পেপার ট্রেইল

“জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজনে সুদূর চীন দেশে যাও” — ছোটবেলা থেকে আমরা শুনে এসেছি এটা নাকি নবীজী বলেছেন। সত্যি কথা হলো, এটি একটি দা’য়ীফ (দুর্বল) হাদীস, সম্ভবত বানোয়াট। ইসলাম ও আরবের আদি ইতিহাসে চীনের সাথে তেমন কোন প্রত্যক্ষ সাংস্কৃতিক যোগাযোগ ছিল না।

অবশ্য ইসলামের শুরুতে আরব দিগ্বিজয়ের ঝান্ডা পশ্চিমে ইউরোপ আর পূর্বে ভারত পর্যন্ত প্রসারিত হতে বেশি সময় লাগেনি। নবীজীর প্রয়াণের বিশ বছরের মধ্যে দুই বড় পড়শী বিজ্যান্টিন সাম্রাজ্যের পূর্বভাগের একটা বড় অংশ আর সাসানীদের পুরো রাজ্য আরবদের করায়ত্ত হয়। এর মধ্যে ইরানের উত্তরপূর্বের খোরাসান (বর্তমান আফগান-ইরানের উত্তর সীমান্তে) মধ্য এশিয়ার প্রবেশপথ। এ এলাকার উত্তরের দুর্গম গিরিপথের মধ্যে দিয়েই প্রাচীন পরিব্রাজকরা চীনে যেতেন।

অর্থাৎ চীন ও আরব এ দুইয়ের মোলাকাত ছিল কেবল সময়ের ব্যাপার।

চীনের তাং সাম্রাজ্যের মানচিত্র

এসময় চীনে তাং রাজবংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত। পরবর্তী অন্যান্য রাজবংশের মত অন্তর্মুখী এরা ছিল না। বিশাল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রায় সমান অংশগ্রহণ ছিল রাজকার্য পরিচালনায়। এরকম কসমোপলিটান রাজ্যে পূর্বের কোরিয়ান, উত্তরের মোঙ্গোল, পশ্চিমের তুর্কী জাতিগোষ্ঠীগুলিকে যথাযোগ্য স্থান দেয়া হত। অবশ্যই যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা চীনের সম্রাট ‘স্বর্গপুত্রকে’ উপঢৌকন পাঠানো বন্ধ করত।

মধ্য এশিয়ার মাধ্যমে সিল্করোডের বাণিজ্যপথ এসময় ভারতকে চীনের সাথে যুক্ত করে। মধ্য এশিয়া ছিল প্রাচ্য-প্রতীচ্যের এক মিলনস্থল। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের উত্তরসূরী গ্রেকো-ব্যাক্ট্রিয়ান রাজারা যেমন ছিল আফগানে, সেরকম ফারগানা-তাশখন্দ-বুখারা-কাশগর-সমরখন্দ এসব শহরেও সগডিয়ানভাষী ইরানীশাসিত নগররাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল। এরা ছিল বংশপরম্পরায় বণিক। আর নেস্টরিয়ান খ্রীষ্টান, বৌদ্ধ, মানিকিয়ান, ইহুদী, জোরোয়াস্ট্রিয়ান ইত্যাকার নানা ধর্মবিশ্বাসের অনুসারীদের আবাস ছিল এ রাজ্যগুলিতে।

সিল্ক রোডের ভারতীয়, পারসিক, চীনা অংশ

ভারত থেকে বৌদ্ধধর্ম চীনে প্রথম যায় এ পথেই। সম্ভবত অতীশ দীপংকরও এই রাস্তার পূর্বভাগ যেটা পাকিস্তানের গিলগিটের মধ্যে দিয়ে গেছে, সেদিক দিয়ে তিব্বতে গেছেন। চীন থেকেও হিউয়েন সাং এ পথেই ভারত ও বাংলায় এসেছিলেন সংস্কৃত বৌদ্ধ পান্ডুলিপি সংগ্রহ করতে। তার সে অভিযানের গল্প পরবর্তীতে চীনা পুরাকাহিনীতে পরিণত হয়েছে, যার ইংরেজী নাম ‘এ জার্নি টু দ্য ওয়েস্ট’। আর তার অন্যতম প্রধান চরিত্র বানররাজা সুন উখোং। ছোটবেলায় আমরা এই কাহিনীর চীনা ছবিবই পড়েছি।

সিল্ক রোডের অন্যতম স্থলবন্দর চীনের দুনহুয়াংএর গুহায় আবিষ্কৃত হয়েছে দেয়ালচিত্র। এখানে ভারতীয় প্রভাবে আঁকা বৌদ্ধ জাতকের কাহিনী চিত্রিত।
বানর রাজা সুন উখোং, সম্ভবত চরিত্রটি ভারতের হনুমানজির অনুপ্রেরণায় সৃষ্ট

তাং সাম্রাজ্যের শত্রু অবশ্য কম ছিল না। ইরানীরা যেমন তুরানের যাযাবরদের একরোখা বর্বর বলে তুলে ধরেছে শাহনামার মত মহাকাব্যে, তেমন চীনারাও এদেরকে ‘পশ্চিমের ডাকাত’ নামে ডাকত। বিভিন্ন ট্রাইবের তুর্কীভাষী এসকল জনপদ আবার নিজেদের মধ্যেও লড়ত। চীনাদের সাথে মিত্র হিসাবেও যোগ দিত, কখনো হত শত্রু। এসকল যাযাবরদের ঠান্ডা রাখার জন্যে তাদের সাথে তাং সম্রাটরা নানা কূটনৈতিক চুক্তি সাক্ষর করে। সে অনুযায়ী একে অন্যের পরিবারের সাথে বিবাহসূত্রে তারা আবদ্ধ হয়।

নতুন একটি সাম্রাজ্য অবশ্য চীনের দক্ষিণপশ্চিমে এ সময় মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করে। সেটি তিব্বত। এরাও মূলত যাযাবর। আর সপ্তম শতক থেকে শুরু করে এরা চীনাদেরকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখে। তারিম বেসিন পুরোপুরি তিব্বতের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়াতে চীনাদের পশ্চিমে যাবার রাস্তা সংকুচিত হয়ে পড়ে। মধ্য এশিয়াতে তাং বাণিজ্যপ্রভাব ও সাম্রাজ্য বিস্তারের সবচে বড় প্রতিবন্ধক ছিল তিব্বত সাম্রাজ্য।

আরব সেনাদল এসময় মধ্য এশিয়ার মারি-সমরখন্দ জয় করে বেশি পূর্বে আর অগ্রসর হয়নি। এরপরে মধ্য এশিয়ার বিশাল স্তেপভূমি আর গোবি-তাকলামাকান মরুভূমি। জনশূন্য বিশাল এলাকার মাঝে একটি-দুটি মরূদ্যান শহর। কেন্দ্রীয় কোন শাসনব্যবস্থা নেই। সব মিলিয়ে করারোপের মত যথেষ্ট জনসংখ্যা নেই। বিশাল সাম্রাজ্যও নেই জয় করার মত। তখন ইউরোপের সাথে সিল্ক রোড বাণিজ্যও তেমন বেশি নয়। সব মিলিয়ে উমায়্যা খলীফাদের তেমন কোন অর্থনৈতিক ইনসেন্টিভ ছিল না মধ্য এশিয়ার আরো অভ্যন্তরে ঢোকার।

সিল্ক রোডের পশ্চিম চীন প্রান্তের তুরপান শহরের প্রাচীন ভবন। তাকলা মাকান মরুভূমি পেরিয়ে চীনা তুর্কীস্তান কিংবা শিনজিয়াংএ এসে এই মরুদ্যান শহরে পৌঁছত সওদাগরি কাফেলা।

চীনাদের অবশ্য এ অঞ্চলের প্রতি প্রাচীনতা থেকে আগ্রহ ছিল। প্রথম চীনা সম্রাট শিহুয়াংতি মধ্য এশিয়াতে এক রাজপ্রতিনিধি পাঠান ‘রক্তঘর্ম’ অশ্ব খুঁজে নিয়ে আসার জন্যে। যুদ্ধে নাকি ভীষণ দ্রুততা দিত এ ঘোড়া। আরো নানা ভারতীয় বিলাসদ্রব্য পাওয়া যেত এখানকার বাজারে।

পূর্ব-পশ্চিমের মিলনস্থলের এ রাষ্ট্রগুলো তাই কখনো স্বাধীন, কখনো চীনা প্রটেক্টরেট, এভাবে চলছিল। নবাগত প্রতিবেশী উমাইয়্যা খিলাফতকে এরা চীনের বিরুদ্ধে ব্যালান্সিং অ্যাক্টের জন্যে ব্যবহার করতে শুরু করে। এর ফলে ৭১৫তে একবার আর ৭১৭তে আরেকবার উমাইয়্যা সেনাদল তাংদের মিত্র তুর্কী জাত তুর্গেশদের মুখোমুখি হয়।

৭৪৭এ উমাইয়্যাদের পতন ঘটে আব্বাসী অভ্যুত্থানের মুখে। ক্ষমতার কেন্দ্র সিরিয়া থেকে পরিবর্তিত হয়ে আসে ইরাক-ইরানে। সাসানী সাম্রাজ্যেরই একরকম পুনরুত্থান ঘটে পারসিক প্রভাব বাড়ার সাথে। বাগদাদের আব্বাসী খলীফাদের দৃষ্টি হয় প্রাচ্যমুখী। আর নতুন ‘সাম্যবাদী’ খেলাফত প্রতিষ্ঠার সাথে বেশ একটা জিহাদী জোশও চলে আসে আরব-অনারব দু’জাতের মুসলিমদের মধ্যে।

আব্বাসী খেলাফতের মানচিত্র

৭৫১তে মধ্য এশিয়ার দুই রাজ্য ফারগানা আর শাশ (তাশখন্দ) একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। শাশের বিরুদ্ধে তাং সাম্রাজ্যের সাহায্য প্রার্থনা করে ফারগানা। কোরিয়ান তাং জেনারেল গাও শাশে আক্রমণ চালিয়ে সেখানকার অধিকর্তাকে হত্যা করেন। শাশের রাজপুত্র পালিয়ে গিয়ে আব্বাসী বিপ্লবের অন্যতম নেতা মারি-সমরখন্দের গভর্নর আবু মুসলিমের দরবারে গিয়ে হাজির হন। এভাবে আব্বাসীদের সাথে তাং সাম্রাজ্যের সংঘাতের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।

আব্বাসী খেলাফতের সাথে মিত্রতার চুক্তিতে আবদ্ধ হয় বৌদ্ধ তিব্বত সাম্রাজ্য। অমুসলিম তুর্কী যাযাবর তুর্গেশরাও সাহায্যের হাত বাড়ায়। সব মিলিয়ে প্রায় লাখখানেক সৈন্য নিয়ে বর্তমান কাজাকস্তানের তালাস নদীর উপত্যকায় সমবেত হয় আব্বাসী সেনাদল। চীনাদের সেনাশক্তিও কম ছিল না। অবশ্য এ সব সংখ্যার অনেক কমবেশি হতে পারে।

তিব্বতী সাম্রাজ্য, ৭৯০ খ্রিষ্টাব্দ
বর্তমান কাজাখস্তানে অবস্থিত তালাস নদী

তিনদিনব্যাপী ভীষণ যুদ্ধ হয় দুই দলের মধ্যে। যুদ্ধের শেষভাগে তাংদের মিত্র কারলুক তুর্কী যাযাবররা দলত্যাগ করে শত্রুদের সাথে যোগ দেয়। তাতে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় চীনা সেনাশক্তি। সেনাপতি গাও পশ্চিম থেকে জান নিয়ে পালিয়ে ফেরেন মূল তাং ভূমিতে। প্রতিশোধ নেবার জন্যে নতুন সেনাদল গড়ে তুলতে না তুলতেই ৭৫৫তে খোঁজ আসে যে বেজিংয়ের দিকে এক বিশাল বিদ্রোহীদল নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে তাং সেনাপতি আন লুশান। নিজেকে তিনি ইয়ান নামে নতুন এক বংশের সম্রাট দাবি করে বসেছেন। আব্বাসীদের কথা ভুলে সেনাপতি গাওকে উল্টোদিকে রওনা দিতে হয় তাং সাম্রাজ্য রক্ষার জন্য।

আন লুশান বিদ্রোহে পরবর্তী আট বছর বিপর্যস্ত হয় সমগ্র উত্তর চীন। পশ্চিমে সাম্রাজ্যপ্রসারের স্বপ্ন আপাতত শিকেয় তুলে রাখতে হয় তাংদের।

তালাসের যুদ্ধ, ৭৫১ খ্রিষ্টাব্দ

অপরদিকে আবু মুসলিমের জিহাদী জোশেও ব্রেক কষে দেন নতুন আব্বাসী খলীফা আল-মনসুর। আবু মুসলিমের জনপ্রিয়তা আর বিশেষত শিয়া মতাদর্শীদের অন্ধ সমর্থনের কারণে শত্রুতা বেড়ে চলে খলীফার সাথে। ষড়যন্ত্র করে ‘জিন্দিক’ বা ধর্মপরিত্যাগকারী সাব্যস্ত করে আবু মুসলিমকে হত্যা করেন আল-মনসুর। এরপর আব্বাসীরাও মধ্য এশিয়ায় নতুন সামরিক অভিযান পাঠানো বন্ধ করে দেয়।

অর্থাৎ দুই সাম্রাজ্যই মোটামুটি একটা স্থিতিশীলতায় আসে। শ’দুয়েক বছর ধরে প্রাচ্য-প্রতীচ্যের একটা সীমানা দাঁড়া হয়ে যায় এ অঞ্চলে। এ সীমানা অবশ্য দ্বাদশ শতাব্দীতে পদদলিত করে চেঙ্গিস খান আর তার মোঙ্গোল হোর্ড।

তালাসের যুদ্ধ নিয়ে আজকালকার মানুষ খুব বেশি কিছু জানে না। চীনারা এর কিছু বিবরণ লিখে গেছে। তাতে নিজেদের পরাজয়ের সাফাই গেয়েছে। আর আরব ইতিহাসবিদরাও দুয়েক জায়গায় এর উল্লেখ করেছেন, কিন্তু খুব বেশি গুরুত্ব দেননি।

কিন্তু এ যুদ্ধের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এরপর মধ্য এশিয়ার পশ্চিমভাগ সুনির্দিষ্টভাবে মুসলিম সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে আসে, যদিও এরা ইসলাম ধর্মকে পরিপূর্ণরূপে গ্রহণ করে আরো শ’খানেক বছর পর। চীনা বাণিজ্য যায় কমে।

মধ্য এশিয়া হয়ে ভারত থেকে চীনে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। অর্থাৎ বৌদ্ধ ধর্মের যে সাপ্লাই লাইন সেটা কেটে যায়। অবশ্য এসময় ভারতে নতুন করে হিন্দু ধর্মের প্রভাব বাড়ছিল। বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশের জন্যে চীনা-জাপানী-কোরিয়ানদের তাই খুঁজে নিতে হয় স্বকীয়তা। এর ফলে শুরু হয় শাওলিন, চান, জেন, প্রভৃতি স্থানীয় জাতের বৌদ্ধধর্ম। তাদের শিল্পসংস্কৃতিও ভারতীয় প্রভাব থেকে স্বাধীন হতে থাকে।

চীনা ‘চান’ বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম নিদর্শন ‘হাস্যরত বুদ্ধ’। আসলে ইনি লোককাহিনীতে বর্ণিত এক চীনা বৌদ্ধ ভিক্ষু। ভারতীয় বৌদ্ধ ধর্মে এরকম কিছু নেই। অর্থাৎ চীনা বৌদ্ধ ধর্ম হয়ে গেছে স্বতন্ত্র।

এ হল তালাস যুদ্ধের কালচারাল ইমপ্যাক্ট। এর থেকেও বড় যে ইমপ্যাক্ট তা টেকনোলজিকাল। সেটা হলো কাগজ তৈরির প্রযুক্তি। নবম শতকের আগে শুধুমাত্র চীনারা জানত কিভাবে তুঁত গাছের বাকল থেকে মালবেরি পেপার প্রস্তুত করা যায়। এ ছিল তাংদের রাষ্ট্রীয় টপ সিক্রেট জ্ঞান। সিল্ক রোডের কোন বণিকের সাধ্য ছিল না কাগজ তৈরির কারখানায় ঢোকার। চীনের বাইরে বাকি বিশ্বের লেখাপড়া চলত ভাঙা মাটির পাত্রের টুকরায় (শার্ড) আঁকিবুঁকি করে, নয়ত পশুর চামড়ার পার্চমেন্টে লিখে। এসবই ছিল খুব কঠিন প্রক্রিয়া।

চীনের ফাং মাতানে আবিষ্কৃত প্রাচীনতম কাগজের নিদর্শন, আনুমানিক দ্বিতীয় খৃষ্টপূর্বাব্দ।

তালাস যুদ্ধে আব্বাসীরা হাজার কয়েক তাং সৈন্য ও প্রযুক্তিবিদদের যুদ্ধবন্দী করে। এদের মধ্যে ছিল কাগজওয়ালারাও। প্রথমে সমরখন্দে এদের নিয়ে যাওয়া হয়। কাগজ বানানোর কৌশল তাদের কাছ থেকে শিখে নেয় স্থানীয় শিল্পীরা। এর বছর পঞ্চাশেক পরেই বাগদাদে কাগজ তৈরির কারখানার উল্লেখ পাওয়া যায়।

কাগজের প্রযুক্তিলাভের ফলে আব্বাসী খেলাফতে জ্ঞানবিজ্ঞানের বিস্তারে বিশাল একটা বিপ্লব আসে। শুধু কুরআন-হাদীস নয়, দর্শন-বিজ্ঞানেরও চর্চা সহজলভ্য করে দেয় কাগজ। এ জোয়ারে সওয়ার হয়ে আসে নবম-দশম শতকের ইসলামী স্বর্ণযুগ। কাগজে যেভাবে কালিকলমে লেখার প্রক্রিয়া, ক্যালিগ্রাফি একমাত্র সে মিডিয়ামেই সম্ভব। চীনাদের ক্যালিগ্রাফি সর্বজনবিদিত। সম্ভবত একইভাবে আরবী ক্যালিগ্রাফিরও যাত্রা শুরু হয়। মধ্যপ্রাচ্য আর পশ্চিমা বিশ্বের প্রথম লাইব্রেরিগুলিও প্রতিষ্ঠিত হয় আব্বাসী খেলাফতে।

১১৮০তে পূর্ব ইরানে কাগজে তৈরি কুরআনের ক্যালিগ্রাফিক ফোলিও (নিউ ইয়র্কের মেট মিউজিয়াম)
ডানে একাদশ শতকের চীনা সং রাজবংশের সময়কালীন কাগজে আঁকা ক্যালিগ্রাফি (তাইওয়ানের ন্যাশনাল প্যালেস মিউজিয়াম)

একাদশ-দ্বাদশ শতকের মধ্যে কাগজ পৌঁছে যায় স্পেনের উমায়্যা খেলাফতে। সেখানে পড়তে আসা ইউরোপীয়রাও পায় কাগজ তৈরির প্রযুক্তি। তারপর পঞ্চদশ শতকে গুটেনবের্গ, বাঁধানো বই, রেনেসাঁস, এজ অফ রিজন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভল্যুশন ইত্যাদি ইত্যাদি।

এই ‘পেপার ট্রেইল’ ধরে সামনে হাঁটলে আমরা এরকম বৈপ্লবিক অনেক কিছুই পাই। আজকে কাগজ নষ্ট করতে আমাদের বাঁধে না। অথচ ছোটবেলায় শিখেছি কাগজ অমূল্য একটা জিনিস। আসলেই তাই! প্রমিথিউসের আগুন চুরির মত কাগজের রহস্যটাকেও ভেদ করে কেড়ে নিয়ে আসতে হয়েছিল বাকি বিশ্বের জন্যে। যদি না এরকমটা হত, তালাসের যুদ্ধ না হত, আর যুদ্ধে আব্বাসীরা না জিতত, তাহলে হয়ত কাগজের জন্যে ইউরোপকে অপেক্ষা করে বসে থাকতে হত আরো একশ’ বছর। সেই অল্টারনেট হিস্টরি কল্পনার কাজটা আপনাদের হাতে সমর্পণ করে আজকের মত শেষ করলাম।

সুবর্ণদ্বীপের বানরনৃত্য

Featured Video Play Icon
জাকার্তা, সুকার্নো, ইয়োগইয়াকার্তা, সুহার্তো, জাভা, সুমাত্রা, গারুডা, মালয়, সিঙ্গাপুর — মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়ার এই নামগুলির সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। আজ বলবো কি কারণে এই নামগুলো যথাক্রমে আসলে জয়কর্তা, সুকর্ণ, যোগ্যকর্তা, সু-অর্থ, যব, সমুদ্র, গরুড়, মলয়, সিংহপুর ইত্যাদি থেকে এসেছে।

লেখার সাথের ভিডিওতে দেখতে পাচ্ছেন ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপের আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী ‘কেচা’ নামক অনুষ্ঠান। অপার্থিব এই দৃশ্যটি নেয়া হয়েছে ‘বারাকা’ বলে ১৯৯২এ তৈরি তথ্যচিত্র থেকে। এটা ধারণ করা হয়েছে বালির গুনুং কাউয়ি বলে একাদশ শতাব্দীর এক মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের মাঝে।

বালির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ট্যুরিস্টদের কাছে যেমন জনপ্রিয়, ঠিক ততটা মনকাড়া তাদের শিল্প-সংস্কৃতি — যার মধ্যে আছে ছায়ানাট্য, লেগংবারং নৃত্য, আর রামায়ণের নাট্যাভিনয়। রাবণের রাক্ষসবাহিনী বনাম হনুমানের বানরবাহিনীর যুদ্ধের প্রতীকী রি-এন্যাক্টমেন্ট এই কেচা  নামক ‘বানরনৃত্য’।

অংশগ্রহণকারীদের কানে গোঁজা জবাকুসুম — যেটা বাংলায় দুর্গাপূজায় ব্যবহৃত হয়। দৃশ্যটির গোঁড়ার দিকে দেখা যাচ্ছে বালির উলুওয়াতু মন্দিরের নিকটবর্তী অরণ্যের শাখামৃগদের, তারা সেখানকার পবিত্র রক্ষক। আর দেখানো হয়েছে জাভার বোরোবুদুর বৌদ্ধবিহার আর কম্বোডিয়ার আংকোর ভাটের বিষ্ণুমন্দিরের স্থাপত্য ও অলংকরণ। সেগুলি ভারতবর্ষের মন্দির-মসজিদগুলোর থেকে কোন অংশে কম নয়!

রামায়ণ আর হিন্দুধর্ম বালিসহ সারা ইন্দোনেশিয়াতে এসেছে প্রাচীন ভারতবর্ষ থেকে। ভারতীয় উপমহাদেশের সাথে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ প্রায় দু’হাজার বছরের পুরনো।

ভিয়েতনামের ফুনানচম্পা, কম্বোডিয়ার চেনলাখ্মের, থাইল্যান্ডের দ্বারাবতী, মালয়েশিয়ার গঙ্গানগরলংকাসুকা, ইন্দোনেশিয়ার মজাপহিতশ্রীবিজয়াশৈলেন্দ্র, মায়ানমারের পাগান — অতীতের এ সকল রাজ্য সবাই কোন না কোনভাবে ভারতীয় সংস্কৃতির চর্চা করেছে। এদের অধিকাংশের নামই সে ইতিহাসের প্রত্যক্ষ স্বাক্ষ্য।

বিশেষ করে ভারতের দুটো অঞ্চল পূর্বদিকে হিন্দু-বৌদ্ধধর্ম, সংস্কৃত-পালি ভাষা, নাগরীলিপি, স্থাপত্যশৈলী, আর পরবর্তীতে ইসলাম, ইত্যাদির বিস্তারে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। সে দুটো কোরোমান্ডেল উপকূল আর বঙ্গ। নালন্দার বৌদ্ধবিহারে ৮৬০ খ্রীষ্টাব্দে খচিত শিলালিপি থেকে আমরা জানতে পারি ‘সুবর্ণদ্বীপের’ — অর্থাৎ সুমাত্রার — শ্রীবিজয়া রাজ্যের শৈলেন্দ্রবংশীয় মহারাজা বলপুত্র কর্তৃক একটি মঠস্থাপনের জন্যে অনুদানের কথা। আর আমাদের বিক্রমপুরের বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর তিব্বতে ধর্মপ্রচারে যাবার আগে সুবর্ণদ্বীপেই  শ্রীবিজয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় অধ্যয়ন করেন।

কি উপায়ে ভারতীয় সংস্কৃতি প্রথম পূর্ব এশিয়াতে এসে পৌঁচেছে, তার বিস্তারিত কোথাও লিপিবদ্ধ নেই। ধারণা করা যেতে পারে বাণিজ্যের খাতিরে শ’ শ’ বছর ধরে ধীরে ধীরে এখানকার স্থানীয় রাজ-রাজড়ারা — সাথে তাদের প্রজারা — ভারতবর্ষের বিজ্ঞান-শিল্পকলা-ধর্মচিন্তার ঐশ্বর্য দেখে তাতে আকৃষ্ট হয়। দক্ষিণ ভারতের তেলেগু পল্লব বংশের রাজারাও বিশেষ ভূমিকা পালন করে সমুদ্রের অপরপারে নতুন রাজ্য আর রাজবংশ স্থাপনে। এ ছিল কমবেশি শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়া।

ভারতীয় দখলদারিত্ব আর ঔপনিবেশিক শোষণের ইতিহাসও অবশ্য একটা সময়ে পাওয়া যায়। সেটা হলো একাদশ শতাব্দীতে তামিল চোলবংশের আগ্রাসনে শ্রীবিজয়া সাম্রাজ্যের পরাজয়, যাদের স্থান পরে পূরণ করে ত্রয়োদশ শতকের মজাপহিত বলে জবদ্বীপের — অর্থাৎ জাভার — আরেকটি রাজবংশ।

মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিমদের ঠিকানাও এ এলাকায় প্রাচীনতা থেকে পাওয়া যায়। সপ্তম-অষ্টম শতক থেকে তাদের বাণিজ্যপ্রধান সমুদ্রতীরবর্তী বন্দর-নগরগুলি ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ হতে শুরু করে। সুফী ধর্মপ্রচারকরা দ্বীপগুলির আরো গভীরাঞ্চলে ইসলামের বাণী নিয়ে যায়। তার উপরে ভারতে মুসলিম রাজত্ব প্রতিষ্ঠার পরে তাদের বনেদী বংশগুলির সাথে আত্মীয়তা করার জন্যে ইন্দোনেশিয়ার রাজারাও ধর্মান্তরিত হওয়া শুরু করে। তাছাড়াও আরবীর পরিবর্তে মালয় ভাষাতে ইসলামী পান্ডুলিপির প্রাচুর্য ছিল। এসব কারণে শীঘ্রই পুরো ইন্দোনেশিয়ার আশি শতাংশ মানুষ মুসলিম হয়ে যায়।

সেই ধারার ব্যতিক্রম শুধু বালি । বহুদিন ধরে তারা জাভা-সুমাত্রার মুসলিম রাজ্যগুলি থেকে স্বাধীন ছিল। আলাদা দ্বীপ হওয়ায় ধর্মপ্রচারকরাও সহজে সেখানে যেতে পারেনি। সেকারণে তারা আদিধর্ম বজিয়ে রেখেছে। তাদের রাজ্যগুলিকে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরে দখলে নেয় ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তি হল্যান্ড। বালিনিজ়দের উপর তাদের অত্যাচার দেখে বাকি ইউরোপীয় জাত তাদেরকে ছি-ছি করেছিল। সে কারণে তিরিশের দশকে অনেকটা ক্ষতিপূরণস্বরূপ ডাচরা বালির শিল্পসংস্কৃতিকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেয়া শুরু করে। কেচা-নৃত্যের উদ্ভব সে সময়।

এদের হিন্দুধর্মও ভারতের থেকে অনেক স্বতন্ত্র। পুরনো অ্যানিমিস্ট বিশ্বাসের মূল খুঁজতে বেশিদূর যাওয়া লাগে না। যেমন, কেচা আসলে সাংহিয়াং বলে বালির এক ভূততাড়ানি অনুষ্ঠানের আধুনিক রূপ। বৌদ্ধধর্মও পুরোপুরি বিলীন হয়ে যায়নি। মজাপহিত রাজবংশের সময় শিব আর বুদ্ধ দু’য়েরই উপাসনা চলত একই মন্দিরে, এ ছিল তাদের অভাবনীয় ধর্মীয় সংস্কার আর সহনশীলতার প্রমাণ। ইসলামের বিস্তারের পরেও আগের অনেক আচারব্যবস্থা সুফী চিন্তার প্রভাবে রিডিফাইন-রিপারপাজ় হয়েছে। যেমন সুরো বলে নববর্ষের অনুষ্ঠান যুগ যুগ ধরে মুসলিম সমাজে জনপ্রিয়তাসহকারে পালিত হয়ে আসছে।

অবশ্য ১৯৯৮ সালে সুহার্তোর পতনের সময় থেকে মুসলিম-খ্রীষ্টান, মালয়-চীনা দাঙ্গা এখন নিত্যনৈমিত্তিক। নাইন-ইলেভেনের মত ভূরাজনৈতিক কারণে স্থানীয় কট্টরপন্থীদের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা গিয়ে ইন্দোনেশীয়দের হাজার বছরের ধর্মীয় সহনশীলতা বিপন্ন। বালির হিন্দু জনগোষ্ঠী তাও বেঁচে গেছে দেশের কদর বাড়ানো আর ট্যুরিস্টদের টাকা উপার্জনের সামর্থের কারণে। সেটা কতদিন টেকে সেটা দেখবার বিষয়। অন্তত যতদিন ওয়াহহাবি মতবাদের সরকারগুলির অর্থায়ন থাকবে, ততদিন তাদের ভয় থেকেই যাবে।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!