আদি ইসলামী মুদ্রা – ২

আদি ইসলামী মুদ্রা নিয়ে এটা আমার দ্বিতীয় লেখা — প্রথম লেখা এখানে

আজকে লিখছি আরব দিগ্বিজয়ের সমসাময়িক সিরিয়ার মুদ্রা নিয়ে। ছবির মুদ্রাগুলো আমার সংগ্রহ থেকে। ভালমত খেয়াল করলে দেখবেন, বিজ্যান্টাইন ধাঁচের মুদ্রাগুলিতে সম্রাট কিংবা খলীফার ছবি তো রয়েছেই, তার সাথে দৃশ্যমান একাধিক ক্রুশ। কখনো এসব খ্রীষ্টান প্রতীকের পাশাপাশি আরবীতে ধর্মীয় কিংবা ধর্মনিরপেক্ষ অনুবাক্য লেখা। মুদ্রাগুলির বর্ণনার পর তদকালীন ঘটনাবলীর সংক্ষিপ্ত একটা বিবরণ দেব, তারপর কিছু কৌতূহলোদ্দীপক বিশ্লেষণ।

এখানে দেখানো সব মুদ্রাই তামার তৈরি। কালের বিবর্তনে অনেকটা ক্ষয়ে গেছে, তারপরও ছাঁপগুলি দৃশ্যমান। এগুলি চালু ছিল পূর্ব রোম সাম্রাজ্যে, যার প্রচলিত নাম বিজ্যান্টিন সাম্রাজ্য। আরবদের কাছে এ সাম্রাজ্য পরিচিত ছিল ‘রূম’ হিসাবে। কুরআনে একটি সুরাও রয়েছে একই নামে। এ সুরায় রোম আর পারস্যের সাসানী সাম্রাজ্যের চিরন্তন রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার শেষ ফলের ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে।

বিজ্যান্টিন সাম্রাজ্যে এই নিম্ন মূল্যের মুদ্রা পরিচিত ছিল ফোলিস নামে। আরবদের কাছে এর নাম ফালস, বর্তমানযুগের বহু আরবীভাষী দেশে দিরহাম বা দিনারের থেকে ছোট মানের মুদ্রাকে বলা হয় ফিলস, বহুবচনে ফুলুস। সন্দেহ নেই, আরবী নামটির উৎস সেই লাতিন ফোলিস।

বিজ্যান্টিন সম্রাট দ্বিতীয় কন্সট্যান্সের তাম্রমুদ্রা

ছবির প্রথম মুদ্রা খোদ বিজ্যান্টিন সাম্রাজ্যের। ৬৪১ থেকে ৬৬৮ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত চালু ছিল। এক পিঠে বড় করে লাতিন হরফ ‘এম’ লেখা, এটা মুদ্রা মানের প্রতীক। সাথে লাতিন হরফে টাঁকশালের নামের কয়েকটি অক্ষর আর বছর। অপর পিঠে দন্ডায়মান সম্রাট দ্বিতীয় কন্সট্যান্স, ডানহাতে ক্রুশমন্ডিত রাজদন্ড, আরেক হাতে ক্রুশওয়ালা গ্লোব — গ্লোবুস ক্রুসিজের।

পরের আটটি ছবির মুদ্রা সিরিয়ায় প্রচলিত ছিল এমন এক সময়ে যখন সে দেশটি আর বিজ্যান্টিনদের হাতে নেই। ৬৩৫ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে দামেস্ক থেকে জেরুজালেম পর্যন্ত অধিকাংশ এলাকা হয়েছে নতুন ইসলামী রাশিদুন খেলাফতের করায়ত্ত। মুদ্রাগুলি নতুন প্রশাসনের আশীর্বাদপুষ্ট। দেখা যাচ্ছে, বিজ্যান্টিনদের আমল থেকে মুদ্রার চেহারার এমন কোন পরিবর্তন হয়নি। সেই ‘এম’, সেই সম্রাটের কায়া, এমনকি ক্রস পর্যন্ত। মুদ্রা গবেষকরা কিভাবে আলাদা করে বুঝলেন এগুলি ইসলামী মুদ্রা? এর কারণ, একটু নজর দিলে বোঝা যাবে মুদ্রার ছাঁচে পরিবর্তন, গুণমানের তফাত। আরো চোখে পড়বে এখানে সেখানে ত্রুটিপূর্ণ লাতিনের ব্যবহার। আর কোন ক্ষেত্রে মুদ্রার আকৃতি ও ওজন বিজ্যান্টিন মুদ্রার থেকে ভিন্ন। বিজ্যান্টিনসদৃশ এই ইমিটেশনগুলিকে নিউমিজম্যাটিস্টরা নাম দিয়েছেন স্যুডো-বিজ্যান্টিন। সময়কাল ৬৪৭ থেকে ৬৭০ সালের মধ্যে। সবচেয়ে পুরনোটিতে তিন ক্রসধারী ‘সম্রাটের’ ছবি, সময়কাল ৬৩৮-৬৪৩।

রাশিদুন খিলাফাতের আমলের সিউডো-বিজ্যান্টিন ‘তিন সম্রাট’ ফালস
রাশিদুন খিলাফাতের আমলের সিউডো-বিজ্যান্টিন ‘দ্বিতীয় কন্সট্যান্স’ ইমিটেশন ফোলিস
রাশিদুন খিলাফাতের আমলের সিউডো-বিজ্যান্টিন ‘দ্বিতীয় কন্সট্যান্স’ ইমিটেশন ফোলিস
রাশিদুন খিলাফাতের আমলের সিউডো-বিজ্যান্টিন ‘দ্বিতীয় কন্সট্যান্স’ ইমিটেশন ফোলিস
রাশিদুন খিলাফাতের আমলের সিউডো-বিজ্যান্টিন ‘দ্বিতীয় কন্সট্যান্স’ ইমিটেশন ফোলিস
রাশিদুন খিলাফাতের আমলের সিউডো-বিজ্যান্টিন ‘সম্রাত-সম্রাজ্ঞী’ ইমিটেশন ফোলিস
রাশিদুন খিলাফাতের আমলের সিউডো-বিজ্যান্টিন ‘দ্বিতীয় কন্সট্যান্স’ ইমিটেশন ফোলিস
রাশিদুন খিলাফাতের আমলের সিউডো-বিজ্যান্টিন ‘দাঁড়িওয়ালা
দ্বিতীয় কন্সট্যান্স’ ইমিটেশন ফোলিস

আর সব শেষের পাঁচটি মুদ্রা রাশিদুন খেলাফত পরবর্তী উমাইয়া খলীফাদের সময়কার সিরিয়া-প্যালেস্টাইনের।

প্রথম দুটি প্রথম উমাইয়া শাসক মুয়া’বিয়ার সময়কার (শাসনকাল ৬৬১-৬৮০), যার সাথে চতুর্থ রাশিদুন খলীফা আলীর সংঘাত দিয়ে ইসলামের প্রথম ‘ফিতনা’ বা গৃহযুদ্ধের শুরু। একটি মুদ্রা দেখতে হুবহু আগের আমলের স্যুডো-বিজ্যান্টিনগুলির মত। অন্যটিতে একটু তফাত চোখে পড়ে। ক্রসওয়ালা রাজন্ডধারী ‘সম্রাটের’ ঠিক সামনে আরবীতে ওপর থেকে নিচে ‘বিসমিল্লাহ’ লেখা। আর অপর পিঠে এম অক্ষরের ওপরে বামপাশে অর্ধচন্দ্র, ডানপাশে ছয়মাথা তারা। অস্পষ্ট কিন্তু এমের নিচেও আরবীতে ‘তাইয়িব’ লেখা, যার অর্থ ‘উত্তম’ অর্থাৎ এই মুদ্রা লেনদেনের জন্যে স্বীকৃত।

পরের তিনটি মু্য়া’বিয়ার উত্তরসূরী আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ানের সময়ের। উমাইয়া বংশের পঞ্চম এই খলীফা ৬৮৫ থেকে ৭০৫ পর্যন্ত শাসন করেন। তার মূল কৃতিত্ব ছিল মুয়া’বিয়ার মৃত্যুর পর শুরু হওয়া দ্বিতীয় ফিতনার অবসান ঘটিয়ে পুরো সাম্রাজ্যকে একীভূত করা। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি ইসলামের জন্যে একটি গঠনমূলক সময়। সে ব্যাপারে বিস্তারিত ভিন্ন পোস্টে বলবো। আব্দুল মালিকের মুদ্রা দুটির প্রথমটিতে সেই সম্রাটের ছবি, হাতে গ্লোবাস ক্রুসিজের, মাথায় ক্রুশধারী মুকুট। সাথে গ্রীকে লেখা ΚΑΛΟΝ – কালোন, অর্থ ‘উত্তম’। অন্যপাশে আরবীতে লেখা ‘বি-হিমস’ অর্থাৎ এমেসা বা হিমস (বর্তমান হোমস) শহরে মুদ্রিত। অপরপিঠে এম অক্ষর, ওপরে সাতমাথা তারকা, আর দুপাশে গ্রীক অক্ষরেও এমেসা শহরে মুদ্রিত লেখা — এমেসিস — ΕΜΙ/СΗС। নিচে আরবীতে ‘তাইয়িব।’ দ্বিতীয় মুদ্রাটিতেও সম্রাট-ক্রস, আর এমের নিচে আরবী লেখা ‘আল-ওয়াফা লিল্লাহ’ — অর্থাৎ বিশ্বস্ততা আল্লাহর। কোন ধর্মীয় পুস্তকে বা দোয়ার মধ্যে এখন এমন অনুবাক্য অবিশ্বাস্যকরভাবে অনুপস্থিত। তৃতীয় মুদ্রায় ক্রসধারী তিন বিজ্যান্টিন সম্রাটের মূর্তি এক পিঠে। আরেক পিঠে এম অক্ষরের ওপর খ্রীষ্টান কাই-রো গুপ্তলিপি (এমনটার ব্যবহার কুরআনেও রয়েছে, যেমন ইয়া-সীন)। আর তিন পাশে আরবী লেখা — ফালস আল-হাক্ব বি-বাইসান। অর্থাৎ বাইসান (স্কাইথোপোলিস) শহরে মুদ্রিত প্রকৃত ফালস। শহরটি বর্তমান ইসরাইলের বেইত-শে’আন।

প্রথম উমাইয়া খলিফা মুয়া’বিয়ার আমলের সিউডো-বিজ্যান্টিন ‘দ্বিতীয় কন্সট্যান্স’ ইমিটেশন ফোলিস
মুয়া’বিয়ার আমলের সিউডো-বিজ্যান্টিন ‘দ্বিতীয় কন্সট্যান্স’ ইমিটেশন ফোলিস, বিসমিল্লাহ অংকিত
আব্দুল মালিকের আমলের সিউডো-বিজ্যান্টিন ‘দ্বিতীয় কন্সট্যান্স’ ইমিটেশন ফোলিস, বি-হিমস/তাইয়িব অংকিত
আব্দুল মালিকের আমলের সিউডো-বিজ্যান্টিন ‘দ্বিতীয় কন্সট্যান্স’ ইমিটেশন ফোলিস, আল-ওয়াফা লিল্লাহ অংকিত
আব্দুল মালিকের আমলের সিউডো-বিজ্যান্টিন ‘তিন সম্রাট’ ইমিটেশন ফোলিস, ফালস আল-হাক্ব বি-বাইসান’ অংকিত

সিরিয়াতে কিভাবে ৬৩৩-৬৩৬এর ভেতর ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠিত হল, তার জন্য দুইটি বিপরীত প্রেক্ষাপট চিন্তা করে দেখতে হবে। এক, বিজ্যান্টিন-সাসানী সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক অবস্থা ও তাদের মধ্যে একটানা যুদ্ধবিগ্রহ। আরেকটি হলো আরব উপদ্বীপে ট্রাইবাল সিস্টেমের বহুত্বভিত্তিক পরিচয় শেষ হয়ে ইসলামী একত্বভিত্তিক আত্মপরিচয়ের শুরু।

লেইট অ্যান্টিকুইটি বলে ৩০০ থেকে ৭০০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত যে সময়টা, তখন সভ্য বিশ্বে দুইটি পরাশক্তি — কনস্ট্যান্টিনোপলভিত্তিক বিজ্যান্টিন সাম্রাজ্য আর বাগদাদের নিকটবর্তী ক্টেসিফোনভিত্তিক পারসিক সাসানী সাম্রাজ্য। রোমান সাম্রাজ্যের সাথে সামরিক প্রতিযোগিতার ধারাবাহিকতায় বিজ্যান্টিনরা সাসানীদের বিরুদ্ধে পর্যায়ক্রমে লড়ে ৫০২-৫০৭এ আনাস্তাসিয়ান যুদ্ধ, ৫২৪-৫৩২এ আইবেরিয়ান যুদ্ধ, ৫৪০-৫৫৭তে জাস্টিনিয়ান-খসরুর যুদ্ধ, ৫৭২-৫৯১এ ককেশাসের যুদ্ধ, আর শেষমেশ ৬০২-৬২৮এর বিজ্যান্টিন-সাসানী যুদ্ধ।

৬০০ খ্রিষ্টাব্দের আশপাশ দিয়ে সাসানী-বিজ্যান্টিন সাম্রাজ্যের সাথে স্থানীয় রাজ্যগুলির মানচিত্র

এ যুদ্ধগুলো মহাযুদ্ধের থেকে কম কিছু ছিল না। দুই সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রদেশের বিভিন্নভাষী সৈন্য এসবে অংশ নেয়। বড় শহর অবরোধ ও গ্রামাঞ্চলের কৃষিক্ষেত্রের ধ্বংসসাধন ছিল নিত্যনৈমিত্তিক। যুদ্ধে দুই সাম্রাজ্যেরই ছিল একাধিক শক্তিশালী মিত্র। ইথিওপিয়ার আক্সুম সম্রাট নাজুস ছিলেন অর্থডক্স খ্রীষ্টান ও বিজ্যান্টিনদের বন্ধু। দক্ষিণ আরবের ইয়েমেনের প্রাচীন রাজ্যগুলির একটি হিমইয়ার তখনো ছিল মোটামুটি শক্তিশালী। তাদের ওপর ছিল পারস্যের প্রভাব। এই ইয়েমেনই সংঘটিত হ্য় বিজ্যান্টিন ও সাসানীদের রক্তক্ষয়ী প্রক্সি ওয়ার। কুরআনে বর্ণিত আবরাহার সেনাবাহিনী ছিল ইথিওপিয়া থেকে প্রেরিত। তারা স্থানীয় ইয়েমেনী ইহুদী রাজার খ্রীষ্টান নির্মূল অভিযানের বদলা নিতে নাজরান এলাকায় ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। সুরা ফীল অনুযায়ী আবাবিল পাখির প্রস্তরবর্ষণে মক্কাঅভিমুখী আবরাহা আর তার হস্তীবাহিনীর নির্মম মৃত্যু হয়। ইয়েমেনের মত স্থানে খ্রীষ্টান-ইহুদীর পাশাপাশি পাগানবিশ্বাসী দক্ষিণ আরবীয় ট্রাইবের বসবাস ছিল। এদের জীবনধারা উত্তর আরবের হেজাজ আর মধ্য আরবের বেদুইনদের থেকে অনেকটা ভিন্ন ছিল।

দুই সাম্রাজ্যের আরেকটা বড় যুদ্ধক্ষেত্র ছিল আরবের উত্তরে সিরিয়া-ইরাকের বিশাল স্তেপ সমভূমি। পূর্বে ফোরাত নদীর পশ্চিম তীরে আবাস গাড়া আরব লাখমী বংশের ট্রাইব। এক দুই শতক ধরে এরা সাসানীদের আজ্ঞাবহ, কখনো কখনো রাজা স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। আর মধ্যোপসাগরীয় উপকূলের পশ্চাদভূমি সিরিয়া-জর্দানের আরব ট্রাইবগুলির নেতৃত্বে ছিল ঘাসানী বংশের গোত্রপতিরা। এরা বিজ্যান্টিনদের মিত্র হিসাবে যথেষ্ট স্বাধীনভাবে দেশ শাসন করত। এই দুই পক্ষের আরবরা যে কোন বড় যুদ্ধে ফ্রন্টলাইনে থাকত। তাদের লাইট ক্যাভালরি দিয়ে দ্রুত আক্রমণ ছিল বিজ্যান্টিন-সাসানী দুপক্ষেরই প্রমিত রণকৌশল।

৬২০-৬২৮এর যুদ্ধে সাসানীরা বিজ্যান্টিন সাম্রাজ্যের অন্তর্কলহের সুযোগ নিয়ে ইরাক-সিরিয়া পুরোটুকু দখল করে কন্সট্যান্টিনোপল পর্যন্ত চলে যায়। পুরো নিকটপ্রাচ্য পদানত হয় পারসিকদের। এই দীর্ঘ সামরিক অধিকৃতির সময়টা সিরিয়ার মানুষ বিজ্যান্টিন সাম্রাজ্যের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। খ্রীষ্টান ঘাসানী দলনেতারাও পালিয়ে যায় বিজ্যান্টিন এলাকায়। অপরদিকে সাসানীরা বিজয়ের সুযোগে ইরাকের লাখমীদের স্বাধীনতা খর্ব করে তাদের রাজাকে লাঞ্ছিত করে। পুরস্কার দূরে থাকুক, কেন্দ্রের আজ্ঞাবহ হয়ে পড়তে হয় এ এলাকার নেস্টরিয়ান খ্রীষ্টান, মানিকেইস্ট ও পাগান আরব ট্রাইবগুলিকে।

এ হলো আরব উপদ্বীপের ঠিক বাইরের ভূরাজনৈতিক চিত্র। হেজাজ ও মধ্য আরবে এই দুই সাম্রাজ্যের খুব একটা আগ্রহ ছিল না। বিশাল মরু এলাকায় নাগরিক সভ্যতা গড়ে তোলা, করসংগ্রহের মাধ্যমে তাকে টিকিয়ে রাখা কঠিন কাজ। সামান্য জীবিকার ওপর বেঁচে থাকা মরুর বেদুইনরাও কাবু করার মত মানুষ নয়। প্রায়ই এরা দল বেঁধে চড়াও হত এই এলাকার মধ্য দিয়ে যাওয়া বাণিজ্য কাফেলার ওপর। আর দুই সাম্রাজ্যের দুর্বলতা একটু টের পেলে এরা দ্রুত মরুভূমি অতিক্রম করে আক্রমণ করত সভ্যতার কিনারায় গড়ে ওঠা শহরগুলিতে। ইসলামের অভ্যুদয়ের আগেও এরা জেরুজালেম অবরোধ করেছিল একবার। এসব আক্রমণের লক্ষ্য সেসব এলাকার স্থায়ী নিয়ন্ত্রণ নেয়া নয়, শহরবাসী ও বিজ্যান্টিন গভর্নরদের কাছ থেকে ঘুষ আদায় করে কেটে পড়া।

ইসলামী ঐতিহ্য অনুযায়ী যদি ধরি মক্কা ছিল হেজাজের অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্র, তাহলে মক্কাকে ওপরের ট্রাইবগুলির ব্যতিক্রম বলতে হবে। আরব উপদ্বীপে এরকম ছোট ছোট কিছু শহর ছিল, যাদের যৎসামান্য বাণিজ্যিক গুরুত্ব ছিল, তার পাশাপাশি স্থানীয় দেবদেবীর মন্দির থাকার কারণে একটা বাৎসরিক মেলাও হত — তার ইকনমিক ইমপ্যাক্ট পড়ত স্থানীয় লোকজনদের ওপর। অর্থাৎ এ শহরগুলির বাসিন্দারা মরুর বেদুইনের মত পুরোপুরি যাযাবর নয়, বলা চলে সেমি-নোমাডিক।

এদেরই মত সেমি-নোমাডিক ঐ ঘাসানী-লাখমীরাও। বাণিজ্যকেন্দ্রিক শহর তাদেরও ছিল। দক্ষিণ আরবের ক্যাশ ক্রপ আতর-ধূপ আর সেমিপ্রেশাস রত্ন ইত্যাদি সিরিয়া হয়ে রোমে পৌঁছত আদিকালে। ঘাসানীদের পূর্বসূরী নাবাতীরা সেভাবে সম্পদশালী হয়ে গড়েছিল পেত্রার মত শহর। ইসলামের অভ্যুদয়ের সময় কিছুটা হলেও এ বাণিজ্য চালু ছিল — যদিও আগের মাত্রায় নয়। এই বাণিজ্যপথ ধরেই দামেস্ক-হিমস পর্যন্ত যাতায়াত ছিল মক্কার কুরাইশ ট্রাইবসহ অন্যান্য আরবদের। সেসব বড় শহরে নিঃসন্দেহে তাদের আত্মীয়স্বজনেরও বসতি ছিল। হাদীসে ঘাঁটালে দেখা যাবে, আবু জাহল, যিনি ছিলেন অন্যতম ইসলামবিদ্বেষী কুরাইশ, তার মালিকানায় নাকি দামেস্কের আশপাশে জমিজমা ছিল।

মোট কথা, সিরিয়া ও ইরাকের জনগণের শহুরে অংশ বিজ্যান্টিন বা সাসানী হলেও তাদের সেমিটিক পরিচয় বিলুপ্ত হয়নি। শহুরেদের ভাষা গ্রীকের পাশাপাশি আরামায়িক। আর নাগরিক সভ্যতার ফ্রিঞ্জে গেলে দেখা মিলবে আরামায়িকের নিকটাত্মীয় ভাষা আরবীর, আর সেমি নোমাডিক আরবদের। অর্থাৎ জাতিগত-ভাষাগত পরিচয়ের কথা চিন্তা করলে বিজ্যান্টিন বা সাসানী সাম্রাজ্যের এই এলাকাগুলি আরবদের বেশি কাছাকাছি।

ইসলামের অভ্যুদয়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল দাওয়া বা ধর্মপ্রচার। কিন্তু এটি আমরা এখন যেভাবে বুঝি তেমনটা নয়। মুহাম্মদ(সা) ছিলেন সুচতুর কূটনীতিবিদ। মক্কা ছেড়ে মদিনায় আশ্রয় নেবার কারণটাই ছিল মদিনাবাসীর অনুরোধ, যেন তিনি তাদের জাতিগত বিবাদগুলির নিষ্পত্তি করে দেন। তিনি সেটা করতে সমর্থ হন। আর এর মাধ্যমে সারা আরবের ট্রাইবগুলির একীভূত হবার বীজবপন হয়। মক্কার কুরাইশ ও তাদের মিত্রদের আক্রমণ প্রতিহত করে তিনি মদিনার ঐক্য ধরে রাখতে সক্ষম হন। পাশাপাশি একাধিক বিয়ের মাধ্যমে ও অন্যান্য প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে আরো বেদুইন ট্রাইবকে মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ করতে সমর্থ হন।

কিন্তু এসব মিত্র ট্রাইবগুলি যে সবাই মুসলিম হয়েছিল তা নয়। সাকিফ বলে ইরাকের কাছের একটি ট্রাইব তার সকল যুদ্ধে সৈন্য পাঠালেও মুসলিম হয়নি। আর মদীনায় ইহুদী ট্রাইবেরও উপস্থিতি ছিল। হাদীসে যদিও বলা হয়েছে, কুরাইশদের সাহায্য করার কারণে চুক্তিভঙের শাস্তি হিসাবে হয় এদেরকে হত্যা করা হয়, নয়ত নির্বাসনে পাঠানো হয়, আমার ধারণা সেটা সব ইহুদীদের বেলায় ঘটেনি। পরবর্তী ইসলামী দিগ্বিজয়ের সময় মুসলিমদের পাশাপাশি সম্ভবত ঘাসানী ও ইয়েমেনী খ্রীষ্টান, হেজাজি ও ইয়েমেনী ইহুদী, আর ইরাকী মানিকেইস্ট আরব যুদ্ধে পাশাপাশি অংশ নেয়। এর কারণ ইসলামের আবির্ভাবের একটি সাইড-এফেক্ট ছিল বংশপরিচয়ভিত্তিক বিভাজনের বিনাশ। এটি একবার হয়ে গেলে ধর্মীয় বিভাজনটা আর অত বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়।

মুহাম্মদ(সা)এর মৃত্যুর পর রাশিদুন প্রথম খলীফা আবু বকর কনসলিডেশন ও করসংগ্রহ শুরু করলে স্বাভাবিকভাবেই তার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ আসে। অনেক ট্রাইব আগের চুক্তি অনুযায়ী ‘জাকাত’ ট্যাক্সের বাইরে ছিল। তাদের এটা দিতে বাধ্য করা হলে এরা বেঁকে বসে। আবার কিছু ট্রাইবের নেতা মুহাম্মদ(সা)এর দেখাদেখি নিজেদের নবী বলে দাবী করে বসে। ইত্যাকার নানা বিদ্রোহ দমন করার জন্যে আবু বকর বিভিন্ন সেনাপতিকে পাঠান প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলিতে। কোন ক্ষেত্রে যুদ্ধ আর কোন ক্ষেত্রে সমঝোতা ছিল এদের পদ্ধতি। এ যুদ্ধগুলিকে একত্রে বলে ‘রিদ্দা’ যুদ্ধ। ইসলামী সেনানায়কদের বেশিরভাগই আবার ছিল মুহাম্মদ(সা)এর প্রাক্তন শত্রু, যারা মক্কার আত্মসমর্পণের পর ধর্মান্তরিত হয়। এরা যেহেতু মক্কার মত একটা কসমোপলিটান শহরের মানুষ, ম্যানেজমেন্ট, ট্রেড আর পলিটিক্স এরা ভালই বুঝত — বেদুইনদের মত নয়।

সিরিয়া ও ইরাকের বিজয় এই রিদ্দা যুদ্ধের সূত্র ধরেই। যখন এ সকল সেনানায়করা দূরদূরান্তের ট্রাইবগুলিকে বশ করতে গেছে, তখন তারা এসেছে বিজ্যান্টিন ও সাসানী ভূমিতে আবাসরত আরবদের সংস্পর্শে। স্বভাবতই এদের ট্রাইবাল পরিচয় ভেঙে তাদেরকে নতুন আরব-মুসলিম পরিচয়ের মধ্যে আনার একটা প্রচেষ্টা হয়। কোন ক্ষেত্রে যুদ্ধ কোন ক্ষেত্রে মূলো ঝুলানোর মাধ্যমে সে কাজটা হয়।

বিশেষ করে সিরিয়া ছিল আরবের বাইরে সাম্রাজ্যবিস্তারের জন্যে খুবই উপযুক্ত। ততদিনে বিজ্যান্টিনরা সাসানীদেরকে হঠিয়েছে। তারা আবার নতুন করে ঘাসানীদের মত একটা মিত্র ট্রাইবাল স্ট্রাকচার দাঁড়া করানোর চেষ্টা করছে। তাদের সে লক্ষ্যটা আবার রাশিদুন খলীফাদের লক্ষ্যের পরিপন্থী, সংঘাত ছিল অনিবার্য। তাছাড়াও সিরিয়া ছিল আরব উপদ্বীপের তুলনায় স্বর্গ। মেডিটেরানিয়ান সাগরের আর্দ্র বাতাসের কারণে সেখানে চাষাবাদ হত ভাল। বাণিজ্যের সম্পর্কও সেখানে কুরাইশ-উমাইয়াদের আগে থেকেই ছিল। তার ওপর ইসা(সা)সহ অনেক আব্রাহামিক নবীর কারণে জেরুজালেম শহরের ধর্মীয় গুরুত্বও অপরিসীম।

সিরিয়াতে শুরুতে পাঠানো পাঁচ সেনাপ্রধানের সকলেই মক্কাবাসী কুরাইশ ছিলেন, যাদের আগের জীবন ছিল ইসলামবিদ্বেষী, কিন্তু পাপমোচনের প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে ইসলামগ্রহণ করেন। সাথে তারা নিয়ে আসেন যুদ্ধের কৌশলজ্ঞান। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আমর ইবনে আবুল আস, খালিদ বিন ওয়ালিদ, ইয়াজিদ ইবনে আবু সুফিয়ান, আবু উবায়দা ইবনে আল জার্রাহ, শুরাহবিল ইবনে আবু হাসানা। এদের সৈন্যরা ছিল শুধু মক্কার কুরাইশবংশীয় নয়, ইয়েমেনের কিন্দাবংশীয় ও মধ্য আরবের তায়ী বংশীয়। অর্থাৎ মূলত রিসেন্ট মুসলিম কনভার্ট, যারা হয়ত রিদ্দা যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

আরবদের সিরিয়া অভিযানের মানচিত্র

প্রথম পর্যায়ে সিরিয়ার মরু ও গ্রামাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় এদের সেনাবাহিনী। স্থানীয় সব ট্রাইব তাদেরকে যে সাহায্য করেছিল তা নয়। ঘাসানসহ চারপাঁচটি ট্রাইব বিজ্যান্টিনদের পক্ষ নিয়ে ছোট ছোট যুদ্ধে লড়ে। কিন্তু খুব একটা সুবিধা তারা করতে পারে না। দামেস্কের মত শহরগুলি বহু সংঘাত দেখে ক্লান্ত, আরব সেনাবাহিনী তাদের দ্বারে আসলে নামমাত্র প্রতিরোধ করার পর করপ্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আত্মসমর্পণ করে। ধর্মান্তরের কোন শর্ত ছিল না। আর এধরনের কর তারা সাসানী কিংবা বিজ্যান্টিনদের আগে থেকেই দিয়ে এসেছে।

দ্বিতীয় পর্যায়ে বিজ্যান্টিনরা ঘটনার সংবেদনশীলতা আঁচ করতে পেরে বড় সেনাবাহিনী নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সম্রাট হেরাক্লিয়াস স্বয়ং সিরিয়ার অ্যান্টিয়োক শহর থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। প্রথমদিকে ধরাশায়ী শহরগুলি এ সুযোগে আবার পক্ষপরিবর্তন করে। কিন্তু যুদ্ধকৌশলের সুবাদে কিংবা নেহাত ভাগ্যক্রমে সংখ্যায় কম আরব সৈন্যদলের কাছে বিজ্যান্টিনরা একে একে পরাজিত হয় আজনাদাইন আর ইয়ারমুকের মত গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে। যুদ্ধে নিহত হয় হেরাক্লিয়াসের বহু নিকট সেনাপ্রধান, ৬৩৫এ সিরিয়া ছেড়ে কন্সট্যান্টিনোপলে ফিরে যান তিনি। সে বছরই দামেস্ক পুনরায় আরবদের করতলগত হয়। তারপর ৬৩৬এ জেরুজালেম অবরোধ করে বসে আরবরা। শহরটির অর্থডক্স খ্রীষ্টান প্যাট্রিয়ার্ক সোফ্রোনিয়াস আরবদের সাথে চুক্তি করে জেরুজালেম তাদের হাতে তুলে দেন। চুক্তির অন্যতম শর্ত ছিল জেরুজালেমে ইহুদীদের পুনর্বাসন করা যাবে না।

তৃতীয় পর্যায়ে বিজ্যান্টিন সাম্রাজ্য থেকে এ এলাকায় সরাসরি আর কোন হস্তক্ষেপ আসে না। মোটামুটি ৫০ বছরের জন্যে চিন্তাহীনভাবে চলে রাশিদুন ও উমাইয়া খলীফাদের শাসন, বিজ্যান্টিনরা ৬৯০এর দিকে একটিবার চেষ্টা চালায় কিন্তু শেষমেশ ঘুষ নিয়ে চলে যায়। উমাইয়া শাসনামলে মদীনা থেকে খেলাফতের গদি সরিয়ে নিয়ে আনা হয় দামেস্কে, কারণ শহরটির অবস্থান ছিল কৌশলগতভাবে আরো গুরুত্বপূর্ণ ও বিশ্ববাণিজ্যের সাথে সংযুক্ত। আশপাশের তুলনামূলক দুর্গম এলাকাগুলিতে বিদ্রোহী জনগোষ্ঠী ধীরে ধীরে উমাইয়াদের বশ্যতা স্বীকার করে। এদের মধ্যে অ্যান্টি-লেবানন পর্বতের ম্যারোনাইট খ্রীষ্টান মার্দাইটরা বহুদিন কার্যত স্বাধীন ছিল। এসব বিচ্ছিন্ন জনপদ করপ্রদান ছাড়াও অন্যান্য নানা শর্ত মেনে নিয়ে উমাইয়াদের শাসন মেনে নেয়।

এই হল মুসলিমদের সিরিয়া বিজয়ের সম্পূর্ণ না হলেও সংক্ষিপ্ত একটা আউটলাইন। এবার কিছু ইন্টারেস্টিং পর্যবেক্ষণ আর প্রশ্ন করি। প্রশ্নগুলির কিছুর উত্তর আছে, কিছুর সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা নেই।

প্রথমত, আদি ইসলামী শাসকরা বর্বর যাযাবর ছিল না। মক্কা-মদীনা-তায়েফের মত হেজাজের কমবেশি গুরুত্বপূর্ণ শহরের বাসিন্দা ছিল এরা। সিরিয়ার সভ্য আরব গোত্রদের সাথে বাণিজ্যিক খাতিরে তাদের যোগাযোগ ছিল। টাকাপয়সা আর কর আদায়ের গুরুত্বটা আগের রেজিমগুলির মত তাদের বেশ ভালই জানা ছিল। ইরাকের আরব গোত্রগুলোর ওপর সাসানীদের চাপিয়ে দেয়া ‘ইতিওয়া’ করের সাথে যেমন তারা পরিচিত ছিল, তেমনই তাদের নিজেদের সমাজেও দুর্বল ট্রাইবদের থেকে তারা প্রটেকশন মানি হিসাবে খুউওয়া নামে কর আদায় করত। সিরিয়ার এই মুদ্রাগুলির ডিজাইনের পেছনে সেটাই মটিভেশন। যে নতুন ধর্মই তারা গ্রহণ করুক না কেন, বাণিজ্য-অর্থনীতির কোন ডিসরাপশন হবে না, চলতে থাকবে। একই কারণে মুহাম্মদ(সা)এর মৃত্যুর পর আদি ইসলামী কম্যুনিটিতে তার বংশ বনু হাশিমের পরিবর্তে প্রভাব বেড়েছে বাণিজ্যে অগ্রগণ্য বনু উমাইয়া গোত্রের। তৃতীয় খলীফা উসমান ছিলেন তাদেরই এক গোত্রনেতা। তেমনটা ছিলেন প্রথম উমাইয়া খলীফা মুয়া’বিয়া।

দ্বিতীয়ত, কর আর অর্থনীতি চালু রাখতে মু্দ্রাব্যবস্থার হঠাৎ কোন সংস্কার তারা করেনি। একই রকম বিজ্যান্টিন মুদ্রা চালু রেখেছে, এমনকি ৬৬০এর দশক পর্যন্ত সরাসরি বিজ্যান্টিন সাম্রাজ্য থেকে তাম্রমুদ্রা আমদানি করেছে। নিজেরা মুদ্রণ শুরু করলেও মানব অবয়ব কিংবা ভিন্নধর্মীয় প্রতীক ব্যবহারের ব্যাপারে কার্পণ্য করেনি। তাতে আরবী অক্ষর আনতেও সময় লাগিয়েছে ত্রিশ বছরের বেশি। এটা রাশিদুন খলীফাদের সময়েও হয়েছে, কিন্তু তারা তাদের নামের কোন চিহ্ন এসব মুদ্রায় রেখে যাননি, যেটা পরবর্তী উমাইয়ারা করেছেন।

মুয়া’বিয়া আর তার পুত্র ইয়াজিদকে পরবর্তী ইসলামী ইতিহাসবিদরা, বিশেষ করে শিয়ারা, গুপ্ত খ্রীষ্টান আখ্যায়িত করে। তার একটা মূল কারণ, উমাইয়া সাম্রাজ্যের শক্তির কেন্দ্র ছিল সিরিয়া যেটা প্রাক্তন বিজ্যান্টিন এলাকা, পারস্য-ইরানের নয়। দ্বিতীয় কারণ আলী আর তার পুত্রদের সাথে এদের সংঘাত। আরেকটা কারণ হতে পারে পরবর্তী যুগের ইতিহাসবিদরা এসব মুদ্রা দেখেই সে ধারণায় উপনীত হয়েছেন এবং সেটাই লিখে গেছেন। আসল ব্যাপারটা হল, মুয়া’বিয়া একবার মানবঅবয়ববিহীন স্বর্ণমুদ্রা চালু করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সিরিয়ার সভ্য মানুষের কাছে তখনো মুদ্রার ফিয়াত মূল্যের সাথে সম্রাট-ক্রস প্রভৃতির ইমেজ সংযুক্ত। মুয়া’বিয়ার প্রথম প্রচেষ্টার মুদ্রাগুলিকে কেউ গ্রহণ না করায় বাধ্য হয়ে আগের মুদ্রার নকশা ফিরিয়ে আনতে হয় তাকে।

একই প্রসঙ্গে বলা ভাল, শুধু মুদ্রায় নয়। জর্দান ও ইসরাইলের মরুভূমিতে রয়েছে বেশ কিছু প্রাচীন উমাইয়া প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ। সেসবে রয়েছে খুবই হৃদয়গ্রাহী ও প্রাণবন্ত মানুষ ও পশুপাখির মূর্তি। অর্থাৎ, শুধু মু্দ্রায় নয় ব্যক্তিগত জীবনেও উমাইয়ারা ইসলামের বর্তমান স্বীকৃত ট্যাবুর একটি ভেঙেছেন, আর পরবর্তী ধর্মগুরুদের থেকে তাদের ধর্মবিচ্যুতির অভিযোগ একটা খেয়াল করার মত ব্যাপার। আরো উল্লেখ্য, কুরআনে সরাসরি ছবি আঁকা, মূর্তি বানানোর নিষেধাজ্ঞা নেই, যদি না তার উদ্দেশ্য খোদার শরীক করে পূজো করা হয়। এসব ট্যাবুর ভিত্তি হাদীসে, যেগুলি সংকলিত হয় এসব মুদ্রা ও প্রাসাদের পত্তনেরও একশ বছর পর।

জর্দানের কুসাইর আমরার উমাইয়া প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের ভেতর ফ্রেস্কো ছবি
জর্দানের কুসাইর আমরার উমাইয়া প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের ভেতর ফ্রেস্কো ছবি
প্যালেস্টাইনের পশ্চিম তীরের খিরবাত আল মাফজার উমাইয়া প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের ভেতর দন্ডায়মান খলিফার মূর্তি, পাদানিতে দুইটি সিংহ
প্যালেস্টাইনের পশ্চিম তীরের খিরবাত আল মাফজার উমাইয়া প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের ভেতর ফ্রেস্কো ছবি

তৃতীয়ত, চাঁদ-তারা প্রতীক। এ প্রতীক উমাইয়া মুদ্রায় দেখা যায় আর পরবর্তীতে ইসলামী প্রতীক হিসাবেও তার ব্যবহার হয়। কিন্তু এটি আরো পুরনো সিম্বল। বিজ্যান্টিন আর সাসানী দুই সাম্রাজ্যের মুদ্রাতেই চাঁদতারা ব্যবহৃত। আসলে চাঁদ ও তারা, যেটা কিনা আসলে শুক্রগ্রহ, পাগান একটি সিম্বল। রোমান পাগান বিশ্বাসে দেবী ডায়ানার প্রতীক চাঁদ ও তারা। তেমন প্রাচীন মেসোপটেমিয়ান দেবী ইশতারেরও, যেটা চলে এসেছে সাসানী মুদ্রায়। এ বিধর্মী চিহ্নটি কি জেনেশুনে অ্যাডপ্ট করেছিল আদি মুসলিম শাসকরা? আজকাল অনেকে বলে চাঁদ-তারার জন্যে দায়ী অটোমানরা। সেটা অর্ধসত্য, এই মুদ্রাগুলি চাঁদ-তারার আদি গুরুত্বের প্রমাণ।

চতুর্থত, আল ওয়াফা লিল্লাহ। লয়াল্টি বিলংগস টু আল্লাহ। এমন অনুবাক্য কেন অন্য কোথাও আর চোখে পড়ে না? বিসমিল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মুহাম্মাদ রাসুলাল্লাহ, লিল্লাহিল হামদ, ইনিল হুকমু ইল্লা লিল্লাহ, লা হাওলা ওয়া কুওয়াতা…, আল্লাহুস সামাদ… — ইত্যাদি জিকর ও সুরার অংশবিশেষ উমাইয়া আমলের মুদ্রায় দেখা যায়, যেগুলি এখনো সুপরিচিত। কিন্তু আল ওয়াফা লিল্লাহ — এর কোন খোঁজ নেই। কোথা থেকে এল? আর কোথায় গেল? আগে ছিল? আগে থাকলে হারিয়ে গেল কিভাবে?

পরবর্তী উমাইয়া ফালসে মানব অবয়ব না থাকলেও চাঁদ-তারা চলে যায়নি

পঞ্চমত, আরব সেনাবাহিনীতে ইহুদী ও খ্রীষ্টানদের সম্ভাব্য উপস্থিতি। তদকালীন সিরিয়াক-কপ্টিক-গ্রীক ভাষায় লিখিত ইতিহাসবিদদের বিবরণীর কোথাও মুসলিম বা ইসলাম শব্দটি পাওয়া যায় না। তাদের বিবরণীতে নতুন আরব শাসকদের নাম ‘মাহগেরে’ বা মাহগ্রায়ে। কোথাও তায়ী গোত্রের নামে তাইইয়ায়ে। মাহগ্রায়ে শব্দটি আরবী মুহাজির শব্দের অপভ্রংশ। মদীনায় যে আদি মুসলিমরা মক্কা থেকে গিয়েছিলেন তাদের নাম মুহাজির বা স্বেচ্ছানির্বাসিত। ইসলামে এখনও হিজরতের একটা রিচুয়াল সিগনিফিক্যান্স আছে। এখন এরা মুসলিম ছিল নাকি বিভিন্ন ধর্মের আরবের অংশগ্রহণ সেখানে ছিল এটা একটা বিশাল প্রশ্ন।

সোফ্রোনিয়াসের চুক্তিতে ইহুদীদের জেরুজালেমে পুনর্বাসন নিষেধের যে শর্তটা, সেটা কি বিজয়ী আরব সেনাদলে ইহুদীদের অন্তর্ভুক্তির কারণে? নাকি মদিনা আর সংলগ্ন এলাকা থেকে খলীফা উমরের সময় কথিত ইহুদী উচ্ছেদের রিঅ্যাকশন? এখানে উল্লেখ্য, ৬২০-২৮এর সাসানী-বিজ্যান্টিনদের মহাযুদ্ধের অংশ হিসাবে একটি ইহুদী বিদ্রোহও সংঘটিত হয়। বিজ্যান্টিনদের দুর্বলতার সুযোগে সিরিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে আবাসরত ইহুদীরা প্যালেস্টাইন প্রিমা প্রদেশে একটি স্বায়ত্তশাসিত রাজ্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। আরব দিগ্বিজয়ের সময়ে কি এরা তুতো ভাই আরবদের সাথে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে সৈন্যদল দিয়ে সাহায্য করে? বর্তমান যুগে ইহুদীদেরকে মুসলিম বিশ্ব দু’চোখে না দেখতে পারলেও ইসলামের ইতিহাসের তুলনামূলক অধিক সময়ে তাদের সাথে ভাল সম্পর্ক ছিল, এমনকি তাদের ধর্ম ও দর্শনও ইসলাম দ্বারা প্রভাবিত হয়। যদি উভয়ে দলবদ্ধ হয়ে সিরিয়া-প্যালেস্টাইনের দখল নেয়, তাতে অবাক হব না। পরের ইসলামী ইতিহাসবিদরা যা লিখে গেছেন, তার অধিকাংশ তাদের সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে সেল্ফ-সার্ভিং হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। অন্তত সমসাময়িক অনৈসলামী উৎস সেরকমই ইঙ্গিত দেয়।

আজ এ পর্যন্তই। এতগুলি প্রশ্ন করার কারণ এসট্যাবলিশমেন্টকে আঘাত করা নয়, অবজেক্টিভ পদ্ধতিতে ইতিহাস নিরূপণ। আশা করি, পাঠক ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।

প্রাচীন বিশ্বের বাণিজ্য

সুইডেনে আবিষ্কৃত আব্বাসী খেলাফতের দিরহাম।

ছবির রৌপ্যমুদ্রাগুলি আব্বাসী খেলাফতের দিরহাম। মুদ্রার পিঠে খলীফার নামের পাশাপাশি আল্লাহ-রাসুলের নামে কালেমা লেখা। এ মুদ্রা খুব একটা দুর্লভ নয়। তবে এগুলি যে জায়গায় আবিষ্কৃত হয়েছে, সেটাই পিলে-চমকানো ব্যাপার! উৎপত্তিস্থল বাগদাদ কিংবা দামেস্ক থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মাইল উত্তরে, একাধিক পর্বত-সাগর-নদী পেরিয়ে সুইডেনের স্টকহোমের কাছে এক সমাধিঢিবির মধ্যে পাওয়া গেছে এগুলি।

ভাইকিং ‘নৌকাসমাধিতে’ কুফী হরফে আল্লাহ-আলীর নাম এম্ব্রয়ডার করা সিল্কের কাপড়ও নাকি পেয়েছেন বলছেন সুইডিশ গবেষকরা। আরেক জায়গায় একটা আংটিও পাওয়া গেছে যার গায়ে নাকি ‘আল্লাহর জন্যে’ আরবীতে খোদাই করা।

ভাইকিং আর আব্বাসী খেলাফতের মধ্যে দশম/একাদশ শতকে একটা যোগসূত্র যে থেকে থাকতে পারে, এটা অনেকের কল্পনাতীত। দুটি কালচারের মধ্যে হাজার হাজার মাইল দূরত্ব। অবশ্য প্রত্নতত্ত্ববিদরা এরকম উদাহরণ প্রায়শই পান। এর যৌক্তিক ব্যাখ্যাও রয়েছে।

সুইডেনের ভাইকিং সমাধিতে আবিষ্কৃত রেশমের কাপড়ে এম্ব্রয়ডার করে আল্লাহ ও আলী লেখা।
সুইডেনের ভাইকিং সমাধিতে আবিষ্কৃত আংটিতে লিল্লাহ লেখা।

এরকম আরো ভূরি ভূরি উদাহরণ দিতে পারি। বঙ্গোপসাগরের তীরে পন্ডিচেরির কাছে তামিলনাড়ুর আরিকামেডুতে গ্রীক-রোমান ধাঁচের একটি বসতি আবিষ্কৃত হয়েছে। সেখানে পাওয়া গেছে রোমান অ্যাম্ফোরা — ওয়াইন সংরক্ষণ ও স্থানান্তরের জন্যে বড় বড় মাটির বোতল। আরো পাওয়া গেছে রোমান-গ্রীক ও ভারতীয় ডিজাইনে ছাঁপমারা মাটির পাত্র। আর সম্রাট অগাস্টাসের মুখাবয়বখচিত স্বর্ণমুদ্রা।

জাপানের সমাধিস্তূপে পাওয়া নীলরঙের কাঁচের থালা নিয়েও জাপানী রসায়নবিদরা অনেক গবেষণা করেছেন। কারণ এরকম নিদর্শন জাপানে আর পাওয়া যায়নি। তাদের রিসার্চ থেকে বেরিয়েছে যে, রোমান সাম্রাজ্যে এ ধরনের থালা ব্যবহৃত হত, আর সেসবে অ্যান্টিমোনির মত বিশেষ ধাতু যে যে পরিমাণ পাওয়া গেছে, তা একই অনুপাতে রয়েছে থালাটিতে। অর্থাৎ রোমের বিলাসদ্রব্য কিভাবে যেন এসে পড়েছে ছয় হাজার মাইল দূরে জাপানে।

তামিলনাড়ুর আরিকামেডুর কাছে পুদুক্কোটাইয়ে আবিষ্কৃত রোমান সম্রাট অগাস্টাসের মুদ্রা।
জাপানের সামাধিস্তূপে আবিষ্কৃত রোমান কাঁচের থালি।

এতক্ষণ যেসব উদাহরণ দিলাম, তা বড়জোর এক হাজার থেকে দু’হাজার বছর আগের। এদের থেকেও পুরনো উদাহরণ হলো, প্রাচীন মিশরের তিন হাজার বছরের পুরনো মামির চুলে সিল্কের সুতোর আবিষ্কার। সে সময়ে একমাত্র চীনাদেরই আয়ত্ত ছিল সিল্ক তৈরির চাবিকাঠি। তার মানে দাঁড়াল, ছয় হাজার মাইল অর্থাৎ পৃথিবীর পরিধির প্রায় একচতুর্থাংশ পাড়ি দিয়ে এসে মিশরীয় অভিজাতদের শোভাবর্ধন করেছে রেশমী সুতো।

আজকের দুনিয়ার কথা‌ই ভাবুন। বাংলাদেশে বসে ‘আই লাভ এনওয়াই’ টিশার্ট পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন আপনি। শার্টের আমদানি হয়ত মার্কিন মুল্লুক থেকে। আবার মার্কিন মুল্লুকের আইডিয়া কাজে লাগিয়ে বানানো শার্টটা খুব সম্ভব বাংলাদেশের গার্মেন্টশিল্পেরই প্রস্তুত। কোথাকার মাল কোথায় এসে পড়ল, অথচ আমরা আজ অবাক হই না।

চীনা সমাধিসৌধে আবিষ্কৃত রোমান পাত্র।

আজ থেকে তিন চার হাজার বছর আগেও একই কাহিনী ঘটেছে। আজকের পরিসরে না হলেও সেপরিমাণটা তুলনামূলকভাবে বড়ই। পরিমাণটারও উত্থানপতন হয়েছে।

আর বিভিন্ন সভ্যতার যে কর্মকান্ড এ ম্যাজিকটা যুগযুগান্তরে ঘটিয়েছে, তার নাম ট্রেড — বাণিজ্য। সোনা-রূপার তৈরি মুদ্রা কিংবা বুলিয়ন আবিষ্কারের বহু আগে থেকেই মানবজাতি একে অন্যের সাথে বাণিজ্যের মাধ্যমে যোগাযোগ করে আসছে। টাকার ব্যবহার না থাকলেও বার্টার বা বিনিময়ের মাধ্যমে বাণিজ্য চলেছে। আর সওদা আদানপ্রদানের পাশাপাশি চলেছে ধর্মীয়, দার্শনিক, প্রযুক্তিগত, ভাষা-সাংস্কৃতিক মতবিনিময়।

প্রাচীন মানুষ কৃষিকাজ শিখে থিতু হতে হতে শুরু হয় নগরসভ্যতার। সমষ্টিগত শ্রমের দক্ষ প্রয়োগের মাধ্যমে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা আসে মানুষের। কিন্তু বহু আদি নগরসভ্যতায় একটা সমস্যা খুঁজে পান প্রত্নতত্ত্ববিদরা। যদিও খাদ্যশস্য উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে বড় জনসংখ্যার ভরনপোষণ সম্ভব, তাতে খাদ্যের বৈচিত্র কমে যায়। সুষম পুষ্টির অভাবে আদি নগরবাসীরা ছিল শিকারী-সংগ্রহকারী যাযাবরদের থেকে শারীরিকভাবে দুর্বল। ফলে ‌অনেক আদি নগর বহির্শত্রুর আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যায়।

কিন্তু দক্ষতা বাড়ানোর জন্যে যে কাজটা তারা সাধন করেছে তা হলো শ্রমের বিশেষায়িতকরণ। আদি নগরেই দেখা যায় একেকটি পাড়ার পেশা একেক রকম। কেউ কৃষক, কেউ কুম্ভকার, কেউ সূত্রধর। নগরের মধ্যেই আঞ্চলিক বাণিজ্যের যাত্রা শুরু। তারপরে খাদ্য থেকে শুরু করে অন্যান্য কাঁচামালের বৈচিত্র্যের জন্যে স্থানীয় আর সব জনবসতির সাথে আদানপ্রদান শুরু।

নব্যপ্রস্তরযুগের পরবর্তী ক্যালকোলিথিক যুগে, অর্থাৎ ব্রোঞ্জের আবিষ্কারের প্রাক্কালে বিশেষায়িত শ্রমের আবির্ভাবের সাথে সাথে বৈশ্বিক না হলেও আঞ্চলিক বাণিজ্যের শুরু। সেটা কমপক্ষে সাত/আট বাজার বছর আগের কথা। তারপর চার হাজার খ্রীষ্টপূর্বাব্দে মেসোপটেমিয়াতে গরুর মত ভারবাহী পশুকে পোষ মানানোর ফলে লং ডিসট্যান্স ট্রেডিংয়ের রাস্তা খুলে যায়।

মেসোপটেমিয়ার সুমেরীয়দের সাথে ময়েঞ্জোদারো-হরপ্পার যোগাযোগটা বৈদেশিক বাণিজ্যের সবচে প্রাচীন উদাহরণ। স্থল ও নৌপথে ভারতের মশলাপাতি ও সেমিপ্রেশাস রত্নরাজি এসে পৌঁছত উরের মত ইরাকের বড় শহরগুলিতে। হরপ্পান সভ্যতার টেরাকোটা সীল আর আবক্ষ মুর্তির মধ্যেও মেসোপটেমিয়ার সাংস্কৃতিক প্রভাব হুবহু দৃশ্যমান। এ বাণিজ্য তুঙ্গে ওঠে আড়াই হাজার খ্রীষ্টপূর্বাব্দে। আর প্রাক-আর্য হরপ্পান নগরগুলির পতনের পর এ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

ময়েঞ্জোদারোর এই মূর্তিটি কোন রাজার নয়, সম্ভবত অলিগার্কের। শিল্পে মেসোপটেমিয়ার সাংস্কৃতিক প্রভাব সুস্পষ্ট।
ঊর শহরে আবিষ্কৃত কার্নেলিয়ান পাথরের নেকলেস। শিল্প দেখে মনে হয় সিন্ধু সভ্যতার থেকে আমদানি।

এরপর মিশরে পোষ মানে ভারবাহী গাধা, সে তিন হাজার খ্রীষ্টপূর্বে। তার পাশাপাশি নীলনদের নৌপথে চলে উত্তর-দক্ষিণ বাণিজ্য। কৃষিজমির দখল আর আঞ্চলিক নৌবাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণের খাতিরেই সম্ভবত মিশরে আবির্ভাব ঘটে প্রথম সাম্রাজ্য কিংবা কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার। শাসকদের কাজ হলো প্রজাদের কৃষিজমির ভাগবন্টন আর আঞ্চলিক বাণিজ্যের নিরাপত্তাবিধান আর যাত্রাপথের রক্ষণাবেক্ষণ। এসবের ব্যয়নির্বাহের জন্যে কর ধার্য হত। অর্থ দিয়ে না হলেও খাদ্যশস্য আর বাণিজ্যের ফেরির ভাগ দিয়ে সে কর পরিশোধিত হত। অর্থাৎ যেখানে মিষ্টির সুবাস, মাছির উৎপাত সেখানেই। তার মানে এই নয় যে, ইতিহাসে বাণিজ্যই সবসময় রাজা-সম্রাটদের জন্ম দিয়েছে।

ঊটও পোষ মানে তিন হাজার খ্রীষ্টপূর্বাব্দের আশপাশ দিয়ে। দক্ষিণ আরবের ইয়েমেন-ওমানের স্থলপথ, হর্ন অফ আফ্রিকার সোমালিয়া, লোহিত সাগরের নৌপথ ইত্যাদির যোগসাজশে প্রাচীন ভারতের সাথে যুক্ত হয় মিশর। ১২০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে ‘ব্রোঞ্জ এইজ কলাপ্সের’ আগ দিয়ে মিশরে সিডার কাঠ আমদানি হত লেবানন থেকে, সাইপ্রাস থেকে তামা-ব্রোঞ্জ, দক্ষিণ আরব থেকে সুগন্ধি, নুবিয়া থেকে সোনা, প্রভৃতি।

হিট্টাইট আর মিশরীরা ছিল সেযুগের সুপারপাওয়ার, আর সভ্য বিশ্বের হেন শহর নেই যাদের সাথে যোগাযোগ ছিল এ দু’য়ের। সিরিয়ার মিত্তানি মিত্রদের সাথে পত্রযোগাযোগের পান্ডুলিপি আবিষ্কৃত হয়েছে, যেগুলি পড়লে মনে হবে সে যুগের কূটনীতি এ যুগের থেকে এমন ভিন্ন কিছু ছিল না। সে সব পত্রে বিলাসদ্রব্যের বিনিময়ে কেউ চাইছে মিশরীদের প্রতিরক্ষা। কেউ পাঠাচ্ছে বিশাল উপঢৌকন, এ আশায় যে ভবিষ্যতে তার প্রতিদান পাওয়া যাবে। বিভিন্ন আদানপ্রদানের রশিদ এগুলি। পাওয়া গেছে মিশরের তেল-আল-আমারনাতে।

১৪২০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের মিশরী বাণিজ্যজাহাজ।
চতুর্থ খ্রীষ্টপূর্ব শতকের ফীনিশীয় জাহাজ।

এরপর এক অন্ধকার যুগের সূচনা হয়ে, যাকে অনেক প্রত্নতত্ত্ববিদ নাম দিয়েছেন ‘ব্রোঞ্জ এইজ কলাপ্স’। ‘সীপিপল’ নামক অজানা জাতির আগ্রাসনে মধ্যপ্রাচ্যের সভ্য শহরগুলির একে একে পতন ঘটে। কমে আসে কূটনৈতিক যোগাযোগ। ভেঙে পড়ে কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা আর বড় সাম্রাজ্যগুলি। অর্থাৎ মাছিরা ঝেঁটিয়ে বিদায়। তাই বলে মিষ্টি আদানপ্রদান থেমে থাকেনি। এই অরাজকতার মধ্যেই উত্থান ঘটে নতুন এক বণিকজাতির, যাদের নাম ফীনিশিয়ান। এরা নতুন ধরনের দ্রুত জাহাজ নিয়ে বেরিয়ে পড়ে দিকে দিকে। দূরদূরান্তে স্থাপন করে বাণিজ্য কলোনি। বড় সাম্রাজ্যের জন্ম না দিলেও তাদের একটা বড় লেগ্যাসি আমরা এখনো বহন করে চলেছি, যার নাম অ্যালফাবেট।

পৃথিবীর অপর প্রান্ত চীনে অরাজকতার যুগশেষে দ্বিতীয় খ্রীষ্টপূর্ব শতকে নতুন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন সম্রাট শিহুয়াংদি। তার রাজদূত মরুভূমি-পর্বত পেরিয়ে মধ্য এশিয়ায় আসে যুদ্ধে কাজে লাগানোর মত দ্রুত ঘোড়ার খোঁজে। সে বাণিজ্য সম্পর্ক থেকেই শুরু হয় সিল্করোডের পূর্বভাগের।

ফারগানার ঘোড়া, এই ‘স্বর্গের’ ঘোড়ার জন্যেই চীনারা মধ্য এশিয়ার সাথে বাণিজ্যসম্পর্ক স্থাপন করে, যার থেকে সিল্করোডের শুরু।
প্রাচীন রোমের অভিজাতদের কাছে চীনা রেশমের কাপড়ের বেশ কদর ছিল।
চীনের সমাধিসৌধে আবিষ্কৃত বিজ্যান্টিন স্বর্ণমুদ্রায় সম্রাট কন্সট্যান্সের মুখাবয়ব।

আর রোমান সাম্রাজ্যও দ্বিতীয় খ্রীষ্টীয় শতকে ইরান ও মধ্য এশিয়ার মাধ্যমে যুক্ত হয় চীনের বাণিজ্যপথের সাথে। ইউরোপ থেকে যেত সোনা আর চীন থেকে রেশম। আর আজকের ট্রেড ওয়ারের শুরুও এই সময়ে। রোমান অভিজাতরা চীনা রেশমের জন্যে রাজ্যের স্বর্ণভান্ডার প্রায় নিঃশেষ করে ফেলে। সম্রাট টাইবেরিয়াস বাধ্য হয়ে সিল্কের ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। চীনও রেশমের গোপন প্রস্তুতপ্রণালী আগলে রেখেছিল, যাতে রোম সাম্রাজ্যের কারিগররা প্রতিযোগিতায় আবির্ভূত না হয়।

রোমানদের আগেই সম্ভবত গ্রীকরা বাণিজ্য কলোনি স্থাপন করেছিল ভারতের আরিকামেডুতে। পেরিপ্লাস অফ দ্য এরিথ্রেয়ান সী নামের গ্রীক পান্ডুলিপিতে এ বন্দরের উল্লেখ আছে। গ্রীকদের পরে রোমান সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে আসে এই বাণিজ্যবসতি। বহু দেশীবিদেশী বণিকদের স্থায়ী-অস্থায়ী নিবাস ছিল এই ভারতীয় শহরটি। আনুমানিক সময়কাল দ্বিতীয় খ্রীষ্টপূর্ব শতক থেকে সপ্তম খ্রীষ্টীয় শতক।

রোম, আর পরে বিজ্যান্টিন, সাম্রাজ্যের সাথে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথ যুক্ত ছিল। একে বলে ইনসেন্স রাউট। ইয়েমেনের স্থানীয় গাছের বাকল থেকে তৈরি হত দুটি সুগন্ধি, এগুলি দিয়ে এখনো আতর তৈরি হয়। এদের নাম ফ্রাংকিনসেন্স ও মাঢ়। রোমান দেবালয়ে পূজোর কাজে এদের ব্যবহার ছিল।

ইয়েমেন থেকে শুরু করে লোহিত সাগরের তীরের জেদ্দা, তারপর জর্দানের পেত্রা হয়ে মধ্যোপসাগরীয় বন্দরে এসে জাহাজে উঠত এই মালামাল। যীশুখ্রীষ্টের জন্মলগ্নে এগুলিই উপহার নিয়ে এসেছিলেন তিন মেজাই। তৃতীয় খ্রীষ্টপূর্ব শতক থেকে দ্বিতীয় খ্রীষ্টীয় শতকের মধ্যে এই ইনসেন্স রাউট উপকূলীয় আরব শহরগুলিকে সমৃদ্ধি এনে দিয়েছিল।

ইনসেন্স রাউটের অন্যতম স্থলবন্দর জর্দানের পেত্রা।

ইসলামী ঐতিহ্যে যদিও বলা হয় নবীজীর বাণিজ্যে হাতেখড়ি এই পথের মক্কা-সিরিয়া অংশে, তাতে একটা সমস্যা রয়েছে। গথদের হাতে ততদিনে রোমের পতন হয়েছে, আর বিজ্যান্টিনরা ঘোরতর খ্রীষ্টান। এসব সুগন্ধির বড় বাজার তখন আর নেই ইউরোপে।

রোমের পতনপরবর্তী সময় বিজ্যান্টিনরা চীনের সাথে সিল্করোডের মাধ্যমে বাণিজ্য করতে থাকে। চীনা সমাধিতে বিজ্যান্টিন মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। রাজনৈতিক শত্রু ইরানিদের পাশ কাটিয়ে মধ্য এশীয় সগডিয়ানদের মাধ্যমে সরাসরি সিল্কের বাজার পায় তারা। ভারত থেকেও মধ্য এশিয়ার মধ্য দিয়ে বৌদ্ধধর্ম পাচার হয়ে গেছে চীনে একই সময়ে। মধ্য এশিয়ার রাজ্যগুলি প্রকৃতার্থেই ছিল মানুষের মিলনমেলা।

ভাইকিংরা এ চিত্রে এসে যুক্ত হয় এরকম সময়েই। নবম/দশম খ্রীষ্টীয় শতকে সুইডিশ ভাইকিংরা ভলগা নদীর তীর ধরে লুটতরাজ করতে করতে অনেক দক্ষিণে ইউক্রেনের নভগরোদ আর কিয়েভ শহরে এসে পড়ে। সেখানকার স্লাভ জাতির মানুষ এই ‘রুস’দেরকে রাজা মানা শুরু করে। গোড়াপত্তন হয় প্রাচীন রাশিয়ার। এই ভাইকিংয়ের দল আরো দক্ষিণে কৃষ্ণসাগরের তীরে এসে টক্কর খায় বিজ্যান্টিনদের সাথে।

ততদিনে লুটতরাজ ছেড়ে ভাইকিংরা নতুন পেশা ধরেছে, বাণিজ্য আর ভাড়াটে সৈন্যগিরি। মার্সেনারি হিসাবে বিজ্যান্টিন সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাওয়া পড়ত তাদের। সে সুবাদে একটু বাণিজ্যও করে নিত। এভাবেই সম্ভবত আব্বাসী খেলাফতের সাথে তাদের যোগাযোগ। আর আব্বাসীদের চকচকে রূপার ধাতব মুদ্রার প্রতি তাদের ছিল বিশেষ টান। আরব পরিব্রাজক ইবনে ফাদলানও উত্তরের দেশে ভ্রমণ করে এসে ভাইকিংদের নৌকা-শেষকৃত্যের একটা বিবরণী লিখে গেছেন আরবীতে।

এ হলো মোটামুটি সভ্য দেশগুলির থেকে পাওয়া বাণিজ্যের লিখিত বিবরণী। নিরক্ষর অনেক দেশও যে বৈদেশিক বাণিজ্যে প্রাচীনকাল থেকে যুক্ত ছিল তার প্রমাণও প্রত্নতত্ত্ববিদরা পেয়েছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের ওয়েলসের চার হাজার বছরের পুরনো তামার খনি থেকে মধ্যোপসাগরীয় সভ্য দেশগুলোতে রপ্তানী। কর্নওয়ালের টিনের খনিও সেরকম তিন হাজার বছরের পুরনো। এ দুয়ের তামা আর টিন মিলে সভ্য দেশগুলিতে তৈরি হত ব্রোঞ্জের জিনিসপত্র।

বাল্টিক উপকূল থেকে দক্ষিণে রোম-গ্রীস পর্যন্ত বিস্তৃত অ্যাম্বার রোড তিন হাজার বছরের পুরনো। মধ্যোপসাগর ছাড়িয়ে মিশরের তুতানখামুনের মামির গয়নাতেও জায়গা করে নিয়েছিল বাল্টিকের অ্যাম্বার। সেটা সাড়ে তিন হাজার বছর আগের কথা। ভাইকিং-আরব বাণিজ্যের যেমন লিখিত বিবরণ নেই, ইউরোপের অধিকাংশ এলাকা তখন নিরক্ষর থাকার কারণে অ্যাম্বার রোডেরও তেমন কোন বিবরণী পাওয়া যায়না।

ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষও ছিল নিরক্ষর। কিন্তু তাতে বাণিজ্য থেমে থাকেনি। মূলত নৌপথে তারা চীন থেকে জেড পাথরের আমদানি-রপ্তানি করে গেছে। কমপক্ষে তিন হাজার বছর আগে এই সওদাগরির শুরু।

মিশরের ফারাও তুতানখামুনের ব্রেস্টপ্লেটের নিচের অংশের চারটি অ্যাম্বার পাথর এসেছে সুদূর বাল্টিক উপসাগর থেকে।
ফিলিপাইনের জেড পাথরে তৈরি লিংলিং-ও গয়না রপ্তানি হত পুরো দক্ষিণপূর্ব এশিয়াতে।

আর সাব-সাহারান আফ্রিকার থেকে রোমান সাম্রাজ্য আর আরব খেলাফতে গেছে সোনা, লবণ, আর কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস।

পরবর্তী যুগে আরো বহু ট্রেড রুট বিশ্বের মানুষকে সংযুক্ত করেছে। পূর্ব আফ্রিকার জিরাফ বাঙ্গালার সুলতানের উপঢৌকন হিসাবে গিয়ে পৌঁছেছে চীনা সম্রাটের দরবারে। পশ্চিম আফ্রিকার আইভরি হ্যান্ডিক্রাফট শোভা বাড়িয়েছে পর্তুগীজ ডাইনিং টেবিলের। ইন্দোনেশিয়ার মশলা সোনার দরে বিক্রি হয়েছে হল্যান্ড-ইংল্যান্ডের বন্দরে। আমেরিকার আনারস, আলু, কোকো, রাবার, টমেটো, তামাক পাল্টে দিয়েছে বাকি বিশ্বকে।

পঞ্চদশ শতকে চীনা সম্রাটের জন্যে বাংলার সুলতান সাইফউদ্দিন উপঢৌকন পাঠান এই জিরাফ। বহন করে নিয়ে যায় খোজা সেনাপতি জংহোর জাহাজবহর। সাইফউদ্দিন জিরাফটি পান কেনিয়ার মালিন্দির রাজার কাছ থেকে, বাণিজ্যসূত্রে। চীনে জিরাফটি ব্যাপক সাড়া ফেলে, কারণ কাল্পনিক প্রাণী জিলিনের সাথে এর মিল। ফলে সম্রাটের শাসনক্ষমতা পাকাপোক্ত হয়।

শুধু যে বস্তু আর জ্ঞানের আদানপ্রদান হয়েছে তা নয়, মানুষের কাফেলা একেকসময় একেকমুখী হয়েছে। কখনো পরদেশেই রয়ে গেছে বিদেশী বণিক। হরপ্পান সভ্যতার একটি পরিবারের সমাধি আবিষ্কৃত হয়েছে ইরানে। ধরা যেতে পারে যে এরা ছিল সভ্যতার প্রথম ইমিগ্রান্ট। বিদেশ-বিভুঁইয়ে নিজেদের ছোট একটি কলোনি হয়ত তৈরি করেছিল তারা, যেমনটা করেছিল ফীনিশীয় (কার্থেজ), রোমান (মধ্য এশিয়া), গ্রীক (স্পেন), পারসিক (ইয়েমেন), চীনা (ইন্দোনেশিয়া), আরব (আফ্রিকা), আর রেনেসাঁস পরবর্তী যুগের অন্যান্য ইউরোপীয় জনগোষ্ঠী। এদের যাতায়াত কখনো ছিল বাধাহীন নিরাপদ, কারণ নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করেছে কোন না কোন বড় সাম্রাজ্য (প্যাক্স রোমানা — ইউরোপীয় বাণিজ্য, প্যাক্স মোঙ্গোলিকা — সিল্ক রোড, অধুনা প্যাক্স আমেরিকানা — বিশ্বব্যাপী মুক্তবাজার প্রতিষ্ঠার ক্রেডিট এদেরই‌ প্রাপ্য)। আবার কখনো কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার অভাবে তা ছিল বিপৎসংকুল।

কিন্তু এটা মানতেই হবে, যতই বাধাবিপত্তি থাকুক, মানুষ একে অন্যের সাথে যোগাযোগ যখন একবার শুরু করেছে, তারপর আর থেমে থাকেনি। জোয়ার-ভাঁটা এসেছে সে বাণিজ্যে, কিন্তু নদীর প্রবাহের মত নতুন ধ্যানধারণা, ধর্মচিন্তা, শব্দভান্ডার এসে যুক্ত হয়েছে একেক সভ্যতায়।

লেখার শেষে এসে মনে হলো রবিঠাকুরের ‘তাসের দেশ’ গীতিনাট্য। সে কাহিনীতে রাজপুত্র আর সদাগর এসে হাজির নতুন দেশে। রাজপুত্র যেখানে দিনবদলের ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে, সেখানে সদাগর কিন্তু তুলনামূলকভাবে বাস্তববাদী। প্রচলিত নিয়মের সুবিধাভোগী সফল বণিকসমাজ। তাই তারা সাধারণত শান্তিকামীও।

অবাধ ও ন্যায্য বাণিজ্য আসলে বিশ্বশান্তির একটা বড় অনুঘটক। মধ্যপন্থায় ধীর কিন্তু স্থির সামাজিক পরিবর্তন যদি কোন প্রক্রিয়া আনতে পারে, তো সেই বাণিজ্য। সহিংস বিপ্লব তার পন্থা নয়। আলোকিত বিপ্লব যুগে যুগে যারা করে গেছেন, তাদের মূলে বণিকরাই ছিলেন চালিকাশক্তি। রেনেসাঁস শিল্পের পৃষ্ঠপোষকরা যেমন ছিলেন মেদিচির মত বণিক-ব্যাংকার পরিবার, তেমন মার্ক্যান্টাইল যুগের কলোনিয়াল এক্সপ্লয়টেশন থেকে হোমনেশনগুলির মধ্যবিত্ত শ্রেণী আরও সমৃদ্ধশালী ও বহির্মুখী হয়েছে, যার ফলশ্রুতিতে তাদের দর্শন থেকে এসেছে এজ অফ এনলাইটেনমেন্ট। তারপর আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা, গণতন্ত্র, বিজ্ঞানপ্রযুক্তি ইত্যাদি।

বাণিজ্যের হাত ধরে ঔপনিবেশিকতা-সাম্রাজ্যবাদের শুরু বলবেন অনেকে। কিন্তু সব দিক বিচার করে, সব ইতিহাস, লংটার্ম ইমপ্যাক্ট দেখে, আমার ব্যক্তিগত মতামত হল, ট্রেড ইজ নট এ জিরো-সাম গেম, ট্রেড ইজ এ পজিটিভ সাম গেম। সবার জন্যে মুক্তবাণিজ্যে আখেরে উইন-উইন।

স্রষ্টার স্বর্গদুয়ার উন্মুক্ত…

Featured Video Play Icon

ইজ়রায়েলের সর্বকালের সবচে’ জনপ্রিয় শিল্পী ওফ়রা হাজ়া গাইছেন এই গানটা। ১৯৭৮এর টিভি সম্প্রচারের ভিডিও এটা। গানটার ১৯৮৪এর ভার্শন পরে ইউরোপ-আমেরিকার চার্টে প্রথম স্থানে ছিল। এই রেকর্ডিংএর সময় ওফ়রা ২১ বছরের তরুণী, কিন্তু ১৯ বছরেই তিনি খ্যাতি কুড়নো শুরু করেন। পরে ইজ়রায়েলের হয়ে ইউরোভিশন প্রতিযোগিতাতেও অংশ নেন। যেসব বিখ্যাত শিল্পীদের সাথে একসাথে গান করেছেন, তাদের মধ্যে নুসরাত ফতেহ আলী খানও আছেন।

ওফ়রা হাজ়ার ছোটবেলা কেটেছিল তেল আবিবের হাতিকভ়া নামের এক বস্তিতে। তাঁর বাবা-মা ছিলেন ইয়েমেন থেকে আসা কপর্দকশূন্য রেফ্যুজি। সপ্তদশ শতকের ইয়েমেনী কবি সালাম শাবাজ়ির লেখা কবিতায় সুর করা এই গানটা গাইছেন হাতিকভ়ার মিউজ়িক ওয়ার্কশপের সাথে। দলটা তৈরি হয়েছিল তাঁদের মহল্লার গরীব ছেলেমেয়েদেরকে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সুযোগ দেয়ার জন্য।

লঘুচিত্তে গাওয়া এই গানটার বিষয়বস্তু নির্ধনের প্রতি স্রষ্টার মমতার গুণকীর্তন। “যদি ন্যায়পরায়ণের দানের দরজা বন্ধ হয়ে যায়, তবে মনে রেখো স্রষ্টার স্বর্গদুয়ার সর্বদা উন্মুক্ত।” আর খোদার কাছে অনুনয় করা হচ্ছে তাঁকে ‘এল হা’ঈ’ নামে ডেকে, যেটা মুসলিমদের কাছেও স্রষ্টার নিরানব্বই নামের একটা। সপ্তদশ শতকে মধ্যমপন্থী সুন্নি ওসমানী তুর্কীদের সাহায্য করার সন্দেহে ইয়েমেনের জ়াইদী শিয়া বংশীয় ইমাম বা শাসক শাবাজ়ি আর তাঁর ইয়েমেনী ইহুদী গোত্রকে মাওজ়া বলে এক মরুএলাকায় নির্বাসনে পাঠায়। সেখানে তাদের এক-পঞ্চমাংশ খাদ্যাভাবে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। স্বগোত্রকে সাহস আর আশা যোগানোর জন্যে শাবাজ়ির এ কাব্য রচনা।

গরীবের প্রতি যেমন ইসলামে জ়াকাত দেয়া কর্তব্য, ইহুদী ধর্মেও সেরকমটা আছে। ধর্মপ্রাণ ইহুদীদের আয়ের এক-দশমাংশ দান-খয়রাতে দিয়ে দেবার নিয়ম কোন কোন তরিকায়। হিব্রু ভাষায় এই বাধ্যতামূলক নিয়মকে বলে স়দাকা, যেটা ইসলামে ঐচ্ছিক দানক্রিয়ারও নাম। ইসলামী স্বর্ণযুগের অন্যতম মনীষী ইহুদী ধর্মসংস্কারক মুসা বিন মাইমুনের তরিকায় আট শ্রেণীর মধ্যে প্রথম সারির স়দাকা হলো, সত্যিকারের অভাবী কাউকে অনুদান বা সুদহীন ঋণ দেয়া, বিশেষ করে যদি সে অর্থটাকে নিজের অবস্থার দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের কাজে লাগায়। আর তাঁর নিয়মাবলীতে ধনী-গরীব সবারই কিছু পরিমাণ দান-খয়রাত করা বাধ্যতামূলক।

বৌদ্ধ বা খ্রীষ্টান ধর্মে কিছু ক্ষেত্রে দরিদ্রতাকে দেখা হয় স্বর্গীয় গুণ হিসাবে। যে কারণে সন্ন্যাসব্রত নেয়ার একটা ঐতিহ্য তাদের আছে। ইহুদীধর্মে তেমনটা নেই। গরীবদের দয়া করার কথা বলা হলেও ধর্মীয়ভাবে ছোটবেলা থেকে ইহুদীদের এটাই শেখানো হয় যে স্বেচ্ছায় দরিদ্র-পরনির্ভর হওয়া অবাঞ্ছনীয়, সবার উচিত নিজের সাধ্যমত কারিগরি কাজ শিখে ব্যবসা-বাণিজ্য বা চাকুরি করা। কারণ আব্রাহাম, জেকব, সলোমন, আইজ়্যাক — ইহুদী ঐতিহ্যে এ সকল নবীই স্বনির্ভর ছিলেন। হয়ত এই মানসিকতার কারণেই পৃথিবীর ইহুদী জনসংখ্যার একটা বড় অংশ অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল।

সুদখোর ইহুদীর যে স্টেরেওটাইপটা সুপরিচিত, সেটা কিন্তু অনেকাংশেই অতিরঞ্জিত, আর সেটা মুসলিম বিশ্ব নয়, এসেছে পশ্চিমাবিশ্ব থেকে — শেক্সপীয়ারের শাইলক দ্রষ্টব্য। ধনী ইহুদীদের মধ্যে রথ্সচাইল্ড পরিবার সুপরিচিত হলেও অনেকে মনে করেন রকাফেলার, কার্নেগী, জেপি মর্গান, এরাও ইহুদী ছিলেন — সে ধারণা ভুল। আর দারিদ্র্য থেকে ইহুদীরাও মুক্ত নয়। আল্ট্রা-কনজ়ার্ভেটিভ ইহুদী ‌অধ্যুষিত নিউ ইয়র্ক স্টেটের কিরিয়াস জোয়েল হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সবচে’ গরীব শহর।

ইয়েমেনে ইহুদীদের বসবাস ছিল সুপ্রাচীন কাল থেকে, তারা ঈশ্বরকে ডাকত রহমান নামে, তাদের ধর্মীয় আচারব্যবস্থাও ছিল অন্য এলাকার ইহুদীদের থেকে স্বতন্ত্র। তৃতীয় খ্রীষ্টাব্দ থেকে ষষ্ঠ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত খ্রীষ্টান বিজ়্যান্টাইন সাম্রাজ্য আর আহুরা-মাজ়দার উপাসক পারসিক সাসানী সাম্রাজ্যের মধ্যে যে স্নায়ুযুদ্ধ চলেছে, তাতে ইয়েমেনের খ্রীষ্টান আরব আর ইহুদীরাও পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রক্সি যুদ্ধ করেছে। জ়ু নুওয়াস বলে ইয়েমেনের হিমইয়ার রাজ্যের এক ইহুদী রাজা ইসলামের আবির্ভাবের একশ’ বছর আগে খ্রীষ্টানদের ওপর গণহত্যা চালান। তাদেরকে ইহুদীধর্মগ্রহণ অথবা মৃত্যু বেছে নিতে বাধ্য করেন, আর যারা ধর্মান্তরিত হয়নি, তাদেরকে চার্চের মধ্যে আটকে রেখে জীবন্ত পুড়িয়ে মারেন। সে অত্যাচার থেকে খ্রীষ্টানরা রক্ষা পায় আবিসিনিয়ার খ্রীষ্টান আক্সুম সাম্রাজ্যের সামরিক হস্তক্ষেপে। কিন্তু সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত ইয়েমেনী ইহুদীদের করতে হয়েছে অধুনাকাল পর্যন্ত।

এখানে এটা উল্লেখ করা দরকার যে, ইসলামে ইহুদীদের স্বাধিকার দেবার বিরুদ্ধে কোন নিয়ম নেই। খ্রীষ্টানদের মত তাদেরকে ‘আহলাল কিতাব’ বা খোদাপ্রদত্ত পুস্তকের অনুসারী হিসাবে যথোপযুক্ত ধর্মীয় অধিকার দেয়া আর তাদের সম্পত্তি রক্ষার কথা বলা আছে। হিজরতের পরে মদিনাসনদ বলে একটা চুক্তিনামায় সকলপক্ষের সহমতে এ সকল গ্যারান্টি দেয়া হয়। তাতে একটা রাষ্ট্রেরও গঠনতন্ত্র রূপ পায়, যার সকল সদস্যকে ধর্মগোত্রনির্বিশেষে সুনির্দিষ্ট অধিকার দেয়া হয়। পরে চুক্তিভঙ্গের কারণে তিনটি প্রধান ইহুদী গোত্রকে তখনকার সাধারণ প্রচলন অনুযায়ী নিষ্ঠুর শাস্তি দেয়া হয়। তারপরেও অন্যান্য ইহুদীগোত্র মদিনায় মুসলিমদের সাথে দ্বিতীয় খলিফার শাসনামল পর্যন্ত সহাবস্থান করেছে। অন্যধর্মাবলম্বীদের মত জিজ়িয়া কর তাদের দিতে হত, কিন্তু মুসলিমদের বাধ্যতামূলক জ়াকাত কর তাদের জন্যে ছিল মওকুফ।

হাজার বছরের বেশি ধরে মুসলিম-ইহুদীরা একসাথে বসবাস করেছে, এটাই স্বাভাবিক যে সে ইতিহাস মিশ্র। মুসলিম রাজ্যগুলি তাদের ইহুদী প্রজাদের সাথে কিরকম আচরণ করেছে, সেটা নির্ভর করে কোন গোত্র-বংশ-ধর্মীয় গ্রুপ ক্ষমতায় ছিল তার ওপর। স্পেনের গ্রানাদাতে একবার যেমন ইহুদীদের ওপর গণহত্যা চলেছে, আবার সেরকমই কোন দূরদর্শী রাজা সেখানে তাদেরকে মুসলিমদের সমান অধিকার দিয়েছিলেন। মধ্যযুগে নিঃসন্দেহে ইউরোপের খ্রীষ্টান রাজ্যগুলির থেকে মুসলিম রাজ্যে ইহুদীরা নিরাপত্তা বেশি পেত। ওসমানী সাম্রাজ্যেও ইহুদীরা যথেষ্ট ইন্টেগ্রেটেড ছিল, শাসন আর করব্যবস্থায় তাদের অনেক অবদান ছিল।

এখন আবারও মুসলিম সমাজ একটা ইহুদীবিদ্বেষী ফেইজ়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে বলে আমার ধারণা। কারণ দু’টো। এক, ঊনবিংশ-বিংশ শতকে ইহুদীবিদ্বেষী ইউরোপীয় সাম্রাজ্যগুলির কলোনিতে ইউরোপীয়দেরই প্রভাবে গুজব-ভুল ধারণার বিস্তার ঘটেছে বেশি। সেটা তুঙ্গে উঠেছিল নাৎসিদের ছড়ানো প্রপ্যাগান্ডার মাধ্যমে। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে ইজ়রায়েলের আবির্ভাব, আর তার বিরুদ্ধে আরবদের তিনটা যুদ্ধ (খেয়াল করুন, এখনকার ইজ়রায়েলের প্রাণের শত্রু ইরান সেগুলির কোনটাতেই অংশ নেয়নি)। সেই রাজনীতির মধ্যে না গিয়ে এটুকু বলাই যথেষ্ট যে তিরিশ-চল্লিশের দশকে মিশর, লিবিয়া, ইরাক, আর ইয়েমেনে এসবের প্রভাবে কয়েকটি মুসলিম-ইহুদী দাঙ্গা হয়েছে, দু’পক্ষেই বহু ক্ষয়ক্ষতি-মৃত্যু ঘটেছে।

ইয়েমেনে দীর্ঘকালের জাতিবিদ্বেষী রাষ্ট্রীয় নীতির শিকার ইহুদীরা ১৯৪৭এর ইজ়রায়েল-ফিলিস্তিন বিভাজনের জাতিসংঘ রেজ়োল্যুশনের পরে আরেকবার আক্রান্ত হয়। তাদের ধর্মালয়-বিদ্যালয়-দোকানপাট জ্বালিয়ে দেয় মুসলিম মব্। অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বদলে আদেনের মুসলিম পুলিশই লুটতরাজে যোগ দেয়। দুপক্ষ মিলিয়ে প্রায় দু’শ মানুষ প্রাণ হারায়। ‌

অতঃপর শেষবারের মত ইয়েমেনী ইহুদীরা নিঃস্ব হয় ১৯৪৯/৫০এ অপারেশন ম্যাজিক কার্পেটের সময়। সেটা ছিল ইজ়রায়েলের জুয়িশ এজেন্সীর একটা অপারেশন, যার মাধ্যমে এরিত্রিয়া, সাউদি, জিবুতি, ইয়েমেন আর ব্রিটিশ আদেন থেকে প্রায় পঞ্চাশ হাজার ইহুদীকে গোপনে আকাশপথে ইজ়রায়েলে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন এদের বেশিরভাগই দূর-দূরান্ত থেকে স্থাবর সম্পত্তি জমিজমা ছেড়ে আদেনে এসে প্লেনে উঠে পড়ে। তাদের স্থিরচিত্র ইন্টারনেটে আছে, আর সেগুলি দেখে আমার মধ্যে মানবিক সহানুভূতি জাগ্রত হয়, কারণ আমার পিতৃপুরুষও রেফ্যুজি হিসাবে জমিজমা ছেড়ে প্লেনে চড়ে অজানার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন।

ওফ়রা হাজ়ার বাবা-মাও এভাবে ম্যাজিক কার্পেটে করে ইজ়রায়েলে এসে পড়েন। সেখানে পৌঁছে কিন্তু ইয়েমেনী ইহুদীরা সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থার কারণে তাদের স্বকীয় ধর্মীয় পরিচয় খুইয়ে বসেছিল, সেটা একটা আয়রনি! এখন মধ্যপ্রাচ্যের তুরস্ক আর ইরানে কয়েক হাজার বাদ দিলে ইজ়রায়েল ছাড়া আর কোথাও তেমন কোন ইহুদী জনসংখ্যা নেই।

ও আরেকটা ব্যাপার… এই গানটা ১৯৭৮এ গাওয়া। এসময় একটা বড় আশা নিয়ে ইজ়রায়েল-মিশর দু’দেশের মানুষই একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পেরেছিল। ১৯৭৭এ সারা আরব বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে মিশরের রাষ্ট্রপতি আনওয়ার সাদাত ইজ়রায়েলে এসে প্রেসিডেন্ট মেনাহিম বেগিনের সাথে দেখা করেন। ১৯৭৮এ ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে মিশরকে ইজ়রায়েল ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে দখলকরা সিনাই উপদ্বীপের বিশাল ভূখন্ড ফেরত দিয়ে দেয় (গাজ়া বাদে)। কিন্তু দু’দেশেরই কট্টরপন্থীরা একে সুদৃষ্টিতে দেখেনি। ফলশ্রুতিতে সাদাতকে ১৯৮১তে নিজের জীবন দিয়ে তার মাশুল দিতে হয়।

এই গানটা ভাল লাগলে একই সময়ে ধারণকৃত  নেশিকোত বায়াম বলে হাজ়ার আরবী-হিব্রু গানটাও শুনে দেখুন! ইম নিন আ’লু গানটার কথা আর অনুবাদ আছে এখানে

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!