কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকা সমাচার – ২

কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকার সাথে যুক্তরাজ্যের কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন সরাসরি সম্পর্ক নেই। কম্পানিটি নিবন্ধিত যুক্তরাষ্ট্রের ডেলাওয়্যারে, আর লন্ডন, নিউ ইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে তাদের অফিস আছে। প্রধান নির্বাহী আলেকজান্ডার নিক্স এখন সাসপেন্ডেড, তিনি ‘ম্যানসিস্টার’ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। কম্পানিটির কাজ হলো ‘ড্যাটা-মাইনিং’ আর ‘বিগ ড্যাটা অ্যানালিসিস’-এর সাহায্যে কর্পোরেট আর রাজনৈতিক মক্কেলের স্বপক্ষে মানুষের চিন্তাধারা আর আচরণ পরিবর্তন করা। সোজা কথায় ‘মস্তিষ্ক-প্রক্ষালন’! কম্পানিটির যাত্রা শুরু ২০১৩ সালে, এস,সি,এল বলে আরেক কম্পানির অধীনে। এসসিএলের ব্যবসাও একই রকম, তারা অ্যানালিটিকার মূলধনের ১০% দেয়, আর বাকি ৯০% আসে রবার্ট মার্সারের থেকে।

যারা মার্সার পরিবারের নাম শুনেননি, একটু খুঁজে দেখুন! রবার্ট আর তার মেয়ে রেবেকা চরম রক্ষণশীল আর ট্রাম্প-ব্যাননের সবচে’ বড় পৃষ্ঠপোষক। মার্সার ছিলেন আইবিএমের নামকরা কৃত্রিম-বুদ্ধিমত্তা বিশেষজ্ঞ, পরে নিজে একটা স্টকে বিনিয়োগের ব্যবসা শুরু করেন, যেখানে তার আবিষ্কৃত প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে রাতারাতি বিলিওনিয়ার বনে যান। পরে ব্যাননকে ব্রাইটবার্ট নিউজ দাঁড়া করাতেও সাহায্য করেন অর্থ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে। রেবেকাই ব্যাননকে মোলাকাত করিয়ে দেন ট্রাম্পের সাথে। এখানেই শেষ নয়, ব্যানন ছিলেন অ্যানালিটিকার ভিপি, ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণার দায়ভার নেয়ার আগে। ট্রাম্পের প্রাক্তন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইকেল ফ্লিন, যিনি রুশদের সাথে দহরম মহরম করে রবার্ট ম্যুলারের কাছে ধরা খেয়ে বসে আছেন, তিনি ছিলেন এসসিএলেরও উপদেষ্টা। আটলান্টিকের ওপারে ব্রেক্সিটের সমর্থনকারী তিনজন ক্ষমতাসীন টোরি পার্টির রাজনীতিবিদেরও অ্যানালিটিকাতে ‘অর্থলগ্নি’ আছে। বুঝতেই পারছেন যে এই কম্পানি গভীর জলের তিমিমাছ!

কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকা তাদের ওয়েবসাইটে দাবি করছে যে, তাদের কাছে ২২ কোটিরও বেশি মার্কিনবাসীর প্রত্যেকের ৫ হাজার শ্রেণীর তথ্য আছে। আর সেগুলি ব্যবহার করে তারা সমমনা পাঠক-দর্শক-শ্রোতাদের গণমাধ্যম ও ইন্টারনেটে টার্গেট করতে পারে, আর কি ধরনের ইনপুটে তাদের সামগ্রিক প্রতিক্রিয়া কিরকম হবে তা আন্দাজ করতে পারে। তারা ভেঙে না বললেও ধরে নিতে পারি যে তাদের কর্মচারীদের মধ্যে ড্যাটা সায়েন্টিস্ট, মনস্তত্ত্ববিদ, ডিজিটাল ওয়েবপেজ, ছবি, ভিডিও ও অন্যান্য কন্টেন্ট সৃজনবিশারদ আছেন। এস,ই,ও জিনিসটাও খুঁজে দেখবেন, এটা হলো গুগল আর অন্যান্য সার্চ ইঞ্জিনে কিভাবে আপনার ‘প্রডাক্টটা’ (সেটা নির্বাচনপ্রার্থীও হতে পারে) আর সব প্রতিযোগীর থেকে উপরে উঠে আসবে, তার শিল্প। আরও যেটা না বললেই নয়, রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবুর্গেও পুতিনের ‘বাবুর্চির’ পরিচালিত একই রকম একটা ট্রোল ফার্ম আছে, যার তেরজন কর্মকর্তাকে রবার্ট ম্যুলার দোষীসাব্যস্ত করেছেন ২০১৬ নির্বাচনে অবৈধ হস্তক্ষেপের দায়ে।

অ্যানালিটিকা এত তথ্য পেলো কীভাবে?

এটা মনে রাখবেন যে ফেসবুক-গুগলের কাছে আপনি হয়ত সোশ্যাল সিক্যুরিটি বা ক্রেডিট কার্ড নাম্বার দেননি, কিন্তু তাদের কাছে যে অস্ত্র আছে সেটা আরো মোক্ষম, সেটা হলো আপনার অন্তরের অন্তস্তলে পৌঁছানোর চাবিকাঠি!

অ্যানালিটিকা যোগসাজশ করে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক রুশ-মলদোভান বংশোদ্ভূত লেকচারার আলেকসান্দ্র্ কোগানের সাথে। এই লোক রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষকতা করেন (উপরের ঐ একই শহরে!) আর রুশ সরকার থেকেও ‘গবেষণার’ টাকা পেয়েছেন। ২০১৪ সালে একটা ফেসবুক অ্যাপ বানান, যার নাম ThisIsYourDigitalLife। গবেষণার উসিলায় ফেসবুক তাকে অনুমতি দেয় অ্যাপটির মাধ্যমে শুধু অ্যাপের ব্যবহারকারী নয়, তাদের ফ্রেন্ডদেরও প্রোফাইল ঘাঁটানোর। মনে মনে ভাবুন, আপনি সেই অ্যাপ, অনেক ‌অপরিচিত মানুষের প্রোফাইল-ছবি-ভিডিও-নোটস দেখছেন, তারা সাদা না কালো, কোথাকার বাসিন্দা, জন্ম কবে, বয়স কত, একলা না দোকলা, কিসে কিসে লাইক দিল, স্ট্যাটাস আপডেট অনুযায়ী সে সুখী না দুখী, গেদের দুচোক্ষে দেখতে পারে কি পারে না, কোন গ্রুপে যাতায়াত, হোক্সনিউজ দেখে না চিকেন নুডুল, মাসে কয়বার কোন রেস্টুরেন্টে চেকিন করে, মাকড়সা ভয় করে নাকি আরশোলা, তারা কার বা কিসের প্রতি দুর্বল, যদি আইপি অ্যাড্রেস পান তাহলে তাদের জিপকোড, ইত্যাদি। সেগুলি দেখে আপনি নিজে যা যা আন্দাজ করবেন, এই তথ্যগুলো দিয়ে মেশিন লার্নিংয়ের সাহায্যে তার থেকে শতগুণ বেশি আর শতগুণ দ্রুত আন্দাজ করা সম্ভব। কোগানের এই অ্যাপ মানুষ নিজেদের ব্যক্তিত্ব কিরকম তা জানার জন্য ব্যবহার করে, অর্থাৎ আরো বেশি কিছু তথ্যও দিয়ে দেয়। এভাবে তিনি দু’মাসের মধ্যে ২,৬০,০০০ মানুষের তথ্য সরাসরি পান, আর তাদের ফ্রেন্ড যারা অ্যাপটা কখনো ব্যবহারও করেনি, তাদের মিলিয়ে সে সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি! এর সাথে তুলনা করুন মার্কিনে ফেসবুক ব্যবহারকারী প্রায় ২৫ কোটি। ফেসবুককে কেউ হ্যাক করেনি, আমরাই ফেসবুককে এসব তথ্য দিয়েছি, আর তাই নিয়ে তারা ব্যবসা ফেঁদেছে, ‘গবেষণার’ খেলা খেলেছে।

শুধু ফেসবুক না, আপনি যদি গুগলও ব্যবহার করেন লগ্ডইন অবস্থায়, আপনি কি খুঁজাখুঁজি করছেন, গুগল তা জানবে, এবং পরের বার আন্দাজ করে আপনার পছন্দসই রেজাল্ট আপনাকে দেখাবে। তাছাড়া দুনিয়ার বেশিরভাগ ওয়েবসাইটে তাদের কোড বসানো আছে, অর্থাৎ আপনি সেসব সাইটে যাচ্ছেন কিনা, তার আগে-পরে আর কি খোঁজাখুঁজি করেছেন, সেসব তথ্য তারা সংগ্রহ করছে। চিন্তা করুন অ্যানালিটিকা যদি পারত সেটাও কব্জা করতে!

আর এর উপরে আছে কনজিউমার ড্যাটাসেট! আর রাজনৈতিক ‘প্যাক’! কনজিউমার ড্যাটা হলো বিভিন্ন দোকানপাটের সিস্টেমে তাদের খদ্দেরদের নাম-ঠিকানা-ফোন-ইমেলসহ অন্যান্য তথ্য, যেগুলি তারা আপনার কাছ থেকে আপনাকে জানিয়েই সংগ্রহ করে। আপনি ফাইনপ্রিন্ট না পড়েই লিস্টে নাম লিখিয়ে ফেললেন, যার বিনিময়ে হয়ত তারা আপনাকে ডিসকাউন্ট দিল। ইন্টারনেটের কারণে একাজ এখন অনেক সহজ। আর ‘প্যাক’ হলো যুক্তরাষ্ট্রের পলিটিক্যাল অ্যাকশন কমিটি, যারা কোন নির্বাচনপ্রার্থীর সমর্থক, তাদের পক্ষে প্রচারণা চালায়, জনে জনে ফোনকল করে, কলিংবেল চেপে ঘরে এসে কথা বলে। তারা সরাসরি প্রার্থীর সাথে জড়িত না হওয়ায় বিপুল পরিমাণ অর্থসংগ্রহ ও খরচ করতে পারে। এদের কাছেও আছে কোটি কোটি মানুষের তথ্য। আপনি হয়ত যেটা জানেন না বা গা করেন না, সেটা হলো এই সব স্টোর, প্যাক, এমনকি দাতব্য প্রতিষ্ঠানও, আপনারসহ আরো অনেকের খুঁটিনাটি জানে এবং এগুলির কেনাবেচা করে। যেকোন মার্কেটিং-অ্যাডভার্টাইজিং কর্মকর্তা বুঝবেন যে এ এক সোনার খনি!

কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকার মত সংস্থার ড্যাটা সায়েন্টিস্টের পক্ষে খুবই সম্ভব এসব সাধারণ তথ্য সংগ্রহ করে ফেসবুক থেকে পাওয়া অসাধারণ তথ্যের সাথে লাইন ধরে মেলানো। অর্থাৎ তারা জানে আপনার জটিল কোন রোগ আছে কিনা, সর্পতৈলের প্রতি দুর্বলতা আছে কিনা, আর আপনার সাথে যোগাযোগের উপায়। বাকি থাকলো মান্নান মিয়াকে গিয়ে ধরে তার পয়সা উসুল করা।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




বলা বাহুল্য, এসকল তথ্য আপনি স্বেচ্ছাতেই কাউকে না কাউকে দিয়েছেন। ইউরোপে না হলেও, যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী বৈধভাবেই এসব তথ্য কেনাবেচা সম্ভব। এই কারণেই প্রতি সপ্তাহে আপনি ভুড়ি-ভুড়ি জাংক চিঠি ও ইমেল ডাস্টবিনে ফেলেন আর অনাহূত ফোনকল-টেক্স্ট পেয়ে বিরক্ত হন!



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...






আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকা সমাচার – ১

ধরুন আপনি জেমসের গানের মান্নান মিয়া, আপনার তিতাস মলমের বিজনেস। আপনি নিজেও লিস্ট করে বলতে পারেন না, আপনার স্বপ্নে পাওয়া মলমের কত হাজার রোগ সারানোর গুণ। কিন্তু আপনার বিক্রি-বাট্টা কোন ভাবেই বাড়ছে না, অথচ বউকে প্রমিজ করে বসে আছেন যে নেক্স্ট মডেলের টেসলাটা আপনি আগামী মাসে কিনে দিচ্ছেন। কিভাবে করবেন এই অসাধ্যসাধন? চিন্তার কিছু নেই, আছে ফেসবুক! টার্গেটেড অ্যাড দাঁড়া করিয়ে দেন, দুনিয়ার যত উজবুক যারা দোয়াপড়া-ছ্যাপফেলা পানি খাওয়া থেকে শুরু করে সাপের তেল মালিশ করেছে (সাথে সাথে সেগুলির গুণকীর্তন করে ফেসবুকে পোস্টাইছে নয়তো লাইকাইছে), সবগুলোকে একসাথে পেয়ে যাবেন ফেসবুকে। বিশ্বাস করুন, দুনিয়াতে উজবুকের সংখ্যাই বেশি, যে জাত-ধর্মেরই হোক না কেন। অতএব, ফেসবুককে দিলেন অ্যাডের পয়সা, আর সাথে ক’টা একটু চাল্লু উজবুককে দুটো পয়সা দিয়ে বললেন একটা করে লাইক ফেলার জন্য (নইলে আল্লার গজব পড়বে!), আর চটকদার পজিটিভ কমেন্টের জন্য চার পয়সা, হাজার ফ্রেন্ডওলা প্রোফাইল থেকে শেয়ার হলে দশ পয়সা। যদি আপনার মলমের শিশিটা দেখতে জব্বর হয় (অনন্ত জলিলের ছবিওলা লেবেল লাগিয়ে), আর দুয়েকটা ‘ফেকবুক ডাক্তারের’ ভাল ‘প্লাগ’ পান, তাহলে টেসলা না হলেও একটা টাটা মহীন্দ্র তো হয়েই যাবে!

আর যদি আপনি ডোনাল্ড ট্রাম্প হন, অথবা কোন আফ্রিকান ‘প্রিন্স’, আর আপনি চান একটা দেশের প্রেসিডেন্ট হতে, তাহলে আপনার দরকার কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকার ইস্পেশাল নির্বাচনী প্যাকেজ! একটা ছোট উদাহরণের পরে করছি অ্যানালিটিকার অ্যানালিসিস।

বছর দশেক আগে আমি দু-তিনজন অ্যামেচারকে জানতাম, যারা এক সপ্তাহের মধ্যে ফেসবুকের দু-একটা গ্রুপের সদস্যদের শুধু নাম-পরিচয় না, তাদের রাজনৈতিক চিন্তাধারা-মতামত কোন ধরনের, এসব তথ্যসংগ্রহের উপায় বের করেছিল। শুধু তাই না, কমপক্ষে পাঁচশ সদস্যের এসব তথ্য তাদের অজান্তে সংগ্রহও করেছিল। কয়েকটা ফেক প্রোফাইল আর ফেক ওয়েবসাইট বানিয়ে তারা পরের স্তরে কিছুদূর গিয়েছিল, সেটা হলো ঐ তথ্য কাজে লাগিয়ে গ্রুপের সদস্যদের চিন্তাধারাকে নির্দিষ্ট পথে পরিচালিত করা। এই কাজ বেশ কঠিন, কিন্তু পুরোপুরি অসম্ভব নয়। হাতে অঢেল সময় থাকলে, একজন ভাল বিহেভিয়োরাল সাইকোলজিস্টকে দলে পেলে আর ফেসবুক অ্যাডে ঢালার মত যথেষ্ট পয়সা থাকলে সেটাও এই একহাতে গোনা অ্যামেচাররা পারতো বলে আমার বিশ্বাস। আর ফেসবুকও এটা সহজে ধরতেই পারতো না। যাই হোক, নানাকারণে সেই অ্যামেচাররা বেশিদূর না এগিয়ে কেটে পড়ে।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...






আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




বাঙ্গালীর দাসপ্রথা

আমেরিকার গৃহযুদ্ধের মূল কারণ ছিল ক্রীতদাসপ্রথার উচ্ছেদ। এখনো বর্ণবৈষম্যের ব্যাপারটা নিয়তই চলে আসে এদেশের রাজনীতির মধ্যে। আমাদের জন্য সেটা কেমন ছিল?

চর্যাপদের আবিষ্কর্তা হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছিলেন বাঙ্গালী আত্মভোলা একটা জাত। সেকথা এক্কেবারে ঠিক! বাঙ্গালীর ইতিহাসেও দাসপ্রথা ছিল এবং এখনো আছে। সে নিজে দাস হয়েছে, আবার ক্রীতদাসের মালিক হতেও তার খুব একটা বাঁধেনি।

প্রথমে বলি কবে কোথায় আমাদের স্বজাতি দাসত্বের শৃঙ্খল পরেছিল। অনেকে ভুল আন্দাজ করবেন যে মুসলিম শাসনামলে এর শুরু। ইসলামের আগেও আরবদের মধ্যে দাসপ্রথা ছিল। ইসলামে ক্রীতদাসের সাথে সদাচরণ করতে বলা হলেও সেটাকে বিলুপ্ত করা হয়নি। সে কারণে নানাযুগে মুসলিম দিগ্বিজয়ীদের সাথে হাবশী-তুর্কী দাসেরা এদেশে এসেছে। আবার তারা নিজেরাও একসময় রাজা বনেছে, যেমন দিল্লীর মামলুক, বাংলার হাবশী রাজ্য। এইসব রাজারা সবাইই যুদ্ধবিগ্রহের মাধ্যমে বাংলাসহ ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে পরাজিত গোষ্ঠীর নারী-পুরুষ-শিশুদের ধরে দাস হিসেবে পৃথিবীর আনাচেকানাচে বিক্রি করে দিয়েছে।

দিল্লীর মামলুক সুলতানাতের প্রতিষ্ঠাতা কুতুব মিনার খ্যাত কুতব আলদ্বীন আইবক (১১৫০-১২১০) শিশুকালে দাস হিসাবে বিক্রিত হন। তুর্কীস্তানের অধিবাসীদের দাস হিসাবে চাহিদা ছিল, কারণ প্রশিক্ষণ দিলে তারা ভাল সৈন্য হত। ছবিতে লাহোরস্থিত আইবকের সমাধি।
ভারতের গুজরাতের নেটিভ রাজ্য সাচিনের নবাব দ্বিতীয় ইব্রাহিম মোহাম্মদ ইয়াকুত খান (নবাবীর কাল, ১৭৯১-১৮০২)। জাঞ্জিরা দ্বীপের আফ্রিকান সুন্নি মুসলিম রাজবংশে জন্ম। তার পূর্বসূরীরা সুলতানী আমলে দাস হিসাবে ভারতে এসেছিল, পরে সম্রাটের অনুগ্রহে রাজত্ব পায়।

কিন্তু এই অভিশাপ শুধু মুসলিম শাসনামলেই ছিল না। জীমূতবাহনের দায়ভাগে আমরা দেখতে পাই দ্বাদশ শতাব্দীর হিন্দু উত্তরাধিকারবিধিতে দাসীর উল্লেখ, তারও আগের বৌদ্ধ বিনয়পিটকেও দেখি দাসেদের ভিক্ষু হওয়া বারণ। বলা বাহুল্য, খ্রীষ্টধর্মেও যীশু এপ্রথার বিরুদ্ধে সরাসরি কিছু বলে যাননি, যার ফলে সন্ত পল দাসদের উপদেশ দিয়েছেন মালিকের প্রতি বিশ্বস্ত হতে। শ্বেতাঙ্গরাও অতীত আর বর্তমানকালে দাসত্বের শৃংখল পরেছে, সেকথা সুযোগ হলে অন্য সময়।

প্রাগাধুনিক যুগে ইউরোপীয় বণিকদের আনাগোনার সাথে সাথে দাসবাণিজ্য আরও বৈশ্বিক রূপ নিয়েছিল। পর্তুগীজ হার্মাদ জলদস্যু আর বার্মার আরাকানের মগ দুয়ে মিলে ষোড়শ শতকে দক্ষিণ বাংলার সুন্দরবন, সন্দ্বীপ আর চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রায়ই লুট তরাজ চালিয়ে দাস ধরে নিয়ে যেত — যাকে আক্ষরিক অর্থেই বলা হতো ‘মগের মুল্লুক’। অন্যদিকে মোঘলরা ছিল দাসপ্রথার বিরোধী (আওরঙ্গজেব বাদে), তারা ১৬৬৬ সালে চট্টগ্রাম দখল করে এই মুল্লুকের সমাপ্তি ঘটায়।

মনুস্মৃতিতে জীমূতবাহনের দায়ভাগে দাসীর ঔরসে সন্তান জন্মালে কিভাবে সম্পত্তি ভাগ হবে তার নিয়ম।
বৌদ্ধ বিনয়পিটক অনুযায়ী দাসদের ভিক্ষু হওয়া বারণ।
সেন্ট পল দাসদের বলে গেছেন মনিবের প্রতি অনুগত থাকতে।
কুরআন অনুযায়ী দাসদাসীদের সাথে কিভাবে ব্যবহার করতে হবে তার নিয়ম।

প্রায় একই সময়ে, সপ্তদশ শতকে, ওলন্দাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি (VOC) কাশিমপুর, হুগলী এসব জায়গায় ঘাঁটি গাঁড়ে। তারা লুটতরাজ করত না, কিন্তু দাস কেনাবেচা সেখানে ঠিকই চলত। এসব দাসদের কারা এনে তাদের হাতে সমর্পণ করত, তার কাগজেকলমে প্রমাণ না থাকলেও আন্দাজ করা যায় অনেক ক্ষেত্রে এদের পরিবারের অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত কর্তাই হয়ত পেটের দায়ে সে কাজটি করেছেন, নয়ত বাঙ্গালী বা অন্য ভারতীয় বেনিয়া-ছেলেধরাদের কাজ। ইন্দোনেশিয়ার বাতাফিয়া হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউনে এসব দাসের অধিকাংশ গিয়ে পৌঁছায়, এখনও তাদের বংশধররা সেখানে আছেন, কিন্তু নিজ সংস্কৃতি-ভাষা-ধর্ম হারিয়ে ফেলেছেন। ছেলেরা অনেকে সেখানে করেছে হাঁড়ভাঙা খাটুনি, আর মেয়েদের চাহিদা ছিল ভাল সেবক আর সূঁচকর্মী হিসাবে, কারও কারও ভাগ্যে পণমুক্তি আর ওলন্দাজ জামাইও জুটেছিল। সেদেশের এককালীন শ্বেতাঙ্গ-আধিপত্যবাদী প্রেসিডেন্ট ডিক্লার্কেরও ধমনীতে নাকি বাংলার রক্ত আছে।

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানিও (EIC) কিছুটা সময় মাদ্রাজ আর কলকাতা থেকে এসব করেছে, কিন্তু আন্তর্জাতিক দাস বাণিজ্যে ভাঁটা পড়া শুরু হল ব্রিটিশদের কারণেই। ১৮৩৩ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোতে দাসপ্রথা আইন করে বন্ধ করে দেয়, আর তাদের সমুদ্রে কোন দাসবাহী জাহাজ পেলে সেটা দখল করে দাসদের মুক্তি দেয়া শুরু করে। অবশ্য এতে করে অন্য ধরনের দাসত্বও শুরু হয়ে যায়, সেটা ক্রয়বিক্রয়ের দাস নয়, একে বলে চুক্তিভিত্তিক দাসত্ব। ভারতে অবশ্য তখনও ব্রিটিশরা দেশীদের ভিতরে ক্রীতদাস-প্রথা সহ্য করত, অভ্যন্তরীণ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে নাক গলাতে এসে ঝামেলা পোহাতে চাইত না। অবশেষে তারা সেটাও আইন করে বন্ধ করে ১৮৬১ সালে।

১৬০১এর এনগ্রেভিংয়ে পূর্ব ইউরোপীয় জনগণকে গলায় দড়ি বেঁধে দাস হিসাবে নিয়ে যাচ্ছে তুর্কী অটোমান সেনাদল।
ঊনবিংশ শতকে আলজিয়ার্সের মুসলিম শাসকরা মার্কিন ও ইউরোপীয় জাহাজ দখল করে তার নাবিকদের দাস হিসাবে ব্যবহার করত।
ঊনবিংশ শতকের মার্কিন সংবাদপত্রের বিজ্ঞপ্তিতে পালিয়ে যাওয়া আইরিশ চাকরানীর সন্ধানের জন্যে পুরস্কারের ঘোষণা
ঊনবিংশ শতকের মার্কিন সংবাদপত্রে পালিয়ে যাওয়া স্কটিশ ইনডেঞ্চারড সারভ্যান্টের জন্যে পুরস্কারের ঘোষণা
আইরিশ ইনডেঞ্চারড সারভ্যান্ট পরিবার। ঊনবিংশ শতকে পটাটো ফ্যামিনের সময় প্রচুর আইরিশ চাকর হিসাবে আমেরিকায় আসে।

এখন বলি বাঙ্গালী কখন নিজে হয়েছে দাসের মালিক। ঐযে কেপ টাউনের কথা বললাম, সেখানেই কিছু কিছু বঙ্গীয় মুক্তি-অর্জনের পরে নিজেই স্বদেশ-বিদেশ থেকে আনা দাস ক্রয় করত। সেটা ১৭০০ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত একশ’ বছরেরও বেশি সময় ধরে। আরো পরে, এমন কী ১৮৬২ সালে সিডনি মর্নিং হেরাল্ডে ইন্ডিয়ান রিফরমার পত্রিকা থেকে পুনর্প্রকাশিত একটা খবর পড়লাম, তাতে প্রতিবেদক অভিযোগ করছেন যে পূর্ববঙ্গের ঢাকা, বরিশাল, বিক্রমপুর, ফরিদপুর, পাবনা, ময়মনসিংহ, সিলেট, চট্টগ্রাম – এসব জায়গায় নাকি গোলাম-বাঁদি কেনাবেচা চলে। এদের কেউ আক্ষরিক অর্থেই ক্রীতদাস, আর কেউ কেউ চুক্তিভিত্তিক। মফস্বলের জমিদারদের মধ্যে দাস কেনা-বেচা আর উপহার হিসাবে আদান-প্রদানও চলত পুরোদমে। সেসময়কার এরকম আরও অন্তত দুটো খবর ইন্টারনেটে খুঁজে পাই।

আধুনিক বাংলাদেশে সেই প্রথা কি এখন সম্পূর্ণ বিলুপ্ত? আমার শ্রদ্ধেয় এক অগ্রজ আলোকচিত্রী, আর তার স্ত্রী (হফস্ট্রা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক), এই একবিংশ শতকেই বাংলাদেশের দুবলার চরে গিয়ে আবিষ্কার করেছেন আধুনিক দাসত্ব। শুঁটকির ফ্যাক্টরিতে কর্মরত আর শিকলপরা কিশোরদের প্রচুর ছবি আমাকে দেখিয়েছেন, এমনকি এক ছেলেকে উদ্ধার করেও নিয়ে এসেছিলেন। এরকম আরও নানারকম দাসত্ব আমাদের দেশে প্রতি নিয়ত দেখতে পাই।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




সপ্তদশ/অষ্টাদশ শতকে আমেরিকার কলোনিগুলিতে ইংলিশ কনভিক্টদেরও কেনাবেচা চলত
সাদা দাসদাসীদের কপালেও সাজা খুব সোজা প্রকৃতির ছিল না। মার্কিন উডকাট, অষ্টাদশ/ঊনবিংশ শতক।
আঙ্গেলা ফন বেঙালা, বাংলা থেকে কিডন্যাপ করে দাসব্যবসায়ীরা ডাচদের কাছে বিকিয়ে দেয় এনাকে। ১৬৫৭ সালে কেপ কলোনিতে এসে হাজির হন। ১৬৬৮তে মালিক মুক্তি দিয়ে দেন, ও তিনি খ্রীষ্টান হিসাবে ব্যাপ্টাইজ হন। ১৬৬৯ সালে ডাচ বুর্গার সমাজে বিয়েশাদী করে সেটলার শ্রেণীর অংশ হয়ে যান।
এই বইটিতে বাঙালী দাসরা কিভাবে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ কলোনিতে এসে হাজির হয় তার ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে।

যাই হোক, ধরলাম এইগুলি স্বভাবের ব্যতিক্রম। কিন্তু আমার মূল কথা হল, মার্কিনীরা গৃহযুদ্ধ করল এই নিয়ে, আর আমরা যুদ্ধ না করে পার পেয়ে গেলাম ব্রিটিশদের খাতিরে। যদি ব্রিটিশরা আমাদের ওপর খানিকটা ছড়ি না ঘোরাত— নাহয় তারা আর মার্কিনরাই এই প্রথার উচ্ছেদ করলো শুধু নিজেদের রাজ্যে — তাই যদি হতো, দাস কেনা-বেচাতে কি বাঙালী পিছিয়ে থাকত আরব কিংবা পর্তুগীজদের থেকে?

এই পেপারে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রাক্তন শ্বেতাঙ্গ প্রেসিডেন্ট এফ ডি ক্লার্কের বংশলতিকার বিশ্লেষণে বেরিয়েছে যে তার এক পূর্বপুরুষের নাম ‘ডায়ানা অফ বেঙ্গল’।
ইংল্যান্ডের ফ্রমে দাসপ্রথাবিরোধী অ্যাবসিশনিস্টদের সম্মেলনের বিজ্ঞপ্তি, ১৮২৫।
১৮৩৩ সালের স্লেভারি অ্যাবলিশন অ্যাক্টের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার তার সকল কলোনিতে দাসপ্রথা রহিত করে।
দাসপ্রথা বিলুপ্ত ঘোষণার পর ইনডেঞ্চারড সারভ্যান্ট বা কন্ট্রাক্ট লেবারের মার্কেট তৈরি হয়। ঊনবিংশ শতকের এই সংবাদবিজ্ঞপ্তিতে মার্কিন এক বন্দরে আসা ব্রিটিশ কারুকারদের ফিরিস্তি দিয়ে তাদের দাম বলা হয়েছে।
ইনডেঞ্চারড সার্ভ্যান্ট হিসাবে ভারতেরও কিছু অচ্ছুৎ জাতিগোষ্ঠীর মানুষ কুলি ও শ্রমিক হিসাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে হাজির হয়।
১৮৬২তে সিডনি মর্নিং হেরাল্ড পত্রিকায় বাংলাদেশের দাসপ্রথার বর্নণা।
ব্রিটিশরা ব্রিটিশ ভারতে দাসপ্রথা বিলুপ্ত করলেও নেটিভ রাজ্যগুলি, বিশেষ করে দুর্গম এলাকায়, তখনো সেটা করতে পারেনি। ভারত সরকারের এগুলি বন্ধ করতে ষাটের দশক লেগে যায়।
নেপালে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয় ১৯২৫এ
১৯২৭এ বার্মায় ক্রীতদাস মুক্ত করতে গিয়ে মারা গেছে ব্রিটিশ সৈন্য
ভূটানে দাসপ্রথা রহিত হয় ১৯৬০এ


আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!