শুকনো পাতার নুপূর পায়ে…

Featured Video Play Icon

নিচের গানটির সুর বাঙ্গালী সবারই জানার কথা। বিদ্রোহী কবি নজরুলের ‘ত্রিভূবনের প্রিয় মোহাম্মদ’ আর ‘শুকনো পাতার নুপূর পায়ে’ গান দু’টি একই সুরে বাঁধা। কিন্তু কাতালান কন্ডাক্টর জোর্ডি সাভালের হেসপেরিওন অনসম্বলের এই পারফরম্যান্সে সেই সুরটার সাথে যে ভাষাগুলিতে গান গাওয়া হচ্ছে, সেটা বাংলা নয় — তুর্কী, আরবী, হিব্রু, গ্রীক, আর লাদিনো!

এধরনের ভৌগোলিকসীমাহীন জনপ্রিয় সুরকে মিউজিকোলজিস্টরা ডাকনাম দিয়েছে ওয়ান্ডারিং মেলোডীজ — যাযাবর সুর। উপরের ভাষাগুলি ছাড়াও সার্বিয়ান, বসনিয়ান, বুলগেরিয়ান, রোমানিয়ান, ম্যাসিডোনিয়ান, আর্মেনিয়ান ভাষার গানেও এই সুর ব্যবহার হয়েছে। মার্কিন জ্যাজ় শিল্পী আর্থা কিটও পঞ্চাশের দশকে গানটা গেয়েছিলেন।

সুদূর নিকট-প্রাচ্য থেকে এই সুরটা বাংলা গানে আনা নজরুলের কৃতিত্ব। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির হাবিলদার হিসাবে তিনি ১৯১৭ থেকে ১৯২০ করাচি সেনানিবাসে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু প্রাচ্যের যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়া হয়নি তাঁর। তাও কোন না কোনভাবে সুরটি তাঁর সামনে এইসময়ই এসে পড়ে ধারণা করলে মনে হয় না খুব একটা ভুল করব।

গানটার বিষয়বস্তুও এক ভাষা থেকে আরেক ভাষাতে গিয়ে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। হিব্রুতে সেটা প্রার্থনাগীতি, গ্রীক, লাদিনো আর আরবীতে সেটা প্রেমের গান বা চপলা কিশোরীর স্তুতি; আবার আর্মেনিয়ান-বুলগেরিয়ানে দেশাত্মবোধক। ওসমানলি সাম্রাজ্যের সময় লেখা মূল তুর্কী গানটার কথা পড়লে মনে হবে, তরুণী গায়িকা তার সুদর্শন ‘কতিব’ বা কেরানির সাথে ফষ্টিনষ্টি করছে। বেচারার লেজওয়ালা কোট জলেকাঁদায় নোংরা হয়ে গেছে বলে তার বিমর্ষবদন দেখে তরুণী পুলকিত বোধ করছে।

আজকের নব্য ওসমানলি জাতীয়তাবাদীরা হয়ত আপনাকে বুঝ দিবে যে, মূল তুর্কী গানটারও উদ্দেশ্য প্রেমনিবেদন, আর তুর্কীদেশ সেসময় মুসলিম সাম্রাজ্য হওয়া সত্ত্বেও সেদেশে সমসাময়িক পশ্চিমাদেশের তুলনায় নারীস্বাধীনতা বেশি ছিল। কিন্তু ইতিহাস ঘাঁটলে বুঝবেন তা আসলে নয়! ওসমানলি সাম্রাজ্যে কেবল হারেমের মেয়েরা আর রাজমাতারাই ছিলেন ক্ষমতাবান নারী, সাধারণ মেয়েদের অধিকার ছিল পুরুষের অর্ধেক।

‘কতিবিম’ নামে মূল গানটার আসল উদ্দেশ্য ছিল ঊনবিংশ শতকে সুলতান প্রথম আব্দুল মজিদের চাপিয়ে দেয়া সংস্কারকে নিয়ে বিদ্রূপ করা। ১৮৫০এর দিকে ক্রিমিয়ার যুদ্ধে রুশদের আগ্রাসনের মুখে ইউরোপের ‘সিক ম্যান’ তুরস্ককে ইংরেজ, ফরাসী আর সার্ডিনিয়ানরা সহায়তা করে। রুশরা সেযুদ্ধে পরাজিত হয়, আর পশ্চিমাদের অনুকরণে সুলতান তুরস্কে তানজ়িমাত বলে একটা সংস্কার চালু করেন। অন্যান্য অনেক প্রগতিশীল নীতির সাথে সাথে নিয়ম করে রাজকর্মচারীদের পোশাকও পরিবর্তন করে কোট-প্যান্টালুন করা হয়। ঐতিহ্যবাহী ঢোলা জামাকাপড়ে অভ্যস্ত রক্ষণশীল তুর্কীরা সেটা পছন্দ করেনি। তাই এরকম বিদ্রূপাত্মক গান চালু হয়ে গেল, যেন কমবয়েসী মেয়েরা পর্যন্ত সরকারি কেরানিদের পরনের কাপড় নিয়ে ঠাট্টাতামাশা করছে!

তুর্কী জনগণের অসন্তুষ্টির মুখে তানজ়িমাত সংস্কার বেশিদিন চলতে পারেনি। আব্দুল মজিদের মৃত্যুর পনেরো বছর পরে আবার যেমনকার তেমন। তবে কিছু জিনিস টিকে গিয়েছিল। যেমন, সাম্রাজ্যে ইহুদী-খ্রীষ্টান-মুসলিম-দ্রুজ আরব-তুর্কী-আর্মেনিয়ান নানাগোত্রের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখার জন্যে তাদের ওসমানলি দেশভিত্তিক জাতীয়তাবাদী পরিচয়টাকে ভাষা-জাতি-ধর্মভিত্তিক পরিচয়ের থেকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। নাগরিকত্ব আর সম্পত্তি মালিকানা আইনেও কিছুটা সমাধিকার আনা হয়। (ইতিহাসবিদরা বলবেন, ১৮৮০র দিকে রাশিয়া থেকে তাড়িয়ে দেয়া রুশ ইহুদীরা সেসব আইনের ব্যবহার করে প্যালেস্টাইন প্রদেশে জমি কেনা শুরু করে।) বহুজাতিক দেশ হিসাবে কিছুটা হলেও গ্রহণযোগ্যতা পায় ওসমানলি রাষ্ট্র, সেজন্যেই হয়ত তাদের প্রাক্তন প্রদেশগুলিতে এধরনের তুর্কী সুরসংস্কৃতি এখনো প্রচলিত। শুধু সেসময়ের সাধারণ তুর্কীরা এরকম ইনক্লুজিভিটি পছন্দ করেনি, বিদ্রূপ করেছে।

ইতিহাস যাই হোক না কেন, সুরটা যে ‌অনেক দেশের অনেক ভাষার মানুষের হৃদয়জয় করেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এ এক জলজ্যান্ত প্রমাণ যে, ধর্ম-ভাষা-জাত-বর্ণের ওপর সুরসঙ্গীত মনুষ্যত্বের মৌলিক সার্বজনীন পরিচয়গুলির একটি!

***

[পারফর্মারদের গুরুগম্ভীর ভাব দেখে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, তাঁরা রেনেসাঁস বারোক সঙ্গীতের বিশেষজ্ঞ বিধায় বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকের ভোল ধরেছেন! ঘুমপাড়ানি লাদিনো গানের মহিলাকণ্ঠ রেকর্ডেড, জোর্ডি সাভালের প্রয়াত স্ত্রী মন্টসেরাত ফিগেরাসের।]

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!