চীনের আপৎকালে যুক্তরাষ্ট্র


ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে প্রাক-আধুনিক যুগের বহু সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক অবস্থা ছিল করুণ। ইউরোপে অটোমান সাম্রাজ্য, পশ্চিম এশিয়ায় ইরানী আব্বাসী সাম্রাজ্য, চীনের চিং, ভারতের মুঘল — এরা সকলেই ইউরোপীয়, মূলত ব্রিটিশ, ফরাসী, অস্ট্রোহাঙেরীয়, রুশ, কিংবা জাপানী আগ্রাসনের সম্মুখীন। আফ্রিকার পুরনো রাজ্যগুলিও ছিন্নবিচ্ছিন্ন, তাদের ভাগাভাগি করে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করছে ব্রিটিশ-ফরাসী-জার্মানরা। ডাচ, পর্তুগীজ ও স্পেনীয়রাও দ্বিতীয় কাতারে।

ফরাসী পত্রিকা ল্য পতি জু্র্নালে চীন ভাগাভাগির কার্টুন, ১৮৯৮

একটা ব্যাপার মাথায় এল যে, মুঘল সাম্রাজ্যের অধঃপতনের মূল সুবিধাভোগী হল ব্রিটিশরা। অটোমান সাম্রাজ্য থেকে অস্ট্রীয়, ব্রিটিশ ও রুশ পৃষ্ঠপোষকতায় স্বাধীনতা পেল কিংবা বিচ্ছিন্ন হল গ্রীস, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, বসনিয়া, আলবেনিয়া প্রভৃতি। কিন্তু চীনের ভাগ্য কেন এমন টুকরোটুকরো হল না? ইউরোপীয় ও জাপানীদের চীন নামের কেক কেটে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করার কার্টুন তো সে সময়েই প্রকাশিত হয়েছিল বিভিন্ন পত্রিকায়। কিন্তু আসলে তো তা হয়নি।

হ্যাঁ, হংকং ও মাকাউ ব্রিটিশ ও পর্তুগীজদের কলোনি ছিল। চীনের বিভিন্ন বন্দরে পশ্চিমা, রুশ ও জাপানীদের বিশেষ সুবিধা ছিল। শাংহাইয়ে ছিল ইন্টারন্যাশনাল ডিস্ট্রিক্ট। ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের মত এক্সট্রা-টেরিটরিয়ালিটি সুবিধা। কিন্তু মুঘল সাম্রাজ্যের মত ফরেন কলোনাইজেশনের সম্মুখীন হয়নি চীন। আবার প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত পক্ষ তুরস্ক ও অস্ট্রোহাঙেরি যেভাবে বিভক্ত হয়ে “ডিকলোনাইজেশন”ধাঁচের ব্রেকআপের মাধ্যমে নতুন কিছু দেশের জন্ম দিয়েছিল, সেরকম ভাগ্যও চীনের হয়নি। যদিও সেটিও মূলে মাল্টিএথনিক এম্পায়ার রুলড বাই আ মাইনরিটি পীপল। হংকং-মাকাউয়ের মত কলোনি পর্তুগীজদের গোয়া-দমন-দিউ কিংবা ব্রিটিশদের ফোর্ট উইলিয়ামের থেকে তেমন কিছু বেশি ছিল না। বাকি চীনের আয়তনের তুলনায় এ সকল উপনিবেশ নিতান্তই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র।

তবে ফোর্ট উইলিয়াম যেমন ব্রিটিশ বেঙ্গলের ভবিষ্যতের দিকেই নির্দেশ করছিল, চিং শাসনামলের এক পর্যায়ে মুঘল সাম্রাজ্যের সেইরকম শেষ পরিণতির দিকেই যাচ্ছিল চীন। সে থেকে ঘটনাচক্রে তারা রক্ষা পায় এক উঠতি স্থানীয় পরাশক্তির কারণে। সে পরাশক্তিটি যুক্তরাষ্ট্র!

এ বলছি না যে, যুক্তরাষ্ট্র কেবল শুভানুধ্যায়ী হিসাবে চীনের পাশে এসে বন্ধুরাষ্ট্র হিসাবে দাঁড়ায়। সেটা অবশ্যই একটা লেভেলে ছিল। তবে প্রশান্ত মহাসাগরের অপর পারের “নিকট” প্রতিবেশী হিসাবে চীনের ভাগ্য নিয়ে কিংবা চীনে নিজেদের স্বার্থ নিয়ে মার্কিনদের মাথাব্যথা আর সক্ষমতা দুটোই যথেষ্ট ছিল, যেটা তুরস্ক কিংবা ভারতের বেলায় অতটা ছিল না। ইউরোপীয় ও জাপানীদের ওজনের বিপরীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনা দাঁড়িপাল্লায় বিশাল এক ব্যালেন্স হিসাবে কাজ করে।

একটু ব্যাখ্যা করে বলি চীনকে সম্পূর্ণ উপনিবেশায়নের হাত থেকে কিভাবে একার্থে মার্কিনরা রক্ষা করে।

চীনের সাথে ইউরোপীয়দের সরাসরি বাণিজ্য শুরুর অনেক পরে মার্কিনদের আবির্ভাব। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দুয়েকটা সরকারী মিশন সরাসরি যায়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মার্কিন বিনিয়োগকারীরা চীনে আফিমের ব্যবসায় বেশি জড়িত ছিল। ব্রিটিশরা যেখানে ভারত থেকে একচেটিয়া আফিম রপ্তানী করত, সেখানে মার্কিনরা পারস্য থেকে কিনে সে বস্তু চীনে বিক্রি করত। চীনে এ বাণিজ্যের সিংহভাগ অবশ্য ছিল ব্রিটিশদের হাতে।

চীনে স্থানীয় পোশাকপরিহিত মার্কিন মিশনারি, ঊনবিংশ শতক

এর পাশাপাশি মার্কিন মিশনারিদের আনাগোনা হতে শুরু করে চীনে। ধর্মপ্রচারের পাশাপাশি বিদ্যালয়, হাসপাতাল প্রভৃতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে চীনের জনগণের মাঝে আধুনিকতার ছোঁয়া নিয়ে আসে তারা। মিশনারিদের অনেকে এখনো খারাপ দৃষ্টিতে দেখেন। কিন্তু সত্য এত সোজাসাপ্টা নয়। আমি, আমার পরিবারের একাধিক সদস্য শিক্ষিত হয়েছি ক্যাথলিকপরিচালিত স্কুল বা কলেজে। ধর্মপ্রচারণার বিন্দুমাত্র অন্তত আমি দেখিনি। চীনের কিছু সাধারণ মানুষও মিশনারিদের শিক্ষার সে সুফল ভোগ করে।

আফিম যুদ্ধে পরাজয়ের পর চিং সাম্রাজ্যকে অনেক ছাড় দিতে হয় ব্রিটিশদের কাছে। বাণিজ্যে তারা পায় মোস্ট ফেভারড নেশনের সম্মান। পাঁচটি বন্দরে মুক্তবাণিজ্যের সুবিধা পায়। এর আগে সরকারীভাবে চীনের অভ্যন্তরের সাথে সরাসরি বাণিজ্য ছিল নিষিদ্ধ, তবে চোরাকারবারী ঠিকই চলত। ব্রিটিশরা এই লাভজনক সরকারী সুবিধাটি পাওয়ার কারণে ‌অন্যান্য বাণিজ্যিক শক্তিরাও একই ন্যায্য দাবি নিয়ে চীন সম্রাটের কাছে দূত পাঠায়। সামরিক হুমকি দিয়ে হোক, উপঢৌকনের বিনিময়ে হোক, সে দাবি আদায় করে নেয় ফরাসী, রুশ, জাপানী, ও অন্যান্য দেশ। সাথে মার্কিনরাও।

যুক্তরাষ্ট্রের নেভাডায় রেললাইন তৈরিতে নিযুক্ত চীনা শ্রমিক, ঊনবিংশ শতক

মার্কিন বণিকরা যখন চীনা বন্দরে ব্যবসারত, তখন চীনা শ্রমিকদেরও আগমন হতে থাকে ক্যালিফোর্নিয়াসহ অন্যান্য মার্কিন টেরিটরিতে। প্যাসিফিক রেলওয়ে লাইনে কাজ করে অনেকে, আবার নতুন আবিষ্কৃত স্বর্ণখনিতেও। স্বল্প সময়ের মধ্যে এত বেশি চীনা আসে যে অনেক মার্কিন নাগরিক চীনাবিদ্বেষ পোষণ করতে শুরু করে। পরবর্তীতে চীনা শ্রমিকদের প্রবেশ কয়েক দশকের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। তারপরও এখনো সান ফ্রান্সিস্কোতে অনেক পরিবারের দেখা মিলবে যারা সেই চীনাবংশোদ্ভূত।

শুধু যে শ্রমিকের আগমন হয় তা নয়। ১৮৫০ ও ১৮৬০এর দশকে তাইপিং নামে এক প্রলয়ংকরী গৃহযুদ্ধ হয় চীনে। চিং সাম্রাজ্য ছিল পতনের দ্বারপ্রান্তে। মার্কিন ও ইউরোপীয়দের প্রযুক্তিগত ও সামরিক সহযোগিতায় সে যাত্রা বেঁচে যায় হান জনগোষ্ঠীর ওপর শাসনরত বহিরাগত মাঞ্চুরিয়ান রাজপরিবার। এর পর তাদের উপলব্ধি হয় যে পশ্চিমা প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ না পেলে তারা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে না। চায়নিজ এডুকেশন মিশন নামে একটি প্রজেক্টে দেড়শ’র মত টীনেজ বয়েসী চীনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পড়তে আসে। এসব সাংস্কৃতিক লেনদেনে অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখেন আদিতে চীনে বাণিজ্যকরা মার্কিন ব্যবসায়ীরা আর তদকালীন স্টেট ডিপার্টমেন্ট।

কানেকটিকাটে চায়নিজ এডুকেশন মিশনের চীনা ছাত্রদের বেসবল টীম, ১৮৭৮
যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত চিং সম্রাটের রাষ্ট্রদূত লিয়াং চেং, চায়নিজ এডুকেশন মিশনে শিক্ষিত, বক্সার ইনডেমনিটি ফান্ডের প্রতিষ্ঠায় অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখেন, বিংশ শতকের প্রথমভাগ

চায়নিজ এডুকেশন মিশনে যারা প্রশিক্ষণ পেয়েছিল, এদের অধিকাংশ আর ফিরে যায়নি। চিং সম্রাট এদের পাঠালেও সম্রাটের হর্তাকর্তাদের মধ্যে একটা প্রতিক্রিয়াশীল দল ছিলই। এরা তাইপিং বিদ্রোহের জন্যে তাইপিং নেতার পশ্চিমা মিশনারি শিক্ষা, আর তার খ্রীষ্টান সিনক্রেটিক ধর্মকে দোষারোপ করে। তাছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে চীনাবিদ্বেষী মনোভাব থেকে ইমিগ্রেশনের ওপর কড়াকড়ি হবার কারণেও চায়নিজ এডুকেশন মিশন বন্ধ করার একটা চাপ আসে। ছাত্ররা বেশি বেশি পশ্চিমা ও “বিলাসী” হয়ে যাচ্ছে এমন জজবা তোলা হয়। তবে এদের মধ্যে যারা ফিরে গেছিল, তাদের অনেকেই চীনে পজিটিভ একটা অবদান রাখে। প্রজাতন্ত্রী চীনের একাধিক মন্ত্রী ও রাষ্ট্রনেতা ছিলেন মার্কিনশিক্ষিত। সামাজিক সংস্কার, বিশেষ করে নারীদের পা-বাঁধার কুসংস্কারের বিরুদ্ধেও আমাদের দেশের বিদ্যাসাগরের মত ভূমিকা রাখেন এসকল মার্কিনশিক্ষিত চীনারা।

১৯০৫এ কোরিয়ায় মোতায়েন জাপানী সৈন্য, লক্ষ্য করুন পশ্চিমা পোশাক ও অস্ত্রসজ্জা

জাপান সাগরের অপর পারে কিন্তু চলছিল চিংদের সংস্কারবিমুখতার বিপরীত চিত্র। জাপানীরা খুব দ্রুত পশ্চিমাদের সাথে বাণিজ্যের রাস্তা খুলে দেয়। পাশাপাশি বিভিন্ন পাশ্চাত্যদেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। নইলে তারা ১৮৫০এর দশক নাগাদ চীনের মতই বন্ধ দেশ ছিল। পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ ও কম্পানিকেও পরস্পরের সাথে প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত রেখে তারা নিজেদের আখেরটা গুছিয়ে নেয়। খুব দ্রুত একটা রাজনৈতিক ও শিল্পসংস্কার ঘটে যায় সে দেশে। অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে পরিণত হয় জাপান।

পশ্চিমা দেশগুলির সাথে চীনে “অধিকার আদায়ের” প্রতিযোগিতায় শামিল হয় জাপানও। নানা ছুঁতোয় কোরিয়া উপদ্বীপের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চীনের সাথে যুদ্ধ হয় জাপানের। সেটা ১৮৯৪/৯৫ সাল। পরাজিত চীন কোরিয়ায় জাপানের অধিকার মেনে নেয়, সাথে আরো কিছু সুযোগ সুবিধা ছেড়ে দেয়।

কাঁচি দিয়ে চীনের মানচিত্র কাটতে উদ্যত জার্মানি, ইতালি, ইংল্যান্ড, রাশিয়া, ফ্রান্স। মাঝখানে ওপেন ডোর পলিসির কাগজ হাতে বাগড়া বেঁধে দাঁড়িয়েছে আংকল স্যাম, পাক ম্যাগাজিন, ১৮৯৯

এখানেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম অবতীর্ণ হয় চীনের অখন্ডতা রক্ষায়। চীনের এই দুর্বল অবস্থার সুযোগে মুখিয়ে ছিল ব্রিটিশ, ফরাসী, জাপানী, রুশ সকলে। ল্য পতি জু্র্নাল নামের ম্যাগাজিনে তখনই সেই কেক কাটার কার্টুন প্রকাশিত হয়। এ সকল পরাশক্তি চীনকে টুকরো টুকরো করে যার যার নিজের “স্ফেয়ার অফ ইনফ্লুয়েন্স” বানানোর স্বপ্নে গোপনে এক অন্যের সাথে মোলাকাত করতে থাকে। ব্যাপারটা অনেকটা স্ক্র্যাম্বল ফর আফ্রিকার মত বড় একটা ভূখন্ড নিজেদের বোঝাপড়ার মাধ্যমে ভাগাভাগি করে নেয়া।

যুক্তরাষ্ট্রের ওপেন ডোর পলিসি নিয়ে ব্রিটিশ কার্টুন যে রুশ ভল্লুক ভদ্রভাবে মার্কিন ফ্রী ট্রেড লেডিকে চীনের ওপেন ডোর দিয়ে প্রবেশের অনুমতি দেবে (সার্কাজম অর্থে!), ১৮৯৯ পাঞ্চ ম্যাগাজিন

কিন্তু বাদ সাঁধে মার্কিনরা। তাদের নীতি ছিল “ওপেন ডোর পলিসি।” সে নীতি অনুযায়ী চীনে মুক্তবাণিজ্যের ক্ষেত্রে সকল দেশ সমান অধিকার ভোগ করবে। চীনের ভৌগোলিক-রাজনৈতিক অখন্ডতা বজিয়ে থাকবে। বাণিজ্যকর আদায়ের দায়িত্ব সম্পূর্ণ চিং সরকারের। বাংলায় ব্রিটিশরা যেমন মুঘল সম্রাটকে ঘুষ দিয়ে সে লাভজনক দায়িত্ব বাগিয়ে নিয়েছিল, সেটি হবে না। অন্যান্য পরাশক্তি মার্কিনদের এই ওপেন ডোর পলিসির সাথে একমত না হলেও নতুন পরাশক্তিটির ভৌগোলিক নিকটতা আর সামরিক শক্তির ভয়ে চুপচাপ সেটা মেনে নেয়। সে যাত্রা বেঁচে যায় চীন।

জাপানের সাথে যুদ্ধে হারার পর আবার একটা বোধোদয় ঘটে চীনের নেতৃত্বের মধ্যে। তরুণ সম্রাট গুয়াংশু রাজ্যের সুশিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের একটি ছোট দল নিয়ে নতুন করে একটি সংস্কার আন্দোলন দাঁড়া করানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু সে আশায় গুঁড়েবালি! একশ’ দিনের মাথায় রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়াশীল আমলা ও সেনানায়করা বিধবা রাণীমাতা সিশিএর নেতৃত্বে সংস্কারপন্থীদের ক্যুয়ের মাধ্যমে পদচ্যুত করে। অনেক বুদ্ধিজীবী নিহত হন, গুয়াংশু হন প্যালেস প্রিজনার। আবার অন্ধকার যুগে ফিরে যায় চীন।

চীনের অশীতিপর বৃদ্ধা বিধবা রাণীমাতা সিশি, চীনের সকল আধুনিকায়ন ও সংস্কার রহিত করেন, বক্সারদের উস্কানি দেন, ফলশ্রুতিতে চিং সাম্রাজ্যের শেষ ঘন্টা বেজে ওঠে, ১৯০০

প্রতিক্রিয়াশীলতার সাথে যুক্ত হয় সাধারণ মানুষের জাতীয়তাবাদী ক্ষোভ আর বিদেশীবিদ্বেষ। শহরে শহরে গড়ে ওঠে কুংফুএর মুগুরভাঁজা “বক্সার” ষন্ডাদের ক্লাব — অনেকটা অনুশীলন সমিতির মত। এবার চিং সাম্রাজ্যের প্রকাশ্য সমর্থন ও সহায়তায় প্রতিটি প্রদেশে এসকল বক্সার মব আক্রমণ করতে থাকে বিদেশী যে কোন কিছু। হোক খ্রীষ্টান মিশন, দোকানপাট, হাসপাতাল, স্কুল। এ অবস্থায় চিং সম্রাট ইচ্ছাকৃতভাবে হাত গুঁটিয়ে বসে থাকার কারণে বিদেশী চৌদ্দটি দেশ একসাথে একটি শান্তিরক্ষীবাহিনী পাঠায় চীনে। অনুপ্রবেশের দোহাই দেখিয়ে এদের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করে সিশির প্রতিক্রিয়াশীল সরকার। যেসব সংস্কার থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছিলেন সিশি, সেগুলির অভাবেই দ্রুত পরাজিত হয় কুস্তিগীর বক্সার বিপ্লবী আর চিং সেনাদল।

১৯১১ সালের পূর্বের মাঞ্চুরিয়ার মুগুরভাজা বক্সারদের চিত্র
১৮৯৯ সালের বক্সার বিদ্রোহের সময় বক্সার ও চিং সেনাদল পশ্চিমা, সন্দেহজনক পশ্চিমা চর ও খ্রীষ্টানদের ওপর বেধড়ক হত্যাকান্ড চালায়, ধ্বংস হয় তাদের জীবিকা

কিন্তু যে বিদেশী কনসার্নগুলির বিপুল ক্ষয়ক্ষতি বক্সার বিদ্রোহ থেকে হয়, তার পুরো ক্ষতিপূরণের দাবি থেকে মুক্তি পেলেন না সিশি। চিং সরকারকে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলিকে বিশাল পরিমাণের ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হতে হল। এ ছিল লাস্ট স্ট্র অন দ্য ক্যামেল’স ব্যাক। চিং সাম্রাজ্যের বাকি দিন ছিল হাতেগোনা।

বক্সার বিদ্রোহের ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু বাকি পরাশক্তিগুলোর থেকে ভিন্ন একটা পন্থা অবলম্বন করে। বক্সারের ক্ষতিপূরণ থেকে একটা বিশাল অংশ যুক্তরাষ্ট্রের হাতে উদ্বৃত্ত রয়ে যায়। ১৯০৮ সালে কংগ্রেস ঠিক করে যে এ টাকা চীনকে ফিরিয়ে দেয়া হবে। এ চিন্তাটি আর কোন পরাশক্তি করেওনি। যুক্তরাষ্ট্রে চালু হয় বক্সার ইনডেমনিটি স্কলারশিপ নামে একটি বিখ্যাত এডুকেশন ফান্ড। এর মাধ্যমে প্রচুর চীনা ছাত্র আবারও পড়তে আসে যুক্তরাষ্ট্রের নামীদামী বিশ্ববিদ্যালয়ে। এদের অনেকেই পরে প্রজাতন্ত্রী ও গণপ্রজাতন্ত্রী কম্যুনিস্ট চীনা মূল ভূখন্ড আর তাইওয়ানে বিদ্বান ও বিজ্ঞানী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হন। বক্সার ইনডেমনিটি ফান্ড থেকে বেজিংএ একটি প্রযুক্তি কলেজও শুরু হয়, যার নাম ছিংহুয়া। এটি কিন্তু এখনও গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের এক নাম্বার বিদ্যাপীঠ।

বক্সার ইনডেমনিটি স্কলারশিপ পাওয়া প্রথম ব্যাচের ছাত্রছাত্রী, ১৯০৯ সাল। সামনের সারিতে বসা ভবিষ্যৎ প্রজাতন্ত্রী প্রেসিডেন্ট চৌ জিচি।
বক্সার ইনডেমনিটি স্কলারশিপের টাকায় প্রতিষ্ঠিত চীনের নাম্বার ওয়ান বিশ্ববিদ্যালয় ছিংহুয়ার বর্তমান চিত্র

ওদিকে ১৯০৫এ রুশ-জাপানী যুদ্ধের পর আবারও জাপান মাঞ্চুরিয়া ও উত্তর-পূর্ব চীনে রুশদেরকে সরিয়ে নিজেদের প্রভাব বাড়াতে সচেষ্ট হয়। তখনো মার্কিনরা যুদ্ধ ব্যতিরেকে কূটনীতির মাধ্যমে চীনের অখন্ডতা নিশ্চিত করে। চীনের চলমান সংস্কারেও মার্কিন সাহায্য আসতে থাকে। ১৯১২ সালে বিপ্লবের মাধ্যমে প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয় চীন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানায়। একই সাথে ওপেন ডোর পলিসির প্রতি নতুন করে আস্থা ব্যক্ত করে।

১৯১১ সালের শিনহাই বিপ্লবের মাধ্যমে চীনের চিং সাম্রাজ্যের উচ্ছেদ হয়, প্রতিষ্ঠিত হয় প্রজাতন্ত্রী সরকার
চীনা বিপ্লবের পুরোধা সুন ইয়াত সেন, ১৯১০, ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত হাওয়াইয়ে মার্কিন শিক্ষায় শিক্ষিত হন
ইউয়ান শিকাই, চীন প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি, ১৯১৫। সুন ইয়াত সেনের পরিবর্তে তাকে আপোষে রাষ্ট্রপতি বানানো হয়। পরে নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করতে গিয়ে পুরো দেশে বিশৃংখলা অরাজকতার জন্ম দেন এই পুরনো ধাঁচের চিং জেনারেল।

তবে ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে আবার বিপদে পড়ে যায় চীন। ব্রিটিশদের অনুরোধে জাপান মিত্রপক্ষে যোগ দেয়। কারণ আর কিছুই না। চীনের যে স্বল্প কিছু অংশে জার্মান কলোনি ছিল সেগুলি কব্জা করা। ব্রিটিশরা সেটা মেনে নেয়। কিন্তু জাপানীদের লোভ ছিল আরো বিস্তৃত। একুশ দফা নামে ১৯১৫ সালে তারা একটি আলটিমেটাম দেয়। এর সারবত্তা ছিল চীনের সকল কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক আর প্রশাসনিক দায়িত্ব জাপানের কাছে ছেড়ে দিতে হবে। সোজা কথায় চীন পরিণত হবে জাপানীপ্রশাসিত চীনে। যেখানে চীন নামটা ঠিক থাকবে, কিন্তু আসলে পরিচালিত হবে জাপানীদের দ্বারা।

ইউরোপের যুদ্ধে ব্যস্ত থাকা ব্রিটিশ ও আমেরিকানরা জাপানীদের সুযোগ নিয়ে এমন খাইখাই করাটা একদম সহ্য করেনি। তারা এই আল্টিমেটাম পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করে। মার্কিনরা উল্টো চীনা সরকারকে বলে দেয় যেকোন মূল্যে জাপানকে রুখতে, যুক্তরাষ্ট্রের তাতে সমর্থন থাকবে। অবস্থা বেগতিক দেখে জাপানীরা পিছপা হয়। খুব সামান্য অর্জনের বিনিময়ে তারা খোয়ায় ব্রিটিশ ও মার্কিনদের বিশ্বাসভাজনতা। এ ব্যাপারটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপূর্ব ঘটনাবলীতে প্রভাব রাখে।

অর্থাৎ এ যাত্রাও চীন বেঁচে যায়। তবে তাদের মূল্যও দিতে হয়। ১৯১৭ সালে সেদেশে বিশৃংখলা শুরু হয়ে যায়। কেন্দ্রীয় সরকার প্রদেশগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। সেসব এলাকা স্থানীয় “ওয়ারলর্ডদের” শাসনাধীন হয়। তারা নামকাওয়াস্তে কেন্দ্রীয় প্রশাসনের নামে নিজ নিজ এলাকায় শাসন করতে থাকে। এই অবস্থায় মার্কিনদের সম্পূর্ণ সমর্থন ছিল কেন্দ্রীয় জাতীয়তাবাদী সরকারের সাথে। আর রুশ-জাপানীদের পলিসি ছিল একেক ওয়ারলর্ডকে পয়সা খাইয়ে নয়ত একের বিরুদ্ধে আরককে লড়িয়ে নিজেদের সুবিধা উদ্ধার।

১৯১৯এর ভের্সাই ট্রীটিতেও চীন ব্যর্থ হয় শানদং উপদ্বীপে প্রাক্তন জার্মান, এখন জাপানের শাসনাধীন কলোনি পুনরুদ্ধার করতে। এর জন্য বহু চীনা নাগরিক মার্কিন প্রেসিডেন্ট উইলসনকে দোষারোপ করে। কিন্তু আসল ঘটনা হল, চীনা সরকার ভের্সাই ট্রীটির আগেই জাপানীদের সাথে আলদা গোপন চুক্তি করে সে দাবি ছেড়ে দেয়ায় উইলসনের আর কিছু করার ছিল না।

১৯২০/৩০এর দশকে শাংহাইয়ে মার্কন ধাঁচের জ্যাজ ব্লুজ সঙ্গীত ছিল জনপ্রিয়। চীনা সঙ্গীতের সাথে মিলে নতুন ধরনের মিশ্র গীতিবাদ্যের জন্ম হয়।

তবে বিশের দশকে কূটনীতির জোরে জাপানের এসকল আগ্রাসী কার্যকলাপকে পিছিয়ে দিতে সক্ষম হয় মার্কিনসহ অন্যান্য পরাশক্তি। বিশ-ত্রিশের দশক ছিল পাশ্চাত্য আর চীনা প্রগতিশীল নেতৃত্বের সুসম্পর্কের স্বর্ণযুগ। শাংহাই ছিল চীনা জ্যাজ-ব্লুজ সিনক্রেটিজমের ক্যাপিটাল, আর পূর্ব এশিয়ার ফাইন্যানশিয়াল ক্যাপিটাল। হংকংয়ের সাথে পাল্লা দেবার মত শহর ছিল সেটি।

১৯২৭-২৮ সালের মধ্যে প্রায় পুরো চীনকে একত্রিত করতে সক্ষম হয় কুওমিনতাং পার্টি। তাদের রাজধানী ছিল নানজিংয়ে। নতুন করে এরা পাশ্চাত্য ও মার্কিনদের স্বীকৃতি পায়। কিন্তু হয় জাপানের চক্ষুশূল। ১৯৩১ সালে জাপানী সেনাবাহিনীর একদল ষড়যন্ত্র করে মাঞ্চুরিয়াতে মুকদেন ফল্স ফ্ল্যাগ ইনসিডেন্টের ছুঁতোয় চীনের ওপর একতরফা আক্রমণ করে। জাপানের অভিযোগের সত্যতা যাচাই করতে আসে ব্রিটিশ লর্ড লিটনের নেতৃত্বে একটি আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানকারী দল। চীনের পক্ষে তাদের রায় গেলে লীগ অফ নেশনস থেকে সদস্যপদ প্রত্যাহার করে জাপান। এসব ঘটনা টিনটিনের কমিক পাতাতেও এসেছে।

১৯৩৩ সালে লীগ অফ নেশনস থেকে জাপানের ওয়াক আউটের দৃশ্য এভাবে কমিক বইয়ের পাতায় তুলে ধরেছেন বেলজিয়ান শিল্পী এর্জে।

মাঞ্চুরিয়ায় একতরফা জাপানী দখলদারিত্ব আর প্রাক্তন চীনা সম্রাট পু’য়ীর পুতুল সরকার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পায়নি। যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক মহলে এর বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। জাপান বাণিজ্যিকভাবে একঘরে হয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের সাথে তাদের অনেক লাভজনক লেনদেন ছিল। জাপানের এমন কট্টরপন্থার পেছনে ছিল তাদের আর্মির এক অতি-জাতীয়তাবাদী ফ্যাকশন, যারা ত্রিশের দশকে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে সমর্থ হয়।

১৯৩৭ সালের নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার রিপোর্টে এসেছে চীনা রাজধানী নানকিংয়ে ব্যাপক জাপানী বোমাবাজির ক্ষয়ক্ষতিতে আহতদের সহায়তায় কিভাবে এগিয়ে এসেছে স্থানীয় মার্কিনরা।

মাঞ্চুরিয়ান ইনসিডেন্টের কপি-পেস্ট ১৯৩৭ সালে মার্কো পোলো ব্রিজ ইনসিডেন্ট ঘটে। শুরু হয় দ্বিতীয় চীন-জাপান যুদ্ধ। চীনে অবস্থানরত মার্কিন নাগরিকরা চীনা সাধারণ মানুষের জন্য ত্রাণ প্রচেষ্টার আয়োজন করে। বহুর্বিশ্বে জাপানীদের নিষ্ঠুরতাকে হেডলাইনে প্রকাশ করতে সাহায্য করে। “নানজিংয়ের ধর্ষণের” মত ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ দেখে আন্তর্জাতিক মহলের আর ভাবনার অবকাশ থাকে না যে, সাম্রাজ্যের জন্য ক্ষুধিত ক্ষমতালিপ্সু জাপানী মিলিটারি হুন্তা কতদূর যেতে পারে। পরবর্তীতে অ্যাটম বোমা ফেলার মত সিদ্ধান্তে এসব ঘটনা ভীষণ প্রভাব ফেলে।

জাপানের বিরুদ্ধে মুক্তি সংগ্রামে চীনের প্রজাতন্ত্রী জাতীয়তাবাদী সরকার নয় শুধু, মাওজেদংয়ের কম্যুনিস্টদেরও সহায়তা দেয় মার্কিনরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ ও রুশদের যে লেন্ডলীজ পদ্ধতিতে মার্কিন সামরিক সহায়তা দেয়া হয়েছিল, তার শুরু আসলে এই চীনা সহায়তার মধ্য দিয়ে। সামরিক রসদের চালান যেত দুর্গম বার্মা রোড দিয়ে। ব্রিটিশ কনভয়ে যেত মার্কিন অস্ত্র। জাপানীরা বার্মা দখল করলে সে কাজের দায়িত্ব নেয় ফ্লায়িং টাইগারস নামে ব্রিটিশ ও মার্কিন আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবক পাইলটদের দল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার আগেই চীনের সাথে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন অসম চুক্তি রদ করা হয়, সকল ট্রীটি পোর্ট ফিরে যায় চীনের কাছে। শাংহাইয়ের ইন্টারন্যাশনাল লেগেশনও। যুদ্ধের পর মার্কিন সমর্থনের কারণেই জাতিসংঘে স্থায়ী আসনটি পায় প্রজাতন্ত্রী চীন।

দুর্গম বার্মা রোড দিয়ে মার্কিন ও ব্রিটিশ রসদ যেত জাপানের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত চীনা সেনাবাহিনীর কাছে, ১৯৪১
বার্মা জাপানী দখলে চলে যাবার পর দুর্গম পর্বতের প্রতিকূল আবহাওয়া উপেক্ষা করে চীনাদের কাছে রসদ নিয়ে পৌঁছে দিত ফ্লায়িং টাইগার্স নামে এই মার্কিন স্বেচ্ছাসেবক পাইলটের দল, ১৯৪৩

কম্যুনিস্টদের সাথে জাতীয়তাবাদীদের গৃহযুদ্ধেও মধ্যস্থতার একটা ইনিশিয়াল প্রচেষ্টা হয় মার্কিনদের থেকে। কিন্তু সোভিয়েত প্রভাব আর কোল্ড ওয়ার ডায়নামিক্সের কারণে সেগুলি সাফল্য পায়নি। কম্যুনিস্টদের ক্ষমতা দখলের ফলে ওপেন ডোর পলিসির আর কোন প্রয়োজন থাকে না। বাকি বিশ্ব থেকে আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে চীনের মূল ভূখন্ড।

কোরিয়ান যুদ্ধে প্রথম চীনা কম্যুনিস্ট লালফৌজ আর মার্কিন সামরিক শক্তি মুখোমুখি হয়। এ ছাড়া আর কখনো দেশ দুটি একে অপরের বিরুদ্ধে লড়েনি। চীনাদের হিউম্যান ওয়েভ আক্রমণের বিরুদ্ধে জেনারেল ম্যাকার্থার অ্যাটম বোমা আক্রমণ চালাতে চেয়েছিলেন। তার পাগলামো থামানোর জন্য তাকে পদচ্যুত করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান স্বয়ং — জাপানে অ্যাটম বোমা ফেলার দায় চাপানো হয় যার ওপর।

সত্তর দশকে চীন-সোভিয়েত শত্রুতা চরমে উঠলে তার সুবিধাটা বাগিয়ে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সঠিক মানবিক অবস্থানটি ভেতরে ভেতরে থাকলেও নিক্সন প্রশাসন গোপনে চীনের সাথে চ্যানেল তৈরি করে ইয়াহিয়া সরকারের মধ্যস্থতায়। সে কারণে সকল ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সরাসরি বিরোধিতা তারা করতে পারেনি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে চীনের অবস্থান ছিল খোলাখুলিরকম স্বাধীনতাবিরোধী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তেমনটা ছিল না।

চীন-মার্কিন এই দেতঁতের কারণেই কম্যুনিস্ট চীন জাতিসংঘে প্রজাতন্ত্রী চীনের স্থায়ী আসনটি পায়। নইলে সে ভোটটি ছিল তাইওয়ানের হাতে। সেই ওপেন ডোর পলিসির উত্তরাধিকার ধরেই তাইওয়ানকে এখনও অখন্ড চীনের অংশ হিসাবে স্বীকার করে যুক্তরাষ্ট্র। তাইওয়ানের কোন দূতাবাস ও অফিশাল কূটনৈতিক মিশন যুক্তরাষ্ট্রে নেই। আছে কেবল কালচারাল মিশন।

সারমর্মে সেঞ্চুরি অফ হিউমিলিয়েশনের নাম ধরে যে মড়াকান্নাটা চীনারা এখনো দেয়, সে সেঞ্চুরিটি আরো খারাপ হতে পারত তাদের জন্য। বেঁচে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের কারণে। এর কারণ যে যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের স্বার্থ শুধু দেখতে পেয়েছে তা নয়। ১৮৯০এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মত প্রাক্তন স্পেনীয় কলোনিগুলিকে হস্তগত করে নিজেদের একটা ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য বানানোর অবস্থানে ছিল। অন্যান্য পরাশক্তির সাথে যোগসাজশে চীনকেও কেটেছিঁড়ে খাবার একটা সুযোগ যুক্তরাষ্ট্রের ছিল। সেটা ঘটেনি। অষ্টাদশ শতকে ওরিয়েন্টাল সভ্যতা বিশেষত চীনা সভ্যতার ব্যাপারে মার্কিনদের একটা ফ্যাসিনেশন ছিল। রোমান বা গ্রীক সভ্যতার প্রতি আকর্ষণের থেকে সেটা কম ছিল না। ফাউন্ডিং ফাদারদের অনেকেই চীনা সভ্যতার প্রশংসা করে গেছেন। এ সম্মানটার কারণেই চীন প্রচুর সহমর্মিতা সমবেদনা আর সহায়তা যুক্তরাষ্ট্র থেকে পায়।

বর্তমান যুগের চীনা-মার্কিন শত্রুতার নেপথ্যে চীনা সংস্কৃতি-সভ্যতা বাঁধা নয়। বাঁধা কম্যুনিজম, একদলীয় শাসনব্যবস্থা, চীনা সম্প্রসারণবাদ ও বাণিজ্যে অসম সুবিধাভোগ। যদি চীনে কোন এক স্বপ্নের যুগে সিসিপি’র বিনাশ ঘটে, যুক্তরাষ্ট্র আর সে দেশটি নিঃসন্দেহে বন্ধুতার বহু প্রাচীন ইতিহাস খুঁজে পাবে। এতে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই!

হাইতি – ৩, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, ১৮৬০-১৯১০

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে হাইতি, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেরও, সম্মানজনক অবস্থান ঊনবিংশ শতকে ছিল না। দুটি দেশই দুই পরাশক্তির বিরুদ্ধে রক্তাক্ত স্বাধীনতাযুদ্ধ করেছে। বিশেষত, হাইতিতে ফরাসী শ্বেতাঙ্গ খামারমালিকরা সপরিবারে গণহত্যার শিকার হয়। ফ্রান্স তাই হাইতিকে তাদের উপনিবেশই ধরত, আর বাকি ইউরোপীয় শক্তিগুলি ফ্রান্সের আগ বাড়িয়ে কূটনৈতিক সম্পর্কস্থাপনে আগ্রহী ছিল না।

তাই হাইতির বন্দরগুলিতে মার্কিন, জার্মান আর ব্রিটিশ জাহাজের আনাগোনা থাকলেও বড় ধরনের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যচুক্তি করার সামর্থ্য হাইতি সরকারের ছিল না। এই দুর্বলতার সুযোগ নিতে ফ্রান্স হাইতিতে দূত পাঠায়। তাদের শর্ত, স্বাধীনতাযুদ্ধে যে ফরাসী সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার জরিমানা দিলে ফ্রান্স হাইতিকে স্বীকৃতি দেবে।

উত্তর হাইতির রাজা ক্রিস্তফ ফরাসীদের একদমই বিশ্বাস করতেন না। তার দরবারে পাঠানো ফরাসী দূতকে হত্যার নির্দেশ দেন তিনি। ঠিক তখনই দূতের হাত থেকে গোপন ফরাসী সরকারী নির্দেশনা এসে পড়ে ক্রিস্তফের কাছে। তার ভয় অমূলক ছিল না! দূতের কাছে নির্দেশ ছিল, শর্তে রাজি না হলে নিকটস্থ ফরাসী নৌবাহিনীকে সংকেত পাঠাতে, যেন তারা ক্রিস্তফের বন্দরগুলিতে আক্রমণ চালায়।

এসব নাটকীয়তার ফলে ফরাসীদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির ব্যাপারটা পিছিয়ে এসে পড়ে ১৮২৫ সালে। রাষ্ট্রপতি বোয়াইয়েরের কাছে ফরাসীরা আবার দূত পাঠায়। ক্ষতিপূরণের অংক তারা ঠিক করে পনের কোটি ফ্রাংক — আজকের হিসাবে ৩৫০ কোটি ডলার! সামর্থ্যে না কুলালে ফরাসী ব্যাংকও প্রস্তুত রয়েছে দীর্ঘকালীন ঋণ দিতে!

হাইতির সরকারী বাজেট কমিশন এই ব্যাপারে না আগাতে বোয়াইয়েরকে সুপারিশ করে। কিন্তু একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রপতি বোয়াইয়ের তার তোয়াক্কা না করে এতে রাজি হয়ে যান। এই একতরফা সিদ্ধান্তের মাশুল হাইতিবাসীকে গুনতে হবে প্রায় একশ বিশ বছর! সুদে-মূলে যত টাকা এতে খরচ হবে, তাতে হাইতিতে উন্নতমানের জনপথ-নৌবন্দর-বিশ্ববিদ্যালয়-হাসপাতাল হতে পারত অনেক।

ফরাসী দূতের সাথে ইনডেমনিটি সম্মেলনে রাষ্ট্রপতি বোয়াইয়ের, ১৮২৫। ১৮৬৪ সালে প্রকাশিত ফরাসী বইয়ে দেখানো চিত্র।

হাইতির সরকারী কোষাগারের সীমিত সম্পদের সিংহভাগই খরচ হয়ে যেত সেনাবাহিনী পালতে। তাদের মূল কাজটা আবার দেশরক্ষার চেয়ে বেশি বিপ্লবীদের ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করা। হাইতির বাজেটের ১ শতাংশেরও কম খরচ হত শিক্ষাক্ষেত্রে। বোয়াইয়ের চাইলে ফরাসী দাবি কানে না তুলে সরাসরি তাদের প্রতিযোগী জার্মানি আর আমেরিকার সাথে সম্পর্কস্থাপনে মনোযোগ দিতে পারতেন। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির রাস্তা কার্যত তৈরি হয়ে যেত।

বোয়াইয়েরের তো জাতীয়তাবাদী অহংকার ছিলই, তাছাড়াও তিনি হিসাব কষেছিলেন যে ফ্রান্সের স্বীকৃতি পেলে হাইতিতে বৈদেশিক বিনিয়োগ ও বাণিজ্য বাড়বে। তা বেড়েছিল কিছুটা, কিন্তু তার সাথে সাথে নতুন নতুন সমস্যার সম্মুখীন হয় হাইতি। মুক্তবাণিজ্যের রাস্তা ধরে হাইতিতে বিভিন্ন দেশ থেকে অভিবাসন বৃদ্ধি পায়। জার্মান বণিকরা হাইতির বন্দরগুলিতে আমদানি-রপ্তানির কারখানা খুলে বসে। আইনানুযায়ী তারা সম্পত্তির মালিক হতে না পারলেও, স্থানীয় নাগরিক বিয়ে করে সে আইন পাশ কাটানো সম্ভব ছিল।

তাও যদি হাইতিতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকত, মুক্তবাণিজ্য আর শিক্ষাদীক্ষার মাধ্যমে নাগরিকদের মুক্তি আর সমৃদ্ধি আসতে পারত। কিন্তু রাষ্ট্রপতি বোয়াইয়েরকে তাড়িয়ে সম্রাট সুলুক, তারপর ১৮৫৯এ তাঁকেও খেদিয়ে রাষ্ট্রপতি জেফ্রার — এভাবে ১৮৪৩ থেকে ১৮৮৯এর মধ্যে ১২জন রাষ্ট্রনায়ক দেশ পরিচালনা করেন, আর গঠনতন্ত্র পরিবর্তিত হয় ৮বার। কিন্তু আসল সমস্যাগুলির কোন পরিবর্তন হয় না।

মার্কিন ম্যাগাজিন হার্পারস উইকলিতে হাইতির নতুন প্রেসিডেন্ট সালনাভের ছবি, ১৮৬৭। একই পৃষ্ঠার নিচে ডানের চিত্রঃ আমেরিকায় প্রথম কৃষ্ণাঙ্গরা ভোট দিচ্ছে ওয়াশিংটন ডিসির একটি স্থানীয় নির্বাচনে।

প্রদেশগুলিতে সেনাশাসকরাই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিল। বড় খামারগুলো তাদের অফিসারদের দখলে। নির্বাচন হলেও সেগুলি নামেমাত্র, আর ফলাফল পছন্দ না হলে তো বিপ্লব আর অভ্যুত্থানের রাস্তা আছেই! রাষ্ট্রপতি গদিতে বসামাত্রই প্রাসাদে গিয়ে সৈন্যসামন্ত নিয়ে এমন ঘাঁটি গাড়তেন, যেন স্বদেশীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছেন তিনি!

এসব গোলমালের ফলে বৈদেশিক সম্পত্তির ক্ষতি হওয়া ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। জার্মান বা ব্রিটিশ বাণিজ্যিক স্বার্থের ক্ষতি সাধিত হলে, সেসব দেশের যুদ্ধজাহাজ হাইতির সাগরে টহল দিত আর বন্দরগুলির দিকে কামান তাগ করে থাকত। ক্ষতিপূরণ আদায় না হওয়া পর্যন্ত হুমকির মুখে থাকত হাইতির বন্দর ও বাণিজ্য।

হাইতির আরও বড় মাথাব্যথার কারণ ছিল আন্তর্জাতিক ঋণ। ফ্রান্সের সেই ইনডেমনিটির কিস্তি শোধ করতে গিয়ে আরো পর্যায়ক্রমিক ঋণ হাইতি নেয় যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও ব্রিটেনের কাছ থেকে। ১৮৬০এর দশকে বাজেটের ৩০% যেত সামরিক খাতে আর ২৫% ধারের কিস্তি পরিশোধ করতে। ১৮৯৮ নাগাদ ধারশোধের ভাগ হয়ে দাঁড়ায় ৫০%, ১৯১৩ নাগাদ ৬৭%। এক পর্যায়ে ফরাসী একটি ব্যাংক হাইতির কোষাগারের ‘ইজারা’ নেয়, তারাই ছাঁপাত হাইতির ব্যাংকনোট, আর সেভাবে দেশটির অর্থনীতিতে একটা বড় প্রভাব বিস্তার করে ফ্রান্স।

জার্মান অ্যালবামে ছাঁপানো হাইতির অনুপম দৃশ্যাবলী, ঊনবিংশ শতকে বহু জার্মান অভিবাসী হাইতিতে আবাস গাড়ে। ১৮৯৭ সালে ছাঁপানো এনগ্রেভিং।
১৮৯৭ সালে জার্মান এক নাগরিককে হাইতির আইনশৃংখলাবাহিনী চুরির দায়ে গ্রেপ্তার করলে জার্মানি শার্লট নামে এই যুদ্ধজাহাজ পাঠায় হাইতিতে, শক্তিপ্রয়োগের ভয় দেখিয়ে তার নাগরিককে মুক্ত করার প্রয়াস। ইউরোপীয় পরাশক্তিগুলি এরকম নানাভাবে ব্ল্যাকমেইল করে এসেছে হাইতিকে। ফিরম্যাঁর মত কূটনীতিবিদদের লক্ষ্য ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের মত শক্তিশালী দেশের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্কস্থাপন করে ইউরোপীয়দের প্রভাবহ্রাস।

এ সময়টা অবশ্য পৃথিবীর আরো অন্যান্য জায়গার মত হাইতির শিল্প-সংস্কৃতির জন্যেও একটা রেনেসাঁর যুগ ছিল। আমেরিকা-ইউরোপে শিক্ষিত গুণীজন আর অভিবাসীদের সমাগমে হাইতির শহরগুলিতে একটা মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে ওঠে। এরাই নানা সময়ে হাইতির একনায়কদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, যদিও তাদের বিপ্লবগুলিতেই নিহিত ছিল নতুন কোন একনায়কতন্ত্রের বীজ।

১৮৭০এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কৃষ্ণাঙ্গ ধর্মপ্রচারক জোসেফ হোলি দানের টাকায় মুক্তিপ্রাপ্ত ক্রীতদাসদের হাইতিতে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলবায়ুতে অভ্যাস না থাকায় রোগে-জরায় এদের অনেকে মারা যায়।

একই সময়ে ইউরোপীয় খ্রীষ্টান মিশনারিরা পশ্চিমা শিক্ষাব্যবস্থাও নিয়ে আসেন হাইতিতে। গ্রামাঞ্চলের দিকে তারা ছড়িয়ে পড়তে থাকলে সংঘাতের ক্ষেত্র তৈরি হয় সনাতন বিশ্বাসীদের সাথে। সহজ-সরল গ্রাম্য হাইতিবাসী ছিল কুসংস্কারাচ্ছ্ন্ন, ভুডুতে বিশ্বাসী। বহুবিবাহেরও প্রচলন ছিল। খ্রীষ্টান পাদ্রীরা এসবের পরিবর্তনের চেষ্টা করেন। ভুডুবিশ্বাসীদের নরবলি-নরমাংসভক্ষণের গুজব হাইতির শহরগুলিতেও শোরগোল তোলে। স্বদেশের পশ্চাদপসরতা নিয়ে একটা হীনমন্যতা গড়ে ওঠে শহরবাসী দোআঁশলা সুধীসমাজের মধ্যে। তারাও উঠে পড়ে লাগে অবস্থার পরিবর্তনের জন্যে। রাজনীতিতেও সেসবের প্রভাব এসে পড়ে।

হাইতির নতুন শিক্ষিত কাতারের একজন ছিলেন অঁতেনর ফিরম্যাঁ। পেশায় সাংবাদিক, ফ্রান্সে কাটিয়েছেন যুবাবয়স। ইউরোপে তখন ‘রেইস থিওরি’ নামে একটি সিউডোসায়েন্টিফিক তত্ত্ব বেশ চালু। এ তত্ত্বের প্রবক্তরা যৌক্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রমাণের চেষ্টা করেন যে, ককেশিয়ান আর্যজাত মানবজাতির শ্রেষ্ঠতম, আর কৃষ্ণাঙ্গরা গায়েগতরে শক্তি ধরলেও মগজের জোরে সকলের অধম। ফিরম্যাঁ কয়েকটি প্রবন্ধ ও একটি বই প্রকাশ করে এদের যুক্তিখন্ডন করেন। এসব গবেষণা করতে গিয়ে হাইতির বহু লোকসংস্কৃতির সাথে পরিচিত হন তিনি। এভাবে পুরোদস্তুর নৃতত্ত্ববিদ বনে যান।

১৮৮৯ সালে ফিরম্যাঁ দেশে ফিরে রাজনীতিতে জড়িত হয়ে পড়েন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে হাইতির বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক আরো দৃঢ় করতে আগ্রহী ছিলেন। কৃষ্ণাঙ্গ সংস্কৃতির পুরোধা হলেও ফিরম্যাঁ পপুলিস্ট রাজনীতিতে একদম বিশ্বাস করতেন না। তার দর্শন ছিল, দেশ পরিচালনার জন্যে দরকার হাতেগোনা কিছু অভিজ্ঞ দেশপ্রেমী নেতা। ফিরম্যাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারা হাইতির শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে।

অঁন্তেনর ফিরম্যাঁ (১৮৫০-১৯১১), হাইতিয়ান রাজনীতিবিদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, দার্শনিক, নৃতত্ত্ববিদ, সাংবাদিক।

যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য ১৮৮০র দশকের আগে হাইতিকে নিয়ে খুব একটা আগ্রহী ছিল না। পার্শ্ববর্তী ডমিনিকান রিপাবলিকের ঋণলাঘবের বিনিময়ে নতুন স্টেট হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রে যোগদানের একটা কথাবার্তা অনেকদিন চলে। কিন্তু মার্কিন সেনেট সে প্রস্তাবনা ১৮৭৪এ নাকচ করে দেয়।

হিস্পানিওলা দ্বীপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ আরো বাড়তে শুরু করে স্টীমশিপের কারণে। স্টীমশিপ তখনকার বিশ্বকে সংযুক্ত করে ফেলেছে, আরেক গ্লোবালাইজেশনের যুগ চলছে তখন (জুল ভার্নের ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেইজ’ রচনার সময়কাল ১৮৭২)। আটলান্টিক অতিক্রম করতে সময় লাগে মোটে ৭ দিন! কিন্তু স্টীমশিপের জন্যে যেটা বেশ জরুরী সেটা হল কোলিং স্টেশন — এঞ্জিনে কয়লা ভরার বন্দর। প্রশান্ত মহাসাগরে এর প্রয়োজন থেকেই জাপানের বন্দরগুলি উন্মুক্ত করতে ১৮৫৪তে মার্কিন অ্যাডমিরাল পেরিকে পাঠানো হয়। হাইতিও ছিল ক্যারিবিয়ান এলাকায় কোলিং স্টেশনের একটা উত্তম অবস্থান।

ওদিকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে টাকা ধার করে হাইতি সময়মত পরিশোধ করতে পারছে না। বছরে বছরে বিপ্লবের ফলে বিনিয়োগকারীদেরও কোন নিশ্চয়তা নেই। সব মিলিয়ে হাইতির রাজনীতিতে নাক না গলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোলিং স্টেশনের চাহিদাপূরণের তেমন কোন উপায় ছিল না, বিশেষ করে যখন ফিরম্যাঁর মত রাজনীতিবিদ ও তাঁর সমর্থকরা যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সমর্থন চাইছে। হাইতিতে হস্তক্ষেপের যত অজুহাত ও লেভারেজ দরকার, সবই যুক্তরাষ্ট্রের ছিল।

১৮৮৯ সালে হাইতির মোল-স্যাঁ-নিকোলা দ্বীপে নৌঘাঁটি করার জন্যে যুক্তরাষ্ট্র রাষ্ট্রপতি লেজিতিমকে পীড়াপিড়ি করে। তাতে কাজ না হওয়ায়, উত্তর হাইতির বিদ্রোহীদেরকে তারা ইন্ধন দিতে শুরু করে — ফিরম্যাঁ ছিলেন এদলে। উত্তরের সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে আন্দোলনের মুখে সরকারের পতন হয়। নির্বাচিত নতুন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন অঁতেনর ফিরম্যাঁ।

যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিবিদরা ফিরম্যাঁকে বেশ সম্মান করত। দ্বিপাক্ষিক সংলাপে সরাসরি অংশ নেন ফিরম্যাঁ ও মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ মুক্তির পথিকৃত ফ্রেডরিক ডগলাস। প্রাক্তন দাস ডগলাস হাইতিতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন। শুধু হাইতির সাথে ভ্রাতৃপ্রতিম কূটনৈতিক সম্পর্ক নয়, ডমিনিকান রিপাবলিক মার্কিন স্টেট হলে কিংবা ক্যারিবিয়ানের কৃষ্ণাঙ্গপ্রধান ছোট দ্বীপগুলোর নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্র নিলেই তাদের মঙ্গল হবে, এটা ছিল ডগলাসের দৃঢ় বিশ্বাস। অর্থাৎ এসব কৃষ্ণাঙ্গপ্রধান দেশগুলির একরকম মার্কিন ‘উপনিবেশায়ন’ ফ্রেডরিক ডগলাস নিজেই সমর্থন করতেন।

ফ্রেডরিক ডগলাস (১৮১৭-৯৫), প্রাক্তন দাস, মার্কিন কূটনীতিক, বিশিষ্ট বক্তা, লেখক, অ্যাবলিশনিস্ট, ১৮৭২ সালের নির্বাচনে ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী, হাইতিতে প্রেরিত মার্কিন দূত (১৮৮৯-৯১)।

ফিরম্যাঁ ডগলাসের সাথে সংলাপ চালিয়ে গেলেও তাকে মিথ্যে আশ্বাস দেননি, কারণ সংবিধান অনুযায়ী হাইতির সীমানায় বিদেশীদের কাছে জমিবিক্রি বারণ। ডগলাসও ওয়াশিংটনে বার্তা পাঠান হাইতিকে চাপাচাপি না করার জন্যে। সে কথা গায়ে না মেখে যখন যুক্তরাষ্ট্রের হর্তাকর্তারা সাতটি যুদ্ধজাহাজ পাঠান হাইতির সাগরে, তখন ফিরম্যাঁই প্রথম মার্কিন নৌবন্দরের প্রস্তাব নাকচ করে দেন। তার লেখা প্রতিবাদলিপির বাগ্মীতার কাছে হার মেনে মার্কিন নৌবাহিনী জাহাজ ফিরিয়ে নেয়। ডগলাসও বেশ মনোক্ষুন্ন হন।

এরপর ফিরম্যাঁ রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্রে বেশ কিছু সংস্কারের প্রস্তাব আনেন। মার্কিনদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের খাতিরে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সহজ করার জন্যে কিছু প্রস্তাবও তোলা হয়। তার একটি ছিল শ্বেতাঙ্গদের সম্পত্তির মালিকানার ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার। রাষ্ট্রপতির সেনেটর মনোনয়নের ক্ষমতা রহিত করা হয়। আরো বহু মানুষকে ভোটাধিকারের আওতায় আনা হয়।

সংস্কারের বিষয়গুলিতে সামরিক বাহিনীর অবশ্য সায় ছিল না। শীঘ্রই আবার হাইতির উত্তরাঞ্চলে গোলমাল শুরু হয়ে যায়। ১৯০২ সালে নতুন নির্বাচনের দাবিতে সরকার অপসারিত হয়। এবার ফিরম্যাঁ স্বয়ং নির্বাচনে দল নিয়ে অংশ নিলেন। তার সমর্থকরা অধিকাংশ ছিল যুবাবয়সী ও পেশাজীবী শহুরে মানুষ। তার মূল প্রতিপক্ষ উত্তরের সেনাশাসক জেনারেল নোর্-অ্যালেক্সিসের বিরুদ্ধে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ ওঠে। তার রেশ ধরে অ্যালেক্সিস ফিরম্যাঁপন্থীদের মার্কিন তাঁবেদার আখ্যা দিয়ে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাদখল করেন।

ফিরম্যাঁপন্থীদের সাথে একদফা সংঘর্ষে জয়লাভ করে অ্যালেক্সিসপন্থীরা। ফিরম্যাঁ প্রাণভয়ে নিকটবর্তী সেন্ট টমাস দ্বীপে পালিয়ে যান। তাঁর বসতবাড়ি-লাইব্রেরি তছনছ করে ফেলে অ্যালেক্সিসের সৈন্যরা। নির্বাচনের যেটুকু ফলাফল বেরিয়েছিল, তাতে ফিরম্যাঁর দল বিশাল ব্যবধানে এগিয়ে ছিল। ১৯১১ সালে ফিরম্যাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে এক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গুণীজনের সম্ভাবনাময় নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হয় হাইতির জনগণ।

জেনারেল পিয়ের নোর্-অ্যালেক্সিস (১৮২০-১৯১০), হাইতির রাষ্ট্রপতি (১৯০২-১৯০৮), যুদ্ধ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ফিরম্যাঁকে জোর করে রাষ্ট্রপতি হতে না দিলেও শেষমেশ বিপ্লবের মুখে গদি ছাড়তে হয় তাকেও।

আসলে হাইতির জন্মলগ্ন থেকেই বাইরের মানুষকে তাদের গভীর অবিশ্বাস। তারা প্রচন্ড স্বাধীনচেতা, এতটাই যে স্বদেশী সরকারের শাসনেও অবদমিত হয় না তারা। নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্ব আর অহংকারী অকর্মণ্য নেতাদের কারণে দায়িত্বশীল পররাষ্ট্র ও বাণিজ্য নীতি হাইতির ছিল না। এসবের কর্মফল ফিরম্যাঁ নিজেই ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিলেন।

ফিরম্যাঁ বলেছিলেন, উত্তরের ‘দানব’ যুক্তরাষ্ট্রই হাইতির ভবিষ্যতের চাবিকাঠি। হাইতিবাসীর সামনে একটাই পথ: নিজেদের বিবাদ-বিভক্তি ছেড়ে সময় থাকতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সহযোগিতা-সহমর্মিতার সম্পর্ক গড়ে তোলা। যদি তারা তা করতে না পারে, তাহলে সে দানবই হাইতিকে আপাদমস্তক গিলে খাবে। ফিরম্যাঁপন্থীদের বিফলতায় প্রমাণ হয়ে গেল, হাইতি বেছে নিয়েছে দ্বিতীয় পথটিই।

১৯০১ সালে রাজধানী পোর্তোপ্র্যাঁসের দৃশ্য।
১৯০১ সালে রাজধানী পোর্তোপ্র্যাঁসের দৃশ্য, একশ বছরেও খুব একটা পরিবর্তন হয়নি।
বন্দরে মার্কিন বাণিজ্যজাহাজ থেকে ময়দার বস্তা নামাচ্ছে খালাসীরা, ১৮৯০ থেকে ১৯০০র মধ্যে তোলা ছবি।
close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!