সজ্ঞান সমাধিচর্চা

বিগত কয়েকটি পোস্টে বলছিলাম আদি মানুষের ধর্মবিশ্বাস আর কল্পনাশক্তির কিভাবে বিকাশ হল, তার একটা সম্ভাব্য কাহিনী। আগুনের আবিষ্কার সেই কাহিনীর কেন্দ্রবিন্দু।

অবশ্য আগুন এই প্রক্রিয়ার একমাত্র নিয়ামক হয়ত নয়, আর মানুষ এক-দুই জেনারেশনে হঠাৎ করে ‘মানুষ’ হয়ে ওঠেনি। লাখখানেক বছর তো লেগেছেই। কবে কিভাবে তার ঊর্বর মস্তিষ্কে প্রাচীন ধর্মবিশ্বাসের উদয়, তার সঠিক নির্দেশক নির্ধারণ করা কঠিন। কারণ মৌখিক ভাষা কোন ফসিল রেখে যায় না। ঠিক তেমন সঙ্গীতনৃত্য আর প্রার্থনারীতিরও কোন প্রত্যক্ষ নিদর্শন উদ্ঘাটন সম্ভব নয়।

সেকারণে নৃতত্ত্ববিদরা দু’ধরনের বাস্তব প্রমাণের মাধ্যমে মানুষের উদ্ভাবনী ক্ষমতার আরম্ভকাল নির্ধারণ করেন। পাথরের অস্ত্র যদি হয় মানুষের প্রযুক্তিগত বিবর্তনের প্রমাণ, তাহলে তার কল্পনাশক্তি বিকাশের প্রমাণ মেলে মূর্তশিল্পে আর সমাধিতে।

সেকারণে চারটি ছবি দিয়েছি। এগুলির তিনটি সভ্যতাপূর্ব মানববসতিতে প্রাপ্ত সমাধির চিত্র, আর একটির কথা পরে বলছি। ব্যাখ্যা করার আগে বলে নেই, এদের দু’টি শিকাগোর ফীল্ড মিউজিয়াম আর ওয়াশিংটনের স্মিথসোনিয়ান ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্টরিতে প্রদর্শিত। একটি স্টকহোমের মিউজিয়াম অফ ফার ঈস্টার্ন অ্যান্টিকুইটিজে। আরেকটি জার্মানির উল্ম মিউজিয়ামে।

কোভিড মহামারিতে এসকল মিউজিয়াম বন্ধ হয়ে রয়েছে বহুদিন। দর্শক সমাগম নেই। তাই আয়ের উৎস এদের সংকুচিত। ব্যয়বহুল রক্ষণাবেক্ষণ তো বটেই, যেসব গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা এ সকল জাদুঘরের কর্মীরা দেশেবিদেশে করে থাকেন, সেগুলিও স্থগিত। যদি আপনি মিউজিয়াম ভালবাসেন আর মনে করেন যে ভবিষ্যত প্রজন্মের এসকল কাহিনী জানা জরুরী, দয়া করে নিচে দেয়া লিংকে গিয়ে ফীল্ড মিউজিয়ামে কিছু দান করুন। ১২০ বছর আগে শিকাগোর এক কোটিপতির অনুদানের মাধ্যমে মিউজিয়ামটির শুরু। এ মুহূর্তে ক্রাউডফান্ডিং ছাড়া এদের উপার্জনের খুব বেশি রাস্তা নেই।

শিকাগোর ফীল্ড মিউজিয়ামের মূল গ্যালারী।

মূল কথায় ফিরে আসি। ছবিতে দেখানো সমাধিগুলির প্রথমটি মিশরের নাকাদা-বাদারি কালচারের। মৃতদেহটি মরুভূমির শুষ্ক আবহাওয়া আর ন্যাট্রন লবণের কারণে সম্ভবত প্রাকৃতিকভাবেই মামিতে পরিণত হয়েছে। সময়কাল প্রায় সাড়ে চার হাজার খ্রীষ্টপূর্ব, অর্থাৎ গিজার পিরামিডের থেকেও দু’হাজার বছরের পুরনো।

দ্বিতীয় ছবির কংকালটি আবিষ্কৃত হয়েছিল জর্দানের ডেডসীর কাছে বাবেজজারাতে। এটি সাড়ে তিন হাজার খ্রীষ্টপূর্বের। আর তৃতীয় ছবিটি আরো দূরের চীনের বানপো গ্রামের প্রস্তরযুগীয় সমাধি। সেটাও প্রায় সাড়ে তিন হাজার খ্রীষ্টপূর্বের।

মিশরের নাকাদা-বাদারি কালচারের সমাধি।
বাব-এজ-জারার প্রস্তরযুগীয় সমাধি।
চীনের বানপো গ্রামের প্রস্তরযুগীয় সমাধি।

তিনটি ভিন্ন স্থানের সমাধির ধরন প্রায় একই রকম। মাটিতে অথবা পাথরে ওভাল শেপের একটা গর্ত করে তাতে ‘ফিটাল পজিশনে’ (মাতৃগর্ভে যেভাবে থাকে শিশু) মৃতদেহটিকে শোয়ানা হয়েছে। মুখটা কোন বিশেষ দিকে ফেরানো। কোন ক্ষেত্রে সাথে দেয়া হয়েছে রঙীন নুড়ি, পাথরের অস্ত্র, আর মাটির পাত্রভরা খাবার। অর্থাৎ মানুষ ইতিমধ্যে পরকাল বলে একটা কিছু আছে সে বিশ্বাস করা শুরু করেছে। পরপারের যাত্রায় যা যা লাগতে পারে, তা প্রিয়জনের সমাধিতে দিয়ে দিয়েছে।

আজকের দৃষ্টিতে বিচার করলে মনে হতে পারে এ আর এমনকি ব্যাপার। কিন্তু মাথায় আবার প্রস্তরযুগীয় মস্তিষ্কটি ফিট করুন। কেন হঠাৎ করে মনে হলো আপনার, যে মৃতদেহটিকে সমাহিত করতে হবে, সাথে দিতে হবে প্রয়োজনীয় সব বস্তু? কেন অন্য জানোয়ারের মত মৃতদেহটি ফেলে রেখে চলে গেলেন না? আপনার পশুমনোবৃত্তিটির পরিবর্তন কেন কিভাবে হলো?



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




এই যে একে অন্যের জন্যে কেয়ার করার ব্যাপারটা, সেটা শিম্পাঞ্জি ছাড়াও অন্যান্য আরো কিছু প্রাণীর মধ্যে আছে, যাদের মধ্যে হাতিও পড়ে। আফ্রিকার হাতিরা নাকি মৃত্যুকালে তাদের ‘নির্ধারিত’ কবরস্থানে গিয়ে অপেক্ষা করে। বিপুলসংখ্যক হাতির কংকাল সেসব জায়গায় আবিষ্কৃত হয়েছে। হতে পারে এর মধ্যে একটা প্রাকৃতিক ব্যাপার রয়েছে। স্বল্প উন্নত মস্তিষ্কের প্রাণীও হয়ত বুঝতে পারে যে, মৃতদেহ পচনশীল, তার থেকে যে গন্ধ ও জীবাণু ছড়ায় তা জীবিতদের জন্য স্বাস্থ্যকর নয়।

এরকম ন্যাচারাল ইন্সটিংক্ট থেকে হয়ত প্রাচীন মানুষ মৃতদেহ কবর দেয়া শুরু করে। কুরআনে হাবিল-কাবিলের কাহিনীটাও অনেকটা সেরকম। কাবিল হাবিলকে হত্যা করার পর খোদার পাঠানো দাঁড়কাকের দেখাদেখি কবর খুঁড়ে ভাইকে সমাহিত করে। অর্থাৎ প্রকৃতি থেকে শেখার একটা ক্লু রয়ে গেছে গল্পটাতে।

তিনতোরেত্তোর ছবিতে হাবিল-কাবিলের কাহিনী, ১৫৫০-৫৩।

কিন্তু সমাধির সাথে সাথে অন্যান্য বস্তু দেয়ার চিন্তাটা কেন মানুষের মাথায় এল? উত্তর খুব সোজা। আদি মানুষ কল্পনার জগতে ভেবেছে তাদের পূর্বপুরুষেরা মৃত নয়, সীমানা পেরিয়ে অন্য একটি স্থানে প্রবেশ করেছে মাত্র। সেখানেও তাদের দৈহিক চাহিদা থাকবে। জীবিতদের দায়িত্ব সেসব পূরণের যথোপযুক্ত বন্দোবস্ত করা।

আদিম মানুষ কবে থেকে সজ্ঞানে এ ধরনের সমাধি দেয়া শুরু করেছে, তা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। ২০১৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার রাইজিং স্টার কেভ সিস্টেমে এক প্রাচীন প্রজাতির হোমিনিডের ফসিল আবিষ্কৃত হয়, যার নাম দেয়া হয় হোমো নালেদি। খননকার্যের এক পর্যায়ে কেভ সিস্টেমের খুব গভীরে আবিষ্কৃত হয় বেশ কয়েকটি দেহাবশেষ। সরু সুরঙ্গের মধ্যে দিয়ে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় এসকল মৃতদেহের এখানে এসে পড়াটা সহজ নয়। হিংস্র কোন প্রাণীও যে টেনে এনে এখানে ফেলবে তাও সম্ভব নয়। সব মিলিয়ে তিন লাখ বছরের পুরনো এই দেহাবশেষগুলিকে গুহার গভীরে ‘কবর’ দেয়া হয়েছে বলে কিছু নৃতত্ত্ববিদের ধারণা। এখনো এ নিয়ে বাকবিতন্ডা চলছে।

প্রস্তরযুগীয় ‘জার’ সমাধি, নিয়াহ কেভ, সারাওয়াক।

এর সাথে আবার মেলে মালয়েশিয়ার সারাওয়াকের গুহাবাসী হোমো সেপিয়েন্সদের সমাধি। এগুলি ‌অবশ্য তুলনামূলক নতুন, মোটে সাড়ে তিন হাজার খ্রীষ্টপূর্বের। বাঁশের তৈরি ঝাঁকিতে করে ফীটাল পজিশনে বসিয়ে মৃতদেহ তারা রেখে আসত গুহার টয়াইলাইট জোনে, অর্থাৎ যেখানে আলোর শেষ আর আঁধারের শুরু। পরবর্তীতে যারা মারা যেত, তাদের কবর হত তাদের প্রয়াত পূর্বপুরুষদের সাথে। এভাবে পারিবারিক গোরস্তান গড়ে উঠেছিল গুহার অভ্যন্তরে। এই টয়াইলাইট জোনই হয়ত পরবর্তীকালের ধর্মবিশ্বাসের ‘পাতাল’ — আন্ডারওয়ার্ল্ড। স্বর্গ-নরকের থেকেও ‘পাতালের’ কনসেপ্ট বেশি পুরনো।

দেড় লাখ বছর আগের হোমো নেয়ান্ডারটালেনসিসের বিশাল এক বসতি ক্রোয়েশিয়ার ক্রাপিনাতে আবিষ্কৃত হয়েছে। এর মধ্যে বেশ কিছু সমাধিও রয়েছে। ৫২ হাজার বছর আগের একটি নেয়ান্ডারটাল কবরও ফ্রান্সে আবিষ্কৃত হয়েছে। তবে নেয়ান্ডারটালের যথেষ্ট কল্পনাশক্তি ছিল কিনা তা নিয়ে এখনো বিতর্ক রয়েছে। এসব কবরে কোন সমাধিবস্তু পাওয়া যায়নি। একমাত্র ইরাকের শানিদার গুহায় নেয়ান্ডারটাল কবরে ফুলের পোলেন পাওয়া গেছিল, যদিও প্রত্নতত্ত্ববিদরা পরে বলেছেন সেটি নাকি অন্য প্রাণীর কাজ।

ইজরায়েলের কাফজা গুহায় আবিষ্কৃত প্রস্তরযুগীয় দ্বৈত সমাধি।

সন্দেহাতীতভাবে সবচে’ প্রাচীন মানবসমাধি ৯২ হাজার বছরের পুরনো। ইজরায়েলের কাফজা গুহাতে মা-মেয়ের একত্রিত কবর আবিষ্কৃত হয়েছে। সমাধিদ্রব্য হিসাবে পাওয়া গেছে রঙকরা ফোঁড়া ঝিনুক, যেগুলি সম্ভবত সুতোয় বেঁধে গলায় নেকলেস হিসাবে পড়া হত। আরো পাওয়া গেছে রেড ওকার। একধরনের পাথর গুঁড়িয়ে এই রংটি তৈরি হত। গুহাচিত্রে যেমন এর ব্যবহার ছিল, তেমন সমাহিত মৃতদেহের মুখমন্ডল রঙীন করতেও। অর্থাৎ এ কবরটির নিঃসন্দেহে ‘কালচারাল রিচুয়াল’ তাৎপর্য রয়েছে।

প্রায় এক লাখ বছর আগে এদের হোমো সেপিয়েন্স পূর্বপুরুষ আফ্রিকা থেকে প্রথম মধ্যপ্রাচ্যে পদার্পণ করে। কিন্তু দশ-বিশ হাজার বছরের মধ্যে বসতি বিলীন হয়ে যায়। সত্তর হাজার বছর আগে দ্বিতীয় চেষ্টার পর হোমো সেপিয়েন্স লেভান্ট ও আরবে স্থায়ী আবাস বাঁধতে সক্ষম হয়। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে এশিয়া, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকায়। আর মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপে এসে তাদের মোলাকাত হয় অতি দূর সম্পর্কের কাজিন নেয়ান্ডারটালদের সাথে। এমনটা অসম্ভব নয় যে দুই প্রজাতি একে অন্যের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করেছে।

স্পেনের মালত্রাভিয়েসো গুহার প্রস্তরযুগীয় শিল্প।

সমাধির সাথে সাথে যদি মূর্তশিল্পের দিকে নজর দিই, তাহলেও একটা ট্রান্সফর্মেশন ধরা পড়ে কেভ পেন্টিংয়ের শুরুতে। স্পেনের মালত্রাভিয়েসো গুহায় আবিষ্কৃত হয়েছে ৬৪,০০০ বছরের প্রাচীনতম গুহাচিত্র। এগুলির মূল বিষয়বস্তু শিকারের জন্তুজানোয়ার। এঁকেছে নেয়ান্ডারটাল কাজিনরা। মডার্ন হিউম্যানের আঁকা গুহাচিত্রও প্রায় সমসাময়িক। ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার বছরের পুরনো চিত্রগুলো ইন্দোনেশিয়া আর ইউরোপে আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব আঁকারও রিচুয়াল সিগনিফিক্যান্স রয়েছে, যেটা বিগত লেখায় বলেছি।

জার্মানিতে আবিষ্কৃত সিংহমানবের মূর্তি।

একই সময়কালের আরও যে অদ্ভূত নিদর্শনটি জার্মানিতে আবিষ্কৃত হয়েছে তার নাম লোভেনমেনশ বা লায়নম্যান ফিগার। মানুষের দেহের ওপর সিংহের মাথা লাগানো আইভরির তৈরি এই ছোট্ট ‘পুতুলটি’ ৩৫ থেকে ৪০ হাজার বছরের পুরনো। মানুষের এহেন কল্পনাশক্তির এর থেকে প্রাচীন কোন নমুনা এখনো পাওয়া যায়নি।

অন্য পশুপাখির যে ক্ষমতা রয়েছে — কিন্তু মানুষের নেই — তা দিয়ে কোন অসাধ্য সাধনের ‘ম্যাজিক’ করতে চেয়েছে হয়ত সেকালের মানুষ। যেসব বিশেষ পশুকে মানবরূপ দেয়া হয়েছে, তাদের বলা যেতে পারে অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যানিম্যাল স্পিরিট। যেমন আমার লক্ষ্য যদি হয় আকাশে দেখা উজ্জ্বল একটি নক্ষত্রে পৌঁছনো, যেখানে রয়েছে আমার প্রয়াত পূর্বপুরুষ, তাহলে আমার দরকার ঈগলের মত কোন পাখির সাহায্য।

ধরুন আমি-আপনি একটি প্রস্তরযুগীয় ক্লানের সদস্য। দলটির জন্যে ক্রান্তিকাল চলছে। শিকারীদল বার বার বিফল হয়ে ফিরে আসছে। মাংসের অভাবে বুনো ফলমূল খেয়ে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। এহেন অবস্থায় ক্লানের প্রধান হিসাবে আপনি পুরোপুরি দিগহারা। শীতের তুষারপাত সমাগত প্রায়। আপনাদের হাতে দু’টি রাস্তা। এলাকাটি ছেড়ে আরো দূরে পাড়ি জমানো যেখানে শিকার জুটতেও পারে নাও পারে। নয়ত আরো একটিবার শিকারের প্রচেষ্টা করে শীতকালটি কাটিয়ে তারপর স্থানান্তর। যুবাবয়সে বয়োবৃদ্ধদের উপদেশ কাজে দিত। কিন্তু তাদের কেউ আর জীবিত নেই। আমাকে তাই আপনি নির্দেশ দিলেন মৃত পূর্বপুরুষদের উপদেশগ্রহণের জন্যে তাদের সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা করতে।

যজ্ঞ করে একটি ঈগল শিকার করে তার পালক ও চঞ্চু দিয়ে মুখোশ বানালাম। তারপর দলবল নিয়ে, সাইকিডেলিক ওষধি শেকড়ে আগুন লাগিয়ে তার ধোঁয়া ফুঁকে, মন্ত্র পড়ে, দৌড়ঝাঁপ করলাম। তারপর হয়ত সে রাতে সত্যি সত্যি স্বপ্নে দেখলাম আমি নক্ষত্রমন্ডলে হারানো পিতা-পিতামহের সাথে পুনর্মিলিত হয়েছি। ট্রাইবের সবার অবশ্য এ বিশেষ শক্তি থাকবে না। আমার মত যার যার থাকবে, তাদের নাম ওঝা, মেডিসিনম্যান, শামান, ইত্যাদি। আর এই প্রক্রিয়ায় যে প্রাণীর স্পিরিট আমাকে সাহায্য করলো, সেটি ঈগল। আর আমার যজ্ঞে ব্যবহারের জন্যে এরকম একটা ঈগলম্যান মূর্তি কল্পনা থেকে বানিয়ে ফেলা কোন ব্যাপারই না।

বুঝতেই পারছেন আদিম মানুষের কল্পনাশক্তির দৌড় কতদূর!

প্রিয়জনকে সমাহিত করার মাধ্যমে মানুষ প্রমাণ করেছে যে শুধু পাথরের অস্ত্র তৈরিতে তার উদ্ভাবনী ক্ষমতা সীমাবদ্ধ নয়। চিন্তা করে দেখুন যে আজ থেকে ত্রিশ লাখ বছর আগে মানুষের পূর্বপুরুষ পাথরের অস্ত্র ব্যবহার শেখে। কিন্তু সে প্রযুক্তির সম্মুখ বিবর্তন পরবর্তী বিশ লাখ বছরেও তেমন একটা হয়নি।

তারপর এল আগুন, সাথে জীবনযাত্রার একটা পরিবর্তন। আর বিগত এক লাখ থেকে পঞ্চাশ হাজার বছরের মধ্যে এল আমাদের ইমাজিনেশন-ভিজুয়ালাইজেশনের ক্ষমতা। প্রস্তরাস্ত্রের টেকনোলজি আবিষ্কার করেও মানুষ তাতে আটকে ছিল লাখ লাখ বছর। আর কল্পনাশক্তির আল্টিমেট ইভল্যুশনের পঞ্চাশ হাজার বছরের মধ্যে আমরা বর্তমান বিশ্বের অধিবাসী।

ইমাজিনেশন আর ম্যাজিক-স্পিরিট-শামানিজম, সোজা ভাষায় রিলিজাস বিলিফ সিস্টেমের যে পাওয়ার অফ সাজেশন, সেটা মানবজাতিকে এমন একটা সম্মুখমুখী ঘাত দিয়েছে যার শক্তি এখনো ফুরোয়নি।

যতই বিজ্ঞানপ্রযুক্তি পড়ে জ্ঞানী হোন না কেন, যে শিকড় থেকে এই শক্তিটি মানুষ আহরণ করেছে, সেই স্পিরিচুয়াল-ম্যাজিকাল-রিলিজাস বিলিফ সিস্টেমটাকে অবজ্ঞা করবেন না!

ফীল্ড মিউজিয়ামে দানের লিংক:



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...






আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




জেসমিন ফুল

Featured Video Play Icon

মোলিহোয়া, জেসমিন ফুল, নামের এই চীনা গানটা আমার বেশ পছন্দ।

খুঁজে খুঁজেও অনেক আগে দেখা অন্য আরেকটা ক্লাসিকাল অর্কেস্ট্রা সংস্করণ পেলাম না। আজকাল চীনা সরকারের দাপটে গুগল-অ্যাপল সবাই ‘সংবেদনশীল’ ইন্টারনেট পাতা পরিষ্কার করতে ব্যস্ত। এ যেন আরেক কালচারাল রেভোল্যুশন!

কেন জেসমিন ফুল গানটার ভাল সংস্করণটা পেলাম না, এ ভাবতেই মনে পড়ল ২০১১তে তুনিসিয়াতে যে আরব স্প্রিংয়ের বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল, তার নাম দেয়া হয়েছিল জেসমিন বিপ্লব। আর তার কিছুমাত্র ছোঁয়া চীনেও লেগেছিল।

গণতন্ত্রের দাবিতে কিছু চীনা যে ইন্টারনেটভিত্তিক বিক্ষোভ শুরু করেছিল, তার অন্যতম মাস্কট হিসাবে তারা এই জেসমিন ফুল গানটাকে ব্যবহার করার চেষ্টা চালায়। গানটা খুবই জনপ্রিয়। কিন্তু এর মধ্যে বিক্ষোভ-বিপ্লবের নামমাত্র নেই।

গানটির বিষয়বস্তু হলো জেসমিন ফুলের সুগন্ধ-সৌন্দর্যের কাব্যিক বর্ণনা।

তাহলে কেন এ গান চীনের কমুনিস্ট সরকারের টনক নড়ালো? কেন গানটির শিরোনামের চীনা অক্ষরগুলি সেদেশের মোবাইল সেটে ফিল্টার করে নিষিদ্ধ করা হলো ২০১১তে? শুধু তাই না, এমনকি জেসমিন কালচারাল ফেস্টিভাল নামে একটি আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক সম্মেলনও সে বছর বাতিল করে দেয়া হয়।

বুঝাই, ধৈর্য ধরুন।

মোলিহোয়ার উৎপত্তি চীনের চিং সাম্রাজ্যের শাসনামলে, অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি। যে কাব্যের মাধ্যমে ফুলের সৌন্দর্য বর্ণনা করা হচ্ছে, তার বিলাসিতা কেবল অবস্থাপন্ন বনেদী পরিবারদের পক্ষেই সম্ভব। যেকোন দেশের সংস্কৃতিতে ধনাঢ্য জমিদারী পরিবার কিংবা বণিকগোষ্ঠী যে পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকায় থাকে, সেটা আমাদের বাংলা সংস্কৃতির ইতিহাসেও ষোল আনা সত্য।

মোলিহোয়া গানটা একসময় চিং সাম্রাজ্যের বেসরকারী জাতীয় সঙ্গীতও ছিল এবং পশ্চিমেও ধীরে ধীরে অপেরা পীসের মাধ্যমে জনপ্রিয়তা পায়। আমি যোগাযোগটা ঠিক জানি না, কিন্তু আন্দাজ লাকমে অপেরার ফ্লাওয়ার ডুয়েট (ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের বিজ্ঞাপনের মিউজিক ছিল) হয়তবা, হয়তবা…. মোলিহোয়া দিয়ে প্রভাবিত।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




সে যাই হোক, বিংশ শতকের শুরুর ভাগে চিং সাম্রাজ্যের পতন হয়। নানা ওয়ারলর্ডের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। সে যুগের অবসান ঘটান কোমিনতাং পার্টির জাতীয়তাবাদী নেতা চিয়াংকাইশেক

কিন্তু তাঁর শাসনামলেই চীন হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রথম ক্যাজু্য়ালটি — ১৯৩৯এ যুদ্ধের অফিশাল শুরুর আগেই। একদিকে উত্তরপশ্চিমে মাওয়ের কম্যুনিস্ট গেরিলা, আরেকদিকে উত্তরপূর্বে জাপানের আগ্রাসন।

তারপরও চীনের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তখন অনেক পরিবর্তন আসে। অনেক ছাত্র মার্কিন-ইউরোপ থেকে নতুন ধ্যান-ধারণা নিয়ে এসে চীনা সংস্কৃতিকে আধুনিক রূপ দেন।

মার্কিনদের দীর্ঘকালীন সহযোগিতা আর মাওয়ের সাথে চুক্তি করে জাপানীদের ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হন চিয়াংকাইশেক (সোভিয়েতদের মাঞ্চুরিয়া দখল একেবারে শেষের সুবিধাবাদী ঘাত।)

যুদ্ধচলাকালীন সময়েই মাও তার লংমার্চ বিপ্লব ইত্যাদি শুরু করেন। ১৯৪৯এ কোমিন্তাংওয়ালাদের তাইওয়ানে ভাগিয়ে দিয়ে মেইনল্যান্ডে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন কায়েম হয়।

প্রথম বিশ-পঁচিশ বছর কম্যুনিস্ট শাসনামলে ধেঁয়ে ধেঁয়ে ভারিশিল্পের বিস্তার, শিক্ষা-চিকিৎসাক্ষেত্রের উন্নতি সাধিত হয়। নিঃসন্দেহে তা ছিল সমাজতন্ত্রী পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ফসল, এর বিপরীতে কী মূল্য দিতে হয়েছিল, তা না বললাম।

ষাটের দশকে মাওয়ের মাথায় ভূত চাপে যে যত দুনিয়ার ইউরোপীয় সংস্কৃতি উচ্ছেদ করতে হবে। প্রতিষ্ঠা করতে হবে চীনা গণমানুষের সংস্কৃতি। সব পুরাতনের ধ্বংস করে গড়তে হবে নতুন ইন্সটিটিউশন।

ষাটের দশকে কালচারাল রেভোলুশনের সময় ধ্বংস করা হয় বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্মের পুরনো পাণ্ডুলিপি আর মূর্তি।

তাঁর নামে দাঁড়িয়ে গেলো বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্টিজান পাইওনিয়ার ছাত্রগোষ্ঠী। চললো মবরুল। তারা যেখানেই পশ্চিমা কিছু কিংবা চীনা চিংযুগের বা সামন্তযুগের কিছু পেলো, সব পুড়িয়ে-গুঁড়িয়ে ধ্বংস করে ফেলল। পান্ডুলিপিহীন হলেন গবেষক, যন্ত্রবিহীন বাদ্যযন্ত্রী, ভগ্নমন্দিরের নিচে ভগ্নহৃদয় পুরোহিত।

 

কালচারাল রেভোলুশনে নিগৃহীত হন শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের মানুষ

এসময়ে চিংযুগের অনেক চীনা সঙ্গীতের লিপি হারিয়ে যায় বা ধ্বংস করে ফেলা হয়। কেউ কেউ মাটিতে পুঁতে লুকিয়ে ফেলে। কিছু অনেক পরে বেরিয়েছে আবার, বেশিরভাগই বেরোইনি।

বলা বাহুল্য, ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৬এর এই নৈরাজ্যকর সময়ে প্রচুর মানুষ বিনা কারণে বিনা বিচারে শুধু মাত্র পশ্চিমা চর বা কোমিন্তাং-চিংদরদী ইত্যাদি রাজাকারী অভিযোগের সন্দেহে প্রাণ হারায়। অনেক গবেষকের হিসাবে সে সংখ্যা প্রায় দু’কোটি।

চীনা সঙ্গীতের রাতারাতি পরিবর্তন ঘটে। আগে পশ্চিমা কিংবা চিং প্রভাবে ‘শিল্পের খাতিরেই ছিল শিল্প’। এখন আর্ট হয়ে দাঁড়ালো ‘উচ্চতর লক্ষ্য অর্জনের হাতিয়ার’, তথা নিষ্পেষিত জনগণের নামে মাও ও কম্যুনিস্ট পার্টির গুণকীর্তন। আর তাও যদি না হয়, লোকসঙ্গীতকে তুলে ধরা হলো অপেরা ফর্মে — এ যেন এক ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। ‘ওহে গ্রাম্যবালিকা, কোথা যাও একটু দাঁড়াও…’ ইত্যাদি হলো অপেরা-অর্কেস্ট্রার বিষয়বস্তু। নয়ত, ‘আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা, ক্ষেতে কাজ করি চল’, নয়ত টাইগার টিলার মাথায় দাঁড়িয়ে চেয়ারম্যান মাওয়ের লাল বই নিয়ে লাফালাফির স্মৃতিচারণ।

তো এসবের মধ্যে মোলিহোয়ার মত স্বল্প কিছু পুরনো গান বেঁচে রয়েছিল। কারণ, এসব গানের কথায় নেই কোন সম্রাট-বুর্জোয়ার নাম, নেই বিদ্রোহ-বিক্ষোভের আভাষ। শুধুই একটি নিষ্পাপ ফুলের গুণকীর্তন।

আর ঠিক এ কারণেই নিষ্পেষক কমুনিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের প্রতীক হিসাবে ২০১১তে এ গানটি বেঁছে নেয়া হয়। সে বিপ্লব বেশি দূর যায়নি। কারণ, রাষ্ট্রের হাতে মোবাইল-ইন্টারনেটের সকল কলকব্জা। টের পাওয়া মাত্রই মোলিহোয়ার যাত্রাভঙ্গ।

এখনও হংকংশিনজিয়াংয়ে স্বগোত্রীয়-অন্যগোত্রীয়দের ওপর একই কলকব্জা শানিয়ে তাদের জায়গামত পুরো দিচ্ছে কমুনিস্ট রাষ্ট্র। যারা রাষ্ট্রের সুফলভোগী তাদের কোন বিকার নেই। কোন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না, কবে জেসমিন ফুল মোলিহোয়ার মুক্তি আসবে চীনে।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...






আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




মুঘল চিত্রশিল্পে ইউরোপীয় প্রভাব

আজকে লিখছি মুঘল আমলের চিত্রকর্মের ওপর ইউরোপীয় প্রভাব নিয়ে। ব্রিটিশ কলোনিয়াল আমলের বহু আগ থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশে যে পর্তুগীজ, স্প্যানিশ, ওলন্দাজদের আগমন ঘটেছে, আর সে বাণিজ্যের ফলে স্বভাবতই নতুন ধ্যানধারণার মুক্তবিস্তার হয়েছে, সে ইতিহাস আজ ঢাকা পড়ে গেছে শুধুমাত্র ঊনবিংশ-বিংশ শতকের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার রাজনৈতিক ইতিহাসের পুরু প্রলেপে। আমার বিচারে সেটা ইউরোপীয় প্রভাব পরিপূর্ণ ন্যায়সঙ্গত মূল্যায়নের পথে একটা অন্তরায়।

মুঘল আমলে অংকিত এই চিত্রে কাগজের ওপর রঙ ও সোনার ব্যবহার। নবাব পরিচারকসহ প্রাতভ্রমণে বেরিয়েছেন। ১৭৩০-৪০। ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ এশিয়ান আর্ট।

প্রথম ছবিটা স্মিথসোনিয়ান মিউজিয়ামের ফ্রিয়ার গ্যালারি অফ আর্টে সংরক্ষিত। মোটরগাড়ির ব্যবসা করে বড়লোক এক শিল্পপতি চার্লস ফ্রিয়ার বিশের দশকে তাঁর সমস্ত এশিয়ান আর্ট দান করে দেন স্মিথসোনিয়ানকে। এমনকি সেগুলি রাখার জন্যে দালান বানানোর খরচটাও দিয়ে দেন। ওয়াশিংটন ডিসিতে এ মিউজিয়াম দেখার সৌভাগ্য হয় আমার। বাকি ছবিগুলোর অনেকগুলিও একই স্থানে সংরক্ষিত।

মূল কথায় ফিরে আসি। প্রথম ছবিটি ১৭৩০-৪০এ আঁকা। অশ্বারোহী এক নবাব ফুল শুঁকতে শুঁকতে পরিচারকসহকারে প্রমোদভ্রমণ করছেন। ছবিটি উল্লেখযোগ্য এ কারণে যে, এতে অনেকখানি রিয়ালিজম ও ন্যাচারালিজম উঠে এসেছে, যা মুঘলপূর্ববর্তী আমলে দেখা যায়নি। পার্স্পেকটিভ, ডেপথ অফ ফীল্ড, ধর্মীয় ও পৌরাণিক সাবজেক্ট ছেড়ে দৈনন্দিন কার্যকলাপকে ফুঁটিয়ে তোলা — এসবই ভারতীয় শিল্পকলায় নতুন ব্যাপারস্যাপার। পারসিক শিল্পীদের অনুপ্রেরণায় মুঘল চিত্রকলা প্রথম প্রথম সনাতনই ছিল। ন্যাচারালিস্টিক ছবি না আঁকার কারণ, অনেক শিল্পরসিক বলেন, ইসলাম ধর্মের বিধিনিষেধ যে একেবারে প্রাণবন্ত ছবি আঁকা হলে খোদার ওপর খোদকারি করার প্রচেষ্টা হবে সেটা, আর ফলাফল জাহান্নামের আগুন!

এখন বলি রিয়ালিজমে রূপান্তরের পিছনে ইউরোপীয় মিশনারী ও মুঘলদের অবদানের কথা।

সম্ভবত বিজাপুরের শিল্পী ফররুখ বেগের আঁকা এই চিত্রে মাতা মেরি ও যীশু। ১৫৮০-১৬১৯। ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ এশিয়ান আর্ট।

১৫৪২ সালে গোয়াতে এসে উপস্থিত হন সেন্ট ফ্রান্সিস জাভিয়ের। তাঁর লক্ষ্য ছিল সেখানকার পর্তুগীজ খ্রীষ্টানদের বিপথগামী হওয়া থেকে রক্ষা করা, আর তার লেজুড় ধরে নেটিভদের কাছে ধর্মপ্রচার। গোয়ার পার্শ্ববর্তী রাজ্য বিজাপুর ছিল আদিলশাহী সুলতানদের শাসিত। সেখানেও মিশনারীদের কার্যক্রম বিস্তার পায়। এর সাথে সাথে চলে আসে ধর্মীয় চিত্রকলা। যেমন, দ্বিতীয় ছবিটা বিজাপুরের ফররুখ বেগের আঁকা মাতা মেরী ও যীশুর ছবি। এ যতটা না ধর্মবিশ্বাস থেকে আঁকা, তার থেকে বেশি নতুন বিষয় নতুন ভঙ্গি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা। ফররুখ বেগ অবশ্যই এ ছবির নাম ম্যাডোনা অ্যান্ড চাইল্ড দেননি, কিন্তু বিষয়বস্তু রেনেসাঁস যুগের ম্যাডোনা অ্যান্ড চাইল্ডের সাথে পুরোপুরি মিলে যায়। তৃতীয় ছবিটিও সেরকম মুঘল আমলে করা হোলি ফ্যামিলির চিত্রায়ন। ফররুখ বেগ পরবর্তীতে সম্রাট আকবরের শিল্পকলা কর্মশালার সদস্য হন।

ইউরোপীয় চিত্রের অনুকরণে ভারতীয় শিল্পী এঁকেছেন হোলি ফ্যামিলির ছবি। সপ্তাদশ শতক। ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ এশিয়ান আর্ট।

সম্রাট আকবর ছিলেন সকল প্রকার চিত্রকলা ও স্থাপত্যশিল্পের পৃষ্ঠপোষক। তার আমলে মুঘল সাম্রাজ্য সর্বোচ্চ শৈল্পিক শিখরে ওঠে। আকবর একই সাথে ছিলেন নানা ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে আগ্রহী, আর সুফীবাদে বিশ্বাসী। এমনকি প্রচলিত ধারার চিত্রকলার পরিবর্তনের ব্যাপারেও তাঁর মতামত ছিল বেশ প্রগতিশীল। বিশেষ করে, তাঁর মতে চিত্রকররা যদি লাইফলাইক ছবি আঁকেও, তাদের অবশ্যই এই অনুধাবন অবশ্যম্ভাবী যে, তাদের ন্যুনতম ক্ষমতা নেই স্রষ্টার মত জড় বস্তুতে জীবন দেবার। একার্থে, এভাবে চিত্রকর্মের মাধ্যমে মানুষের পক্ষে আত্মগরিমা পরিত্যাগ করে স্রষ্টার অপার মহিমার প্রত্যক্ষদর্শী হওয়া সম্ভব। সুতরাং চিত্রকর্ম ধর্মীয় দিক থেকেও শিক্ষণীয় একটি কাজ। এ ছিল আকবরের সুফী ঘরানার চিন্তা।

সুফী ধর্মানুরাগী আকবর নতুন রাজধানী ফতেপুর সিক্রিতে ইবাদতখানা বলে একটি সম্মেলনকেন্দ্র বানিয়ে সেখানে মুসলিম-সুফী-হিন্দু-শিখ-জৈন-বৌদ্ধ প্রভৃতি ধর্মের গুরুদের আমন্ত্রণ জানান। গোয়ার পর্তুগীজ জেসাইটরাও বাদ পড়লো না নিমন্ত্রণ থেকে। তারা আকবরের ধর্মীয় ঔদার্যের ব্যাপারে ভালমতই জানত। দু’জন পাদ্রী আকবরের ইবাদতখানায় গেলেন আলোচনায় অংশ নিতে। তাদের আশা, আকবর কোন না কোনভাবে যীশুর দেবত্ব মানবেনই।

সে আশা গুঁড়ে বালি। আকবর তাদের থাকার জায়গা দিলেন, নিয়মিত তাদের সাথে আলোচনা করলেন। এমনকি, একটি বিদ্রোহ দমনের যুদ্ধেও এদের একজনকে নিয়ে গেলেন। আকবরের বহু কৌতূহল নিবৃত করার পরও পাদ্রীদের লক্ষ্য বিফল হলো। আকবর নিজেরই এক সুফী তরিকা চালু করলেন, দ্বীন-ই-ইলাহী নামে। তাতে যীশু নয়, স্বয়ং আকবরই একরকম দেবত্বের আসনে আসীন!

কিন্তু যে তিন-চার বছর জেসাইট পাদ্রীরা আকবরের দরবারে কাটালেন, সে সময়ের মধ্যে তারা বহু মেরী-যীশুর ছবি, রেনেসাঁস শিল্পীদের মাস্টারপীসের প্রতিলিপি, ইত্যাদি আকবরকে স্বাড়ম্বরে দেখিয়েছেন। আকবরও সেসব দেখতে যাবার সময় নিজের শিল্পীগোষ্ঠীকে সাথে নিতে ভোলেননি। তাঁরাই সেসব দেখে এসে আঁকা শুরু করলেন নতুন ধরনের ছবি। সেসবে যীশুর জায়গা নিলেন মুঘল সম্রাট নিজেই।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




তুলনার জন্য চতুর্থ ও পঞ্চম ছবি দিলাম। এগুলি চতুর্দশ শতকের প্রাকরেনেসাঁস যুগের ইতালীয় চিত্রকর জোত্তো দি বোন্দোনের আঁকা ফ্রেস্কো। প্রথমটি যীশুর জন্মের চিত্র, দ্বিতীয়টি মৃত্যুর। দু’টিততেই লক্ষ্য করুন, আকাশে ফেরেশতার দল, আর পবিত্র আলোকচ্ছটা বা হেলো যীশু-মেরী প্রমুখের মাথার চারদিকে।

১৩২০ সালের আশপাশ দিয়ে আঁকা জোত্তো দি বোন্দোনের অ্যাডোরেশন অফ দ্য মেজাই। মেট মিউজিয়াম
১৩০৫ সালের আশপাশ দিয়ে জোত্তো দি বোন্দোনের আঁকা দ্য ল্যামেন্টেশন অফ ক্রাইস্ট। স্ক্রোভেনি চ্যাপেল

এর সাথে মেলান ষষ্ঠ ছবিটি, যাতে সম্রাট আকবরের মাথার চারপাশেও সেই একই আলোকচক্র। আর ওপরে ছবির ফ্রেমে দুই ফেরেশতা (ইতালীয় ভাষায় পুত্তি)। সন্দেহাতীতভাবে রেনেসাঁস আর্টের প্রভাব!

এই স্টাইল যে শুধু সম্রাটের ছবির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়। সাত নম্বর ছবিটিতে এক মোল্লার ছবিতেও একই ব্যাপার।

১৬৫০ সালের দিকে মুঘল সম্রাট আকবরের ছবি, মাথার চারপাশে ইউরোপীয় ধাঁচে হেলো।ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ এশিয়ান আর্ট।
উনবিংশ শতকে মুঘল চিত্রকরদের আঁকা এক সুফি সাধকের ছবি। ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ এশিয়ান আর্ট।

পরবর্তী সম্রাট জাহাংগীরের সময় ভারতে ব্রিটিশদের আনাগোনা শুরু হয়ে যায়। রেনেসাঁস আর্টের সাথে কিছুটা হলেও এসে মিলে উত্তর ইউরোপীয় প্রভাব। আট নম্বর ছবিটি বাদশা জাহাংগীরের। এতে দেখানো হয়েছে সম্রাট ইংল্যান্ডের রাজা জেমসের বন্ধুতার প্রস্তাব পাশে ফেলে এক সুফী সন্তের নিকট থেকে পুস্তক গ্রহণ করছেন। ‘হেলো-পুত্তিও’ আছে জায়গামতই। জেমসের পোশাক-আষাকও নিখুঁত ইংরেজ।

১৬১৫ থেকে ১৬১৮এর মধ্যে শিল্পী বিচিত্রের আঁকা ছবিতে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গির দরবারে সুফি সন্তদের স্বাগত জানাচ্ছেন। নিচে বাম কোনায় ইংরেজ রাজা জেমস অপেক্ষমান। ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ এশিয়ান আর্ট।

নয় নম্বর ছবিটি ইংল্যান্ডের রাণী প্রথম এলিজাবেথের। এতে রাণী হাতে নিয়েছেন রাজদন্ড আর ‘গ্লোবাস ক্রুসিজের’। এই ব্রহ্মাণ্ডগোলক  বা সেলেস্টিয়াল অর্ব হলো বিশ্বব্রহ্মান্ডের রূপক, আর ক্রসটি যীশুর। অর্থাৎ এলিজাবেথ হলেন যীশুর স্বর্গীয় রাজক্ষমতার লৌকিক প্রতিনিধি। শুধু এলিজাবেথ নয়, বহু ইউরোপীয় রাজরাজড়াদের একইরকম পোর্ট্রেট ছবি আছে।

এর সাথে মিলান দশ নম্বর ছবিটিকে। জাহাংগীর বসে আছেন চেয়ারে, এ কিন্তু পুরোপুরি ইউরোপীয় ভঙ্গিমার চেয়ার। তার ওপর, জাহাংগীরের হাতে সেই সেলেস্টিয়াল অর্ব। ব্রহ্মান্ডের প্রতীক।

আনুমানিক ১৬০০ সালে নাম-না-জানা শিল্পীর আঁকা ইংল্যান্ডের রাণী প্রথম এলিজাবেথ। হাতে গ্লোবাস ক্রুসিজের। ইংল্যান্ডের ন্যাশনাল পোরট্রেট গ্যালারী।
মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর ইউরোপীয় ঘরানার চেয়ারে বসে আছেন, হাতে ব্রহ্মাণ্ড-গোলক। সপ্তদশ শতকের প্রথমভাগ।

লেখা শেষ করি তিনটি মুঘল ছবি দিয়ে। এ তিনটিতেই রেনেসাঁস আর্টের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য পুরোপুরি দৃশ্যমান। এক, আলোছায়ার খেলা, এমনকি কালো পটভূমিতেও সঠিক রং ব্যবহার করে রাতের দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। আর দুই, পারস্পেক্টিভ, ফোরগ্রাউন্ড-ব্যাকগ্রাউন্ডের ইলিউশন। একটিতে নৈশকালীন হরিণশিকারের দৃশ্য, আরেকটিতে ইব্রাহীম ইবনে আদম বল্খী নামক এক আদি সুফির ধ্যানের দৃশ্য, তাঁর আহারাদির ব্যবস্থা করছে ফেরেশতার দল।

আর শেষ ছবিটিতে আকবরের স্কেচ। লিওনার্দো দা ভিঞ্চির করা বলেও ভুল হয়ে যেতে পারত কারো! অর্ধনিমিলিত চোখে আকবর বিভোর হয়ে কিছু একটা পর্যবেক্ষণ করছেন। চেহারায় খুব প্রশান্তির ছাপ। জুলফি-গোঁফ খুব পরিচর্যা করে স্কেচ করা।

রাতের আঁধারে হরিণ শিকারের দৃশ্য, এঁকেছেন মুঘল শিল্পী মীর কালান খান। অষ্টাদশ শতক।ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ এশিয়ান আর্ট।
বলখের সুলতান ইব্রাহিম ইবনে আযাম জঙ্গলে ধ্যান করছেন, তার জন্যে খাদ্য নিয়ে এসেছে ফেরেশতার দল। মুঘল মিনিয়েচার, অষ্টাদশ শতকের প্রথমভাগ। ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ এশিয়ান আর্ট।
মুঘল শিল্পীদের আঁকা মহামতি আকবরের স্কেচ, আনুমানিক ১৬০৫ সাল।

ফার্সী-তুর্কীদের চিত্রকর্মও এসময় নানাভাবে ইউরোপীয় আর্ট দিয়ে প্রভাবিত হয়েছিল। মুঘলদের যাত্রা যদিও শুরু ইরানী-মধ্য এশীয় ঐতিহ্যের ছত্রছায়ায়, খুব দ্রুত তারা ভারতীয় আর ইউরোপীয় উপাদান গ্রহণ করে, আর জন্ম দেয় নতুন একটি ধারার, যা পরে বিভিন্ন স্থানীয় রাজা ও নবাবদের শিল্পরস আর রুচিকে প্রভাবিত করে।

সুতরাং, কলোনিয়ালিজমের দোষ দেবার পরেও বেশকিছু পজিটিভ ব্যাপারে ইউরোপীয়দের সামান্যতম ক্রেডিট না দিলেই নয়!



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...






আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




টাকা-আনা-পাই

ছবির এই মুদ্রা দু’টি আমার সংগ্রহের। দুটোই ১৮৩০এর দশকের বেংগল প্রেসিডেন্সির, অর্থাৎ ঈস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির মুদ্রিত।

প্রথম জোড়াছবি তামার এক পাই মুদ্রার দু’পিঠের। দ্বিতীয়টা রূপার টাকা।

বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির এক পাই মুদ্রা, ১৮৩১-১৮৩৫
বেংগল প্রেসিডেন্সির এক রূপিয়া মুদ্রা, ১৮৩০-১৮৩৩

কম্পানির আগে নওয়াবরা কার্যত স্বাধীন হলেও মুখে মুঘলদের শাসন মানতেন। তাঁরা শুরুতে মুঘল করসংগ্রহ বা দিওয়ানির দায়িত্বে ছিলেন। আওরঙ্গজেব তাঁর পুত্র আজিমুশশানের কাছ থেকে বাংলার নিজামাত বা প্রশাসনক্ষমতা কেড়ে নিয়ে তা অর্পণ করেন মুর্শিদকুলী খানের নিকট। সে থেকে শুরু বাংলার নওয়াব-নাজিমদের।

নওয়াবদের সময় বাংলায় যে মুঘল ধাঁচের মু্দ্রা চালু ছিল, তারও একটি ছবি দিলাম। এটি ফার্সিভাষায় মুঘল বাদশা শাহ আলমের নামসহকারে ইস্যুকৃত। বাংলা বা দেশীয় হরফের কোন ব্যবহার নওয়াবী মুদ্রায় ছিল না।

সম্রাট শাহ আলমের নামাঙ্কিত মুঘল রূপিয়া, ১৭৮১

তাই কম্পানি আমলের তাম্রমুদ্রাটিতে বাংলা হরফের ব্যবহার আমাকে একটু অবাক করে। এর আগে শুধুমাত্র কুচবিহার আর আসাম-ত্রিপুরার প্রাচীন মুদ্রায় বাংলা অক্ষরের যৎকিঞ্চিত ব্যবহার হয়েছিল। উদাহরণ ছবিতে।

রূপার টাকাটায় কম্পানি আগের মুঘল ডিজাইনই বলবৎ রেখেছে। কারণ বাদশার নামাংকিত পরিচিত ডিজাইনের ফিয়াত ভ্যালু রাতারাতি পরিত্যাগ করে নতুন ডিজাইন করলে জনসাধারণের সেটা গ্রহণ না করার সমূহ সম্ভাবনা।

অহম (আসাম) রাজ্যের ব্রজনাথ সিংহের স্বর্ণ মুদ্রা, ১৮১৮

কিন্তু তামার পয়সাটিতে ইউরোপীয় ধাঁচে ইংরেজী-বাংলা-ঊর্দু-হিন্দীতে এক পাই লিখে ইস্যু করাটা প্র্যাকটিকাল লিমিটের মধ্যে একটা যুগান্তকারী ব্যাপারই বলতে হবে!

মনে রাখতে হবে, কম্পানি বাংলার দিওয়ানি আর পরে নিজামাত পেলেও তাদের মূল লক্ষ্য ছিল বাণিজ্য। যে কোনধরনের সনাতন অকার্যকর প্রথা পরিত্যাগের ব্যাপারটা ব্রাহ্মণ্য কুলীনরা করেন না, করেন কায়স্থ বণিকরাই — সে যে কালচারেই হোক।

বঙ্গের আমজনতার মুখে বাংলাই বেশি চলত, সরকারী কর্মচারীদের মত ফার্সি নয়। বাণিজ্য তো সাধারণ মানুষকে নিয়েই: তাতে অংশগ্রহণ কৃষক, শ্রমজীবী, মধ্যস্বত্ত্বভোগী, জমিদার, প্রমুখ নানা শ্রেণীর। তাদের পাওনা সোজা করে বুঝিয়ে দিতে বাংলা আর অন্যান্য দেশীয় ভাষাই উপযুক্ত।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




তাই কম্পানির বেনিয়া শাসনের শুরুর সময়টা একার্থে বাংলা রেনেসাঁর আঁতুড়ঘর, অনেকটা রেনেসাঁ ইতালির মত। সে আঁতুড়ঘরে জন্ম রাজা রামমোহন, বিদ্যাসাগর, দ্বারকানাথ, প্রমুখ সংস্কারক শিক্ষিতজনের, আর পরবর্তীতে হিন্দু কলেজের ‘ইয়াং বেঙ্গলের’ । মুসলিমদের মধ্যেও যথেষ্ট পরিমাণে পাশ্চাত্যচর্চার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, ঢাকার নবাবরা উদাহরণ।

একেশ্বরবাদী ব্রাহ্ম রামমোহন কম্পানির শোষণের হিসাব করতে গিয়ে পেয়েছিলেন যে, কম্পানি যা রাজস্ব পাচ্ছে, তার একতৃতীয়াংশ বিলাতে যাচ্ছে। বাংলার নীলচাষ সংকটের সময় রামমোহন নানাভাবে ব্রিটিশদেরকে চোখে আঙুল দিয়ে তাদের অবিচারের বর্ণনা দিয়েছেন। তবে সে রাজস্বের বাকি ভাগ বাংলাতেই ছিল।

বলতে বাঁধা নেই, সেকালের বিশ্বের আর সব সভ্য দেশের মত এ ব্যবস্থায় তার পুরোভাগ লাভ ছিল রাজা-জমিদার আর ইউরোপীয় সেটলার সম্প্রদায়ের। নানা দুর্ভিক্ষ আর চাষীবিদ্রোহ তার প্রমাণ। কিন্তু এই বেনিয়া গোত্রই নতুন ধরনের মুক্ত সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করেন — যা ছিল আধুনিক — নবাবী আমলের ফার্সীনির্ভর ধ্রুপদী সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা নয়। সে মুক্তচিন্তা থেকেই বোধ করি বাংলা ভাষার আধুনিক সার্বজনীন চর্চা আর পরবর্তীতে তার জাতিগত পরিচয়ের আধুনিক রূপলাভ। (এর আগে হুসেনশাহী আমলে একটা মধ্যযুগীয় জাগরণ হয়েছিল)

ভারতীয় দর্শনে পাশ্চাত্যমানসের শুরু বাংলা ভাষাতেই প্রথম। আর বাংলাই কিন্তু ব্রিটিশশাসিত বিশ্বব্যাপী সংযুক্ত বহুজাতিক সাম্রাজ্যের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য — তার আগে আমেরিকার কলোনিগুলি আসলেই ছিল ইংরেজ-অধ্যুষিত কলোনি বা সেটলমেন্ট। বাংলা হল প্রথম বিজিত-শাসিত রাজ্য। এখানে তাই ব্রিটিশদের সাম্রাজ্যবাদী শাসনের প্রথম শিক্ষালাভ আর পরীক্ষা-নিরীক্ষা।

পরে কম্পানি মুদ্রায় অবশ্য ডিজাইন পরিবর্তনের পাশাপাশি শুধুমাত্র ইংরেজী হরফ ব্যবহার শুরু হয়। অর্থাৎ ব্যবসা আর শাসন পাকাপোক্ত করার পর বণিকরা এবার আসলেই হন শাসক, নামেন ‘অসভ্যদের সভ্য বানানোর অভিযানে।’

ঈস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি আমলের সওয়া আনা মুদ্রা, ১৮৩৫

যাই হোক, কম্পানি আর ব্রিটিশ রাজের ইতিবাচক ব্যাপারগুলির সংশোধনবাদী সমালোচনা শুরু হয় প্রথমবিশ্বযুদ্ধকালীন ‘হোমরুল’ আন্দোলনের সময় (অ্যানি বেসান্ট নামে এক ইংরেজ ভারতবাসিনী সমাজতন্ত্রী ছিলেন তার অন্যতম নেত্রী)। আর পরে দুই যুদ্ধের মাঝের কট্টর জাতীয়তাবাদের যুগে তা আরও হালে পানি পায়। সুভাষ বোসের রচনাবলী সেই রিভিশনিজমকে একটা বড় খুঁটি দেয়, যার ধারা এখনো আমাদের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতাবিরোধী চিন্তায় বেঁচে আছে।

আমি মুদ্রার দিকে তাকাই আর ভাবি, সত্য সবসময় সোজাসাপ্টা আর সার্বজনীন নয়! সব খারাপেরও ভাল খুঁজলে পাওয়া যায়। আপনি গ্লাসকে আধ-ভরা বলবেন, না আধ-খালি, সেটা আপনার মর্জি আর বদান্যতার লক্ষণ।

পুনশ্চ: এখানে আরো একটা ব্যাপার উল্লেখ না করে পারছি না যে, পূর্ববঙ্গ এই বাংলা পুনর্জন্মের পরিমণ্ডল থেকে অনেক দূরবর্তীই ছিল। পূর্ববঙ্গের সন্তান যারা এ পুনর্জন্মে অংশ নিয়েছেন, তারা কলকাতায় বসে ব্রিটিশ বা জমিদারি পৃষ্ঠপোষকতায় তা করেছেন। পূর্ববঙ্গের মুসলিমপ্রধান ‘গন্ডগ্রামে’ (কিন্তু বাণিজ্যিক উৎপাদনের অন্যতম মূল কেন্দ্র!) ফার্সী-উর্দু চলেছে বিংশ শতকের গোড়া পর্যন্ত।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...






আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




আফিম যুদ্ধ

(জাপানের মেইজি যুগ সম্পর্কে এ লেখাটি লিখতে গিয়ে চীনা-ভারতীয় আফিমের ডালপালা গজিয়ে গেল!)

ব্রিটিশদের সাথে চিং সাম্রাজ্যের দু’দু’টো যুদ্ধ হয়েছিল আফিমব্যবসাকে কেন্দ্র করে (প্রথম, ১৮৩৯-৪২; দ্বিতীয়, ১৮৫৬-৬০)। এর আগে চীনের জিডিপি ছিল বিশ্বের সর্বাধিক, আর ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে হেরে অসম অর্থনৈতিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে তা হয়ে যায় অর্ধেক। চীনের মানুষ এখনও মনে করে যে তারা এসময় পশ্চিমের উপনিবেশে পরিণত হয়েছিল। আফিম যুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস আর ফলশ্রুতি অবশ্য এভাবে এক লাইনে বর্ণনা করলে দু’পক্ষের প্রতিই অবিচার করা হবে। তাই আমি আরেকটু বড় করে ঘটনাটার বিবরণ দিচ্ছি।

(এখানে এটাও বলে রাখা দরকার যে, দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝের সময়টায় জাপানের একতরফা আগ্রাসনের মুখে চীনের নতুন প্রজাতন্ত্র পশ্চিমা সরকারদের থেকে যথেষ্ট সাহায্য আর সহানুভূতিশীলতা পেয়েছিল।)

আফিমের ওষধি গুণাগুণ আর আসক্তিকর প্রভাবের কথা প্রাচীন চীন ও ভারত দুই এলাকারই মানুষ জানত। আমরা রান্নায় যে পোস্তদানা ব্যবহার করি, তা আসলে পপি সীড বা আফিম গাছেরই বীজ। মধ্যযুগে চীনে স্থানীয়ভাবে আফিমের চাষ তেমন একটা হত না। মূলত ভারতের বিভিন্ন এলাকায় চাষাবাদের পর চীনে রপ্তানি হত আর কালোবাজারে চড়াদামে বিক্রি হত। আকবরের সময় মুঘলরা ছিল চীনে আফিমব্যবসার একচেটিয়া সত্ত্বাধিকারী। মুঘলদের কাছ থেকে ব্রিটিশ ঈস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি (ইআইসি) উত্তরাধিকারসূত্রে এ ব্যবসা পায়। অবশ্য সপ্তদশ শতকে ইআইসি নয়, ভিওসি (ডাচ ঈস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি) ছিল চীনের মূল আফিম সরবরাহকারী।

১৯০৮ সালে মার্কিন আলোকচিত্রী ভারতের সরকারী ফ্যাক্টরিতে আফিম ওজন করার দৃশ্য ধারণ করেছেন — উইকিমিডিয়া কমন্স – পাবলিক ডোমেইন

সপ্তদশ শতকের শেষে চিবিয়ে খাবার বদলে ধূম্রপানের মাধ্যমে আফিমসেবনের নতুন প্রক্রিয়া আবিষ্কৃত হয়। আফিমের ধোঁয়া ছিল আরো বেশি আসক্তিকর। ভারতের থেকে চীনেই বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এভাবে আফিমসেবন। এ কারণে চিংসম্রাট ফরমান জারি করে ১৭২৯ সালে আফিমের ব্যবহার ও কেনাবেচা নিষিদ্ধ করে দেন। প্রথম প্রথম তাতে আফিমের আমদানি কমলেও দাম আকাশচুম্বি হয়ে যায়। সরকারি দুর্নীতি আর চোরাকারবারির মাধ্যমে আফিম ব্যবসা বেশ লাভজনক হয়ে ওঠে।

অষ্টাদশ শতকের শেষে আফিমব্যবসার চাবিকাঠি ইআইসির হাতে এসে পড়ে। সিরাজউদ্দৌলাকে হারিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণে আসে ভারতের সবচে’ বেশি আফিমউৎপাদনকারী দুই এলাকা — বাংলা ও বিহার। আর পশ্চিমে ছিল মলওয়া রাজ্য। কলকাতায় বাঙ্গালী জমিদার আর মারোয়াড়ি বণিকরা কম্পানি খুলে বসে ইআইসির জাহাজে আফিম সাপ্লাইয়ের জন্যে। আফিমচাষীদের কাছ থেকে কমদামে ফসল কিনে এসব দালালরা বহুগুণ লাভে ইআইসির কাছে বিক্রি করত (বাংলার ১৭৭০এর দুর্ভিক্ষের একটি কারণ আফিমচাষের ওপর জমিদারদের ভারসাম্যহীন গুরুত্বপ্রদান)। এভাবে বাঙ্গালী-অবাঙ্গালী বহু জমিদার আর বণিক কলকাতায় প্রতিপত্তিশালী হয়ে ওঠে। এদের মধ্যে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথের দাদা দ্বারকানাথ ঠাকুর, বিরলা পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা শিবনারায়ণ, আর অনেক প্রভাবশালী পার্সী শিল্পপতিদের পূর্বপুরুষ। মুজতবা আলীর বই পড়ে আমার মনে হয়েছে বিশ-ত্রিশের দশকে সিলেটেও মুসলিম জমিদাররা আফিমচাষে অর্থলগ্নি করত। অষ্টাদশ শতকের শেষ নাগাদ বাংলায় উৎপন্ন আফিমের এক-তৃতীয়াংশ চীন ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় রপ্তানি হয়েছে।

ইআইসির আফিমভর্তি জাহাজ নোঙর ফেলত চীনের একমাত্র বৈদেশিক বন্দর ক্যান্টনে (গুয়াংচৌ) গিয়ে। সেখান মালখালাসের পর চীনা কালোবাজারিদের কাছে আফিম বিক্রি করে দেয়া হত। তারা সেসব নিয়ে লুকিয়ে বেচত স্থানীয় বাজারে। এভাবে সরাসরি চীনে আফিমের বাজারে ইআইসি যুক্ত না থাকলেও সাপ্লাই লাইনের সুবন্দোবস্ত করে দিয়েছিল তারা। এই কালোবাজারির লাভের মাধ্যমে চীনের সাথে বিশাল ট্রেডগ্যাপের ব্যালেন্স করে ব্রিটিশরা, কারণ চীন থেকে বিলাসদ্রব্য ব্রিটিশরা বিপুল পরিমাণে কিনলেও বিলাতি বিলাসদ্রব্য চীনে বিক্রি করা ছিল নিষিদ্ধ।

১৯০৬ সালে চীনের বেজিংয়ে তামাক ও আফিম সেবন চলছে আফিমের আখড়ায় — উইকিমিডিয়া কমন্স – পাবলিক ডোমেইন

১৮৩০এর দশকে আফিমব্যবসায় ইআইসি ও ভারতীয় আফিমের প্রতিযোগী হিসাবে আবির্ভূত হয় মার্কিন চোরাকারবারীরা (জন কেরি আর ফ্রাংকলিন রোজভেল্টের পূর্বপুরুষ এ ব্যবসায় জড়িত ছিলেন)। তাদের জাহাজ পারস্য-তুরস্ক থেকে আফিম কিনে চীনে বিক্রি শুরু করে। প্রতিযোগিতার ফলে দরপতন হতে থাকে। লাভ ধরে রাখতে তাই জাহাজীরা বাধ্য হয় আরো বেশি পরিমাণে আফিম পরিবহন করতে। চীনাদের মধ্যে মহামারির মত ছড়িয়ে পড়ে আফিম-আসক্তি।

১৮৩১ সালে চীনের সম্রাট নতুন করে আফিমের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এতেও যখন কাজ হল না, তখন ১৮৩৯এ সম্রাটের নির্দেশে চীনা সরকারী কর্মচারীরা ক্যান্টনের সকল আড়ত থেকে আফিম জব্দ করা শুরু করে। ব্রিটিশ আর অন্যান্য বিদেশীদের মজুদও রেহাই পেল না। বিশাল লোকসানের সম্মুখীন হল ইআইসি ও ভারতীয় লগ্নিকাররা। অপমানের জবাব দিতে ব্রিটিশরা যুদ্ধজাহাজ পাঠাল দক্ষিণ চীন সাগরে। জাহাজের কামান থেকে দূরপাল্লার গোলানিক্ষেপ করা হল উপকূলের বন্দরগুলিতে। ক্যান্টন বন্দর দখল করে নিল তারা। চীনারা বাধ্য হলো শান্তিচুক্তি করতে। সে চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটিশরা পেল হংকংয়ের মালিকানা, আর পাঁচটি সমুদ্রবন্দরে বাণিজ্য করার অধিকার।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




কিন্তু আফিম ব্যবসার ব্যাপারে কোন সুরাহা সে চুক্তিতে হয়নি। চীনে তখনও তা বেআইনী। এ সুযোগে হংকংয়ের চীনা কালোবাজারিরা নিজেদের জাহাজে ইউনিয়ন জ্যাক উড়িয়ে ব্রিটিশদের নিরাপত্তায় আফিম আনানেয়া করতে থাকে। ১৮৫৬ সালে এরকম একটি জাহাজ আটক করে চিং কর্মচারীরা, আর তারা জাহাজের ব্রিটিশ পতাকা ছিন্নভিন্ন করে ফেলে। ফলে শুরু হয় দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধ। এতে ফরাসী ও ব্রিটিশদের জয়লাভের পরে আফিমের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন সম্রাট, এবং আরো আশিটির মত বন্দরে বিদেশীদের বাণিজ্য করার অনুমতি দেয়া হয়। ভারত ছাড়াও তুরস্ক, মিশর, পারস্য, বল্কানে উৎপন্ন আফিমে সয়লাব হয়ে যায় চীন।

বেলজিয়ান কার্টুনিস্ট এরঝ়ে টিনটিন এন্ড দ্য ব্লু লোটাস কমিকে ত্রিশের দশকের চীনের আফিম আখড়ার ছবি এঁকেছেন — ব্যক্তিগত সংগ্রহ

আফিম আসক্তি নিরসনে চিংদের ভুল পদক্ষেপগুলি জাপানসহ অন্যান্য দেশের জন্য শিক্ষা হয়ে ছিল। যদি চীনা বন্দরগুলিতে সাধারণ বিলাসদ্রব্যের বাণিজ্য করতে দেয়া হত, তাহলে হয়ত আফিম কালোবাজারির খুব একটা দরকার পড়ত না পশ্চিমা ও ভারতীয় ব্যবসায়ীদের। আফিমকে বেআইনী করার কারণেও ‌অনিচ্ছাকৃতভাবে তার দাম বাড়িয়ে ব্যবসাটিকে লোভনীয় রূপ দেয় তারা। তারা চাইলে আফিম ব্যবসায়ীদের লাইসেন্সপ্রদান করে আর উচ্চশুল্ক আরোপ করে এ সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারত। শুল্ক থেকে সরকারী আয় নিয়ে স্থানীয় আফিমখোরদের বালাই সারাতে খরচ করতে পারত। শুধু মুনাফাখোর ব্রিটিশদের সকল দোষের ভাগীদার করা মনে হয় ন্যায়সঙ্গত নয়। চীনাদের ভুল পদক্ষেপ আর মিথ্যে সামরিক গর্বের কারণে তারা তো যুদ্ধে হেরে অর্থনৈতিক শক্তি হারায়ই, তার ওপর ঊনবিংশ শতকের শেষ নাগাদ তাদের জনগোষ্ঠীর প্রায় এক-দশমাংশ হয়ে ওঠে আফিমাসক্ত।

আর আফিম-আসক্তি যে শুধু চীনাদের সমস্যা ছিল তা নয়। পৃথিবীর সকল সভ্য স্থানেই আফিম চলত সে আমলে, কোথাওই বেআইনী ছিল না। বাদশা জাহাংগীর আর তাঁর পুত্র মুরাদ আফিমে আসক্ত ছিলেন। ব্রিটিশ আর মার্কিন প্রচুর বিখ্যাত মানুষেরও এরকম আসক্তি ছিল। যেমন, স্যামুয়েল টেলর কোলরিজ (অসমাপ্ত ‘কুবলা খান’ মহাকাব্য লিখেছিলেন নেশার প্রভাবে!), চার্লস ডিকেন্স, মেরি শেলী, ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল, এলিজাবেথ ব্রাউনিং, এডগার অ্যালান পো, জন কীটস, লিউয়িস ক্যারল, রবার্ট ক্লাইভ প্রমুখের আফিমসেবনের বদভ্যাস ছিল।

আমেরিকায় এখন আফিমের ডেরিভেটিভ ওপিয়েট পেইনকিলার বড়িতে প্রচুর সাধারণ মানুষ আসক্ত। এর দোষ যদিও মুনাফাখোর ওষুধ কম্পানিগুলিকে দেয়া হয়, আমি নিশ্চিত আসল ঘটনা তার থেকে জটিলতর — আফিম যুদ্ধের ইতিহাসের মতই।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!