তান্নু তুভা

আজ যে দেশটির ডাকটিকেট দেখাচ্ছি ত্রিশ দশকের ম্যাপসহ, তার স্বাধীন অস্তিত্ব আর নেই। ১৯২১ থেকে ১৯৪৪ পর্যন্ত নামমাত্র স্বাধীন দেশটির নাম তুভা।

১৯৩৬ সালের তুভার এই ডাকটিকেটে দেখা যাচ্ছে রেলের সাথে উটের দৌড়। প্রকৃতপক্ষে তুভায় কোন রেললাইন ছিল না। তুভার ‘উন্নয়নের’ মিথ্যে প্রচারনার উদাহরণ এ ডাকটিকেট। — ব্যক্তিগত সংগ্রহ

মোঙ্গোলিয়া আর রাশিয়ার মাঝে স্যান্ডইউচ দেশটি এখন রাশিয়ার একটি স্টেট। ১৯১১ পর্যন্ত এটি চীনের চিং সাম্রাজ্যের করদ রাজ্য মোঙ্গোলিয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিল।

ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি রুশ সাম্রাজ্য মধ্য এশিয়ার অনেকগুলি স্বাধীন রাজ্যকে ‘কলোনাইজ’ করে। তাদের মধ্যে রয়েছে কাজ়াখ়, বুখা়রা, খ়িভ়া, কোকন্দ প্রভৃতি খা়নাত আর তুর্কমেন-কিরগিজ় যাযাবরদের একাধিক গোত্র। এর আগেই অবশ্য ষোড়শ শতকে ইভ়ান দ্য টেরিবলের সময় সাইবেরিয়ার সিবির খা়নাতকে বশ করার মাধ্যমে মস্কোর ছোট্ট স্লাভিক রাজত্বটি রুশ সাম্রাজ্যে পরিণত হয়।

উপরের দেশগুলি যখন স্বাধীন ছিল, তখন সভ্যদেশে ডাকটিকেটের প্রচলন থাকলেও এরা অনগ্রসর মধ্যযুগীয় রাজ্য হওয়ায় টিকেট ছাড়ত না। তাই রুশ ‘কলোনাইজেশনের’ প্রমাণ হিসাবে সেসব জাহির করতে পারছি না। কাছাকাছি যেটা পড়ে, সেটা এই তুভার স্ট্যাম্প। কলোনাইজেশনের ফর্মুলাটা বলছি। এর সাথে ১৮৩৬এ টেক্সাসের যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যুক্ত হবার ফর্মুলার মিল আছে — বেমিলও আছে।

তুভায় ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকেই রুশ বণিক, র‍্যাঞ্চার, আর শিকারীরা চিং সাম্রাজ্যের ফরমান নিয়েই আনাগোনা করত। তারা বিভিন্ন জায়গায় বড় বড় ফার্ম গড়ে তোলে। শিকারীরা সেখানকার লোমশ জানোয়ার মেরে তাদের ফার নিয়ে বেঁচতো রাশিয়ার বনেদী পরিবারগুলির কাছে।

১৯১১তে চীনের মানুষ চিং সাম্রাজ্যের উপর যারপরনাই বীতশ্রদ্ধ ছিল। বিদেশীদের কাছে বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত্ব স্বার্থ বিকিয়ে দেয়া ছিল তাদের অসন্তুষ্টির মূল কারণ (বক্সার বিদ্রোহ, ১৮৯৯-১৯০১)। ফলে চিংদের বিরুদ্ধে শিনহাই বিপ্লবের সূত্রপাত হয়, প্রতিবাদের মুখে ‘বিধবা-সম্রাজ্ঞীর’ হাতের পুতুল ছয়বছরবয়েসী পুত্র সম্রাট পু-য়ী রাজসিংহাসন পরিত্যাগ করেন । পরিশেষে সুন-ইয়াত-সেনের নেতৃত্বে চীনা জাতীয়তাবাদী দল কোমিনতাং প্রভিশনাল প্রজাতন্ত্রী সরকার গঠন করে।

ত্রিশ দশকের এই মানচিত্রে তুভার অবস্থান দেখানো হয়েছে — ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

১৯১১তে চীনের এই দুর্বলতার সুযোগে মোঙ্গোলিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এসময় মোঙ্গোলদের মত তুভার জনগণও অনেকটা হাভাতে জীবনযাপন করছিল। একটা কারণ রুশ ফারশিকারীদের অতিশিকারের কারণে তাদের অন্নসংস্থান কমে যাওয়া, তার ওপর অজন্মা খরা। একদল তুভান নেতা চাইলো মোঙ্গোলিয়ার সাথে যোগ দিতে, আরেকদল চাইলো রুশদের ‘প্রোটেকশন’। কারণ মোঙ্গোলদের থেকে তাদের তুর্কীজাতীয় ভাষা-সংস্কৃতি ভিন্ন, শুধুমাত্র বৌদ্ধধর্মে দু’জাত মিলে।

রুশ সম্রাট নিকোলাস প্রথমে মনোস্থির করতে না পারলেও শেষ পর্যন্ত রুশ কলোনিস্ট আর ট্রেডারদের চাপে অজুহাত দাঁড়া করালেন যে তুভায় রুশদের ওপর আক্রমণ হচ্ছে, আর তাদের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব তাঁর সেনাবাহিনীর। রুশ সেনাদল প্রথমে একটা ক্ষণস্থায়ী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করলো রুশপন্থী তুভানদের, পরে সে প্রজাতন্ত্র রাশিয়ার অংশ হয়ে গেল।

এখানেই কাহিনী শেষ নয়। ১৯১৭তে রুশ সাম্রাজ্যের বহুদিনের নড়বড়ে ভিত ভেঙে পড়ল বলশেভিক বিপ্লবের আঘাতে। মস্কো-পেত্রোগ্রাদসহ অল্পকিছু শহরে কম্যুনিস্টরা সরকারের দখল নিলেও প্রাদেশিক অঞ্চলগুলি ৎসারপন্থী ‘শ্বেত রুশ’ জেনারেলদের দখলে ছিল। সেসব অঞ্চলে তারা নিজেদের ইচ্ছেমত স্বাধীন সরকার গঠন করা শুরু করে



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




সেই রুশ গৃহযুদ্ধের সময়ে ১৯১৮তে তুভা প্রথমে দখল করে এক শ্বেতফৌজ জেনারেল কোলচাক। কিন্তু এক বছর পরেই তুভার দখল চলে যায় চীনা ও মোঙ্গোল সেনাদলের কাছে। কম্যুনিস্ট লালফৌজ ধীরে ধীরে যখন শ্বেতরুশদের হারিয়ে দেয়া শুরু করে, তখন তারা ১৯২১এ তুভায় ঢুকে চীনাদের হটিয়ে দেয়। আর তুভার বলশেভিক কমরেডদেরকে দিয়ে নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের ঘোষণা দেয় — তুভান পিপলস রিপাবলিক

তান্নু-তুভা নামে নতুন ‘স্বাধীন’ দেশটিকে স্বীকৃতি দিয়েছিল কেবলমাত্র সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মোঙ্গোলিয়া। ছোট দেশটি এত সুদূর আর বিচ্ছিন্ন যে তারা স্বাধীন না পরাধীন নাকি পাপেট, তাতে বাকি বিশ্বের কিছু যেত-আসত না। কিন্তু তুভা ডাকটিকেট ইস্যু করত। আর সেগুলিও ছিল নানা রঙের, আর ত্রিভুজ, প্যারালেলোগ্রাম, ডায়মন্ড, ইত্যাদি অদ্ভূত আকারের। তাই যখন বহির্বিশ্বের মানুষের হাতে এসে পড়ত, সবাই তখন আহা-উহু করত

তুভার প্রথম প্রধানমন্ত্রী কু’লার দোন্দুকের মাথায় স্বাধীন চিন্তা ঘুরপাক খাওয়া অবশ্য রুশরা থামাতে পারেনি। প্রাক্তন বৌদ্ধ শ্রমণ সেই রাষ্ট্রনায়ক চেষ্টা করেন মোঙ্গোলিয়ার সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করতে, আর বৌদ্ধ ধর্ম ও লামাদেরকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিতে। সমাজতান্ত্রিক পলিসিকেও পাশ কাটিয়ে চলা শুরু করেন তিনি।

১৯২৬এ দোন্দুক বৌদ্ধ ধর্মকে যখন রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেন, তখন স্তালিনের টনক নড়ল। মস্কোর এক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ তুভান ছাত্রকে দেশে ফেরত পাঠালেন। তারা তুভায় এসে ‘জনসংগ্রাম’ সংগঠিত করতে শুরু করে। শেষপর্যন্ত ১৯২৯এ কু’র মাধ্যমে দোন্দুককে অপসারণ করা হয়। পাঁচ জনে মিলে সোভিয়েত স্টাইল সরকার দাড়া করায়। জোরপূর্বক যৌথখামারব্যবস্থা চালু করে; মোঙ্গোল বর্ণমালা উচ্ছেদ করে প্রথমে লাতিন ও পরে সিরিলিক অক্ষরের ব্যবহার চালু করে ; রুশদের নাগরিকত্বপ্রদান শুরু করে; আর বৌদ্ধ ধর্মের লামা আর প্রাচীন ধর্মের শামানদের জেলে পোরা শুরু করে। ১৯৩২ সালে দোন্দুককে বিচারের প্রহসনে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়।

উপরের স্ট্যাম্পটি তার পরবর্তী সময়ের। ১৯৩৬ সালের। বাইরের মানুষ যদিও ভাবত এসব ডাকটিকেট তুভা থেকে প্রকাশিত, তারপরও পারতপক্ষে এগুলি তুভার আলোবাতাস আদৌ পেয়েছে কিনা সন্দেহ! কারণ এগুলি প্রিন্ট করা হয়েছে মস্কোর অফিশাল সোভিয়েত প্রেসে! হয়ত কিছু তুভাতে পাঠানো হয়েছে — তুভার মত বিস্তীর্ণ কম জনধ্যুষিত দেশে সেগুলির কি ব্যবহার ছিল স্তালিনই বলতে পারতেন ভাল! কিন্তু বাকি বিশ্বের ফিলাটেলিস্টদের কাছে এসব স্ট্যাম্প বিকোত বেশ, আর তার থেকে দু’পয়সা কামাই করে নিত সোভিয়েতরা (তখনও তারা সুপারপাওয়ার হয়ে ওঠেনি)।

এ ডাকটিকেটে দেখানো হচ্ছে যে রেলগাড়ির সাথে রেইস দিচ্ছে ব্যাক্ট্রিয়ান ঊট। ভাবখানা এমন যে, তুভায় এতই প্রগতির বন্যা বইছে যে ঊটকে নিজের চাকরি বহাল রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে!

বাস্তবতা হলো, তুভাতে সে আমলে কোন রেললাইনই ছিল না, আর এই একবিংশ শতকেও নেই!

তুভাকে অবশ্য বেশিদিন এই ড্রামার ভিক্টিম হতে হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে স্তালিন যখন ১৯৪৪এর অক্টোবরে জার্মান বাহিনীকে সাঁড়াশি অভিযান করে ইউক্রেইন, বেলারুশ, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, এস্তোনিয়া থেকে উৎখাত করছেন, আর একে একে এ দেশগুলিকে ‘এসএসআর’ নাম দিয়ে ‘মুক্ত’ করে দিচ্ছেন, আর তারা বেজায় খুশি হয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে যোগ দিচ্ছে, তখন কোন এক সকালে উঠে তুভাবাসী দেখে তারাও কোন ফাঁকে ‘এসএসআর’ নয়, রুশ এসএসআরের ‘ওব্লাস্ত’ (প্রদেশ) হয়ে গেছে! তাদের সংসদ ‘খুরালে’ কোন ভোটাভুটি ছাড়াই রাবারস্ট্যাম্প মেরে রাশিয়ার কাছে যা স্বাধীনতা ছিল — স্ট্যাম্প ইস্যু করার অধিকারসহ — দেশনেতারা বেঁচে দিয়েছে!

আজ তুভা রুশ ফেডারেশনের ৮৫টি ফেডারেল সাবজেক্ট, যার মধ্যে ২২টি রিপাবলিক, তাদের একটি রিপাবলিক। এখনো দেশটি বিচ্ছিন্ন, প্রত্যন্ত। রেললাইন একটা চালু হবার কথা ২০২০ সালে।

তুভানদের সংস্কৃতি, বিশেষ করে মোঙ্গোলদের মত থ্রোট সিঙ্গিং
, পশ্চিমা বিশ্বে বেশ মনোযোগ কেড়েছে। সেটা শোনার জন্য ইউটিউবে হুন-হুর-তু (Huun Huur Tuu) কিংবা কোঙ্গার-ওল ওন্দার (Kongar-ol Ondar) খুঁজে দেখুন


(১) খা়নাত হলো ‘খা়ন’শাসিত ক্ষুদ্র রাজ্য। এরা মুসলিমও হতে পারে, বৌদ্ধও হতে পারে, শামানও হতে পারে। খা়ন শব্দটি মূলে তুর্কী-মোঙ্গোল, আরবী নয়। চেঙ্গিস খা়ন মুসলিম ছিলেন না! [Khanate]

(২) এখানে অবশ্য পু-য়ীর কাহিনী শেষ না, আবার তাঁকে দেখা যাবে জাপানের পাপেট স্টেট মাঞ্চুরিয়ার নামমাত্র ‘সম্রাট’ হিসাবে! [Henry Puyi]

(৩) বিভিন্ন শ্বেতফৌজ জেনারেলও রাশিয়ার সাম্রাজ্যের কোন না কোন এলাকায় ৎসার নিকোলাসকে রাজা মেনে স্বাধীন রাজ্য বানিয়ে ডাকটিকেট ছাড়ত, সেগুলি বেশ চমকপ্রদ আইটেম! [White Movement]

(৪) মোঙ্গোলিয়াতেও লালফৌজের প্রচ্ছন্ন সহায়তায় গঠিত হয় কম্যুনিস্ট সরকার। সোভিয়েত রাশিয়া বাদে তাই মোঙ্গোলিয়া একটি মাত্র দেশ যেখান সাত দশক কম্যুনিজম চলেছে। [Mongolian People’s Republic]

(৫) পদার্থবিদ রিচার্ড ফেইনম্যানও তান্নু-তুভার পোস্টেজ স্ট্যাম্প দেখে খুবই শখ করেছিলেন সেখানে যাবার। কিন্তু মার্কিনদের জন্যে সোভিয়েতের সুদূর একটি অঞ্চলে যাওয়া ছিল অকল্পনীয়, বিশেষ করে যখন সোভিয়েতদের পর্যটনশিল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের প্রগতিশীলতা জাহির করা, তুভার মত প্রত্যন্ত পশ্চাদপর সমাজব্যবস্থা দেখালে উল্টোফল। ১৯৮৮ সালে ফেইনম্যানের স্বপ্ন পুরো হবার আগেই তিনি ক্যান্সারে মারা যান। তার ঠিক পরপরই তার তুভা যাবার ভিসা হাজির হয়। [Tuva or Bust!]

(৬)কামাল আতাতুর্কের তুর্কী-আরবী থেকে লাতিনে যাবার মত। খোলস পাল্টে কিছু একটার চেহারা পরিবর্তনই ছিল এসকল ‘রিফর্মার’দের প্রগতিশীলতার উদাহরণ। এতে সামাজিক বাস্তবতার তেমন কোন পরিবর্তন হয় না। [Turkish Alphabet Reform]

(৭) সোভেতস্কায়া সোৎসিয়ালিস্তিচেস্কায়া রেসপুবলিকা — এ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের নামেমাত্র স্বতন্ত্র ১৫টি প্রজাতন্ত্রের গালভরা অফিশাল নাম, সোভিয়েত সোশালিস্ট রিপাবলিক। [Republics of the Soviet Union]

(৮) থ্রোট সিঙ্গিং এক অদ্ভূত ‘এলিয়েন’ টাইপের গান, ফুসফুস থেকে গলা পর্যন্ত প্রায় প্রতিটা চেম্বারের রেজোন্যান্ট ফ্রিকোয়েন্সিতে আওয়াজ তুলতে পারলে মনে হয় যে একই মানুষ দুই বা ততোধিক টোনের শব্দ করছে! একে ওভারটোন সিঙ্গিংও বলে। তিব্বতী বৌদ্ধ শ্রমণরাও এভাবে মন্ত্রোচ্চারণ করে। মোঙ্গলদের পাশাপাশি তুভান আর আরো কিছু পূর্ব সাইবেরীয় গোত্রের এ ঐতিহ্য রয়েছে। [Overtone Singing]

(৯) টেড-এক্সের একটা তুভান থ্রোট সিঙ্গিং ভিডিও [Tuvan Throat Singing | Alash | TEDxBaltimore]



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...






আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




ব্যালান্স অফ গ্রেট পাওয়ারস

১৯১৪ সালে সার্বিয়া নামের ছোট্ট, কিন্তু দাম্ভিক, স্লাভিক জাতীয়তাবাদী রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রটিকে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির যৌথ সাম্রাজ্য আক্রমণ করে বসে। আর তার ফলে শুরুতে ইউরোপ, পরে বিশ্বব্যাপী ইউরোপীয় কলোনিগুলি, আর শেষে নব্যপরাশক্তি জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র, জড়িয়ে পড়ে সাড়ে তিন বছর দীর্ঘ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে (১৯১৪-১৯১৮)।

ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধে ইউরোপে এথনিক-লিংগুইস্টিক জাতীয়তাবাদ ছিল বেশ জনপ্রিয়। এর ফলশ্রুতিতে ছোট-মাঝারি কয়েকটি রাজ্য নিয়ে উত্তরে ও দক্ষিণে দু’টি নতুন সাম্রাজ্যের সূচনা হয় — বিসমার্কের জার্মানি (১৮৭১) ও গারিবাল্দির ইতালি (১৮৬১)।

ডানপন্থী জাতীয়তাবাদের পাশাপাশি বামপন্থী অ্যানার্কিজ়ম, বিপ্লবী কম্যুনিজ়মও যে জনপ্রিয় হচ্ছিল বলা বাহুল্য। পুরনো সাম্রাজ্যগুলির দুর্বলতার সুযোগে তাদেরও সফল ও বিফল উত্থান ঘটে বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে (বলশেভিক বিপ্লব, ১৯১৭; সোভিয়েত হাঙ্গেরি, ১৯১৯; জার্মানির স্পার্টাসিস্ট বিদ্রোহ, ১৯১৯)। আর জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে মুলত অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি ও রাশিয়া ভেঙ্গে নতুন কয়েকটি দেশ ইউরোপের মানচিত্রে স্থান পায় (চেকোস্লোভাকিয়া, ইউগোস্লাভিয়া, পোল্যান্ড, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া)।

ঊনবিংশ শতকে ইউরোপের রাজপরিবারগুলি নাপোলেওনের সময়কার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ (১৮০৩-১৮১৫) এড়ানোর জন্যে একে অন্যের সাথে সামরিক সমঝোতা চুক্তি করা শুরু করে। নানা চুক্তির জালের বুনটে সংরক্ষিত হয় ছোট রাজ্যগুলির নিরাপত্তা, স্ফেয়ার অফ ইনফ্লুয়েন্স, ইত্যাদি। তার ওপর রাজপরিবারগুলি একে অন্যের সাথে আত্মীয়তার বন্ধনে জড়িয়ে আরেক লেভেলের ‘নিরাপত্তা’ তৈরি করে। যেমন, রুশ ৎসার নিকোলাস ছিলেন ব্রিটিশরাজ পঞ্চম জর্জের আপন খালাত ভাই, তাঁদের ছবি দেখলে তাঁদের আলাদা করে চেনার উপায় নেই। এধরনের ভূরাজনৈতিক ব্যবস্থা পরিচিত ছিল ‘ব্যালান্স অফ গ্রেট পাওয়ারস’ বলে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থামানো তো দূরের কথা, এ ব্যবস্থা একদিক থেকে দায়ী ছিল যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরির জন্যে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মূল কারণ অনেক গভীর, একটি কারণ জার্মানির উচ্চাকাংক্ষা। উডরো উইলসনের ভাষায় “ব্রিটেন হ্যাজ় দ্য আর্থ, এন্ড জার্মানি ওয়ান্টস ইট।” এটুকু কথার পিছনে অনেক লম্বা ইতিহাস রয়েছে। শিল্পায়ন যুগের শেষভাগে কাঁচামাল আর বাজারের জন্যে প্রতিযোগিতা, বাণিজ্যিক ও সামরিক সাম্রাজ্য গড়ার প্রচেষ্টা, ইত্যাদি। সে চিত্রে জার্মানি ছিল লেইটকামার। শেষে এসেও যুদ্ধবিগ্রহের সুযোগ নিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়ে নেয়া ছিল জার্মান শাসকগোষ্ঠীর মূল লক্ষ্য। এধরনের “রেয়ালপলিটিক” (“বাস্তবতাভিত্তিক কূটনীতি”) জার্মানির রূপকার বিসমার্কেরই সিগনেচার কৌশল। এর সফলতার কারণেই প্রুশিয়া নামক সামরিক রাষ্ট্র থেকে জার্মান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ হয় (১৮৭১-১৯১৯)।

অর্থাৎ বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকেই তার যথেষ্ট বারুদ তৈরি ছিল।

আর সে বারুদে যে স্ফূলিঙ্গটি বিস্ফোরণ সৃষ্টি করে, তা হলো বসনিয়ায় সার্ব আততায়ীর হাতে ডাকটিকেটে দেখানো অস্ট্রীয় যুবরাজ আর্চডিউক ফ্রানৎস ফেরডিনন্ড ও তাঁর স্ত্রী সোফিয়ার মৃত্যু (জুন ২৪, ১৯১৪)।

১৯১৭ সালে বসনিয়ায় অস্ট্রীয় সামরিকবাহিনীর ব্যবহারের জন্য প্রকাশিত এই ডাকটিকেটে স্মরণ করা হয়েছে ১৯১৪ সালে সার্ব আততায়ীর হাতে নিহত আর্চডিউক ফ্রানৎস ফেরডিনন্ড ও তাঁর স্ত্রী সোফিয়াকে — ব্যক্তিগত সংগ্রহ

ফ্রানৎস ফেরডিনন্ডের যুবরাজ হবার কথা ছিল না। অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির রক্ষণশীল সম্রাট ফ্রানৎস ইয়োসেফের একমাত্র পুত্র রুডল্ফ ত্রিশ বছর বয়সে পরকীয়া প্রেমের সূত্র ধরে প্রেমিকার সাথে আত্মহত্যা করেন ১৮৮৯ সালে। সেসময় নাকি তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন। ফলশ্রুতিতে, ফ্রানৎস ইয়োসেফের ছোট ভাই কার্ল লুডভ়িগ হন সিংহাসনের উত্তরাধিকারী। ১৮৯৬ সালে তাঁরও মৃত্যু হয় — প্যালেস্টাইনের ‘পবিত্র’ জর্দান নদীর নোংরা পানি খেয়ে টাইফয়েডে ভুগে। তখন তাঁরই ছেলে ফ্রানৎস ফেরডিনন্ডের ওপর যুবরাজ হবার গুরুদায়িত্ব বর্তায়।

ফ্রানৎস ফেরডিনন্ড সেকারণে অনেক দেরিতে রাজশাসনের উপযোগী শিক্ষালাভ শুরু করেন। বৃদ্ধ সম্রাট ফ্রানৎস ইয়োসেফের সাথেও ঝগড়াঝাঁটি লেগে থাকত। ‘বুড়ো ভামকে’ অতিরিক্ত রক্ষণশীল ভাবতেন তিনি। বিয়েও করেন রাজপরিবারের ঐতিহ্যের বাইরে। তাতে সম্রাট সায় দেন শুধুমাত্র একটি শর্তে, যে বিয়েটি হবে ‘মর্গানিটিক’। অর্থাৎ রাজকার্য, উপাধি, ইত্যাদিতে সোফিয়া আর তাঁর ছেলেমেয়েদের কোন দাবি থাকবে না। ফ্রানৎস ফেরডিনন্ড মারা গেলে তাঁর বংশধরের পরিবর্তে সম্রাট হবেন ফ্রানৎস ইয়োসেফের আরেক ভাতিজা কার্ল।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




শিকারপাগল ফ্রানৎস ফেরডিনন্ডের ১৮৯২-৯৩এর ভারতভ্রমণের সময়কার ছবি। — ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

জার্মানির সমস্যা ছিল তার শাসকগোষ্ঠীর জার্মান-জাতীয়তাবাদী ঔদ্ধত্য, আর অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির সমস্যা ছিল তার উল্টো। জাতিগতভাবে জার্মান, আর ধর্মে ক্যাথলিক, হাবসবুর্গ গোষ্ঠীর সম্রাটরা কয়েক শতাব্দী ধরে সার্ব, ক্রোয়েশিয়ান, স্লোভেনিয়ান, চেক, স্লোভাক, ইউক্রেনিয়ান, রোমানিয়ান, পোলিশ, ইতালিয়ান, ইত্যাদি নানা ভাষা ও জাতের প্রজাদেরকে শক্ত হাতে শাসন করে চলছিল। ১৮৪৮ সালে সে ব্যবস্থার ওপর আঘাত আসে হাঙ্গেরির মাগিয়ার জাতিগোষ্ঠীর বিপ্লবের মাধ্যমে। অস্ট্রিয়ার শাসকরা রাজি হন সাম্রাজ্যকে দু’টি সমকক্ষ রাজত্বে ভাগ করে একভাগের শাসনভার মাগিয়ারদের দিতে, অবশ্য রাজা-সম্রাট থাকবেন একই হাবসবুর্গ উত্তরসূরী।

এতে সমস্যার তেমন কোন সমাধান হয়নি। কারণ মাগিয়াররা আরো ক্ষমতাবান হয়ে অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীকে তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করা শুরু করে। অপরদিকে অস্ট্রীয় জার্মানরাও সামরিক অভিযানের মাধ্যমে প্রাক্তন তুর্কী প্রদেশ বসনিয়া-হারজেগোভিনাকে হস্তগত করে তাকে ‘প্রতিরক্ষার’ নামে (বসনিয়া-হারজেগোভিনা প্রটেক্টোরেট, ১৮৭৮)।

অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরিকে প্রদেশে ভাগ করে কিভাবে ফেডারেল পদ্ধতিতে শাসন করা সম্ভব, ১৯০৬এ তার একটা প্রস্তাবনা করেছিলেন এক রোমানিয়ান বুদ্ধিজীবী আউরেল পপভিৎস। ফরাসী ভাষার মানচিত্রে এই বৃহত্তর অস্ট্রিয়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রাদেশিক বিভাগ দেখানো হয়েছে। — ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

এসব কারণে জার্মান-মাগিয়ার বাদে বাকি সকল এথনিক জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে স্লাভরা, যারপরনাই অসন্তুষ্ট ছিল। আর দু-দু’টো বল্কান যুদ্ধে ‘ইউরোপের সিক ম্যান’ তুরস্ককে পরাজিত করে সার্বিয়া-বুলগেরিয়ার মত দেশগুলি সে এলাকার সামরিক পরাশক্তিগুলির মাঝে যথোপযুক্ত স্থান করে নেয়। সার্বিয়ার পরবর্তী লক্ষ্য হলো আরেক ‘সিকম্যান’ অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরীর ‘নিষ্পেষিত’ স্লাভিক জনগোষ্ঠীদের ‘মুক্ত’ করে উত্তরের তুতো ভাই রুশদের মত দক্ষিণেও সর্ব-স্লাভিক দেশ ‘ইউগোস্লাভিয়া’ কায়েম করা। সে লক্ষ্যে বসনিয়ার সার্ব স্বাধীনতাসংগ্রামীদের (বা সন্ত্রাসবাদীদের) গোপনে রসদ সরবরাহ করে সার্বিয়া। সংগঠিত হয় ইয়ং বসনিয়া আর ব্ল্যাক হ্যান্ডের মত গুপ্তদল।

১৯১৪ সালের ২৪শে জুন ফ্রানৎস ফেরডিনন্ড সস্ত্রীক বসনিয়ার সারায়েভো পরিদর্শনে আসেন। সকালেই তাঁর মোটর শোভাযাত্রার ওপর পরিকল্পিত গ্রেনেড হামলা করে ইয়ং বসনিয়ার এক সদস্য। সে যাত্রা বেঁচে যান অস্ট্রিয়ার যুবরাজ, শুধু পিছনের গাড়ির কয়েকজন আহত হয়। ফ্রানৎস ফেরডিনন্ড গভর্নরের প্রাসাদে পৌঁছে বেশ হম্বিতম্বি করেন, তারপর দুঃসাহস দেখিয়ে দিনের বাকি কর্মসূচীপালনের জন্যে আবার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। কিছু বিভ্রান্তির কারণে গাড়িবহর পথে বিলম্বিত হয়। ভাগ্যের ফেরে সেপথের পাশেই এক কাফেতে বসে কফি খাচ্ছিল গাভ্রিলো প্রিন্সিপ বলে ইয়ং বসনিয়ার আরেক সদস্য। সকালের বিফল সাথীর কার্যসিদ্ধি করবে কি করবে না সে নিয়ে দোনমনা করতে করতেই গাভ্রিলো কাফে থেকে বের হয়ে সাথে থাকা রিভলভার দিয়ে ক্লোজ রেঞ্জে ফ্রানৎস ফেরডিনন্ড আর সোফিয়াকে গুলি করে বসে। যথোপযুক্ত পরিচর্যা সাথে সাথে না পাওয়ায় দু’জনেই কয়েক মিনিটের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন।

এরপরে সূচনা হয় ১৯১৪এর জুলাই সংকট — অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি কঠিন শর্তের আল্টিমেটাম দেয় সার্বিয়াকে। আক্রান্ত হলে সার্বিয়াকে তাদের তুতোভাই রুশরা সাহায্য করবে, এ ভরসায় সার্বরা আল্টিমেটামকে পাশ কাটিয়ে যায়। ফলে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় দুজনের মধ্যে। রুশরা ঠিকই আসে সার্বদের সাহায্যে। জার্মানিও আরো সাম্রাজ্যের লোভে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দেয়। আর রুশদের মিত্র, ত্রিপল-অঁতঁতের অপর দুই দেশ ব্রিটেন-ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয়। তুরস্কও অক্ষশক্তির সাথে যোগ দেয় এই ভেবে যে রুশ আর স্লাভদের কাছে খোঁয়া যাওয়া আগের সাম্রাজ্য পুনরোদ্ধার হবে।

ফ্রানৎস ফেরডিনন্ডের মৃত্যুতে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলো, এ ভাগ্যের পরিহাস! কারণ, ফ্রানৎস ফেরডিনন্ড অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির সাম্রাজ্যে জার্মান-মাগিয়ারদের একাধিপত্য খর্ব করে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীকে সমাধিকার দেয়ার ব্যাপারে উদারপন্থী ছিলেন। তাতে নিজের সর্বময় ক্ষমতা অবশ্য অটুট রাখতে পিছপা ছিলেন না। বেঁচে থাকলে আর রাজসিংহাসনে বসলে হয়ত কোন না কোন উপায়ে নিজ রাজ্যের সমস্যাগুলি সমাধানের চেষ্টা করতেন।

এখানে আরেকটা তুলনা উল্লেখযোগ্য। ওসমানি তুরস্ক আর হাবসবুর্গ অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি — এ দুটি দেশের সমস্যাগুলি একই রকম ছিল। দুটোতেই সম্রাট সর্বেসর্বা — সংসদ নামেমাত্র। তাছাড়াও অস্ট্রিয়ার কাইজ়ার একই সাথে হোলি রোমান এম্পেরর — অর্থাৎ ক্যাথলিককূলের ধ্বজাধারী রক্ষক। তুরস্কের সুলতানও সেরকম নমিনাল ‘আমিরুল মুমিনীন’ — তাবৎ মুসলিমদের ঈমানের রক্ষক। দুটো দেশেই ইহুদী-খ্রীষ্টান-মুসলিম আরব-তুর্কী-আর্মানী-ফার্সী চেক-স্লোভাক-ক্রোয়েশীয়-পোলিশ ইত্যাদি নানা জাতি ও ভাষার জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। দুটোই ছিল একরকম ‘সিক ম্যান’ — অর্থাৎ সামরিক প্রযুক্তি আর অর্থনৈতিক-সামাজিক প্রগতিশীলতার বিচারে পশ্চাদপর। আর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে দুটো দেশই টুকরো টুকরো হয় যায়।

তফাত হলো, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির টুকরোগুলি দেশে পরিণত হয় তাদের জাতিস্বত্ত্বার ইচ্ছানুযায়ী। সেসব আত্মসমর্পণের চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র ও উডরো উইলসন জড়িত ছিলেন, যাঁর মূল লক্ষ্য ছিল যেন সেসব নতুন দেশে কোন না কোন ধাঁচের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়। কিছুটা সফলও হয়েছিল সে উদ্দেশ্য, চেকোস্লোভাকিয়া ভাল উদাহরণ। আবার উল্টোদিকে ইউগোস্লাভিয়ায় গণতন্ত্রের বদলে সার্বীয় রাজার ৎসারতন্ত্র কায়েম হয়।

তুরস্কের ক্ষেত্রে আত্মসমর্পণের চুক্তিতে মার্কিনদের আসন ছিল না। তুরস্কের জাতিস্বত্ত্বাগুলির নিজস্ব সিদ্ধান্তের বদলে বিজয়ী ঔপনিবেশিক শক্তি ব্রিটেন ও ফ্রান্স নিজেদের ইচ্ছেমত ম্যাপ কাটাকুটি করে ভাগ করে নেয়। যার ফলে সিরিয়া ও ইরাকের মত দুটি ‘আর্টিফিশিয়াল’ দেশের উদ্ভব ঘটে, যার প্রজাদের জাতিগত পরিচয়ের মধ্যে কোন সামঞ্জস্য ছিল না। এখানেই কিন্তু তাদের পরবর্তী দুর্ভোগের বীজের বপন। সাথে কুর্দিস্তান-সৌদি-প্যালেস্টাইন-লিবিয়া ইত্যাদিরও ভাগ্যলিখন চূড়ান্ত হয়ে যায়। (সাইকস-পিকো অ্যাগ্রিমেন্ট, ১৯১৬)।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে এত কিছু লেখার জন্যে শুরুতে বসিনি। চেয়েছিলাম আমার সংগ্রহের ঐ ডাকটিকেটটা জাহির করে ফ্রানৎস ফেরডিনন্ডের গল্প বলতে। কান টানতে মাথা চলে এল!


পুনশ্চ: চিন্তা করে দেখলাম সাইকস-পিকোকে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে নির্দোষ বলা যায় কিনা। মনে হয় যায়। কারণ, সিরিয়া-ইরাকের যেসকল সমস্যা, সেসকল সমস্যা ইউগোস্লাভ জনপদগুলিরও ছিল, আর তাদেরও কপালে একই লিখন ছিল (নব্বই দশকের একাধিক যুদ্ধ ও প্রচুর পৈশাচিকতা ও লোকক্ষয়)। ইউগোস্লাভিয়া সেসকল তুর্কী সমস্যা ইনহেরিট করেছিল, গ্রীক-আলবেনীয়দের প্রচুর পকেট ছিল তাদের রাজ্যে যাদের তেমন কোন অধিকার স্লাভরা দেয়নি। অর্থাৎ সমস্যা একই — সাইকস-পিকো ছাড়াই।

আর ইউরোপের জাতিগোষ্ঠীগুলির জাতীয়তাবাদের কারণে তাদের ইতিমধ্যে স্বদেশের মানচিত্রের ধারণা ছিল। ইরাক-সিরিয়ার আলাউয়ী, শিয়া, সুন্নি, দ্রুজ, ইয়াজিদি, তুর্কমেন, এদের জাতীয়তাবাদের তেমন কোন ধারণাই ছিল না — আরব, আর্মনী আর কুর্দ বাদ দিলে। তাদের জনপদগুলিও ছিল ছড়ানো-ছিটানো, আলাদা করে অর্থবহ ভৌগোলিক ম্যাপ আঁকা মনে হয় না সম্ভব ছিল। পরবর্তীতে যখন জনসংখ্যা বাড়তে বাড়তে একেক জনপদের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়, তখন থেকেই অধুনাযুগের টেনশনগুলির শুরু।

অর্থাৎ সেসময়ের নিরিখে হয়ত সাইকস-পিকো ছিল আরব স্বদেশভূমির একটি গ্রহণযোগ্য, কিন্তু ঔপনিবেশিক, সমাধান। আর তা না হলেও সাইকস-পিকোর সাধ্যি ছিল না এত কিছু বুঝে (বা না বুঝে) ভবিষ্যদ্দর্শনের।

(আর সাইকস-পিকোর আরেক পার্টনর ছিল রুশরা, পরবর্তী বলশেভিক সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সাইকস-পিকোর হাড়ি হাঁটে ভেঙে দেয়।)

[Sykes–Picot Agreement]




আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...






আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




পুরানো সেই দিনের কথা…

Featured Video Play Icon

“পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়।
ও সেই চোখের দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়।
আয় আর-একটিবার আয় রে সখা, প্রাণের মাঝে আয়।
মোরা সুখের দুখের কথা কব, প্রাণ জুড়াবে তায়।”

রবিঠাকুরের এই গানটির সুর যে মৌলিক নয়, তা প্রবাসী বাঙ্গালীমাত্রেরই জানা। কারণ, প্রতি ৩১শে ডিসেম্বর লন্ডনের বিগ বেন থেকে নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কয়ার, সিডনি অপেরা হাউস থেকে এমনকি প্রাচ্যের জাপান পর্যন্ত একই সুরে গান করে নতুন বছরকে স্বাগত জানায় বিপুলসংখ্যক জনতা।

রবীন্দ্রনাথ গানটি লিখেছিলেন ১৮৮৫ সালে। তাঁর প্রথম বিলাতযাত্রা হয় সতেরো বছর বয়েসে ১৮৭৮ সালে। সে যাত্রা আর বিলাতজীবনের কাহিনী তিনি লিখে রেখে গেছেন য়ুরোপ-বাসীর পত্রে। সে বই পড়লে জানবেন যে, ব্রাইটন আর সংলগ্ন এলাকার বিভিন্ন পার্টি, সোশ্যাল গ্যাদারিং আর নাচগানের দাওয়াতে রবীন্দ্রনাথের হরদম যাওয়া-আসা ছিল। রবার্ট বার্নসের আসল গানটা ততদিনে কমপক্ষে একশ’ বছর ধরে স্কটল্যান্ড আর অন্যান্য ব্রিটিশ রাজ্যের পানশালাগুলিতে জনপ্রিয়তা কুড়িয়ে আসছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রথম বিলাতজীবনে কোন না কোন জায়গায় গানটি অবশ্যই শুনে থাকবেন। ও হ্যাঁ, যারা তদ্কালীন ব্রিটেনের মানুষের ‘কলোনিয়াল’ দৃষ্টিভঙ্গি সম্বন্ধে খুবই অরাজনৈতিক বিবরণী জানতে চান, তারা বিশ্বকবির এই বইটি পড়ে দেখুন।

সুরটির ‘মূল রচয়িতা’ রবার্ট বার্নস ছিলেন স্কটিশ কবি ও গীতিকার। লিখতেন ইংরেজীর স্কটিশ উপভাষা স্কটসে। ১৭৮৮ সালে এডিনবরার ‘স্কটস মিউজিকাল মিউজিয়াম’ নামে এক প্রকাশনার কাছে ‘ফর অল্ড ল্যাং সাইন’ নামক এই গানটি সুরসহ পাঠান, নামটির ইংরেজী শব্দান্তর হল ‘ফর ওল্ড টাইম’স সেইক’ — পুরনো স্মৃতির খাতিরে। বার্নস যদিও নিজের কিছু কাব্য এতে জুড়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু সুর ও মূল কথাগুলি যে একটি স্কটিশ লোকগীতি থেকে ধার করেছিলেন সে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছিলেন। অর্থাৎ রবিঠাকুরের সুপরিচিত গানটি বার্নসের ধারেরও ধার।

আমরা যদিও জানুয়ারির এক তারিখকে বলি ইংরেজী নববর্ষ, আসলে ইংল্যান্ড-স্কটল্যান্ডসহ ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের রাজ্যগুলি, এবং তাদের প্রাক্তন কলনী আমেরিকা, ১৭৫২ সালের আগে ২৫শে মার্চকে মানত বছরের শুরু। ২৫শে মার্চের তারিখটা স্প্রিং ইকুইনক্সের সাথে জড়িত। আরব-পারসিকদের নওরোজও উদযাপিত হয় একই দিনের ধারকাছ দিয়ে।

পয়লা জানুয়ারিটা মূলে রোমান ঐতিহ্য, কারণ প্রাচীন রোমের শাসনভার নবনির্বাচিত কনসালরা তুলে নিতেন ঐ তারিখে। আসলে, রোমসহ প্রাচীন নিকটপ্রাচ্যে দশটি মাসে বছর গোনা হত, শীতকালে কোন মাস গোনা হত না, আর বছর শুরু হত মার্চে। সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মাসগুলির নাম তাই এখনো লাতিনের সাত থেকে দশ পর্যন্ত সংখ্যার স্মৃতিবহন করে চলেছে। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি যোগ হয় রোমশহরের আদিকালে, পুরো বছরকে বারটি চান্দ্রমাস দিয়ে পরিপূর্ণতা দিতে। জানুয়ারির নামকরণ তখন হয় দু’মুখো দেবতা জানুসের নামে। জানুস হলেন কাল, আরম্ভ, শেষ — সোজা কথায় ট্রানজিশনের দেবতা। এজন্য তাঁর এক মুখ ফেরানো অতীতের দিকে, আরেকটা ভবিষ্যদ্মুখী।

সুদূর স্কটল্যান্ডে অবশ্য প্রাচীন রোমান সভ্যতার ছোঁয়া কখনোই লাগেনি (‘বুডিকার বিদ্রোহ ও অন্যান্য’ দ্রষ্টব্য)। স্কটিশদের ঐতিহ্য এখনো বেশ গ্রাম্য ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন। অবশ্য একই কারণে তাঁরা অতিথিপরায়ণ আর বন্ধুবৎসল। আমার প্রাক্তন কর্মক্ষেত্রের ম্যানেজার ছিলেন স্কটিশ এবং খুবই অমায়িক। অবশ্য কিপ্টা আর গুলবাজ বলেও স্কটদের দুর্নাম আছে। অতীতে ৩১শে ডিসেম্বর আর পয়লা জানুয়ারিতে স্কটিশরা নববর্ষের বদলে ‌অন্য এক উৎসব পালন করত। একে স্কটস ভাষায় বলে হগমানে। একটা সময় স্কটল্যান্ডের প্রেসবাইটারিয়ান চার্চ ক্রিসমাস পালন করতে মানুষকে নিরুৎসাহিত করত। প্রাক-খ্রীষ্টান হগমানেই ছিল ক্রিসমাসের পরিবর্তে বছরের সবচে’ বড় উৎসব।

এদিনে স্কটিশ বাচ্চাকাচ্চারা হ্যালোইনের মত বাড়ি বাড়ি গিয়ে কড়া নাড়ে, আর চকলেট-মিষ্টি উপহার পায়। ফার্স্ট-ফুটিং বলে একটা কুসংস্কার মানে যারা, তারা চেষ্টা করে কারো বাসায় প্রথম পদার্পণ করে সৌভাগ্য আর সর্বোৎকৃষ্ট আতিথেয়তা অর্জন করতে। বন্ধুরা একে অন্যের বাড়িতে যায় লবণ, কয়লা, শর্টব্রেড, হুইস্কি, ব্ল্যাকবান রুটি ইত্যাদি ঐতিহ্যবাহী উপহার নিয়ে। পুরনো আমলে শীত কাটানোর জন্যে এসবের দরকার ছিল, সেসব উপহারের প্রথা এখনো রয়ে গেছে। আর রবার্ট বার্নসের গানটি থেকে বুঝতে পারছেন যে সারা বছরের ব্যস্ততার কারণে বহুদিন যোগাযোগ না থাকার পরেও এদিন হয়তবা বাল্যবন্ধুদের একটা সুযোগ হয় কুশলবিনিময়ের। সেটাই বার্নস বলছেন এভাবেঃ
“We twa hae run about the braes,
and pou’d the gowans fine;
But we’ve wander’d mony a weary fit,
sin’ auld lang syne.”
অর্থাৎ বন্ধু বা বান্ধবী দু’জন মিলে ছোটবেলায় পাহাড়ে পাহাড়ে কত দৌড়ে বেরিয়েছে, সুন্দর সুন্দর কত ডেইজি ফুল তুলেছে একসাথে। সময়ে দু’জনের পথ হয়ে গেছে সুদূর, পদযুগল হয়ে পড়েছে ক্লান্ত। কিন্তু হতাশার কিছু নেই! বর্ষবরণের সুযোগে আবার মিলিত হবে দু’জনার হৃদয়, পানপাত্র তুলে একে অপরের সৌভাগ্য কামনা করবে দু’জনে। অর্থাৎ ‘পুরানো সেই দিনের কথার’ মতই নস্টালজিয়ার সাথে সাথে বান্ধব-আলিঙ্গন আর শুভকামনা।

এখনো স্কটল্যান্ডের এডিনবরায় বিশ্বের সবচে’ ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণের উৎসব পালিত হয় ৩১শে ডিসেম্বর। এ ভিডিওটিতে দর্শকরা যেভাবে ক্রস করে একে অন্যের হাত ধরে গান করছেন, সেভাবে এডিনবরায় সমবেত জনতা হাতে হাত মিলিয়ে নাচে-গায়। বহ্ন্যুৎসবও হয় স্কটল্যান্ডের কোথাও কোথাও। সেসব জায়গায় শীতের শুকনো কাঁটালতা পেঁচিয়ে তৈরি বলে আগুন জ্বালিয়ে রাতের বেলায় আনন্দসমাবেশ করে শহরের অধিবাসীরা, উৎসবশেষে সেসব জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ড সমুদ্রের ঢেউয়ে বিসর্জিত হয়।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




আজকের যুগে নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কয়ারে যে ‘বলড্রপ’ হয়, তার অনুপ্রেরণা স্কটল্যান্ডের সেসব ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান থেকে আসাটা বিচিত্র নয়। ৩১শে ডিসেম্বর টাইমস স্কয়ারে প্রতি বছর বর্ষবরণের কনসার্ট হয়, আর বছরের শেষ মিনিটকে বিদায় জানানো হয় ওয়ান টাইমস স্কয়ারের স্কাইস্ক্র্যাপারের শীর্ষের ফ্ল্যাগপোল থেকে আলোকসজ্জিত একটি ‘টাইম বলের’ ৬০ ফীট ‘অধঃগমনের’ মাধ্যমে। প্রচুর জনসমাগমের মাধ্যমে ১৯০৭ সাল থেকে টাইমস স্কয়ারের এই ঐতিহ্য পালিত হচ্ছে। ‌এ উৎসবে সবার আগে যে গানটি বাজানো হয় সেটি অল্ড ল্যাং সাইন। ‌অবশ্য আমেরিকায় গানটি জনপ্রিয় হয় তিরিশের দশকে, গাই লমবার্ডো নামে কানাডীয় এক সঙ্গীতশিল্পীর নিউইয়ারস ঈভের বিশেষ রেডিও অনুষ্ঠানের খাতিরে।

শুধু্মাত্র রবিঠাকুরই যে বার্নসের ‘রচিত’ গানটিকে ভাষান্তর করেছেন তা কিন্তু নয়! জাপানের একটি জনপ্রিয় গান ‘হোতারু নো হিকারি’ — সেটিও অল্ড ল্যাং সাইনের সুরে, বিষয়বস্তুও একইরকম। আর একসময় দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় সঙ্গীতেরও ছিল একই সুর। একে আজকের সংবেদনশীল শিল্পসমঝদাররা হয়ত আখ্যা দিবেন কালচারাল অ্যাপ্রোপ্রিয়েশন হিসাবে। যেমনটা চীনের জনপ্রিয় লোকসঙ্গীতজ্ঞ লোবিন ওয়াং নব্বইয়ের দশকে উইগুর লোকগীতির অনুপ্রেরণায় রচিত কিছু গান কপিরাইট করতে গিয়ে কঠোর সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিলেন (সে ব্যাপারে শীঘ্রই লিখবো)।

আমার হিসাবে, লোকগীতি তো আসলে কোন জাতিগোষ্ঠীর কপিরাইট করার মত কিছু নয়, কারণ কোন একজনমাত্র শিল্পী একদিনে বা একমাসে ‘শিল্পটি’ তৈরি করেননি। সুর আর কথাগুলি শতবছর ধরে মুখে মুখে বিবর্তিত হয়েছে, অন্য দেশ-ভাষাতেও গিয়েছে অরগ্যানিকভাবে লোকমুখেই। যদি এগুলোকে অন্য দেশের কোন স্বনামধন্য কবি বা গীতিকার যথাযথ কৃতজ্ঞতাস্বীকার করে স্বভাষায় অ্যাডপ্ট করেন, তাতে ক্ষতি নেই। বরং মূল জাতিগোষ্ঠীর গৌরবই তাতে। অবশ্য ‘ইন্সপায়ারড’ শিল্পীর কপিরাইট করার চেষ্টাটা আর্টিস্টিক লাইসেন্সের থেকে একটু বেশি হয়ে যেতে পারে। আমি যতদূর জানি, রবীন্দ্রনাথ যথাযথ ক্রেডিট দিয়েছিলেন, কিন্তু বার্নসের নাম উল্লেখ করেননি কারণ তা হয়ত সেসময় জানা ছিল না তাঁর। জনপ্রিয় ফোকগানই ভেবে নিয়েছেন আর তাই লিখেছেন পাদটীকায়। আপাতদৃষ্টে তা ভুল নয়, কারণ বার্নসের ‘মূলটিও’ আসলে ‘নকল’!

অল্ড ল্যাং সাইনের স্মৃতিস্পর্শে নতুন বছর সবার ভালো কাটুক, বন্ধুবান্ধব আর পরিবারের সকলের সাথে আনন্দময় হোক — এ শুভকামনা রইল। হ্যাপি নিউ ইয়ার!



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...






আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




একশৃঙ্গ অভিযান

সত্যজিতের প্রফেসর শঙ্কুর রোমাঞ্চকর সব অভিযানের মধ্যে একটা ছিল একশৃঙ্গ অভিযান। তাতে শঙ্কু আর তাঁর সঙ্গীসাথীরা তিব্বতের দুর্গম এলাকায় গিয়ে সন্ধান পান অদ্ভূত এক স্থানের। সেখানে দুনিয়ার যাবতীয় রূপকথার প্রাণী আর বৃক্ষের আবাস — এদের মধ্যে একটা হচ্ছে ইউনিকর্ন, যার বাংলা সত্যজিৎ করেছেন একশৃঙ্গ।

এই গল্পটা আজ মনে পড়ল একটা খবর দেখে। বিজ্ঞানীরা পুরনো কিছু ফসিল পুনরায় নিরীক্ষণ করেছেন, যেগুলি এলাস্মোথেরিয়াম বলে এক অতিকায় গন্ডারজাতীয় প্রাণীর। গন্ডারের শিংয়ের থেকেও লম্বা একটিমাত্র শিং ছিল এই আদি স্তন্যপায়ী প্রাণীটির। কিছুদিন আগেও ধারণা করা হত যে এলাস্মোথেরিয়াম পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে এক থেকে দু’লাখ বছর আগে।

নতুন গবেষণায় বিজ্ঞানীরা পেয়েছেন যে পশ্চিম রাশিয়া ও মধ্য এশিয়া থেকে সাইবেরিয়া ও উত্তর চীন পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় এলাস্মোথেরিয়াম বেঁচে ছিল ৩৬,০০০ বছর আগ পর্যন্ত। অর্থাৎ এলাস্মোথেরিয়াম সিবিরিকাম নামক এ প্রজাতিটির সাথে আদি হোমো স্যাপিয়েন্সের মোলাকাত অসম্ভব কিছু ছিল না। হয়ত কোন কোন দুর্গম এলাকায় আরো কয়েক হাজার বছর বেঁচে থাকলেও থাকতে পারে এই ইউনিকর্ন।

স্বভাবতই আমরা ভাবতে পারি এই এলাস্মোথেরিয়ামই রূপকথার ইউনিকর্ন কিনা। প্রাচীনকালের মানুষ হয়ত সে জানোয়ারকে নিয়েই বর্তমানের রূপকথা ফেঁদেছে। যদিও রূপকথার ইউনিকর্ন দেখতে ঘোড়ার মত, তার শিং প্যাঁচানো। আর এলাস্মোথেরিয়াম দেখতে গন্ডারের মত। তবে তাপির, গন্ডার আর ঘোড়া একই বর্গের খুরসহ প্রাণী — তাদেরকে বলে অড-টোড্ আঙ্গালেটস

যদি ধরে নিই এলাস্মোথেরিয়ামই আদিকালের ইউনিকর্ন, তাহলে প্রস্তরযুগের মানুষ তার চিত্র ফ্রান্সের রুফিন্যাক গুহায় এঁকেছে ১৩,০০০ বছর আগে। আবার ২,৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে সিন্ধু সভ্যতার টেরাকোটা সীলেও পাওয়া গেছে এর মত এক ছবি। চীনা আর তুর্কী-মোঙ্গল মিথলজিতেও এরকম ঘোড়া আছে। আবার অনেক ক্লাসিক গ্রীক লেখক ইউনিকর্নের বর্ণনা দিয়েছেন তাঁদের বইয়ে। কিন্তু সন্দেহ নেই তাদের সে বিবরণ সেকেন্ড-হ্যান্ড, পূর্ববর্তী কোন মৌখিক গল্প শুনে তাতে আরো মনের মাধুরী মিশিয়ে মুখরোচক বানিয়েছেন একশৃঙ্গ ঘোটককে।

মধ্যযুগে আরব আলকেমিস্টরা ইউনিকর্নের শিংয়ের ভেষজ গুণাগুণ বর্ণনা করেছেন। আবার বাগদাদের খলিফা হারুন-অর-রশিদ নাকি ফ্রাংক সম্রাট ও প্রথম হোলি রোমান এম্পেরর শার্লমেইনকে ইউনিকর্নের শিং উপহার পাঠিয়েছিলেন, যেগুলো এখন ফ্রান্সের এক জাদুঘরে সংরক্ষিত। কিন্তু এগুলো আসলে নারহয়াল নামে এক শিংওয়ালা তিমির। এখনো চীনের হোমিওপ্যাথি মেডিসিনে গন্ডারের শিংয়ের ওষধি গুণ আছে বলে কুসংস্কার চালু আছে। যেকারণে আফ্রিকার প্রচুর দেশে পোচাররা বিলুপ্তপ্রায় ব্ল্যাক রাইনো মেরে তাদের শিং চীনা-অধ্যুষিত দেশগুলিতে মোটা দামে পাচার করেছে।

রূপকথার প্রাণী নিয়ে যে জীববিদ্যা তাকে বলে ক্রিপ্টোজুওলজি। যারা এতে আগ্রহ পান, তারা নানাভাবে অতীতের বিলুপ্ত প্রাণীর সাথে রূপকথার জীবের যোগাযোগ বের করেছেন। দুর্ভাগ্যজনক যে তাদের থিওরিগুলি প্রমাণ করা সহজ কাজ নয়। মানুষের আদিমতম স্মৃতিগুলি সোজাসাপ্টা লিখিত ভাষায় কেউ বলে যায়নি। যদি থেকে থাকে তো তা মৌখিকভাবে বংশপরম্পরায় ‘ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো’ টাইপ ঘুমের গান অথবা ঠাকুরমার ঝুলির মত গল্পের মাধ্যমে কালে কালে অনেক ফিল্টার হয়ে আমাদের কাছে এসেছে।

কিন্তু রূপকথা নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন, তারা বলবেন যে পৃথিবীর নানা সংস্কৃতির রূপকথাগুলির মধ্যে একটা সামঞ্জস্য রয়েছে। আমাদের দেশের ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ভারতবর্ষের রূপকথার সাথে পূর্ব ইউরোপের রূপকথার যোগাযোগ নিয়ে কিছু গবেষণা করেছিলেন বলে মনে পড়ে। তাঁর আগ্রহ যোগানোর জন্যে বোধহয় তাঁর গুরু ময়মনসিংহগীতিকার সংকলক দীনেশচন্দ্র সেন কৃতিত্বের দাবিদার। দীনেশচন্দ্র ছিলেন ভারতীয় উপকথার পাইওনিয়ার, যদিও তিনি তুলনামূলক লোককথা নিয়ে শহীদুল্লাহর মত কাজ করেননি।

এখানে এটাও উল্লেখ না করে পারছি না যে, শহীদুল্লাহ ধর্মপরায়ণ মুসলিম ছিলেন, একই সাথে বৌদ্ধ চর্যাপদ নিয়ে গবেষণা-অনুবাদ করেছেন, সংস্কৃত-তিব্বতীসহ বহু প্রাচীন ভারতীয় ভাষায় তাঁর দখল ছিল। পশ্চিমা শিক্ষাতে শিক্ষিত হয়েও আরবী-ফারসী থেকে অনেক সাহিত্যকর্ম বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন, যার মধ্যে রুবাইয়াতে ওমর খইয়াম রয়েছে। আজকের যুগে আমাদের তরুণপ্রজন্ম তাঁর নাম শুনেছে কিনা আমার সন্দেহ!



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




যাক গে, মূল কথায় ফিরে আসি। চীনের মিথে যেমন ড্রাগন আছে, তেমন ইউরোপেও আছে, আবার দক্ষিণ আমেরিকাতেও সর্পরূপী দেবতার উপাসনা করা হত। আমাদের রূপকথায় যেমন পঙ্খীরাজ, তেমন তুর্কী-মোঙ্গল-তিব্বতী রূপকথাতেও আছে উড়ন্ত ঘোড়া। তুর্কীদের পঙ্খীরাজের নাম আবার তুলপারনর্স ভাইকিংদের উপকথার ভালক্যুরিরা উড়ন্ত ঘোড়ার পিঠে চেপেই যুদ্ধক্ষেত্রে নেমে আসত নিহত বীরদেরকে ভালহাল্লা স্বর্গে নিয়ে যেতে। গ্রীকদের পাখাওয়ালা ঘোড়ার নাম পেগাসাস

সেরকম কেল্টিক রূপকথায় আছে ডয়ার্ফগবলিন, লর্ড অফ দ্য রিংসে দেখে বুঝেছেন যে ডয়ার্ফদের অবসেশন মাটি খুঁড়ে ধনরত্ন বের করা, কিন্তু তাদের মত কিপ্টে আর হয় না। সেরকম ভারতের রূপকথায় আছে যক্ষ আর যক্ষের ধন।

কোত্থেকে কি এসেছে সেটা বের করা কঠিন কাজ। তবে কিছু কমন থিম সব রূপকথায় আছে। যেমন জোসেফ ক্যাম্পবেল বলে এক উপকথাবিদ হিরো থিমটা নিয়ে গবেষণা করেছেন। হিরো থাকবে একজন গল্পে, তার ‘কামিং অফ এইজে’ বা পরিপক্বতার বয়েসে   কোন কঠিন পরীক্ষা বা ফীট থাকবে। উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে গ্রীকদের ‘টুয়েল্ফ টাস্কস অফ হারকিউলিস’। জোসেফ ক্যাম্পবেল এসব কাহিনীকে ইন্টারপ্রেট করেছেন প্রাচীন মানুষের মনস্তত্ত্ব আর তাদের ম্যাজিকে বিশ্বাসের মাধ্যমে। এ থিমটা তাই সব কালচারেই কমন, কারণ সব মানবপ্রজাতির আদি মনস্তাত্ত্বিক বিবর্তন একইভাবে হয়েছিল, পরে বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে সেসবে আরো স্থানীয় ডিটেইল যোগ হয়।

কিছু রূপকথাতে সেক্সুয়াল আন্ডারটোনও রয়েছে। যেমন বিউটি অ্যান্ড দ্য বীস্ট এবং আরো অনেক। আমি জানি না কোন নৃতত্ত্ববিদ এ প্রমাণ করতে পারবেন কিনা, যে সেসব কাহিনী প্রাচীনকালে যেসব আলাদা আলাদা মানবপ্রজাতি ছিল — যেমন নিয়ান্ডারটাল, হোমোসেপিয়েন্স, ডেনিসভ়ান, আরো একটি অজানা প্রজাতি — তাদের মধ্যে ইন্টারমিঙলিংয়ের অবচেতন স্মৃতি। তারা যে ইন্টারমিঙ্গল করেছিল তা এখন বিজ্ঞানীদের অজানা নেই, আফ্রিকার বাইরের মানুষের কমপক্ষে শতকরা পাঁচ ভাগ জীন নিয়ান্ডারটাল। বলা বাহুল্য নিয়ান্ডারটালদের চেহারা ছিল গাঁট্টাগোট্টা, অনেকটা লর্ড অফ দ্য রিংসের ডয়ার্ফরাজা গিমলির মত! আবার যদি ডেনিসোভানদের আরো পরিপূর্ণ ফসিল বেরোয়, আর তাতে যদি দেখা যায় তারা এল্ফদের মত, তাহলে তো উপকথাবিদ-নৃতত্ত্ববিদ দুয়েরই পোয়াবারো! এখানে আমি সত্যজিতের মত একটু অতিকল্পনার আশ্রয় নিলাম!

অনেক কাহিনীই আছে যেখানে কল্পনার আশ্রয় নেয়ার কোন দরকার নেই। নূহনবীর মহাপ্লাবনের কাহিনী ৩০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের সুমেরীয় গল্প থেকে এসেছে। সে কাহিনী পুরোপুরি অক্ষত অবস্থায় আবিষ্কৃত হয়নি, কিন্তু তার অংশবিশেষের উল্লেখ আছে প্রাচীনতম মহাকাব্য গিলগামেশের বীরত্বগাঁথার মধ্যে। আরব্যোপন্যাসের সিন্দবাদ যদি পড়ে থাকেন, তাহলে ২০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের প্রাচীন মিশরের টেইল অফ দ্য শিপরেকড সেইলর পড়ে মিলিয়ে দেখুন!

আরব্যোপন্যাসের আলিবাবা-চল্লিশ চোরের কাহিনী তো সত্য ঘটনা অবলম্বনে! ১৪৫৬ থেকে ১৪০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে হিব্রুদের পূর্বসূরী কানানাইট জাতির জোপা (বর্তমান জাফা) নগররাষ্ট্র ফারাও তৃতীয় থুতমোসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। প্রাচীন মিশরের নাপোলেওঁ হিসাবে পরিচিত থুতমোসে তাঁর জেনারেল জেহুতিকে পাঠান বিদ্রোহদমনে। জেহুতি জোপ্পার রাজকুমারকে শান্তিআলোচনার নামে নগরপ্রাচীরের বাইরে তাঁর ক্যাম্পে দাওয়াত দিয়ে পাঠান। তারপর চালাকি করে তাঁকে বন্দি করে ফেলেন। আর কয়েকশ’ সৈন্যকে বস্তায় ভোর ঘোড়াগাধার পিঠে চাপিয়ে এক রথীকে পাঠান নগরে। সেখানে গিয়ে রথী ঘোষণা করে যে জেহুতি রাজকুমারের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন আর নগরবাসীকে শান্তির টোকেনস্বরূপ উপহার পাঠিয়েছেন। মাথামোটা কানানাইটরা যে দরজা খুলে দিয়েছিল বলা বাহুল্য! ট্রোজান হর্সের কাহিনীও একই রকম!

কথায় কথায় ইউনিকর্ন থেকে বহু দূরে চলে এসেছি। উপসংহারে এটুকুই বলতে চাই যে, মানবসভ্যতার রূপকথা-মিথ-ফেইরিটেল-লেজেন্ডের মধ্যে অনেক ভুলেযাওয়া স্মৃতি আছে যেগুলি মানুষ এখনো ফিরে ফিরে মনে করে, কারণ সেগুলি তার মানসের কাছে এখনও ‌আকর্ষণীয়। কয়েক শতাব্দী পরে স্টার ওয়ারসের ল্যুক স্কাইওয়াকার হয়ে যাবে গিলগামেশ, লর্ড অফ দ্য রিংস হয়ে যাবে রামায়ণ বা ইলিয়াড। এগুলিতে যা রয়েছে, পূর্বসূরীদের মত তাদের একই রসদ! তখনকার মানুষ তাই খাবে, কারণ তার মনস্তত্ত্ব তখনও থাকবে আজকের মতই প্রাচীন।

 

১৮৭৮ সালে শিল্পীর কল্পনায় এলাস্মোথেরিয়াম চিত্রিত হয়েছিল এভাবে। ১৮০৮ সালে প্রাণীটির বিবরণ প্রথম প্রাণীবিদদের কাছে তুলে ধরেন মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘরের পরিচালক য়োহান ভ়াল্ডহাইম।
নেদারল্যান্ডের উট্রেখটের রাইকসমিউজিয়ামে সংরক্ষিত ‘ইউনিকর্নের শিং’।
ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর জন্ম পশ্চিম বাংলার চব্বিশ পরগনায় ১৮৮৫ সালে, মৃত্যু ১৯৬৯এ ঢাকাতে। বহুভাষাবিদ, শিক্ষাবিদ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে এম.এ. করার পরে ফ্রান্সের সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট করেন, তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল চর্যাপদের প্রাচীন বাংলার বিভিন্ন ডায়ালেক্ট বা আঞ্চলিক ভাষার বিশ্লেষণ। তিনি ছিলেন অখন্ড ভারতবর্ষের মুসলিমদের মধ্যে প্রথম ডক্টরেটধারী। দেশবিভাগের আগেই পূর্ববঙ্গের নতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। ৫২র ভাষা আন্দোলনেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।
কনরাড গেসনার নামক এক সুইস প্রকৃতিবিজ্ঞানী ১৫৫১ সালে তাঁর প্রকাশিত ইস্তোরিঈ আনিমালিয়ুম গ্রন্থে ইউনিকর্নকে কল্পনা করেছেন এভাবে।
ফ্রান্সের রুফিন্যাক গুহায় পাওয়া ‘ইউনিকর্নের’ স্কেচ, ১০ থেকে ৫০,০০০ হাজার বছরের পুরনো।
মহেঞ্জোদারোতে পাওয়া চার হাজার বছরের পুরনো ‘ইউনিকর্নের’ ছাপমারা সীল। এরকম বহু পাওয়া গেছে মহেঞ্জোদারো-হরপ্পাতে। অবশ্য পাশ থেকে দেখা জ়েবু নামক বৃহদাকার গবাদিপশুও হতে পারে।
দীনেশচন্দ্র সেনের জন্ম ঢাকা জেলায়, ১৮৬৬ সালে; মৃত্যু ১৯৩৯এ কলকাতায়। ঢাকা কলেজ আর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা। কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া স্কুলের (বর্তমানে কলেজ) প্রধান শিক্ষক ছিলেন। মৈমনসিংহ গীতিকায় ২১টি গাঁথা সংকলন করেন, চন্দ্রকুমার দে’র সহযোগিতায়। ১৯২৩এ মৈমনসিংহ গীতিকা প্রকাশের পরে দেশী-বিদেশী সাহিত্যবোদ্ধামহলে বেশ সাড়া পড়ে যায়। হিন্দু-মুসলিম দুই ধর্মীয় সংস্কৃতি থেকেই এ গানগুলো সংগৃহীত। মৈমনসিংহ গীতিকার সাফল্যের পরে পূর্ববঙ্গগীতিকা বলে আরেকটি সংকলন ১৯২৬এ প্রকাশিত হয়। এতে ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর পালাগানের নমুনা সংরক্ষিত হয়েছে।
নারহয়াল তিমি, ঠান্ডা উত্তর সাগরে এর বাস। এর ‘শিং ’ আসলে তার লম্বা প্যাঁচানো একটি দাঁত।
ব্ল্যাক রাইনো, সারা দুনিয়াতে পাঁচ হাজারেরও কম আছে এখন। পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিস্তৃত অঞ্চলে নিরামিশাষী এই প্রাণীর আবাস ছিল।
নিউ ইয়র্কের ন্যাচারাল হিস্টরি মিউজিয়ামে সংরক্ষিত নিয়ানডারটালের কংকাল। দেড় লাখ বছর আগে আদি মানুষ হোমো ইরেক্টাসের একটি ধারা আফ্রিকা থেকে ইউরোপে আসে এবং বিবর্তিত হয় হোমো নিয়ান্ডারটালেন্সিসে। ইউরোপ থেকে মধ্য এশিয়া আর মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় এরা টিকে ছিল ৪২,০০০ বছর আগ পর্যন্ত। ৪৫,০০০ বছর আগে হোমো সেপিয়েন্স, যে কিনা আফ্রিকায় ইরেক্টাস থেকে আলাদাভাবে বিবর্তিত হয়, ইউরোপে এসে পৌঁছায়। অর্থাৎ তিন থেকে চার হাজার বছর মানুষের দুটো আলাদা জাত একই এলাকায় পাশাপাশি বসবাস করেছে। সন্দেহ নেই যথেষ্ট মারামারি তারা করেছে খাদ্য ও অন্যান্য চাহিদার জন্যে। তাদের মধ্যে যে ব্রীডিংও হয়েছিল সেটার প্রমাণও আমাদের জেনেটিক ম্যাপে পাওয়া গেছে।
মোঙ্গোলিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রতীকে তাদের উপকথার উড়ন্ত অশ্ব তুলপারকে দেখানো হয়েছে এভাবে।
সপ্তদশ শতাব্দীতে আঁকা তেয়্যেরিয়ানো-রেমেনসিস কোডেক্সে মধ্য আমেরিকার অ্যাজটেক সভ্যতার দেবতা কেৎসালকোয়াতলকে দেখানো হয়েছে পালকওয়ালা সর্প হিসাবে। মায়াদের কাছে একই দেব পরিচিত কুকুলকান হিসাবে। মেক্সিকোর বিখ্যাত তেওতিওয়াকানে এই সর্পদেবের উপাসনার প্রমাণ পাওয়া যায়, ২০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ থেকে ৭০০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত এই শহর গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু ফেদারড সারপেন্টের উপাসনা আরো আদিম ওলমেক সভ্যতাতেও ছিল, তাদের বয়স কমপক্ষে সাড়ে তিন হাজার বছর। পূর্ব এশীয় সভ্যতাগুলিতেও ড্রাগন একইরকম সম্মানের আসনে অধিষ্ট।
ইংরেজ চিত্রশিল্পী অশ্বারোহী ভালক্যুরিদের কল্পনা করেছেন এভাবে। নর্স মিথোলজিতে আরেকটা উড়ন্ত ঘোড়া আছে যার নাম হোফৰার্পনির আর আরোহী বার্তাবাহক দেবী গ্না। দেবপিতা ওডিনের আটপেয়ে ঘোড়ার নাম স্লীপনির। কোরিয়ার প্রাচীন রাজাদের সমাধিতেও আটপেয়ে পাখাওয়ালা ঘোড়ার চিত্র পাওয়া গেছে।
ল্যুভরে প্রদর্শিত অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের আমলে তৈরি বীর গিলগামেশের মূর্তি। গিলগামেশের কাহিনীতে তিনি অমরত্বের সন্ধানে গিয়ে হাজির হন দিলমুন বলে দূরের এক দেশে (বর্তমান বাহরাইন এলাকার সুমেরীয় নাম)। সেখানে উতনাপিশতিম বলে এক সাধুর কাছে আছে অমরত্বের গুপ্তরহস্যের উত্তর। এই উতনাপিশতিম নিজে অমর, দেবতাদের আশীর্বাদে। আর দেবতাদের নির্দেশে নূহনবীর মত বজরা বানিয়ে মহাপ্লাবন থেকে নিজ পরিবারকে রক্ষা করেন, সাথে বিভিন্ন প্রাণী।
Link
৭৮-৮০ খ্রীষ্টাব্দে রোমসম্রাট ডোমিশানের এই মুদ্রার এক পিঠে গ্রীক পুরাণের পেগাসাসের ছবি। হিরো বেলেরোফোন তাকে ধরে পোষ মানায়, তারপর তার সাহায্যে কাইমিরা নামক এক দানবকে হত্যা করে।
সাইবেরিয়ার ডেনিসোভার গুহায় দুয়েকটা দাঁত আর অল্পকিছু হাড়গোড় পাওয়া গেছে বেশিদিন হয়নি। বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করতে সমর্থ হয়েছেন যে, এগুলি নিয়ান্ডারটাল আর হোমোসেপিয়েন্স থেকে ভিন্ন আরেকটি মনুষ্যপ্রজাতির, যার নাম দেয়া হয়েছে ডেনিসোভান। এগুহায় অন্যান্য সময়ে নিয়ান্ডারটাল আর হোমোসেপিয়েন্সেরও বসতি ছিল। ১৫০,০০০ থেকে ৪৮,০০০ বছর আগ পর্যন্ত এই গুহায় ডেনিসভানদের বসবাস ছিল। নিয়ান্ডারটাল আর ডেনিসভান সংকর এক কিশোরীর হাড়ের অংশও এখানে আবিষ্কৃত হয়েছে। মেলানেশিয়ান আর অস্ট্রেলীয় আদিবাসীদের ৩% থেকে ৫% জীন তারা পেয়েছে ডেনিসভানদের থেকে।
This tale is the oldest known instance of a story of a castaway on a fabulous island, who returns home laden with riches. The Sinbad, the Sailor stories [1] from One Thousand and One Nights belong to the same tradition and share many of its characteristics.
Link
মিশরের লুক্সরের কারনাক মন্দিরে খোদাই করা ফারাও থুতমোসের যুদ্ধংদেহী কায়া। তিনি একাধিক যুদ্ধবন্দীর চুল মুঠো করে ধরে মুগুর দিয়ে তাদের মাথা গুঁড়িয়ে দিচ্ছেন। একই সাথে লেখা আছে প্যালেস্টাইনের ১১৯টি শহরের নাম, আর লেবানন থেকে ফোরাত নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ২৪০টি শহরের নাম, যেগুলিকে তিনি মিশরের বশ্যতাস্বীকারে বাধ্য করেন। এ এলাকার লোকজন সবসময়ই সুযোগে থাকত কখন আশপাশের বড় বড় রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়লে নিজেদের সার্বভৌমত্ব জাহির করবে। কোন ফারাওয়ের মৃত্যুবরণের পরে যদি কমবয়েসী যুবরাজ সিংহাসনে আসীন হত, তখন তারা মোক্ষম সুযোগ ভেবে অন্য বড় সাম্রাজ্যের সহায়তায় বিদ্রোহ করে বসত।


আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...






আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




বলির পাঁঠা

বিভিন্ন কালচারে প্রাচীনকালে নরবলির প্রথা চালু ছিল। এ নিয়ে একটু জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করতে চাই। এর থেকে পাঠক ইতিহাসের ‘অপরাধ’গুলিকে ‘ফাস্ট ফুড’ স্টাইলে মূল্যায়নের আগে ভালভাবে সেগুলির পরিস্থিতি যাচাই করার ব্যাপারে একটু শিক্ষালাভ করতে পারেন।

অনেক ধর্মে এখনো পশুবলির প্রথা আছে। ইসলামে গবাদিপশু কোরবানীকে আধুনিকচিত্তের অনেক মানুষ দেখেন মধ্যযুগীয় বর্বরতা হিসাবে। মনে রাখা দরকার, ইসলামে পশু কোরবানীর লক্ষ্য শুধুমাত্র খাদ্য নয়, বরং নিজের প্রিয় কোন প্রাণীকে নিজ স্বত্ত্ব পরিত্যাগ করে, মায়া ভুলে ঈশ্বরের কাছে উৎসর্গ করা।

হ্যাঁ, আজকের মূল্যবোধের হিসাবে এটা অমানবিক হতে পারে। কারণ আমাদের গোয়াল থাকলে গোয়ালে এখন হাজারো পশু, আলাদা করে একটা প্রিয় পশু সেরকম আর নেই। আর গোয়াল যাদের নেই, তাদের আর পশুর প্রতি মায়াই জন্মাবে কোত্থেকে! অর্থাৎ আসল উপলক্ষ্য থেকে কোরবানীর ব্যাপারটা অনেক দূরে চলে এসেছে, শুধু হয়ে রয়েছে আনুষ্ঠানিকতা।

তাবৎ হিউমেইন সোসাইটি সদস্যদের এ ভেবে একটু বাস্তববাদী হওয়াটা বোধহয় দরকার যে, যখন পশুবলি প্রথা ইসলাম, খ্রীষ্টান আর ইহুদীধর্মের কুলপিতা ইব্রাহিম বা এব্রাহাম চালু করছেন, তখন তিনি যে প্রাচীন রীতিটার সংস্কারসাধন করছেন সে হল নরবলি! This triggers the tooltipইসমাঈল হোন কিংবা আইজ়্যাক, তিনি নিজেই রাজি ছিলেন এতে, কিন্তু বেঁচে গেলেন ঈশ্বর দয়াপরবশ হয়ে তাঁকে এক মেষ দিয়ে স্থানান্তরিত করার কারণে।

এ রূপকথা নয়! জাতিগত স্মৃতির অবশেষ রয়ে গেছে শিক্ষামূলক ‘কিংবদন্তীর’ মধ্যে। ইহুদী ধর্মের সবচে’ বড় সংস্কার হয়েছিল সপ্তম খ্রীষ্টপূর্ব শতকে নবী দ্বিতীয় ইসাইয়ার আমলে। এসব লেজেন্ডের তখনই উৎপত্তি ‘নতুন’ মূল্যবোধের জাস্টিফিকেশন হিসাবে। সেসময়েই ইহুদীদের ‘ইহুদী’ হয়ে ওঠা। এর পূর্ববর্তী জনগোষ্ঠীকে ইহুদী না বলে হিব্রু বলা সমীচীন। হিব্রুদের রাজ্যে নরবলি চালু ছিল, আর তাদের রাজারা নিজেদের সন্তানকেই তাদের দেবের উদ্দেশ্যে অগ্নিআহুতি দিত গেহেন্না বলে এক উপত্যকায় — পরবর্তীতে অভিশপ্ত ঘোষিত এই উপত্যকার নাম আর আরবী জাহান্নাম একই শব্দ।

তো এ ধরনের বলিদান শুধু মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসেই নেই, কালীসাধনার পাঁঠাবলির মূল নরবলিতে। প্রাচীন মিশর, গ্রীসেও একই জিনিস ছিল। আমেরিকাতে তো এই সেদিন, পঞ্চদশ খ্রীষ্টাব্দেও অ্যাজ়টেক, মায়া আর অন্যান্যরা পিরামিডের শীর্ষ থেকে মনুষ্যরক্তের বন্যা নামিয়ে দিত।

ফাস্টফুড ইতিহাসবিদরা দ্রুত দেখেশুনে ড্রাইভবাই শুটিং করে যাবেন: ওরা ছিল বর্বর, অনুন্নত; কিংবা তারা ছিল ধর্মান্ধ, সাধারণের সুযোগ নেয়া রাজা আর হুজুরের দল।

কয়েকটা সিম্পল প্রশ্নের জবাব তাদের কাছে আমার আর্জি: কেন নরবলির সময় বহুক্ষেত্রে শিশুদের বেঁছে নেয়া হত, মানুষ কি এতই অমানুষ? আবার সেসব শিশুর বেশিরভাগই রাজ্যপালের বা পুরোহিতের সন্তান? অ্যাজ়টেকরা হয়ত যুদ্ধবন্দীদের মারত। কিন্তু তাদের না মেরে দাস বানিয়ে গতরখাঁটা কাজ করালেই তো তাদের আরো উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি হত।

বুঝতে হলে আপনাকে বহুদিন ধরে বহু দিক থেকে লেখা বহু ইতিহাস পড়ে একটা পরিপূর্ণ কম্প্রেহেনশন আনতে হবে। অথবা অন্ততপক্ষে অবজ়ার্ভার হিসাবে নিজেকে চিন্তা না করে ভাবুন আপনি সে আমলের একজন মানুষ। ভাবুন আপনার দৈনন্দিন জীবনের সীমাবদ্ধতাগুলি কি হতে পারে, সারভাইভালের জন্য আপনার কী কী দরকার। এ যুগে এধরনের কল্পনা খুব কঠিন কাজ, কারণ আমরা একটা কমপ্লেসেন্ট জেনারেশন — খাদ্য, পোশাক, জ্ঞান-বিজ্ঞানের অ্যাক্সেস, টেক, কোন কিছুর অভাব নেই, আছে উদ্বৃত্ত! তাই আমাদের বাঁধে না নিজেদের মাপকাঠিতে অন্য দেশ-কাল-কালচারের বিচার বসাতে।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




আমি একটু চেষ্টা করে দেখি পারি কিনা। প্রাচীন মানুষ হিসাবে আপনি হতে পারেন পঞ্চাশ থেকে একশ’ মানুষের ছোটখাট একটা দলের নেতা। জাতিদেশের কনসেপ্ট তখনও শুরু হয়নি। জীবিকানির্বাহ হয় শিকার করে, নয়ত প্রাথমিকস্তরের কৃষিকার্য করে। প্রকৃতির ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। হয়ত পাঁচটা বছর ভাল শিকার জুটলো বা ফলন হলো, তারপর শুরু হলো মন্দা।

খাবার রেশনিং শুরু হলো। কিন্তু পরের বছরও মন্দা। কোনরকমে টেনেটুনে চলছে। কিন্তু জনতা ক্ষুধায়-ক্লান্তিতে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। আপনার কাছে বা পুরাহিতের কাছে কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই — কেন এমন হচ্ছে। বিজ্ঞানের ব’ও জানা নেই । প্রথম যেটা মনে হতে পারে যে প্রকৃতির কোন দৈবশক্তি আপনার বা আপনার গোত্রের ওপর ক্রোধান্বিত। সুতরাং সেই দেবের ক্রোধপ্রশমন করতে হবে। আপনার বউ রাগলে আপনি কী করেন? ফুলের গোঁছা? জুয়েলরি গিফ্ট? হয়ত একটা ডিনার? অর্থাৎ একটা কিছু উৎসর্গ করা দরকার শক্তিমান দেবতার উদ্দেশ্যে।

উৎসর্গ করার জন্যে সবচে’ কার্যকরী যার মধ্যে আপনার অ্যাটাচমেন্ট আছে। বস্তুগত অনুরক্তি নয়, আত্মিক। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা হবে আপনার সন্তান। সন্তান আপনার ভবিষ্যতের বীজ নয় শুধু, সে বড় হলে গোত্রের কর্মক্ষম একজন ব্যক্তিও হবে। গোত্রপ্রধান হিসাবে আপনার প্রভাব আরো বাড়াবে। কিন্তু বর্তমানের অকালটাকে না অতিক্রম করতে পারলে সন্তানসহ গোত্রের বাকি সবাই না খেয়ে মরবেন। এ কথা হয়ত পুরোহিত শুধু বানিয়ে বানিয়ে বলছে না, সে নিজেও তা বিশ্বাস করে মনেপ্রাণে। আর অন্যকোন বেটার এক্সপ্লেনেশন তার বা আপনার কাছে নেই। গোত্রের বাকি সবার কাছে আইডিয়াটা উপস্থাপন করার পর নব্বইজন সায় দিল, দশজন দিল না। কী করবেন আপনি?

আশা করি কিছুটা বোঝাতে পেরেছি পরিস্থিতিটা। প্রস্তরযুগের শেষ পর্যন্ত মানবজাতির জন্যে সারভাইভ্যালটা এমনি ছিল। ব্রোঞ্জযুগে নতুন টেকনোলজির কারণে আরেকটু ভাল অবস্থায় আসে মানুষ। তারপরও সেরেমোনিয়াল রিলিজিয়াস স্যাক্রিফাইস চলত, কারণ বাপদাদারা করে এসেছে। লৌহযুগে এসে যখন মানবসভ্যতা উপনীত হলো, তখন তাদের কৃষিকাজের লাঙলসহ নতুন নতুন যন্ত্র বেরিয়েছে, শিকারের বহুরকম অস্ত্র। প্রকৃতির প্রতিকূলতা কাটিয়ে কিছুটা স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষ। ইসাইয়ার মত সংস্কার তখন অনেক কালচারেই হয়, এবং নরবলি স্থানান্তরিত হয় পশুবলি দ্বারা।

যেকোন প্রাচীন মূল্যবোধকে মূল্যায়নের পরীক্ষা হলো, Did it sound like the only, not just a, good idea at the time? And did everyone else think so?

নতুন মূল্যবোধও একইভাবে এস্ট্যাবলিশ হয়। যারা জোর করে সব সনাতন প্রথাকে বন্ধ করে দিতে চান, আশা করি তারা এটা কনসিডার করবেন!



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!