ভারতীয় ভক্তিবাদ – ২

Featured Video Play Icon

মধুর সুর বোল রে কাগা, মীরা রো মন রাম সে লাগা — ষোড়শ শতকের ভারতীয় ভক্তিবাদের অন্যতম পথিকৃত মীরাবাঈয়ের রাজস্থানী ভজন। রাম এখানে ভগবানের নাম, আদতে শ্রীকৃষ্ণ। রাম-কৃষ্ণ উভয়েই ভগবান বিষ্ণুর অবতার।

মীরাবাঈ কৃষ্ণের প্রেমে মত্ত। তার এই বার্তার বাহক কাক — কাকের কর্কশ কন্ঠ কিভাবে মধুর হয় সেটা বুঝতে হয়ত আবার উলটপুরাণ ঘাঁটতে হবে! কৃষ্ণের প্রেমে মজাটাও এখানে আধ্যাত্মিক। মাওলানা রূমী যখন বলেন, আমি তোমার প্রেমে মত্ত হতে চা‌ই নীরবতায়, কারণ নীরবতায় নেই কোন প্রত্যাখ্যান — তখন তাতে সেই একই একতরফা প্রেম-ভক্তি ধরা পড়ে। এই প্রেম ঈশ্বরের সাথে ভক্তের।

কাওয়ালীতে যেমন প্রথমে একজন একটা লাইন গাওয়ার পর বাকিরা একসাথে তার জবাব দেয়, কীর্তনে ঠিক একই রকম কল এন্ড রেসপন্স রয়েছে। এসব ভজন-কীর্তন ভারতবর্ষে নতুন নয়। কীর্তনের উল্লেখ বেদে পর্যন্ত আছে। আর ষষ্ঠ-সপ্তম শতকে দক্ষিণ ভারত থেকে এই বৈষ্ণব-শৈব ভক্তিবাদ ধীরে ধীরে উত্তর ও পূর্ব ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। শুধু হিন্দু ধর্ম নয়, জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের ওপরও ভক্তিবাদ ও আধ্যাত্মিকতাবাদের একটা প্রভাব শুরু হয়, তাদেরও ভজন-কীর্তন রয়েছে।

তবে দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে ভারতে ইসলাম আসার সাথে সাথে ‌অনেক কিছু উল্টেপাল্টে যেতে থাকে। ইসলামে যে নিয়মিত দৈনিক প্রার্থনা, আর কোন যজ্ঞ বা নৈবেদ্যের ঝামেলা নেই, অর্থাৎ ঈশ্বরের সাথে একটা ব্যক্তিগত সম্পর্ক, এ ব্যাপারটা সম্ভবত হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মকে প্রভাবিত করে। আগের রিচুয়ালভিত্তিক মন্দির ও ব্রাহ্মণ্যকেন্দ্রিক ধর্মচর্চাকে টিকিয়ে রাখতে ভারতের জবাব হয় ঐ ভক্তিবাদ। তাতে মন্দির অপরিহার্য নয়। ভারতের সব মন্দির নতুন তুর্কী মুসলিম শাসকরা ধ্বংস করে ফেললেও ভক্তের মনের দৃঢ় নিষ্ঠা বিলুপ্ত করার সামর্থ্য তাদের নেই। অর্থাৎ কঠিন একটা সময়ে ভক্তিবাদের মাধ্যমে নতুন বাস্তবতার সাথে খাঁপ খাইয়ে নেয় ভারতীয় দর্শনগুলি।

মীরাবাঈ পঞ্চদশ শতকে একই রকম বাস্তবতার সম্মুখীন। মুসলিম-হিন্দু সংঘাত হয় যুদ্ধক্ষেত্রে নয়ত অন্য কোনভাবে দৃশ্যমান। দিল্লী সুলতানাত আফগানদের থেকে হাত বদলে এসেছে মুঘলদের হাতে। আগের শত্রুতা-মিত্রতার সম্পর্কগুলি পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। রাজপুত এলিট পরিবারের মীরাবাঈ সেসবের প্রতক্ষ্য সাক্ষী। হয়ত এসব চ্যালেঞ্জের মুখে তার কৃষ্ণভক্তি তাকে অবিচল থাকতে সাহায্য করেছে।

মীরাবাঈয়ের পাশাপাশি আরো বহু সন্ত-সাধক এ সময়ে ভক্তিবাদের চর্চা করেন। শিখ গুরু নানক একই সময়ের, একই ঘরানার। নবদ্বীপের শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু আর বৈষ্ণব পদাবলী বৈষ্ণবভক্তির বঙ্গীয় নমুনা। রাধা-কৃষ্ণের লীলা এদের জন্যে ঈশ্বরপ্রেম কিংবা আধ্যাত্মিকতার রূপক মাত্র। আবার গীতায় অর্জুন-শ্রীকৃষ্ণের যে গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক, তার সমান্তরাল ধরতে পারি শামসে তাব্রিজি আর মাওলানা রূমির পীর-মুর্শিদ সম্পর্ক, কিংবা নিজামুদ্দিন আউলিয়ার সাথে আমীর খসরুর সম্পর্ক। শুধু তফাত হল শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং বিষ্ণুর অবতার।

ইসলামী ভক্তিবাদের কাওয়ালী সঙ্গীতের সাথে একটা দৃশ্যমান পার্থক্য চোখে পড়ে এই ভজনের। সেটা হল মঞ্জিরা-করতালের ব্যবহার। মঞ্জিরা বাদ্যযন্ত্রটি আসলে বহু আদিকাল থেকে পাগান ধর্মগুলির সবটিতে ব্যবহৃত হয়েছে। সেটা তো হিন্দু ও রোমান পাগান মন্দিরে ব্যবহার হয়েছেই, ইসলামপূর্ব আরব পাগানরাও ব্যবহার করে থাকলে অবাক হব না। হয়ত সেকারণে করতালে আদিকাল থেকে মুসলিমদের অ্যালার্জি, আর ভজন-কীর্তন থেকে কাওয়ালীতে আসার পথে সেটি গায়েব হয়ে গেছে।

হিন্দু-মুসলিম সংঘাত যে ভারতবর্ষে বিভাজন তৈরির ব্রিটিশদের অধুনা পন্থা তা নয়, অতীত ঘাঁটালে বহু উদাহরণ চোখে পড়বে। তার প্রতিক্রিয়া হিসাবে মীরাবাঈয়ের আগের শতকেই আরেক ভক্তিবাদী সাধক কবির বহু ভজন লিখে গেছেন। তাতে উভয় ধর্মকেই প্রত্যাখ্যান করে সাধারণ মানুষের বোধগম্য সরল এক পন্থা উঠে এসেছে। তৃতীয় ‌অনুখন্ডে তার একটা উদাহরণ দিয়ে শেষ করব।

ভারতীয় ভক্তিবাদ – ১

Featured Video Play Icon

নুসরাত ফতেহ আলী খান আর তার ভাতিজা রাহাত বলিউডের মাধ্যমে খ্যাতির শীর্ষে উঠে আসলেও তাদের মূলধারা সুফী ভক্তিবাদী কাওয়ালী গান।

ভক্তিবাদের কথা উঠলে বাংলার সবাই বাউল গান চেনে। কিন্তু পুরো উপমহাদেশে ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে আছে নানারকম ভক্তিমূলক সাধনার গান। কাওয়ালী তার অন্যতম, যদিও বোধ করি ধর্মের সীমানা অতিক্রম করে খুব কম মানুষই এসব ভক্তিবাদকে একই ছায়াতলে দেখার চেষ্টা করবে।

গত রাতে নুসরাত ফতেহ আলীর সুদীর্ঘ হাক্ব আলী, আলী মওলা গানটা কয়েকবার মনোযোগ দিয়ে শুনতে শুনতে চলে গেলাম মীরাবাঈএর রাজস্থানী ভজনে, সেখান থেকে কবিরের নাথপন্থী না-হিন্দু না-মুসলিম পপুলিস্ট প্রাতিষ্ঠানিকতাবিরোধী ভজনে। এসব মিলিয়ে তিনটা অনুখন্ড লিখতে ইচ্ছে হল।

উত্তর ভারতে ইসলামের আগমনের সাথে সাথে বহু পারসিক-তুর্কী মুসলিম কর্মচারী ও সেনাপতি ভারতে আসেন। এদের সেকেন্ড থার্ড জেনারেশনের বংশধররা আমাদের মত অধুনা ইমিগ্র্যান্টদের স্টাইলে স্থানীয় ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে তাদের জাতিগত ঐতিহ্যের মিলন ঘটিয়ে জন্ম দেন নতুন এক সঙ্গীত ঘরানার, যার নাম হিন্দুস্তানী। আর দক্ষিণ ভারতের কর্নাটী সঙ্গীতে তখনও চলতে থাকে আদি ঘরানার ধারাবাহিকতা।

উত্তর ভারতের এই সুরকারদের মধ্যে সবচে অগ্রগণ্য আমীর খসরু। নিজামুদ্দিন আউলিয়ার সান্নিধ্যে সুফী ভক্তিবাদে শিক্ষা পান তিনি। প্রাচীন ভারতীয় সুরকলাকে সংস্কার করে নতুন রূপ দেন আমীর খসরু। এই কাওয়ালীর সুর ও বিষয়বস্তুর ঐতিহ্য আমীর খসরু পর্যন্ত ট্রেস করা যায়।

আলী মওলা গানটার মূল প্রতিপাদ্য ইসলামের অন্যতম হিরো হযরত আলীর গুণকীর্তন। এটা মূল ধারার সুন্নী ঐতিহ্যের সাথে খুব একটা যায় না। অর্থডক্স ইসলামে মানুষ হিসাবে যদি কাউকে অনুসরণ করা কর্তব্য সে একমাত্র হযরত মুহাম্মদ(সা)।

কিন্তু ইরানী জোরোয়াস্ত্রিয়ান ও শিয়া প্রভাবে হিরো ওয়ারশিপের যে ইন্দোআর্য ট্রাডিশন (তুলনা করুন শাহনামা-রামায়ণ-মহাভারতের সাথে), সেটা চলে এসেছে ভারতীয় ফোক ইসলামে। শিয়া ঐতিহ্য অনুযায়ী হযরত মুহাম্মদ(সা) নাকি গাদির খুম বলে বিদায়হজ্জ্বপরবর্তী এক ভাষণে সরাসরি আলীকে তার উত্তরাধিকারী ঘোষণা করে বলেন, যে কেউ আমাকে যদি মাওলা মানে, সে আলীকেও মাওলা মানে। মাওলা শব্দের অর্থ নিয়ে বহু বিতর্ক আছে। কিন্তু সুফী সাধনার পরিপ্রেক্ষিতে মাওলা মানে ধরতে পারি ইন্টারসেসর — অর্থাৎ যার কিনা উচ্চতর দৈব শক্তির কাছে কারো পক্ষে সুপারিশের ক্ষমতা রয়েছে।

অপরদিকে ইসলামী সাম্রাজ্যের চতুর্থ খলীফা হিসাবে আলী শক্তিরও একটি প্রতীক। তার তরবারি জুলফিকার খোদা-রাসুলের আশীর্বাদমন্ডিত, কিন্তু অত্যাচারী নয়, ন্যায়বিচারী। সেই লাইন ধরে আলী শেরে-ইয়াজদান — খোদার সিংহ। উল্লেখ্য, ইয়াজদান শব্দটা আরবী নয়, পুরনো ফারসীতে জোরোয়াস্ত্রিয়ান দেবতাদের নাম ছিল ‘ইয়াজাতা’। সেখান থেকে ইয়াজদান=খোদা।

তো এই গানটিতে ঘুরে ফিরে আলী, তার শক্তিমহিমা ও আধ্যাত্মিক গরিমার গুণকীর্তন হচ্ছে। পারসিককৃত ভারতীয় রাগ-সুরের ব্যবহারের পাশাপাশি কখনো কখনো ধুম-তানানা ধরনের অর্থহীন শব্দ ব্যবহার করে তাল দেয়া হচ্ছে। হয়তবা শব্দগুলোর লুক্বায়িত কোন অর্থ আছে, নয়ত সেগুলি আলীভক্ত শ্রোতার মনে একটা ইনটক্সিকেশন কিংবা ফানা তৈরির সহায়ক।

যারা নুসরাত ফতেহ আলীর গান বা কাওয়ালী পছন্দ করেন, তারা অবাক হতে পারেন যদি বলি কাওয়ালী আসলে ভারতীয় কীর্তন-ভজনের ঐতিহ্যেরই একটা এক্সটেনশন। দ্বিতীয় পর্বে দেব মীরাবাঈয়ের সেরকম একটা ভক্তির গান

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!