জিন-জিয়ান-আজাদী

আমাদের স্থানীয় মিডল ঈস্টার্ন গ্রসারি স্টোরের প্রতিটি চেক আউট কাউন্টারে রাখা এই ছবিটি। উইমেন-লাইফ-ফ্রীডম স্লোগানলেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে প্রতিবাদী মিছিল। প্ল্যাকার্ডে মাহসা আমিনির ছবি। ২২ বছর বয়েসী মেয়েটি ইরানে নৈতিকতা পুলিশের হাতে প্রাণ হারানোর পর থেকে সারা বিশ্বে পরিচিত মুখ।

সান ডিয়েগোর মধ্যপ্রাচ্যীয় দোকানের চেকআউট কাউন্টারে মাহসা আমিনির ছবি

মাহসাকে নিয়ে সারা ইরান বিক্ষোভে ফেটে পড়লেও কতজন জানেন যে মেয়েটির জন্ম কুর্দী পরিবারে? তার আবাস যে শহরটিতে প্রথম বিক্ষোভ শুরু হয়, সেই সানান্দাজ কিন্তু ইরানী কুর্দিস্তান প্রদেশের রাজধানী। আমি আরেকটু পরে এ‌ প্রতিবাদী আন্দোলনের গভীর কুর্দী যোগাযোগটা তুলে ধরব। যদিও মাহসা বা তার মত অনেক কুর্দীই হয়ত রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিল না।

গ্রাজুয়েট স্কুলে ইরানী-আমেরিকান অধ্যাপকের সাথে কাজ করতাম। তাঁর স্ত্রী মার্কিন হলেও অধ্যাপকের আত্মার সংযোগ ইরানী সংস্কৃতির সাথে। ফার্সীতে কবিতা লেখেন বেনামে। কিন্তু ইরানের সাথে সে যোগাযোগটা নেই। ইসলামী বিপ্লবের ঠিক আগ দিয়ে ইরান ছেড়ে এদেশে আসেন। তাঁর ল্যাবে আমি যে কয়েক বছর কাটিয়েছি, সে সময়টা অন্যান্য ছাত্রছাত্রীদের ‌বাকিরা ছিল ইরানী। কিন্তু এদের মধ্যে দু’জন ছিল একটু ব্যতিক্রমী।

একজনের প্রথম নাম খোলাখুলিরকম তুর্কী, আর পারিবারিক নামেই বোঝা যায় তার জাতিপরিচয় আজেরি। অর্থাৎ সে ইরানের উত্তর পশ্চিমে ককেশাসের নিকটবর্তী এলাকার মানুষ। তাব্রিজ সেখানকার মূল শহর। বাকি ইরানীদের মত এদের মাতৃভাষা ফার্সী বা ‌অন্য কোন ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা নয়। বরং তু্র্কী গোষ্ঠীর আজেরি ভাষা।

আরেকজনের নাম দেখে ধারণা হয়েছিল সে বুঝি বাকিদের মতই ফার্সীভাষী। কিন্তু কোন এক স্ট্রেসফুল সময়ে ডিপার্টমেন্টের বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে স্বীকার করেছিল, সে আসলে কুর্দী। ঐ প্রথম, ঐ শেষ। এরপর নিজের জাতিগত পরিচয়ের ব্যাপারে আর কোন টুঁ শব্দটিও সে করেনি। তবে একটা ব্যাপার খেয়াল করেছি যে ইরানী অন্যান্য যে মেয়েরা ল্যাবে ছিল বা যাওয়া-আসা করত তারা হেজাব পড়ুক বা না পড়ুক একটু মাথা ঢাকত, কিন্তু এ ছেলেটির বউ তেমন ছিল না।

ইরানের মাথাপিছু জিডিপি, উত্তর-পশ্চিমের কুর্দী প্রদেশগুলিতে সর্বনিম্ন

নিজের কুর্দী পরিচয়টা ঢাকঢোল পিটিয়ে বলতে না চাওয়াটাই হয়ত স্বাভাবিক। ইরানী মূলধারার সমাজে কুর্দীদের নিজস্ব পরিচয় বিলিয়ে দেয়াটা সহজ। ফার্সী ও কুর্দী একই ভাষা পরিবারের। কুর্দী অনেকের নামও ফার্সীপ্রভাবিত। কুর্দী সঙ্গীত-সংস্কৃতিও ইরানী অন্যান্য উপজাতির কাছাকাছি। বাংলার প্রভাবে যেমন বাংলাদেশের ইন্দো-আর্য নিকটাত্মীয় ভাষাগুলি (যেমন রাজবংশী) দুর্গতির সম্মুখীন, তেমন কুর্দী ভাষাও ফার্সীর অসম প্রভাবের কারণে কোণঠাঁষা। শিক্ষা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক মই বেয়ে ওপরে উঠতে চাইলে কুর্দী যে কেউই ফার্সীকে গ্রহণ করে নেবে। সহজে কুর্দীতে মুখ খুলবে না। ইরানী কু্র্দিস্তান ভৌগলিক সৌন্দর্যের জন্য পরিচিত হলেও সেখানকার মাথা পিছু আয় দেশের সবচে কম (মানচিত্র দেখুন)।

অতীতের পারস্য সাম্রাজ্য আসলে বহুজাতিক ইন্দো-আর্য গোষ্ঠীর সমন্বয়ে সংগঠিত ছিল। এখনো প্রকারান্তরে তাই। মাজান্দারানী, কেরমানী, খোরাসানী প্রভৃতি বিভিন্ন ভাষা স্থানীয়ভাবে প্রচলিত। কুর্দীরা সে সাম্রাজ্যে তুলনামূলক নতুন সংযোজন। এদের সকল উপজাতি শিয়াও নয়। আর প্রাচীনকালে তাদের নিজেদেরই সাম্রাজ্য ছিল, যার নাম মিডিয়া।

ইরানে প্রচলিত বিভিন্ন ভাষার বিস্তৃতি
প্রাচীন মিডিয়ান সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি, ৬৭৮-৫৪৯ খ্রীষ্টপূর্ব

আধুনিক ইরানে কাজার রাজবংশের আমলে বিভিন্ন অঞ্চলে উপজাতীয় স্বায়ত্ত্বশাসন প্রচলিত ছিল। তার পরিবর্তন হতে শুরু করে বিংশ শতকে। ১৯০৭ সালের ক্যু পরবর্তী রাষ্ট্রতন্ত্রে ফার্সীকে দেয়া হয় একমাত্র রাষ্ট্রভাষার স্থান। কুর্দীরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী দুর্বল রাজতন্ত্রকে হটিয়ে নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করেন রেজা শাহ পাহলভী (শেষ শাহের বাবা)। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের উপজাতীয় বিদ্রোহগুলি শক্ত হাতে দমন করে তার সেনাবাহিনী। কুর্দীরাও তার শিকার হয়। রেজা শাহ ছিলেন একনিষ্ঠ পারসিক জাতীয়তাবাদী। তুরস্কের মুস্তাফা কামালের ইরানী সমকক্ষ ধরা যেতে পারে তাকে। তুরস্কের মত ইরানেও প্রচলিত হয় সংখ্যাগুরু জাতীয়তার একনায়কতান্ত্রিক শাসন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ ও সোভিয়েতরা ইরানের দক্ষিণ ও উত্তর অংশ দখল করে রাখে। তার একটা কারণ জার্মানদের সাথে রেজা শাহের সখ্যতা। দেশটির তেল সম্পদ আরেকটা কারণ। তবে মূল কারণ ব্রিটিশ ভারত থেকে নাৎসিদের বিরুদ্ধে যুধ্যমান রুশদেরকে রসদ সরবরাহের একটা নিরাপদ রাস্তা খোলা রাখা। কথা ছিল যে, যুদ্ধের পর রুশ ও ব্রিটিশ উভয়েই তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবে।

আধুনিক ইরানের জাতীয়তাবাদী আদর্শে একীভূত হবার পেছনে ছিল রেজা শাহ পাহলভীর নিরলস প্রচেষ্টা

১৯৪৬এ সে সময়টা চলে এলেও সোভিয়েতরা প্রতিজ্ঞাভঙ্গ করে। এ ছিল স্নায়ুযুদ্ধের প্রাক্কালে প্রথম বিশ্বাসভঙ্গের ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্রের শাসানির কারণেই শেষ পর্যন্ত ইরান ছাড়তে বাধ্য হয় সোভিয়েতরা। নিজেদের দখলদারিত্বকে বৈধতা দেবার জন্যে তারা দুটি পাপেট রাজ্য তৈরি করেছিল ইরানের উত্তর পশ্চিমে। একটি আজারবাইজান পীপলস গভার্নমেন্ট। আরেকটি রিপাবলিক অফ মাহাবাদ। দ্বিতীয়টি ছিল মূলে কুর্দী রাষ্ট্র। তাদের সাহায্য করতে ইরাকী কুর্দিস্তান থেকে উপজাতীয় সৈন্যসহ এসে হাজির হন মুস্তাফা বারজানি।

তবে সোভিয়েত সেনাদল ইরান ছাড়ার সাথে সাথে এ সকল পাপেট রাষ্ট্র অস্তিত্বসংকটে পড়ে যায়। তাদের নবজাত “স্বাধীনতা” মুখ থুবড়ে পড়ে রেজা শাহের সেনাদলের সামনে। তবে ইতিমধ্যেই অনেক কিছু পরিবর্তিত হয়ে গেছে। ট্রাইবাল লয়াল্টি ছাঁপিয়ে জাতীয়তাবাদী আদর্শ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। আরেকটি যে আদর্শ সেটি সোভিয়েত সমর্থনের কারণে। কেডিপি বা কুর্দিস্তান ডেমোক্রাটিক পার্টি আর কোমালা পার্টি (কোমালা=কামলা!) তাদের আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করে সাম্যবাদ, সমাজতন্ত্র।

তাদের বিদ্রোহ আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে ষাটের দশকে। সীমানার ওপারে তখন চলছিল ইরাকী-কুর্দী যুদ্ধ। পাহাড়ী সীমান্ত জুড়ে বহু সহযোগিতা ও বিশ্বাসঘাতকতার ঘটনা ঘটে। তবে ইরানে কুর্দী বিচ্ছিন্নতাবাদের আপাতত সমাপ্তি ঘটায় ইরানী সামরিক অভিযান।

১৯৭৯র সফল বিপ্লবের পর শাহবিরোধী কুর্দীদের আশা ছিল যে এবার তারা ইরানে স্বায়ত্ত্বশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। কিন্তু সে বিপ্লব দ্রুত ছিনতাই করে নেয় খোমেনী গং। শাহের মত তাদের কাছেও মুসলিম ব্যতীত অন্য কোন জাতিপরিচয় ছিল অবান্তর। সেটা বোঝার সাথে সাথে আরো কড়া বিদ্রোহ শুরু হয়ে যায় ইরানী কুর্দিস্তানে। ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮৩ সালের মধ্যে বিশ হাজারের ওপর মানুষ প্রাণ হারায় সেখানে। কেডিপি ও কোমালা ছিল এ সকল বামঘেঁষা সংগ্রামের নেতৃত্বে। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত নানা প্রখরতায় এ সংগ্রাম চলে। শেষ হয় সংস্কারপন্থী নমনীয় রাষ্ট্রপতি খাতামির আমলে। ১৯৮০ থেকে ৮৯ ইরান-ইরাক যুদ্ধের মধ্যেও বিভিন্ন কুর্দী দল একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।

কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি নেতা আব্দুল্লাহ ওজালানের ভাষ্যে প্রকৃত মুক্তির জন্য লিঙ্গবৈষম্যের বিলুপ্তিসাধন অবশ্যকরণীয়

২০১১ থেকে ইরানী কুর্দিস্তানে নতুন করে সংঘাতের সূচনা হয়। কুর্দিস্তান ফ্রী লাইফ পার্টি (জিয়ানা আজাদ পার্টি) নামে নতুন একটি দল এর পুরোভাগে। আগের দলগুলির মত এটিও পুরোমাত্রায় বামপন্থী প্রগতিশীল। তুরস্কের পিকেকে বা কুর্দিশ ওয়ার্কার্স পার্টির সাথে এদের যোগাযোগ রয়েছে।

এখানেই ঐ উইমেন-লাইফ-লিবার্টি শ্লোগানটির উৎপত্তি। তুরস্কের কুর্দী স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা আব্দুল্লাহ ওজালানও বামপন্থী আদর্শের অনুসারী। বহু বামপন্থী তাত্ত্বিক লেখালেখিও আছে তার। তার তত্ত্ব অনুযায়ী কুর্দী সমাজ ও সংস্কৃতির ধারক-বাহক তাদের মেয়েরাই। নিজেদের সমাজে ছেলে ও মেয়ের সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই তাদের উত্তরণ। চলমান ইরানী বিপ্লবের জান-জিন্দেগী-আজাদী শ্লোগানটি ফার্সী, কিন্তু শ্লোগানটি মূলে কুর্দী — জিন, জিয়ান, আজাদী। বিচ্ছিন্নতাবাদী জিয়ান-এ আজাদী পার্টির নামের সাথেও এর মিল। ওজালানের লেখা বইয়েও এ শ্লোগানের উৎস পাওয়া যায়।

নারী-জীবন-মুক্তি আন্দোলন কখনো সহিংসতার পর্যায়ে চলে যায়, তেহরান, অক্টোবর ২০২২
জিন-জিয়ান-আযাদি — নারী-জীবন-মুক্তিঃ কুর্দী ভাষায় লেখা শ্লোগান

২০১৫-১৬ সালে সিরিয়া-ইরাকে আইসিসের বিরুদ্ধে মার্কিন মিত্র কুর্দী পেশমের্গা মিলিশিয়ার যুদ্ধের ক্লিপ যদি টিভিতে দেখে থাকেন, তাহলে নিশ্চয় পেশমের্গার মহিলা সদস্যরা আপনার চোখ এড়িয়ে যায়নি। তাদের এমন অবস্থানের কারণ কু্র্দীদের প্রগতিশীল বিপ্লব। আর সীমানার ওপারে সিরিয়া-তুরস্ক-ইরাকে কুর্দী মেয়েদের শক্তিমত্তায় অনুপ্রেরণা পেয়েই হয়তবা ইরানী কুর্দিস্তানে শোর উঠেছে জিন-জিয়ান-আজাদী। আর এর জোয়ারে এখনো ভেসে যাচ্ছে পুরো ইরান।

ইরানে কুর্দীদের ওপর তুরস্কের মত অত্যাচার করা হয়নি এটা ঠিক। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ আসে নানা খোলসে। ইরানের ক্ষেত্রে সেটা সংখ্যাগুরু ভাষা ও সংস্কৃতি আর কেন্দ্রের জবরদস্তির প্রশাসন। ওদিকে এদের বিরুদ্ধে অসন্তোষের প্রকাশটাও যখন কুর্দী ভাষার মধ্য দিয়ে হচ্ছে, তখন ফার্সীতেও সেটা সংক্রমিত হতে সময় লাগেনি। কারণ দুটো নিকটাত্মীয় ভাষা। তুরস্ক-ইরাকে কুর্দীদের যে ইতিহাস, ইরানে সেরকমটা না হলেও, স্বাধীনতার দাবি বেশ শক্তিশালী না হলেও, পুরো সমাজটাকে নাড়িয়ে দেবার ক্ষমতা যে তারা রাখে, বর্তমান ঘটনাবলী তারই চাক্ষুষ প্রমাণ।

(শেষ ছবিটির মার্সিডিজ সান ডিয়েগোতে আমাদের নেইবারহুডে মাসখানেক আগে দেখা)

নারী-জীবন-মুক্তি আন্দোলনের সপক্ষে এ গাড়িটির ওপর শ্লোগান লেখা হয়েছে, সান ডিয়েগো, ক্যালিফোর্নিয়া, মার্চ ২০২৩

রাষ্ট্রবিহীন জাতি

আগের পোস্টে বলছিলাম রাষ্ট্রবিহীন এক বিপুল জনসংখ্যার জাতির কথা। কুর্দীরা সে জাতি। বর্তমান তুরস্কের জনসংখ্যার বিশ শতাংশ কুর্দী, ইরাকের বিশ শতাংশ, সিরিয়ার দশ, আর ইরানের দশ। সব মিলিয়ে তিন থেকে সাড়ে চার কোটির মত। সঠিক সংখ্যাটা বলা খুবই মুশকিল কারণ তারা যেসব রাষ্ট্রের বাসিন্দা সেসবের জাতীয়তাবাদী নীতির কারণে অনেকে তাদের মূল পরিচয় হারিয়ে ফেলেছে, নয়ত খোলাখুলি প্রকাশ করে না। আর সরকারি গণশুমারিতে কুর্দীদের জাতিগত অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় না।

মধ্যপ্রাচ্যের কুর্দীঅধ্যুষিত এলাকার মানচিত্র

কুর্দীদের আবাসস্থল ঐ চারটি দেশের সীমানায় একটি পাহাড়ী অঞ্চলে, যার নাম জাগ্রোস মাউন্টেনস। কুর্দী প্রবাদে, পাহাড় ছাড়া তাদের কোন বন্ধু নেই। পাহাড় তাদের পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ। হয়ত পাহাড়ের দুর্গমতার কারণেই কুর্দীদের বৈচিত্রপূর্ণ ভাষাগত বিবর্তন ঘটে। সোরানি, কুরমাঞ্জি আর খওয়ারিন বলে কুর্দির অন্তত তিনটি উপভাষা। কিন্তু এদের মধ্যে মুচুয়াল ইন্টেলিজিবিলিটি বেশি নয়। ফার্সীর সাথেও নেই, যদিও কুর্দী ফার্সীর মতই ইন্দোইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত। তুরস্ক ও সিরিয়ায় কুর্দী লিখিত হয় লাতিন হরফে, ইরাক-ইরানে ফার্সী-আরবী হরফে। আজকের কুর্দী জনসংখ্যার মধ্যে ভাষার মত ধর্মের বৈচিত্রও লক্ষণীয়। শিয়া-সুন্নী ইসলামের পাশাপাশি খ্রীষ্টান, ইহুদী, জোরোয়াস্ট্রিয়ান আর আলাউয়ী, ইয়াজিদী, ইয়ারসানী প্রভৃতি সুফী ও সুফীপ্রভাবিত ধর্মবিশ্বাস কুর্দীরা অনুসরণ করে।

ইরাকী কুর্দিস্তান রোডসাইন, তিন ভাষায়
সিরিয়ার ডি ফ্যাক্টো স্বায়ত্ত্বশাসিত রোজাভা এলাকায় লাতিন হরফে কুর্দী সিনিয়েজ

অনেকের হয়ত জানা আছে, একাদশ শতকে লেভ্যান্ট ও জেরুজালেম থেকে ক্রুসেডারদের বিতাড়িত করতে সক্ষম হন যে মুসলিম সেনাপতি, সে সালাহ-আল-দ্বীনও জাতিগত কুর্দী। আইয়ুবী রাজপরিবারের সূচনা করেন তিনি। ক্রুসেডারদের বিতাড়িত করাটা ছিল সোজা কাজ, কিন্তু তাদের দূরে রাখাটা ছিল অপেক্ষাকৃত জটিল কাজ। পূর্ববতী শিয়া ফাতিমী শাসকদের রিলিজিয়াস ইনটলারেন্স পলিসি আইয়ুবীরা পরিত্যাগ করে। ক্রুসেডারদের সাথেও খ্রীষ্টানদের অধিকার নিয়ে একটা সমঝোতায় আসা হয়। জেরুজালেমে পুনরায় ইহুদীদের বসবাসের অধিকার দেয়া হয়। আইয়ুবী শাসনামলে পরে বেশ কিছু ক্রুসেড হলেও সেগুলি নানা কারণে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। শিল্প ও বিজ্ঞানেও ইসলামী জগতে একটা পুনরুজ্জীবন আসে আ‌ইয়ুবী শাসনামলে।

সালাউদ্দিনের চিত্রসম্বলিত আইয়ুবী মুদ্রা

প্রাক-আধুনিক যুগে অবশ্য কুর্দীরা দুটি বড় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে, যদিও নানা সময়ে তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামও চলে। একটি ‌অটোমান সাম্রাজ্য, অন্যটি ইরানের সাফাভী সাম্রাজ্য। সেটা ষোড়শ-সপ্তদশ শতকের কথা। ধর্মীয়ভাবে সুন্নী হওয়ায় অটোমানরা শিয়া সাফাভীদের দুর্বল করার জন্য নানাভাবে কুর্দীদের ব্যবহার করে। সেভাবে সাফাভী ইরানের পশ্চিমের একটা বড় এলাকা কব্জা করতে সক্ষম হয় অটোমান তুরস্ক। কয়েক বছর পর পর বিভিন্ন কুর্দী বিদ্রোহেরও সম্মুখীন হয় সাফাভীরা। তবে সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় তারা। জোরপূর্বক শিয়া মতবাদ চাপিয়ে দেয়া হয় দেশের ‌অন্যান্য জাতির মত।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগ দিয়ে বিশ্বের ‌অন্যান্য ‌অনেক জাতির মত শিক্ষিত কুর্দীরাও জাতীয়তাবাদী আদর্শের দিকে ঝুঁকে পড়ে। তবে তাদের জনসংখ্যার একটা বিপুল অংশ তখনও ট্রাইবাল লয়ালটির অনুসারী। সে কারণে দুয়েকটি জাতীয়তাবাদী কুর্দী বিদ্রোহ হলেও সেগুলি ছিল স্বল্প কিছু উপজাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ। তবে বিশ্বযুদ্ধের সময়ে দুটি বড় বিদ্রোহে গোপন সমর্থন দেয় তুর্কীদের শত্রু রুশরা। সেগুলির মূল কারণ ছিল যুদ্ধের জন্যে করবৃদ্ধি ও কনস্ক্রিপশন।

তবে কুর্দীদের একটা বড় অংশের মূল সমর্থন ছিল তুর্কী অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতি। মূলত সুন্নী ধর্মবিশ্বাসের কারণে। আর তাছাড়া তুরস্কে ১৯০৮এর ক্যু পরবর্তী সংস্কারের কারণে কুর্দী উপজাতীয় নেতাদের ছিল ভাল সম্মানজনক অবস্থান।

‌আরব ছাড়াও অটোমান তুরস্কে কুর্দী এবং আর্মেনীরা ছিল আরো দুটি বড় জাতি। এদের মধ্যে রুশদের সাহায্য করার অভিযোগে ১৯১৫তে অটোমানরা আরমেনীদের ওপর গণহত্যা চালায়। কুর্দী সৈন্যদের এ কাজে ব্যবহার করে অটোমান তুর্কীরা। প্রচুর তুর্কী-কুর্দী নাগরিক এ সংঘাতে প্রাণ হারায়।

অটোমানদের পরাজয়ের পর উইলসনের জাতিগত ভাগ্য স্বনির্ধারণ তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে আরবদের জন্যে আলাদা আবাসভূমি প্রস্তাবিত হয়। আরব ট্রাইবাল নেতারা প্যারিসে আলোচনায় অংশ নেয়।

প্যারিস শান্তি সম্মেলনে আরব প্রতিনিধি ভবিষ্যৎ জর্দানী রাজা ফয়সাল, সৌদী নন, হাশেমী

যুদ্ধ শেষে ১৯১৯এ স্যাভর্ চুক্তির আলোচনায় কুর্দী-আরমেনীদের প্রতিনিধিরাও অংশ নেয়। ১৯১৭তে রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবের ডামাডোলে একটি স্বাধীন আর্মেনিয়া রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে ইতিমধ্যে। পূর্ব তুরস্কবাসী আর্মেনিয়ানদের তার সাথে যুক্ত করে নতুন একটি বৃহত্তর আরমেনিয়ার পরিকল্পনা দেন উইলসন।

প্যারিস শান্তি আলোচনার ‌অংশ হিসাবে ১৯১৯এ যুক্তরাষ্ট্র থেকে দুই সেনেটর কিং এবং ক্রেন সিরিয়া-ইরাকে আসেন জাতিগত অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে। ১৯২২এ প্রকাশিত তাদের রিপোর্টে আশা প্রকাশ করা হয় যে, একসময় এ এলাকায় বহুজাতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সার্বভৌম রাষ্ট্র স্থাপন সম্ভব। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে তাদের স্বাধীনতা দেয়া হবে ভুল। মূল কারণ জাতিগত ও উপজাতীয় দ্বন্দ্ব, আর আধুনিক শিক্ষা ও সাক্ষরতার অভাব। ফিলিস্তিনে ইহুদী আবাসভূমি পুনর্স্থাপনের ব্যাপরটাও তারা সমর্থন করেননি। কারণ সেখানে ইতিমধ্যে অইহুদী একাধিক জাতি রয়েছে যাদের ডিসএনফ্রাঞ্চাইজ করা সম্ভব নয়। সামরিক জোর ব্যতিরেকে সে কাজ অসম্ভব। তবে কুর্দিস্তানের ব্যাপারে কিং-ক্রেন আলাদা আবাসভূমির পক্ষে মত দেন।

উইলসনিয়ান আরমেনিয়া
কিং ক্রেন কমিশনের রিপোর্ট

কিং-ক্রেন বা উইলসন যাই বলুন বা ভাবুন না কেন, ইতিহাসের চাকা ঘোরে নিজের ইচ্ছেমত। কুর্দী-আরমেনীদের জাতিগত ভাগ্য স্বনির্ধারণের আগেই দুটো ব্যাপার ঘটে যায়। উইলসন পরাজিত হন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে, যুক্তরাষ্ট্র সকল আন্তর্জাতিক এনগেজমেন্ট থেকে গুঁটিয়ে আইসোলেশনিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত হয়। লীগ অফ নেশনসে যোগদান দূরের কথা, ‌অটোমান সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের আলোচনা থেকেও সরে আসে।

আর দ্বিতীয় ঘটনাটা হল, তুরস্কে তুর্কী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে স্বাধীনতা যুদ্ধ। এই নতুন তুর্কী পুনরজ্জীবনের জোয়ারে পশ্চিম উপকূল থেকে গ্রীক দখলদার সেনাবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। আর পূর্বে কুর্দী-আর্মেনী এলাকাও আতাতুর্কের তুর্কী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ততদিনে খোদ রাশিয়া এবং রুশ আর্মেনিয়াতেও বলশেভিকরা ক্ষমতা পুনর্দখল করতে সমর্থ হয়েছে। তারা তুরস্কের সাথে পৃথক শান্তি আলোচনার মাধ্যমে ককেশাসের জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, আজারবাইজানের সীমানা নির্ধারণ করে নেয়। বলা বাহুল্য এর ফলে আরমেনীদের যুক্তিসংগত দাবিটিও মাটিচাপা পড়ে যায় আর তুরস্কের আরমেনিয়ান অধ্যুষিত এলাকাটি তুরস্কের অধীনস্থই রয়ে যায়।

এই নতুন পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে স্যাভরে অটোমানদের সাথে সইকৃত চুক্তিটি রদ করতে বাধ্য হয় মিত্রশক্তি। নতুন করে লোজান চুক্তি হয়। যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতিতে ফ্রান্স-ব্রিটেন ফিরে যায় তাদের পুরনো সাম্রাজ্যবাদী চেহারায়। যুদ্ধ চলাকালীন সময়েই ১৯১৫তে একটা গোপন চুক্তি করেছিল তারা। সে চুক্তি অনুযায়ী সিরিয়া-ইরাকের মাঝ বরাবর একটা সোজা লাইন টেনে সীমানা নির্ধারিত হয়। তার একপাশে সিরিয়া-লেবানন থাকবে ফরাসী অধিকৃত। মেসোপটেমিয়া-প্যালেস্টাইন-ট্রান্সজর্দান হবে ব্রিটিশদের অধীন।

লোজান চুক্তি পরবর্তী মানচিত্রে উইলসনিয়ান আর্মেনিয়া ও কুর্দীস্তান অনুপস্থিত

১৯১৭ সালে সোভিয়েতরা হাঁটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছিল এ গোপন সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রের। মার্কিনরাও এটি পুরোপুরি অবগত ছিল না। শুধু রুশ ও ইতালীয়রা জানত। ১৯২১ নাগাদ নতুন পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সেই গোপন চুক্তিই প্রকারান্তরে বাস্তবায়িত হয়। ফরাসী-ব্রিটিশরা সিরিয়ার উত্তর ও ইরাকের উত্তরের মোসুলে কুর্দীদের জন্যে জায়গা ছাড়তে ছিল নারাজ। আর আতাতুর্কও তুরস্কের কুর্দী অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণে। বিশ্বযুদ্ধে অংশ না নেয়ায় ইরানের কুর্দিস্তানেরও ভাগ্য আলোচনার বিষয়বস্তু নয়। এভাবে কুর্দী আবাসভূমির স্বপ্নটা শুরুতেই ধূলিসাৎ হয়ে যায়।

ব্রিটিশ ম্যান্ডেটরি ইরাকে ব্রিটিশদের সাথে মিত্রতায় আবদ্ধ কুর্দীরা ব্রিটিশদের পয়সায় দ্রুত শক্তিবৃদ্ধি করে। কিন্তু তাদের উপজাতীয় নেতা স্বাধীনতা ঘোষণা করে একটি রাজতন্ত্রী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে ব্রিটিশরা দ্রুত সে বিদ্রোহ দমন করে।

মাহমুদ বারজানজী — “কিং ‌অফ কুর্দীস্তান”

বিশ ও ত্রিশের দশকে ম্যান্ডেটরি ও রাজতন্ত্রী ইরাক উভয় রেজিমের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ হয়। একাধিক কুর্দী বিদ্রোহ দমন করতে হয় ইরান ও তুরস্ক উভয়কেই। সিরিয়ায় অবশ্য ফরাসীরা কুর্দীদের স্বাগত জানায়, তাদের আরব সংখ্যাগুরু জনসংখ্যার বিপরীতে ব্যালান্স আনার জন্য।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত কুর্দী স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল ট্রাইবাল লয়ালটির ওপর ভিত্তি করে। জাতীয়তাবাদী আদর্শের প্রভাব শিক্ষিত মানুষের ওপর থাকলেও উপজাতীয় নেতারা নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধির জন্যই স্বাধীনতার পক্ষে বিপক্ষে অবস্থান নেয়। বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে প্রতিযোগিতাও চলে এ ব্যাপারে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে কুর্দী বিচ্ছিন্নতাবাদের চরিত্র পাল্টে যেতে শুরু করে। উপজাতীয় চরিত্রের জায়গা নিতে শুরু করে জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থী আদর্শবাদের রাজনীতি। আর তাদের স্বপ্নপূরণের পথে আরও বেশি শক্ত অবস্থান নেয় উপনিবেশপরবর্তী আরব ও তুর্কী রাষ্ট্রগুলি। পরবর্তী খন্ডে তুলে ধরব আধুনিক কালে কুর্দী স্বাধিকার সংগ্রামের খন্ডচিত্র।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!