল সৈন্যদের অধিকাংশ বংশপরম্পরায় ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীতে সার্ভিস দিয়ে এসেছে। ব্রিটিশরাজের প্রতি ব্যক্তিগত আনুগত্যের যে শপথ তারা নিয়েছে, তা ভঙ্গ করা মিলিটারি কোড অফ অনারের পরিপন্থীও বটে। আর ভিনদেশী-অন্যভাষী জার্মানদেরই বিশ্বাস করার কি কারণ?

সুভাষ বসু একে একে প্রতিটা পিওডাব্লিউ ক্যাম্পে গিয়ে এসকল ভারতীয় সৈন্যদের স্বাধীনতার পক্ষে লড়ার জন্যে উদ্বেলিত করে তোলেন। ফ্রী ইন্ডিয়া সেন্টার বলে একটি রেডিও স্টেশনও শুরু হয়। নেতাজি ছিলেন অসাধারণ বক্তা। আর অনেক শিক্ষিত সৈন্যের কাছেও তাঁর নাম ছিল সুপরিচিত। শুধু এসকল কারণে নয়, যুদ্ধবন্দীশিবিরের করুণ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্যে আর নতুন সেনাদলে অফিসার পদবীর আশাতেও অনেকে সিদ্ধান্ত নেয় ব্রিটিশরাজের প্রতি আনুগত্যের শপথ ভাঙার। সুভাষ বসু ছিলেন তাদের এ সিদ্ধান্তের রেস্পন্সিবল পার্টি।

তবে ১৫ হাজার যুদ্ধবন্দীর মধ্যে শেষ পর্যন্ত শুরুতে কেবল তিন হাজার সৈন্য ফ্রী ইন্ডিয়ান লেজিওনে যোগ দেয়। নেতাজির আশা ছিল কমপক্ষে এক লাখ সৈন্যের একটি বাহিনী বানাবেন। তারপর জার্মানি থেকে যাত্রা করে সোভিয়েত এলাকার মধ্য দিয়ে আফগান ও ভারতের সীমানায় পৌঁছলে ভারতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জনবিদ্রোহ শুরু হয়ে যাবে। বলা বাহুল্য, এ ছিল নিতান্ত নাইভ একটি প্ল্যান।

ভারতের অবিসংবাদিত নেতা সুভাষ বসু ছিলেন না। গান্ধী-নেহরুর নেতৃত্বে কংগ্রেস ও অসহযোগিতা আন্দোলনের পক্ষে বেশ দৃঢ় জনসমর্থন ছিল। আর উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের বালুচ ও পাঠান জাত কিন্তু ব্রিটিশদের সেনাদলে বংশানুক্রমে বিশ্বস্ত সৈন্য যুগিয়ে এসেছে। তাদের মধ্যে নেতাজির নেতৃত্বে হুঁটহাঁট বিদ্রোহ শুরু হত কিনা, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। আর কিভাবে কার খরচের খাতা ভরিয়ে হাজার হাজার মাইল পেরোত এ বিশাল সেনাবহর সেটা মোটেও অবান্তর প্রশ্ন নয়। নেতাজির পরিকল্পনাগুলি ছিল বেশ জাঁকালো, কিন্তু বাস্তবতাবিবর্জিত। তার এসব পরিকল্পনায় পূর্ণ সমর্থন যোগানোটাও ছিল জার্মানদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব।

১৯৩৯এ যুদ্ধ শুরুর সাথে সাথে হোম রুলের পরওয়া না করে ব্রিটেনের পক্ষে ভারতের ব্রিটিশ রাজ জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। কষ্টার্জিত সংসদীয় ব্যবস্থা প্রায় রহিত করা হয়। এ টিকেটটির ব্যবহার ডাকপ্রেরনে হয়নি, হয়েছিল যুদ্ধের খরচ ওঠানোর বন্ডে। লাখে লাখে এ দামী টিকেটটি কেনেও অনেক ভারতবাসী, মূলত পাকিস্তানের এলাকাতে। ব্রিটিশদের প্রতি মুসলিম জনগোষ্ঠীর সমর্থন তুলনামূলক বেশি ছিল।

যা হোক অগাস্ট ‘৪২ নাগাদ মোটামুটি সাড়ে চার হাজারের একটা রেজিমেন্ট গড়ে ওঠে জার্মানিতে। তাদের ইউনিফর্ম ছিল জার্মান সেনাবাহিনীর ধাঁচে। আর ইনসিগনিয়া ছিল জাফরান-সাদা-সবুজ ট্রাইকালার স্ট্রিপের মাঝে শিকারে উদ্যত বাঘের ছবি। শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে তারা নেতাজির প্রতি নয়, হিটলারের প্রতি আনুগত্যের শপথ নেয়। শপথের কথাগুলি ছিল এমন: “I swear by God this holy oath that I will obey the leader of the German race and state, Adolf Hitler, as the commander of the German armed forces in the fight for India, whose leader is Subhas Chandra Bose.”

লেগিওন ফ্রাইয়েস ইন্ডিয়েনের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের কালার গার্ড। শিখ, মুসলিম ও হিন্দু ধর্মের সম্মিলিত। ভারতের তিনরঙা পতাকার মাঝে শিকারোদ্যত ব্যাঘ্র। ওপরে দেখানো আজাদ হিন্দের ডাকটিকেটের একটিতে এ চিত্র রয়েছে।
নাৎসি আর্মির প্রশিক্ষণে রত শিখ সৈন্য। হাতে এমজি-৩৪ অটোম্যাটিক। আজাদ হিন্দের ইন্সিগ্নিয়া দেখা যাচ্ছে ইউনিফরমে। ওপরে দেখানো একটি টিকেটে এ দৃশ্য মুদ্রিত হয়েছে।

নেতাজির অনুরোধ ছিল এ সৈন্যবাহিনী ইউরোপের যুদ্ধে ব্যবহৃত হবে না, হবে কেবল ভারতমুক্তির যুদ্ধে। এতে জার্মানরা যে খুব একটা খুশি হয়েছিল তা নয়। হিটলার নাকি আড়ালে বলেছিলেন, ফ্রি ইন্ডিয়ান আর্মি ইজ এ জোক। শুধু প্রপাগান্ডার খাতিরে বসিয়ে বসিয়ে এদের খাওয়ানো-পরানো আর প্রশিক্ষণ দেয়াটা তাঁর মনঃপূত হয়নি। তাঁকে বুঝিয়ে ঠান্ডা করেন হিমলার। শেষ পর্যন্ত সুভাষ বসুর সাথে একটি মোলাকাতেরও ব্যবস্থা করে দেন, কিন্তু হিটলার কোন প্রতিশ্রুতি সে মিটিংএ নেতাজিকে দেননি। নেতাজি এতে মনোক্ষুণ্ণ হন।

১৯৪২এ হিটলারের সাথে শেষ পর্যন্ত মোলাকাত হয় নেতাজির।

নেতাজির পছন্দের সোভিয়েতদেরকেও ততদিনে আক্রমণ করে বসেছেন হিটলার। স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধ চলছে। কিন্তু আফগান সীমানা পর্যন্ত জার্মান সেনাদের যাওয়া তো দূরের কথা, তার কৌশলগত তেমন কোন কারণও ছিল না। হিটলারের লক্ষ্য ছিল উরাল আর ককেশাস পর্যন্ত সম্পদশালী এলাকাটির দখল নেয়া। তাঁর প্ল্যানে মধ্য এশিয়া ও ইরান ছিল সুদূরের পরিকল্পনামাত্র। পারস্যের মধ্যে দিয়ে একটা রাস্তা থাকলেও তা ছিল অনেক প্রতিকূল।

বিষন্ন নেতাজির দিকে তখন অগ্রসর হয় জাপানিরা। ‘৪২ নাগাদ জাপানিদের হাতে সিঙ্গাপুর-মালয়-বার্মার ব্রিটিশ গ্যারিসনের পতন হয়েছে। তাদের হাতে হাজার চল্লিশেক ভারতীয় যুদ্ধবন্দী। এদের নিয়ে তৈরি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির নেতৃত্বে তখন জাপানপ্রবাসী রাসবিহারী বসু, কিন্তু তাদের দরকার ছিল আরো তরুণ ক্যারিসম্যাটিক নেতৃত্ব। সুভাষ বসু সে রোলপ্লে করতে রাজি হন।

ভারতের বার্মা সীমান্তে জাপানিসমর্থিত বড় সেনাদল নিয়ে স্বাধীনতাসংগ্রামের সফলতার সম্ভাব্যতা নেতাজির চোখে আরো বেশি ছিল। কিন্তু তাঁর যে আশা ভারতের সীমানায় এসে পৌঁছলেই জনবিদ্রোহের সূচনা হবে তাতে গুড়েবালি। ব্রিটিশরা যুদ্ধকালীন সংবাদের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ রেখেছিল শত্রুর প্রপাগান্ডা ছড়ানো বন্ধের জন্যে। এই সেনাদলের অস্তিত্বের কোন খবরই ভারতবাসী যুদ্ধকালীন সময়ে জানতে পারেনি। তাই সুভাষ বসুর সামরিক পন্থায় ভারতমুক্তির তেমন কোন বাস্তবতা ছিল না।

যাই হোক, ১৯৪৩এ সুভাষ বসু ফ্রী ইন্ডিয়া লেজিওনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জাপানমুখী সাবমেরিনে চড়ে বসেন। তাঁকে অনুসরণ করে কিছু সেনা অফিসার। কিন্তু অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হয় সাধারণ ভারতীয় সৈন্যরা। জার্মান এক অফিসারকে তাদের অধিনায়ক বানানো হয়, কিন্তু সৈন্যদের অভিযোগের মুখে তাকে অপসারণ করা হয়। শুধুমাত্র ভারতমুক্তির যুদ্ধে শামিল করা হবে এ কথা দেয়া সত্ত্বেও জার্মানরা রেজিমেন্টটিকে অধিকৃত নেদারল্যান্ডে আটলান্টিক ওয়াল নামক উপকূলীয় প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় স্থানান্তর করে।

ফেব্রুয়ারি ১৯৪৪এ আটলান্টিক ওয়ালে ফ্রী ইন্ডিয়ান আর্মি পরিদর্শনে ফীল্ড মার্শাল রোমেল।

এসময় ডাচ সাধারণ জনগণের কাছে বেশ জনপ্রিয় ছিল ভিনদেশী এ সৈন্যদল। ডাচ মেয়েরা পর্যন্ত ভারতীয় সৈন্যদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। কিছু ক্ষেত্রে বিবাহবন্ধনেও আবদ্ধ হয় কয়েক সৈন্য। অন্যান্য জার্মানদের মত ফ্রন্টলাইন যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়নি এই ভারতীয়রা। মোটামুটি আরামেই কাটে তাদের ১৯৪৩-৪৪। ডাচরা নিজেরাও অধিকৃত জনগোষ্ঠী হওয়ায় ব্রিটিশশাসিত পরাধীন ভারতীয়দের প্রতি তাদের যথেষ্ট সহানুভূতি ছিল। জার্মান প্রপাগান্ডার একটা ভূমিকাও ছিল এতে।

‘৪৩এর শীতের আগমনের সাথে সাথে আবার স্থানান্তর করা হয় ফ্রী ইন্ডিয়া লেজিওনকে। এবার ভাফেন এসএসের সরাসরি কমান্ডে তাদের অবস্থান হয় দক্ষিণ ফ্রান্সের আরামদায়ক উপকূলে। ‘৪৪এর জুনে ফ্রান্সের নর্মন্ডি উপকূলে যৌথবাহিনী সফলতার সাথে অবতরণ করে। শুরু হয় ফ্রান্সের স্বাধীনতাযুদ্ধ। সে সমরে না চাইলেও ভারতীয় সৈন্যরা জড়িয়ে যায়। জার্মান ডিভিশনগুলি সমানে পিছু হটতে শুরু করে। আর ফ্রন্টলাইনের পেছনে ফ্রেঞ্চ রেজিস্ট্যান্সের চোরাগোপ্তা গেরিলা হামলা বেড়ে যায়। ফ্রী ইন্ডিয়া লেজিওনের প্রথম লোকক্ষয় হয় এখানেই। ফরাসী পার্টিজানদের বিরুদ্ধে তখন কিছু যুদ্ধে শামিল হয় ভারতীয়রা।

ফ্রান্সে জার্মান সেনাবাহিনীর মিলিটারি ফাংশনে আজাদ হিন্দের শিখ অফিসারকে নাৎসি স্যালুট দিচ্ছে উপস্থিত জার্মানরা।
ভারতীয় সৈন্যদের একটি ছোট গ্রুপকে নির্দেশনা দিচ্ছে জার্মান অফিসার। ভারতীয় সৈন্যদের পরনে জার্মান সেনাবাহিনীর পোশাক, হেলমেট। ফ্রান্স, ১৯৪৪।

যে স্বাধীন ভারতের লক্ষ্যে এ সাড়ে চার হাজার সৈন্যের জার্মান সার্ভিসে যোগদান, তার থেকে এভাবে ক্রমে দূরে সরে যায় তারা। যে নেতার ব্যক্তিগত অনুরোধের কারণে বাপদাদার মিলিটারি কোড অফ অনার ভেঙে হিটলারের আনুগত্যের শপথ নিয়েছিল তারা, তাঁর কাছ থেকেও বহুদিন কোন খবর নেই। নেতৃত্বহীন, খুঁটিহীন, হতোদ্যম ভারতীয় সৈন্যদের মধ্যে নিয়মানুবর্তিতার অভাব দেখা দিতে শুরু করে। অনেকে মদ্যোপান শুরু করে। ফ্রান্সের প্রতিকূল সামরিক পরিবেশে ধর্ষণ ও শিশুহত্যার মত যুদ্ধাপরাধের অভিযোগও এদের বিরুদ্ধে ফরাসীরা করে যুদ্ধের পরে।

‘৪৫এর মে’তে যুদ্ধ শেষ হয়। নিরপেক্ষ সুইজারল্যান্ডে আশ্রয় নেবার ইচ্ছা থাকলেও ফ্রী ইন্ডিয়া আর্মি শেষমেশ ফরাসী ও মার্কিনদের হাতে বন্দী হয়। তাদেরকে ব্রিটিশদের হাতে সমর্পণ করা হয়। ভারতে প্রত্যাবর্তনের পর ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির পাশাপাশি লালকেল্লায় এদেরও বিচার হয়। কিন্তু ভারতে ততদিনে স্বাধীনতার পক্ষে গণআন্দোলন বেশ জোরেসোরে চলছে। লালকেল্লায় আজাদ হিন্দের রাষ্ট্রদ্রোহিতার বিচারের পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্রোহ করে বসে ভারতীয় নৌ ও বিমানবাহিনী। শেষ পর্যন্ত কিছুদিনের জেল ও ডিসঅনারেবল ডিসচার্জের শাস্তি দিয়ে আইএনএ ও ফ্রী ইন্ডিয়া লেজিওনের সকল অফিসার ও সৈন্যকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় ব্রিটিশরাজ। সুভাষ বসু এসবের আগেই তাইওয়ানে বিমানদুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছেন। যে সামরিক প্রক্রিয়ায় বিজয়ী সেনাবাহিনীর অধিনায়ক হিসাবে ভারতের মুক্তি আনার স্বপ্ন ছিল তাঁর, আজাদ হিন্দ ফৌজ তার থেকে পুরোপুরি ভিন্ন প্রক্রিয়ায় পরাজিত ও ‘রাজাকার’ আখ্যায়িত হয়ে স্বাধীনতাসংগ্রামকে প্রভাবিত করে।

আরেকটা ব্যাপার অনেক বাঙালী ভাবেন যে সুভাষ বসু তাঁর অনুগত সেনাদলে ধর্মীয়-জাতিগত সীমানা ভেঙে সব ছাঁপিয়ে ভারতীয় সাম্যবাদী-জাতীয়তাবাদী একটি অনুভূতি দাঁড়া করান। এটা যতটা না আদর্শবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা উচিত, তার থেকে বেশি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যাচাই করা জরুরী।

ব্রিটিশ ভারতীয় আর্মিতে ধর্মীয়-জাতিগত বিভাজনের অনেক যুক্তিসঙ্গত কারণ ছিল। একই ভাষার ব্যবহার, একই ধরনের খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি অনেক বড় প্র্যাক্টিকাল কারণ। ফ্রী ইন্ডিয়ান আর্মির অবস্থা সেরকম ছিল না। তারা সংখ্যাতেও ছিল কম, জাতিগত-ধর্মীয়ভাবে আলাদা করলে ছোট ইউনিটের কারণে সাংগঠনিক সমস্যা দেখা দিত। তাছাড়াও মনে রাখতে হবে যুদ্ধবন্দী হিসাবে তারা একটা প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন ছিল। সেখানে জাতিগত-ধর্মীয় বিরোধ তৈরির কোন অনুকূল অবস্থা ছিল না। খারাপ সিচুয়েশনে পড়লে বাঘে-মহিষেও এক ঘাঁটে জল খায়।

আর প্রতিকূল অবস্থা থেকে বেরুনোর সাথে সাথেই কিন্তু হিন্দু-মুসলিম বিরোধটা এই একই আর্মির মধ্যে দেখা গেছে। লালকেল্লার বিচারের সময় মুসলিম সৈন্যরা হিন্দুদের ওপর দোষ চাপায় জোরপূর্বক আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগদানে তাদের বাধ্য করার জন্যে। এ অভিযোগের সত্যাসত্য বের করা কঠিন। কিন্তু ভারতীয় ব্রিটিশ আর্মিতে যে ধর্মীয় বিরোধের সুযোগ ও স্থান ছিল না, তার পরিস্থিতি ঠিকই তৈরি হয় আজাদ হিন্দ ফৌজে। সে ব্যাপারে পরে কোনসময় বিস্তারিত বলবো।

সুভাষ বসুর জীবনী নিয়ে বাঙালী বহু পড়াশোনা করেছে, বিস্তর লেখালেখি করেছে। হিরো ওয়ারশিপের শেষ নেই!  কিন্তু পুরো কাহিনীটার বাস্তবধর্মী বিশ্লেষণ করতে হলে জার্মান-জাপানী দৃষ্টিভঙ্গিটা দেখাও জরুরী। আর সাধারণ সৈন্যদের দিকেও নজরটা বাঙালী দিয়েছে কম, যতটা না দিয়েছে নেতৃত্বের প্রতি। সে চেষ্টাটাই আজকে আমি করলাম জার্মান ফ্রী ইন্ডিয়ান লেজিওনের সংক্ষিপ্ত কাহিনীর মধ্য দিয়ে। পরে সুযোগ হলে বার্মার ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির কাহিনী ও জাপানী দৃষ্টিকোণ নিয়েও একটি বিশ্লেষণ করার আশা রাখি।

ব্যালান্স অফ গ্রেট পাওয়ারস

১৯১৪ সালে সার্বিয়া নামের ছোট্ট, কিন্তু দাম্ভিক, স্লাভিক জাতীয়তাবাদী রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রটিকে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির যৌথ সাম্রাজ্য আক্রমণ করে বসে। আর তার ফলে শুরুতে ইউরোপ, পরে বিশ্বব্যাপী ইউরোপীয় কলোনিগুলি, আর শেষে নব্যপরাশক্তি জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র, জড়িয়ে পড়ে সাড়ে তিন বছর দীর্ঘ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে (১৯১৪-১৯১৮)।

ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধে ইউরোপে এথনিক-লিংগুইস্টিক জাতীয়তাবাদ ছিল বেশ জনপ্রিয়। এর ফলশ্রুতিতে ছোট-মাঝারি কয়েকটি রাজ্য নিয়ে উত্তরে ও দক্ষিণে দু’টি নতুন সাম্রাজ্যের সূচনা হয় — বিসমার্কের জার্মানি (১৮৭১) ও গারিবাল্দির ইতালি (১৮৬১)।

ডানপন্থী জাতীয়তাবাদের পাশাপাশি বামপন্থী অ্যানার্কিজ়ম, বিপ্লবী কম্যুনিজ়মও যে জনপ্রিয় হচ্ছিল বলা বাহুল্য। পুরনো সাম্রাজ্যগুলির দুর্বলতার সুযোগে তাদেরও সফল ও বিফল উত্থান ঘটে বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে (বলশেভিক বিপ্লব, ১৯১৭; সোভিয়েত হাঙ্গেরি, ১৯১৯; জার্মানির স্পার্টাসিস্ট বিদ্রোহ, ১৯১৯)। আর জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে মুলত অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি ও রাশিয়া ভেঙ্গে নতুন কয়েকটি দেশ ইউরোপের মানচিত্রে স্থান পায় (চেকোস্লোভাকিয়া, ইউগোস্লাভিয়া, পোল্যান্ড, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া)।

ঊনবিংশ শতকে ইউরোপের রাজপরিবারগুলি নাপোলেওনের সময়কার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ (১৮০৩-১৮১৫) এড়ানোর জন্যে একে অন্যের সাথে সামরিক সমঝোতা চুক্তি করা শুরু করে। নানা চুক্তির জালের বুনটে সংরক্ষিত হয় ছোট রাজ্যগুলির নিরাপত্তা, স্ফেয়ার অফ ইনফ্লুয়েন্স, ইত্যাদি। তার ওপর রাজপরিবারগুলি একে অন্যের সাথে আত্মীয়তার বন্ধনে জড়িয়ে আরেক লেভেলের ‘নিরাপত্তা’ তৈরি করে। যেমন, রুশ ৎসার নিকোলাস ছিলেন ব্রিটিশরাজ পঞ্চম জর্জের আপন খালাত ভাই, তাঁদের ছবি দেখলে তাঁদের আলাদা করে চেনার উপায় নেই। এধরনের ভূরাজনৈতিক ব্যবস্থা পরিচিত ছিল ‘ব্যালান্স অফ গ্রেট পাওয়ারস’ বলে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থামানো তো দূরের কথা, এ ব্যবস্থা একদিক থেকে দায়ী ছিল যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরির জন্যে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মূল কারণ অনেক গভীর, একটি কারণ জার্মানির উচ্চাকাংক্ষা। উডরো উইলসনের ভাষায় “ব্রিটেন হ্যাজ় দ্য আর্থ, এন্ড জার্মানি ওয়ান্টস ইট।” এটুকু কথার পিছনে অনেক লম্বা ইতিহাস রয়েছে। শিল্পায়ন যুগের শেষভাগে কাঁচামাল আর বাজারের জন্যে প্রতিযোগিতা, বাণিজ্যিক ও সামরিক সাম্রাজ্য গড়ার প্রচেষ্টা, ইত্যাদি। সে চিত্রে জার্মানি ছিল লেইটকামার। শেষে এসেও যুদ্ধবিগ্রহের সুযোগ নিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়ে নেয়া ছিল জার্মান শাসকগোষ্ঠীর মূল লক্ষ্য। এধরনের “রেয়ালপলিটিক” (“বাস্তবতাভিত্তিক কূটনীতি”) জার্মানির রূপকার বিসমার্কেরই সিগনেচার কৌশল। এর সফলতার কারণেই প্রুশিয়া নামক সামরিক রাষ্ট্র থেকে জার্মান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ হয় (১৮৭১-১৯১৯)।

অর্থাৎ বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকেই তার যথেষ্ট বারুদ তৈরি ছিল।

আর সে বারুদে যে স্ফূলিঙ্গটি বিস্ফোরণ সৃষ্টি করে, তা হলো বসনিয়ায় সার্ব আততায়ীর হাতে ডাকটিকেটে দেখানো অস্ট্রীয় যুবরাজ আর্চডিউক ফ্রানৎস ফেরডিনন্ড ও তাঁর স্ত্রী সোফিয়ার মৃত্যু (জুন ২৪, ১৯১৪)।

১৯১৭ সালে বসনিয়ায় অস্ট্রীয় সামরিকবাহিনীর ব্যবহারের জন্য প্রকাশিত এই ডাকটিকেটে স্মরণ করা হয়েছে ১৯১৪ সালে সার্ব আততায়ীর হাতে নিহত আর্চডিউক ফ্রানৎস ফেরডিনন্ড ও তাঁর স্ত্রী সোফিয়াকে — ব্যক্তিগত সংগ্রহ

ফ্রানৎস ফেরডিনন্ডের যুবরাজ হবার কথা ছিল না। অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির রক্ষণশীল সম্রাট ফ্রানৎস ইয়োসেফের একমাত্র পুত্র রুডল্ফ ত্রিশ বছর বয়সে পরকীয়া প্রেমের সূত্র ধরে প্রেমিকার সাথে আত্মহত্যা করেন ১৮৮৯ সালে। সেসময় নাকি তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন। ফলশ্রুতিতে, ফ্রানৎস ইয়োসেফের ছোট ভাই কার্ল লুডভ়িগ হন সিংহাসনের উত্তরাধিকারী। ১৮৯৬ সালে তাঁরও মৃত্যু হয় — প্যালেস্টাইনের ‘পবিত্র’ জর্দান নদীর নোংরা পানি খেয়ে টাইফয়েডে ভুগে। তখন তাঁরই ছেলে ফ্রানৎস ফেরডিনন্ডের ওপর যুবরাজ হবার গুরুদায়িত্ব বর্তায়।

ফ্রানৎস ফেরডিনন্ড সেকারণে অনেক দেরিতে রাজশাসনের উপযোগী শিক্ষালাভ শুরু করেন। বৃদ্ধ সম্রাট ফ্রানৎস ইয়োসেফের সাথেও ঝগড়াঝাঁটি লেগে থাকত। ‘বুড়ো ভামকে’ অতিরিক্ত রক্ষণশীল ভাবতেন তিনি। বিয়েও করেন রাজপরিবারের ঐতিহ্যের বাইরে। তাতে সম্রাট সায় দেন শুধুমাত্র একটি শর্তে, যে বিয়েটি হবে ‘মর্গানিটিক’। অর্থাৎ রাজকার্য, উপাধি, ইত্যাদিতে সোফিয়া আর তাঁর ছেলেমেয়েদের কোন দাবি থাকবে না। ফ্রানৎস ফেরডিনন্ড মারা গেলে তাঁর বংশধরের পরিবর্তে সম্রাট হবেন ফ্রানৎস ইয়োসেফের আরেক ভাতিজা কার্ল।

শিকারপাগল ফ্রানৎস ফেরডিনন্ডের ১৮৯২-৯৩এর ভারতভ্রমণের সময়কার ছবি। — ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

জার্মানির সমস্যা ছিল তার শাসকগোষ্ঠীর জার্মান-জাতীয়তাবাদী ঔদ্ধত্য, আর অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির সমস্যা ছিল তার উল্টো। জাতিগতভাবে জার্মান, আর ধর্মে ক্যাথলিক, হাবসবুর্গ গোষ্ঠীর সম্রাটরা কয়েক শতাব্দী ধরে সার্ব, ক্রোয়েশিয়ান, স্লোভেনিয়ান, চেক, স্লোভাক, ইউক্রেনিয়ান, রোমানিয়ান, পোলিশ, ইতালিয়ান, ইত্যাদি নানা ভাষা ও জাতের প্রজাদেরকে শক্ত হাতে শাসন করে চলছিল। ১৮৪৮ সালে সে ব্যবস্থার ওপর আঘাত আসে হাঙ্গেরির মাগিয়ার জাতিগোষ্ঠীর বিপ্লবের মাধ্যমে। অস্ট্রিয়ার শাসকরা রাজি হন সাম্রাজ্যকে দু’টি সমকক্ষ রাজত্বে ভাগ করে একভাগের শাসনভার মাগিয়ারদের দিতে, অবশ্য রাজা-সম্রাট থাকবেন একই হাবসবুর্গ উত্তরসূরী।

এতে সমস্যার তেমন কোন সমাধান হয়নি। কারণ মাগিয়াররা আরো ক্ষমতাবান হয়ে অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীকে তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করা শুরু করে। অপরদিকে অস্ট্রীয় জার্মানরাও সামরিক অভিযানের মাধ্যমে প্রাক্তন তুর্কী প্রদেশ বসনিয়া-হারজেগোভিনাকে হস্তগত করে তাকে ‘প্রতিরক্ষার’ নামে (বসনিয়া-হারজেগোভিনা প্রটেক্টোরেট, ১৮৭৮)।

অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরিকে প্রদেশে ভাগ করে কিভাবে ফেডারেল পদ্ধতিতে শাসন করা সম্ভব, ১৯০৬এ তার একটা প্রস্তাবনা করেছিলেন এক রোমানিয়ান বুদ্ধিজীবী আউরেল পপভিৎস। ফরাসী ভাষার মানচিত্রে এই বৃহত্তর অস্ট্রিয়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রাদেশিক বিভাগ দেখানো হয়েছে। — ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

এসব কারণে জার্মান-মাগিয়ার বাদে বাকি সকল এথনিক জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে স্লাভরা, যারপরনাই অসন্তুষ্ট ছিল। আর দু-দু’টো বল্কান যুদ্ধে ‘ইউরোপের সিক ম্যান’ তুরস্ককে পরাজিত করে সার্বিয়া-বুলগেরিয়ার মত দেশগুলি সে এলাকার সামরিক পরাশক্তিগুলির মাঝে যথোপযুক্ত স্থান করে নেয়। সার্বিয়ার পরবর্তী লক্ষ্য হলো আরেক ‘সিকম্যান’ অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরীর ‘নিষ্পেষিত’ স্লাভিক জনগোষ্ঠীদের ‘মুক্ত’ করে উত্তরের তুতো ভাই রুশদের মত দক্ষিণেও সর্ব-স্লাভিক দেশ ‘ইউগোস্লাভিয়া’ কায়েম করা। সে লক্ষ্যে বসনিয়ার সার্ব স্বাধীনতাসংগ্রামীদের (বা সন্ত্রাসবাদীদের) গোপনে রসদ সরবরাহ করে সার্বিয়া। সংগঠিত হয় ইয়ং বসনিয়া আর ব্ল্যাক হ্যান্ডের মত গুপ্তদল।

১৯১৪ সালের ২৪শে জুন ফ্রানৎস ফেরডিনন্ড সস্ত্রীক বসনিয়ার সারায়েভো পরিদর্শনে আসেন। সকালেই তাঁর মোটর শোভাযাত্রার ওপর পরিকল্পিত গ্রেনেড হামলা করে ইয়ং বসনিয়ার এক সদস্য। সে যাত্রা বেঁচে যান অস্ট্রিয়ার যুবরাজ, শুধু পিছনের গাড়ির কয়েকজন আহত হয়। ফ্রানৎস ফেরডিনন্ড গভর্নরের প্রাসাদে পৌঁছে বেশ হম্বিতম্বি করেন, তারপর দুঃসাহস দেখিয়ে দিনের বাকি কর্মসূচীপালনের জন্যে আবার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। কিছু বিভ্রান্তির কারণে গাড়িবহর পথে বিলম্বিত হয়। ভাগ্যের ফেরে সেপথের পাশেই এক কাফেতে বসে কফি খাচ্ছিল গাভ্রিলো প্রিন্সিপ বলে ইয়ং বসনিয়ার আরেক সদস্য। সকালের বিফল সাথীর কার্যসিদ্ধি করবে কি করবে না সে নিয়ে দোনমনা করতে করতেই গাভ্রিলো কাফে থেকে বের হয়ে সাথে থাকা রিভলভার দিয়ে ক্লোজ রেঞ্জে ফ্রানৎস ফেরডিনন্ড আর সোফিয়াকে গুলি করে বসে। যথোপযুক্ত পরিচর্যা সাথে সাথে না পাওয়ায় দু’জনেই কয়েক মিনিটের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন।

এরপরে সূচনা হয় ১৯১৪এর জুলাই সংকট — অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি কঠিন শর্তের আল্টিমেটাম দেয় সার্বিয়াকে। আক্রান্ত হলে সার্বিয়াকে তাদের তুতোভাই রুশরা সাহায্য করবে, এ ভরসায় সার্বরা আল্টিমেটামকে পাশ কাটিয়ে যায়। ফলে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় দুজনের মধ্যে। রুশরা ঠিকই আসে সার্বদের সাহায্যে। জার্মানিও আরো সাম্রাজ্যের লোভে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দেয়। আর রুশদের মিত্র, ত্রিপল-অঁতঁতের অপর দুই দেশ ব্রিটেন-ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয়। তুরস্কও অক্ষশক্তির সাথে যোগ দেয় এই ভেবে যে রুশ আর স্লাভদের কাছে খোঁয়া যাওয়া আগের সাম্রাজ্য পুনরোদ্ধার হবে।

ফ্রানৎস ফেরডিনন্ডের মৃত্যুতে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলো, এ ভাগ্যের পরিহাস! কারণ, ফ্রানৎস ফেরডিনন্ড অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির সাম্রাজ্যে জার্মান-মাগিয়ারদের একাধিপত্য খর্ব করে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীকে সমাধিকার দেয়ার ব্যাপারে উদারপন্থী ছিলেন। তাতে নিজের সর্বময় ক্ষমতা অবশ্য অটুট রাখতে পিছপা ছিলেন না। বেঁচে থাকলে আর রাজসিংহাসনে বসলে হয়ত কোন না কোন উপায়ে নিজ রাজ্যের সমস্যাগুলি সমাধানের চেষ্টা করতেন।

এখানে আরেকটা তুলনা উল্লেখযোগ্য। ওসমানি তুরস্ক আর হাবসবুর্গ অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি — এ দুটি দেশের সমস্যাগুলি একই রকম ছিল। দুটোতেই সম্রাট সর্বেসর্বা — সংসদ নামেমাত্র। তাছাড়াও অস্ট্রিয়ার কাইজ়ার একই সাথে হোলি রোমান এম্পেরর — অর্থাৎ ক্যাথলিককূলের ধ্বজাধারী রক্ষক। তুরস্কের সুলতানও সেরকম নমিনাল ‘আমিরুল মুমিনীন’ — তাবৎ মুসলিমদের ঈমানের রক্ষক। দুটো দেশেই ইহুদী-খ্রীষ্টান-মুসলিম আরব-তুর্কী-আর্মানী-ফার্সী চেক-স্লোভাক-ক্রোয়েশীয়-পোলিশ ইত্যাদি নানা জাতি ও ভাষার জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। দুটোই ছিল একরকম ‘সিক ম্যান’ — অর্থাৎ সামরিক প্রযুক্তি আর অর্থনৈতিক-সামাজিক প্রগতিশীলতার বিচারে পশ্চাদপর। আর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে দুটো দেশই টুকরো টুকরো হয় যায়।

তফাত হলো, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির টুকরোগুলি দেশে পরিণত হয় তাদের জাতিস্বত্ত্বার ইচ্ছানুযায়ী। সেসব আত্মসমর্পণের চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র ও উডরো উইলসন জড়িত ছিলেন, যাঁর মূল লক্ষ্য ছিল যেন সেসব নতুন দেশে কোন না কোন ধাঁচের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়। কিছুটা সফলও হয়েছিল সে উদ্দেশ্য, চেকোস্লোভাকিয়া ভাল উদাহরণ। আবার উল্টোদিকে ইউগোস্লাভিয়ায় গণতন্ত্রের বদলে সার্বীয় রাজার ৎসারতন্ত্র কায়েম হয়।

তুরস্কের ক্ষেত্রে আত্মসমর্পণের চুক্তিতে মার্কিনদের আসন ছিল না। তুরস্কের জাতিস্বত্ত্বাগুলির নিজস্ব সিদ্ধান্তের বদলে বিজয়ী ঔপনিবেশিক শক্তি ব্রিটেন ও ফ্রান্স নিজেদের ইচ্ছেমত ম্যাপ কাটাকুটি করে ভাগ করে নেয়। যার ফলে সিরিয়া ও ইরাকের মত দুটি ‘আর্টিফিশিয়াল’ দেশের উদ্ভব ঘটে, যার প্রজাদের জাতিগত পরিচয়ের মধ্যে কোন সামঞ্জস্য ছিল না। এখানেই কিন্তু তাদের পরবর্তী দুর্ভোগের বীজের বপন। সাথে কুর্দিস্তান-সৌদি-প্যালেস্টাইন-লিবিয়া ইত্যাদিরও ভাগ্যলিখন চূড়ান্ত হয়ে যায়। (সাইকস-পিকো অ্যাগ্রিমেন্ট, ১৯১৬)।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে এত কিছু লেখার জন্যে শুরুতে বসিনি। চেয়েছিলাম আমার সংগ্রহের ঐ ডাকটিকেটটা জাহির করে ফ্রানৎস ফেরডিনন্ডের গল্প বলতে। কান টানতে মাথা চলে এল!


পুনশ্চ: চিন্তা করে দেখলাম সাইকস-পিকোকে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে নির্দোষ বলা যায় কিনা। মনে হয় যায়। কারণ, সিরিয়া-ইরাকের যেসকল সমস্যা, সেসকল সমস্যা ইউগোস্লাভ জনপদগুলিরও ছিল, আর তাদেরও কপালে একই লিখন ছিল (নব্বই দশকের একাধিক যুদ্ধ ও প্রচুর পৈশাচিকতা ও লোকক্ষয়)। ইউগোস্লাভিয়া সেসকল তুর্কী সমস্যা ইনহেরিট করেছিল, গ্রীক-আলবেনীয়দের প্রচুর পকেট ছিল তাদের রাজ্যে যাদের তেমন কোন অধিকার স্লাভরা দেয়নি। অর্থাৎ সমস্যা একই — সাইকস-পিকো ছাড়াই।

আর ইউরোপের জাতিগোষ্ঠীগুলির জাতীয়তাবাদের কারণে তাদের ইতিমধ্যে স্বদেশের মানচিত্রের ধারণা ছিল। ইরাক-সিরিয়ার আলাউয়ী, শিয়া, সুন্নি, দ্রুজ, ইয়াজিদি, তুর্কমেন, এদের জাতীয়তাবাদের তেমন কোন ধারণাই ছিল না — আরব, আর্মনী আর কুর্দ বাদ দিলে। তাদের জনপদগুলিও ছিল ছড়ানো-ছিটানো, আলাদা করে অর্থবহ ভৌগোলিক ম্যাপ আঁকা মনে হয় না সম্ভব ছিল। পরবর্তীতে যখন জনসংখ্যা বাড়তে বাড়তে একেক জনপদের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়, তখন থেকেই অধুনাযুগের টেনশনগুলির শুরু।

অর্থাৎ সেসময়ের নিরিখে হয়ত সাইকস-পিকো ছিল আরব স্বদেশভূমির একটি গ্রহণযোগ্য, কিন্তু ঔপনিবেশিক, সমাধান। আর তা না হলেও সাইকস-পিকোর সাধ্যি ছিল না এত কিছু বুঝে (বা না বুঝে) ভবিষ্যদ্দর্শনের।

(আর সাইকস-পিকোর আরেক পার্টনর ছিল রুশরা, পরবর্তী বলশেভিক সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সাইকস-পিকোর হাড়ি হাঁটে ভেঙে দেয়।)

[Sykes–Picot Agreement]


close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!