সুফী জিকির

তিনারিওয়েন বলে মালির একটা ব্যান্ড আমার বেশ পছন্দ। ২০১০এ ফিফা বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এরা গান করেছিল। পশ্চিম আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ মিউজিকাল ট্রাডিশনেই অধিকাংশ মার্কিন জনরের উৎপত্তি।

তিনারিওয়েনের সদস্যরা অবশ্য কালো নয়, তারা বেরবের বা তুয়ারেগ নামক একটি মিশ্র জাতের। ইউরোপীয় বা মেডিটেরানিয়ান জনগোষ্ঠীতে প্রাচীন বেরবের জিন রয়েছে। অর্থাৎ প্রাগৈতিহাসিক ইউরোপকে জনধ্যুষিত করেছিল এদের পূর্বপুরুষদের একটি অংশ।

আলহাসান আগ তুহামি বলে তিনারিওয়েনের এক গায়ক অদ্ভূত এক চরিত্র। নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে লম্ফজম্প দিয়ে দর্শকদের মাতিয়ে রাখে। কখনো মনে হয়, সেই করতে করতে ঘোরের মধ্যে চলে গেছে আলহাসান।

ভদ্রলোকের সাথে ঠিক এক বছর আগে একটা কনসার্টে মোলাকাত হয়, ফরাসীতে কিছু বাতচিতও চলে। এথনিক মিউজিকে আগ্রহ থাকাতে এধরনের কনসার্টের সুযোগ মিললে হাতছাড়া করি না।

আলহাসান আর তার সঙ্গীরা কৃষ্ণাঙ্গপ্রধান মালিতে স্বজাতির স্বাধীনতার জন্যে প্রথমে অস্ত্র ধরেছিল, পরে গীটার। ছোটবেলা কেটেছে রেফ্যুজি ক্যাম্পগুলিতে। চাদ নামের একটি দেশে গন্ডগোল পাকাতেও লিবিয়ার গাদ্দাফি এদেরকে ব্যবহার করে।

মালির কৃষ্ণাঙ্গদের মত তুয়ারেগরাও মুসলিম। কিন্তু আরবদের সাথে তাদের ভাষা-কালচার মেলে বেশি। আরব দিগ্বিজয়ের যুগে তুয়ারেগরা ‘মাওয়ালি’ বা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন সামরিক অভিযানে উমাইয়্যা খেলাফতকে সহায়তা করে। তাদের একজন তারেক ইবনে জিয়াদ, স্পেন অভিযানের সফল সেনানায়ক। অবশ্য উত্তর আফ্রিকার অধিকাংশ জনগণ তখনও মুসলিম হয়নি। সেটি হয়েছে অনেক পরে। আমাদের দেশের মতই সুফী সাধকদের সংস্পর্শে এসে।

আলহাসান যে গানের তালে তালে তিড়িংবিড়িং লাফ দিয়ে ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছে, এটাও আসলে তাদের সুফী ঘরানার একটা ব্যাপার। রুমির ‌অনুসারী তুর্কী-ইরানী মাওলানা সেক্ট যেমন সেমা নৃত্য করে ঈশ্বরের নিকটবর্তী হবার প্রচেষ্টায়, সেরকম উত্তর আফ্রিকার সুফীরাও গানবাজনার তালে তালে শরীর দোলানোর মাধ্যমে ‘ফানা’ বা সেল্ফ-অ্যানাইহিলেশনের একটা অনুভূতির জগতে চলে যায়।

তিনারিওয়েনের আলহাসানের তিড়িংবিড়িং

 

মরক্কোর গানাওয়া সুফী সেক্টটির সদস্যদেরও ফেজ-মারাকেশ-এসাউইয়া শহরের রাস্তাঘাটে কারাকেব নামের করতাল আর সিন্তির বাদ্যযন্ত্র নিয়ে সম্মোহনী ট্র্যান্স মিউজিক করতে দেখা যায়। বাদ্যের সাথে তারা মাথাটিকে এমনভাবে দোলায় যাতে ফেজটুপির টিকলিটি সমানে ঘুরতে থাকে। বলা বাহুল্য, এরও লক্ষ্য ট্র্যান্স বা মন্ত্রাচ্ছন্ন অবস্থায় পৌঁছনো, যেটাকে রুমির মত কবিরা বলেছেন খোদাপ্রেমের মদে মাতাল হওয়া।

মরক্কোর গানাওয়া সুফী মিউজিক

সুফী তরিকাগুলির এধরনের রিচুয়ালের ধর্মীয় ভিত্তি জিকর বা খোদাকে স্মরণ করা। মূলধারাতে জিকির ফরজ নয়, কিন্তু আমাদের দেশের মুসলিম কেউ যদি কখনো জিকিরে অংশ না নিয়ে থাকে তাহলে অবাক হবো। এ প্রক্রিয়ায় আলো-আঁধারিতে একদল মানুষ জোরে জোরে আল্লাহর বিভিন্ন নাম পাঠ করতে থাকে। কখনো নবীজীর প্রশংসাসূচক দরূদ। কখনো সাধু-সন্ত-সাহাবীদের নাম। পুরো ব্যাপারটিতে একটা আধ্যাত্মিক অনুভূতি আসে, যেটা মনপ্রাণকে হাল্কা করে দেয়। মূলধারায় অবশ্যই নামাজ-রোজার গুরুত্ব জিকিরের থেকে ‌অনেক বেশি।

কিন্তু সুফীদের মধ্যে জিকিরের গুরুত্ব পঞ্চস্তম্ভের সমপরিমাণ। ভারতীয় উপমহাদেশের বাউল-কাওয়ালী-ধামাল এগুলির কথা না হয় না বললাম। সাবসাহারান আফ্রিকার নাইজেরিয়া, সুদান, সোমালিয়া — এসব দেশগুলিতেও তিড়িংবিড়িংকরা সুফী দলের দেখা মেলে। মিশরে রয়েছে মাওলানাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত তান্নুর। সিরিয়া আর আরবের অন্যান্য স্থানে সেমার পাশাপাশি চলে হাধরা। সেখানে কালিমা-দরূদ-জিকিরের সঙ্গত হয় দারবুকা-ড্রাম, কখনো নে নামক তুর্কী বাঁশি। মাথায় পাগড়ি আঁটা শ্মশ্রুমন্ডিত সুফীরা তার তালে তালে শরীর সামনে পিছে করে।

তুরস্কের সেমা

নাইজেরিয়ার কানোর তিড়িংবিড়িং জিকির

সিরিয়ার নকশবন্দী হাধরা

 

সিরিয়ার আলেভী সেমা আরেক অদ্ভূত জিনিস। শিয়া মিস্টিক এ গ্রুপটা সেদেশে সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। এদের ছেলে ও মেয়েরা একসাথে সেমা নৃত্যে অংশ নেয়। জিকির চলে আলী ও অন্যান্য শিয়া সন্তদের নামে। কুর্দীসমাজেও একইরকম মহিলা-পুরুষ মিশ্রিত সেমা করে থাকে। ইরাকের কুর্দী নারী যোদ্ধাদের ছবি খবরে প্রায় আসে। এদের জেন্ডার রোল বহু হাজার বছর ধরে সমানুপাতিক।

সিরিয়া-তুরস্কের আলেভী সেমা

ককেশাসের রুশ প্রজাতন্ত্র চেচনিয়া ও ইঙ্গুশেতিয়ার মানুষও মূলত সুফী মুসলিম। এদের জিকির আতা’য়ী দেখলে মূলধারার মুসলিমরা মূর্ছা যাবে। কলেমা পড়তে পড়তে দু’স্তরে গোল হয়ে দাঁড়ানো মানুষগুলি ড্রামের তালে বানরের মত দু’পায়ে লাফায়, আর হাতে তালি দেয়। মাঝে দলনেতার ইঙ্গিত অনুযায়ী চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। সে ঘোরার দ্রুততা কখনো বাড়ে, কখনো কমে। কারো কিন্তু ছন্দপতন নেই, পুরো দলটি যেন হয়ে গেছে একটিমাত্র দেহ। চেচেন মহিলারাও ভিতরঘরে বসে আলাদা জিকির করে।

চেচনিয়ার জিকির আতা’য়ী

সুফীদের ছোঁয়া কিন্তু পূর্বে বাংলাদেশে এসে শেষ হয়নি। ইন্দোনেশিয়া ও চীনে কখনো কোন মুসলিম সৈনিক পদার্পণ করেনি। সেসকল স্থানে ইসলাম গেছে সুফী মতবিশ্বাসের ওপর ভর করে। বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে এরাও জিকিরে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যায়।

ইন্দোনেশিয়ার সুফী দরূদ-জিকির

চীনের সুফী জিকির

 

বিশ্বের অন্যান্য অনেক ধর্মেও আধ্যাত্মিকতাবাদ রয়েছে। খ্রীষ্টানধর্মের উৎপত্তিই গ্নস্টিক আর ডায়োনাইসিয়ান মিস্টিসিজমের মধ্যে। ইহুদীদের রয়েছে কাবালা। তিব্বতী তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মে মন্ত্রপাঠ আর ভূত তাড়ানোর নাচের মধ্যে একই বিষয়। বর্তমানকালের খ্রীষ্টান ইভানজেলিস্ট অনেক গ্রুপকেও দেখা যায় নাচগান করতে করতে একটা একস্ট্যাটিক স্টেটের মধ্যে চলে যায়। তাতে নাকি ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীও সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরে। সত্যমিথ্যা বলা মুশকিল।

যাই হোক, অন্য ধর্মের আধ্যাত্মিকতাবাদে সুফী জিকিরের কোন সমান্তরাল খুঁজে পেলাম না। একমাত্র যেটার সাথে মিলল তা হলো নামিবিয়া-বতসওয়ানার বুশম্যান বা খয়সান জনগোষ্ঠীর হিলিং সেরেমনি। এরা বহু প্রাচীন এক জাত। ইউরোপীয়দের সংস্পর্শে আসার আগে এরা হাজার বছর ধরে প্রস্তর যুগেই আটকে ছিল। এদের ধর্মবিশ্বাস অ্যানিমিস্ট, অর্থাৎ প্রকৃতির বিভিন্ন বস্তু-প্রাণীর স্পিরিট আর পূর্বপুরুষদের আত্মার শক্তিতে এরা বিশ্বাসী। ট্রাইবের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে ভূত তাড়ানোর হিলিং সেরেমনি হয়। সেখানে এরা লাইন ধরে মাটিতে পদাঘাত করতে করতে মন্ত্রপাঠ করে। তাদের নেতৃত্ব দেয় মেডিসিনম্যান বা শামান। মন্ত্রপাঠ করতে করতে একসময় ঘোরের মধ্যে চলে যায় শামান। তার মুখ থেকে তখন অবোধ্য সব কথা বের হতে থাকে। সারারাত এরকম অনুষ্ঠানের পরদিন অসুস্থ ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলে বলে সে সুস্থ হয়ে গেছে।

নামিবিয়ার খয়সান হীলিং সেরেমনি

‌একইরকম ব্যাপার আলাস্কা-আমেরিকার নেটিভদের কালচারে রয়েছে। উদ্দেশ্য একই, হীলিং।

এটা অবাক করার মত ব্যাপার নয়। মানুষ দলগতভাবে হাজার হাজার বছর ধরে এ ধরনের রিচুয়াল করে আসছে। গ্রুপ সাজেশনের মত একটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার এর মধ্যে আছে। মুসলিম জিকির নিয়ে গবেষণা করা বিজ্ঞানীরা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করেছেন যে, জিকিররত মানুষদের হৃদস্পন্দন একে অপরের সাথে সিনক্রনাইজড হয়ে যায়। এক সাথে উত্থানপতন হয়। পুরো এক্সপেরিয়েন্সটা থেকে একটা পরিপূর্ণতা নিয়ে ফেরে অংশগ্রহণকারীরা। অর্থাৎ এর থেরাপিউটিক একটা ভ্যালু রয়েছে। এটাকেই হয়ত রুমির মত সুফীরা বলেছেন ডিভাইন ইনটক্সিকেশন।

সুফীদের এসব নাচগানবাদ্য অবশ্য মূলধারার অনেকের যেমন পছন্দ নয়, তেমন প্রগতিশীলদেরও নয়। বিশের দশকে তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক আইন করে সুফী অনেক দরগা বন্ধ করে দেন। কারণ তারা নাকি পশ্চাদমুখী। শুধু পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্যে বেঁচে থাকে সেমা সেরেমনি। বর্তমানকালের সৌদী-সালাফীদেরও এসব অপছন্দ। সে ধারাটির পয়সা ঢালার কারণে যেসব দেশে সুফী ইসলাম ছিল মূলধারা, তারা এখন কোনঠাঁষা হয়ে গেছে। ব্যাপারটা ইন্দোনেশিয়া থেকে মরক্কো পর্যন্ত সত্য। তবে কুরআন-হাদীসে এ ভাবে জিকির করার কোন ইনস্ট্রাকশন আসলেই নেই।

যেভাবে এসকল রীতি রিজিওনাল ইসলামে এসেছে, তাকে বলে সিনক্রেটিজম। ধর্মপ্রচারকরা দেশে দেশে গিয়ে একটা কমন থীম বের করে সেটার ইসলামীকরণ করেছেন। তাতে স্থানীয়দের আদি ধর্মবিশ্বাস থেকে ইসলামে প্রবেশের পথ পরিষ্কার হয়ে গেছিল। সাধারণ মানুষ গভীর ধর্মতত্ত্ব বোঝে না, কিন্তু জিকির বা হিলিং সেরেমনির সোশাল-পারসোনাল বেনেফিটগুলি ঠিকই বোঝে। যদি সুফী ধর্মপ্রচারকরা বতসওয়ানাতে পৌঁছতেন, তাহলে খয়সান জনগোষ্ঠী গা-টা ঢেকেঢুকে খোদারসুলের নামেই জিকির করত।

অর্থাৎ মুসলিম লোকাল সংস্কৃতিগুলির ওপরের স্তরটাকে ঘষে তুলে ফেললে যেটা দেখি, সেটা অনেক প্রাচীন একটা সাবস্ট্রেট। আর পূর্ব থেকে পশ্চিমে সে সাবস্ট্রেট একই। প্রস্তরযুগের মানুষ যে অ্যানিমিস্ট শামানিজমে বিশ্বাস করত, সেটাই এই সাবস্ট্রেট। মানুষ হিসাবে আমাদের ফিজিকাল-সাইকলজিকাল ক্যারেক্টারের খুব একটা রূপান্তর হয়নি। সেই পরিচয়ে নাচগানবাদ্য এন্টারটেইনমেন্ট নয়, বরং প্রকৃতি আর আত্মাদের বশে আনার প্রচেষ্টার ম্যাজিক।

লাস্কো গুহার শিকারের চিত্র সেই একই ম্যাজিক। গুহাচিত্র অবশ্য গুহাতেই রয়ে গেছে, কিন্তু এসকল জিকির-হিলিং সেরেমনি গুহা থেকে আমাদের সাথেই বেরিয়ে এসেছে। আর এখনো বহাল তবিয়তে বেঁচে রয়েছে আমাদের ধর্ম-সংস্কৃতিতে।

গতে, গতে, পারগতে, পারসংগতে — বোধি স্বাহা!

Featured Video Play Icon

মালয়েশিয়ার এথনিক চীনা শিল্পী ইমী উইয়ের গাওয়া এ গানটি বৌদ্ধ ধর্মের সবচে’ পবিত্র মন্ত্রগুলোর একটি। এর নাম প্রজ্ঞাপারমিতাহৃদয় সূত্রম — সংস্কৃত ভাষায় যার অর্থ প্রজ্ঞার পরিপূর্ণতার অন্তঃকরণ। অর্থাৎ এ মন্ত্রের মধ্যে অন্তর্নিহিত আছে সর্বোচ্চ সত্য উদ্ঘাটনের গূঢ়তত্ত্ব।

মহাযান মতধারার বৌদ্ধধর্মে প্রজ্ঞাপারমিতার স্থান উচ্চাসনে। এ প্রসঙ্গে বলা ভাল যে, ইসলামে যেমন দু’টো বড় শাখা শিয়া ও সুন্নী, তেমন বৌদ্ধধর্মের তিনটি প্রধান ধারা বা ‘যান’ থেরবাদী, তান্ত্রিক আর মহাযানী। থেরবাদী আর মহাযানীর মধ্যে মৌলিক তেমন কোন তফাত নেই; থেরবাদকে ধরা যেতে পারে সনাতন, প্রাচীন; মহাযান অন্যান্য দেশে গিয়ে তাদের স্থানীয় আচারকে একীভূত করে নিয়েছে। বাংলাদেশ-শ্রীলংকা-মিয়ানমারসহ দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় বর্তমানে থেরবাদ প্রচলিত। চীন-ভিয়েতনাম-জাপানের মহাযান পন্থার শাস্ত্রীয় আনুষ্ঠানিকতা থেরবাদের থেকে বেশি। মহাযানী ধারার একাংশ ভূটান-তিব্বত-মোঙ্গোলিয়াতে গিয়ে সেখানকার প্রাচীন শামানিস্ট বিশ্বাসকে মিলিয়ে নিয়ে হয়ে গেছে গূঢ়তাত্ত্বিক অধ্যাত্মবাদ, যার নাম তন্ত্রযান বা বজ্রযান।

ধারণা করা হয়, প্রজ্ঞাপারমিতাসূত্রের উদ্ভব খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম শতকে। সবচে’ প্রাচীন আবিষ্কৃত নমুনাটি ৭৫ খ্রীষ্টাব্দের, এর নাম অষ্টসহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা, কারণ এতে আট হাজার পংক্তি রয়েছে। ১৭৯ খ্রীষ্টাব্দে কুষাণ সাম্রাজ্যের এক বৌদ্ধ শ্রমণ চীনা ভাষায় প্রজ্ঞাপারমিতার অনুবাদ করেন। এর আশপাশ দিয়েই ভারতবর্ষ থেকে চীনে বৌদ্ধধর্মের আগমন ঘটে। চীনের সুপরিচিত শাওলিন টেম্পলের শ্রমণরা মহাযানপন্থারই অনুসারী। আত্মসংযম চর্চার জন্যে চীনা শ্রমণরা যে ধ্যান করে, তাকে তারা ডাকে ‘চান’ বলে। জাপানে গিয়ে চান হয়ে গেছে ‘জ়েন’

বাংলায় পাল রাজবংশ ছিল মহাযান আর তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের বড় পৃষ্ঠপোষক। অষ্টম থেকে দ্বাদশ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত পালরা উত্তরপূর্ব ভারতের বিভিন্ন রাজ্য শাসন করে। বিহারের নালন্দাবিক্রমশীলা আর বাংলাদেশের নওগাঁর সোমপুর বিহার পালদের পৃষ্ঠপোষকতায় সমৃদ্ধি লাভ করে। দ্বাদশ শতকে দিল্লীর মামলুক সুলতানাতের তুর্কী সেনাপতি বখতিয়ার খিলজির আক্রমণে এসকল বিহার লুন্ঠিত-বিধ্বস্ত হয় — অবশ্য ইতিমধ্যে পালসাম্রাজ্যের অন্তিমযাত্রা শুরু হয়ে গিয়েছিল।

নালন্দা-সোমপুর ছিল অনেকটা এখনকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মত। ধর্মের পাশাপাশি সাহিত্য, বিজ্ঞান, গণিত ইত্যাদি চর্চার কেন্দ্র ছিল বিহারগুলি। পালপূর্ববর্তী গুপ্ত আর বর্ধন রাজবংশের আমলে চীন থেকে ঈ জিং, শ়ুয়ান ৎসাং, ফাশ়িয়ান — শেষ দু’জনকে আমরা চিনি ‘হিউয়েন সাং’ আর ‘ফা হিয়েন’ নামে — ভারতের এসব বিহারে এসেছিলেন সংস্কৃত শিখতে আর বৌদ্ধ সূত্রের পান্ডুলিপি সংগ্রহ করতে। তারা চীনে ফিরে সেসবের অনুবাদ করেন — প্রজ্ঞাপারমিতাও ছিল এদের মাঝে। ইন্দোনেশিয়ার শ্রীবিজয়ারাজ্যও পালযুগে নালন্দায় বিহারস্থাপনের জন্যে অর্থ যোগান দেয়।

পালদের যুগেই বাংলা ভাষার আদিরূপ আবির্ভাব হওয়া শুরু করে। প্রাচীন বাংলার প্রথম নিদর্শন চর্যাপদ তান্ত্রিক বৌদ্ধ অধ্যাত্মবাদের অমূল্য সাহিত্যকর্ম। ঢাকার বিক্রমপুরের সন্তান অতীশ দীপংকর মহাযান-বজ্রযান পন্থার বিস্তারের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন। ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রায় অধ্যয়নের পরে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্যে তিব্বতের রাজার অনুরোধে সেদেশে যান অতীশ। তিব্বতী তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মে তিনি এখনও সম্মানের আসনে অধিষ্ট। ২০০৩এ সোমপুর বিহার দেখতে গিয়েছিলাম যখন, তখন এই ভেবে গায়ে শিহরণ হয়েছিল যে, সাড়ে আটশ’ বছর পূর্বে সেখানের সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামা করতেন অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান, আর হয়ত প্রাচীন বাংলাতেই তাঁর কথোপকথন হত সঙ্গী-সাথীদের সাথে! এখনো জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে প্রচুর বৌদ্ধ পর্যটক এসকল বিহারে তীর্থযাত্রায় আসেন।

প্রজ্ঞাপারমিতা বর্তমানযুগে ‘ধারণী’ মন্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ এ মন্ত্র যে পাঠ করবে — সে অর্থ বুঝুক বা নাই বুঝুক — অমঙ্গল তাকে স্পর্শ করবে না। অনেকটা যেমন আমাদের দেশী সরল ধার্মিক মানুষ অর্থ না জেনে সূরা-দোয়া মুখস্ত করেন আর সোচ্চারে পাঠ করেন। বলতে পারেন, পালযুগে আমরা একই কাজ করতাম বৌদ্ধমন্ত্র নিয়ে। অর্থাৎ আমাদের ধর্মচর্চাপদ্ধতির খুব একটা পরিবর্তন হয়নি! চীনা-জাপানীদের বৌদ্ধধর্মের সেই একই দশা! তারা সংস্কৃত শব্দোচ্চারণের স্বদেশী রূপ দিয়ে প্রজ্ঞাপারমিতা আবৃত্তি করে — অথচ উচ্চারিত শব্দগুলোর কোন সত্যিকার অর্থ তাদের ভাষাতে নেই!

আনুষ্ঠানিকতার জাল ভেদ করে প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্রের মূল বিষয়বস্তুটা বুঝানোর চেষ্টা করি। এতে বুদ্ধশিষ্য, গৌতমের অন্যতম সাথী, শারিপুত্রের সাথে কথোপকথন হচ্ছে অবলোকিতেশ্বরের। অবলোকিতেশ্বর হচ্ছেন গৌতমের নির্বাণপরবর্তীযুগে পুনর্জন্ম হয়ে আসা বর্তমানযুগের বোধিসত্ত্ব। সংসারের জাল ছিন্ন করে বোধিপ্রাপ্ত হলেও অন্যান্য প্রাণীর প্রতি দয়াপরবশ হয়ে পরিনির্বাণ গ্রহণ না করে ফিরে ফিরে আসেন ধর্মদীক্ষাদানের জন্যে, যাতে অন্যেও তাঁর শিক্ষা নিয়ে বোধি বা সত্যের সন্ধান পেতে পারে।

শারিপুত্রকে অবলোকিতেশ্বর শেখাচ্ছেন মোক্ষলাভের মূলমন্ত্র: সকল বস্তু, ভাবের অস্তিত্বের সাথে তাদের অনস্তিত্ত্বের কোন পার্থক্য নেই! দ্বিতীয় বুদ্ধ বলে পরিচিত বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুনের শূন্যতাবাদের তত্ত্বে এই চিন্তা পরিপূর্ণতা পেয়েছে। এ তত্ত্ব লিখে বা বলে বোঝানো খুব কঠিন! মনোভাবটা জাগ্রত করতে হলে চাই কঠোর সাধনা। সোজা ভাষায় যদি বোঝাতে চেষ্টা করি, তাহলে এটুকুই বলতে পারি যে, সকল দুঃখ থেকে মুক্তিলাভের উপায় এটা অন্তরের অন্তস্তলে অনুভব করা যে, কোন কিছুর অস্তিত্ত্ব আছে বলেই আমরা তার অনস্তিত্ত্ব বা অভাব বোধ করি। দুঃখজরার মূল প্রথিত সেই জ্ঞানের মধ্যেই। যদি মোহমুক্তি পেতে চাই তাহলে আত্মপরিচয় বা ইগোকে পরিত্যাগ করতে হবে, মিলিয়ে দিতে হবে শূন্যতার মাঝে, যেখানে বস্তু বা ভাবের অনস্তিত্ত্ব আর অস্তিত্ত্বের উপলব্ধির মাঝে কোন ফারাক নেই। দুঃখ থেকে মুক্তি সে পথেই।

এটা অন্য ধর্মদর্শনের মাধ্যমে বোঝানোটা মনে হয় খুব বেশি কঠিন নয়। ইসলামের সুফী মতের সাথে তুলনা করে দেখতে পারেন। সেখানে খোদাপ্রেমের মদে মত্ত মানুষ নশ্বরতার পরিধি পেরিয়ে হতে চায় স্রষ্টার সাথে একাত্ম। হাদীসের ভাষায় ‘মৃত্যুর পূর্বেই মৃত্যুবরণ করা’! কিংবা চেষ্টাচরিত্রের পরে মন্দভাল যাই ফল হোক না কেন, তাকে গ্রহণ করে কৃতজ্ঞ হওয়া। খুব একটা তফাত নেই প্রজ্ঞাপারমিতার থেকে। বাউলিয়ানার ওপরেও  বৌদ্ধ দর্শনের কিছুটা প্রভাব এক সময় পড়েছিল।

বিজ্ঞানভিত্তিক দর্শন বা নাস্তিক যুক্তিবাদী দর্শনের দিকে যদি চোখ ফেরাই তাহলেও এ ধরনের চিন্তাধারা রয়েছে। ঊনবিংশ শতকে আর্থার শপেনহাওয়ার তাঁর ‘দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যাজ় উইল অ্যান্ড রিপ্রেজ়েন্টেশন’ বইটিতে অস্তিত্ত্বের উপলব্ধিকে তুলে ধরেছেন মানুষের প্রবল ইচ্ছাশক্তির চূড়ান্ত অভিব্যক্তি হিসাবে। যদিও শপেনহাওয়ার বৌদ্ধ দর্শনের সাথে পরিচিত ছিলেন আর সেখান থেকেই অনুপ্রেরণা পান, তাঁর ব্যাখ্যা বৌদ্ধ চিন্তাধারার অনেকটা বিকৃত পশ্চিমা সংস্করণ । শপেনহাওয়ার পক্ষান্তরে অনুপ্রেরণা যোগান আধুনিক যুগের আরো অনেক দার্শনিক, লেখক ও বৈজ্ঞানিককে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ফ্রয়ড, আইনস্টাইন, য়্যুঙ, মপাসঁ, নয়মান, নিচা, শ্রয়ডিঙার, তলস্তয়, ভ়াগনার — আর নোবেলজয়ী ঔপন্যাসিক হেরমান হেসা!

এই হেরমান হেসার ‘সিদ্ধার্থ’ উপন্যাসটি আমার তরুণ বয়সে পড়া, আমার পরবর্তী চিন্তাভাবনার উপর এর প্রভাব অপরিসীম। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বেশ ভাল একটা বাংলা অনুবাদ পড়েছিলাম, পরে ইংরেজী দু’টি আলাদা অনুবাদও। এই অসাধারণ কাহিনীতে গৌতম নয়, সিদ্ধার্থ বলে আরেক সমসাময়িক কল্পিত রাজকুমারের জীবনের বিভিন্ন পর্যায় অবলোকন করতে পারবেন — তাঁর মনোবেদনা, মোক্ষলাভের সংগ্রাম, শ্রমণজীবন, ‘মধ্যপন্থার’ আবিষ্কার, সংসারে মনোনিবেশ, গৌতমবুদ্ধের সাথে মোলাকাত, শেষ পর্যন্ত নদীপারাপারের তরীচালক হিসাবে তাঁর অহমলোপ আর বোধিপ্রাপ্তি।

হেসা খুবই নিখুঁতভাবেই মহাযান বৌদ্ধ দর্শনের প্রজ্ঞাপারমিতা তত্ত্ব তুলে ধরেছেন। সে তত্ত্বে বোধিলাভের জন্যে থেরবাদের অন্তর্মুখী সাধনার আবশ্যকীয়তা নেই, জাগতিক সুখদুঃখের অনুভূতি অক্ষত রেখেই শূন্যতার উপলব্ধি অর্জন করা সম্ভব। অর্থাৎ আমি-আপনি যে জাগতিক অবস্থাতেই থাকি না কেন, কিছু মৌলিক সত্যের ওপর মনোনিবেশ করলে অহমের বিলোপ, মনের দ্বন্দ্বগুলি প্রশমন করে দুঃখজরার বিনাশসাধন অসাধ্য নয়।

মনে হয় পাঠক ইতিমধ্যে আন্দাজ করতে পারছেন সব ধর্মের একটা মৌলিক গুণ মানসিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতগুলির নিরসন করে শান্তিতে বিরাজমান হওয়ার পথ বাতলানো। মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এব্রাহাম ম্যাজ়লো বলে এক মনস্তত্ত্ববিদ মানবিক চাহিদার খুঁটিনাটি গবেষণা করেছেন। তাঁর শ্রেণীবিভাগের সর্বনিম্ন স্তরে রয়েছে দৈহিক চাহিদা, তার পরে নিরাপত্তা, তৃতীয়ত প্রেম-ভালোবাসা বা কোন জাতিগোত্রের সাথে একাত্মতার চাহিদা, চতুর্থত শ্রদ্ধা-মর্যাদার চাহিদা, আর সর্বোচ্চ স্তরের নাম দিলেন সেল্ফ়-অ্যাকচুয়ালাইজ়েশন। প্রথম চারটি স্তর অতিক্রম করে মানুষ শেষ স্তরে এসে চায় স্বপরিচয়ে, স্বপেশায় পারফ়েকশন বা পূর্ণতাপ্রাপ্তি। বৌদ্ধ দর্শনে এটা অহম বা ইগোর সর্বোচ্চ রূপ।

ম্যাজ়লো পরে আরো একটি পর্যায় যোগ করেন যার নাম দেন ট্রানসেন্ডেন্স বা স্ব-কে অতিক্রম করা। বৌদ্ধ দর্শনে এটাই অহমের বিলোপ, নিজের থেকে বেশি কিছু হয়ে ওঠা, শূন্যতা!

এপর্যায়ে এসে প্রজ্ঞাপারমিতার শেষ পংক্তি অনুযায়ী আপনি ‘গতে, গতে, পারগতে, পারসংগতে — বোধি স্বাহা!’ — নদীর অপরপারে! স্নান করছেন বোধির আলোকচ্ছটায়! তবে তাই হোক!

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!