সুফী জিকির

তিনারিওয়েন বলে মালির একটা ব্যান্ড আমার বেশ পছন্দ। ২০১০এ ফিফা বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এরা গান করেছিল। পশ্চিম আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ মিউজিকাল ট্রাডিশনেই অধিকাংশ মার্কিন জনরের উৎপত্তি।

তিনারিওয়েনের সদস্যরা অবশ্য কালো নয়, তারা বেরবের বা তুয়ারেগ নামক একটি মিশ্র জাতের। ইউরোপীয় বা মেডিটেরানিয়ান জনগোষ্ঠীতে প্রাচীন বেরবের জিন রয়েছে। অর্থাৎ প্রাগৈতিহাসিক ইউরোপকে জনধ্যুষিত করেছিল এদের পূর্বপুরুষদের একটি অংশ।

আলহাসান আগ তুহামি বলে তিনারিওয়েনের এক গায়ক অদ্ভূত এক চরিত্র। নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে লম্ফজম্প দিয়ে দর্শকদের মাতিয়ে রাখে। কখনো মনে হয়, সেই করতে করতে ঘোরের মধ্যে চলে গেছে আলহাসান।

ভদ্রলোকের সাথে ঠিক এক বছর আগে একটা কনসার্টে মোলাকাত হয়, ফরাসীতে কিছু বাতচিতও চলে। এথনিক মিউজিকে আগ্রহ থাকাতে এধরনের কনসার্টের সুযোগ মিললে হাতছাড়া করি না।

আলহাসান আর তার সঙ্গীরা কৃষ্ণাঙ্গপ্রধান মালিতে স্বজাতির স্বাধীনতার জন্যে প্রথমে অস্ত্র ধরেছিল, পরে গীটার। ছোটবেলা কেটেছে রেফ্যুজি ক্যাম্পগুলিতে। চাদ নামের একটি দেশে গন্ডগোল পাকাতেও লিবিয়ার গাদ্দাফি এদেরকে ব্যবহার করে।

মালির কৃষ্ণাঙ্গদের মত তুয়ারেগরাও মুসলিম। কিন্তু আরবদের সাথে তাদের ভাষা-কালচার মেলে বেশি। আরব দিগ্বিজয়ের যুগে তুয়ারেগরা ‘মাওয়ালি’ বা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন সামরিক অভিযানে উমাইয়্যা খেলাফতকে সহায়তা করে। তাদের একজন তারেক ইবনে জিয়াদ, স্পেন অভিযানের সফল সেনানায়ক। অবশ্য উত্তর আফ্রিকার অধিকাংশ জনগণ তখনও মুসলিম হয়নি। সেটি হয়েছে অনেক পরে। আমাদের দেশের মতই সুফী সাধকদের সংস্পর্শে এসে।

আলহাসান যে গানের তালে তালে তিড়িংবিড়িং লাফ দিয়ে ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছে, এটাও আসলে তাদের সুফী ঘরানার একটা ব্যাপার। রুমির ‌অনুসারী তুর্কী-ইরানী মাওলানা সেক্ট যেমন সেমা নৃত্য করে ঈশ্বরের নিকটবর্তী হবার প্রচেষ্টায়, সেরকম উত্তর আফ্রিকার সুফীরাও গানবাজনার তালে তালে শরীর দোলানোর মাধ্যমে ‘ফানা’ বা সেল্ফ-অ্যানাইহিলেশনের একটা অনুভূতির জগতে চলে যায়।

তিনারিওয়েনের আলহাসানের তিড়িংবিড়িং

 

মরক্কোর গানাওয়া সুফী সেক্টটির সদস্যদেরও ফেজ-মারাকেশ-এসাউইয়া শহরের রাস্তাঘাটে কারাকেব নামের করতাল আর সিন্তির বাদ্যযন্ত্র নিয়ে সম্মোহনী ট্র্যান্স মিউজিক করতে দেখা যায়। বাদ্যের সাথে তারা মাথাটিকে এমনভাবে দোলায় যাতে ফেজটুপির টিকলিটি সমানে ঘুরতে থাকে। বলা বাহুল্য, এরও লক্ষ্য ট্র্যান্স বা মন্ত্রাচ্ছন্ন অবস্থায় পৌঁছনো, যেটাকে রুমির মত কবিরা বলেছেন খোদাপ্রেমের মদে মাতাল হওয়া।

মরক্কোর গানাওয়া সুফী মিউজিক

সুফী তরিকাগুলির এধরনের রিচুয়ালের ধর্মীয় ভিত্তি জিকর বা খোদাকে স্মরণ করা। মূলধারাতে জিকির ফরজ নয়, কিন্তু আমাদের দেশের মুসলিম কেউ যদি কখনো জিকিরে অংশ না নিয়ে থাকে তাহলে অবাক হবো। এ প্রক্রিয়ায় আলো-আঁধারিতে একদল মানুষ জোরে জোরে আল্লাহর বিভিন্ন নাম পাঠ করতে থাকে। কখনো নবীজীর প্রশংসাসূচক দরূদ। কখনো সাধু-সন্ত-সাহাবীদের নাম। পুরো ব্যাপারটিতে একটা আধ্যাত্মিক অনুভূতি আসে, যেটা মনপ্রাণকে হাল্কা করে দেয়। মূলধারায় অবশ্যই নামাজ-রোজার গুরুত্ব জিকিরের থেকে ‌অনেক বেশি।

কিন্তু সুফীদের মধ্যে জিকিরের গুরুত্ব পঞ্চস্তম্ভের সমপরিমাণ। ভারতীয় উপমহাদেশের বাউল-কাওয়ালী-ধামাল এগুলির কথা না হয় না বললাম। সাবসাহারান আফ্রিকার নাইজেরিয়া, সুদান, সোমালিয়া — এসব দেশগুলিতেও তিড়িংবিড়িংকরা সুফী দলের দেখা মেলে। মিশরে রয়েছে মাওলানাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত তান্নুর। সিরিয়া আর আরবের অন্যান্য স্থানে সেমার পাশাপাশি চলে হাধরা। সেখানে কালিমা-দরূদ-জিকিরের সঙ্গত হয় দারবুকা-ড্রাম, কখনো নে নামক তুর্কী বাঁশি। মাথায় পাগড়ি আঁটা শ্মশ্রুমন্ডিত সুফীরা তার তালে তালে শরীর সামনে পিছে করে।

তুরস্কের সেমা

নাইজেরিয়ার কানোর তিড়িংবিড়িং জিকির

সিরিয়ার নকশবন্দী হাধরা

 

সিরিয়ার আলেভী সেমা আরেক অদ্ভূত জিনিস। শিয়া মিস্টিক এ গ্রুপটা সেদেশে সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। এদের ছেলে ও মেয়েরা একসাথে সেমা নৃত্যে অংশ নেয়। জিকির চলে আলী ও অন্যান্য শিয়া সন্তদের নামে। কুর্দীসমাজেও একইরকম মহিলা-পুরুষ মিশ্রিত সেমা করে থাকে। ইরাকের কুর্দী নারী যোদ্ধাদের ছবি খবরে প্রায় আসে। এদের জেন্ডার রোল বহু হাজার বছর ধরে সমানুপাতিক।

সিরিয়া-তুরস্কের আলেভী সেমা

ককেশাসের রুশ প্রজাতন্ত্র চেচনিয়া ও ইঙ্গুশেতিয়ার মানুষও মূলত সুফী মুসলিম। এদের জিকির আতা’য়ী দেখলে মূলধারার মুসলিমরা মূর্ছা যাবে। কলেমা পড়তে পড়তে দু’স্তরে গোল হয়ে দাঁড়ানো মানুষগুলি ড্রামের তালে বানরের মত দু’পায়ে লাফায়, আর হাতে তালি দেয়। মাঝে দলনেতার ইঙ্গিত অনুযায়ী চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। সে ঘোরার দ্রুততা কখনো বাড়ে, কখনো কমে। কারো কিন্তু ছন্দপতন নেই, পুরো দলটি যেন হয়ে গেছে একটিমাত্র দেহ। চেচেন মহিলারাও ভিতরঘরে বসে আলাদা জিকির করে।

চেচনিয়ার জিকির আতা’য়ী

সুফীদের ছোঁয়া কিন্তু পূর্বে বাংলাদেশে এসে শেষ হয়নি। ইন্দোনেশিয়া ও চীনে কখনো কোন মুসলিম সৈনিক পদার্পণ করেনি। সেসকল স্থানে ইসলাম গেছে সুফী মতবিশ্বাসের ওপর ভর করে। বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে এরাও জিকিরে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যায়।

ইন্দোনেশিয়ার সুফী দরূদ-জিকির

চীনের সুফী জিকির

 

বিশ্বের অন্যান্য অনেক ধর্মেও আধ্যাত্মিকতাবাদ রয়েছে। খ্রীষ্টানধর্মের উৎপত্তিই গ্নস্টিক আর ডায়োনাইসিয়ান মিস্টিসিজমের মধ্যে। ইহুদীদের রয়েছে কাবালা। তিব্বতী তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মে মন্ত্রপাঠ আর ভূত তাড়ানোর নাচের মধ্যে একই বিষয়। বর্তমানকালের খ্রীষ্টান ইভানজেলিস্ট অনেক গ্রুপকেও দেখা যায় নাচগান করতে করতে একটা একস্ট্যাটিক স্টেটের মধ্যে চলে যায়। তাতে নাকি ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীও সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরে। সত্যমিথ্যা বলা মুশকিল।

যাই হোক, অন্য ধর্মের আধ্যাত্মিকতাবাদে সুফী জিকিরের কোন সমান্তরাল খুঁজে পেলাম না। একমাত্র যেটার সাথে মিলল তা হলো নামিবিয়া-বতসওয়ানার বুশম্যান বা খয়সান জনগোষ্ঠীর হিলিং সেরেমনি। এরা বহু প্রাচীন এক জাত। ইউরোপীয়দের সংস্পর্শে আসার আগে এরা হাজার বছর ধরে প্রস্তর যুগেই আটকে ছিল। এদের ধর্মবিশ্বাস অ্যানিমিস্ট, অর্থাৎ প্রকৃতির বিভিন্ন বস্তু-প্রাণীর স্পিরিট আর পূর্বপুরুষদের আত্মার শক্তিতে এরা বিশ্বাসী। ট্রাইবের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে ভূত তাড়ানোর হিলিং সেরেমনি হয়। সেখানে এরা লাইন ধরে মাটিতে পদাঘাত করতে করতে মন্ত্রপাঠ করে। তাদের নেতৃত্ব দেয় মেডিসিনম্যান বা শামান। মন্ত্রপাঠ করতে করতে একসময় ঘোরের মধ্যে চলে যায় শামান। তার মুখ থেকে তখন অবোধ্য সব কথা বের হতে থাকে। সারারাত এরকম অনুষ্ঠানের পরদিন অসুস্থ ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলে বলে সে সুস্থ হয়ে গেছে।

নামিবিয়ার খয়সান হীলিং সেরেমনি

‌একইরকম ব্যাপার আলাস্কা-আমেরিকার নেটিভদের কালচারে রয়েছে। উদ্দেশ্য একই, হীলিং।

এটা অবাক করার মত ব্যাপার নয়। মানুষ দলগতভাবে হাজার হাজার বছর ধরে এ ধরনের রিচুয়াল করে আসছে। গ্রুপ সাজেশনের মত একটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার এর মধ্যে আছে। মুসলিম জিকির নিয়ে গবেষণা করা বিজ্ঞানীরা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করেছেন যে, জিকিররত মানুষদের হৃদস্পন্দন একে অপরের সাথে সিনক্রনাইজড হয়ে যায়। এক সাথে উত্থানপতন হয়। পুরো এক্সপেরিয়েন্সটা থেকে একটা পরিপূর্ণতা নিয়ে ফেরে অংশগ্রহণকারীরা। অর্থাৎ এর থেরাপিউটিক একটা ভ্যালু রয়েছে। এটাকেই হয়ত রুমির মত সুফীরা বলেছেন ডিভাইন ইনটক্সিকেশন।

সুফীদের এসব নাচগানবাদ্য অবশ্য মূলধারার অনেকের যেমন পছন্দ নয়, তেমন প্রগতিশীলদেরও নয়। বিশের দশকে তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক আইন করে সুফী অনেক দরগা বন্ধ করে দেন। কারণ তারা নাকি পশ্চাদমুখী। শুধু পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্যে বেঁচে থাকে সেমা সেরেমনি। বর্তমানকালের সৌদী-সালাফীদেরও এসব অপছন্দ। সে ধারাটির পয়সা ঢালার কারণে যেসব দেশে সুফী ইসলাম ছিল মূলধারা, তারা এখন কোনঠাঁষা হয়ে গেছে। ব্যাপারটা ইন্দোনেশিয়া থেকে মরক্কো পর্যন্ত সত্য। তবে কুরআন-হাদীসে এ ভাবে জিকির করার কোন ইনস্ট্রাকশন আসলেই নেই।

যেভাবে এসকল রীতি রিজিওনাল ইসলামে এসেছে, তাকে বলে সিনক্রেটিজম। ধর্মপ্রচারকরা দেশে দেশে গিয়ে একটা কমন থীম বের করে সেটার ইসলামীকরণ করেছেন। তাতে স্থানীয়দের আদি ধর্মবিশ্বাস থেকে ইসলামে প্রবেশের পথ পরিষ্কার হয়ে গেছিল। সাধারণ মানুষ গভীর ধর্মতত্ত্ব বোঝে না, কিন্তু জিকির বা হিলিং সেরেমনির সোশাল-পারসোনাল বেনেফিটগুলি ঠিকই বোঝে। যদি সুফী ধর্মপ্রচারকরা বতসওয়ানাতে পৌঁছতেন, তাহলে খয়সান জনগোষ্ঠী গা-টা ঢেকেঢুকে খোদারসুলের নামেই জিকির করত।

অর্থাৎ মুসলিম লোকাল সংস্কৃতিগুলির ওপরের স্তরটাকে ঘষে তুলে ফেললে যেটা দেখি, সেটা অনেক প্রাচীন একটা সাবস্ট্রেট। আর পূর্ব থেকে পশ্চিমে সে সাবস্ট্রেট একই। প্রস্তরযুগের মানুষ যে অ্যানিমিস্ট শামানিজমে বিশ্বাস করত, সেটাই এই সাবস্ট্রেট। মানুষ হিসাবে আমাদের ফিজিকাল-সাইকলজিকাল ক্যারেক্টারের খুব একটা রূপান্তর হয়নি। সেই পরিচয়ে নাচগানবাদ্য এন্টারটেইনমেন্ট নয়, বরং প্রকৃতি আর আত্মাদের বশে আনার প্রচেষ্টার ম্যাজিক।

লাস্কো গুহার শিকারের চিত্র সেই একই ম্যাজিক। গুহাচিত্র অবশ্য গুহাতেই রয়ে গেছে, কিন্তু এসকল জিকির-হিলিং সেরেমনি গুহা থেকে আমাদের সাথেই বেরিয়ে এসেছে। আর এখনো বহাল তবিয়তে বেঁচে রয়েছে আমাদের ধর্ম-সংস্কৃতিতে।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!