লাইবেরিয়া – ৫, গৃহযুদ্ধ, ১৯৩০-

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত লাইবেরিয়ার ইতিহাসকে দু’ভাগে ভাগ করতে পারি। ১৯৮০ পর্যন্ত প্রথমভাগে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসে মার্কিন ও ডাচ বিনিয়োগের ফলে। ফায়ারস্টোন টায়ারের রাবারশিল্প, ডাচ ও রাষ্ট্রায়ত্ত সোনা ও লৌহআকরিক উত্তোলনশিল্প, আর মার্কিনদের তৈরি গভীর সমুদ্রবন্দর ও বিমানবন্দরের সুবাদে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি আসে লাইবেরিয়াতে। সরকারী পয়সায় পশ্চিম আফ্রিকার তথাকথিত ‘সুইজারল্যান্ডের’ প্রচুর যুবক উচ্চশিক্ষার্থে মার্কিনে পাড়ি জমায়।

প্রেসিডেন্ট টাবম্যান ১৯৪৪ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত দেশশাসন করেন। টাবম্যান চাটুকারপরিবেষ্টিত থাকতে পছন্দ করতেন। তার আমলে যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়, সবের কৃতিত্ব নিজে দাবি করতেন। মতবিরোধীদের যৎসামান্য কৃতজ্ঞতাবোধও নেই, একথা বলে বেড়াতেন সবার কাছে। তার জন্মদিন পরিণত হয় রাষ্ট্রীয় ছুটির দিনে। আমেরিকো সেটলার ঐতিহ্যের প্রতীকগুলির ‘পূজো’ তো চলতই।

লাইবেরিয়ার ঊনিশতম প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম টাবম্যান (১৮৯৫-১৯৭১)। রাষ্ট্রপতি ছিলেন ১৯৪৪ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত।
ডাচ রাজপরিবারের সাথে প্রেসিডেন্ট টাবম্যান, ১৯৫৫।

মার্কিন সিভিল রাইটস আন্দোলনের জোয়ারে অবশ্য টাবম্যান ১৯৬৪তে ‘ইউনিফিকেশন অ্যাক্ট’ স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন। ফলে দেশের যে ৯৮ শতাংশ মানুষ এতদিন ভোটাধিকারবঞ্চিত ছিল, তারা সে অধিকার পায়। ইতিহাসের কী নির্মম পরিহাস, যে দেশ ছেড়ে আমেরিকোদের লাইবেরিয়ায় আসা মুক্তির সন্ধানে, সেদেশের উদাহরণ অনুসরণ করেই সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিত করতে হয়, স্বাধীনতার একশ’ কুড়ি বছর পর!

১৯৭১এ টাবম্যানের মৃত্যুর পর তার উপরাষ্ট্রপতি টলবার্ট হন প্রেসিডেন্ট। এসময় ভিন্নমুখী পরিবর্তন আসতে শুরু করে লাইবেরিয়াতে। মার্কিনফেরত ছাত্ররা লাইবেরিয়ায় ফিরে চাকরি পেতে বেশ বেগ পায়। কারণ ততদিনে ইকনমির বুম শেষ হয়ে বাস্টের দিকে চলছে। এসকল ছাত্রদের অনেকেই মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে বামপন্থী রাজনীতিতে দীক্ষিত হয়।

তাছাড়া আফ্রিকার অন্যান্য অনেক দেশও তখন ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্তি পাচ্ছে। প্রতিবেশী দেশ ঘানার নেতা কওয়ামে ন্ক্রুমা সোভিয়েত সমর্থিত ছিলেন, স্বদেশে তিনি সমাজতন্ত্র আর বিদেশে প্যান-আফ্রিকানিজমের জজবা তোলেন। লাইবেরিয়ার যুবসমাজ সমাজতন্ত্র আসলে কতটুকু বুঝত, তা প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু দেশের বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্যে মার্কসবাদের বাণীতেই তারা থিওরিটিকাল সমাধান খুঁজে ফেরে।

ষাটের দশকে লগিং ছিল লাইবেরিয়ার বিদেশী বিনিয়োগের অন্যতম শিল্প।
লৌহআকরিক উত্তোলনে লাইবেরিয়া ষাটের দশকে ছিল অগ্রগণ্য একটি দেশ।
সত্তরের দশকে আখমাড়াই করে চিনি প্রস্তুত ও রপ্তানি হত লাইবেরিয়া থেকে।

দু’টি ‘প্রগতিশীল’ সংগঠন গড়ে ওঠে রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্যে। সত্তরের দশকের শেষে চালের দামবৃদ্ধির প্রতিবাদ করতে গিয়ে এদের একটির সমর্থকরা মনরোভিয়াতে ব্যাপক লুটতরাজ চালায়। তাদের প্রতিবাদ মিছিলে গুলিবর্ষণ করলে সত্তরজনের মত মারা যায়।

পুরো দেশে থমথমে একটা অবস্থা বিরাজ করছিল। টলবার্ট ভেবেছিলেন একটা বামপন্থী বিপ্লব হবে আর তার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। যেটা হল, তা বোধহয় কারো আন্দাজে ছিল না। বামপন্থী সংগঠনগুলি স্বজাতির মজলুমদের কথা বললেও গ্রামাঞ্চলে তাদের তেমন কোন প্রভাব ছিল না। শহরকেন্দ্রিক রাজনীতির অঙ্গন থেকে তারা একটা পরাবাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গোত্রীয় উপজাতিগুলিকে বিচার করত। আর লাইবেরিয়ান আর্মির অর্ধশিক্ষিত উপজাতীয় পেটি অফিসার, জওয়ান এদেরকে দীক্ষিত করত প্রগতিশীল চেতনায়। এসকল সেনাসদস্য বেশির ভাগই ছিল ক্রান গোত্রের।

বিদেশী অর্থায়নে মনরোভিয়া আধুনিক রাজধানীতে পরিণত হলেও ১৯৬৯এ এটি ছিল বিশ্বের সবচে কম জনবহুল রাজধানী।
লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট টলবার্ট (বামে) জাইর বা বর্তমান ডিআর কংগোর একনায়ক প্রেসিডেন্ট মবুতুর সাথে। এদের মাথায় সিভিল রাইটস আন্দোলনের প্রতীকী টুপি।
১৯৭৩এর মনরোভিয়া।

এই সেনাবাহিনীর একটা দল ১৯৮০র এপ্রিলে দেশের ক্রান্তিলগ্নে রক্তাক্ত একটি ক্যুদেতা করে বসে। প্রেসিডেন্ট টলবার্টকে তার প্রাসাদে হত্যা করা হয়। জনসমক্ষে তার ক্যাবিনেটের তেরজন সদস্যকে মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা করে ফেলে সেনাসদস্যরা। সেটা দেখে স্থানীয় জনগণ আনন্দ-উল্লাস করে। স্যামুয়েল ডো বলে এক মাস্টার সার্জ্যান্ট হয়ে বসেন দেশের রাষ্ট্রপতি। তিনি হন স্থানীয় উপজাতীয় গোত্রগুলো থেকে নিযুক্ত প্রথম রাষ্ট্রপতি।

সংবিধান রহিত করে সামরিক শাসন জারি করেন ডো। বামপন্থী দলগুলির একটিকে নিজের আজ্ঞাবহ রাজনৈতিক দলে পরিণত করলেও আসলে তিনি ছিলেন মার্কিন আর সিআইএর সাথে বেশি ঘনিষ্ঠ। ক্রান উপজাতীয়রা এসময় তার পৃষ্ঠপোষকতায় সরকারী চাকরি থেকে শুরু করে সব জায়গায় অগ্রাধিকার পায়। একটি বিফল ক্যু সংঘটিত হয় তার বিরুদ্ধে। ১৯৮৫তে কারচুপির নির্বাচন করে ডো রাষ্ট্রপতির আসনে পাকাপোক্তভাবে বসেন।

লাইবেরিয়াতে ১৯৭৯ সালে চালের দাম নিয়ে রায়টে সত্তরের মত মানুষ পুলিশের গুলিতে মারা যায়।
১৯৮০তে ক্ষমতার দখল করে ক্রান উপজাতীয় সেনানায়ক স্যামুয়েল ডো
যুক্তরাষ্ট্রের পেন্টাগনের সামনে লাইবেরিয়ার রাষ্ট্রপতি ডো

এরও ফল যা হবার হলো। ১৯৮৯ সালে চার্লস টেইলর বলে আরেক ওয়ারলর্ড অন্যান্য উপজাতির সহায়তায় আইভরি কোস্ট থেকে বিদ্রোহীবাহিনী নিয়ে লাইবেরিয়াতে ঢোকেন। পুরো দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। টেইলর ডো’র সরকারকে হঠাতে সক্ষম হন। ডো’র ভাগ্যও হয় তার পূর্বসূরীর মত। তার নগ্ন মৃতদেহ প্রদর্শিত হয় জনপথে।

টেইলর হয়ে বসেন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু যে ‘ক্যান অফ ওয়ার্মস’ একবার খোলা হয়ে গেছে, তা আর বন্ধ করার উপায় নেই। টেইলরের বিরুদ্ধেও দু’তিনটি ভিন্নগোত্রীয় উপজাতি যুদ্ধ শুরু করে। ১৯৯৭ পর্যন্ত ত্রিমুখী প্রথম যুদ্ধটি চলার পর আবার ১৯৯৯এ শুরু হয় দ্বিতীয় গৃহযুদ্ধ। ২০০৩এ চার্লস টেইলর নাইজেরিয়ায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। তারপর জাতিসংঘের পীসকিপিং মিশনের মাধ্যমে দেশটিতে শান্তি আসে। সেটা এখনো চলছে।

মনরোভিয়া, ২০০৯
চার্লস টেইলর, আইসিসির ট্রিব্যুনালে বিচারকালে, ২০০৯
২০১৮ সাল পর্যন্ত লাইবেরিয়ার রাষ্ট্রপতি ছিলেন নোবেল শান্তিজয়ী এলেন জনসন সারলীফ

চৌদ্দ বছরের গৃহযুদ্ধের শুরুতেই যারা দেশটি ছেড়ে প্রথমে ভাগে, তারা হলো আমেরিকো পরিবারগুলি। দেড়শ বছর ধরে নানাভাবে যে দেশটিকে তারা শাসন করে এসেছে, তার থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে যেখানে আশ্রয় নেয় তারা, সে তাদের ক্রীতদাস পূর্বপুরুষদের মনিবের ভিটা আমেরিকা! ঈস্ট কোস্টের যেসব প্ল্যান্টেশন থেকে তাদের বাপদাদাদের মুক্তি ও লাইবেরিয়া যাত্রা, ভাগ্যচক্রে সেখানেই তারা ফিরে যায় দেড়শ বছর পর।

আর আমেরিকোরা পেছনে ফেলে রেখে যায় অন্ধকারে নিমজ্জমান একটি দেশ। ষোলটি যুধ্যমান উপজাতি, পনের হাজার শিশুসৈন্য, আড়াই থেকে নয় লাখ মৃত, ষাট থেকে নব্বই শতাংশ নারী জনসংখ্যা ধর্ষিত — এসব পরিসংখ্যান দিয়ে ঢাকা পড়ে যায় আমেরিকো ক্রীতদাসবংশধরদের অত্যাচারের কাহিনী, স্বজাতিকে অধিকারবঞ্চিত করার ইতিহাস, আর গণতান্ত্রিক প্রথার আড়ালে-আবডালে ক্ষমতালিপ্সা আর দুর্নীতির খেলা।

তাদের এই অধঃপতনের পেছনে কোন পশ্চিমা সরকার, কোন ঔপনিবেশিক শক্তির তেমন কোন হাত ছিল না। পুরো দেড়শ বছর ধরে মু্ক্ত দাসের বংশধররাই স্বাধীন দেশে নিজেদের পতন ডেকে এনেছে একটু একটু করে।

মুঘল চিত্রশিল্পে ইউরোপীয় প্রভাব

আজকে লিখছি মুঘল আমলের চিত্রকর্মের ওপর ইউরোপীয় প্রভাব নিয়ে। ব্রিটিশ কলোনিয়াল আমলের বহু আগ থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশে যে পর্তুগীজ, স্প্যানিশ, ওলন্দাজদের আগমন ঘটেছে, আর সে বাণিজ্যের ফলে স্বভাবতই নতুন ধ্যানধারণার মুক্তবিস্তার হয়েছে, সে ইতিহাস আজ ঢাকা পড়ে গেছে শুধুমাত্র ঊনবিংশ-বিংশ শতকের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার রাজনৈতিক ইতিহাসের পুরু প্রলেপে। আমার বিচারে সেটা ইউরোপীয় প্রভাব পরিপূর্ণ ন্যায়সঙ্গত মূল্যায়নের পথে একটা অন্তরায়।

মুঘল আমলে অংকিত এই চিত্রে কাগজের ওপর রঙ ও সোনার ব্যবহার। নবাব পরিচারকসহ প্রাতভ্রমণে বেরিয়েছেন। ১৭৩০-৪০। ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ এশিয়ান আর্ট।

প্রথম ছবিটা স্মিথসোনিয়ান মিউজিয়ামের ফ্রিয়ার গ্যালারি অফ আর্টে সংরক্ষিত। মোটরগাড়ির ব্যবসা করে বড়লোক এক শিল্পপতি চার্লস ফ্রিয়ার বিশের দশকে তাঁর সমস্ত এশিয়ান আর্ট দান করে দেন স্মিথসোনিয়ানকে। এমনকি সেগুলি রাখার জন্যে দালান বানানোর খরচটাও দিয়ে দেন। ওয়াশিংটন ডিসিতে এ মিউজিয়াম দেখার সৌভাগ্য হয় আমার। বাকি ছবিগুলোর অনেকগুলিও একই স্থানে সংরক্ষিত।

মূল কথায় ফিরে আসি। প্রথম ছবিটি ১৭৩০-৪০এ আঁকা। অশ্বারোহী এক নবাব ফুল শুঁকতে শুঁকতে পরিচারকসহকারে প্রমোদভ্রমণ করছেন। ছবিটি উল্লেখযোগ্য এ কারণে যে, এতে অনেকখানি রিয়ালিজম ও ন্যাচারালিজম উঠে এসেছে, যা মুঘলপূর্ববর্তী আমলে দেখা যায়নি। পার্স্পেকটিভ, ডেপথ অফ ফীল্ড, ধর্মীয় ও পৌরাণিক সাবজেক্ট ছেড়ে দৈনন্দিন কার্যকলাপকে ফুঁটিয়ে তোলা — এসবই ভারতীয় শিল্পকলায় নতুন ব্যাপারস্যাপার। পারসিক শিল্পীদের অনুপ্রেরণায় মুঘল চিত্রকলা প্রথম প্রথম সনাতনই ছিল। ন্যাচারালিস্টিক ছবি না আঁকার কারণ, অনেক শিল্পরসিক বলেন, ইসলাম ধর্মের বিধিনিষেধ যে একেবারে প্রাণবন্ত ছবি আঁকা হলে খোদার ওপর খোদকারি করার প্রচেষ্টা হবে সেটা, আর ফলাফল জাহান্নামের আগুন!

এখন বলি রিয়ালিজমে রূপান্তরের পিছনে ইউরোপীয় মিশনারী ও মুঘলদের অবদানের কথা।

সম্ভবত বিজাপুরের শিল্পী ফররুখ বেগের আঁকা এই চিত্রে মাতা মেরি ও যীশু। ১৫৮০-১৬১৯। ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ এশিয়ান আর্ট।

১৫৪২ সালে গোয়াতে এসে উপস্থিত হন সেন্ট ফ্রান্সিস জাভিয়ের। তাঁর লক্ষ্য ছিল সেখানকার পর্তুগীজ খ্রীষ্টানদের বিপথগামী হওয়া থেকে রক্ষা করা, আর তার লেজুড় ধরে নেটিভদের কাছে ধর্মপ্রচার। গোয়ার পার্শ্ববর্তী রাজ্য বিজাপুর ছিল আদিলশাহী সুলতানদের শাসিত। সেখানেও মিশনারীদের কার্যক্রম বিস্তার পায়। এর সাথে সাথে চলে আসে ধর্মীয় চিত্রকলা। যেমন, দ্বিতীয় ছবিটা বিজাপুরের ফররুখ বেগের আঁকা মাতা মেরী ও যীশুর ছবি। এ যতটা না ধর্মবিশ্বাস থেকে আঁকা, তার থেকে বেশি নতুন বিষয় নতুন ভঙ্গি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা। ফররুখ বেগ অবশ্যই এ ছবির নাম ম্যাডোনা অ্যান্ড চাইল্ড দেননি, কিন্তু বিষয়বস্তু রেনেসাঁস যুগের ম্যাডোনা অ্যান্ড চাইল্ডের সাথে পুরোপুরি মিলে যায়। তৃতীয় ছবিটিও সেরকম মুঘল আমলে করা হোলি ফ্যামিলির চিত্রায়ন। ফররুখ বেগ পরবর্তীতে সম্রাট আকবরের শিল্পকলা কর্মশালার সদস্য হন।

ইউরোপীয় চিত্রের অনুকরণে ভারতীয় শিল্পী এঁকেছেন হোলি ফ্যামিলির ছবি। সপ্তাদশ শতক। ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ এশিয়ান আর্ট।

সম্রাট আকবর ছিলেন সকল প্রকার চিত্রকলা ও স্থাপত্যশিল্পের পৃষ্ঠপোষক। তার আমলে মুঘল সাম্রাজ্য সর্বোচ্চ শৈল্পিক শিখরে ওঠে। আকবর একই সাথে ছিলেন নানা ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে আগ্রহী, আর সুফীবাদে বিশ্বাসী। এমনকি প্রচলিত ধারার চিত্রকলার পরিবর্তনের ব্যাপারেও তাঁর মতামত ছিল বেশ প্রগতিশীল। বিশেষ করে, তাঁর মতে চিত্রকররা যদি লাইফলাইক ছবি আঁকেও, তাদের অবশ্যই এই অনুধাবন অবশ্যম্ভাবী যে, তাদের ন্যুনতম ক্ষমতা নেই স্রষ্টার মত জড় বস্তুতে জীবন দেবার। একার্থে, এভাবে চিত্রকর্মের মাধ্যমে মানুষের পক্ষে আত্মগরিমা পরিত্যাগ করে স্রষ্টার অপার মহিমার প্রত্যক্ষদর্শী হওয়া সম্ভব। সুতরাং চিত্রকর্ম ধর্মীয় দিক থেকেও শিক্ষণীয় একটি কাজ। এ ছিল আকবরের সুফী ঘরানার চিন্তা।

সুফী ধর্মানুরাগী আকবর নতুন রাজধানী ফতেপুর সিক্রিতে ইবাদতখানা বলে একটি সম্মেলনকেন্দ্র বানিয়ে সেখানে মুসলিম-সুফী-হিন্দু-শিখ-জৈন-বৌদ্ধ প্রভৃতি ধর্মের গুরুদের আমন্ত্রণ জানান। গোয়ার পর্তুগীজ জেসাইটরাও বাদ পড়লো না নিমন্ত্রণ থেকে। তারা আকবরের ধর্মীয় ঔদার্যের ব্যাপারে ভালমতই জানত। দু’জন পাদ্রী আকবরের ইবাদতখানায় গেলেন আলোচনায় অংশ নিতে। তাদের আশা, আকবর কোন না কোনভাবে যীশুর দেবত্ব মানবেনই।

সে আশা গুঁড়ে বালি। আকবর তাদের থাকার জায়গা দিলেন, নিয়মিত তাদের সাথে আলোচনা করলেন। এমনকি, একটি বিদ্রোহ দমনের যুদ্ধেও এদের একজনকে নিয়ে গেলেন। আকবরের বহু কৌতূহল নিবৃত করার পরও পাদ্রীদের লক্ষ্য বিফল হলো। আকবর নিজেরই এক সুফী তরিকা চালু করলেন, দ্বীন-ই-ইলাহী নামে। তাতে যীশু নয়, স্বয়ং আকবরই একরকম দেবত্বের আসনে আসীন!

কিন্তু যে তিন-চার বছর জেসাইট পাদ্রীরা আকবরের দরবারে কাটালেন, সে সময়ের মধ্যে তারা বহু মেরী-যীশুর ছবি, রেনেসাঁস শিল্পীদের মাস্টারপীসের প্রতিলিপি, ইত্যাদি আকবরকে স্বাড়ম্বরে দেখিয়েছেন। আকবরও সেসব দেখতে যাবার সময় নিজের শিল্পীগোষ্ঠীকে সাথে নিতে ভোলেননি। তাঁরাই সেসব দেখে এসে আঁকা শুরু করলেন নতুন ধরনের ছবি। সেসবে যীশুর জায়গা নিলেন মুঘল সম্রাট নিজেই।

তুলনার জন্য চতুর্থ ও পঞ্চম ছবি দিলাম। এগুলি চতুর্দশ শতকের প্রাকরেনেসাঁস যুগের ইতালীয় চিত্রকর জোত্তো দি বোন্দোনের আঁকা ফ্রেস্কো। প্রথমটি যীশুর জন্মের চিত্র, দ্বিতীয়টি মৃত্যুর। দু’টিততেই লক্ষ্য করুন, আকাশে ফেরেশতার দল, আর পবিত্র আলোকচ্ছটা বা হেলো যীশু-মেরী প্রমুখের মাথার চারদিকে।

১৩২০ সালের আশপাশ দিয়ে আঁকা জোত্তো দি বোন্দোনের অ্যাডোরেশন অফ দ্য মেজাই। মেট মিউজিয়াম
১৩০৫ সালের আশপাশ দিয়ে জোত্তো দি বোন্দোনের আঁকা দ্য ল্যামেন্টেশন অফ ক্রাইস্ট। স্ক্রোভেনি চ্যাপেল

এর সাথে মেলান ষষ্ঠ ছবিটি, যাতে সম্রাট আকবরের মাথার চারপাশেও সেই একই আলোকচক্র। আর ওপরে ছবির ফ্রেমে দুই ফেরেশতা (ইতালীয় ভাষায় পুত্তি)। সন্দেহাতীতভাবে রেনেসাঁস আর্টের প্রভাব!

এই স্টাইল যে শুধু সম্রাটের ছবির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়। সাত নম্বর ছবিটিতে এক মোল্লার ছবিতেও একই ব্যাপার।

১৬৫০ সালের দিকে মুঘল সম্রাট আকবরের ছবি, মাথার চারপাশে ইউরোপীয় ধাঁচে হেলো।ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ এশিয়ান আর্ট।
উনবিংশ শতকে মুঘল চিত্রকরদের আঁকা এক সুফি সাধকের ছবি। ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ এশিয়ান আর্ট।

পরবর্তী সম্রাট জাহাংগীরের সময় ভারতে ব্রিটিশদের আনাগোনা শুরু হয়ে যায়। রেনেসাঁস আর্টের সাথে কিছুটা হলেও এসে মিলে উত্তর ইউরোপীয় প্রভাব। আট নম্বর ছবিটি বাদশা জাহাংগীরের। এতে দেখানো হয়েছে সম্রাট ইংল্যান্ডের রাজা জেমসের বন্ধুতার প্রস্তাব পাশে ফেলে এক সুফী সন্তের নিকট থেকে পুস্তক গ্রহণ করছেন। ‘হেলো-পুত্তিও’ আছে জায়গামতই। জেমসের পোশাক-আষাকও নিখুঁত ইংরেজ।

১৬১৫ থেকে ১৬১৮এর মধ্যে শিল্পী বিচিত্রের আঁকা ছবিতে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গির দরবারে সুফি সন্তদের স্বাগত জানাচ্ছেন। নিচে বাম কোনায় ইংরেজ রাজা জেমস অপেক্ষমান। ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ এশিয়ান আর্ট।

নয় নম্বর ছবিটি ইংল্যান্ডের রাণী প্রথম এলিজাবেথের। এতে রাণী হাতে নিয়েছেন রাজদন্ড আর ‘গ্লোবাস ক্রুসিজের’। এই ব্রহ্মাণ্ডগোলক  বা সেলেস্টিয়াল অর্ব হলো বিশ্বব্রহ্মান্ডের রূপক, আর ক্রসটি যীশুর। অর্থাৎ এলিজাবেথ হলেন যীশুর স্বর্গীয় রাজক্ষমতার লৌকিক প্রতিনিধি। শুধু এলিজাবেথ নয়, বহু ইউরোপীয় রাজরাজড়াদের একইরকম পোর্ট্রেট ছবি আছে।

এর সাথে মিলান দশ নম্বর ছবিটিকে। জাহাংগীর বসে আছেন চেয়ারে, এ কিন্তু পুরোপুরি ইউরোপীয় ভঙ্গিমার চেয়ার। তার ওপর, জাহাংগীরের হাতে সেই সেলেস্টিয়াল অর্ব। ব্রহ্মান্ডের প্রতীক।

আনুমানিক ১৬০০ সালে নাম-না-জানা শিল্পীর আঁকা ইংল্যান্ডের রাণী প্রথম এলিজাবেথ। হাতে গ্লোবাস ক্রুসিজের। ইংল্যান্ডের ন্যাশনাল পোরট্রেট গ্যালারী।
মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর ইউরোপীয় ঘরানার চেয়ারে বসে আছেন, হাতে ব্রহ্মাণ্ড-গোলক। সপ্তদশ শতকের প্রথমভাগ।

লেখা শেষ করি তিনটি মুঘল ছবি দিয়ে। এ তিনটিতেই রেনেসাঁস আর্টের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য পুরোপুরি দৃশ্যমান। এক, আলোছায়ার খেলা, এমনকি কালো পটভূমিতেও সঠিক রং ব্যবহার করে রাতের দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। আর দুই, পারস্পেক্টিভ, ফোরগ্রাউন্ড-ব্যাকগ্রাউন্ডের ইলিউশন। একটিতে নৈশকালীন হরিণশিকারের দৃশ্য, আরেকটিতে ইব্রাহীম ইবনে আদম বল্খী নামক এক আদি সুফির ধ্যানের দৃশ্য, তাঁর আহারাদির ব্যবস্থা করছে ফেরেশতার দল।

আর শেষ ছবিটিতে আকবরের স্কেচ। লিওনার্দো দা ভিঞ্চির করা বলেও ভুল হয়ে যেতে পারত কারো! অর্ধনিমিলিত চোখে আকবর বিভোর হয়ে কিছু একটা পর্যবেক্ষণ করছেন। চেহারায় খুব প্রশান্তির ছাপ। জুলফি-গোঁফ খুব পরিচর্যা করে স্কেচ করা।

রাতের আঁধারে হরিণ শিকারের দৃশ্য, এঁকেছেন মুঘল শিল্পী মীর কালান খান। অষ্টাদশ শতক।ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ এশিয়ান আর্ট।
বলখের সুলতান ইব্রাহিম ইবনে আযাম জঙ্গলে ধ্যান করছেন, তার জন্যে খাদ্য নিয়ে এসেছে ফেরেশতার দল। মুঘল মিনিয়েচার, অষ্টাদশ শতকের প্রথমভাগ। ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ এশিয়ান আর্ট।
মুঘল শিল্পীদের আঁকা মহামতি আকবরের স্কেচ, আনুমানিক ১৬০৫ সাল।

ফার্সী-তুর্কীদের চিত্রকর্মও এসময় নানাভাবে ইউরোপীয় আর্ট দিয়ে প্রভাবিত হয়েছিল। মুঘলদের যাত্রা যদিও শুরু ইরানী-মধ্য এশীয় ঐতিহ্যের ছত্রছায়ায়, খুব দ্রুত তারা ভারতীয় আর ইউরোপীয় উপাদান গ্রহণ করে, আর জন্ম দেয় নতুন একটি ধারার, যা পরে বিভিন্ন স্থানীয় রাজা ও নবাবদের শিল্পরস আর রুচিকে প্রভাবিত করে।

সুতরাং, কলোনিয়ালিজমের দোষ দেবার পরেও বেশকিছু পজিটিভ ব্যাপারে ইউরোপীয়দের সামান্যতম ক্রেডিট না দিলেই নয়!

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!