মধুর সুর বোল রে কাগা, মীরা রো মন রাম সে লাগা — ষোড়শ শতকের ভারতীয় ভক্তিবাদের অন্যতম পথিকৃত মীরাবাঈয়ের রাজস্থানী ভজন। রাম এখানে ভগবানের নাম, আদতে শ্রীকৃষ্ণ। রাম-কৃষ্ণ উভয়েই ভগবান বিষ্ণুর অবতার।
মীরাবাঈ কৃষ্ণের প্রেমে মত্ত। তার এই বার্তার বাহক কাক — কাকের কর্কশ কন্ঠ কিভাবে মধুর হয় সেটা বুঝতে হয়ত আবার উলটপুরাণ ঘাঁটতে হবে! কৃষ্ণের প্রেমে মজাটাও এখানে আধ্যাত্মিক। মাওলানা রূমী যখন বলেন, আমি তোমার প্রেমে মত্ত হতে চাই নীরবতায়, কারণ নীরবতায় নেই কোন প্রত্যাখ্যান — তখন তাতে সেই একই একতরফা প্রেম-ভক্তি ধরা পড়ে। এই প্রেম ঈশ্বরের সাথে ভক্তের।
কাওয়ালীতে যেমন প্রথমে একজন একটা লাইন গাওয়ার পর বাকিরা একসাথে তার জবাব দেয়, কীর্তনে ঠিক একই রকম কল এন্ড রেসপন্স রয়েছে। এসব ভজন-কীর্তন ভারতবর্ষে নতুন নয়। কীর্তনের উল্লেখ বেদে পর্যন্ত আছে। আর ষষ্ঠ-সপ্তম শতকে দক্ষিণ ভারত থেকে এই বৈষ্ণব-শৈব ভক্তিবাদ ধীরে ধীরে উত্তর ও পূর্ব ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। শুধু হিন্দু ধর্ম নয়, জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের ওপরও ভক্তিবাদ ও আধ্যাত্মিকতাবাদের একটা প্রভাব শুরু হয়, তাদেরও ভজন-কীর্তন রয়েছে।
তবে দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে ভারতে ইসলাম আসার সাথে সাথে অনেক কিছু উল্টেপাল্টে যেতে থাকে। ইসলামে যে নিয়মিত দৈনিক প্রার্থনা, আর কোন যজ্ঞ বা নৈবেদ্যের ঝামেলা নেই, অর্থাৎ ঈশ্বরের সাথে একটা ব্যক্তিগত সম্পর্ক, এ ব্যাপারটা সম্ভবত হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মকে প্রভাবিত করে। আগের রিচুয়ালভিত্তিক মন্দির ও ব্রাহ্মণ্যকেন্দ্রিক ধর্মচর্চাকে টিকিয়ে রাখতে ভারতের জবাব হয় ঐ ভক্তিবাদ। তাতে মন্দির অপরিহার্য নয়। ভারতের সব মন্দির নতুন তুর্কী মুসলিম শাসকরা ধ্বংস করে ফেললেও ভক্তের মনের দৃঢ় নিষ্ঠা বিলুপ্ত করার সামর্থ্য তাদের নেই। অর্থাৎ কঠিন একটা সময়ে ভক্তিবাদের মাধ্যমে নতুন বাস্তবতার সাথে খাঁপ খাইয়ে নেয় ভারতীয় দর্শনগুলি।
মীরাবাঈ পঞ্চদশ শতকে একই রকম বাস্তবতার সম্মুখীন। মুসলিম-হিন্দু সংঘাত হয় যুদ্ধক্ষেত্রে নয়ত অন্য কোনভাবে দৃশ্যমান। দিল্লী সুলতানাত আফগানদের থেকে হাত বদলে এসেছে মুঘলদের হাতে। আগের শত্রুতা-মিত্রতার সম্পর্কগুলি পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। রাজপুত এলিট পরিবারের মীরাবাঈ সেসবের প্রতক্ষ্য সাক্ষী। হয়ত এসব চ্যালেঞ্জের মুখে তার কৃষ্ণভক্তি তাকে অবিচল থাকতে সাহায্য করেছে।
মীরাবাঈয়ের পাশাপাশি আরো বহু সন্ত-সাধক এ সময়ে ভক্তিবাদের চর্চা করেন। শিখ গুরু নানক একই সময়ের, একই ঘরানার। নবদ্বীপের শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু আর বৈষ্ণব পদাবলী বৈষ্ণবভক্তির বঙ্গীয় নমুনা। রাধা-কৃষ্ণের লীলা এদের জন্যে ঈশ্বরপ্রেম কিংবা আধ্যাত্মিকতার রূপক মাত্র। আবার গীতায় অর্জুন-শ্রীকৃষ্ণের যে গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক, তার সমান্তরাল ধরতে পারি শামসে তাব্রিজি আর মাওলানা রূমির পীর-মুর্শিদ সম্পর্ক, কিংবা নিজামুদ্দিন আউলিয়ার সাথে আমীর খসরুর সম্পর্ক। শুধু তফাত হল শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং বিষ্ণুর অবতার।
ইসলামী ভক্তিবাদের কাওয়ালী সঙ্গীতের সাথে একটা দৃশ্যমান পার্থক্য চোখে পড়ে এই ভজনের। সেটা হল মঞ্জিরা-করতালের ব্যবহার। মঞ্জিরা বাদ্যযন্ত্রটি আসলে বহু আদিকাল থেকে পাগান ধর্মগুলির সবটিতে ব্যবহৃত হয়েছে। সেটা তো হিন্দু ও রোমান পাগান মন্দিরে ব্যবহার হয়েছেই, ইসলামপূর্ব আরব পাগানরাও ব্যবহার করে থাকলে অবাক হব না। হয়ত সেকারণে করতালে আদিকাল থেকে মুসলিমদের অ্যালার্জি, আর ভজন-কীর্তন থেকে কাওয়ালীতে আসার পথে সেটি গায়েব হয়ে গেছে।
হিন্দু-মুসলিম সংঘাত যে ভারতবর্ষে বিভাজন তৈরির ব্রিটিশদের অধুনা পন্থা তা নয়, অতীত ঘাঁটালে বহু উদাহরণ চোখে পড়বে। তার প্রতিক্রিয়া হিসাবে মীরাবাঈয়ের আগের শতকেই আরেক ভক্তিবাদী সাধক কবির বহু ভজন লিখে গেছেন। তাতে উভয় ধর্মকেই প্রত্যাখ্যান করে সাধারণ মানুষের বোধগম্য সরল এক পন্থা উঠে এসেছে। তৃতীয় অনুখন্ডে তার একটা উদাহরণ দিয়ে শেষ করব।
নুসরাত ফতেহ আলী খান আর তার ভাতিজা রাহাত বলিউডের মাধ্যমে খ্যাতির শীর্ষে উঠে আসলেও তাদের মূলধারা সুফী ভক্তিবাদী কাওয়ালী গান।
ভক্তিবাদের কথা উঠলে বাংলার সবাই বাউল গান চেনে। কিন্তু পুরো উপমহাদেশে ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে আছে নানারকম ভক্তিমূলক সাধনার গান। কাওয়ালী তার অন্যতম, যদিও বোধ করি ধর্মের সীমানা অতিক্রম করে খুব কম মানুষই এসব ভক্তিবাদকে একই ছায়াতলে দেখার চেষ্টা করবে।
গত রাতে নুসরাত ফতেহ আলীর সুদীর্ঘ হাক্ব আলী, আলী মওলা গানটা কয়েকবার মনোযোগ দিয়ে শুনতে শুনতে চলে গেলাম মীরাবাঈএর রাজস্থানী ভজনে, সেখান থেকে কবিরের নাথপন্থী না-হিন্দু না-মুসলিম পপুলিস্ট প্রাতিষ্ঠানিকতাবিরোধী ভজনে। এসব মিলিয়ে তিনটা অনুখন্ড লিখতে ইচ্ছে হল।
উত্তর ভারতে ইসলামের আগমনের সাথে সাথে বহু পারসিক-তুর্কী মুসলিম কর্মচারী ও সেনাপতি ভারতে আসেন। এদের সেকেন্ড থার্ড জেনারেশনের বংশধররা আমাদের মত অধুনা ইমিগ্র্যান্টদের স্টাইলে স্থানীয় ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে তাদের জাতিগত ঐতিহ্যের মিলন ঘটিয়ে জন্ম দেন নতুন এক সঙ্গীত ঘরানার, যার নাম হিন্দুস্তানী। আর দক্ষিণ ভারতের কর্নাটী সঙ্গীতে তখনও চলতে থাকে আদি ঘরানার ধারাবাহিকতা।
উত্তর ভারতের এই সুরকারদের মধ্যে সবচে অগ্রগণ্য আমীর খসরু। নিজামুদ্দিন আউলিয়ার সান্নিধ্যে সুফী ভক্তিবাদে শিক্ষা পান তিনি। প্রাচীন ভারতীয় সুরকলাকে সংস্কার করে নতুন রূপ দেন আমীর খসরু। এই কাওয়ালীর সুর ও বিষয়বস্তুর ঐতিহ্য আমীর খসরু পর্যন্ত ট্রেস করা যায়।
আলী মওলা গানটার মূল প্রতিপাদ্য ইসলামের অন্যতম হিরো হযরত আলীর গুণকীর্তন। এটা মূল ধারার সুন্নী ঐতিহ্যের সাথে খুব একটা যায় না। অর্থডক্স ইসলামে মানুষ হিসাবে যদি কাউকে অনুসরণ করা কর্তব্য সে একমাত্র হযরত মুহাম্মদ(সা)।
কিন্তু ইরানী জোরোয়াস্ত্রিয়ান ও শিয়া প্রভাবে হিরো ওয়ারশিপের যে ইন্দোআর্য ট্রাডিশন (তুলনা করুন শাহনামা-রামায়ণ-মহাভারতের সাথে), সেটা চলে এসেছে ভারতীয় ফোক ইসলামে। শিয়া ঐতিহ্য অনুযায়ী হযরত মুহাম্মদ(সা) নাকি গাদির খুম বলে বিদায়হজ্জ্বপরবর্তী এক ভাষণে সরাসরি আলীকে তার উত্তরাধিকারী ঘোষণা করে বলেন, যে কেউ আমাকে যদি মাওলা মানে, সে আলীকেও মাওলা মানে। মাওলা শব্দের অর্থ নিয়ে বহু বিতর্ক আছে। কিন্তু সুফী সাধনার পরিপ্রেক্ষিতে মাওলা মানে ধরতে পারি ইন্টারসেসর — অর্থাৎ যার কিনা উচ্চতর দৈব শক্তির কাছে কারো পক্ষে সুপারিশের ক্ষমতা রয়েছে।
অপরদিকে ইসলামী সাম্রাজ্যের চতুর্থ খলীফা হিসাবে আলী শক্তিরও একটি প্রতীক। তার তরবারি জুলফিকার খোদা-রাসুলের আশীর্বাদমন্ডিত, কিন্তু অত্যাচারী নয়, ন্যায়বিচারী। সেই লাইন ধরে আলী শেরে-ইয়াজদান — খোদার সিংহ। উল্লেখ্য, ইয়াজদান শব্দটা আরবী নয়, পুরনো ফারসীতে জোরোয়াস্ত্রিয়ান দেবতাদের নাম ছিল ‘ইয়াজাতা’। সেখান থেকে ইয়াজদান=খোদা।
তো এই গানটিতে ঘুরে ফিরে আলী, তার শক্তিমহিমা ও আধ্যাত্মিক গরিমার গুণকীর্তন হচ্ছে। পারসিককৃত ভারতীয় রাগ-সুরের ব্যবহারের পাশাপাশি কখনো কখনো ধুম-তানানা ধরনের অর্থহীন শব্দ ব্যবহার করে তাল দেয়া হচ্ছে। হয়তবা শব্দগুলোর লুক্বায়িত কোন অর্থ আছে, নয়ত সেগুলি আলীভক্ত শ্রোতার মনে একটা ইনটক্সিকেশন কিংবা ফানা তৈরির সহায়ক।
আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...
যারা নুসরাত ফতেহ আলীর গান বা কাওয়ালী পছন্দ করেন, তারা অবাক হতে পারেন যদি বলি কাওয়ালী আসলে ভারতীয় কীর্তন-ভজনের ঐতিহ্যেরই একটা এক্সটেনশন। দ্বিতীয় পর্বে দেব মীরাবাঈয়ের সেরকম একটা ভক্তির গান।
আদি ইসলামী মুদ্রা নিয়ে এটা আমার দ্বিতীয় লেখা — প্রথম লেখা এখানে।
আজকে লিখছি আরব দিগ্বিজয়ের সমসাময়িক সিরিয়ার মুদ্রা নিয়ে। ছবির মুদ্রাগুলো আমার সংগ্রহ থেকে। ভালমত খেয়াল করলে দেখবেন, বিজ্যান্টাইন ধাঁচের মুদ্রাগুলিতে সম্রাট কিংবা খলীফার ছবি তো রয়েছেই, তার সাথে দৃশ্যমান একাধিক ক্রুশ। কখনো এসব খ্রীষ্টান প্রতীকের পাশাপাশি আরবীতে ধর্মীয় কিংবা ধর্মনিরপেক্ষ অনুবাক্য লেখা। মুদ্রাগুলির বর্ণনার পর তদকালীন ঘটনাবলীর সংক্ষিপ্ত একটা বিবরণ দেব, তারপর কিছু কৌতূহলোদ্দীপক বিশ্লেষণ।
এখানে দেখানো সব মুদ্রাই তামার তৈরি। কালের বিবর্তনে অনেকটা ক্ষয়ে গেছে, তারপরও ছাঁপগুলি দৃশ্যমান। এগুলি চালু ছিল পূর্ব রোম সাম্রাজ্যে, যার প্রচলিত নাম বিজ্যান্টিন সাম্রাজ্য। আরবদের কাছে এ সাম্রাজ্য পরিচিত ছিল ‘রূম’ হিসাবে। কুরআনে একটি সুরাও রয়েছে একই নামে। এ সুরায় রোম আর পারস্যের সাসানী সাম্রাজ্যের চিরন্তন রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার শেষ ফলের ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে।
বিজ্যান্টিন সাম্রাজ্যে এই নিম্ন মূল্যের মুদ্রা পরিচিত ছিল ফোলিস নামে। আরবদের কাছে এর নাম ফালস, বর্তমানযুগের বহু আরবীভাষী দেশে দিরহাম বা দিনারের থেকে ছোট মানের মুদ্রাকে বলা হয় ফিলস, বহুবচনে ফুলুস। সন্দেহ নেই, আরবী নামটির উৎস সেই লাতিন ফোলিস।
বিজ্যান্টিন সম্রাট দ্বিতীয় কন্সট্যান্সের তাম্রমুদ্রা
ছবির প্রথম মুদ্রা খোদ বিজ্যান্টিন সাম্রাজ্যের। ৬৪১ থেকে ৬৬৮ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত চালু ছিল। এক পিঠে বড় করে লাতিন হরফ ‘এম’ লেখা, এটা মুদ্রা মানের প্রতীক। সাথে লাতিন হরফে টাঁকশালের নামের কয়েকটি অক্ষর আর বছর। অপর পিঠে দন্ডায়মান সম্রাট দ্বিতীয় কন্সট্যান্স, ডানহাতে ক্রুশমন্ডিত রাজদন্ড, আরেক হাতে ক্রুশওয়ালা গ্লোব — গ্লোবুস ক্রুসিজের।
পরের আটটি ছবির মুদ্রা সিরিয়ায় প্রচলিত ছিল এমন এক সময়ে যখন সে দেশটি আর বিজ্যান্টিনদের হাতে নেই। ৬৩৫ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে দামেস্ক থেকে জেরুজালেম পর্যন্ত অধিকাংশ এলাকা হয়েছে নতুন ইসলামী রাশিদুন খেলাফতের করায়ত্ত। মুদ্রাগুলি নতুন প্রশাসনের আশীর্বাদপুষ্ট। দেখা যাচ্ছে, বিজ্যান্টিনদের আমল থেকে মুদ্রার চেহারার এমন কোন পরিবর্তন হয়নি। সেই ‘এম’, সেই সম্রাটের কায়া, এমনকি ক্রস পর্যন্ত। মুদ্রা গবেষকরা কিভাবে আলাদা করে বুঝলেন এগুলি ইসলামী মুদ্রা? এর কারণ, একটু নজর দিলে বোঝা যাবে মুদ্রার ছাঁচে পরিবর্তন, গুণমানের তফাত। আরো চোখে পড়বে এখানে সেখানে ত্রুটিপূর্ণ লাতিনের ব্যবহার। আর কোন ক্ষেত্রে মুদ্রার আকৃতি ও ওজন বিজ্যান্টিন মুদ্রার থেকে ভিন্ন। বিজ্যান্টিনসদৃশ এই ইমিটেশনগুলিকে নিউমিজম্যাটিস্টরা নাম দিয়েছেন স্যুডো-বিজ্যান্টিন। সময়কাল ৬৪৭ থেকে ৬৭০ সালের মধ্যে। সবচেয়ে পুরনোটিতে তিন ক্রসধারী ‘সম্রাটের’ ছবি, সময়কাল ৬৩৮-৬৪৩।
রাশিদুন খিলাফাতের আমলের সিউডো-বিজ্যান্টিন ‘দাঁড়িওয়ালা দ্বিতীয় কন্সট্যান্স’ ইমিটেশন ফোলিস
আর সব শেষের পাঁচটি মুদ্রা রাশিদুন খেলাফত পরবর্তী উমাইয়া খলীফাদের সময়কার সিরিয়া-প্যালেস্টাইনের।
প্রথম দুটি প্রথম উমাইয়া শাসক মুয়া’বিয়ার সময়কার (শাসনকাল ৬৬১-৬৮০), যার সাথে চতুর্থ রাশিদুন খলীফা আলীর সংঘাত দিয়ে ইসলামের প্রথম ‘ফিতনা’ বা গৃহযুদ্ধের শুরু। একটি মুদ্রা দেখতে হুবহু আগের আমলের স্যুডো-বিজ্যান্টিনগুলির মত। অন্যটিতে একটু তফাত চোখে পড়ে। ক্রসওয়ালা রাজন্ডধারী ‘সম্রাটের’ ঠিক সামনে আরবীতে ওপর থেকে নিচে ‘বিসমিল্লাহ’ লেখা। আর অপর পিঠে এম অক্ষরের ওপরে বামপাশে অর্ধচন্দ্র, ডানপাশে ছয়মাথা তারা। অস্পষ্ট কিন্তু এমের নিচেও আরবীতে ‘তাইয়িব’ লেখা, যার অর্থ ‘উত্তম’ অর্থাৎ এই মুদ্রা লেনদেনের জন্যে স্বীকৃত।
পরের তিনটি মু্য়া’বিয়ার উত্তরসূরী আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ানের সময়ের। উমাইয়া বংশের পঞ্চম এই খলীফা ৬৮৫ থেকে ৭০৫ পর্যন্ত শাসন করেন। তার মূল কৃতিত্ব ছিল মুয়া’বিয়ার মৃত্যুর পর শুরু হওয়া দ্বিতীয় ফিতনার অবসান ঘটিয়ে পুরো সাম্রাজ্যকে একীভূত করা। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি ইসলামের জন্যে একটি গঠনমূলক সময়। সে ব্যাপারে বিস্তারিত ভিন্ন পোস্টে বলবো। আব্দুল মালিকের মুদ্রা দুটির প্রথমটিতে সেই সম্রাটের ছবি, হাতে গ্লোবাস ক্রুসিজের, মাথায় ক্রুশধারী মুকুট। সাথে গ্রীকে লেখা ΚΑΛΟΝ – কালোন, অর্থ ‘উত্তম’। অন্যপাশে আরবীতে লেখা ‘বি-হিমস’ অর্থাৎ এমেসা বা হিমস (বর্তমান হোমস) শহরে মুদ্রিত। অপরপিঠে এম অক্ষর, ওপরে সাতমাথা তারকা, আর দুপাশে গ্রীক অক্ষরেও এমেসা শহরে মুদ্রিত লেখা — এমেসিস — ΕΜΙ/СΗС। নিচে আরবীতে ‘তাইয়িব।’ দ্বিতীয় মুদ্রাটিতেও সম্রাট-ক্রস, আর এমের নিচে আরবী লেখা ‘আল-ওয়াফা লিল্লাহ’ — অর্থাৎ বিশ্বস্ততা আল্লাহর। কোন ধর্মীয় পুস্তকে বা দোয়ার মধ্যে এখন এমন অনুবাক্য অবিশ্বাস্যকরভাবে অনুপস্থিত। তৃতীয় মুদ্রায় ক্রসধারী তিন বিজ্যান্টিন সম্রাটের মূর্তি এক পিঠে। আরেক পিঠে এম অক্ষরের ওপর খ্রীষ্টান কাই-রো গুপ্তলিপি (এমনটার ব্যবহার কুরআনেও রয়েছে, যেমন ইয়া-সীন)। আর তিন পাশে আরবী লেখা — ফালস আল-হাক্ব বি-বাইসান। অর্থাৎ বাইসান (স্কাইথোপোলিস) শহরে মুদ্রিত প্রকৃত ফালস। শহরটি বর্তমান ইসরাইলের বেইত-শে’আন।
প্রথম উমাইয়া খলিফা মুয়া’বিয়ার আমলের সিউডো-বিজ্যান্টিন ‘দ্বিতীয় কন্সট্যান্স’ ইমিটেশন ফোলিস
সিরিয়াতে কিভাবে ৬৩৩-৬৩৬এর ভেতর ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠিত হল, তার জন্য দুইটি বিপরীত প্রেক্ষাপট চিন্তা করে দেখতে হবে। এক, বিজ্যান্টিন-সাসানী সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক অবস্থা ও তাদের মধ্যে একটানা যুদ্ধবিগ্রহ। আরেকটি হলো আরব উপদ্বীপে ট্রাইবাল সিস্টেমের বহুত্বভিত্তিক পরিচয় শেষ হয়ে ইসলামী একত্বভিত্তিক আত্মপরিচয়ের শুরু।
লেইট অ্যান্টিকুইটি বলে ৩০০ থেকে ৭০০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত যে সময়টা, তখন সভ্য বিশ্বে দুইটি পরাশক্তি — কনস্ট্যান্টিনোপলভিত্তিক বিজ্যান্টিন সাম্রাজ্য আর বাগদাদের নিকটবর্তী ক্টেসিফোনভিত্তিক পারসিক সাসানী সাম্রাজ্য। রোমান সাম্রাজ্যের সাথে সামরিক প্রতিযোগিতার ধারাবাহিকতায় বিজ্যান্টিনরা সাসানীদের বিরুদ্ধে পর্যায়ক্রমে লড়ে ৫০২-৫০৭এ আনাস্তাসিয়ান যুদ্ধ, ৫২৪-৫৩২এ আইবেরিয়ান যুদ্ধ, ৫৪০-৫৫৭তে জাস্টিনিয়ান-খসরুর যুদ্ধ, ৫৭২-৫৯১এ ককেশাসের যুদ্ধ, আর শেষমেশ ৬০২-৬২৮এর বিজ্যান্টিন-সাসানী যুদ্ধ।
৬০০ খ্রিষ্টাব্দের আশপাশ দিয়ে সাসানী-বিজ্যান্টিন সাম্রাজ্যের সাথে স্থানীয় রাজ্যগুলির মানচিত্র
এ যুদ্ধগুলো মহাযুদ্ধের থেকে কম কিছু ছিল না। দুই সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রদেশের বিভিন্নভাষী সৈন্য এসবে অংশ নেয়। বড় শহর অবরোধ ও গ্রামাঞ্চলের কৃষিক্ষেত্রের ধ্বংসসাধন ছিল নিত্যনৈমিত্তিক। যুদ্ধে দুই সাম্রাজ্যেরই ছিল একাধিক শক্তিশালী মিত্র। ইথিওপিয়ার আক্সুম সম্রাট নাজুস ছিলেন অর্থডক্স খ্রীষ্টান ও বিজ্যান্টিনদের বন্ধু। দক্ষিণ আরবের ইয়েমেনের প্রাচীন রাজ্যগুলির একটি হিমইয়ার তখনো ছিল মোটামুটি শক্তিশালী। তাদের ওপর ছিল পারস্যের প্রভাব। এই ইয়েমেনই সংঘটিত হ্য় বিজ্যান্টিন ও সাসানীদের রক্তক্ষয়ী প্রক্সি ওয়ার। কুরআনে বর্ণিত আবরাহার সেনাবাহিনী ছিল ইথিওপিয়া থেকে প্রেরিত। তারা স্থানীয় ইয়েমেনী ইহুদী রাজার খ্রীষ্টান নির্মূল অভিযানের বদলা নিতে নাজরান এলাকায় ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। সুরা ফীল অনুযায়ী আবাবিল পাখির প্রস্তরবর্ষণে মক্কাঅভিমুখী আবরাহা আর তার হস্তীবাহিনীর নির্মম মৃত্যু হয়। ইয়েমেনের মত স্থানে খ্রীষ্টান-ইহুদীর পাশাপাশি পাগানবিশ্বাসী দক্ষিণ আরবীয় ট্রাইবের বসবাস ছিল। এদের জীবনধারা উত্তর আরবের হেজাজ আর মধ্য আরবের বেদুইনদের থেকে অনেকটা ভিন্ন ছিল।
দুই সাম্রাজ্যের আরেকটা বড় যুদ্ধক্ষেত্র ছিল আরবের উত্তরে সিরিয়া-ইরাকের বিশাল স্তেপ সমভূমি। পূর্বে ফোরাত নদীর পশ্চিম তীরে আবাস গাড়া আরব লাখমী বংশের ট্রাইব। এক দুই শতক ধরে এরা সাসানীদের আজ্ঞাবহ, কখনো কখনো রাজা স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। আর মধ্যোপসাগরীয় উপকূলের পশ্চাদভূমি সিরিয়া-জর্দানের আরব ট্রাইবগুলির নেতৃত্বে ছিল ঘাসানী বংশের গোত্রপতিরা। এরা বিজ্যান্টিনদের মিত্র হিসাবে যথেষ্ট স্বাধীনভাবে দেশ শাসন করত। এই দুই পক্ষের আরবরা যে কোন বড় যুদ্ধে ফ্রন্টলাইনে থাকত। তাদের লাইট ক্যাভালরি দিয়ে দ্রুত আক্রমণ ছিল বিজ্যান্টিন-সাসানী দুপক্ষেরই প্রমিত রণকৌশল।
৬২০-৬২৮এর যুদ্ধে সাসানীরা বিজ্যান্টিন সাম্রাজ্যের অন্তর্কলহের সুযোগ নিয়ে ইরাক-সিরিয়া পুরোটুকু দখল করে কন্সট্যান্টিনোপল পর্যন্ত চলে যায়। পুরো নিকটপ্রাচ্য পদানত হয় পারসিকদের। এই দীর্ঘ সামরিক অধিকৃতির সময়টা সিরিয়ার মানুষ বিজ্যান্টিন সাম্রাজ্যের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। খ্রীষ্টান ঘাসানী দলনেতারাও পালিয়ে যায় বিজ্যান্টিন এলাকায়। অপরদিকে সাসানীরা বিজয়ের সুযোগে ইরাকের লাখমীদের স্বাধীনতা খর্ব করে তাদের রাজাকে লাঞ্ছিত করে। পুরস্কার দূরে থাকুক, কেন্দ্রের আজ্ঞাবহ হয়ে পড়তে হয় এ এলাকার নেস্টরিয়ান খ্রীষ্টান, মানিকেইস্ট ও পাগান আরব ট্রাইবগুলিকে।
এ হলো আরব উপদ্বীপের ঠিক বাইরের ভূরাজনৈতিক চিত্র। হেজাজ ও মধ্য আরবে এই দুই সাম্রাজ্যের খুব একটা আগ্রহ ছিল না। বিশাল মরু এলাকায় নাগরিক সভ্যতা গড়ে তোলা, করসংগ্রহের মাধ্যমে তাকে টিকিয়ে রাখা কঠিন কাজ। সামান্য জীবিকার ওপর বেঁচে থাকা মরুর বেদুইনরাও কাবু করার মত মানুষ নয়। প্রায়ই এরা দল বেঁধে চড়াও হত এই এলাকার মধ্য দিয়ে যাওয়া বাণিজ্য কাফেলার ওপর। আর দুই সাম্রাজ্যের দুর্বলতা একটু টের পেলে এরা দ্রুত মরুভূমি অতিক্রম করে আক্রমণ করত সভ্যতার কিনারায় গড়ে ওঠা শহরগুলিতে। ইসলামের অভ্যুদয়ের আগেও এরা জেরুজালেম অবরোধ করেছিল একবার। এসব আক্রমণের লক্ষ্য সেসব এলাকার স্থায়ী নিয়ন্ত্রণ নেয়া নয়, শহরবাসী ও বিজ্যান্টিন গভর্নরদের কাছ থেকে ঘুষ আদায় করে কেটে পড়া।
ইসলামী ঐতিহ্য অনুযায়ী যদি ধরি মক্কা ছিল হেজাজের অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্র, তাহলে মক্কাকে ওপরের ট্রাইবগুলির ব্যতিক্রম বলতে হবে। আরব উপদ্বীপে এরকম ছোট ছোট কিছু শহর ছিল, যাদের যৎসামান্য বাণিজ্যিক গুরুত্ব ছিল, তার পাশাপাশি স্থানীয় দেবদেবীর মন্দির থাকার কারণে একটা বাৎসরিক মেলাও হত — তার ইকনমিক ইমপ্যাক্ট পড়ত স্থানীয় লোকজনদের ওপর। অর্থাৎ এ শহরগুলির বাসিন্দারা মরুর বেদুইনের মত পুরোপুরি যাযাবর নয়, বলা চলে সেমি-নোমাডিক।
এদেরই মত সেমি-নোমাডিক ঐ ঘাসানী-লাখমীরাও। বাণিজ্যকেন্দ্রিক শহর তাদেরও ছিল। দক্ষিণ আরবের ক্যাশ ক্রপ আতর-ধূপ আর সেমিপ্রেশাস রত্ন ইত্যাদি সিরিয়া হয়ে রোমে পৌঁছত আদিকালে। ঘাসানীদের পূর্বসূরী নাবাতীরা সেভাবে সম্পদশালী হয়ে গড়েছিল পেত্রার মত শহর। ইসলামের অভ্যুদয়ের সময় কিছুটা হলেও এ বাণিজ্য চালু ছিল — যদিও আগের মাত্রায় নয়। এই বাণিজ্যপথ ধরেই দামেস্ক-হিমস পর্যন্ত যাতায়াত ছিল মক্কার কুরাইশ ট্রাইবসহ অন্যান্য আরবদের। সেসব বড় শহরে নিঃসন্দেহে তাদের আত্মীয়স্বজনেরও বসতি ছিল। হাদীসে ঘাঁটালে দেখা যাবে, আবু জাহল, যিনি ছিলেন অন্যতম ইসলামবিদ্বেষী কুরাইশ, তার মালিকানায় নাকি দামেস্কের আশপাশে জমিজমা ছিল।
মোট কথা, সিরিয়া ও ইরাকের জনগণের শহুরে অংশ বিজ্যান্টিন বা সাসানী হলেও তাদের সেমিটিক পরিচয় বিলুপ্ত হয়নি। শহুরেদের ভাষা গ্রীকের পাশাপাশি আরামায়িক। আর নাগরিক সভ্যতার ফ্রিঞ্জে গেলে দেখা মিলবে আরামায়িকের নিকটাত্মীয় ভাষা আরবীর, আর সেমি নোমাডিক আরবদের। অর্থাৎ জাতিগত-ভাষাগত পরিচয়ের কথা চিন্তা করলে বিজ্যান্টিন বা সাসানী সাম্রাজ্যের এই এলাকাগুলি আরবদের বেশি কাছাকাছি।
ইসলামের অভ্যুদয়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল দাওয়া বা ধর্মপ্রচার। কিন্তু এটি আমরা এখন যেভাবে বুঝি তেমনটা নয়। মুহাম্মদ(সা) ছিলেন সুচতুর কূটনীতিবিদ। মক্কা ছেড়ে মদিনায় আশ্রয় নেবার কারণটাই ছিল মদিনাবাসীর অনুরোধ, যেন তিনি তাদের জাতিগত বিবাদগুলির নিষ্পত্তি করে দেন। তিনি সেটা করতে সমর্থ হন। আর এর মাধ্যমে সারা আরবের ট্রাইবগুলির একীভূত হবার বীজবপন হয়। মক্কার কুরাইশ ও তাদের মিত্রদের আক্রমণ প্রতিহত করে তিনি মদিনার ঐক্য ধরে রাখতে সক্ষম হন। পাশাপাশি একাধিক বিয়ের মাধ্যমে ও অন্যান্য প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে আরো বেদুইন ট্রাইবকে মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ করতে সমর্থ হন।
কিন্তু এসব মিত্র ট্রাইবগুলি যে সবাই মুসলিম হয়েছিল তা নয়। সাকিফ বলে ইরাকের কাছের একটি ট্রাইব তার সকল যুদ্ধে সৈন্য পাঠালেও মুসলিম হয়নি। আর মদীনায় ইহুদী ট্রাইবেরও উপস্থিতি ছিল। হাদীসে যদিও বলা হয়েছে, কুরাইশদের সাহায্য করার কারণে চুক্তিভঙের শাস্তি হিসাবে হয় এদেরকে হত্যা করা হয়, নয়ত নির্বাসনে পাঠানো হয়, আমার ধারণা সেটা সব ইহুদীদের বেলায় ঘটেনি। পরবর্তী ইসলামী দিগ্বিজয়ের সময় মুসলিমদের পাশাপাশি সম্ভবত ঘাসানী ও ইয়েমেনী খ্রীষ্টান, হেজাজি ও ইয়েমেনী ইহুদী, আর ইরাকী মানিকেইস্ট আরব যুদ্ধে পাশাপাশি অংশ নেয়। এর কারণ ইসলামের আবির্ভাবের একটি সাইড-এফেক্ট ছিল বংশপরিচয়ভিত্তিক বিভাজনের বিনাশ। এটি একবার হয়ে গেলে ধর্মীয় বিভাজনটা আর অত বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়।
মুহাম্মদ(সা)এর মৃত্যুর পর রাশিদুন প্রথম খলীফা আবু বকর কনসলিডেশন ও করসংগ্রহ শুরু করলে স্বাভাবিকভাবেই তার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ আসে। অনেক ট্রাইব আগের চুক্তি অনুযায়ী ‘জাকাত’ ট্যাক্সের বাইরে ছিল। তাদের এটা দিতে বাধ্য করা হলে এরা বেঁকে বসে। আবার কিছু ট্রাইবের নেতা মুহাম্মদ(সা)এর দেখাদেখি নিজেদের নবী বলে দাবী করে বসে। ইত্যাকার নানা বিদ্রোহ দমন করার জন্যে আবু বকর বিভিন্ন সেনাপতিকে পাঠান প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলিতে। কোন ক্ষেত্রে যুদ্ধ আর কোন ক্ষেত্রে সমঝোতা ছিল এদের পদ্ধতি। এ যুদ্ধগুলিকে একত্রে বলে ‘রিদ্দা’ যুদ্ধ। ইসলামী সেনানায়কদের বেশিরভাগই আবার ছিল মুহাম্মদ(সা)এর প্রাক্তন শত্রু, যারা মক্কার আত্মসমর্পণের পর ধর্মান্তরিত হয়। এরা যেহেতু মক্কার মত একটা কসমোপলিটান শহরের মানুষ, ম্যানেজমেন্ট, ট্রেড আর পলিটিক্স এরা ভালই বুঝত — বেদুইনদের মত নয়।
সিরিয়া ও ইরাকের বিজয় এই রিদ্দা যুদ্ধের সূত্র ধরেই। যখন এ সকল সেনানায়করা দূরদূরান্তের ট্রাইবগুলিকে বশ করতে গেছে, তখন তারা এসেছে বিজ্যান্টিন ও সাসানী ভূমিতে আবাসরত আরবদের সংস্পর্শে। স্বভাবতই এদের ট্রাইবাল পরিচয় ভেঙে তাদেরকে নতুন আরব-মুসলিম পরিচয়ের মধ্যে আনার একটা প্রচেষ্টা হয়। কোন ক্ষেত্রে যুদ্ধ কোন ক্ষেত্রে মূলো ঝুলানোর মাধ্যমে সে কাজটা হয়।
বিশেষ করে সিরিয়া ছিল আরবের বাইরে সাম্রাজ্যবিস্তারের জন্যে খুবই উপযুক্ত। ততদিনে বিজ্যান্টিনরা সাসানীদেরকে হঠিয়েছে। তারা আবার নতুন করে ঘাসানীদের মত একটা মিত্র ট্রাইবাল স্ট্রাকচার দাঁড়া করানোর চেষ্টা করছে। তাদের সে লক্ষ্যটা আবার রাশিদুন খলীফাদের লক্ষ্যের পরিপন্থী, সংঘাত ছিল অনিবার্য। তাছাড়াও সিরিয়া ছিল আরব উপদ্বীপের তুলনায় স্বর্গ। মেডিটেরানিয়ান সাগরের আর্দ্র বাতাসের কারণে সেখানে চাষাবাদ হত ভাল। বাণিজ্যের সম্পর্কও সেখানে কুরাইশ-উমাইয়াদের আগে থেকেই ছিল। তার ওপর ইসা(সা)সহ অনেক আব্রাহামিক নবীর কারণে জেরুজালেম শহরের ধর্মীয় গুরুত্বও অপরিসীম।
সিরিয়াতে শুরুতে পাঠানো পাঁচ সেনাপ্রধানের সকলেই মক্কাবাসী কুরাইশ ছিলেন, যাদের আগের জীবন ছিল ইসলামবিদ্বেষী, কিন্তু পাপমোচনের প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে ইসলামগ্রহণ করেন। সাথে তারা নিয়ে আসেন যুদ্ধের কৌশলজ্ঞান। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আমর ইবনে আবুল আস, খালিদ বিন ওয়ালিদ, ইয়াজিদ ইবনে আবু সুফিয়ান, আবু উবায়দা ইবনে আল জার্রাহ, শুরাহবিল ইবনে আবু হাসানা। এদের সৈন্যরা ছিল শুধু মক্কার কুরাইশবংশীয় নয়, ইয়েমেনের কিন্দাবংশীয় ও মধ্য আরবের তায়ী বংশীয়। অর্থাৎ মূলত রিসেন্ট মুসলিম কনভার্ট, যারা হয়ত রিদ্দা যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আরবদের সিরিয়া অভিযানের মানচিত্র
প্রথম পর্যায়ে সিরিয়ার মরু ও গ্রামাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় এদের সেনাবাহিনী। স্থানীয় সব ট্রাইব তাদেরকে যে সাহায্য করেছিল তা নয়। ঘাসানসহ চারপাঁচটি ট্রাইব বিজ্যান্টিনদের পক্ষ নিয়ে ছোট ছোট যুদ্ধে লড়ে। কিন্তু খুব একটা সুবিধা তারা করতে পারে না। দামেস্কের মত শহরগুলি বহু সংঘাত দেখে ক্লান্ত, আরব সেনাবাহিনী তাদের দ্বারে আসলে নামমাত্র প্রতিরোধ করার পর করপ্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আত্মসমর্পণ করে। ধর্মান্তরের কোন শর্ত ছিল না। আর এধরনের কর তারা সাসানী কিংবা বিজ্যান্টিনদের আগে থেকেই দিয়ে এসেছে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে বিজ্যান্টিনরা ঘটনার সংবেদনশীলতা আঁচ করতে পেরে বড় সেনাবাহিনী নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সম্রাট হেরাক্লিয়াস স্বয়ং সিরিয়ার অ্যান্টিয়োক শহর থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। প্রথমদিকে ধরাশায়ী শহরগুলি এ সুযোগে আবার পক্ষপরিবর্তন করে। কিন্তু যুদ্ধকৌশলের সুবাদে কিংবা নেহাত ভাগ্যক্রমে সংখ্যায় কম আরব সৈন্যদলের কাছে বিজ্যান্টিনরা একে একে পরাজিত হয় আজনাদাইন আর ইয়ারমুকের মত গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে। যুদ্ধে নিহত হয় হেরাক্লিয়াসের বহু নিকট সেনাপ্রধান, ৬৩৫এ সিরিয়া ছেড়ে কন্সট্যান্টিনোপলে ফিরে যান তিনি। সে বছরই দামেস্ক পুনরায় আরবদের করতলগত হয়। তারপর ৬৩৬এ জেরুজালেম অবরোধ করে বসে আরবরা। শহরটির অর্থডক্স খ্রীষ্টান প্যাট্রিয়ার্ক সোফ্রোনিয়াস আরবদের সাথে চুক্তি করে জেরুজালেম তাদের হাতে তুলে দেন। চুক্তির অন্যতম শর্ত ছিল জেরুজালেমে ইহুদীদের পুনর্বাসন করা যাবে না।
তৃতীয় পর্যায়ে বিজ্যান্টিন সাম্রাজ্য থেকে এ এলাকায় সরাসরি আর কোন হস্তক্ষেপ আসে না। মোটামুটি ৫০ বছরের জন্যে চিন্তাহীনভাবে চলে রাশিদুন ও উমাইয়া খলীফাদের শাসন, বিজ্যান্টিনরা ৬৯০এর দিকে একটিবার চেষ্টা চালায় কিন্তু শেষমেশ ঘুষ নিয়ে চলে যায়। উমাইয়া শাসনামলে মদীনা থেকে খেলাফতের গদি সরিয়ে নিয়ে আনা হয় দামেস্কে, কারণ শহরটির অবস্থান ছিল কৌশলগতভাবে আরো গুরুত্বপূর্ণ ও বিশ্ববাণিজ্যের সাথে সংযুক্ত। আশপাশের তুলনামূলক দুর্গম এলাকাগুলিতে বিদ্রোহী জনগোষ্ঠী ধীরে ধীরে উমাইয়াদের বশ্যতা স্বীকার করে। এদের মধ্যে অ্যান্টি-লেবানন পর্বতের ম্যারোনাইট খ্রীষ্টান মার্দাইটরা বহুদিন কার্যত স্বাধীন ছিল। এসব বিচ্ছিন্ন জনপদ করপ্রদান ছাড়াও অন্যান্য নানা শর্ত মেনে নিয়ে উমাইয়াদের শাসন মেনে নেয়।
এই হল মুসলিমদের সিরিয়া বিজয়ের সম্পূর্ণ না হলেও সংক্ষিপ্ত একটা আউটলাইন। এবার কিছু ইন্টারেস্টিং পর্যবেক্ষণ আর প্রশ্ন করি। প্রশ্নগুলির কিছুর উত্তর আছে, কিছুর সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা নেই।
প্রথমত, আদি ইসলামী শাসকরা বর্বর যাযাবর ছিল না। মক্কা-মদীনা-তায়েফের মত হেজাজের কমবেশি গুরুত্বপূর্ণ শহরের বাসিন্দা ছিল এরা। সিরিয়ার সভ্য আরব গোত্রদের সাথে বাণিজ্যিক খাতিরে তাদের যোগাযোগ ছিল। টাকাপয়সা আর কর আদায়ের গুরুত্বটা আগের রেজিমগুলির মত তাদের বেশ ভালই জানা ছিল। ইরাকের আরব গোত্রগুলোর ওপর সাসানীদের চাপিয়ে দেয়া ‘ইতিওয়া’ করের সাথে যেমন তারা পরিচিত ছিল, তেমনই তাদের নিজেদের সমাজেও দুর্বল ট্রাইবদের থেকে তারা প্রটেকশন মানি হিসাবে খুউওয়া নামে কর আদায় করত। সিরিয়ার এই মুদ্রাগুলির ডিজাইনের পেছনে সেটাই মটিভেশন। যে নতুন ধর্মই তারা গ্রহণ করুক না কেন, বাণিজ্য-অর্থনীতির কোন ডিসরাপশন হবে না, চলতে থাকবে। একই কারণে মুহাম্মদ(সা)এর মৃত্যুর পর আদি ইসলামী কম্যুনিটিতে তার বংশ বনু হাশিমের পরিবর্তে প্রভাব বেড়েছে বাণিজ্যে অগ্রগণ্য বনু উমাইয়া গোত্রের। তৃতীয় খলীফা উসমান ছিলেন তাদেরই এক গোত্রনেতা। তেমনটা ছিলেন প্রথম উমাইয়া খলীফা মুয়া’বিয়া।
দ্বিতীয়ত, কর আর অর্থনীতি চালু রাখতে মু্দ্রাব্যবস্থার হঠাৎ কোন সংস্কার তারা করেনি। একই রকম বিজ্যান্টিন মুদ্রা চালু রেখেছে, এমনকি ৬৬০এর দশক পর্যন্ত সরাসরি বিজ্যান্টিন সাম্রাজ্য থেকে তাম্রমুদ্রা আমদানি করেছে। নিজেরা মুদ্রণ শুরু করলেও মানব অবয়ব কিংবা ভিন্নধর্মীয় প্রতীক ব্যবহারের ব্যাপারে কার্পণ্য করেনি। তাতে আরবী অক্ষর আনতেও সময় লাগিয়েছে ত্রিশ বছরের বেশি। এটা রাশিদুন খলীফাদের সময়েও হয়েছে, কিন্তু তারা তাদের নামের কোন চিহ্ন এসব মুদ্রায় রেখে যাননি, যেটা পরবর্তী উমাইয়ারা করেছেন।
মুয়া’বিয়া আর তার পুত্র ইয়াজিদকে পরবর্তী ইসলামী ইতিহাসবিদরা, বিশেষ করে শিয়ারা, গুপ্ত খ্রীষ্টান আখ্যায়িত করে। তার একটা মূল কারণ, উমাইয়া সাম্রাজ্যের শক্তির কেন্দ্র ছিল সিরিয়া যেটা প্রাক্তন বিজ্যান্টিন এলাকা, পারস্য-ইরানের নয়। দ্বিতীয় কারণ আলী আর তার পুত্রদের সাথে এদের সংঘাত। আরেকটা কারণ হতে পারে পরবর্তী যুগের ইতিহাসবিদরা এসব মুদ্রা দেখেই সে ধারণায় উপনীত হয়েছেন এবং সেটাই লিখে গেছেন। আসল ব্যাপারটা হল, মুয়া’বিয়া একবার মানবঅবয়ববিহীন স্বর্ণমুদ্রা চালু করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সিরিয়ার সভ্য মানুষের কাছে তখনো মুদ্রার ফিয়াত মূল্যের সাথে সম্রাট-ক্রস প্রভৃতির ইমেজ সংযুক্ত। মুয়া’বিয়ার প্রথম প্রচেষ্টার মুদ্রাগুলিকে কেউ গ্রহণ না করায় বাধ্য হয়ে আগের মুদ্রার নকশা ফিরিয়ে আনতে হয় তাকে।
একই প্রসঙ্গে বলা ভাল, শুধু মুদ্রায় নয়। জর্দান ও ইসরাইলের মরুভূমিতে রয়েছে বেশ কিছু প্রাচীন উমাইয়া প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ। সেসবে রয়েছে খুবই হৃদয়গ্রাহী ও প্রাণবন্ত মানুষ ও পশুপাখির মূর্তি। অর্থাৎ, শুধু মু্দ্রায় নয় ব্যক্তিগত জীবনেও উমাইয়ারা ইসলামের বর্তমান স্বীকৃত ট্যাবুর একটি ভেঙেছেন, আর পরবর্তী ধর্মগুরুদের থেকে তাদের ধর্মবিচ্যুতির অভিযোগ একটা খেয়াল করার মত ব্যাপার। আরো উল্লেখ্য, কুরআনে সরাসরি ছবি আঁকা, মূর্তি বানানোর নিষেধাজ্ঞা নেই, যদি না তার উদ্দেশ্য খোদার শরীক করে পূজো করা হয়। এসব ট্যাবুর ভিত্তি হাদীসে, যেগুলি সংকলিত হয় এসব মুদ্রা ও প্রাসাদের পত্তনেরও একশ বছর পর।
জর্দানের কুসাইর আমরার উমাইয়া প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের ভেতর ফ্রেস্কো ছবি
জর্দানের কুসাইর আমরার উমাইয়া প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের ভেতর ফ্রেস্কো ছবি
প্যালেস্টাইনের পশ্চিম তীরের খিরবাত আল মাফজার উমাইয়া প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের ভেতর দন্ডায়মান খলিফার মূর্তি, পাদানিতে দুইটি সিংহ
প্যালেস্টাইনের পশ্চিম তীরের খিরবাত আল মাফজার উমাইয়া প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের ভেতর ফ্রেস্কো ছবি
তৃতীয়ত, চাঁদ-তারা প্রতীক। এ প্রতীক উমাইয়া মুদ্রায় দেখা যায় আর পরবর্তীতে ইসলামী প্রতীক হিসাবেও তার ব্যবহার হয়। কিন্তু এটি আরো পুরনো সিম্বল। বিজ্যান্টিন আর সাসানী দুই সাম্রাজ্যের মুদ্রাতেই চাঁদতারা ব্যবহৃত। আসলে চাঁদ ও তারা, যেটা কিনা আসলে শুক্রগ্রহ, পাগান একটি সিম্বল। রোমান পাগান বিশ্বাসে দেবী ডায়ানার প্রতীক চাঁদ ও তারা। তেমন প্রাচীন মেসোপটেমিয়ান দেবী ইশতারেরও, যেটা চলে এসেছে সাসানী মুদ্রায়। এ বিধর্মী চিহ্নটি কি জেনেশুনে অ্যাডপ্ট করেছিল আদি মুসলিম শাসকরা? আজকাল অনেকে বলে চাঁদ-তারার জন্যে দায়ী অটোমানরা। সেটা অর্ধসত্য, এই মুদ্রাগুলি চাঁদ-তারার আদি গুরুত্বের প্রমাণ।
চতুর্থত, আল ওয়াফা লিল্লাহ। লয়াল্টি বিলংগস টু আল্লাহ। এমন অনুবাক্য কেন অন্য কোথাও আর চোখে পড়ে না? বিসমিল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মুহাম্মাদ রাসুলাল্লাহ, লিল্লাহিল হামদ, ইনিল হুকমু ইল্লা লিল্লাহ, লা হাওলা ওয়া কুওয়াতা…, আল্লাহুস সামাদ… — ইত্যাদি জিকর ও সুরার অংশবিশেষ উমাইয়া আমলের মুদ্রায় দেখা যায়, যেগুলি এখনো সুপরিচিত। কিন্তু আল ওয়াফা লিল্লাহ — এর কোন খোঁজ নেই। কোথা থেকে এল? আর কোথায় গেল? আগে ছিল? আগে থাকলে হারিয়ে গেল কিভাবে?
পরবর্তী উমাইয়া ফালসে মানব অবয়ব না থাকলেও চাঁদ-তারা চলে যায়নি
পঞ্চমত, আরব সেনাবাহিনীতে ইহুদী ও খ্রীষ্টানদের সম্ভাব্য উপস্থিতি। তদকালীন সিরিয়াক-কপ্টিক-গ্রীক ভাষায় লিখিত ইতিহাসবিদদের বিবরণীর কোথাও মুসলিম বা ইসলাম শব্দটি পাওয়া যায় না। তাদের বিবরণীতে নতুন আরব শাসকদের নাম ‘মাহগেরে’ বা মাহগ্রায়ে। কোথাও তায়ী গোত্রের নামে তাইইয়ায়ে। মাহগ্রায়ে শব্দটি আরবী মুহাজির শব্দের অপভ্রংশ। মদীনায় যে আদি মুসলিমরা মক্কা থেকে গিয়েছিলেন তাদের নাম মুহাজির বা স্বেচ্ছানির্বাসিত। ইসলামে এখনও হিজরতের একটা রিচুয়াল সিগনিফিক্যান্স আছে। এখন এরা মুসলিম ছিল নাকি বিভিন্ন ধর্মের আরবের অংশগ্রহণ সেখানে ছিল এটা একটা বিশাল প্রশ্ন।
সোফ্রোনিয়াসের চুক্তিতে ইহুদীদের জেরুজালেমে পুনর্বাসন নিষেধের যে শর্তটা, সেটা কি বিজয়ী আরব সেনাদলে ইহুদীদের অন্তর্ভুক্তির কারণে? নাকি মদিনা আর সংলগ্ন এলাকা থেকে খলীফা উমরের সময় কথিত ইহুদী উচ্ছেদের রিঅ্যাকশন? এখানে উল্লেখ্য, ৬২০-২৮এর সাসানী-বিজ্যান্টিনদের মহাযুদ্ধের অংশ হিসাবে একটি ইহুদী বিদ্রোহও সংঘটিত হয়। বিজ্যান্টিনদের দুর্বলতার সুযোগে সিরিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে আবাসরত ইহুদীরা প্যালেস্টাইন প্রিমা প্রদেশে একটি স্বায়ত্তশাসিত রাজ্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। আরব দিগ্বিজয়ের সময়ে কি এরা তুতো ভাই আরবদের সাথে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে সৈন্যদল দিয়ে সাহায্য করে? বর্তমান যুগে ইহুদীদেরকে মুসলিম বিশ্ব দু’চোখে না দেখতে পারলেও ইসলামের ইতিহাসের তুলনামূলক অধিক সময়ে তাদের সাথে ভাল সম্পর্ক ছিল, এমনকি তাদের ধর্ম ও দর্শনও ইসলাম দ্বারা প্রভাবিত হয়। যদি উভয়ে দলবদ্ধ হয়ে সিরিয়া-প্যালেস্টাইনের দখল নেয়, তাতে অবাক হব না। পরের ইসলামী ইতিহাসবিদরা যা লিখে গেছেন, তার অধিকাংশ তাদের সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে সেল্ফ-সার্ভিং হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। অন্তত সমসাময়িক অনৈসলামী উৎস সেরকমই ইঙ্গিত দেয়।
আজ এ পর্যন্তই। এতগুলি প্রশ্ন করার কারণ এসট্যাবলিশমেন্টকে আঘাত করা নয়, অবজেক্টিভ পদ্ধতিতে ইতিহাস নিরূপণ। আশা করি, পাঠক ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।
আব্বাসী খেলাফতের প্রথম খলীফা আবুল আব্বাস আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ আস-সাফ্ফাহর রাজত্বকালের রৌপ্য দিরহাম এটি। সময়কাল ১৩৪ হিজরী, ৭৫২ খ্রীষ্টাব্দ। বর্তমান ইরাকের বসরা শহরের টাঁকশালে মুদ্রিত। আমার সংগ্রহের। এটি মোটামুটি সহজলভ্য।
এক পিঠে আরবী কুফী হরফে লেখা ‘আল্লাহ ব্যতীত ঈশ্বর নেই, সাক্ষ্য দিচ্ছি তাঁর কোন শরীক (সমকক্ষ) নেই’, চারপাশে লেখা ‘আল্লাহর নামে এটি মুদ্রিত হয়েছে বসরায়, সাল চার ত্রিশ একশ।’ অপর পিঠে লেখা, ‘মুহাম্মদ আল্লাহর বার্তাবাহক (রসুল)’, আর চক্রাকারে চারপাশে ‘মুহাম্মদ রাসুলাল্লাহকে আমি প্রেরণ করেছি পথনির্দেশনা ও প্রকৃত ধর্মবিশ্বাসসহকারে, অন্যান্য সকল ধর্মকে প্রতিস্থাপনের জন্যে, যদিও শরীককারীরা তা অপছন্দ করে।’
প্রথম আব্বাসী খলিফা আস-সাফফাহর আমলের দিরহাম
দেখার মত দুটো জিনিস এখানে। এক, হরফগুলোর কোন হরকত বা ভাওয়েল মার্ক নেই। এমনকি নুক্তা কিংবা কনসোন্যান্ট ডিস্টিংশন মার্কও নেই। কেউ সঠিক সূত্র না জানলে, দ (দাল) আর ধ/জ (জাল) গুবলেট করতে পারে। একইভাবে, ব (বা), ত (তা), থ/ছ (থা) এগুলির জন্যেও একটাই হরফ। দ (দদ), ছ/স (সদ) এদেরও একই হাল। স (সিন), শ (শিন) এর অ্যাম্বিগুইটি ‘লা সা/শারিকালাহু’তে পরিপূর্ণরূপে দৃশ্যমান।
আদিতে লিপিবদ্ধ কুরআনেরও একই অবস্থা ছিল। ইসলামী বিবরণীমতে, কুরআনের অর্থ পাল্টে যাবার ভয়ে তৃতীয় খলীফা উসমানের সময় এগুলি ঠিকঠাক করা হয়। আবার অন্যত্র উল্লেখ আছে, সে সংস্কারের কৃতিত্ব ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের। কিন্তু আমার আন্দাজে কাগজের ব্যবহার পুরোমাত্রায় শুরু হবার আগে এ সংস্কার সম্পূর্ণ হয়নি। সেকথায় পরে আসছি। মক্কা থেকে মদিনায় আদি মুসলিমদের অভিবাসনের দীর্ঘ ১৩৪ বছর পরের এ মুদ্রা এ থিওরির একটা সম্ভাব্য প্রমাণ।
আরেকটা চোখে লাগার মত ব্যাপার হল, কুরআনের ৯:৩৩ আয়াত যে হুবহু তুলে দেয়া হয়েছে, তা কিন্তু নয়। শুরুটা সামান্য মডিফাই করে মুদ্রিত হয়েছে। এই নগণ্য পরিবর্তনটাও সম্ভবত কুরআন পরিবর্তনের বর্তমান ইসলামী ট্যাবুর পরিপন্থী।
এই মু্দ্রাটি ইসলাম ধর্ম ও আরব খেলাফতের ইতিহাসের খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়কার। ১৩০ হিজরী নাগাদ পূর্ববর্তী উমাইয়্যা খেলাফতের আসন টলায়মান। উমাইয়্যাদের পারিবারিক অন্তর্কলহ থেকে গৃহযুদ্ধ হয়ে গেছে এক দফা। তাছাড়াও বিভিন্ন সুদূর প্রদেশের গ্যারিসন টাউনগুলিতেও বিদ্রোহ। এসব সামাল দিয়ে খলীফা দ্বিতীয় মারওয়ান রাজধানী হার্রানে এসে পৌঁছনোর মাসখানেকের মধ্যে শুরু হয়ে যায় ‘আব্বাসী বিপ্লব।’
একে বিপ্লব নাম দেবার মূল কারণ বিভিন্ন ধর্ম-গোত্র-জাতের একটা বৈচিত্রময় মোর্চা উমাইয়্যাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। এদের নেতৃত্বে যদিও ছিল মুহাম্মদ(সা)এর চাচা আব্বাসের বংশনামধারী এক আরব পরিবার, বিপ্লবীদের মূল লক্ষ্য ছিল আরবদেরই বর্ণভেদী রাজত্ব উচ্ছেদ করা। উমাইয়্যা বংশটি তৃতীয় রাশিদুন খলীফা উসমানের পরিবারের সাথে জড়িত। উমাইয়্যা প্রথম খলীফা মু্য়াবিয়ার সাথে চতুর্থ রাশিদুন খলীফা আলীর সংঘাত বাঁধে। আলীর মৃত্যুর পর তার দুই পুত্রের নেতৃত্বে আদি শিয়ারা কুফা শহরে সম্মিলিত হয়। দ্বিতীয় উমাইয়্যা খলীফা ইয়াজিদ কারবালার ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে এদের নিষ্ঠুরভাবে নিকেশ করে দেন। শিয়া-সুন্নী বিবাদের সেটা শুরুমাত্র।
উমাইয়্যা শাসনামলে বিজিত দেশগুলোতে আরবরা ছিল প্রথম শ্রেণীর নাগরিক। বিদেশী-বিধর্মীদের জানমাল ‘রক্ষার’ বিনিময়ে পোল ট্যাক্স (জিজিয়া) আর ভূমিকর (খারাজ) আদায় করে আরব সৈন্য আর সেনাপতিদের খরচ ওঠানো হত। এ কারণে বিধর্মীদের ইসলামে দীক্ষিত করতে উমাইয়্যাদের খুব একটা উৎসাহ ছিল না। যতক্ষণ বিজিত জনগণের প্রতিনিধিরা কড়ায় গন্ডায় কর বুঝিয়ে দিচ্ছে, ততক্ষণ তাদের পদবী-ধর্ম-সংস্কৃতির ওপর কোন আগ্রাসন হত না। পুরো উমাইয়্যা সাম্রাজ্যের অনারব জনগণের ১০ শতাংশের নিচে ছিল নতুন মুসলিম।
আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...
কিন্তু এসকল মুসলিমরা পরিগণিত হত দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে। কোন ক্ষেত্রে কর তো দিতে হতই, তার পাশাপাশি পুরনো নাম পরিত্যাগ করে আরবী নাম নিতে হত। আর ‘অ্যাটাচড’ থাকতে হত কোন না কোন আরব ট্রাইবের সাথে। এসব ধর্মান্তরিত মুসলিমদের নাম ছিল ‘মাওয়ালি’, ইংরেজীতে ‘ক্লায়েন্ট’। আদিযুগের অনেক সাম্রাজ্যেই বিজিত রাজ্যের বনেদী বংশের সন্তানদের সম্রাটের দরবারে হাজির থেকে তাদের ভাষা-সংস্কৃতি শিখে নিতে হত। এ অনেকটা সেরকম।
সাধারণ অনারবদের সাথে আরবদের বিয়েশাদীর ব্যাপারেও উমায়্যাদের নিষেধাজ্ঞা ছিল। যদি কোন বড় শহর ইসলামী সৈন্যদলের দখলে আসত, আরব সৈন্যদের অনুমতি ছিল না সে শহরের ভেতরে বসবাসের। তাদের জন্যে অন্যত্র আলাদা ক্যাম্প তৈরি করা হত, যেগুলি পরবর্তীতে দুর্গশহরে রূপান্তরিত হয়। এভাবে আরব জাতিগোষ্ঠীকে ‘সংমিশ্রণ’ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করে উমাইয়্যারা।
অন্যদিকে বিজিত বিশাল এলাকা শাসন আরব দলপতিদের পক্ষে একলা সম্ভব ছিল না। খলীফা আর তার দোসররা শিক্ষিত হলেও সৈন্যদের অধিকাংশ ছিল অর্ধশিক্ষিত, অশিক্ষিত। বিশাল সাম্রাজ্য পরিচালনার জন্যে উমাইয়্যাদের দরকার ছিল আগের আমলের শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের সাহায্য। সেভাবে সিরিয়ার প্রাক্তন বিজ্যান্টিন প্রদেশগুলিতে তারা প্রচুর আরামায়িক, গ্রীক ও লাতিন ভাষায় শিক্ষিত মনোফিসাইট খ্রীষ্টান কেরানী পায়। মনোফিসাইটদের সাথে আবার মুসলিমদের মিল হলো তারাও হোলি ট্রিনিটি কনসেপ্টটা বিশ্বাস করে না। আর ইরাকের প্রাক্তন সাসানী প্রদেশগুলিতে আরব নেতৃত্বকে সাহায্য করে পাহলাভী-ফার্সী ভাষায় শিক্ষিত আরেকদল বুদ্ধিজীবী। এদের ধর্ম ছিল জোরোয়াস্ট্রিয়ান, মানিকেইজম, মাজদাকিজম, কিংবা নেস্টরিয়ান ক্রিশ্চিয়ানিটি।
সিরিয়ার ঐ বুদ্ধিজীবীদের কারণেই কিন্তু পুরনো গ্রীক ক্লাসিকগুলি ইউরোপের অন্ধকার যুগে বেঁচে গিয়েছিল। তারা প্লেটো-অ্যারিস্টোটল প্রমুখের দর্শনতত্ত্বের বইগুলো আরামায়িক-আরবী ইত্যাদি ভাষায় অনুবাদ করে। পরে সেগুলি ছড়িয়ে যায় আরব খেলাফতের আনাচেকানাচে। স্পেন থেকে আবার সেগুলি ফিরে যায় পশ্চিম ইউরোপে।
কিন্তু পর্যায়ক্রমে উমাইয়্যারা এই বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকেও ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করে। তাদের খেলাফতের শেষ নাগাদ সরকারী চাকরি পাবার জন্যে আরবীনামধারী মুসলিম হওয়াটা ছিল বাধ্যতামূলক। ধীরে ধীরে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে সরকারী ভাষা হিসাবে আরবীকে প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করে উমাইয়্যারা। হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ নাকি এ ব্যাপারে এত গোঁড়ামি করেন যে, খওয়ারিজমি ভাষায় লেখাপড়াজানা সকল বুদ্ধিজীবীকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। আর ভাষাটি পুরোপুরি হারিয়ে যায়।
অর্থাৎ, উমাইয়্যা শাসনে অসন্তুষ্ট-ক্ষুব্ধ ছিল বেশ কটি দল। সর্বাগ্রে, বিভিন্ন শিয়া বা শিয়াঘেঁষা দল, যাদের বিশ্বাস খেলাফতের অধিকার কেবলমাত্র মুহাম্মদ(সা)এর সরাসরি উত্তরাধিকারীদের, অর্থাৎ আলীর বংশধরদের। তারপর, বিভিন্নদেশীয় অনারব মুসলিম, যারা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক (আজামী) হিসাবে গঞ্জনা ভোগ করে আসছে — এদের মধ্যে স্বপরিচয়ের ব্যাপারে সবচে একগুঁয়ে ছিল ইরানীরা। তৃতীয়ত, ইসলামভিন্ন অন্যান্য ধর্মের বনেদী বংশগুলি, বিশেষ করে সিপাহবদ নামে তাবারিস্তানের জোরোয়াস্ট্রিয়ান সামন্তরা। চতুর্থত, উমাইয়্যা সরকারী কর্মচারীদের একটা বড় অংশ, যারা অনেকে ছিল অমুসলিম কিংবা মুসলিম হলেও দ্বিতীয় শ্রেণীর।
আব্বাসী বিপ্লবের ডামাডোল প্রথমে শুরু হয় প্রত্যন্ত খুরাসান প্রদেশে। উত্তর আফগানিস্তান ও বর্তমান তাজিকিস্তান-তুর্কমেনিস্তান-উজবেকিস্তানের দক্ষিণাংশে অবস্থিত এই প্রদেশ। প্রশাসনের কেন্দ্র থেকে দূরে হওয়ায় উমাইয়্যাদের এখানে শতভাগ নিয়ন্ত্রণ ছিল না। প্রায় জনশূন্য এলাকায় আরব-অনারবরা অবাধে মেলামেশা করত। আরবীর পাশাপাশি ফার্সীতেও বাতচিত শুরু করে দেয় আরবরা, পারসিক পোশাকও পড়তে শুরু করে। খোরাসানের কোন আরব ইরাকে গেলে নাকি তার ভাষা সম্পূর্ণ বোঝার ক্ষমতা ছিল না কারো।
এই খোরাসান ছিল নানা ধরনের অভিনব বিশ্বাসে ভরপুর। প্রাক্তন সাসানী সাম্রাজ্যের প্রজা ইরানী নব মুসলিমরা ধর্মান্তরের পরও তাদের পুরনো ঐতিহ্যগত পরিচয় ধরে রেখেছিল। জোরোয়াস্ট্রিয়ান ধর্মের ‘মিলেনারিয়ান’ বিশ্বাস যে ভবিষ্যতে কোন এক ত্রাতার উত্থান ঘটবে, যিনি আলোর পক্ষে যুদ্ধ করে অন্ধকারকে পরাজিত করবেন, এসব বিশ্বাস তখনো প্রগাঢ়ভাবে বেঁচে গেছে এদের মধ্যে। বিশেষ করে তাদেরই অতীত সভ্যতার ধ্বজাধারী পারসিক সাম্রাজ্যের পতনের প্রতিক্রিয়ায় এদের মনস্তত্ত্বে কোন এক ‘মাহদীর’ আগমন ছিল অবশ্যম্ভাবী। ১২৫ হিজরী সালটিও এদের কাছে মাহদীর আগমনের নিয়ামক হিসাবে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল।
এসকল নওমুসলিম এবং মানিকেইজম ধর্মের অনুসারীদের সমতুল্য মিলেনারিয়ান বিশ্বাসকে ভালভাবে কাজে লাগাতে সক্ষম হয় কায়সানি হাশেমী বলে এক শিয়া দল। উমাইয়্যারা যেখানে ইসলামধর্মপ্রচারে ছিল বিমুখ, সেখানে এরা মূলধারার ইসলামের সাথে শিয়া ও মানেকইজমের সিনক্রেটিজম ঘটিয়ে খোরাসানের বিশাল জনসাধারণকে ধর্মান্তরিত করতে সক্ষম হয়। তাদের বিশ্বাস ছিল, উমাইয়্যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পর তাদের লুক্বায়িত ইমাম আবির্ভূত হয়ে সারা বিশ্বের কর্তৃত্ব গ্রহণ করবেন। এই শিয়াদের নেতা ছিল আবু মুসলিম আল খোরাসানী বলে এক রহস্যাবৃত সেনাপতি।
অপরদিকে, আবুল আব্বাস ও তার চাচাদের পরিচিতি ছিল পুরো ইসলামী জগতে। আবু মুসলিমের সাথে আব্বাসী পরিবার গোপনে যোগাযোগ করে। আবু মুসলিমের দৃষ্টিতে, বিপ্লবে আব্বাসীদের নেতৃত্ব আর শিয়া সেনাদলের মূল যৌথ লক্ষ্য হল শিয়া ইমামত প্রতিষ্ঠা। আব্বাসী পরিবারের সদস্যরা কুফা-বসরার মত বড় শহরে তাদের পরিচিতদের মাধ্যমে বিদ্রোহের ইন্ধন যোগায়। খোরাসানের উমাইয়্যা গভর্নরকে পরাস্ত করে আবু মুসলিম পূর্বদিক থেকে এগিয়ে আসতে থাকেন ইরাকের দিকে।
আবু মুসলিম আর আব্বাসীদের কাছে কয়েকটি যুদ্ধে উমাইয়্যা সেনাদল পরাজিত হয়, আর মূল শহরগুলিতে তাদের নিযুক্ত গভর্নরদের সরিয়ে দিতে সক্ষম হয় বিপ্লবীরা। ৭৪৭ থেকে ৭৫০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে ইরাকসহ খেলাফতের পূর্বাঞ্চল চলে আসে আব্বাসীদের দখলে। সিরিয়া থেকে সেনাবাহিনী নিয়ে এসে তাদের মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হন দ্বিতীয় মারওয়ান। মিশরে পালিয়ে যাবার পথে ধরা পড়েন পরিবারসহ। নতুন খলীফার নির্দেশে তার শিরোশ্ছেদ করা হয়। বেঁচে যাওয়া উমাইয়্যা রাজপরিবারের সদস্যদের চালাকি করে নেমন্তন্ন করে এনে খাবার টেবিলে হত্যা করেন আবুল আব্বাস। এভাবে উমাইয়্যাদের পুনরুত্থানের সব রাস্তা বন্ধ করে দেন তিনি। একমাত্র একজন উমাইয়্যা রাজপুত্র কোনরকমে স্পেনে পালিয়ে যান। সেখানে আন্দালুসিয়ার উমাইয়্যা রাজ্য চালু থাকে আরো তিনশ বছর।
খলীফা হিসাবে আবুল আব্বাস যে দাপ্তরিক নাম গ্রহণ করেন তা হল আস-সাফ্ফাহ, যার অর্থ শেডার অব ব্লাড, রক্তপাতকারী। প্রতিপক্ষকে সন্ত্রস্ত করতে এ নাম নিয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু তার থেকেও বড় তাৎপর্য হলো এটি একটি ‘মেসায়ানিক’ নাম। অর্থাৎ, ধর্মরক্ষার জন্য যে যোদ্ধা-ত্রাতার আবির্ভাব হবে, তার সম্মাননাকর নাম এটি। বোঝা যাচ্ছে, আস-সাফ্ফাহর অনুসারীদের চিন্তাচেতনার ওপর মিলেনারিয়ানিস্ট প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। শুধু তিনি নন, দ্বিতীয় আব্বাসী খলীফা আল-মনসুর (‘বিজয়ী’), তৃতীয় খলীফা আল-মাহদী (‘ঐশ্বরিকপথনির্দেশিত’), প্রমুখের নামেও মিলেনারিয়ান প্রভাব উল্লেখযোগ্য।
আবার দু’দলের যুদ্ধে আব্বাসীদের কালো পতাকার বিপরীতে উমাইয়্যাদের সাদা পতাকার ব্যবহারটাও পারসিক সংস্কৃতির নওমুসলিমদের জন্যে ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, ইরানী সভ্যতায় সাদা রং মরণশোকের প্রতীক। এরকম ছোটখাট ব্যাপারগুলি যে শুধু আব্বাসী সমর্থকদের উজ্জীবিত করে তোলে তা নয়। আব্বাসী বিপ্লবের প্রথমভাগে শিয়া প্রপাগান্ডা হিসাবে কারবালার যুদ্ধের শোকাবহ রিএন্যাক্টমেন্টও চালু ছিল। এখনো ইরানে সে ধরনের রিএন্যাক্টমেন্ট ধর্মীয় আচার হিসাবে পালিত হয়। এর সাংস্কৃতিক প্রভাব আব্বাসীদের সমসাময়িক অনারব সুন্নি নওমুসলিমদের ওপরও চলে আসে। সেকারণে আজকের মূল আরব ভূখন্ডে কারবালার তাৎপর্য খুব বেশি নেই, অথচ ইরান-ইরাক ও ভারতীয় উপমহাদেশে রয়েছে।
আস-সাফ্ফাহ পাঁচ বছর শাসনের পর গুঁটিবসন্তে মারা যান। তারপর খেলাফতের শাসনভার নিয়ে আরো এক দফা রক্তক্ষয়ী অন্তর্ঘাত ঘটে। তার ভাই ও চাচাদের সাথে এক ভাতিজা আর শিয়া সেনাপতি আবু মুসলিমের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চলে। নতুন খলীফা আল-মনসুর চক্রান্ত করে আবু মুসলিমকে হত্যা করেন। শিয়া ইমামতের স্বপ্ন সেখানেই আপাতত মাটিচাপা পড়ে। আব্বাসীদের বিশ্বাসঘাতকতার বদলার প্রস্তুতি নিতে শিয়া গোত্রগুলি আবারো প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। এদের সকলেই ধর্মপ্রচার বা দাওয়া’র মাধ্যমে অভূতপূর্ব রিক্রুটমেন্ট চালায়। এর আগে ইসলাম ধর্মে অফিশিয়ালি ধর্মপ্রচার তেমন ছিল না। ইসলাম ছিল শুধুমাত্র আরব বিজেতা ও তাদের স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ধর্মান্তরিত মাওয়ালি ক্লায়েন্টদের প্রিভিলেজ।
আব্বাসী খেলাফতের প্রশাসনব্যবস্থায় আরবদের পাশাপাশি অনারব, এমনকি অমুসলিম বা নামমাত্র মুসলিম কর্মচারীদের অংশগ্রহণ ছিল। বার্মাকী বলে একটা বনেদী পরিবার হয় আব্বাসীদের বংশানুক্রমিক উজির। এদের পূর্বপুরুষ ছিল হয় পারসিক জোরোয়াস্ট্রিয়ান নয়ত আফগানিস্তানের ভারতীয় বৌদ্ধসংঘের প্রধান। আল-মুকাফ্ফা নামে জোরোয়াস্ট্রিয়ান পুরোহিতদের এক বংশধর ও দ্বিতীয় জেনারেশনের মুসলিম মনীষী ভারতীয় শাস্ত্র ‘পঞ্চতন্ত্রের’ ফারসী সংস্করণের আরবী অনুবাদ করেন। সাসানী আমলে রাজাদের রাজকার্য পরিচালনার গাইড হিসাবে এ বইয়ের প্রচলন ছিল। এদের প্রভাবে সিরিয়াভিত্তিক উমাইয়্যাদের বিজ্যান্টিন স্টাইল থেকে উল্টো আরো বেশি প্রাচ্যধর্মী হয়ে পড়ে প্রশাসনব্যবস্থা। রাষ্ট্রক্ষমতা হয় আরো বেশি কেন্দ্রীভূত। সাসানী শাহেনশাহদের মত খলীফার অঙ্গুলিহেলনেই পরিচালিত হয় খেলাফতের সুদূরতম প্রদেশের কাজকর্ম। অর্থাৎ যেখানে উমাইয়্যারা পছন্দমত ট্রাইবাল চীফদের ওপর প্রাদেশিক শাসনভার পুরোপুরি ছেড়ে দিতেন, সেখানে আব্বাসী প্রশাসন হয় সাসানী পারসিকদের মত কেন্দ্রীভূত, আর একনায়কতান্ত্রিক। অবশ্য দুই খেলাফতের আমলেই ধর্ম থেকে রাজকার্য পৃথক ও স্বাধীনভাবে পরিচালিত হত।
আব্বাসী খেলাফতে ইরানী এমন প্রভাবের পাশে পুরনো আরব ট্রাইবাল স্ট্রাকচার বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি। যেসব আরব ট্রাইবাল স্ট্রাকচার থেকে বেরিয়ে শহুরে হতে পেরেছে তারা বর্তে গেছে, আর বাকিরা সম্ভবত ফিরে গেছে তাদের আদি মরুময় বাসস্থানে, নয়ত আরো দূরদূরান্তে কোন নতুন রাজ্যজয়ে।
ইসলাম ধর্মের ক্ষেত্রেও আব্বাসী বিপ্লব গুরুত্বপূর্ণ। আগে বলছিলাম, এই মুদ্রার কুফী হরফের কথা। এর আবির্ভাবের এক বছর আগেই মধ্য এশিয়ায় চীনা তাং সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেন আবু মুসলিম। যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে ছিল চীনা কাগজের কারিগর। তাদের মাধ্যমে আরব সাম্রাজ্যে প্রবেশ করে কাগজ। এর ফলে আরবী লিপির চরিত্র পুরোপুরি পাল্টে যায়। আগে পাথরে-চামড়ায় লিখতে হত কষ্ট করে। আর এখন কলম দিয়ে কয়েক খোঁচায় কাজ হয়ে যায়। নুক্তা-হরকত ইত্যাদি দিয়ে অক্ষরগুলোর সঠিক উচ্চারণ বোঝানোর বাঁধা আর থাকে না। সাথে উদ্ভব ঘটে আরবী ক্যালিগ্রাফীর। কুরআনের সাথে সাথে হাদীস ও গ্রীক ক্লাসিকগুলিও প্রথমবারের মত সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ হয়।
আব্বাসী আমল পর্যন্ত কিন্তু সুন্নাহ বলতে শুধু মুহাম্মদ(সা) নয়, তার যত সঙ্গীসাথী, অন্যান্য আদি মুসলিম, প্রাক্তন ধর্মপরায়ণ চার খলীফা, এমনকি কিছু ন্যায়বিচারক উমাইয়্যা খলীফা, তাদের ট্র্যাডিশনকে একটা ব্ল্যাংকেট টার্ম দিয়ে বোঝানো হত। ১৫০ হিজরীতে ইমাম শাফিয়ীর হাত ধরে আজকের হাদীস সংগ্রহগুলির সূচনা হয়। সুন্নাহ টার্মটা আরো নির্দিষ্ট হয়ে মুহাম্মদ(সা)এর ট্রাডিশন বোঝাতে শুরু করে। এ পর্যন্ত হাদীসগুলি লোকমুখে বেঁচে ছিল। অর্থাৎ, ইসলামের প্রথম ১৫০ বছরে হাদীস জানা ও পালন করার কোন সরাসরি প্রমাণ পাওয়া যায় না, সেসব প্রমাণ রেট্রোস্পেক্টিভ। ইসলামের ইতিহাসসংক্রান্ত প্রথম বইগুলিও লিখিত হয় আব্বাসী শাসনামলে। সেগুলিও ছিল শ্রুতিনির্ভর, কোন ক্ষেত্রে বহুলাংশে বাইবেল-তোরার বিষয়বস্তু দ্বারা সাপ্লেমেন্টেড। এধরনের ইহুদী ঐতিহাসিক প্রভাবকে নাম দেয়া হয়েছে ইসরাইলিয়াত।
আব্বাসী খলীফাদের আমলে আজকের সুন্নী মতবাদের শুরু হলেও অন্যান্য অনেক যুক্তি ও দর্শননির্ভর বিশ্বাস প্রচলিত ছিল। তার পাশাপাশি সুফী বিশ্বাসের যাত্রা শুরুও এদের সময়। অনেকভাবে উমাইয়্যা শাসনামলের চিন্তাধারার আড়ষ্টতাগুলি কেটে যায়। রাষ্ট্রব্যবস্থা খলীফার হাতে কেন্দ্রীভূত থাকলেও চিন্তার মোটামুটি স্বাধীনতা ছিল। সিল্ক রোডের বাণিজ্যের মাধ্যমেও বহু কিছুর চালাচালি হয়। শেষ পর্যন্ত আব্বাসীদের সাসানী স্টাইলের অ্যাবসলুট পাওয়ারই ছিল তাদের অধঃপতনের মূল কারণ। পরের দিকের অকর্মন্য খলীফাদের অত্যাচারে ব্যতিব্যস্ত মানুষ ধর্মের মাঝে ন্যায়বিচার খুঁজে ফেরে। তার সুযোগ নিতে তৈরিও ছিল কিছু ধর্মীয় নেতা। এদের টানাপোড়েনের রাজনীতির বলি হন ইসলামের স্বর্ণযুগের মনীষীদের অনেকে, তাদের বহু কাজ হয় বিস্মৃত, বহু গ্রন্থাগার হয় ভস্মীভূত। উমাইয়্যা-আব্বাসী দু’খেলাফতের ক্ষেত্রেই সমান খাঁটে এই প্রবাদবাক্য, ‘পাওয়ার টেন্ডস টু করাপ্ট, অ্যান্ড অ্যাবসলুট পাওয়ার করাপ্টস অ্যাবসলুটলি!’
দুই দশকের মার্কিন দখলদারিত্বের শেষে দ্বিতীয়বার হাইতি স্বাধীন হয় ১৯৩৪ সালে। ততদিনে অনেক পাল্টে গেছে দেশটি। মার্কিন প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক প্রভাবে অবকাঠামোর উন্নতি হয়েছে। সামান্য হলেও স্থিতিশীলতা আর সমৃদ্ধির স্বাদ পেয়েছে শহুরে মানুষ। কিন্তু মফস্বল আর গ্রামাঞ্চলে পূর্বেকার সেনাশাসিত যে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা ছিল, দরকার পড়লে কেন্দ্রীয় সরকারের অবিচারের প্রতিবাদের উৎস ছিল যেটা, তা পুরোপুরি বিলুপ্ত। গ্রামের ক্ষমতার ভিত্তিগুলি বিনষ্ট হয়ে শহরগুলিতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত।
অর্থনৈতিক সুযোগের আশায় গ্রাম থেকে শহরমুখী হয়েছে বহু মানুষ। অনেকে দেশান্তরী। প্রাচীন লাকুভিত্তিক স্বাধীন গ্রাম্য সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। সংসদীয় ব্যবস্থার দুর্বলতার সুযোগে স্বাধীন হাইতির শাসক ও এলিট শ্রেণী রাজধানীভিত্তিক জন্দার্মসমর্থিত একনায়কতন্ত্র কায়েম করে। নতুন রাষ্ট্রপতি ভ্যাঁসঁ মার্কিন ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশের সাথে ভাল সম্পর্ক রেখে চলেন। আগের অন্যান্য মুলাটো নেতার মত তাঁরও বিশ্বাস ছিল, সিংহভাগ হাইতিবাসীর গণতন্ত্র বোঝা ও চর্চা করার মত শিক্ষা-সামর্থ্য নেই।
হাইতির প্রেসিডেন্ট স্তেনিও ভ্যাঁসঁর সাথে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ফ্রাংকলিন রোজাভেল্ট, ১৯৩৬
চেয়ারম্যান মাওয়ের সাথে সাক্ষাত করছেন হাইতির কম্যুনিস্ট পার্টির নেতা জাক স্তেফেন আলেক্সিস, ১৯৬৭
ভ্যাঁসঁর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে যে দলটি দাঁড়া হয়, তারা ছিল শহুরে বামপন্থী। এদের দৃষ্টিতে ভ্যাঁসঁ ছিলেন সাম্রাজ্যবাদী মার্কিনের হাতের পুতুল। ভ্যাঁসঁ নবগঠিত এই কম্যুনিস্ট পার্টিকে কড়াহাতে দমন করেন। একই সাথে চলে গ্রাম্য ভুডুবিরোধী সংস্কারাভিযান। প্রতিবেশী ডমিনিকান রিপাবলিকের একনায়ক ত্রুহিয়োর সাথে ভ্যাঁসঁর বন্ধুত্ব ছিল। ১৯৩৭ সালে দুই দেশের সীমান্তে ডমিনিকান সৈন্যরা হাইতিয়ান শ্রমিকদের ওপর গণহত্যা চালায়। ভ্যাঁসঁর নীরবতার প্রতিবাদে পোর্তোপ্র্যাঁসে জোরদার আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। এর জের ধরে ভ্যাঁসঁ গদি ছাড়েন ১৯৪১ সালে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে রাবারের প্রচুর চাহিদা থেকে লাভ করতে লেস্কো সরকার ক্ষুদ্র কৃষকদের জমিতে রাবারের গাছ বসায়। কিন্তু সে প্রকল্প লাভের মুখ দেখার আগেই যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। মার্কিন ঋণের বোঝা আর অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বামপন্থী ছাত্র-শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে দেশ ছেড়ে পালান লেস্কো। তার জায়গা নেন মার্কিনদের প্রস্থানপরবর্তী প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট এস্তিমে।
লেস্কো সরকারের আমলে ক্ষুদ্র কৃষিজমি অধিগ্রহণ করে অলাভজনক সিসাল ও রাবার গাছ লাগানো হয়, ১৯৪৪
যুক্তরাষ্ট্রের পত্রিকায় হাইতির প্রেসিডেন্ট এনি লেস্কোর ছবি, ১৯৪৭
এস্তিমে সমাজতান্ত্রিক আদর্শে অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু করেন। বিদেশী কম্পানির মালিকানাধীন বড় ফলের বাগানগুলিকে রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়। এতে উল্টো লাভজনক ব্যবসাগুলি ধ্বংস হয়ে যায়। পর্যটনশিল্পে সরকারী বিনিয়োগও লাভের মুখ দেখেনি। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে ব্যর্থ এস্তিমের বিরুদ্ধে এক দফা বিপ্লবের পর সেনাশাসক মাগ্লোয়ার ক্ষমতায় আসেন ১৯৫০এ। মুক্ত বিদেশী বিনিয়োগের ফলে একটি স্বর্ণালী যুগের সূচনা হয়। কিন্তু ১৯৫৬ নাগাদ মাগ্লোয়ারকেও বিদায় নিতে হয়। নগর-অর্থনীতির উন্নতি হলেও কৃষিক্ষেত্রের করুণ হাল, মৃত্তিকার অবক্ষয়, বৃক্ষনিধন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদির ফলে গ্রাম্য জনসংখ্যার ক্রমাগত অবনতি হতে থাকে।
আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...
মাগ্লোয়ারের পর ক্ষমতার শূন্যতা পূরণ করতে তিন প্রতিদ্বন্দ্বীর আবির্ভাব ঘটে, একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী যার পরিকল্পনা হাইতিতে বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি, আরেকজন মার্কসবাদী, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের রাষ্ট্রায়ত্তকরণ তার লক্ষ্য। আর তৃতীয়জন — ফ্রঁসোয়া দ্যুভালিয়ে — মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষিত ডাক্তার, তিনি বিশ্বাস করতেন কৃষ্ণাঙ্গ জাতীয়তাবাদে। তার তত্ত্বে পশ্চিমা — অর্থাৎ শ্বেতাঙ্গ — ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও গণতন্ত্র আফ্রিকান সমাজসংস্কৃতিতে অচল। দ্যুভালিয়ের ব্যক্তিত্বপূজারী জঙ্গী কৃষ্ণাঙ্গরা কাগুলার নামে একটি আধাসামরিক বাহিনী গঠন করে। এরা রাস্তাঘাটে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে গুন্ডামি, বোমাবাজি, খুনখারাবি ইত্যাদি শুরু করে দেয়। দ্যুভালিয়ে সামরিক বাহিনীর মাঝেও সমর্থনের খুঁটি খুঁজে বের করেন।
হাইতির রাষ্ট্রপতি দ্যুমার্সে এস্তিমে, ১৯৪৬। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী প্রথম ‘নোয়ারিস্ট’ বা কৃষ্ণাঙ্গ জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রপতি।
এস্তিমে সরকারের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার পরিবর্তনের লক্ষ্যে ক্ষমতায় আসেন পরবর্তী রাষ্ট্রপতি পল মাগ্লোয়ার, ১৯৫০
প্রথমে বামপন্থীরা ক্ষমতায় গেলেও শীঘ্রই দ্যুভালিয়ের পক্ষে সেনা ও জনঅভ্যুত্থানে তারা অপসারিত হয়। ১৯৫৭ সালে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জবরদস্তি আর কারচুপির মাধ্যমে জয়ী হয়ে আসেন ‘ডক’ (ডক্টর) দ্যুভালিয়ে। নিজের ব্যক্তিত্বের কাল্ট ঘিরে সরকারের সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন দ্যুভালিয়ে। প্রতিবাদ নিয়ন্ত্রণে আনার জন্যে একরোখা নিপীড়নের আশ্রয় নেন তিনি। বিরোধীদলীয় নেতারা হয় নিরুদ্দেশ হয়ে যান, নয়ত আইনরক্ষীদের প্রহারে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকেন। ২০ থেকে ৬০ হাজারের মত মানুষকে হত্যা করে তাঁর প্রশাসন।
নতুন সংবিধান প্রনয়ণ করে সরকারী কর্মীদের ধর্মঘট বেআইনী ঘোষিত হয়। ক্রেওল ভাষাকে অফিশিয়াল মর্যাদা আর নারীদের ভোটাধিকার দেয়া হলেও, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার এতদিনের ভারসাম্য সেনেট বিলুপ্ত হয়। অনুগত লোকজনকে সংসদে মনোনীত করার ব্যাপারটাও গণভোটের মাধ্যমে আইনে পরিণত হয়। সারা দেশে স্বাধীন মতপ্রকাশ থমকে দাঁড়ায়। সামরিক বাহিনীর স্বাধীনতা খর্ব করতে সমান্তরাল আরেকটি বাহিনী গঠন করেন দ্যুভালিয়ে। জাতীয় নিরাপত্তা স্বেচ্ছাসেবকবাহিনী নামে এ সংগঠনটির সদস্যদের ডাকনাম ছিল ‘তঁতঁ মাকুত’, যার অর্থ ‘আংকল বুগিম্যান।’ সেনাবাহিনীর দ্বিগুণ লোকবল ছিল এদের। বিরুদ্ধমত নিষ্পেষণে এমন কোন অসাধ্য ছিল না, যেটা তঁতঁ মাকুত করত না। নতুন সংবিধানে নারীস্বাধীনতার কথা থাকলেও নারীবাদীদেরও ছাড় দেয়নি তঁতঁ মাকুত।
দ্যুভালিয়ে পরিবারতন্ত্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট ফ্রঁসোয়া ‘ডক’ দ্যুভালিয়ে, স্ত্রী সিমনসহ। কৃষ্ণাঙ্গ জাতীয়তাবাদের ধ্বজাধারী পাপাডকের স্ত্রী ছিলেন মুলাটো বা মিশ্রজাত। এ চিত্রে পাপাডকের পোশাক ভুডু মৃত্যুদেবতা বাওন সামদির মত সম্পূর্ণ কালো। এভাবে সাধারণ হাইতিবাসীর মনে ত্রাসের সঞ্চার করেন তিনি।
পাপাডকের পোষা আধাসামরিক বাহিনী তঁতঁমাকুতের অত্যাচারে সন্ত্রস্ত থাকত সাধারণ হাইতিবাসী, ষাটের দশকের ছবি।
মতবিরোধীদের ধরপাকড় ও নিরুদ্দেশ করে দেয়াতে জুড়ি ছিল না তঁতঁমাকুতদের, আশির দশকের ছবি।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলিরও রাজনীতিকরণ হয়। নিষিদ্ধ সংগঠনের কাতারে যেমন পড়ে বামপন্থী পার্টিগুলি, তেমন বয়স্কাউটদের মত নখদন্তহীন সংগঠনগুলিও। কার্নিভালে মনোরঞ্জনের জন্যে রাজনৈতিক ক্যারিকেচারের যে পুতুলখেলা এতদিন চালু ছিল, তার খেলিয়েরাও দ্যুভালিয়ে সরকারের শূলদৃষ্টিতে পড়ে জেলে নিক্ষিপ্ত হয়। কিছু মানুষ সুযোগ বুঝে তঁতঁ মাকুত আর দ্যুভালিয়ের নাম মুখে এনে বিভিন্ন জায়গায় সুবিধা বাগিয়ে নিতে শুরু করে। দ্যুভালিয়ের নিকটজনদের আত্মীয়তা দাবি করলে সাতখুন মাফ! মতবিরোধীদের দ্যুভালিয়ে সাম্রাজ্যবাদী-উপনিবেশবাদীদের দোসর আখ্যা দেন, আর নিজে হয়ে বসেন কৃষ্ণাঙ্গ ‘মানবতাবাদী’ আদর্শের সাষ্টাঙ্গ অবতার! ভুডু মৃত্যুদেবতা বাওন সামদির আদলে কালো স্যুট-হ্যাট পরে চলাফেরা শুরু করেন দ্যুভালিয়ে।
দ্যুভালিয়ের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি বেশ দোদুল্যমান ছিল। স্নায়ুযুদ্ধের সুযোগে আইজেনহাওয়ার প্রশাসনের কাছে কম্যুনিস্টবিরোধী সেজে দ্যুভালিয়ে অর্থ ও অস্ত্র সহায়তা বাগিয়ে নেন। কেনেডি অবশ্য দ্যুভালিয়েকে সরানোর পাঁয়তারা করেন। তাঁর ভয় ছিল, কিউবাতে বাতিস্তার নিপীড়নের কারণে কাস্ত্রোর কম্যুনিস্টরা যেভাবে বিজয়ী হয়, হাইতিও সেদিকে চলেছে। তাঁর পরিকল্পনা ছিল কিউবা ও হাইতিতে গেরিলা বাহিনী পাঠিয়ে দু’দেশেই একসাথে একনায়কতন্ত্রী সরকার উৎখাত। এতে মার্কিনদের অংশীদার হত ডমিনিকান রিপাবলিকের নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বোশের সরকার।
দ্যুভালিয়ে উল্টো কারচুপির নির্বাচন করে মেয়াদ এক দফা বাড়িয়ে নেন। প্রতিটি ভাষণে যুক্তরাষ্ট্রে কালোরা কিধরনের অবিচারের মধ্য দিয়ে যায় সেটা দেশবাসীকে স্মরণ করিয়ে দিতেন তিনি। তাতে কাজ হত ম্যাজিকের মত। কেনেডির মৃত্যু আর বোশের পতনের পর সে যাত্রা বেঁচে যান দ্যুভালিয়ে। মার্কিনদের সহায়তা ছাড়াই যখন একটি ছোট গেরিলাদল হাইতিতে আসে দ্যুভালিয়েকে উৎখাত করতে, তখন জনসাধারণ তাদের কোন সাহায্য করেনি। সেই অভিযান ব্যর্থ হয়, আর নিহত যোদ্ধাদের কাটা মুন্ডু জনসমক্ষে প্রদর্শিত হয়। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট হাইতির ব্যাপারে হাল ছেড়ে দেয় এই বলে যে, প্যারানয়েড পিপল ডিজার্ভ এ প্যারানয়েড প্রেসিডেন্ট।
১৯৬৭ সালে আরেকটি ‘গণভোট’ ডেকে নিজেকে আজীবন রাষ্ট্রপতি বানিয়ে নেন দ্যুভালিয়ে। সে ভোটে টিক মারার অপশন ছিল কেবল একটি! এরপর দ্যুভালিয়ে সরকার আর তঁতঁ মাকুত লাগামছাড়া আচরণ শুরু করে দেয়, যার মূল্য দিতে হয় সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বরেণ্য ব্যক্তিত্বদেরকে। বিশ্বকাপ ফুটবলের খেলোয়াড় গেইতেনসের পরিবারের অল্প কয়েক সদস্য দ্যুভালিয়েবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত ছিল। কিন্তু নিরুদ্দেশ করে দেয়া হয় গেইতেনসকেই। হাইতিবাসীর জন্যে গেইতেনস ছিলেন উদাহরণমাত্র। হাইতির মানুষ ক্যাথলিক প্রার্থনা লর্ডস প্রেয়ারকে কৌতুক করে পাল্টে দেয় এভাবে, ‘আওয়ার ডক হু আর্ট ইন দ্য প্যালে নাসিওনাল ফর লাইফ, হ্যালোড বি দাই নেইম বাই ফিউচার অ্যান্ড প্রেজেন্ট জেনারেশন।’
দ্যুভালিয়ে আমলে দুর্নীতি আর অরাজকতার কারণে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ে। হাইতির সমসাময়িক প্রবাদবাক্যে, দ্যুভালিয়ে অলৌকিক শক্তিবলে হাইতিকে শিখিয়েছেন খাদ্য ছাড়াই কিভাবে ক্ষুধানিবারণ করা যায়। ১৯৬১ থেকে ৬৭র মধ্যে রপ্তানী আয়ের ৩০ শতাংশ সংকোচন ঘটে। সরকারী গুন্ডা পোষার খরচ আসে ডমিনিকান রিপাবলিকের চিনি খামারে গরীব হাইতিবাসীদের গতর খাঁটা পরিশ্রমের রেমিট্যান্সে। এসকল শ্রমিক ছিল দাসের মতই। এদের বেতন যেত দ্যুভালিয়ে সরকারের হাত ঘুরে। ১৯৮১ সালে এভাবে ৩০ লক্ষ ডলার রেমিট্যান্স চলে যায় বিভিন্ন সরকারী কর্মকর্তার পকেটে। গ্রামাঞ্চলে তঁতঁ মাকুতের চাঁদাবাজি আর অপহরণের ভয় তো ছিলই।
১৯৬৯ সালে আরেক ‘গণভোটের’ মাধ্যমে পুত্র জঁক্লোদের রাষ্ট্রপতি হবার রাস্তা পরিষ্কার করেন দ্যুভালিয়ে। দ্যুভালিয়ে ডিন্যাস্টির বড়জনের ডাকনাম তখন দাঁড়াল ‘পাপা ডক’, আর তার ছেলে ‘বেবি ডক।’ ১৯৭১এ বাবার মৃত্যুর পর বিশ্বের কনিষ্ঠতম রাষ্ট্রপতি হন ১৯ বছরবয়েসী বেবিডক। মানুষ ভেবেছিল প্লেবয় মানসিকতার এ ছেলে বেশিদিন টিকবে না। কিন্তু রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের যে যন্তরমন্তর পাপাডক রেখে গেছেন, তার ওপর সওয়ার হয়েই বেবিডক থেকে যান ১৪ বছর!
১৯৬৯ সালে পুত্র জঁক্লোদকে নিজের উত্তরসূরী বানান পাপাডক। পুত্রের ডাকনাম হয় বেবিডক।
পোপ দ্বিতীয় জন পলের সাথে সস্ত্রীক বেবিডক, ১৯৮৩। পোপ হাইতির অবস্থার পরিবর্তনের আহ্বান জানান তার ভাষণে।
বেবিডকের শাসনামলে মুক্ত বাজার অর্থনীতির জোয়ার এসে পড়ে হাইতিতেও। বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়ার খাতিরে দ্যুভালিয়ে স্বদেশকে তাইওয়ান-সিঙ্গাপুর-হংকংয়ের সাথে তুলনা করতে শুরু করেন। আর্থিক প্রবৃদ্ধির ফলভোগী অবশ্য হয় তাঁরই অনুগত রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। রপ্তানি ব্যবসা মূলত ছিল সস্তা শ্রমে তৈরি পোশাক, পরচুলো ইত্যাদি। ধনী-দরিদ্র বৈষম্য ক্রমে বেড়েই চলে। গ্রামাঞ্চল থেকে আরেক দফা শহরমুখী জনসঞ্চারণ হয়। দাতব্য এনজিওর সংখ্যা এত বেড়ে যায় যে বিদেশী ত্রাণকর্মীরা হাইতির নাম দেয় রিপাবলিক অফ এনজিওস! স্থানীয় আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবস্থা বুঝে সে অনুযায়ী দীর্ঘস্থায়ী পদক্ষেপ নেয়ার মত জ্ঞান ছিল না এসব এনজিওর। তারও মাসুল দিতে হয় হাইতিকে।
হাইতির পেশাজীবী জনসংখ্যার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ পাপাডকের আমল থেকেই দেশান্তরী। দ্যুভালিয়ে আমলে প্রায় দশ লাখ মানুষ হাইতি ছাড়ে। আশির দশকে হাইতির বৈদেশিক উপার্জনের এক তৃতীয়াংশই আসত এদের রেমিট্যান্স থেকে। এসকল হাইতিয়ান মায়ামি-নিউইয়র্কের মত বড় শহর থেকে রেডিও ব্রডক্যাস্টের মাধ্যমে দ্যুভালিয়ে পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জিইয়ে রাখে।
১৯৮৫-৮৬ সালে বেবিডকের একনায়কতন্ত্র টলমল হয়ে ওঠে জঁবের্ত্রঁ আরিস্তিদ নামে এক ক্যাথলিক পাদ্রীর রাজনৈতিক উত্থানে। তার সাথে যুক্ত হয় ১৯৮৩ সালে হাইতিসফরে আসা পোপ দ্বিতীয় জন পলের পরিবর্তনের আহ্বান। রিগান প্রশাসনও সকল সমর্থন প্রত্যাহার করে। প্রতিবাদী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের একটি সমাবেশে তঁতঁ মাকুতের গুলিতে বাইস্ট্যান্ডার তিন ছাত্র মারা গেলে সারা দেশে বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়। এমনকি পাপাডকের ‘পোষা’ ভুডু পুরোহিতরাও বেবিডককে বলে দেন, বিদেহী দেশবাসীর আত্মারা দ্যুভালিয়ে দেশ ছাড়া পর্যন্ত শান্ত হবে না। দুই আমেরিকার কোথাও আশ্রয় না পেয়ে ফ্রান্সে নির্বাসনে চলে যান জঁক্লোদ।
ক্যাথলিক পুরোহিত জঁবের্ত্রঁ আরিস্তিদ হয়ে দাঁড়ান দ্যুভালিয়েবিরোধী আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ নেতা। ১৯৯১ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচক হন।
ফুটবল খেলোয়াড় জো গেইতেনস হাইতির নাগরিক হলেও যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে বিশ্বকাপে অংশ নেন ১৯৫০ সালে। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ১-০ গোলে অভূতপূর্ব মার্কিন বিজয়ের নায়ক ছিলেন তিনি। ১৯৬৪ সালে পাপাডকের তঁতঁমাকুতরা তাকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর তার কোন সন্ধান মেলেনি।
বাপছেলের আঠাশ বছরের পরিবারতন্ত্রের পর হাইতির গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার কিছু অবশিষ্ট ছিল না। বিপ্লবী জনতার সমর্থনে সেনাবাহিনী দেশশাসনের সাময়িক ভার নেয়। ৮৭তে নতুন সংবিধান প্রণীত হয়। নানারকম চেক-অ্যান্ড-ব্যালেন্সের পাশাপাশি নগর ও গ্রামের প্রশাসনব্যবস্থাকে সংস্কার করা হয়, ক্রেওল হয় ফরাসীর পাশাপাশি দ্বিতীয় জাতীয় ভাষা। তিন বছর শাসনের পর ১৯৯০ সালে প্রথম মহিলা অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রশাসনিক ক্ষমতা হস্তান্তর করে সেনা কাউন্সিল।
সুষ্ঠু নির্বাচনের পর আরিস্তিদ প্রেসিডেন্ট হলেও ৮ মাসের মাথায় সেনা অভ্যুত্থানের মুখে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। ১৯৯৪ সালে ক্লিনটন প্রশাসনের সহায়তায় আবার হাইতিতে ফিরে শাসনভার নেন তিনি। সেনাবাহিনীকে পুরোপুরি ভেঙে দেয়া হয়, তার জায়গা নেয় যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘপরিচালিত শান্তিরক্ষীবাহিনী। আরিস্তিদ ১৯৯৫এ শান্তিপূর্ণভাবে পরবর্তী সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ২০০০এ আরিস্তিদ আবার নির্বাচিত হন। কিন্তু তার ক্রমাগত স্বৈরাচারী মনোভাবের বিরুদ্ধে একটি আঞ্চলিক বিদ্রোহ শুরু হয়। আবার দেশত্যাগ করতে হয় আরিস্তিদকে। এই ডামাডোলে ২০০৪এ হাইতির স্বাধীনতার দ্বিশতবার্ষিকীর সকল আয়োজন ভন্ডুল হয়ে যায়।
১৯৮৬ সালে বেবি ডককে সফলভাবে উৎখাতের পর উচ্ছসিত জনতা
দ্যুভালিয়ে আমলে প্রচুর হাইতিবাসী স্বদেশ ছেড়ে নৌকায় করে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশে পাড়ি জমায়।
২০১০ সালে ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে হাইতি পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী সৈন্য আর এনজিওগুলো আবারও হাইতিকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে। ভূমিকম্পপরবর্তী কলেরা মহামারীতেও মারা যায় বহু মানুষ। সরকারের দুর্বলতার সুযোগে ২০১১তে আরিস্তিদ-দ্যুভালিয়ে দুজনই আকস্মিক এসে হাজির হন হাইতিতে। দ্যুভালিয়ে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার হন, মারা যান ২০১৪তে।
ভূমিকম্পের পর দশ বছর পেরিয়ে গেছে। হাইতির আইনশৃংখলা পরিস্থিতি আর অবকাঠামোর এখনও করুণ দশা। সাধারণ মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে সেখানে। এর মাঝেই এসেছে গেছে তিনজন রাষ্ট্রপতি আর একটি অস্থায়ী সরকার। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশন হাইতি ছেড়েছে মোটে দু’বছর আগে, তারা পেছনে ফেলে গেছে অগুনতি জারজ সন্তান। ভেনিজুয়েলার সাথে তেলচুক্তিতে দুর্নীতির প্রতিবাদ ২০১৮ থেকে এখন পর্যন্ত চলছে। কবে কিভাবে স্বাধীনচেতা হাইতিবাসীর প্রকৃত স্বনির্ভর ঐক্য ও স্বাধীনতা আসবে, এখনো সে প্রশ্নের জবাব সুদূরপরাহত। হাইতির ভাগ্যে শুধু দুটো জিনিসই তার থেকে বেশি নিশ্চিত — আরো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আর আরো বিপ্লব।
২০১০ সালের ভূমিকম্পের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী
২০১৮ সালে হাইতি সরকার ভেনেজুয়েলা থেকে তেল আমদানির একটি অসম চুক্তি করে। সারা দেশে তেল ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় হাইতিবাসী প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে। সে প্রতিবাদ এখনো চলছে। একসময় যে হাইতি মার্কিনসহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশের ঋণে হাবুডুবু খেত, এখন তার তলারটা কুড়োতে এসেছে ভেনেজুয়েলার মত ‘সমাজতান্ত্রিক’ ‘ভ্রাতৃত্বকামী’ দেশগুলি।