সুফী জিকির

তিনারিওয়েন বলে মালির একটা ব্যান্ড আমার বেশ পছন্দ। ২০১০এ ফিফা বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এরা গান করেছিল। পশ্চিম আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ মিউজিকাল ট্রাডিশনেই অধিকাংশ মার্কিন জনরের উৎপত্তি।

তিনারিওয়েনের সদস্যরা অবশ্য কালো নয়, তারা বেরবের বা তুয়ারেগ নামক একটি মিশ্র জাতের। ইউরোপীয় বা মেডিটেরানিয়ান জনগোষ্ঠীতে প্রাচীন বেরবের জিন রয়েছে। অর্থাৎ প্রাগৈতিহাসিক ইউরোপকে জনধ্যুষিত করেছিল এদের পূর্বপুরুষদের একটি অংশ।

আলহাসান আগ তুহামি বলে তিনারিওয়েনের এক গায়ক অদ্ভূত এক চরিত্র। নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে লম্ফজম্প দিয়ে দর্শকদের মাতিয়ে রাখে। কখনো মনে হয়, সেই করতে করতে ঘোরের মধ্যে চলে গেছে আলহাসান।

ভদ্রলোকের সাথে ঠিক এক বছর আগে একটা কনসার্টে মোলাকাত হয়, ফরাসীতে কিছু বাতচিতও চলে। এথনিক মিউজিকে আগ্রহ থাকাতে এধরনের কনসার্টের সুযোগ মিললে হাতছাড়া করি না।

আলহাসান আর তার সঙ্গীরা কৃষ্ণাঙ্গপ্রধান মালিতে স্বজাতির স্বাধীনতার জন্যে প্রথমে অস্ত্র ধরেছিল, পরে গীটার। ছোটবেলা কেটেছে রেফ্যুজি ক্যাম্পগুলিতে। চাদ নামের একটি দেশে গন্ডগোল পাকাতেও লিবিয়ার গাদ্দাফি এদেরকে ব্যবহার করে।

মালির কৃষ্ণাঙ্গদের মত তুয়ারেগরাও মুসলিম। কিন্তু আরবদের সাথে তাদের ভাষা-কালচার মেলে বেশি। আরব দিগ্বিজয়ের যুগে তুয়ারেগরা ‘মাওয়ালি’ বা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন সামরিক অভিযানে উমাইয়্যা খেলাফতকে সহায়তা করে। তাদের একজন তারেক ইবনে জিয়াদ, স্পেন অভিযানের সফল সেনানায়ক। অবশ্য উত্তর আফ্রিকার অধিকাংশ জনগণ তখনও মুসলিম হয়নি। সেটি হয়েছে অনেক পরে। আমাদের দেশের মতই সুফী সাধকদের সংস্পর্শে এসে।

আলহাসান যে গানের তালে তালে তিড়িংবিড়িং লাফ দিয়ে ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছে, এটাও আসলে তাদের সুফী ঘরানার একটা ব্যাপার। রুমির ‌অনুসারী তুর্কী-ইরানী মাওলানা সেক্ট যেমন সেমা নৃত্য করে ঈশ্বরের নিকটবর্তী হবার প্রচেষ্টায়, সেরকম উত্তর আফ্রিকার সুফীরাও গানবাজনার তালে তালে শরীর দোলানোর মাধ্যমে ‘ফানা’ বা সেল্ফ-অ্যানাইহিলেশনের একটা অনুভূতির জগতে চলে যায়।

তিনারিওয়েনের আলহাসানের তিড়িংবিড়িং

 

মরক্কোর গানাওয়া সুফী সেক্টটির সদস্যদেরও ফেজ-মারাকেশ-এসাউইয়া শহরের রাস্তাঘাটে কারাকেব নামের করতাল আর সিন্তির বাদ্যযন্ত্র নিয়ে সম্মোহনী ট্র্যান্স মিউজিক করতে দেখা যায়। বাদ্যের সাথে তারা মাথাটিকে এমনভাবে দোলায় যাতে ফেজটুপির টিকলিটি সমানে ঘুরতে থাকে। বলা বাহুল্য, এরও লক্ষ্য ট্র্যান্স বা মন্ত্রাচ্ছন্ন অবস্থায় পৌঁছনো, যেটাকে রুমির মত কবিরা বলেছেন খোদাপ্রেমের মদে মাতাল হওয়া।

মরক্কোর গানাওয়া সুফী মিউজিক

সুফী তরিকাগুলির এধরনের রিচুয়ালের ধর্মীয় ভিত্তি জিকর বা খোদাকে স্মরণ করা। মূলধারাতে জিকির ফরজ নয়, কিন্তু আমাদের দেশের মুসলিম কেউ যদি কখনো জিকিরে অংশ না নিয়ে থাকে তাহলে অবাক হবো। এ প্রক্রিয়ায় আলো-আঁধারিতে একদল মানুষ জোরে জোরে আল্লাহর বিভিন্ন নাম পাঠ করতে থাকে। কখনো নবীজীর প্রশংসাসূচক দরূদ। কখনো সাধু-সন্ত-সাহাবীদের নাম। পুরো ব্যাপারটিতে একটা আধ্যাত্মিক অনুভূতি আসে, যেটা মনপ্রাণকে হাল্কা করে দেয়। মূলধারায় অবশ্যই নামাজ-রোজার গুরুত্ব জিকিরের থেকে ‌অনেক বেশি।

কিন্তু সুফীদের মধ্যে জিকিরের গুরুত্ব পঞ্চস্তম্ভের সমপরিমাণ। ভারতীয় উপমহাদেশের বাউল-কাওয়ালী-ধামাল এগুলির কথা না হয় না বললাম। সাবসাহারান আফ্রিকার নাইজেরিয়া, সুদান, সোমালিয়া — এসব দেশগুলিতেও তিড়িংবিড়িংকরা সুফী দলের দেখা মেলে। মিশরে রয়েছে মাওলানাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত তান্নুর। সিরিয়া আর আরবের অন্যান্য স্থানে সেমার পাশাপাশি চলে হাধরা। সেখানে কালিমা-দরূদ-জিকিরের সঙ্গত হয় দারবুকা-ড্রাম, কখনো নে নামক তুর্কী বাঁশি। মাথায় পাগড়ি আঁটা শ্মশ্রুমন্ডিত সুফীরা তার তালে তালে শরীর সামনে পিছে করে।

তুরস্কের সেমা

নাইজেরিয়ার কানোর তিড়িংবিড়িং জিকির

সিরিয়ার নকশবন্দী হাধরা

 

সিরিয়ার আলেভী সেমা আরেক অদ্ভূত জিনিস। শিয়া মিস্টিক এ গ্রুপটা সেদেশে সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। এদের ছেলে ও মেয়েরা একসাথে সেমা নৃত্যে অংশ নেয়। জিকির চলে আলী ও অন্যান্য শিয়া সন্তদের নামে। কুর্দীসমাজেও একইরকম মহিলা-পুরুষ মিশ্রিত সেমা করে থাকে। ইরাকের কুর্দী নারী যোদ্ধাদের ছবি খবরে প্রায় আসে। এদের জেন্ডার রোল বহু হাজার বছর ধরে সমানুপাতিক।

সিরিয়া-তুরস্কের আলেভী সেমা

ককেশাসের রুশ প্রজাতন্ত্র চেচনিয়া ও ইঙ্গুশেতিয়ার মানুষও মূলত সুফী মুসলিম। এদের জিকির আতা’য়ী দেখলে মূলধারার মুসলিমরা মূর্ছা যাবে। কলেমা পড়তে পড়তে দু’স্তরে গোল হয়ে দাঁড়ানো মানুষগুলি ড্রামের তালে বানরের মত দু’পায়ে লাফায়, আর হাতে তালি দেয়। মাঝে দলনেতার ইঙ্গিত অনুযায়ী চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। সে ঘোরার দ্রুততা কখনো বাড়ে, কখনো কমে। কারো কিন্তু ছন্দপতন নেই, পুরো দলটি যেন হয়ে গেছে একটিমাত্র দেহ। চেচেন মহিলারাও ভিতরঘরে বসে আলাদা জিকির করে।

চেচনিয়ার জিকির আতা’য়ী

সুফীদের ছোঁয়া কিন্তু পূর্বে বাংলাদেশে এসে শেষ হয়নি। ইন্দোনেশিয়া ও চীনে কখনো কোন মুসলিম সৈনিক পদার্পণ করেনি। সেসকল স্থানে ইসলাম গেছে সুফী মতবিশ্বাসের ওপর ভর করে। বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে এরাও জিকিরে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যায়।

ইন্দোনেশিয়ার সুফী দরূদ-জিকির

চীনের সুফী জিকির

 

বিশ্বের অন্যান্য অনেক ধর্মেও আধ্যাত্মিকতাবাদ রয়েছে। খ্রীষ্টানধর্মের উৎপত্তিই গ্নস্টিক আর ডায়োনাইসিয়ান মিস্টিসিজমের মধ্যে। ইহুদীদের রয়েছে কাবালা। তিব্বতী তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মে মন্ত্রপাঠ আর ভূত তাড়ানোর নাচের মধ্যে একই বিষয়। বর্তমানকালের খ্রীষ্টান ইভানজেলিস্ট অনেক গ্রুপকেও দেখা যায় নাচগান করতে করতে একটা একস্ট্যাটিক স্টেটের মধ্যে চলে যায়। তাতে নাকি ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীও সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরে। সত্যমিথ্যা বলা মুশকিল।

যাই হোক, অন্য ধর্মের আধ্যাত্মিকতাবাদে সুফী জিকিরের কোন সমান্তরাল খুঁজে পেলাম না। একমাত্র যেটার সাথে মিলল তা হলো নামিবিয়া-বতসওয়ানার বুশম্যান বা খয়সান জনগোষ্ঠীর হিলিং সেরেমনি। এরা বহু প্রাচীন এক জাত। ইউরোপীয়দের সংস্পর্শে আসার আগে এরা হাজার বছর ধরে প্রস্তর যুগেই আটকে ছিল। এদের ধর্মবিশ্বাস অ্যানিমিস্ট, অর্থাৎ প্রকৃতির বিভিন্ন বস্তু-প্রাণীর স্পিরিট আর পূর্বপুরুষদের আত্মার শক্তিতে এরা বিশ্বাসী। ট্রাইবের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে ভূত তাড়ানোর হিলিং সেরেমনি হয়। সেখানে এরা লাইন ধরে মাটিতে পদাঘাত করতে করতে মন্ত্রপাঠ করে। তাদের নেতৃত্ব দেয় মেডিসিনম্যান বা শামান। মন্ত্রপাঠ করতে করতে একসময় ঘোরের মধ্যে চলে যায় শামান। তার মুখ থেকে তখন অবোধ্য সব কথা বের হতে থাকে। সারারাত এরকম অনুষ্ঠানের পরদিন অসুস্থ ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলে বলে সে সুস্থ হয়ে গেছে।

নামিবিয়ার খয়সান হীলিং সেরেমনি

‌একইরকম ব্যাপার আলাস্কা-আমেরিকার নেটিভদের কালচারে রয়েছে। উদ্দেশ্য একই, হীলিং।

এটা অবাক করার মত ব্যাপার নয়। মানুষ দলগতভাবে হাজার হাজার বছর ধরে এ ধরনের রিচুয়াল করে আসছে। গ্রুপ সাজেশনের মত একটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার এর মধ্যে আছে। মুসলিম জিকির নিয়ে গবেষণা করা বিজ্ঞানীরা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করেছেন যে, জিকিররত মানুষদের হৃদস্পন্দন একে অপরের সাথে সিনক্রনাইজড হয়ে যায়। এক সাথে উত্থানপতন হয়। পুরো এক্সপেরিয়েন্সটা থেকে একটা পরিপূর্ণতা নিয়ে ফেরে অংশগ্রহণকারীরা। অর্থাৎ এর থেরাপিউটিক একটা ভ্যালু রয়েছে। এটাকেই হয়ত রুমির মত সুফীরা বলেছেন ডিভাইন ইনটক্সিকেশন।

সুফীদের এসব নাচগানবাদ্য অবশ্য মূলধারার অনেকের যেমন পছন্দ নয়, তেমন প্রগতিশীলদেরও নয়। বিশের দশকে তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক আইন করে সুফী অনেক দরগা বন্ধ করে দেন। কারণ তারা নাকি পশ্চাদমুখী। শুধু পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্যে বেঁচে থাকে সেমা সেরেমনি। বর্তমানকালের সৌদী-সালাফীদেরও এসব অপছন্দ। সে ধারাটির পয়সা ঢালার কারণে যেসব দেশে সুফী ইসলাম ছিল মূলধারা, তারা এখন কোনঠাঁষা হয়ে গেছে। ব্যাপারটা ইন্দোনেশিয়া থেকে মরক্কো পর্যন্ত সত্য। তবে কুরআন-হাদীসে এ ভাবে জিকির করার কোন ইনস্ট্রাকশন আসলেই নেই।

যেভাবে এসকল রীতি রিজিওনাল ইসলামে এসেছে, তাকে বলে সিনক্রেটিজম। ধর্মপ্রচারকরা দেশে দেশে গিয়ে একটা কমন থীম বের করে সেটার ইসলামীকরণ করেছেন। তাতে স্থানীয়দের আদি ধর্মবিশ্বাস থেকে ইসলামে প্রবেশের পথ পরিষ্কার হয়ে গেছিল। সাধারণ মানুষ গভীর ধর্মতত্ত্ব বোঝে না, কিন্তু জিকির বা হিলিং সেরেমনির সোশাল-পারসোনাল বেনেফিটগুলি ঠিকই বোঝে। যদি সুফী ধর্মপ্রচারকরা বতসওয়ানাতে পৌঁছতেন, তাহলে খয়সান জনগোষ্ঠী গা-টা ঢেকেঢুকে খোদারসুলের নামেই জিকির করত।

অর্থাৎ মুসলিম লোকাল সংস্কৃতিগুলির ওপরের স্তরটাকে ঘষে তুলে ফেললে যেটা দেখি, সেটা অনেক প্রাচীন একটা সাবস্ট্রেট। আর পূর্ব থেকে পশ্চিমে সে সাবস্ট্রেট একই। প্রস্তরযুগের মানুষ যে অ্যানিমিস্ট শামানিজমে বিশ্বাস করত, সেটাই এই সাবস্ট্রেট। মানুষ হিসাবে আমাদের ফিজিকাল-সাইকলজিকাল ক্যারেক্টারের খুব একটা রূপান্তর হয়নি। সেই পরিচয়ে নাচগানবাদ্য এন্টারটেইনমেন্ট নয়, বরং প্রকৃতি আর আত্মাদের বশে আনার প্রচেষ্টার ম্যাজিক।

লাস্কো গুহার শিকারের চিত্র সেই একই ম্যাজিক। গুহাচিত্র অবশ্য গুহাতেই রয়ে গেছে, কিন্তু এসকল জিকির-হিলিং সেরেমনি গুহা থেকে আমাদের সাথেই বেরিয়ে এসেছে। আর এখনো বহাল তবিয়তে বেঁচে রয়েছে আমাদের ধর্ম-সংস্কৃতিতে।

সজ্ঞান সমাধিচর্চা

বিগত কয়েকটি পোস্টে বলছিলাম আদি মানুষের ধর্মবিশ্বাস আর কল্পনাশক্তির কিভাবে বিকাশ হল, তার একটা সম্ভাব্য কাহিনী। আগুনের আবিষ্কার সেই কাহিনীর কেন্দ্রবিন্দু।

অবশ্য আগুন এই প্রক্রিয়ার একমাত্র নিয়ামক হয়ত নয়, আর মানুষ এক-দুই জেনারেশনে হঠাৎ করে ‘মানুষ’ হয়ে ওঠেনি। লাখখানেক বছর তো লেগেছেই। কবে কিভাবে তার ঊর্বর মস্তিষ্কে প্রাচীন ধর্মবিশ্বাসের উদয়, তার সঠিক নির্দেশক নির্ধারণ করা কঠিন। কারণ মৌখিক ভাষা কোন ফসিল রেখে যায় না। ঠিক তেমন সঙ্গীতনৃত্য আর প্রার্থনারীতিরও কোন প্রত্যক্ষ নিদর্শন উদ্ঘাটন সম্ভব নয়।

সেকারণে নৃতত্ত্ববিদরা দু’ধরনের বাস্তব প্রমাণের মাধ্যমে মানুষের উদ্ভাবনী ক্ষমতার আরম্ভকাল নির্ধারণ করেন। পাথরের অস্ত্র যদি হয় মানুষের প্রযুক্তিগত বিবর্তনের প্রমাণ, তাহলে তার কল্পনাশক্তি বিকাশের প্রমাণ মেলে মূর্তশিল্পে আর সমাধিতে।

সেকারণে চারটি ছবি দিয়েছি। এগুলির তিনটি সভ্যতাপূর্ব মানববসতিতে প্রাপ্ত সমাধির চিত্র, আর একটির কথা পরে বলছি। ব্যাখ্যা করার আগে বলে নেই, এদের দু’টি শিকাগোর ফীল্ড মিউজিয়াম আর ওয়াশিংটনের স্মিথসোনিয়ান ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্টরিতে প্রদর্শিত। একটি স্টকহোমের মিউজিয়াম অফ ফার ঈস্টার্ন অ্যান্টিকুইটিজে। আরেকটি জার্মানির উল্ম মিউজিয়ামে।

কোভিড মহামারিতে এসকল মিউজিয়াম বন্ধ হয়ে রয়েছে বহুদিন। দর্শক সমাগম নেই। তাই আয়ের উৎস এদের সংকুচিত। ব্যয়বহুল রক্ষণাবেক্ষণ তো বটেই, যেসব গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা এ সকল জাদুঘরের কর্মীরা দেশেবিদেশে করে থাকেন, সেগুলিও স্থগিত। যদি আপনি মিউজিয়াম ভালবাসেন আর মনে করেন যে ভবিষ্যত প্রজন্মের এসকল কাহিনী জানা জরুরী, দয়া করে নিচে দেয়া লিংকে গিয়ে ফীল্ড মিউজিয়ামে কিছু দান করুন। ১২০ বছর আগে শিকাগোর এক কোটিপতির অনুদানের মাধ্যমে মিউজিয়ামটির শুরু। এ মুহূর্তে ক্রাউডফান্ডিং ছাড়া এদের উপার্জনের খুব বেশি রাস্তা নেই।

শিকাগোর ফীল্ড মিউজিয়ামের মূল গ্যালারী।

মূল কথায় ফিরে আসি। ছবিতে দেখানো সমাধিগুলির প্রথমটি মিশরের নাকাদা-বাদারি কালচারের। মৃতদেহটি মরুভূমির শুষ্ক আবহাওয়া আর ন্যাট্রন লবণের কারণে সম্ভবত প্রাকৃতিকভাবেই মামিতে পরিণত হয়েছে। সময়কাল প্রায় সাড়ে চার হাজার খ্রীষ্টপূর্ব, অর্থাৎ গিজার পিরামিডের থেকেও দু’হাজার বছরের পুরনো।

দ্বিতীয় ছবির কংকালটি আবিষ্কৃত হয়েছিল জর্দানের ডেডসীর কাছে বাবেজজারাতে। এটি সাড়ে তিন হাজার খ্রীষ্টপূর্বের। আর তৃতীয় ছবিটি আরো দূরের চীনের বানপো গ্রামের প্রস্তরযুগীয় সমাধি। সেটাও প্রায় সাড়ে তিন হাজার খ্রীষ্টপূর্বের।

মিশরের নাকাদা-বাদারি কালচারের সমাধি।

বাব-এজ-জারার প্রস্তরযুগীয় সমাধি।

চীনের বানপো গ্রামের প্রস্তরযুগীয় সমাধি।

তিনটি ভিন্ন স্থানের সমাধির ধরন প্রায় একই রকম। মাটিতে অথবা পাথরে ওভাল শেপের একটা গর্ত করে তাতে ‘ফিটাল পজিশনে’ (মাতৃগর্ভে যেভাবে থাকে শিশু) মৃতদেহটিকে শোয়ানা হয়েছে। মুখটা কোন বিশেষ দিকে ফেরানো। কোন ক্ষেত্রে সাথে দেয়া হয়েছে রঙীন নুড়ি, পাথরের অস্ত্র, আর মাটির পাত্রভরা খাবার। অর্থাৎ মানুষ ইতিমধ্যে পরকাল বলে একটা কিছু আছে সে বিশ্বাস করা শুরু করেছে। পরপারের যাত্রায় যা যা লাগতে পারে, তা প্রিয়জনের সমাধিতে দিয়ে দিয়েছে।

আজকের দৃষ্টিতে বিচার করলে মনে হতে পারে এ আর এমনকি ব্যাপার। কিন্তু মাথায় আবার প্রস্তরযুগীয় মস্তিষ্কটি ফিট করুন। কেন হঠাৎ করে মনে হলো আপনার, যে মৃতদেহটিকে সমাহিত করতে হবে, সাথে দিতে হবে প্রয়োজনীয় সব বস্তু? কেন অন্য জানোয়ারের মত মৃতদেহটি ফেলে রেখে চলে গেলেন না? আপনার পশুমনোবৃত্তিটির পরিবর্তন কেন কিভাবে হলো?

এই যে একে অন্যের জন্যে কেয়ার করার ব্যাপারটা, সেটা শিম্পাঞ্জি ছাড়াও অন্যান্য আরো কিছু প্রাণীর মধ্যে আছে, যাদের মধ্যে হাতিও পড়ে। আফ্রিকার হাতিরা নাকি মৃত্যুকালে তাদের ‘নির্ধারিত’ কবরস্থানে গিয়ে অপেক্ষা করে। বিপুলসংখ্যক হাতির কংকাল সেসব জায়গায় আবিষ্কৃত হয়েছে। হতে পারে এর মধ্যে একটা প্রাকৃতিক ব্যাপার রয়েছে। স্বল্প উন্নত মস্তিষ্কের প্রাণীও হয়ত বুঝতে পারে যে, মৃতদেহ পচনশীল, তার থেকে যে গন্ধ ও জীবাণু ছড়ায় তা জীবিতদের জন্য স্বাস্থ্যকর নয়।

এরকম ন্যাচারাল ইন্সটিংক্ট থেকে হয়ত প্রাচীন মানুষ মৃতদেহ কবর দেয়া শুরু করে। কুরআনে হাবিল-কাবিলের কাহিনীটাও অনেকটা সেরকম। কাবিল হাবিলকে হত্যা করার পর খোদার পাঠানো দাঁড়কাকের দেখাদেখি কবর খুঁড়ে ভাইকে সমাহিত করে। অর্থাৎ প্রকৃতি থেকে শেখার একটা ক্লু রয়ে গেছে গল্পটাতে।

তিনতোরেত্তোর ছবিতে হাবিল-কাবিলের কাহিনী, ১৫৫০-৫৩।

কিন্তু সমাধির সাথে সাথে অন্যান্য বস্তু দেয়ার চিন্তাটা কেন মানুষের মাথায় এল? উত্তর খুব সোজা। আদি মানুষ কল্পনার জগতে ভেবেছে তাদের পূর্বপুরুষেরা মৃত নয়, সীমানা পেরিয়ে অন্য একটি স্থানে প্রবেশ করেছে মাত্র। সেখানেও তাদের দৈহিক চাহিদা থাকবে। জীবিতদের দায়িত্ব সেসব পূরণের যথোপযুক্ত বন্দোবস্ত করা।

আদিম মানুষ কবে থেকে সজ্ঞানে এ ধরনের সমাধি দেয়া শুরু করেছে, তা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। ২০১৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার রাইজিং স্টার কেভ সিস্টেমে এক প্রাচীন প্রজাতির হোমিনিডের ফসিল আবিষ্কৃত হয়, যার নাম দেয়া হয় হোমো নালেদি। খননকার্যের এক পর্যায়ে কেভ সিস্টেমের খুব গভীরে আবিষ্কৃত হয় বেশ কয়েকটি দেহাবশেষ। সরু সুরঙ্গের মধ্যে দিয়ে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় এসকল মৃতদেহের এখানে এসে পড়াটা সহজ নয়। হিংস্র কোন প্রাণীও যে টেনে এনে এখানে ফেলবে তাও সম্ভব নয়। সব মিলিয়ে তিন লাখ বছরের পুরনো এই দেহাবশেষগুলিকে গুহার গভীরে ‘কবর’ দেয়া হয়েছে বলে কিছু নৃতত্ত্ববিদের ধারণা। এখনো এ নিয়ে বাকবিতন্ডা চলছে।

প্রস্তরযুগীয় ‘জার’ সমাধি, নিয়াহ কেভ, সারাওয়াক।

এর সাথে আবার মেলে মালয়েশিয়ার সারাওয়াকের গুহাবাসী হোমো সেপিয়েন্সদের সমাধি। এগুলি ‌অবশ্য তুলনামূলক নতুন, মোটে সাড়ে তিন হাজার খ্রীষ্টপূর্বের। বাঁশের তৈরি ঝাঁকিতে করে ফীটাল পজিশনে বসিয়ে মৃতদেহ তারা রেখে আসত গুহার টয়াইলাইট জোনে, অর্থাৎ যেখানে আলোর শেষ আর আঁধারের শুরু। পরবর্তীতে যারা মারা যেত, তাদের কবর হত তাদের প্রয়াত পূর্বপুরুষদের সাথে। এভাবে পারিবারিক গোরস্তান গড়ে উঠেছিল গুহার অভ্যন্তরে। এই টয়াইলাইট জোনই হয়ত পরবর্তীকালের ধর্মবিশ্বাসের ‘পাতাল’ — আন্ডারওয়ার্ল্ড। স্বর্গ-নরকের থেকেও ‘পাতালের’ কনসেপ্ট বেশি পুরনো।

দেড় লাখ বছর আগের হোমো নেয়ান্ডারটালেনসিসের বিশাল এক বসতি ক্রোয়েশিয়ার ক্রাপিনাতে আবিষ্কৃত হয়েছে। এর মধ্যে বেশ কিছু সমাধিও রয়েছে। ৫২ হাজার বছর আগের একটি নেয়ান্ডারটাল কবরও ফ্রান্সে আবিষ্কৃত হয়েছে। তবে নেয়ান্ডারটালের যথেষ্ট কল্পনাশক্তি ছিল কিনা তা নিয়ে এখনো বিতর্ক রয়েছে। এসব কবরে কোন সমাধিবস্তু পাওয়া যায়নি। একমাত্র ইরাকের শানিদার গুহায় নেয়ান্ডারটাল কবরে ফুলের পোলেন পাওয়া গেছিল, যদিও প্রত্নতত্ত্ববিদরা পরে বলেছেন সেটি নাকি অন্য প্রাণীর কাজ।

ইজরায়েলের কাফজা গুহায় আবিষ্কৃত প্রস্তরযুগীয় দ্বৈত সমাধি।

সন্দেহাতীতভাবে সবচে’ প্রাচীন মানবসমাধি ৯২ হাজার বছরের পুরনো। ইজরায়েলের কাফজা গুহাতে মা-মেয়ের একত্রিত কবর আবিষ্কৃত হয়েছে। সমাধিদ্রব্য হিসাবে পাওয়া গেছে রঙকরা ফোঁড়া ঝিনুক, যেগুলি সম্ভবত সুতোয় বেঁধে গলায় নেকলেস হিসাবে পড়া হত। আরো পাওয়া গেছে রেড ওকার। একধরনের পাথর গুঁড়িয়ে এই রংটি তৈরি হত। গুহাচিত্রে যেমন এর ব্যবহার ছিল, তেমন সমাহিত মৃতদেহের মুখমন্ডল রঙীন করতেও। অর্থাৎ এ কবরটির নিঃসন্দেহে ‘কালচারাল রিচুয়াল’ তাৎপর্য রয়েছে।

প্রায় এক লাখ বছর আগে এদের হোমো সেপিয়েন্স পূর্বপুরুষ আফ্রিকা থেকে প্রথম মধ্যপ্রাচ্যে পদার্পণ করে। কিন্তু দশ-বিশ হাজার বছরের মধ্যে বসতি বিলীন হয়ে যায়। সত্তর হাজার বছর আগে দ্বিতীয় চেষ্টার পর হোমো সেপিয়েন্স লেভান্ট ও আরবে স্থায়ী আবাস বাঁধতে সক্ষম হয়। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে এশিয়া, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকায়। আর মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপে এসে তাদের মোলাকাত হয় অতি দূর সম্পর্কের কাজিন নেয়ান্ডারটালদের সাথে। এমনটা অসম্ভব নয় যে দুই প্রজাতি একে অন্যের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করেছে।

স্পেনের মালত্রাভিয়েসো গুহার প্রস্তরযুগীয় শিল্প।

সমাধির সাথে সাথে যদি মূর্তশিল্পের দিকে নজর দিই, তাহলেও একটা ট্রান্সফর্মেশন ধরা পড়ে কেভ পেন্টিংয়ের শুরুতে। স্পেনের মালত্রাভিয়েসো গুহায় আবিষ্কৃত হয়েছে ৬৪,০০০ বছরের প্রাচীনতম গুহাচিত্র। এগুলির মূল বিষয়বস্তু শিকারের জন্তুজানোয়ার। এঁকেছে নেয়ান্ডারটাল কাজিনরা। মডার্ন হিউম্যানের আঁকা গুহাচিত্রও প্রায় সমসাময়িক। ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার বছরের পুরনো চিত্রগুলো ইন্দোনেশিয়া আর ইউরোপে আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব আঁকারও রিচুয়াল সিগনিফিক্যান্স রয়েছে, যেটা বিগত লেখায় বলেছি।

জার্মানিতে আবিষ্কৃত সিংহমানবের মূর্তি।

একই সময়কালের আরও যে অদ্ভূত নিদর্শনটি জার্মানিতে আবিষ্কৃত হয়েছে তার নাম লোভেনমেনশ বা লায়নম্যান ফিগার। মানুষের দেহের ওপর সিংহের মাথা লাগানো আইভরির তৈরি এই ছোট্ট ‘পুতুলটি’ ৩৫ থেকে ৪০ হাজার বছরের পুরনো। মানুষের এহেন কল্পনাশক্তির এর থেকে প্রাচীন কোন নমুনা এখনো পাওয়া যায়নি।

অন্য পশুপাখির যে ক্ষমতা রয়েছে — কিন্তু মানুষের নেই — তা দিয়ে কোন অসাধ্য সাধনের ‘ম্যাজিক’ করতে চেয়েছে হয়ত সেকালের মানুষ। যেসব বিশেষ পশুকে মানবরূপ দেয়া হয়েছে, তাদের বলা যেতে পারে অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যানিম্যাল স্পিরিট। যেমন আমার লক্ষ্য যদি হয় আকাশে দেখা উজ্জ্বল একটি নক্ষত্রে পৌঁছনো, যেখানে রয়েছে আমার প্রয়াত পূর্বপুরুষ, তাহলে আমার দরকার ঈগলের মত কোন পাখির সাহায্য।

ধরুন আমি-আপনি একটি প্রস্তরযুগীয় ক্লানের সদস্য। দলটির জন্যে ক্রান্তিকাল চলছে। শিকারীদল বার বার বিফল হয়ে ফিরে আসছে। মাংসের অভাবে বুনো ফলমূল খেয়ে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। এহেন অবস্থায় ক্লানের প্রধান হিসাবে আপনি পুরোপুরি দিগহারা। শীতের তুষারপাত সমাগত প্রায়। আপনাদের হাতে দু’টি রাস্তা। এলাকাটি ছেড়ে আরো দূরে পাড়ি জমানো যেখানে শিকার জুটতেও পারে নাও পারে। নয়ত আরো একটিবার শিকারের প্রচেষ্টা করে শীতকালটি কাটিয়ে তারপর স্থানান্তর। যুবাবয়সে বয়োবৃদ্ধদের উপদেশ কাজে দিত। কিন্তু তাদের কেউ আর জীবিত নেই। আমাকে তাই আপনি নির্দেশ দিলেন মৃত পূর্বপুরুষদের উপদেশগ্রহণের জন্যে তাদের সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা করতে।

যজ্ঞ করে একটি ঈগল শিকার করে তার পালক ও চঞ্চু দিয়ে মুখোশ বানালাম। তারপর দলবল নিয়ে, সাইকিডেলিক ওষধি শেকড়ে আগুন লাগিয়ে তার ধোঁয়া ফুঁকে, মন্ত্র পড়ে, দৌড়ঝাঁপ করলাম। তারপর হয়ত সে রাতে সত্যি সত্যি স্বপ্নে দেখলাম আমি নক্ষত্রমন্ডলে হারানো পিতা-পিতামহের সাথে পুনর্মিলিত হয়েছি। ট্রাইবের সবার অবশ্য এ বিশেষ শক্তি থাকবে না। আমার মত যার যার থাকবে, তাদের নাম ওঝা, মেডিসিনম্যান, শামান, ইত্যাদি। আর এই প্রক্রিয়ায় যে প্রাণীর স্পিরিট আমাকে সাহায্য করলো, সেটি ঈগল। আর আমার যজ্ঞে ব্যবহারের জন্যে এরকম একটা ঈগলম্যান মূর্তি কল্পনা থেকে বানিয়ে ফেলা কোন ব্যাপারই না।

বুঝতেই পারছেন আদিম মানুষের কল্পনাশক্তির দৌড় কতদূর!

প্রিয়জনকে সমাহিত করার মাধ্যমে মানুষ প্রমাণ করেছে যে শুধু পাথরের অস্ত্র তৈরিতে তার উদ্ভাবনী ক্ষমতা সীমাবদ্ধ নয়। চিন্তা করে দেখুন যে আজ থেকে ত্রিশ লাখ বছর আগে মানুষের পূর্বপুরুষ পাথরের অস্ত্র ব্যবহার শেখে। কিন্তু সে প্রযুক্তির সম্মুখ বিবর্তন পরবর্তী বিশ লাখ বছরেও তেমন একটা হয়নি।

তারপর এল আগুন, সাথে জীবনযাত্রার একটা পরিবর্তন। আর বিগত এক লাখ থেকে পঞ্চাশ হাজার বছরের মধ্যে এল আমাদের ইমাজিনেশন-ভিজুয়ালাইজেশনের ক্ষমতা। প্রস্তরাস্ত্রের টেকনোলজি আবিষ্কার করেও মানুষ তাতে আটকে ছিল লাখ লাখ বছর। আর কল্পনাশক্তির আল্টিমেট ইভল্যুশনের পঞ্চাশ হাজার বছরের মধ্যে আমরা বর্তমান বিশ্বের অধিবাসী।

ইমাজিনেশন আর ম্যাজিক-স্পিরিট-শামানিজম, সোজা ভাষায় রিলিজাস বিলিফ সিস্টেমের যে পাওয়ার অফ সাজেশন, সেটা মানবজাতিকে এমন একটা সম্মুখমুখী ঘাত দিয়েছে যার শক্তি এখনো ফুরোয়নি।

যতই বিজ্ঞানপ্রযুক্তি পড়ে জ্ঞানী হোন না কেন, যে শিকড় থেকে এই শক্তিটি মানুষ আহরণ করেছে, সেই স্পিরিচুয়াল-ম্যাজিকাল-রিলিজাস বিলিফ সিস্টেমটাকে অবজ্ঞা করবেন না!

ফীল্ড মিউজিয়ামে দানের লিংক:

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!