লাইবেরিয়া – ২, কলোনাইজেশন, ১৮২০-১৮৪০

আফ্রিকায় দ্বিতীয় জাহাজ পাঠানোর আগেই পল কাফির মৃত্যু হয় ১৮১৭ সালে। তার পর কৃষ্ণাঙ্গ অভিবাসনের কল্যাণ প্রকল্প শুরু করে ১৮১৬তে স্থাপিত আমেরিকান কলোনাইজেশন সোসাইটি (এসিএস) নামে দাতব্য সংস্থাটি। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এক শ্বেতাঙ্গ এজেন্ট ও কিছু কৃষ্ণাঙ্গ বণিক পশ্চিম আফ্রিকা ঘুরে সিয়েরা লিওনের দক্ষিণে, বর্তমান মনরোভিয়ার কাছে একটি স্থান ঠিক করে আসে বসতিস্থাপনের জন্যে।

পেপার কোস্ট (‘মরিচ উপকূল’!) নামে এ এলাকাটি অবশ্য জনশূন্য ছিল না! সেখানে বসবাস করত মান্দে, গ্রেবো, ক্রু প্রভৃতি বিভিন্ন গোত্রীয় আফ্রিকান মানুষ। এসব ‘অসভ্য’ গোত্রের এক রাজার সাথে ক্রয়শর্তেই এসিএসের অভিযাত্রীরা ভবিষ্যত বসতির স্থান ঠিক করে। মার্কিনদের আগে স্প্যানিশ-পর্তুগীজ-ব্রিটিশ-ডাচ বণিকদের সাথেও এসকল গোত্রের মোলাকাত ও ব্যবসাবাণিজ্য চলেছে।

প্রথম ইংলিশ পিলগ্রিম অভিবাসীদের মেফ্লাওয়ার জাহাজে চড়ে আমেরিকাযাত্রার ঠিক দু’শ বছর পর, মার্কিন কালো ‘পিলগ্রিমদের’ একটা দল নিউইয়র্ক থেকে এলিজাবেথ জাহাজে করে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে লাইবেরিয়ার উপকূলে অবতরণ করে। সেটা ১৮২০ সাল।

এলিজাবেথ নামে এই জাহাজের ডাকনাম ‘ব্ল্যাক মেফ্লাওয়ার’। ১৮২০ সালে এতে করেই প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন কলোনিস্টরা লাইবেরিয়ায় এসে পৌঁছায়।

দুর্ভাগ্যবশত তাদের ঠিক করা এলাকাটি সভ্য মানুষের বসবাসোপযোগী ছিল না। ক্রান্তীয় এলাকার জলাজঙ্গলের অসুখবিসুখে নবাগতরা আক্রান্ত হয়, ঠিক ইংলিশ পিলগ্রিমদের মত। তাছাড়া সাথে নিয়ে আসা খাবারদাবারও দ্রুত ফুরিয়ে যেতে শুরু করে। এভাবে মৃত্যুমুখে পতিত হয় প্রথম আসা দলগুলির একতৃতীয়াংশ থেকে একচতুর্থাংশ।

অসুস্থতার কারণে আর আবাদযোগ্য জমির অভাবে এসকল অভিবাসী পরিবারগুলি এসিএসের দ্বারস্থ হয়। এসিএস তাদের সীমিত শক্তির মধ্যে যৎসামান্য সাহায্য করে। অনেকেই প্রাক্তন মনিব পরিবারদের কাছে খাদ্য আর ডাক্তারী সাহায্য চেয়ে চিঠি লেখে। অবস্থাপন্নরা সাহায্য পেয়ে বেঁচেবর্তে যায়।

স্থানীয় কালোদের সাথে রফা করে নতুন জমিজমা কেনার চেষ্টা করে মনরোভিয়ার কলোনি। সবসময় সেটা সাফল্যের মুখ দেখেনি। কোন ক্ষেত্রে জোরজবরদস্তি কিংবা ঠকবাজির আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় তারা। হ্যাঁ, জীবন বাঁচানোর তাগিদে তুতো ভাইদের বোকা বানাতে কসুর করেনি এসব মুক্তিপ্রাপ্ত দাসের বংশধররা!

মনরোভিয়ার কাছে ভার্জিনিয়া থেকে আগত কৃষ্ণাঙ্গদের সেটলমেন্ট, ১৮২০এর দশক।

গোলমাল বাঁধা শুরু করলে স্থানীয় রাজাদের নিয়ে সম্মেলন করে সেটলারদের পক্ষে রায় দেয় সে অঞ্চলের নেতৃস্থানীয় মান্দে গোত্রের অধিকর্তা। সেটা নেটিভরা মেনে নিলেও ভেতরে ভেতরে তারা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়। অর্থাৎ আমেরিকার কলোনাইজেশনের মধ্যভাগে সেই ইংলিশ পিলগ্রিমদের সাথে নেটিভদের সংঘাতের সমান্তরাল ইতিহাসের শুরু হলো।

এসকল জটিলতার সাথে যুক্ত হয় আরো বড় একটা সমস্যা। স্থানীয় আফ্রিকানরা বংশপরম্পরায় দাসবাণিজ্যে সরাসরি জড়িত! অন্তর্ঘাতী সংঘর্ষ থেকে বন্দী করা ভিন্নগোত্রীয় মানুষকে তারা স্বগৃহে দাস করে তো রাখতই, উপকূলীয় অঞ্চলে ইউরোপীয়-মার্কিন দাসব্যবসায়ীদের জাহাজেও সাপ্লাই দিত! ১৮২০/৩০এর দশকে ব্রিটিশ নৌবাহিনী পুরো পশ্চিম আফ্রিকা উপকূলে দাসবাণিজ্য বন্ধের জন্যে ঘেরাও দিলেও, তার ফাঁকফোঁকর গলে চোরাকারবারী বেআইনী দাসবাণিজ্য চলত। দাস সাপ্লাইয়ের বিনিময়ে লাইবেরিয়ার গোত্রগুলো পেত ইউরোপীয় অস্ত্র, নানাপ্রকার বিলাসদ্রব্য, ছাতা, চশমা, রঙবেরঙের সেমিপ্রেশাস রত্ন, ইত্যাদি।

নবাগত সেটলাররা যখন জানতে পারলো স্থানীয়দের এই শয়তানি কর্মকান্ডের কথা, তখন থেকে তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় সেসব জোর করে বন্ধ করতে। যুদ্ধ ছাড়া আর কোন গত্যন্তর ছিল না।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




লাইবেরিয়ার আদিবাসী গ্রেবো জনগোষ্ঠীর সেরেমনিয়াল মুখোশ।
১৮০৯এ ব্রিটিশ নৌবাহিনীর জাহাজ ব্রিস্ক দাসবাহী স্প্যানিশ জাহাজ এমানুয়েলাকে চ্যালেঞ্জ করছে।

সে যুদ্ধ যখন বাঁধল, হাজারে হাজারে স্থানীয় কৃষ্ণাঙ্গ ঘিরে ধরল মনরোভিয়ার শ’খানেক সেটলারকে, তখন একটিমাত্র কামানের গোলায় তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় মনরোভিয়াবাসী। বন্দুক স্থানীয়দেরও ছিল, কিন্তু সেটলারদের মত দ্রুত গোলাবর্ষণের প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ তাদের ছিল না।

এরকম অসম কয়েকটি যুদ্ধের পর হাল ছেড়ে উপকূলীয় অঞ্চল ছেড়ে দেয় আদিবাসীরা। সেটলাররা আবাদযোগ্য জমিজমা কিনে নেয় নামমাত্র মূল্যে। চাষাবাদের পাশাপাশি স্থানীয়দের সাথে ইউরোপীয়দের বাণিজ্যের মধ্যসত্ত্বভোগী হিসাবে জাঁকিয়ে বসে সেটলার পরিবারগুলো।

এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি মার্কিন থেকে আসা ‘আমেরিকোদের’। নিউইয়র্ক, মিসিসিপি, পেনসিলভানিয়া, লুইসিয়ানা, মেরিল্যান্ড, ভার্জিনিয়া, কেন্টাকি ইত্যাদি স্টেটগুলিতে এসিএসের মত কলোনাইজেশন সমিতি গড়ে ওঠে। বর্তমান লাইবেরিয়ার বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকায় গড়ে ওঠে তাদেরও বসতি।

ঊনবিংশ শতকের লাইবেরিয়াতে উপকূলীয় অঞ্চলে ‘আমেরিকোরা’ বসতি গেড়েছিল। অভ্যন্তরে ছিল আদিবাসী বহু গোষ্ঠীর বসবাস।

মার্কিন ফেডারেল সরকার এসব কলোনিকে সরাসরি সাহায্য দেয়া থেকে বিরত থাকে, কারণ সাম্রাজ্যবাদী অভিলাষের বিন্দুমাত্র চিহ্ন দেখানোটাও তার নৈতিকতার পরিপন্থী। কংগ্রেস শুধুমাত্র ‘রিক্যাপচার্ড স্লেভদের’ পুনর্বাসনের জন্যে খোরপোশ দিতে রাজি হয়। এরা হলো মার্কিন নেভি কর্তৃক চোরাকারবারী জাহাজ থেকে জব্দকরা দাসের দল, যারা মোটে দাসত্বশৃংখলে আবদ্ধ হয়েছে, ইংরেজী ভাষা-সভ্যতা জানা নাই। এদেরও নিবাস হয় বর্তমান লাইবেরিয়া।

শীঘ্রই লাইবেরিয়ার মুক্ত কালোরা নতুন দেশে তাদের অবস্থান পাকাপোক্ত করে নেয়। এসিএসের সাদা এজেন্টদের উপস্থিতি শিক্ষিত কালোদের মনঃপূত না হওয়ায় তারা নিজেদের মধ্য থেকে গভর্নর নিযুক্ত করার দাবি জানায়। এসিএস ক্রমে তাদের এসকল দাবি মেনে নেয়। কলোনিটি পরিণত হয় ‘কমনওয়েল্থে’, লিখিত হয় মার্কিন আদলের শাসনতন্ত্র। কর্মঠ কালোরা কৃষিকাজ ও বাণিজ্যের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে, রাজনৈতিক পরিচয় ও অবস্থানও মজবুত হয় তাদের।

ঊনবিংশ শতকের বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য লাইবেরিয়ান আমেরিকো ব্যক্তিত্বের স্থিরচিত্র।
১৮২২এর আদিবাসীদের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষাযুদ্ধে একটি কামানের বদৌলতে বেঁচে যায় কালো সেটলাররা। সে কামান দেঁগেছিল নাকি মাটিল্ডা নিউপোর্ট বলে এক কৃষ্ণাঙ্গিনী। এই লেজেন্ডের সেলেব্রেশন ষাট-সত্তরের দশক পর্যন্ত চালু ছিল লাইবেরিয়া দেশটিতে।

বলা বাহুল্য, এসকল স্বাধিকার ও উন্নয়নের মুখ দেখে কেবল উপকূলের কলোনিগুলির ‘আমেরিকো’ গোষ্ঠী, যাদের সংখ্যা হাজারখানেকের বেশি ছিল না। তাদের স্বদেশী আদিবাসী ভাইদের সংখ্যা ছিল দশ লাখের ওপর। এদের শাসনতান্ত্রিক কোন অধিকার ছিল না, কারণ তারা কলোনির সদস্য নয়।

দূর থেকে এই স্বজাতি আমেরিকোদের ডাকতে শুরু করে ‘কালো শ্বেতাঙ্গ’!



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...






আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




লাইবেরিয়া – ১, শুরুর কথা, ১৮০০-১৮২০

জালিম ও মজলুমের কোন গাত্রবর্ণ নাই, জাতপাত নাই। মানুষ এমন একটা প্রাণী যে সামাজিক ঠিকই, কিন্তু কেবলমাত্র প্রাকৃতিক কিংবা কৃত্রিমভাবে তৈরি নিজস্ব আইডেন্টিটি গ্রুপের মধ্যে। পারিপার্শ্বিকতা ও প্রয়োজন তৈরি করে দেয় তার এই পরিচয়।
আফ্রিকার মানচিত্রে লাইবেরিয়ার স্থান
লাইবেরিয়ার পতাকার অনুপ্রেরণা মার্কিন পতাকা
এ কথাগুলি মনে এল লাইবেরিয়া দেশটির কথা চিন্তা করে। ছোট করে শুরুতে বলি, ঊনবিংশ শতকে মার্কিন থেকে আগত মুক্তিপ্রাপ্ত কৃষ্ণাঙ্গ প্রাক্তন দাস ও দাসদের বংশধরদের আবাসস্থল হিসাবে দেশটির যাত্রা শুরু। তাদের শাসনতন্ত্র প্রায় হুবহু মার্কিন শাসনতন্ত্রের ভিত্তিতে লেখা, তিনটি প্রশাসনিক বিভাগ, মতপ্রকাশের-ধর্মপালনের স্বাধীনতা, ইত্যাদি।

আর গোড়াপত্তনের দেড়শ বছরের মাথায় লাইবেরিয়াতে হয়ে যায় দু’-দু’টি গৃহযুদ্ধ। ষোলটি জাতিগোষ্ঠী চিন্তাতীত নির্মমতার সাথে একে-অপরের ওপর চড়াও হয়। লাইবেরিয়ার যুদ্ধের খবর ঘাঁটালেই হত্যা-ধর্ষণের পাশাপাশি চোখে পড়বে চাইল্ড সোলজার, ব্লাড ডায়মন্ড, ইত্যাদি হেডলাইন। ১৯৮৯ থেকে শুরু করে ২০০৩ পর্যন্ত বিরতি দিয়ে দিয়ে গৃহযুদ্ধ হয়, আর তাতে প্রাণ হারায় নয় লাখেরও বেশি মানুষ। ২০০৩এ বেশ কিছু বাংলাদেশী সেনাসদস্যও সেদেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে যোগ দেয়, সেটা ছিল এযাবত জাতিসংঘের সর্ববৃহৎ শান্তিরক্ষা মিশন। মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রিপ্রাপ্ত চার্লস টেইলর নামক এক লাইবেরিয়ান ওয়ারলর্ড ও প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি হন হেগের আন্তর্জাতিক কোর্টে বিচারপ্রাপ্ত প্রথম কোন প্রাক্তন রাষ্ট্রনেতা।

কেন কিভাবে এ অধঃপতন তার কাহিনীই লিখতে বসেছি।

লাইবেরিয়ার স্বাধীনতাঘোষণার প্রাক্কালে কনস্টিটিউশনাল কনভেনশনে স্পষ্টভাবে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকদের আসল পরিচয় যে মার্কিন, তা উল্লেখ করা হয় (১৮৪৭)।
লাইবেরিয়ান গৃহযুদ্ধের চাইল্ড সোলজার
লাইবেরিয়ান গৃহযুদ্ধের চাইল্ড সোলজার

লাইবেরিয়া কনসেপ্টটার যাত্রাশুরু ১৮১০এর দশকে। ইংরেজ ও মার্কিনরা আন্তর্জাতিক দাসবাণিজ্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ১৮০৭ সালে। যেসকল কৃষ্ণাঙ্গ ইতিমধ্যে দক্ষিণের স্টেটগুলিতে ক্রীতদাস, তাদের মুক্তি আসে আরো পরে। কিন্তু উত্তরে তখন যথেষ্ট মুক্তিপ্রাপ্ত ও শিক্ষিত কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের বসবাস। সেসময় মিসৌরী নদী থেকে আটলান্টিক পর্যন্ত যে প্রায় ৯.৬ মিলিয়ন জনসংখ্যা, তাদের প্রায় ১.৭৫ মিলিয়ন কৃষ্ণাঙ্গ, আর এদের প্রায় ২৩০,০০০, অর্থাৎ ১৩ শতাংশ, মুক্ত মানুষ। এদের অনেকে ‘মুলাটো’ বা মিশ্রজাত। কারো বাবা কৃষ্ণাঙ্গ দাস, তো মা শ্বেতাঙ্গ আইরিশ ইনডেঞ্চারড সারভ্যান্ট — যার স্টেটাস ক্রীতদাসের থেকে এমন একটা উঁচুতে নয়। ১৮০০ শতকের শুরুতে মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গরা ছিল আমেরিকার ফাস্টেস্ট গ্রোয়িং ডেমোগ্রাফি।

মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গদের অনেকে ব্যবসাবাণিজ্যে সাফল্য পায়। এদের অনেকেই ছিল শিক্ষিত, কর্মঠ, অন্টরপ্রনরশিপে বিশ্বাসী, এমনকি অ্যাডাম স্মিথপড়া পুঁজিবাদী লোক। পল কাফি বলে এদের একজন, কৃষ্ণাঙ্গ তিমিশিকারী বণিক তিনি, ঠিক করেন যে কৃষ্ণাঙ্গদের আফ্রিকায় পুনর্বাসিত হওয়াটাই সমীচীন। সে লক্ষ্যে একটি জাহাজে করে প্রায় আশিজন মুক্তমানুষ পরিবারসহ আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে পশ্চিম আফ্রিকার সিয়েরা লিওনে এসে হাজির হয়। সিয়েরা লিওন ছিল ব্রিটিশ কলোনি, এবং ব্রিটিশরা এর গোড়াপত্তনই করে ব্রিটেনের মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গদের স্বেচ্ছাপুনর্বাসনের স্থান হিসাবে।

পল কাফি, ১৭৫৯-১৮১৭
নিউ ইয়র্কের কলোনাইজেশন সোসাইটির মেম্বারশিপ সার্টিফিকেট, ১৮৩৭

কাফির চিন্তাটা অবশ্য নতুন নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফাউন্ডিং ফাদাররাও ভেবেছিলেন, মালিকদের মৃত্যুর পর যেসকল ক্রীতদাস মুক্তি পাচ্ছে, কিংবা নিজেদের উপার্জনের মাধ্যমে স্বাধীনতা কিনে নিচ্ছে, তাদের স্বদেশে ফিরিয়ে দেয়াটাই উত্তম। আমেরিকায় যদি তারা থেকে যায়, তাহলে শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ দু’জাতের মধ্যে অত্যাচার ও অপব্যবহারের যে সম্পর্কের শত বছরের ইতিহাস, সেটা ফিরে ফিরে এসে রাষ্ট্রীয় সমস্যা তৈরি করবে। তাছাড়াও মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকাংশ সহায়-সম্বলহীন হওয়ার কারণে ভবিষ্যতে যে তারা আবার ক্রীতদাসে পরিণত হবে না, তারও গ্যারান্টি নেই।

জেফারসন-মনরো প্রমুখ গোপনে এ ব্যাপারে কথাবার্তা চালান, তাদের ইচ্ছে ছিল কৃষ্ণাঙ্গদের জন্যে কলোনিস্থাপনের। সেটা আমেরিকার নতুন ওহাইয়ো টেরিটরিতেও হতে পারে, কিংবা লাতিন আমেরিকা নতুবা আফ্রিকাতেও। এমনকি লিংকনও মধ্য আমেরিকা কিংবা হাইতিতে কৃষ্ণাঙ্গপুনর্বাসনের চিন্তা করেন। কিন্তু তাদের এসকল আইডিয়া নিয়ে বেশিদূর না আগানোর কারণ, ঐ ‘কলোনি’ শব্দটা! মার্কিনরা হবে কিনা তাদের প্রাক্তন মালিক ব্রিটেনের মত সাম্রাজ্যবাদী! এ ব্যাপারটা সে আমলে কারোরই মনঃপূত হয়নি।

এ অবস্থার একটা সুরাহা হয় আমেরিকান কলোনাইজেশন সোসাইটি (এসিএস) নামে একটি দাতব্য সংস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। সাদার্ন স্টেটগুলির কিছু নামীদামী ধর্মপরায়ণ ব্যক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় এটি শুরু হয়। এদের কারো কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি সত্যিকার সহানুভূতি, আবার কারো কারো জাতিগত মিশ্রণ নিয়ে অ্যালার্জি থাকায় তারা চান কৃষ্ণাঙ্গরা ‘ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাক!’

যে উদ্দেশ্যেই এসিএসের যাত্রা শুরু হোক না কেন, বেশ কিছু মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গ আইডিয়াটা গ্রহণ করে নেয়।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...






আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




লেগিওন ফ্রাইয়েস ইন্ডিয়েন

আজকে আজাদ হিন্দ ফৌজ সম্পর্কে যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লিখবো, সেটা সকলের মনঃপূত না হতে পারে। আমরা ছোটবেলা থেকে নেতাজি সুভাষ বসুকে ভারত-বাংলার স্বাধীনতাসংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা হিসাবে দেখে এসেছি। ব্যক্তিগতভাবে আমি জাতিগত, ধর্মীয় কোন জাতীয়তাবাদকে সুদৃষ্টিতে দেখি না। সে আমলের বৈশ্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয়তাবাদ হয়ত গ্রহণযোগ্য ছিল, কিন্তু আজাদ হিন্দ ফৌজের উৎপত্তি ও যুদ্ধকালীন কার্যক্রম অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। জাতীয়তাবাদের ও জাতীয় নেতাদের পূজো যারা করতে ভালবাসেন, তারা দয়া করে খোলা মন নিয়ে পড়ুন। নয়ত নাই পড়ুন।

আমার সংগ্রহের কয়েকটি ডাকটিকেট দিয়ে শুরু করি। প্রথম জোড়াটি ১৯৪২ সালের ক্রোয়েশিয়ার। বিভিন্ন স্লাভিক জাতির সমন্বয়ে গঠিত রাষ্ট্র ইউগোস্লাভিয়া দখলের পর নাৎসি বাহিনী ক্রোয়েশিয়া রাষ্ট্রকে ‘মু্ক্ত’ করে। সেদেশের সরকার গঠিত হয় উশতাসে নামক উগ্র জাতীয়তাবাদী একটি ক্রোয়েশীয় রাজনৈতিক দলের দ্বারা। তারা নাৎসিদের থেকেও অধিক জাতিগত হত্যা সংঘটন করে। উশতাসে সরকার নামে ‘স্বাধীন’ হলেও আদতে জার্মান তাঁবেদার ছিল।

নাৎসি তাঁবেদার রাষ্ট্র ক্রোয়েশিয়ার ডাকটিকেট, ১৯৪১-৪৩ সাল

সেরকম চেকোস্লোভাকিয়া রাষ্ট্রটিকেও জার্মানরা ত্রিখন্ডিত করে। সুডেটেনল্যান্ড খাস জার্মানির অন্তর্ভুক্ত হয়। বর্তমান চেকিয়ার বাকি অংশ হয় বোহেমিয়া-মোরাভিয়া নামক জার্মান প্রটেক্টরেট। আর স্লোভাকিয়া হয় ক্রোয়েশিয়ার মত চেকদের শাসন থেকে ‘স্বাধীনতাপ্রাপ্ত’। হ্লিংকা পার্টির উগ্র জাতীয়তাবাদী সরকার জার্মান রাষ্ট্রের পাপেট ছিল এবং তাদের সকল যুদ্ধাপরাধী কর্মকান্ডে হাত মেলায়। দ্বিতীয় ছবিতে স্লোভাকিয়ার স্ট্যাম্প।

নাৎসি তাঁবেদার রাষ্ট্র স্লোভাকিয়ার ডাকটিকেট, ১৯৩৯

তৃতীয় ছবির ডাকটিকেটগুলি বেশ দুর্লভ আর বেশির ভাগ সংগ্রহকারীর কাছে অপরিচিত। অপারেশন বারবারোসার মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নকে চকিত আক্রমণ করে বসে জার্মানি। সেটা ১৯৪১ সাল। স্তালিনের একাধিক শুদ্ধি অভিযানের কারণে সোভিয়েত সেনাদল ছিল অপিরপক্ব অফিসারদের নেতৃত্বে পরিচালিত। এদের অনেকে জার্মানদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। হিটলারের বর্ণবাদী থিওরিতে রাশান আর বেশিরভাগ স্লাভিক মানুষ নিচুস্তরে পরিগণিত। তাই এসকল যুদ্ধবন্দীদের বেশ অত্যাচার সহ্য করতে হয়। প্রায় অর্ধেকের মত যুদ্ধবন্দী ক্যাম্পে মৃত্যুমুখে পতিত হয়।

কিন্তু ‘৪২এ স্তালিনগ্রাদে হারার পর হিটলারের সভাসদরা তাঁকে রাজি করান যে এসকল যুদ্ধবন্দীদের নিয়ে একটি ‘লিবারেশন আর্মি’ বানালে সোভিয়েতবিরোধী প্রপাগান্ডায় কাজে দেবে। সোভিয়েত ইউনিয়নে সাধারণ রাশিয়ান মানুষ স্তালিনের ভয়ে প্রকম্পিত হত, যেমনটা হত সেদেশের জাতিগত সংখ্যালঘুরা।

জেনারেল ভ্লাসভ নামে এক রাশান অফিসার জার্মানদের সাথে আঁতাত করে ঠিক করেন যে, যুদ্ধবন্দীদের একাংশ নিয়ে একটি ‘মুক্তিবাহিনী’ গঠিত হবে, যারা রাশিয়া ও সোভিয়েত অধিকৃত অঞ্চল থেকে কমুনিস্ট শাসন উচ্ছেদের জন্যে জার্মানদের সহায়তা করবে। ডাকটিকেট দুটি এই ভ্লাসভ আর্মির ইস্যুকৃত।

রাশিয়ান “রাজাকার” ভ্লাসভ আর্মির ডাকটিকেট, ১৯৪৪

পরের তিনটি ছবিতে দেখিয়েছি নাৎসি জার্মানির ডাকটিকেটের গতানুগতিক বিষয়বস্তু, ডিজাইন ইত্যাদি। আর শেষ ডাকটিকেটগুলো ‘আজাদ হিন্দের’। ডাকটিকেটগুলির বিষয়বস্তু, ডিজাইন ও প্রিন্টিং একটু ভাল করে দেখুন।

নাৎসি জার্মানির ডাকটিকেট, ১৯৪৪
নাৎসি জার্মানির ডাকটিকেট, ১৯৪৫ ও ১৯৪১। ডানের টিকেটটির ডিজাইনার আক্সটার-হয়টলাস আজাদ হিন্দের ডাকটিকেটের নকশা করেন।
নাৎসি জার্মানির ডাকটিকেট, ১৯৪৪ ও ১৯৪৩। নিচের টিকেটটির ডিজাইনার আক্সটার-হয়টলাস আজাদ হিন্দের ডাকটিকেটের নকশা করেন।
আজাদ হিন্দের ডাকটিকেট, ১৯৪৩। জার্মানিতে নকশা করা। নাৎসি জার্মানির রাষ্ট্রীয় ছাপাখানায় মুদ্রিত।

এতগুলি ডাকটিকেট দেখানোর মূল লক্ষ্য এটা বোঝানো যে, জার্মান তাঁবেদার রাষ্ট্রগুলির সরকার থেকে শুরু করে এমনকি ডাকটিকেট ডিজাইন ও প্রিন্টিং পর্যন্ত ছিল নাৎসি আনুকূল্যের ওপর নির্ভরশীল। আমার দেখানো স্ট্যাম্পগুলির সকলের ডিজাইন ও বিষয়বস্তু প্রায় এক।

আজাদ হিন্দের ডাকটিকেটগুলি তার ব্যতিক্রম নয়। জার্মানির যে ডাকটিকেটগুলি দেখিয়েছি তার ডিজাইনার স্বামী-স্ত্রীযুগল আক্সটার-হয়টলাস। আবার এরাই আজাদ হিন্দের ডাকটিকেটেরও ডিজাইনার! আর এ টিকিটগুলো ছাঁপা হয়েছিল জার্মানির সরকারি প্রিন্টিং হাউজ রাইখসড্রুকারিতে। অর্থাৎ তাঁবেদার অন্যান্য সরকারগুলির থেকে এই ‘আজাদ হিন্দ’ খুব একটা আলাদা ছিল না।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




পরে এ ডাকটিকেটের বিশাল পরিমাণ সুভাষ বসু ও তার অনুগত অফিসাররা নিয়ে যান জাপানে ও বার্মায়।

আজাদ হিন্দের যাত্রা শুরু ‘আজাদ হিন্দ’ হিসাবে নয়। উত্তর আফ্রিকায় তবরুক আর আল-আলামিনে ১৯৪০-৪১এর যুদ্ধের পর একটা বড় ব্রিটিশ সেনাদল জার্মান ও ইতালীয়দের যুদ্ধবন্দী হয়। এদের মধ্যে ছিল ব্রিটিশ ভারতের অনেক সৈন্য। প্রথমে ইতালিতে ও পরে জার্মানিতে স্থানান্তরিত হয় এরা।

ভ্লাসভ আর্মির মত ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডার অস্ত্র হিসাবে এই ভারতীয়দের ব্যবহারের বুদ্ধি আসে জার্মান ও ইতালীয়দের মাথায়। ইতালীয়রা ১৯৪২এ তিনশর মত ‘স্বেচ্ছাসেবক’ ভারতীয় সৈন্য নিয়ে গঠন করে বাতালিওনি আজাদ হিন্দুস্তান। কিন্তু যথেষ্ট কাঠখড় পুড়িয়ে প্রশিক্ষণ দেবার পরে এদের বিশ্বস্ততা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়ায় দলটিকে ভেঙে দেয়া হয়।

এখানে বলে রাখা ভাল, যুদ্ধবন্দীদের নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করাটা সাধারণত সামরিক বিবেচনায় ভাল নয়। কারণ যে মুহূর্তে তারা যুদ্ধক্ষেত্রে স্বদেশীদের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হবে, সে মুহূর্তে আবার দল পরিবর্তন করতে পারে। এরপরেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানরা বহুজাতিক ভাফেন এসএস নামে প্যারামিলিটারি বাহিনীতে ভিনদেশী স্বেচ্ছাসেবকদের জায়গা দেয়। এদের মধ্যে ছিল ডাচ, বেলজিয়ান, ডেনিশ, নরওয়েজিয়ান, ব্রতোঁ, তাতার, আর্মানী, আজারবাইজানী, জর্জিয়ান, লাটভিয়ান, এস্তোনিয়ান, ফিনিশ, প্রভৃতি জাতির সৈন্য। আরবদের নিয়ে সংগঠিত হয়েছিল লেগিওন ফ্রাইয়েস আরাবিয়েন — ফ্রী আরাবিয়ান আর্মি। সাধারণত ফ্রন্টলাইনে এদের ব্যবহার করা হত না, সিভিলিয়ান অধিকৃত এলাকাতেই বিভিন্ন কাজে লাগানো হত এদের।

মূল কথা হলো, ইন্ডিয়ান লিবারেশন আর্মির শুরুটা সুভাষ বসুর মাধ্যমে নয়। তাঁর সশস্ত্র সংগ্রামের লক্ষ্যের সাথে ভাগ্যক্রমে অক্ষবাহিনীর এসকল প্রপাগান্ডাধর্মী কর্মকান্ড মিলে যায়।

ইতালির মতই জার্মানরা ১৯৪১ নাগাদ উত্তর আফ্রিকা থেকে সাতাশ জন ভারতীয় যুদ্ধবন্দীকে উড়িয়ে নিয়ে আসে ফ্রী ইন্ডিয়ান আর্মির অফিসার বানানোর উদ্দেশ্যে। ধীরে ধীরে জার্মানিতে আফ্রিকা-ইউরোপ থেকে অধিকৃত প্রায় হাজার পনেরো ব্রিটিশ ভারতীয় যুদ্ধবন্দীর সমাবেশ গড়ে ওঠে। হিটলার অবশ্য এসএসপ্রধান হিমলারের ফ্রী ইন্ডিয়ান আর্মি আইডিয়াটাকে পছন্দ করেননি। তাঁর হিসাবে ভারতীয়রা অতীতে আর্য থেকে থাকলেও এখন মিশ্রিত নিচু শ্রেণীর জাত।

হিটলারকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে হিমলার ১৯৪২এর জানুয়ারি নাগাদ লেগিওন ফ্রাইয়েস ইন্ডিয়েন বলে একটা ছোটখাটো ‘স্বেচ্ছাসেবক’ সৈন্যদল গড়ে তোলেন। কিন্তু পক্ষপরিবর্তনে যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে তেমন একটা সাড়া মিলছিল না। জার্মান অধিনায়কত্বের পরিবর্তে দরকার হয়ে পড়ে বিশ্বাসযোগ্য ভারতীয় নেতৃত্ব। এখানেই নেতাজির সফল আবির্ভাব।

ব্রিটিশ ভারতীয় সিআইডির চোখে ধূলো দিয়ে নেতাজি কলকাতা থেকে দুঃসাহসিক এক যাত্রা করেন ১৯৪২এর শুরুতে। পুরো ভারত অতিক্রম করে আফগানিস্তানের সীমানা দিয়ে রাশিয়াতে ঢোকেন ছদ্মবেশে। তারপর নতুন নাম নিয়ে সোজা মস্কো। তাঁর যাত্রার ঠিকানা ছিল মস্কোই, জার্মানি নয়। তাঁর হিসাবে, স্বাধীন ভারতের জন্যে দরকার ছিল বিশ বছরের সমাজতন্ত্রী একনায়কতন্ত্র, ঠিক সোভিয়েত রাশিয়ার আদলে।

কিন্তু মস্কোতে সাড়া জাগাতে ব্যর্থ হন নেতাজি। সোভিয়েতরা তখন জার্মানদের নিয়ে ভীত। যেকোন মুহূর্তে আক্রমণ আসতে পারে। এমতাবস্থায় ব্রিটেন-আমেরিকার মত সম্ভাব্য মিত্রদের চটানোর কোন মানে হয় না। বিফলমনোরথ নেতাজিকে তারা বার্লিনমুখী ট্রেনে তুলে দেয়। কারণ জার্মানদেরই তখন প্রয়োজন ছিল সুভাষ বসুর মত কারো।

পাঠক হয়ত আঁচ করতে পারছেন, নেতাজি স্বদেশপ্রেম আর ব্রিটিশবিদ্বেষে এতটাই অন্ধ আর ‘দ্য এনেমি অফ মাই এনেমি ইজ মাই ফ্রেন্ড’ এ তত্ত্বে এতটাই মশগুল যে যুদ্ধকালীন রাজনীতির সাধারণ জ্ঞান হয় তাঁর বিলুপ্ত হয়েছে, নয়ত তিনি সজ্ঞানেই ব্রিটিশের তদকালীন শত্রু জার্মান-সোভিয়েতদের বাণিজ্যপণ্যে পরিণত হয়েছেন। যদি এ শত্রুরা সমঝোতার মাধ্যমে একটি যুদ্ধবিরতি ও শান্তিচুক্তি করে ফেলত তাহলে আজাদ হিন্দের কি হত? নানা কৌশলগত কারণেই ‘এনেমি অফ মাই এনেমি…’ এ তত্ত্বের এমন সাদাসিধা প্রয়োগ মূলত অকার্যকর।

যাহোক, এপ্রিল ‘৪২এ জার্মানিতে এসে পড়েন নেতাজি। হিটলারের সাথে দেখা করতে চেয়েও তা মেলে কয়েক মাস পর। এর মধ্যেই তাঁকে কাজে লাগিয়ে নেন হিমলার।

ফ্রী ইন্ডিয়ান লেজিওনে যোগ দেয়ার ব্যাপারে ব্রিটিশ ভারতীয় যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে সাড়া না মেলার মূল কারণ একমাত্র দেশী নেতৃত্বের অভাব নয়। এসকল সৈন্যদের অধিকাংশ বংশপরম্পরায় ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীতে সার্ভিস দিয়ে এসেছে। ব্রিটিশরাজের প্রতি ব্যক্তিগত আনুগত্যের যে শপথ তারা নিয়েছে, তা ভঙ্গ করা মিলিটারি কোড অফ অনারের পরিপন্থীও বটে। আর ভিনদেশী-অন্যভাষী জার্মানদেরই বিশ্বাস করার কি কারণ?

সুভাষ বসু একে একে প্রতিটা পিওডাব্লিউ ক্যাম্পে গিয়ে এসকল ভারতীয় সৈন্যদের স্বাধীনতার পক্ষে লড়ার জন্যে উদ্বেলিত করে তোলেন। ফ্রী ইন্ডিয়া সেন্টার বলে একটি রেডিও স্টেশনও শুরু হয়। নেতাজি ছিলেন অসাধারণ বক্তা। আর অনেক শিক্ষিত সৈন্যের কাছেও তাঁর নাম ছিল সুপরিচিত। শুধু এসকল কারণে নয়, যুদ্ধবন্দীশিবিরের করুণ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্যে আর নতুন সেনাদলে অফিসার পদবীর আশাতেও অনেকে সিদ্ধান্ত নেয় ব্রিটিশরাজের প্রতি আনুগত্যের শপথ ভাঙার। সুভাষ বসু ছিলেন তাদের এ সিদ্ধান্তের রেস্পন্সিবল পার্টি।

তবে ১৫ হাজার যুদ্ধবন্দীর মধ্যে শেষ পর্যন্ত শুরুতে কেবল তিন হাজার সৈন্য ফ্রী ইন্ডিয়ান লেজিওনে যোগ দেয়। নেতাজির আশা ছিল কমপক্ষে এক লাখ সৈন্যের একটি বাহিনী বানাবেন। তারপর জার্মানি থেকে যাত্রা করে সোভিয়েত এলাকার মধ্য দিয়ে আফগান ও ভারতের সীমানায় পৌঁছলে ভারতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জনবিদ্রোহ শুরু হয়ে যাবে। বলা বাহুল্য, এ ছিল নিতান্ত নাইভ একটি প্ল্যান।

ভারতের অবিসংবাদিত নেতা সুভাষ বসু ছিলেন না। গান্ধী-নেহরুর নেতৃত্বে কংগ্রেস ও অসহযোগিতা আন্দোলনের পক্ষে বেশ দৃঢ় জনসমর্থন ছিল। আর উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের বালুচ ও পাঠান জাত কিন্তু ব্রিটিশদের সেনাদলে বংশানুক্রমে বিশ্বস্ত সৈন্য যুগিয়ে এসেছে। তাদের মধ্যে নেতাজির নেতৃত্বে হুঁটহাঁট বিদ্রোহ শুরু হত কিনা, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। আর কিভাবে কার খরচের খাতা ভরিয়ে হাজার হাজার মাইল পেরোত এ বিশাল সেনাবহর সেটা মোটেও অবান্তর প্রশ্ন নয়। নেতাজির পরিকল্পনাগুলি ছিল বেশ জাঁকালো, কিন্তু বাস্তবতাবিবর্জিত। তার এসব পরিকল্পনায় পূর্ণ সমর্থন যোগানোটাও ছিল জার্মানদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব।

১৯৩৯এ যুদ্ধ শুরুর সাথে সাথে হোম রুলের পরওয়া না করে ব্রিটেনের পক্ষে ভারতের ব্রিটিশ রাজ জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। কষ্টার্জিত সংসদীয় ব্যবস্থা প্রায় রহিত করা হয়। এ টিকেটটির ব্যবহার ডাকপ্রেরনে হয়নি, হয়েছিল যুদ্ধের খরচ ওঠানোর বন্ডে। লাখে লাখে এ দামী টিকেটটি কেনেও অনেক ভারতবাসী, মূলত পাকিস্তানের এলাকাতে। ব্রিটিশদের প্রতি মুসলিম জনগোষ্ঠীর সমর্থন তুলনামূলক বেশি ছিল।

যা হোক অগাস্ট ‘৪২ নাগাদ মোটামুটি সাড়ে চার হাজারের একটা রেজিমেন্ট গড়ে ওঠে জার্মানিতে। তাদের ইউনিফর্ম ছিল জার্মান সেনাবাহিনীর ধাঁচে। আর ইনসিগনিয়া ছিল জাফরান-সাদা-সবুজ ট্রাইকালার স্ট্রিপের মাঝে শিকারে উদ্যত বাঘের ছবি। শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে তারা নেতাজির প্রতি নয়, হিটলারের প্রতি আনুগত্যের শপথ নেয়। শপথের কথাগুলি ছিল এমন: “I swear by God this holy oath that I will obey the leader of the German race and state, Adolf Hitler, as the commander of the German armed forces in the fight for India, whose leader is Subhas Chandra Bose.”

লেগিওন ফ্রাইয়েস ইন্ডিয়েনের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের কালার গার্ড। শিখ, মুসলিম ও হিন্দু ধর্মের সম্মিলিত। ভারতের তিনরঙা পতাকার মাঝে শিকারোদ্যত ব্যাঘ্র। ওপরে দেখানো আজাদ হিন্দের ডাকটিকেটের একটিতে এ চিত্র রয়েছে।
নাৎসি আর্মির প্রশিক্ষণে রত শিখ সৈন্য। হাতে এমজি-৩৪ অটোম্যাটিক। আজাদ হিন্দের ইন্সিগ্নিয়া দেখা যাচ্ছে ইউনিফরমে। ওপরে দেখানো একটি টিকেটে এ দৃশ্য মুদ্রিত হয়েছে।

নেতাজির অনুরোধ ছিল এ সৈন্যবাহিনী ইউরোপের যুদ্ধে ব্যবহৃত হবে না, হবে কেবল ভারতমুক্তির যুদ্ধে। এতে জার্মানরা যে খুব একটা খুশি হয়েছিল তা নয়। হিটলার নাকি আড়ালে বলেছিলেন, ফ্রি ইন্ডিয়ান আর্মি ইজ এ জোক। শুধু প্রপাগান্ডার খাতিরে বসিয়ে বসিয়ে এদের খাওয়ানো-পরানো আর প্রশিক্ষণ দেয়াটা তাঁর মনঃপূত হয়নি। তাঁকে বুঝিয়ে ঠান্ডা করেন হিমলার। শেষ পর্যন্ত সুভাষ বসুর সাথে একটি মোলাকাতেরও ব্যবস্থা করে দেন, কিন্তু হিটলার কোন প্রতিশ্রুতি সে মিটিংএ নেতাজিকে দেননি। নেতাজি এতে মনোক্ষুণ্ণ হন।

১৯৪২এ হিটলারের সাথে শেষ পর্যন্ত মোলাকাত হয় নেতাজির।

নেতাজির পছন্দের সোভিয়েতদেরকেও ততদিনে আক্রমণ করে বসেছেন হিটলার। স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধ চলছে। কিন্তু আফগান সীমানা পর্যন্ত জার্মান সেনাদের যাওয়া তো দূরের কথা, তার কৌশলগত তেমন কোন কারণও ছিল না। হিটলারের লক্ষ্য ছিল উরাল আর ককেশাস পর্যন্ত সম্পদশালী এলাকাটির দখল নেয়া। তাঁর প্ল্যানে মধ্য এশিয়া ও ইরান ছিল সুদূরের পরিকল্পনামাত্র। পারস্যের মধ্যে দিয়ে একটা রাস্তা থাকলেও তা ছিল অনেক প্রতিকূল।

বিষন্ন নেতাজির দিকে তখন অগ্রসর হয় জাপানিরা। ‘৪২ নাগাদ জাপানিদের হাতে সিঙ্গাপুর-মালয়-বার্মার ব্রিটিশ গ্যারিসনের পতন হয়েছে। তাদের হাতে হাজার চল্লিশেক ভারতীয় যুদ্ধবন্দী। এদের নিয়ে তৈরি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির নেতৃত্বে তখন জাপানপ্রবাসী রাসবিহারী বসু, কিন্তু তাদের দরকার ছিল আরো তরুণ ক্যারিসম্যাটিক নেতৃত্ব। সুভাষ বসু সে রোলপ্লে করতে রাজি হন।

ভারতের বার্মা সীমান্তে জাপানিসমর্থিত বড় সেনাদল নিয়ে স্বাধীনতাসংগ্রামের সফলতার সম্ভাব্যতা নেতাজির চোখে আরো বেশি ছিল। কিন্তু তাঁর যে আশা ভারতের সীমানায় এসে পৌঁছলেই জনবিদ্রোহের সূচনা হবে তাতে গুড়েবালি। ব্রিটিশরা যুদ্ধকালীন সংবাদের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ রেখেছিল শত্রুর প্রপাগান্ডা ছড়ানো বন্ধের জন্যে। এই সেনাদলের অস্তিত্বের কোন খবরই ভারতবাসী যুদ্ধকালীন সময়ে জানতে পারেনি। তাই সুভাষ বসুর সামরিক পন্থায় ভারতমুক্তির তেমন কোন বাস্তবতা ছিল না।

যাই হোক, ১৯৪৩এ সুভাষ বসু ফ্রী ইন্ডিয়া লেজিওনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জাপানমুখী সাবমেরিনে চড়ে বসেন। তাঁকে অনুসরণ করে কিছু সেনা অফিসার। কিন্তু অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হয় সাধারণ ভারতীয় সৈন্যরা। জার্মান এক অফিসারকে তাদের অধিনায়ক বানানো হয়, কিন্তু সৈন্যদের অভিযোগের মুখে তাকে অপসারণ করা হয়। শুধুমাত্র ভারতমুক্তির যুদ্ধে শামিল করা হবে এ কথা দেয়া সত্ত্বেও জার্মানরা রেজিমেন্টটিকে অধিকৃত নেদারল্যান্ডে আটলান্টিক ওয়াল নামক উপকূলীয় প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় স্থানান্তর করে।

ফেব্রুয়ারি ১৯৪৪এ আটলান্টিক ওয়ালে ফ্রী ইন্ডিয়ান আর্মি পরিদর্শনে ফীল্ড মার্শাল রোমেল।

এসময় ডাচ সাধারণ জনগণের কাছে বেশ জনপ্রিয় ছিল ভিনদেশী এ সৈন্যদল। ডাচ মেয়েরা পর্যন্ত ভারতীয় সৈন্যদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। কিছু ক্ষেত্রে বিবাহবন্ধনেও আবদ্ধ হয় কয়েক সৈন্য। অন্যান্য জার্মানদের মত ফ্রন্টলাইন যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়নি এই ভারতীয়রা। মোটামুটি আরামেই কাটে তাদের ১৯৪৩-৪৪। ডাচরা নিজেরাও অধিকৃত জনগোষ্ঠী হওয়ায় ব্রিটিশশাসিত পরাধীন ভারতীয়দের প্রতি তাদের যথেষ্ট সহানুভূতি ছিল। জার্মান প্রপাগান্ডার একটা ভূমিকাও ছিল এতে।

‘৪৩এর শীতের আগমনের সাথে সাথে আবার স্থানান্তর করা হয় ফ্রী ইন্ডিয়া লেজিওনকে। এবার ভাফেন এসএসের সরাসরি কমান্ডে তাদের অবস্থান হয় দক্ষিণ ফ্রান্সের আরামদায়ক উপকূলে। ‘৪৪এর জুনে ফ্রান্সের নর্মন্ডি উপকূলে যৌথবাহিনী সফলতার সাথে অবতরণ করে। শুরু হয় ফ্রান্সের স্বাধীনতাযুদ্ধ। সে সমরে না চাইলেও ভারতীয় সৈন্যরা জড়িয়ে যায়। জার্মান ডিভিশনগুলি সমানে পিছু হটতে শুরু করে। আর ফ্রন্টলাইনের পেছনে ফ্রেঞ্চ রেজিস্ট্যান্সের চোরাগোপ্তা গেরিলা হামলা বেড়ে যায়। ফ্রী ইন্ডিয়া লেজিওনের প্রথম লোকক্ষয় হয় এখানেই। ফরাসী পার্টিজানদের বিরুদ্ধে তখন কিছু যুদ্ধে শামিল হয় ভারতীয়রা।

ফ্রান্সে জার্মান সেনাবাহিনীর মিলিটারি ফাংশনে আজাদ হিন্দের শিখ অফিসারকে নাৎসি স্যালুট দিচ্ছে উপস্থিত জার্মানরা।
ভারতীয় সৈন্যদের একটি ছোট গ্রুপকে নির্দেশনা দিচ্ছে জার্মান অফিসার। ভারতীয় সৈন্যদের পরনে জার্মান সেনাবাহিনীর পোশাক, হেলমেট। ফ্রান্স, ১৯৪৪।

যে স্বাধীন ভারতের লক্ষ্যে এ সাড়ে চার হাজার সৈন্যের জার্মান সার্ভিসে যোগদান, তার থেকে এভাবে ক্রমে দূরে সরে যায় তারা। যে নেতার ব্যক্তিগত অনুরোধের কারণে বাপদাদার মিলিটারি কোড অফ অনার ভেঙে হিটলারের আনুগত্যের শপথ নিয়েছিল তারা, তাঁর কাছ থেকেও বহুদিন কোন খবর নেই। নেতৃত্বহীন, খুঁটিহীন, হতোদ্যম ভারতীয় সৈন্যদের মধ্যে নিয়মানুবর্তিতার অভাব দেখা দিতে শুরু করে। অনেকে মদ্যোপান শুরু করে। ফ্রান্সের প্রতিকূল সামরিক পরিবেশে ধর্ষণ ও শিশুহত্যার মত যুদ্ধাপরাধের অভিযোগও এদের বিরুদ্ধে ফরাসীরা করে যুদ্ধের পরে।

‘৪৫এর মে’তে যুদ্ধ শেষ হয়। নিরপেক্ষ সুইজারল্যান্ডে আশ্রয় নেবার ইচ্ছা থাকলেও ফ্রী ইন্ডিয়া আর্মি শেষমেশ ফরাসী ও মার্কিনদের হাতে বন্দী হয়। তাদেরকে ব্রিটিশদের হাতে সমর্পণ করা হয়। ভারতে প্রত্যাবর্তনের পর ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির পাশাপাশি লালকেল্লায় এদেরও বিচার হয়। কিন্তু ভারতে ততদিনে স্বাধীনতার পক্ষে গণআন্দোলন বেশ জোরেসোরে চলছে। লালকেল্লায় আজাদ হিন্দের রাষ্ট্রদ্রোহিতার বিচারের পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্রোহ করে বসে ভারতীয় নৌ ও বিমানবাহিনী। শেষ পর্যন্ত কিছুদিনের জেল ও ডিসঅনারেবল ডিসচার্জের শাস্তি দিয়ে আইএনএ ও ফ্রী ইন্ডিয়া লেজিওনের সকল অফিসার ও সৈন্যকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় ব্রিটিশরাজ। সুভাষ বসু এসবের আগেই তাইওয়ানে বিমানদুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছেন। যে সামরিক প্রক্রিয়ায় বিজয়ী সেনাবাহিনীর অধিনায়ক হিসাবে ভারতের মুক্তি আনার স্বপ্ন ছিল তাঁর, আজাদ হিন্দ ফৌজ তার থেকে পুরোপুরি ভিন্ন প্রক্রিয়ায় পরাজিত ও ‘রাজাকার’ আখ্যায়িত হয়ে স্বাধীনতাসংগ্রামকে প্রভাবিত করে।

আরেকটা ব্যাপার অনেক বাঙালী ভাবেন যে সুভাষ বসু তাঁর অনুগত সেনাদলে ধর্মীয়-জাতিগত সীমানা ভেঙে সব ছাঁপিয়ে ভারতীয় সাম্যবাদী-জাতীয়তাবাদী একটি অনুভূতি দাঁড়া করান। এটা যতটা না আদর্শবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা উচিত, তার থেকে বেশি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যাচাই করা জরুরী।

ব্রিটিশ ভারতীয় আর্মিতে ধর্মীয়-জাতিগত বিভাজনের অনেক যুক্তিসঙ্গত কারণ ছিল। একই ভাষার ব্যবহার, একই ধরনের খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি অনেক বড় প্র্যাক্টিকাল কারণ। ফ্রী ইন্ডিয়ান আর্মির অবস্থা সেরকম ছিল না। তারা সংখ্যাতেও ছিল কম, জাতিগত-ধর্মীয়ভাবে আলাদা করলে ছোট ইউনিটের কারণে সাংগঠনিক সমস্যা দেখা দিত। তাছাড়াও মনে রাখতে হবে যুদ্ধবন্দী হিসাবে তারা একটা প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন ছিল। সেখানে জাতিগত-ধর্মীয় বিরোধ তৈরির কোন অনুকূল অবস্থা ছিল না। খারাপ সিচুয়েশনে পড়লে বাঘে-মহিষেও এক ঘাঁটে জল খায়।

আর প্রতিকূল অবস্থা থেকে বেরুনোর সাথে সাথেই কিন্তু হিন্দু-মুসলিম বিরোধটা এই একই আর্মির মধ্যে দেখা গেছে। লালকেল্লার বিচারের সময় মুসলিম সৈন্যরা হিন্দুদের ওপর দোষ চাপায় জোরপূর্বক আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগদানে তাদের বাধ্য করার জন্যে। এ অভিযোগের সত্যাসত্য বের করা কঠিন। কিন্তু ভারতীয় ব্রিটিশ আর্মিতে যে ধর্মীয় বিরোধের সুযোগ ও স্থান ছিল না, তার পরিস্থিতি ঠিকই তৈরি হয় আজাদ হিন্দ ফৌজে। সে ব্যাপারে পরে কোনসময় বিস্তারিত বলবো।

সুভাষ বসুর জীবনী নিয়ে বাঙালী বহু পড়াশোনা করেছে, বিস্তর লেখালেখি করেছে। হিরো ওয়ারশিপের শেষ নেই!  কিন্তু পুরো কাহিনীটার বাস্তবধর্মী বিশ্লেষণ করতে হলে জার্মান-জাপানী দৃষ্টিভঙ্গিটা দেখাও জরুরী। আর সাধারণ সৈন্যদের দিকেও নজরটা বাঙালী দিয়েছে কম, যতটা না দিয়েছে নেতৃত্বের প্রতি। সে চেষ্টাটাই আজকে আমি করলাম জার্মান ফ্রী ইন্ডিয়ান লেজিওনের সংক্ষিপ্ত কাহিনীর মধ্য দিয়ে। পরে সুযোগ হলে বার্মার ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির কাহিনী ও জাপানী দৃষ্টিকোণ নিয়েও একটি বিশ্লেষণ করার আশা রাখি।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...






আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




সাইবেরিয়ার সোনার ট্রেন

সাইবেরিয়ার বৈকাল হ্রদ বিশ্বের সবচে গভীর, সবচে প্রাচীন। আর এ হ্রদের গভীরেই হয়ত লুকিয়ে রয়েছে বিগত শতকের রোমাঞ্চকর এক রহস্যের উত্তর। রহস্যটিকে অনেকে রঙচঙে নাম দিয়েছে ‘ৎসারের হারানো স্বর্ণরাজি’, আবার আরেক নাম ‘কলচাকের সোনা’।

লেক বৈকালের তীর ঘেঁষে ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলওয়ের একাংশ, যার নাম সারকাম-বৈকাল লাইন।

বৈকালের তীরের ইরকুতস্ক শহরের মানুষ এখনো বিশ্বাস করে, হ্রদের তলদেশে একটি সোনাভর্তি ট্রেনের কার রয়েছে। বৈকালের ধারঘেঁষা ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলওয়ের একাংশ থেকে নাকি ছিঁটকে এটি পড়ে গেছিল ১৯২০ সালে। ২০১০এ একটি সাবমেরিন নাকি অনুসন্ধান চালিয়ে একটি বগি পায়, কিন্তু গভীর পানির নিচ থেকে সোনা কিংবা অন্য কোন বস্তু উদ্ধারের সক্ষমতা না থাকায় রহস্য রহস্যই থেকে গেছে।

এ পোস্টারে রাশিয়ার ম্যাপে বৈকাল হ্রদের অবস্থানের পাশাপাশি পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দেয়া হয়েছে।

বিংশ শতকের শুরুতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভের আগে রুশ সাম্রাজ্যের স্বর্ণভান্ডার ছিল তৃতীয় বৃহত্তম। ব্রিটেন-ফ্রান্সের পরপরই তার স্থান। কিন্তু এই দেশ দুটির যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছিল, রাশিয়ার তা ছিল না। দাম্ভিক সম্রাটদের খায়েশে চলা দেশটিতে জনসাধারণের এক বিশাল অংশ ছিল ভূমিদাস। ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে সংস্কারায়নের ফলে শিল্পের অগ্রগতি হয়। কিন্তু তার সাথে যে দ্রুত সামাজিক পরিবর্তনগুলো আসে, তাকে সামাল দেবার যোগ্যতা পুরনো ঘরানার শাসনপদ্ধতিতে সম্ভব ছিল না।

তার ওপর একের পর এক সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের মাধ্যমে রাশিয়ার এলাকাবিস্তার চলতে থাকে। ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি তুরস্ক-ইরান থেকে খাবলা মেরে বিশাল রাজত্বের মালিক হন ৎসারেরা। তারপর চীন-মাঞ্চুরিয়া-সাইবেরিয়ার দিকেও নজর পড়ে তাদের। সেদিকে পা বাড়াতে গিয়ে বাঁধা আসে নতুন এক শক্তিশালী দেশের কাছে থেকে। ১৯০৫ সালে রুশদের যুদ্ধে হারিয়ে বাকি বিশ্বকে তাঁক লাগিয়ে দিয়ে সুপার পাওয়ার হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে আধুনিক জাপান।

একই বছরে রাশিয়াতে রাজনৈতিক অধিকারের দাবিতে সাধারণ জনগণ রাস্তায় নেমে আসে। ৎসারের রক্ষীবাহিনী রাজধানী পিয়েত্রোগ্রাদে প্রতিবাদকারীদের ওপর হামলা চালালে সারাদেশে আগুন জ্বলে ওঠে। ‘স্বৈরাচারী’ ৎসার নিকোলাস নির্বাচন, সংসদ ও সংবিধান প্রনয়ণের দাবির কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হন।

এভাবে দেখতে দেখতে চলে আসে ১৯১৪ সাল। সুপার পাওয়ারগুলি যে সেকেলে ব্যালান্স অব পাওয়ারের মাধ্যমে বিশ্বে তুলনামূলক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজিয়ে রেখেছিল, তার একিলিস হীলে আঘাত আসে। সার্বিয়ান এক জাতীয়তাবাদীর গুলিতে অস্ট্রিয়া-হাঙেরির যুবরাজ সপত্নীক নিহত হলে সারা ইউরোপের দেশগুলি দু’দলে ভাগ হয়ে প্রাণপণ যুদ্ধ শুরু করে।

বলা বাহুল্য, রাশিয়ার সম্রাট যুদ্ধজয় নিয়ে আশাবাদী হলেও ভেতরে ভেতরে তাঁর শেষ সময় ঘনিয়ে আসছিল। জার্মান আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের কাছে কয়েকটি যুদ্ধে হার মেনে দেশের পশ্চিম ভাগের বিশাল এলাকা থেকে সরে আসতে হয় রুশ বাহিনীকে। পুরো সৈন্যদলের মধ্যে শুরু হয়ে যায় অরাজকতা, পলায়নপ্রবৃত্তি। পালিয়ে যাওয়া সৈন্যরা জড়ো হয় বড় শহরগুলিতে। হাত মেলায় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির সাথে। সে দলগুলিও একেকটি একেক রকম। কেউ শাসনতান্ত্রিক রাজতন্ত্রে বিশ্বাসী, কেউ সংসদীয় গণতন্ত্রে। কিন্তু বামপন্থী সোশাল-রেভলুশনারী (এসআর) পার্টির — লেনিনের বলশেভিক নয় — যে পরিমাণ সমর্থন ছিল তেমনটা আর কারো ছিল না।

১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে যুদ্ধচলাকালীন সময়েই বিপ্লবের মুখে ৎসার নিকোলাস পদত্যাগ করেন। রাষ্ট্রের শাসনভার প্রথমে আসে প্রিন্স ল্ভভের হাতে, তারপর এসআর পার্টির নেতা আলেকজান্ডার কেরেনস্কির কাছে। কিন্তু যুদ্ধে জার্মানির কাছে আত্মসমর্পণ করার কোন চিন্তাভাবনা এ সরকারের ছিল না। বড় শহরগুলির অর্থনৈতিক-সামাজিক সমস্যাগুলির দিকে নজর দেবার মত সক্ষমতাও ছিল না। এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে সমাজতান্ত্রিক কট্টরপন্থী বলশেভিক পার্টি ও অন্যান্যরা। জার্মান সরকারও আগুনে কেরোসিন ঢালার জন্যে সময়মত এক গোপন ট্রেনে করে লেনিনকে সেন্ট পিটার্সবার্গে পাচার করে দেয়। ক্ষেত্র প্রস্তুত হয় আরেকটি বিপ্লব — মতান্তরে কু’য়ের।

সোনার কাহিনীর শুরু বলা যেতে পারে এখানে। আসন্ন অস্থিতিশীলতার আঁচ পেয়ে নতুন রুশ সরকার প্রায় পাঁচশ টন ডবল-ঈগলছাঁপমারা সোনার বার ট্রেনে করে পূর্বে উরাল পর্বতের নিকটবর্তী কাজান শহরে পাঠিয়ে দেয়। অক্টোবর বিপ্লবের পর লেনিনের সহকর্মী ত্রতস্কি গঠন করেন লালবাহিনী। হাতে গোনা যে কটি শহর তখন বলশেভিকদের নিয়ন্ত্রণে ছিল, সেসব থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে ‘শত্রু’ শ্বেতবাহিনীকে উৎখাত করা ছিল তাদের কাজ। আর যার হাতে ৎসারের সোনা পড়বে শেষ পর্যন্ত, এই নিরন্তর গৃহযুদ্ধে তাদেরই জয় অবশ্যম্ভাবী।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




ঘর সামলানোর যুদ্ধে মনোনিবেশের জন্যে বলশেভিকরা জার্মানির সাথে যুদ্ধবিরতির চুক্তি স্বাক্ষর করে ১৯১৭তে। পশ্চিম রাশিয়ার বিশাল এক এলাকা ছেড়ে দেয় তারা। ৎসারের পক্ষে লড়া স্বেচ্ছাসেবক চেক ও পোলিশ সৈন্যরা পড়ে যায় মহাবিপদে। তাদের ইচ্ছে ছিল চলমান যুদ্ধে অংশ নেবার জন্যে পূর্ব ফ্রন্ট থেকে ফ্রান্সের পশ্চিম ফ্রন্টে যাবার।

চেক সেনাদল বিশাল ট্রেনবহর নিয়ে পাঁচ হাজার মাইল পূর্বে ভ্লাদিভস্তকের দিকে যাত্রা শুরু করে। এদের রোমাঞ্চকর অভিযানের কথা আগের একটা লেখায় বলেছি। কাজান শহরে লালসেনারা ঘেরাও বসালে তাদেরকে হারাতে শ্বেতদের সাহায্য করে চেকরা। ঘেরাওয়ের ফাঁক গলে সোনার ট্রেন গায়েব হয়ে যায় আরো পূর্বে ইরকুতস্ক শহরে। কাজানে এসে ত্রতস্কি পান শূন্য খাজাঞ্চিখানা।

যারা রাশিয়া সম্পর্কে কিছুটাও জানেন তারা হয়ত ট্রান্সসাইবেরিয়ান রেলওয়ের কথা শুনে থাকবেন। পশ্চিমে পেত্রোগ্রাদ থেকে শুরু করে পূর্বে ভ্লাদিভস্তক পর্যন্ত ব্যাপ্ত ৫,৭০০ মাইল দীর্ঘ এই রেললাইন বিশাল দেশটির নাড়ি বললে ভুল হবে না। সাইবেরিয়ার খনিজ সম্পদ আর গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলির ওপর মাতবরি ফলাতে হলে এ রেললাইনের নিয়ন্ত্রণ থাকা অত্যাবশ্যক। মজার ব্যাপার হলো, রুশ গৃহযুদ্ধের অধিকাংশ সময় শ্বেত-লোহিত কোন রুশের হাতেই এ রেলপথের নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ছিল আটকেপড়া চেক স্বেচ্ছাসেবক সৈন্যদলের হাতে। তারা স্বদেশের স্বাধীনতার আশায় অস্ট্রিয়া-হাঙেরির বিরুদ্ধে রুশদের পক্ষে যুদ্ধে শরিক হয়।

এই রেলবিচ্ছিন্নতার সুযোগে সাইবেরিয়ার ওমস্কে বলশেভিকবিরোধীরা কিছুটা স্থিতিশীল পাল্টা সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়। প্রথমদিকে এ সরকারে বামপন্থী এসআর যেমন ছিল, তেমন ছিল ৎসারের প্রচ্ছন্ন সমর্থক গোষ্ঠী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১৯১৮তে কুয়ের মাধ্যমে ক্ষমতাদখল করেন ৎসারের নৌবাহিনীর এডমিরাল আলিয়েকসান্দর কলচাক।

রুশদের হয়ে উত্তরমেরু অভিযানে অংশ নিয়ে বিখ্যাত হয়েছিলেন ৪৫ বছরবয়েসী এই নৌ অফিসার। জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আহত ও বন্দী হন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে জার্মান নৌবাহিনীকে রুখতে বাল্টিক সাগরে সামুদ্রিক মাইন স্থাপন অভিযানের সফলতাও ছিল তাঁর কৃতিত্ব। ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের সময় কৃষ্ণসাগরের তুর্কী অভিযান থেকে অব্যাহতি পান। পিয়েত্রোগ্রাদে গিয়ে কেরেনস্কিকে নৌসেনাদের নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতি অবহিত করেন। তাঁর সুপারিশ ছিল, সশস্ত্র বাহিনীতে মৃত্যুদন্ডের শাস্তি পুর্নবহাল করার। কেরেন্সকি সে উপদেশ শুধু যে অগ্রাহ্য করেন তা নয়, ক্ষমতার দ্বন্দ্বের ভয়ে কলচাককে যুক্তরাজ্যে একটি অ্যাসাইনমেন্টে পাঠিয়ে দেন।

অক্টোবর বিপ্লব যখন শুরু হয়, তখন কলচাক যুক্তরাষ্ট্র হয়ে জাপানে। সেখান থেকে ভ্লাদিভস্তক হয়ে সোজা সাইবেরিয়া চলে যান তিনি। বলশেভিকবিরোধী বাহিনীগুলির একটির নিয়ন্ত্রণ নেন। সাইবেরিয়ায় কলচাকের পাশাপাশি ফিনল্যান্ড-এস্তোনিয়াতে ইউদেনিচ, ইউক্রেনে দেনিকিন-ভ্রাঙেল প্রমুখ ছিলেন শ্বেতবাহিনীর নেতৃত্বে। এদের পরস্পরের মধ্যে পারতপক্ষে যোগাযোগ ও সামঞ্জস্য না থাকায় ত্রতস্কির লালবাহিনী ক্রমে একে একে এদেরকে হারাতে সক্ষম হয়।

দক্ষিণ রাশিয়ার ইউক্রেনে দেনিকিনের অধীনস্থ শ্বেত বাহিনীর ব্যবহৃত ডাকটিকেট, ১৯১৯।
রাশিয়ায় আটকে পড়া চেক সৈন্যরা সুসংগঠিত ছিল। তাদের নিয়ন্ত্রিত সাইবেরিয়ান রেলপথে একটি ছোটখাট রাষ্ট্র গড়ে ওঠে। সেখানে চালু ছিল এ ডাকটিকেট (১৯১৯)।
দক্ষিণ রাশিয়ার ইউক্রেনে দেনিকিনের অধীনস্থ শ্বেত বাহিনীর ব্যবহৃত ডাকটিকেট, ১৯১৯।
উত্তর-পশ্চিম রাশিয়ার বাল্টিক উপকূল, ফিনল্যান্ড ও এস্তোনিয়াতে জেনারেল ইউদেনিচের নেতৃত্বাধীন শ্বেতবাহিনি এ ডাকটিকেট ব্যবহার করে, ১৯১৯।
কৃষ্ণসাগরে রুশ নৌবাহিনী ছিল ৎসারের অনুগত। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন অ্যাডমিরাল ভ্রাঙেল। তাদের ব্যবহৃত ডাকটিকেট, ১৯২১।

১৯১৮তে ওমস্কে প্রভিশনাল অল-রাশিয়ান গভার্নমেন্টের শাসনভার দখল করেন কলচাক। এর মাসদুয়েক আগে ৎসার নিকোলাস সপরিবারে বলশেভিকদের হাতে নিহত হন। তাই বলশেভিকবিরোধী সমগ্র রাশিয়ার ‘সুপ্রীম লীডার’ হিসাবে নিজেকে ঘোষণা করতে কোন সমস্যা হয়নি কলচাকের।

ভাইস-অ্যাডমিরাল আলিয়েকসান্দর ভাসিলিয়েভিচ কলচাক, ১৯১৬।

একটা কথা আছে, অ্যাবসলুট পাওয়ার করাপ্টস অ্যাবসলুটলি। পরবর্তীতে কম্যুনিস্টদের জন্যে কথাটি যতটা সত্য, কলচাকের জন্যেও ততটা। ক্ষমতা দখল করলেও সফল রাজনীতিবিদের যে দূরদর্শিতা ও সমঝোতার গুণ দরকার, তা দেশপ্রেমী কলচাকের ছিল না। প্রথমেই বামপন্থী শরিকদল এসআর সদস্যদের সরকার থেকে পদচ্যুত করেন। এসআর পার্টির একটি ব্যর্থ পাল্টা কুয়ের পর দলটির পাঁচশ সদস্যকে হত্যা করে কলচাকের অধীনস্থ কসাক সেনাদল।

যে চেক লেজিয়ন কলচাকের কাছে সোনার ট্রেন এনে দিয়েছিল, তারাও কলচাকের স্বেচ্ছাচারে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। পশ্চিম ফ্রন্টের যুদ্ধও ১৯১৯এ শেষ। নতুন রাষ্ট্র চেকোস্লোভাকিয়ার ততদিনে গোড়াপত্তন হয়েছে। রুশদের রক্তাক্ত অন্তর্ঘাতে অংশ নেবার পরিবর্তে স্বদেশপ্রত্যাবর্তন হয়ে দাঁড়িয়েছে চেকদের মূল লক্ষ্য।

কলচাকের তাঁড়িয়ে দেয়া এসআর পার্টিও ততদিনে লালবাহিনীর সাথে যোগ দিয়েছে। ত্রতস্কির সৈন্যরা সমানে ধেঁয়ে আসছে সাইবেরিয়ার আরো অভ্যন্তরে। এসআর পার্টির সাথে চেকরা ১৯২০এ গোপনে রফা করে যে পূর্বে নির্বিঘ্ন যাত্রা ও রেলরসদের বিনিময়ে কলচাক, তাঁর প্রধানমন্ত্রী আর সোনার ট্রেনবহর তুলে দেয়া হবে তাদের হাতে। কলচাক চেকদের ফাঁদে পা দিলেন। এসআর পার্টি তাঁকে কদিন বন্দী করে রাখে। তারপর বলশেভিকরা ইরকুতস্কের নিয়ন্ত্রণ নিলে কলচাক আর প্রধানমন্ত্রী পেলিয়ায়েভকে জনতার শত্রু আখ্যা দিয়ে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদন্ড দেয়।

ইরকুতস্ক শহরে অ্যাডমিরাল কলচাকের স্মৃতিসৌধ।

ব্রিটেন-যুক্তরাষ্ট্র-জাপান ও অন্যান্য সকল সুপারপাওয়ারের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও কলচাকের সাইবেরীয় সরকারের এমন পতন হয়। যুক্তরাজ্যের চার্চিল তাঁর সরকারকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিতে চেয়েছিলেন, পারেননি প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলেন আর মার্কিন প্রেসিডেন্ট উইলসনের কারণে। কেরেনস্কি ততদিনে উইলসনের রুশবিষয়ক উপদেষ্টা। তাঁর প্ররোচনায় উইলসন ভেবেছিলেন কলচাক ৎসারপন্থী ও স্বৈরাচারী। মতবিরোধীদের নির্বিচারে হত্যা, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাবিধানের বিরোধিতা, আর কলচাকের নাম নিয়ে অপমানসূচক কিছু বলা যাবে না — এধরনের আইনের কারণেও সরাসরি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সাহায্য থেকে বঞ্চিত হয় কলচাকের সরকার।

কলচাক পদত্যাগের আগে ইউক্রেনের শ্বেতরুশবাহিনীপ্রধান দেনিকিনকে সুপ্রীম লীডার ঘোষণা করে যান। সাইবেরীয় শ্বেতবাহিনী ইরকুতস্ক থেকে বিশাল এক লম্বা যাত্রা শুরু করে ভ্লাদিভস্তকের দিকে। সে ছিল এক বিচিত্র কাফেলা। চেক সৈন্যরা ছিল তার রক্ষক। রুশ সাম্রাজ্যের বহু অভিজাত যারা সময়মত টের পেয়েছিল বলশেভিক মানেই বিপদ, তারাও তাদের অস্থাবর সম্পত্তি নিয়ে এসকল সৈন্যদের ঘুষ দিয়ে তাদের সহযাত্রী। এই গ্রেট সাইবেরিয়ান আইস মার্চ প্রথমে ইরকুতস্ক থেকে চিতা, তারপর চিতা থেকে মাঞ্চুরিয়ার পোর্ট আর্থার আর কামচাতকা উপদ্বীপের ভ্লাদিভস্তক গিয়ে পৌঁছে ১৯২১ সাল নাগাদ। তারপর সেখান থেকে জাহাজ নিয়ে কেউ জাপান, কেউ আমেরিকা হয়ে ইউরোপে পৌঁছে। পথিমধ্যে ক্ষুধায়, ঠান্ডায়, ক্লান্তিতে, রোগজরায় প্রাণ হারায় অগণিত সৈন্য। এদের মধ্যে ছিলেন দলনেতা জেনারেল কাপেলও।

চিত্রশিল্পীর কল্পনায় জেনারেল কাপেলের নেতৃত্বে গ্রেট সাইবেরিয়ান আইস মার্চ, ১৯১৯।

সেই সোনাগুলির কি হল? চেকরা সে ট্রেনগুলোর সবই কি বলশেভিকদের হাতে তুলে দিয়েছিল? নাকি চালাকি করে দু’তিনটে জুড়ে নিয়েছিল নিজেদের পূবমুখী কাফেলার সাথে? লোককাহিনী তাই বলে। সেই ট্রেনবহরের একটিই নাকি দুর্ঘটনাক্রমে ছিঁটকে পড়ে গেছিল বৈকাল হ্রদের মধ্যে। বাপ-দাদাদের মুখে অন্তত তাই শুনে এসেছে ইরকুতস্কবাসী। আবার আরেক আঞ্চলিক গল্প অনুযায়ী, কলচাকই নাকি ধরা পড়ার আগে কয়েকটি ট্রেনের বগি উত্তরের পাহাড়ের জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে রাখার নির্দেশ দেন। আর তারপর সেসব সৈন্যদের সেখানেই গুলি করে মারে তাঁর বিশ্বস্ত অফিসাররা।

সাইবেরিয়ার কলচাক সরকারের স্বেচ্ছাসেবক শ্বেতরক্ষী বাহিনী, ১৯১৯।

আধুনিক যুগে এধরনের গালগল্প এখনো চলে সাইবেরিয়াতে। শাসক-শাসনব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়, কিন্তু সত্যটা কখনোই বেরোয় না এদেশে। যা বেরোয়, তা কেবল প্রপাগান্ডা। জনগণও জানে সে কথা। তাই লোকমুখে যা চলে, তাই সত্য এখানে। তাই বৈকালের মাইলগভীর পানিতে, কিংবা ঘন সাইবেরিয়ান পাইন-সীডার-বার্চের জঙ্গলে এখনো মানুষ খুঁজে ফেরে ৎসারের হারানো স্বর্ণরাজি। খুঁজতে গিয়ে হারিয়েও যায় অনেকে। ধনভান্ডারের গল্পে এসে তখন যুক্ত হয় দুর্ভাগা অ্যাডমিরাল কলচাকের প্রেতাত্মার অভিশাপ।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...






আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




প্রাচীন বিশ্বের বাণিজ্য

সুইডেনে আবিষ্কৃত আব্বাসী খেলাফতের দিরহাম।

ছবির রৌপ্যমুদ্রাগুলি আব্বাসী খেলাফতের দিরহাম। মুদ্রার পিঠে খলীফার নামের পাশাপাশি আল্লাহ-রাসুলের নামে কালেমা লেখা। এ মুদ্রা খুব একটা দুর্লভ নয়। তবে এগুলি যে জায়গায় আবিষ্কৃত হয়েছে, সেটাই পিলে-চমকানো ব্যাপার! উৎপত্তিস্থল বাগদাদ কিংবা দামেস্ক থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মাইল উত্তরে, একাধিক পর্বত-সাগর-নদী পেরিয়ে সুইডেনের স্টকহোমের কাছে এক সমাধিঢিবির মধ্যে পাওয়া গেছে এগুলি।

ভাইকিং ‘নৌকাসমাধিতে’ কুফী হরফে আল্লাহ-আলীর নাম এম্ব্রয়ডার করা সিল্কের কাপড়ও নাকি পেয়েছেন বলছেন সুইডিশ গবেষকরা। আরেক জায়গায় একটা আংটিও পাওয়া গেছে যার গায়ে নাকি ‘আল্লাহর জন্যে’ আরবীতে খোদাই করা।

ভাইকিং আর আব্বাসী খেলাফতের মধ্যে দশম/একাদশ শতকে একটা যোগসূত্র যে থেকে থাকতে পারে, এটা অনেকের কল্পনাতীত। দুটি কালচারের মধ্যে হাজার হাজার মাইল দূরত্ব। অবশ্য প্রত্নতত্ত্ববিদরা এরকম উদাহরণ প্রায়শই পান। এর যৌক্তিক ব্যাখ্যাও রয়েছে।

সুইডেনের ভাইকিং সমাধিতে আবিষ্কৃত রেশমের কাপড়ে এম্ব্রয়ডার করে আল্লাহ ও আলী লেখা।
সুইডেনের ভাইকিং সমাধিতে আবিষ্কৃত আংটিতে লিল্লাহ লেখা।

এরকম আরো ভূরি ভূরি উদাহরণ দিতে পারি। বঙ্গোপসাগরের তীরে পন্ডিচেরির কাছে তামিলনাড়ুর আরিকামেডুতে গ্রীক-রোমান ধাঁচের একটি বসতি আবিষ্কৃত হয়েছে। সেখানে পাওয়া গেছে রোমান অ্যাম্ফোরা — ওয়াইন সংরক্ষণ ও স্থানান্তরের জন্যে বড় বড় মাটির বোতল। আরো পাওয়া গেছে রোমান-গ্রীক ও ভারতীয় ডিজাইনে ছাঁপমারা মাটির পাত্র। আর সম্রাট অগাস্টাসের মুখাবয়বখচিত স্বর্ণমুদ্রা।

জাপানের সমাধিস্তূপে পাওয়া নীলরঙের কাঁচের থালা নিয়েও জাপানী রসায়নবিদরা অনেক গবেষণা করেছেন। কারণ এরকম নিদর্শন জাপানে আর পাওয়া যায়নি। তাদের রিসার্চ থেকে বেরিয়েছে যে, রোমান সাম্রাজ্যে এ ধরনের থালা ব্যবহৃত হত, আর সেসবে অ্যান্টিমোনির মত বিশেষ ধাতু যে যে পরিমাণ পাওয়া গেছে, তা একই অনুপাতে রয়েছে থালাটিতে। অর্থাৎ রোমের বিলাসদ্রব্য কিভাবে যেন এসে পড়েছে ছয় হাজার মাইল দূরে জাপানে।

তামিলনাড়ুর আরিকামেডুর কাছে পুদুক্কোটাইয়ে আবিষ্কৃত রোমান সম্রাট অগাস্টাসের মুদ্রা।
জাপানের সামাধিস্তূপে আবিষ্কৃত রোমান কাঁচের থালি।

এতক্ষণ যেসব উদাহরণ দিলাম, তা বড়জোর এক হাজার থেকে দু’হাজার বছর আগের। এদের থেকেও পুরনো উদাহরণ হলো, প্রাচীন মিশরের তিন হাজার বছরের পুরনো মামির চুলে সিল্কের সুতোর আবিষ্কার। সে সময়ে একমাত্র চীনাদেরই আয়ত্ত ছিল সিল্ক তৈরির চাবিকাঠি। তার মানে দাঁড়াল, ছয় হাজার মাইল অর্থাৎ পৃথিবীর পরিধির প্রায় একচতুর্থাংশ পাড়ি দিয়ে এসে মিশরীয় অভিজাতদের শোভাবর্ধন করেছে রেশমী সুতো।

আজকের দুনিয়ার কথা‌ই ভাবুন। বাংলাদেশে বসে ‘আই লাভ এনওয়াই’ টিশার্ট পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন আপনি। শার্টের আমদানি হয়ত মার্কিন মুল্লুক থেকে। আবার মার্কিন মুল্লুকের আইডিয়া কাজে লাগিয়ে বানানো শার্টটা খুব সম্ভব বাংলাদেশের গার্মেন্টশিল্পেরই প্রস্তুত। কোথাকার মাল কোথায় এসে পড়ল, অথচ আমরা আজ অবাক হই না।

চীনা সমাধিসৌধে আবিষ্কৃত রোমান পাত্র।

আজ থেকে তিন চার হাজার বছর আগেও একই কাহিনী ঘটেছে। আজকের পরিসরে না হলেও সেপরিমাণটা তুলনামূলকভাবে বড়ই। পরিমাণটারও উত্থানপতন হয়েছে।

আর বিভিন্ন সভ্যতার যে কর্মকান্ড এ ম্যাজিকটা যুগযুগান্তরে ঘটিয়েছে, তার নাম ট্রেড — বাণিজ্য। সোনা-রূপার তৈরি মুদ্রা কিংবা বুলিয়ন আবিষ্কারের বহু আগে থেকেই মানবজাতি একে অন্যের সাথে বাণিজ্যের মাধ্যমে যোগাযোগ করে আসছে। টাকার ব্যবহার না থাকলেও বার্টার বা বিনিময়ের মাধ্যমে বাণিজ্য চলেছে। আর সওদা আদানপ্রদানের পাশাপাশি চলেছে ধর্মীয়, দার্শনিক, প্রযুক্তিগত, ভাষা-সাংস্কৃতিক মতবিনিময়।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




প্রাচীন মানুষ কৃষিকাজ শিখে থিতু হতে হতে শুরু হয় নগরসভ্যতার। সমষ্টিগত শ্রমের দক্ষ প্রয়োগের মাধ্যমে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা আসে মানুষের। কিন্তু বহু আদি নগরসভ্যতায় একটা সমস্যা খুঁজে পান প্রত্নতত্ত্ববিদরা। যদিও খাদ্যশস্য উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে বড় জনসংখ্যার ভরনপোষণ সম্ভব, তাতে খাদ্যের বৈচিত্র কমে যায়। সুষম পুষ্টির অভাবে আদি নগরবাসীরা ছিল শিকারী-সংগ্রহকারী যাযাবরদের থেকে শারীরিকভাবে দুর্বল। ফলে ‌অনেক আদি নগর বহির্শত্রুর আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যায়।

কিন্তু দক্ষতা বাড়ানোর জন্যে যে কাজটা তারা সাধন করেছে তা হলো শ্রমের বিশেষায়িতকরণ। আদি নগরেই দেখা যায় একেকটি পাড়ার পেশা একেক রকম। কেউ কৃষক, কেউ কুম্ভকার, কেউ সূত্রধর। নগরের মধ্যেই আঞ্চলিক বাণিজ্যের যাত্রা শুরু। তারপরে খাদ্য থেকে শুরু করে অন্যান্য কাঁচামালের বৈচিত্র্যের জন্যে স্থানীয় আর সব জনবসতির সাথে আদানপ্রদান শুরু।

নব্যপ্রস্তরযুগের পরবর্তী ক্যালকোলিথিক যুগে, অর্থাৎ ব্রোঞ্জের আবিষ্কারের প্রাক্কালে বিশেষায়িত শ্রমের আবির্ভাবের সাথে সাথে বৈশ্বিক না হলেও আঞ্চলিক বাণিজ্যের শুরু। সেটা কমপক্ষে সাত/আট বাজার বছর আগের কথা। তারপর চার হাজার খ্রীষ্টপূর্বাব্দে মেসোপটেমিয়াতে গরুর মত ভারবাহী পশুকে পোষ মানানোর ফলে লং ডিসট্যান্স ট্রেডিংয়ের রাস্তা খুলে যায়।

মেসোপটেমিয়ার সুমেরীয়দের সাথে ময়েঞ্জোদারো-হরপ্পার যোগাযোগটা বৈদেশিক বাণিজ্যের সবচে প্রাচীন উদাহরণ। স্থল ও নৌপথে ভারতের মশলাপাতি ও সেমিপ্রেশাস রত্নরাজি এসে পৌঁছত উরের মত ইরাকের বড় শহরগুলিতে। হরপ্পান সভ্যতার টেরাকোটা সীল আর আবক্ষ মুর্তির মধ্যেও মেসোপটেমিয়ার সাংস্কৃতিক প্রভাব হুবহু দৃশ্যমান। এ বাণিজ্য তুঙ্গে ওঠে আড়াই হাজার খ্রীষ্টপূর্বাব্দে। আর প্রাক-আর্য হরপ্পান নগরগুলির পতনের পর এ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

ময়েঞ্জোদারোর এই মূর্তিটি কোন রাজার নয়, সম্ভবত অলিগার্কের। শিল্পে মেসোপটেমিয়ার সাংস্কৃতিক প্রভাব সুস্পষ্ট।
ঊর শহরে আবিষ্কৃত কার্নেলিয়ান পাথরের নেকলেস। শিল্প দেখে মনে হয় সিন্ধু সভ্যতার থেকে আমদানি।

এরপর মিশরে পোষ মানে ভারবাহী গাধা, সে তিন হাজার খ্রীষ্টপূর্বে। তার পাশাপাশি নীলনদের নৌপথে চলে উত্তর-দক্ষিণ বাণিজ্য। কৃষিজমির দখল আর আঞ্চলিক নৌবাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণের খাতিরেই সম্ভবত মিশরে আবির্ভাব ঘটে প্রথম সাম্রাজ্য কিংবা কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার। শাসকদের কাজ হলো প্রজাদের কৃষিজমির ভাগবন্টন আর আঞ্চলিক বাণিজ্যের নিরাপত্তাবিধান আর যাত্রাপথের রক্ষণাবেক্ষণ। এসবের ব্যয়নির্বাহের জন্যে কর ধার্য হত। অর্থ দিয়ে না হলেও খাদ্যশস্য আর বাণিজ্যের ফেরির ভাগ দিয়ে সে কর পরিশোধিত হত। অর্থাৎ যেখানে মিষ্টির সুবাস, মাছির উৎপাত সেখানেই। তার মানে এই নয় যে, ইতিহাসে বাণিজ্যই সবসময় রাজা-সম্রাটদের জন্ম দিয়েছে।

ঊটও পোষ মানে তিন হাজার খ্রীষ্টপূর্বাব্দের আশপাশ দিয়ে। দক্ষিণ আরবের ইয়েমেন-ওমানের স্থলপথ, হর্ন অফ আফ্রিকার সোমালিয়া, লোহিত সাগরের নৌপথ ইত্যাদির যোগসাজশে প্রাচীন ভারতের সাথে যুক্ত হয় মিশর। ১২০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে ‘ব্রোঞ্জ এইজ কলাপ্সের’ আগ দিয়ে মিশরে সিডার কাঠ আমদানি হত লেবানন থেকে, সাইপ্রাস থেকে তামা-ব্রোঞ্জ, দক্ষিণ আরব থেকে সুগন্ধি, নুবিয়া থেকে সোনা, প্রভৃতি।

হিট্টাইট আর মিশরীরা ছিল সেযুগের সুপারপাওয়ার, আর সভ্য বিশ্বের হেন শহর নেই যাদের সাথে যোগাযোগ ছিল এ দু’য়ের। সিরিয়ার মিত্তানি মিত্রদের সাথে পত্রযোগাযোগের পান্ডুলিপি আবিষ্কৃত হয়েছে, যেগুলি পড়লে মনে হবে সে যুগের কূটনীতি এ যুগের থেকে এমন ভিন্ন কিছু ছিল না। সে সব পত্রে বিলাসদ্রব্যের বিনিময়ে কেউ চাইছে মিশরীদের প্রতিরক্ষা। কেউ পাঠাচ্ছে বিশাল উপঢৌকন, এ আশায় যে ভবিষ্যতে তার প্রতিদান পাওয়া যাবে। বিভিন্ন আদানপ্রদানের রশিদ এগুলি। পাওয়া গেছে মিশরের তেল-আল-আমারনাতে।

১৪২০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের মিশরী বাণিজ্যজাহাজ।
চতুর্থ খ্রীষ্টপূর্ব শতকের ফীনিশীয় জাহাজ।

এরপর এক অন্ধকার যুগের সূচনা হয়ে, যাকে অনেক প্রত্নতত্ত্ববিদ নাম দিয়েছেন ‘ব্রোঞ্জ এইজ কলাপ্স’। ‘সীপিপল’ নামক অজানা জাতির আগ্রাসনে মধ্যপ্রাচ্যের সভ্য শহরগুলির একে একে পতন ঘটে। কমে আসে কূটনৈতিক যোগাযোগ। ভেঙে পড়ে কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা আর বড় সাম্রাজ্যগুলি। অর্থাৎ মাছিরা ঝেঁটিয়ে বিদায়। তাই বলে মিষ্টি আদানপ্রদান থেমে থাকেনি। এই অরাজকতার মধ্যেই উত্থান ঘটে নতুন এক বণিকজাতির, যাদের নাম ফীনিশিয়ান। এরা নতুন ধরনের দ্রুত জাহাজ নিয়ে বেরিয়ে পড়ে দিকে দিকে। দূরদূরান্তে স্থাপন করে বাণিজ্য কলোনি। বড় সাম্রাজ্যের জন্ম না দিলেও তাদের একটা বড় লেগ্যাসি আমরা এখনো বহন করে চলেছি, যার নাম অ্যালফাবেট।

পৃথিবীর অপর প্রান্ত চীনে অরাজকতার যুগশেষে দ্বিতীয় খ্রীষ্টপূর্ব শতকে নতুন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন সম্রাট শিহুয়াংদি। তার রাজদূত মরুভূমি-পর্বত পেরিয়ে মধ্য এশিয়ায় আসে যুদ্ধে কাজে লাগানোর মত দ্রুত ঘোড়ার খোঁজে। সে বাণিজ্য সম্পর্ক থেকেই শুরু হয় সিল্করোডের পূর্বভাগের।

ফারগানার ঘোড়া, এই ‘স্বর্গের’ ঘোড়ার জন্যেই চীনারা মধ্য এশিয়ার সাথে বাণিজ্যসম্পর্ক স্থাপন করে, যার থেকে সিল্করোডের শুরু।
প্রাচীন রোমের অভিজাতদের কাছে চীনা রেশমের কাপড়ের বেশ কদর ছিল।
চীনের সমাধিসৌধে আবিষ্কৃত বিজ্যান্টিন স্বর্ণমুদ্রায় সম্রাট কন্সট্যান্সের মুখাবয়ব।

আর রোমান সাম্রাজ্যও দ্বিতীয় খ্রীষ্টীয় শতকে ইরান ও মধ্য এশিয়ার মাধ্যমে যুক্ত হয় চীনের বাণিজ্যপথের সাথে। ইউরোপ থেকে যেত সোনা আর চীন থেকে রেশম। আর আজকের ট্রেড ওয়ারের শুরুও এই সময়ে। রোমান অভিজাতরা চীনা রেশমের জন্যে রাজ্যের স্বর্ণভান্ডার প্রায় নিঃশেষ করে ফেলে। সম্রাট টাইবেরিয়াস বাধ্য হয়ে সিল্কের ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। চীনও রেশমের গোপন প্রস্তুতপ্রণালী আগলে রেখেছিল, যাতে রোম সাম্রাজ্যের কারিগররা প্রতিযোগিতায় আবির্ভূত না হয়।

রোমানদের আগেই সম্ভবত গ্রীকরা বাণিজ্য কলোনি স্থাপন করেছিল ভারতের আরিকামেডুতে। পেরিপ্লাস অফ দ্য এরিথ্রেয়ান সী নামের গ্রীক পান্ডুলিপিতে এ বন্দরের উল্লেখ আছে। গ্রীকদের পরে রোমান সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে আসে এই বাণিজ্যবসতি। বহু দেশীবিদেশী বণিকদের স্থায়ী-অস্থায়ী নিবাস ছিল এই ভারতীয় শহরটি। আনুমানিক সময়কাল দ্বিতীয় খ্রীষ্টপূর্ব শতক থেকে সপ্তম খ্রীষ্টীয় শতক।

রোম, আর পরে বিজ্যান্টিন, সাম্রাজ্যের সাথে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথ যুক্ত ছিল। একে বলে ইনসেন্স রাউট। ইয়েমেনের স্থানীয় গাছের বাকল থেকে তৈরি হত দুটি সুগন্ধি, এগুলি দিয়ে এখনো আতর তৈরি হয়। এদের নাম ফ্রাংকিনসেন্স ও মাঢ়। রোমান দেবালয়ে পূজোর কাজে এদের ব্যবহার ছিল।

ইয়েমেন থেকে শুরু করে লোহিত সাগরের তীরের জেদ্দা, তারপর জর্দানের পেত্রা হয়ে মধ্যোপসাগরীয় বন্দরে এসে জাহাজে উঠত এই মালামাল। যীশুখ্রীষ্টের জন্মলগ্নে এগুলিই উপহার নিয়ে এসেছিলেন তিন মেজাই। তৃতীয় খ্রীষ্টপূর্ব শতক থেকে দ্বিতীয় খ্রীষ্টীয় শতকের মধ্যে এই ইনসেন্স রাউট উপকূলীয় আরব শহরগুলিকে সমৃদ্ধি এনে দিয়েছিল।

ইনসেন্স রাউটের অন্যতম স্থলবন্দর জর্দানের পেত্রা।

ইসলামী ঐতিহ্যে যদিও বলা হয় নবীজীর বাণিজ্যে হাতেখড়ি এই পথের মক্কা-সিরিয়া অংশে, তাতে একটা সমস্যা রয়েছে। গথদের হাতে ততদিনে রোমের পতন হয়েছে, আর বিজ্যান্টিনরা ঘোরতর খ্রীষ্টান। এসব সুগন্ধির বড় বাজার তখন আর নেই ইউরোপে।

রোমের পতনপরবর্তী সময় বিজ্যান্টিনরা চীনের সাথে সিল্করোডের মাধ্যমে বাণিজ্য করতে থাকে। চীনা সমাধিতে বিজ্যান্টিন মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। রাজনৈতিক শত্রু ইরানিদের পাশ কাটিয়ে মধ্য এশীয় সগডিয়ানদের মাধ্যমে সরাসরি সিল্কের বাজার পায় তারা। ভারত থেকেও মধ্য এশিয়ার মধ্য দিয়ে বৌদ্ধধর্ম পাচার হয়ে গেছে চীনে একই সময়ে। মধ্য এশিয়ার রাজ্যগুলি প্রকৃতার্থেই ছিল মানুষের মিলনমেলা।

ভাইকিংরা এ চিত্রে এসে যুক্ত হয় এরকম সময়েই। নবম/দশম খ্রীষ্টীয় শতকে সুইডিশ ভাইকিংরা ভলগা নদীর তীর ধরে লুটতরাজ করতে করতে অনেক দক্ষিণে ইউক্রেনের নভগরোদ আর কিয়েভ শহরে এসে পড়ে। সেখানকার স্লাভ জাতির মানুষ এই ‘রুস’দেরকে রাজা মানা শুরু করে। গোড়াপত্তন হয় প্রাচীন রাশিয়ার। এই ভাইকিংয়ের দল আরো দক্ষিণে কৃষ্ণসাগরের তীরে এসে টক্কর খায় বিজ্যান্টিনদের সাথে।

ততদিনে লুটতরাজ ছেড়ে ভাইকিংরা নতুন পেশা ধরেছে, বাণিজ্য আর ভাড়াটে সৈন্যগিরি। মার্সেনারি হিসাবে বিজ্যান্টিন সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাওয়া পড়ত তাদের। সে সুবাদে একটু বাণিজ্যও করে নিত। এভাবেই সম্ভবত আব্বাসী খেলাফতের সাথে তাদের যোগাযোগ। আর আব্বাসীদের চকচকে রূপার ধাতব মুদ্রার প্রতি তাদের ছিল বিশেষ টান। আরব পরিব্রাজক ইবনে ফাদলানও উত্তরের দেশে ভ্রমণ করে এসে ভাইকিংদের নৌকা-শেষকৃত্যের একটা বিবরণী লিখে গেছেন আরবীতে।

এ হলো মোটামুটি সভ্য দেশগুলির থেকে পাওয়া বাণিজ্যের লিখিত বিবরণী। নিরক্ষর অনেক দেশও যে বৈদেশিক বাণিজ্যে প্রাচীনকাল থেকে যুক্ত ছিল তার প্রমাণও প্রত্নতত্ত্ববিদরা পেয়েছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের ওয়েলসের চার হাজার বছরের পুরনো তামার খনি থেকে মধ্যোপসাগরীয় সভ্য দেশগুলোতে রপ্তানী। কর্নওয়ালের টিনের খনিও সেরকম তিন হাজার বছরের পুরনো। এ দুয়ের তামা আর টিন মিলে সভ্য দেশগুলিতে তৈরি হত ব্রোঞ্জের জিনিসপত্র।

বাল্টিক উপকূল থেকে দক্ষিণে রোম-গ্রীস পর্যন্ত বিস্তৃত অ্যাম্বার রোড তিন হাজার বছরের পুরনো। মধ্যোপসাগর ছাড়িয়ে মিশরের তুতানখামুনের মামির গয়নাতেও জায়গা করে নিয়েছিল বাল্টিকের অ্যাম্বার। সেটা সাড়ে তিন হাজার বছর আগের কথা। ভাইকিং-আরব বাণিজ্যের যেমন লিখিত বিবরণ নেই, ইউরোপের অধিকাংশ এলাকা তখন নিরক্ষর থাকার কারণে অ্যাম্বার রোডেরও তেমন কোন বিবরণী পাওয়া যায়না।

ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষও ছিল নিরক্ষর। কিন্তু তাতে বাণিজ্য থেমে থাকেনি। মূলত নৌপথে তারা চীন থেকে জেড পাথরের আমদানি-রপ্তানি করে গেছে। কমপক্ষে তিন হাজার বছর আগে এই সওদাগরির শুরু।

মিশরের ফারাও তুতানখামুনের ব্রেস্টপ্লেটের নিচের অংশের চারটি অ্যাম্বার পাথর এসেছে সুদূর বাল্টিক উপসাগর থেকে।
ফিলিপাইনের জেড পাথরে তৈরি লিংলিং-ও গয়না রপ্তানি হত পুরো দক্ষিণপূর্ব এশিয়াতে।

আর সাব-সাহারান আফ্রিকার থেকে রোমান সাম্রাজ্য আর আরব খেলাফতে গেছে সোনা, লবণ, আর কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস।

পরবর্তী যুগে আরো বহু ট্রেড রুট বিশ্বের মানুষকে সংযুক্ত করেছে। পূর্ব আফ্রিকার জিরাফ বাঙ্গালার সুলতানের উপঢৌকন হিসাবে গিয়ে পৌঁছেছে চীনা সম্রাটের দরবারে। পশ্চিম আফ্রিকার আইভরি হ্যান্ডিক্রাফট শোভা বাড়িয়েছে পর্তুগীজ ডাইনিং টেবিলের। ইন্দোনেশিয়ার মশলা সোনার দরে বিক্রি হয়েছে হল্যান্ড-ইংল্যান্ডের বন্দরে। আমেরিকার আনারস, আলু, কোকো, রাবার, টমেটো, তামাক পাল্টে দিয়েছে বাকি বিশ্বকে।

পঞ্চদশ শতকে চীনা সম্রাটের জন্যে বাংলার সুলতান সাইফউদ্দিন উপঢৌকন পাঠান এই জিরাফ। বহন করে নিয়ে যায় খোজা সেনাপতি জংহোর জাহাজবহর। সাইফউদ্দিন জিরাফটি পান কেনিয়ার মালিন্দির রাজার কাছ থেকে, বাণিজ্যসূত্রে। চীনে জিরাফটি ব্যাপক সাড়া ফেলে, কারণ কাল্পনিক প্রাণী জিলিনের সাথে এর মিল। ফলে সম্রাটের শাসনক্ষমতা পাকাপোক্ত হয়।

শুধু যে বস্তু আর জ্ঞানের আদানপ্রদান হয়েছে তা নয়, মানুষের কাফেলা একেকসময় একেকমুখী হয়েছে। কখনো পরদেশেই রয়ে গেছে বিদেশী বণিক। হরপ্পান সভ্যতার একটি পরিবারের সমাধি আবিষ্কৃত হয়েছে ইরানে। ধরা যেতে পারে যে এরা ছিল সভ্যতার প্রথম ইমিগ্রান্ট। বিদেশ-বিভুঁইয়ে নিজেদের ছোট একটি কলোনি হয়ত তৈরি করেছিল তারা, যেমনটা করেছিল ফীনিশীয় (কার্থেজ), রোমান (মধ্য এশিয়া), গ্রীক (স্পেন), পারসিক (ইয়েমেন), চীনা (ইন্দোনেশিয়া), আরব (আফ্রিকা), আর রেনেসাঁস পরবর্তী যুগের অন্যান্য ইউরোপীয় জনগোষ্ঠী। এদের যাতায়াত কখনো ছিল বাধাহীন নিরাপদ, কারণ নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করেছে কোন না কোন বড় সাম্রাজ্য (প্যাক্স রোমানা — ইউরোপীয় বাণিজ্য, প্যাক্স মোঙ্গোলিকা — সিল্ক রোড, অধুনা প্যাক্স আমেরিকানা — বিশ্বব্যাপী মুক্তবাজার প্রতিষ্ঠার ক্রেডিট এদেরই‌ প্রাপ্য)। আবার কখনো কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার অভাবে তা ছিল বিপৎসংকুল।

কিন্তু এটা মানতেই হবে, যতই বাধাবিপত্তি থাকুক, মানুষ একে অন্যের সাথে যোগাযোগ যখন একবার শুরু করেছে, তারপর আর থেমে থাকেনি। জোয়ার-ভাঁটা এসেছে সে বাণিজ্যে, কিন্তু নদীর প্রবাহের মত নতুন ধ্যানধারণা, ধর্মচিন্তা, শব্দভান্ডার এসে যুক্ত হয়েছে একেক সভ্যতায়।

লেখার শেষে এসে মনে হলো রবিঠাকুরের ‘তাসের দেশ’ গীতিনাট্য। সে কাহিনীতে রাজপুত্র আর সদাগর এসে হাজির নতুন দেশে। রাজপুত্র যেখানে দিনবদলের ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে, সেখানে সদাগর কিন্তু তুলনামূলকভাবে বাস্তববাদী। প্রচলিত নিয়মের সুবিধাভোগী সফল বণিকসমাজ। তাই তারা সাধারণত শান্তিকামীও।

অবাধ ও ন্যায্য বাণিজ্য আসলে বিশ্বশান্তির একটা বড় অনুঘটক। মধ্যপন্থায় ধীর কিন্তু স্থির সামাজিক পরিবর্তন যদি কোন প্রক্রিয়া আনতে পারে, তো সেই বাণিজ্য। সহিংস বিপ্লব তার পন্থা নয়। আলোকিত বিপ্লব যুগে যুগে যারা করে গেছেন, তাদের মূলে বণিকরাই ছিলেন চালিকাশক্তি। রেনেসাঁস শিল্পের পৃষ্ঠপোষকরা যেমন ছিলেন মেদিচির মত বণিক-ব্যাংকার পরিবার, তেমন মার্ক্যান্টাইল যুগের কলোনিয়াল এক্সপ্লয়টেশন থেকে হোমনেশনগুলির মধ্যবিত্ত শ্রেণী আরও সমৃদ্ধশালী ও বহির্মুখী হয়েছে, যার ফলশ্রুতিতে তাদের দর্শন থেকে এসেছে এজ অফ এনলাইটেনমেন্ট। তারপর আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা, গণতন্ত্র, বিজ্ঞানপ্রযুক্তি ইত্যাদি।

বাণিজ্যের হাত ধরে ঔপনিবেশিকতা-সাম্রাজ্যবাদের শুরু বলবেন অনেকে। কিন্তু সব দিক বিচার করে, সব ইতিহাস, লংটার্ম ইমপ্যাক্ট দেখে, আমার ব্যক্তিগত মতামত হল, ট্রেড ইজ নট এ জিরো-সাম গেম, ট্রেড ইজ এ পজিটিভ সাম গেম। সবার জন্যে মুক্তবাণিজ্যে আখেরে উইন-উইন।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!