হাইতি – ১, স্বাধীনতাসংগ্রাম, ১৭৯০-১৮১০

হাইতির ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক বিবরণী, বড় করে দেখার জন্যে ক্লিক করুন।

মানচিত্রে ক্যারিবিয়ান সাগরের দিকে নজর দিলে যে তিনটি বড় দ্বীপ প্রথমেই চোখে পড়বে, সেগুলি হলো কিউবা, জামেইকা আর হিস্পানিওলা। শেষটি অনন্য, কারণ একটি দ্বীপের মধ্যে দুটি রাষ্ট্র — পূর্ব ৫/৮ অংশে ডমিনিকান রিপাবলিক, আর পশ্চিম ৩/৮ অংশে হাইতি।

হাইতি অনেক দিক থেকেই বাকিদের থেকে আলাদা। দুনিয়ার মানুষ তাকে চেনে ভুডু ম্যাজিকের আখড়া হিসাবে। তাছাড়াও এ অঞ্চলের অল্প যে কটি দেশে ফরাসী ভাষা চলে, হাইতি তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। দোআঁশলা ক্রেওল ভাষাও এখন সরকারী স্বীকৃতিপ্রাপ্ত।

হাইতির যাত্রা শুরুও ব্যতিক্রমী। চিনি উৎপাদক ফরাসী উপনিবেশে ক্রীতদাসদের অভ্যুত্থান থেকে তার অভ্যুদয় অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগে। যুক্তরাষ্ট্রের পর পরই আমেরিকা মহাদেশে দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জনকারী রাষ্ট্র হাইতি।

হাইতির জনসংখ্যার অধিকাংশ কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের বংশধর আর একটা বড় অংশ দোআঁশলা মুলাটো জাত। মূল আমেরিকান অধিবাসী উপজাতিগুলি কলোম্বাসের পদার্পণের কয়েক দশকের মধ্যে মহামারী আর যুদ্ধের কবলে বিলুপ্ত হয়ে যায়।

১৭৯১এ শুরু স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে এখন পর্যন্ত হাইতি প্রচুর উত্থানপতন দেখেছে। দেখেছে জনসংগ্রাম আর যুদ্ধের মুখে দুজন সম্রাট আর ডজনখানেক রাষ্ট্রপতির অপসারণ। পার্শ্ববর্তী দেশ ডমিনিকান রিপাবলিককে দখল করে রেখেছে কয়েক বছর। আর নিজে দখলীকৃত হয়েছে দু’বার।

ক্যারিবিয়ানের অন্যান্য কৃষ্ণাঙ্গপ্রধান দ্বীপরাষ্ট্রের সাথে তুলনা করলে আজকের হাইতি বিফল রাষ্ট্র বলা চলে। হাইতি যে উচ্চাভিলাষ নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল, তার থেকে ক্রমাগত দূরে সরে গেছে। পশ্চিম গোলার্ধের দরিদ্রতম দেশ হাইতি। এমনকি পর্যটনের আকর্ষণ প্রতিবেশী দেশ ডমিনিকান রিপাবলিকের মানুষের মাথাপিছু আয় হাইতির পাঁচ-ছয় গুণ — যদিও দেশ দুটি প্রায় একই ধরনের ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে গেছে।

পঞ্চাশের দশক থেকে আশির দশক পর্যন্ত পাপাডক-বেবিডকের পরিবারতান্ত্রিক স্বৈরাচারী শাসনের পরবর্তী অরাজকতা আর ২০১০এ ৭ রিখটারের সর্বনাশা ভূমিকম্পের পর জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর সাথে বাংলাদেশী সেনাদলও হাইতিতে গিয়েছিল। সেখানকার অভিজ্ঞতা যে খুব একটা সুখপ্রদ নয়, এটা শান্তিরক্ষীদের অসামাজিক কর্মকান্ড নিয়ে একটি সাম্প্রতিক রিপোর্টে উঠে এসেছে। শ্রীলংকা সরকার একটি ক্ষেত্রে আর্থিক ক্ষতিপূরণও দেয়।

অর্থাৎ দেশটা এমন হয়ে গেছে যেখানে অমানবিকতা প্রতিদিনকার ব্যাপার। সেখানে বিদেশীরা বেশিদিন থাকলে তাদেরও অধঃপতন অবশ্যম্ভাবী।

কিভাবে হাইতি এমন অবস্থায় এসে পড়লো, তাই নিয়ে পাঁচখন্ডের এবারের সিরিজ।

প্রথম পর্ব: স্বাধীনতাসংগ্রাম, ১৭৯০-১৮১০

দ্বিতীয় পর্ব: রাষ্ট্রনির্মাণ, ১৮১০-১৮৬০

তৃতীয় পর্ব: আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, ১৮৬০-১৯১০

চতুর্থ পর্ব: দখলদার মার্কিন, ১৯১০-৫০

পঞ্চম পর্ব: রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, ১৯৫০-


হিস্পানিওলা নামের যে দ্বীপটিতে হাইতি অবস্থিত, ১৪৯২ সালে আমেরিকা অভিযানের শেষভাগে কলোম্বাস সেখানে অবতরণ করেন। কলোনিস্থাপনের প্রথম কয়েক দশকে আদিবাসীরা স্প্যানিশদের সাথে সংঘর্ষে, মহামারীতে আর দাসত্বশৃংখলের কঠোর পরিশ্রমে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ধীরে ধীরে স্প্যানিশদের মনোযোগ মূল ভূখন্ডের দিকে যত বেশি নিবিষ্ট হয়, হিস্পানিওলার সান্তো দোমিংগো কলোনির গুরুত্ব তত কমতে থাকে। সপ্তদশ শতকের শেষ নাগাদ দ্বীপটির পশ্চিমাংশ থেকে স্প্যানিশরা সরে যায়, তার জায়গা নেয় ফরাসী-ইংরেজ জলদস্যুরা। এই জলদস্যুদের রাস্তা ধরেই ফ্রান্স পশ্চিম হিস্পানিওলার পূর্ণ দখল নেয় ১৬২৫ সালে।

কলাম্বাসের হিস্পানিওলাতে অবতরণের দৃশ্য উডকাট করেছেন ডাচ শিল্পী থিওডর দ্য ব্রি, ১৫৯৪
ক্যারিবিয়ানের ফরাসী বাকেনিয়ার (জলদস্যু) ফ্রঁসোয়া লোলোনোয়া স্প্যানিশ জাহাজ লুটতরাজ করতেন, ১৬৮৪ সালের চিত্র

নতুন নামকৃত স্যাঁ-দোম্যাঙ্গ উপনিবেশটি ফরাসীদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পত্তিতে পরিণত হয়। ক্যারিবিয়ানের গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলবায়ুতে আখ, তামাক, কফি ইত্যাদি অর্থকরী শস্যের চাষাবাদ ও ফলন ভালই হয়। স্যাঁ-দোম্যাঙ্গের খামারে খাঁটুনির কাজের জন্যে হাজারে হাজারে আফ্রিকান ক্রীতদাস আনা শুরু হয়।

ফরাসীরা ক্রীতদাসদের অমানবিকভাবে খাঁটাত। অন্যান্য ইউরোপীয় উপনিবেশগুলিতে ক্রীতদাসরা কিছুটা হলেও মূল্য পেত। কিন্তু ফরাসী রাজতন্ত্রের সেকেলে নিয়মে ক্রীতদাসরা বলতে গেলে ছিল একটিবার ব্যবহারের পণ্য। ফলে প্রতি বছর স্যাঁ-দোম্যাঙ্গে হাজার হাজার জওয়ান ক্রীতদাস মৃত্যুবরণ করত। ১৭৯০ সাল নাগাদ সেখানে ছিল প্রায় পাঁচ লাখ দাস আর হাজার পঞ্চাশেক ফরাসী শ্বেতাঙ্গ খামার মালিক।

আরো একটি ‘বর্ণ’ ছিল, যাদের নাম মুলাটো বা মিশ্রজাত। আর ছিল অল্প কিছু মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গ। এরা মূলত কারিগর, খেতশ্রমিকের তদারককারী, পুলিশ, পেয়াদা, ইত্যাদি অবকাঠামোভিত্তিক পেশায় জড়িত ছিল।

স্পেনের আমেরিকান কলোনিগুলিতে শ্বেতাঙ্গ খামারমালিকের সাথে কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের মিলনে প্রচুর মুলাটো বা মিশ্র সন্তানের জন্ম হয়, কারণ ভদ্র পরিবারের ইউরোপীয় মেয়েরা সাধারণত আমেরিকায় যেতে চাইত না, ১৭৭৫এর ‘কাস্তা’ চিত্র, স্প্যানিশ চিত্রকার ফ্রান্সিস্কো ক্লাপেরা, ১৭৪৬-১৮১০, ডেনভার আর্ট মিউজিয়াম
১৮২৩ সালে ক্যারিবিয়ান সাগরের দ্বীপ অ্যান্টিগাতে ক্রীতদাসদের আখ খামারে কাজ করার অ্যাকুয়াটিন্ট বানিয়েছেন ব্রিটিশ শিল্পী উইলিয়াম ক্লার্ক

ফ্রান্সে ১৭৮৯ সালে রক্তক্ষয়ী বিপ্লব শুরু হয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে রাজা-রাজড়া আর অভিজাত বংশগুলির শোষণের প্রতিবাদে জেগে ওঠে পেশাজীবী মধ্যবিত্ত থেকে দরিদ্র কৃষক। বাস্তিল দুর্গের পতন হয়। রাজা ষোড়শ লুইকে প্রথমে গদি ছাড়তে হয়, তারপর তার আর রাণী মারি অঁতোয়ানেতের গর্দান যায় গিলোটিনে। দশ বছরব্যাপী অন্তর্ঘাতে নিমজ্জিত হয়ে যায় ইউরোপের শক্তিশালী দেশটি।

এই অরাজকতার সুযোগ নিয়ে স্যাঁ-দোম্যাঙ্গের অবস্থাপন্ন মুলাটো ও মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গ যারা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক, তারা আরো রাজনৈতিক অধিকার দাবি করে বসে। প্রথমে তাদের লক্ষ্য স্বাধীন দেশ কিংবা দাসপ্রথার উচ্ছেদ ছিল না। এমনকি এদের অনেকে কালে খামার মালিক বনেছে, দাসদেরও মনিব হয়েছে, তুলা-নীল-কফি রপ্তানী করে বেশ সম্পদশালী হয়েছে। কিন্তু রক্ষণশীল রাজতন্ত্রবাদী ফরাসী খামারমালিকদের প্রশাসন তাদের দাবি প্রত্যাখ্যান করলে, এরা হাত মেলায় সাধারণ কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের সাথে।

এই দাসরা কিন্তু আফ্রিকার আবাসভূমিতে ছিল সশস্ত্র যোদ্ধা! আফ্রিকার গৃহযুদ্ধগুলিতে পরাজিত হবার পর শত্রুরা এদেরকে বেচে দিয়েছিল ইউরোপীয়দের কাছে। এসকল কৃষ্ণাঙ্গ যোদ্ধাদের সাহায্যে একটা শক্তিশালী সামরিকতন্ত্র দাঁড়া হয়ে যায় স্যাঁ-দোম্যাঙ্গে।

১৭৯৪ সালে ফরাসী জনতা তাদের প্রাক্তন রাজা ষোড়শ লুইকে গিলোটিনে মৃত্যুদন্ড দেয়, লুই ব্লঁ-এর ইস্তোয়ার দ্য লা রেভোল্যুসিওঁ বইএর এনগ্রেভিং
হাইতির ১৭৯৩ সালের রক্তাক্ত বিপ্লবের চিত্র দেখানো হয়েছে ১৮২০ সালের ফরাসী বইয়ে
১৮৩৩ সালে ফ্রঁস মিলিতের বইয়ে অংকিত হাইতি বিপ্লবের হত্যাকাণ্ডের চিত্র

স্যাঁ-দোম্যাঙ্গে ত্রিমুখী গোলমাল চলে ১৭৯১ থেকে ১৮০৪ পর্যন্ত। প্রথমে কৃষ্ণাঙ্গসংগ্রামের একক কোন নেতা ছিল না। বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন দল একেক প্রদেশে স্বাধীন শাসন কায়েম করে বসেছিল। ক্রমে এদের নেতা হিসাবে আবির্ভূত হন তুস্যাঁ লুভেরত্যুর নামে এক মুক্ত মুলাটো। বাল্যকালে দাসত্ব থেকে মুক্তি পাবার পর কোচচালক পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। তারপর শিক্ষিত হয়ে নিজেই খামার দেন, দাস পালেন। বিপ্লবের সময় বিদ্রোহী সেনাপ্রধান হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। স্বাধীন হাইতির প্রতিষ্ঠাতা ধরা হয় লুভেরত্যুরকেই।

১৮০৪/০৫ সালে ফরাসী শিল্পী জিরার্দ্যাঁর আঁকা তুস্যাঁ ল্যুভেরতুরের পোর্ট্রেট

১৭৯৪ সালে ফ্রান্সে প্রজাতন্ত্রবাদীরা ক্ষমতাদখল করে ফরাসীশাসিত সকল দেশে দাসপ্রথা রদ করে দেয়। বিদ্রোহী লুভেরত্যুর তখন পক্ষপরিবর্তন করে ফরাসী সরকারের গভর্নর হিসাবে নামেমাত্র ফরাসীঅধীন কলোনিটির শাসনভার দখল করেন। প্রজাতন্ত্রবিরোধী খামার মালিকদের প্রতিরোধযুদ্ধ তখনও চলছিল। তাদের আহ্বানে ব্রিটিশ নৌবাহিনী পাঁচ বছর স্যাঁ-দোম্যাঙ্গের অধিকাংশ এলাকা দখল করে রাখে।

কিছু দাসপ্রথাবিরোধী শ্বেতাঙ্গ অবশ্য লুভেরত্যুরের সাথে যোগ দেয়। লুভেরত্যুর ছিলেন সাদা-কালোর মধ্যে আপোষকামী, তাঁর অধীনে শ্বেতাঙ্গ সেনাপ্রধান ও সচিবও ছিল। সাদা বন্দীদের সাথে ভাল আচরণের উদাহরণও প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।

কিন্তু ফরাসী বিপ্লবের লাগাম টেনে ধরেন নাপোলেওঁ বোনাপার্ত স্বয়ং। ফ্রান্সে ১৭৯৯ সালে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে প্রথমে কনসাল ও পরে সম্রাট পদবী গ্রহণ করেন তিনি। স্যাঁ-দোম্যাঙ্গকে পুনরায় কব্জা করার জন্যে এক বিশাল নৌবাহিনী পাঠানো হয় ক্যারিবিয়ান সাগরে। তাদের সেনাপ্রধান লক্লের্কের চালাকির শিকার হয়ে লুভেরত্যুর ফ্রান্সে বন্দী হিসাবে প্রেরিত হন, সেখানেই মৃত্যু হয় তার। তার সহযোদ্ধা জঁ-জাক দেসালিন ও অন্যান্যরা উপায়ান্তর না দেখে নাপোলেওনের পক্ষে যোগ দেন আর লড়াই চালান স্বাধীনতাকামীদের বিরুদ্ধে।

অবশ্য নাপোলেওনের দাসপ্রথা পুনর্বহাল করার গোপন পরিকল্পনা যখন ফাঁস হয়ে যায়, তখন আবার দেসালিন পক্ষপরিবর্তন করেন। স্পেন ও ব্রিটেন থেকে আমদানি করা অস্ত্রের সাহায্যে কঠিন গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে ফরাসীদের ১৮০৩ সালে তাঁড়াতে সক্ষম হয় দেসালিনের সেনাদল। সে যুদ্ধের খরচ ওঠাতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে লুইজিয়ানা টেরিটোরির বিশাল ভূখন্ড বিক্রি করে দেয় ফ্রান্স।

১৮০৪ সালে ফরাসী জেনারেল নাপোলেওঁ বোনাপার্ত নিজের মাথায় নিজেই মুকুট পরে ফ্রান্সের সম্রাট বনে বসেন, জাক লুই-দাভিদের অংকিত চিত্র, ১৮০৮।
নাপোলেওনের পাঠানো সেনাদলের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত হাইতির সেনাদল। পেছনে মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গের নির্দেশনায় সামনে এগিয়ে যাচ্ছে সশস্ত্র দাসের দল, ১৮০৩। ১৮৩৯ সালে প্রকাশিত ইস্তোয়ার দ্য নাপলেওঁ বই থেকে
নাপোলেওনের পাঠানো সেনাদল প্রচন্ড নিষ্ঠুরতার সাথে মুক্তিকামী কৃষ্ণাঙ্গদের হত্যা করে, ১৮০০। ১৮০৫ সালে প্রকাশিত অ্যান ইস্টরিকাল অ্যাকাউন্ট অফ দ্য ব্ল্যাক এম্পায়ার অফ হেইতি বই থেকে।
নাপোলেওনের হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ হাইতির কৃষ্ণাঙ্গরাও নেয় খুব নৃশংসতার সাথে, ১৮০০। ১৮০৫ সালে প্রকাশিত অ্যান ইস্টরিকাল অ্যাকাউন্ট অফ দ্য ব্ল্যাক এম্পায়ার অফ হেইতি বই থেকে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

দেসালিন ১৮০৪ সালে স্বাধীনতা ঘোষণা করে স্যাঁ-দোম্যাঙ্গকে নতুন নাম দেন হাইতি। এ ছিল লোককথা অনুযায়ী দ্বীপটির জন্যে আমেরিকান আদিবাসীদের ব্যবহৃত নাম। দেসালিন লুভেরত্যুরের মত আপোষকামী ছিলেন না, তার আমলে হাজার হাজার শ্বেতাঙ্গ খামারমালিককে সপরিবারে হ্ত্যা করা হয়। গর্ব করে হাইতিকে ফরাসীদের সমাধি ডাকনাম দেন দেসালিন। কিছু শ্বেতাঙ্গ মিত্রের প্রতিরক্ষার নিশ্চয়তা অবশ্য দেয়া হয়।

স্বাধীন হাইতির গঠনতন্ত্রে দাসপ্রথা রহিত করার পাশাপাশি দেশের সকল নাগরিককে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘কৃষ্ণাঙ্গ’ ঘোষণা করা হয়, যদিও কিছু পোলিশ শ্বেতাঙ্গ সেনা অফিসারকে নাগরিকত্ব দেয়া হয়। আরো যে ধারাটি লেখা হয়, সেটি হাইতিকে অনেক দিন ভোগাবে। সেধারা হলো, হাইতিতে বহির্দেশীয়, বিশেষত শ্বেতাঙ্গ কারো সম্পত্তির মালিকানা নিষিদ্ধ।

দাসপ্রথা রহিত করা হলে কি হবে, লুভেরত্যুর-দেসালিন দু’জনই পূর্ববর্তী খামার ব্যবস্থাকে অটুট রাখেন! তাদের হিসাবে বড় প্ল্যান্টেশনের মাধ্যমে চিনি রপ্তানি করে অর্থনীতিকে সচল রাখতে না পারলে আবার হাইতির স্বাধীনতা বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়বে। আর বাকি বিশ্বকে দেখাতে হবে না, কৃষ্ণাঙ্গরা রাষ্ট্রপরিচালনায় কোন অংশে শ্বেতাঙ্গদের থেকে কম নয়?

স্বাধীন হাইতির প্রথম নেতা ও সম্রাট জঁ-জাক দেসালিন, পোর্তো প্র্যান্সের ম্যুরাল চিত্র
নাপোলেওনের সেনাবাহিনী থেকে বিদ্রোহ করে কৃষ্ণাঙ্গদের সাথে যোগ দেয় অধিকৃত পোল্যান্ডের সৈন্যদল, ১৮০০

 

 

 

 

 

 

 

 

ফরাসীদের কাছ থেকে লুইজিয়ানা টেরিটরি কিনে যুক্তরাষ্ট্রের আকার প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়, ১৮০৩

ফলশ্রুতিতে, সাধারণ কৃষ্ণাঙ্গরা ক্রীতদাস থেকে এবার পরিণত হলো ভূমিদাসে! খামার ছেড়ে অন্য কোথাও যাবার ও বসবাস করার অনুমতি এদের ছিল না। শহরে যেতে হলে তাদের লাগত পাসপোর্ট। খামার থেকে পালালে দেসালিনের পুলিশবাহিনী খুঁজে এনে আবার খামারে সোপর্দ করত। বলা বাহুল্য, খামারগুলোর মালিক তখন দেসালিনের সেনাবাহিনীর অফিসার আর সৈন্যের দল। আর যেসকল চাষী তাদের ক্ষুদ্র জমিতে স্বাধীনভাবে চাষাবাদ করত, তাদেরও যাতায়াতের স্বাধীনতা ছিল না। উৎপন্ন ফসলের এক-চতুর্থাংশ কর হিসাবে সরকারকে দিয়ে দিতে হত।

অন্যদিকে প্রজাদের উন্নয়নের জন্যে যে শিক্ষা আর অবকাঠামো যেকোন নতুন রাষ্ট্রের প্রয়োজন, তার দিকে কোন নজর দেসালিন দেননি। সাধারণ হাইতিয়ানদের জন্যে দরকার ছিল ভূমিসংস্কার আর বড় খামারগুলো ভেঙে ছোট স্বাবলম্বী চাষাবাদযোগ্য জমি তৈরি। সেসব না করার কারণে প্রাক্তন দাসরা লুভেরত্যুর আর দেসালিন দুজনের বিরুদ্ধেই সংগ্রাম করেছিল। এগুলি কঠোর হাতে দমন করেন দুজনেই।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও স্বীকৃতি অর্জন করতে ব্যর্থ হয় হাইতি। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলির সাথে প্রাইভেট সেক্টরে বাণিজ্য চললেও ফ্রান্স স্বাধীনতার স্বীকৃতি না দেয়ায় পাশ্চাত্যের বাকি সরকারগুলিও একই পথ অবলম্বন করে। বিশেষ করে ‘অগ্রজ’ যুক্তরাষ্ট্রের এহেন আচরণে সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত হয়ে পড়ে হাইতির শাসকগোষ্ঠী। ‘স্লেভ লেবারের’ ব্যবহারে উৎপন্ন চিনি-কফির রপ্তানির পয়সায় দেসালিন বিপুল অস্ত্রশস্ত্র কিনেন, আর স্থানে স্থানে দুর্গ তৈরি করা হয় ভবিষ্যত কোন এক যুদ্ধের প্রতিরক্ষার জন্যে।

স্বাধীনতার পর হাইতির শহুরে জনগণ কয়েক বছর উৎসব করে। গ্রামের কর্মঠ কৃষক জনগণের থেকে এদের দূরত্ব ক্রমশ বাড়তে থাকে।
স্বাধীনতার পর খামার বা প্ল্যান্টেশন ব্যবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। ক্রীতদাসরা পরিণত হয় ভূমিদাসে, তাদের খামারের নতুন মালিক বনে দেসালিন-লুভেরত্যুরের অনুগত সেনা অফিসাররা। আর তাদের খাঁটনির পয়সায় সরকার সারা দেশে গড়ে তোলে অনেকগুলি অস্ত্রাগার ও দুর্গ।

এভাবে হাইতির সামরিকতান্ত্রিক শাসকগোষ্ঠী আর প্রাক্তন দাস প্রজাদের মধ্যে একটা বিশাল দূরত্ব তৈরি হতে থাকে। সাধারণ হাইতিয়ানরাও সন্দেহবাতিকে ভুগতে শুরু করে, যুক্তরাষ্ট্র বা ফ্রান্সকে নিয়ে নয়। নিজের স্বাধীন জীবনাচরণ নিয়ে, আর তাতে ক্রমাগত স্বৈরাচারী রাষ্ট্রের নাকগলানো নিয়ে।

দেসালিনের ইচ্ছে ছিল দুনিয়াবাসীকে দেখিয়ে দেবেন যে কৃষ্ণাঙ্গরা রাজনীতি-অর্থনীতি ও কর্মক্ষেত্রে শ্বেতাঙ্গদের থেকে কোন অংশেই কম নয়। কিন্তু তার এই তত্ত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে জনসাধারণের যে স্বাধীনতাটা বিসর্জন দিতে হলো, তাই হাইতির অরিজিনাল সিন। আর সেই পাপের ভার আরেক দফা বাড়ালেন দেসালিন নিজেই — হাইতির স্বাধীনতার নয় মাসের মাথায় নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করে!

লাইবেরিয়া – ৫, গৃহযুদ্ধ, ১৯৩০-

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত লাইবেরিয়ার ইতিহাসকে দু’ভাগে ভাগ করতে পারি। ১৯৮০ পর্যন্ত প্রথমভাগে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসে মার্কিন ও ডাচ বিনিয়োগের ফলে। ফায়ারস্টোন টায়ারের রাবারশিল্প, ডাচ ও রাষ্ট্রায়ত্ত সোনা ও লৌহআকরিক উত্তোলনশিল্প, আর মার্কিনদের তৈরি গভীর সমুদ্রবন্দর ও বিমানবন্দরের সুবাদে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি আসে লাইবেরিয়াতে। সরকারী পয়সায় পশ্চিম আফ্রিকার তথাকথিত ‘সুইজারল্যান্ডের’ প্রচুর যুবক উচ্চশিক্ষার্থে মার্কিনে পাড়ি জমায়।

প্রেসিডেন্ট টাবম্যান ১৯৪৪ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত দেশশাসন করেন। টাবম্যান চাটুকারপরিবেষ্টিত থাকতে পছন্দ করতেন। তার আমলে যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়, সবের কৃতিত্ব নিজে দাবি করতেন। মতবিরোধীদের যৎসামান্য কৃতজ্ঞতাবোধও নেই, একথা বলে বেড়াতেন সবার কাছে। তার জন্মদিন পরিণত হয় রাষ্ট্রীয় ছুটির দিনে। আমেরিকো সেটলার ঐতিহ্যের প্রতীকগুলির ‘পূজো’ তো চলতই।

লাইবেরিয়ার ঊনিশতম প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম টাবম্যান (১৮৯৫-১৯৭১)। রাষ্ট্রপতি ছিলেন ১৯৪৪ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত।
ডাচ রাজপরিবারের সাথে প্রেসিডেন্ট টাবম্যান, ১৯৫৫।

মার্কিন সিভিল রাইটস আন্দোলনের জোয়ারে অবশ্য টাবম্যান ১৯৬৪তে ‘ইউনিফিকেশন অ্যাক্ট’ স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন। ফলে দেশের যে ৯৮ শতাংশ মানুষ এতদিন ভোটাধিকারবঞ্চিত ছিল, তারা সে অধিকার পায়। ইতিহাসের কী নির্মম পরিহাস, যে দেশ ছেড়ে আমেরিকোদের লাইবেরিয়ায় আসা মুক্তির সন্ধানে, সেদেশের উদাহরণ অনুসরণ করেই সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিত করতে হয়, স্বাধীনতার একশ’ কুড়ি বছর পর!

১৯৭১এ টাবম্যানের মৃত্যুর পর তার উপরাষ্ট্রপতি টলবার্ট হন প্রেসিডেন্ট। এসময় ভিন্নমুখী পরিবর্তন আসতে শুরু করে লাইবেরিয়াতে। মার্কিনফেরত ছাত্ররা লাইবেরিয়ায় ফিরে চাকরি পেতে বেশ বেগ পায়। কারণ ততদিনে ইকনমির বুম শেষ হয়ে বাস্টের দিকে চলছে। এসকল ছাত্রদের অনেকেই মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে বামপন্থী রাজনীতিতে দীক্ষিত হয়।

তাছাড়া আফ্রিকার অন্যান্য অনেক দেশও তখন ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্তি পাচ্ছে। প্রতিবেশী দেশ ঘানার নেতা কওয়ামে ন্ক্রুমা সোভিয়েত সমর্থিত ছিলেন, স্বদেশে তিনি সমাজতন্ত্র আর বিদেশে প্যান-আফ্রিকানিজমের জজবা তোলেন। লাইবেরিয়ার যুবসমাজ সমাজতন্ত্র আসলে কতটুকু বুঝত, তা প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু দেশের বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্যে মার্কসবাদের বাণীতেই তারা থিওরিটিকাল সমাধান খুঁজে ফেরে।

ষাটের দশকে লগিং ছিল লাইবেরিয়ার বিদেশী বিনিয়োগের অন্যতম শিল্প।
লৌহআকরিক উত্তোলনে লাইবেরিয়া ষাটের দশকে ছিল অগ্রগণ্য একটি দেশ।
সত্তরের দশকে আখমাড়াই করে চিনি প্রস্তুত ও রপ্তানি হত লাইবেরিয়া থেকে।

দু’টি ‘প্রগতিশীল’ সংগঠন গড়ে ওঠে রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্যে। সত্তরের দশকের শেষে চালের দামবৃদ্ধির প্রতিবাদ করতে গিয়ে এদের একটির সমর্থকরা মনরোভিয়াতে ব্যাপক লুটতরাজ চালায়। তাদের প্রতিবাদ মিছিলে গুলিবর্ষণ করলে সত্তরজনের মত মারা যায়।

পুরো দেশে থমথমে একটা অবস্থা বিরাজ করছিল। টলবার্ট ভেবেছিলেন একটা বামপন্থী বিপ্লব হবে আর তার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। যেটা হল, তা বোধহয় কারো আন্দাজে ছিল না। বামপন্থী সংগঠনগুলি স্বজাতির মজলুমদের কথা বললেও গ্রামাঞ্চলে তাদের তেমন কোন প্রভাব ছিল না। শহরকেন্দ্রিক রাজনীতির অঙ্গন থেকে তারা একটা পরাবাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গোত্রীয় উপজাতিগুলিকে বিচার করত। আর লাইবেরিয়ান আর্মির অর্ধশিক্ষিত উপজাতীয় পেটি অফিসার, জওয়ান এদেরকে দীক্ষিত করত প্রগতিশীল চেতনায়। এসকল সেনাসদস্য বেশির ভাগই ছিল ক্রান গোত্রের।

বিদেশী অর্থায়নে মনরোভিয়া আধুনিক রাজধানীতে পরিণত হলেও ১৯৬৯এ এটি ছিল বিশ্বের সবচে কম জনবহুল রাজধানী।
লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট টলবার্ট (বামে) জাইর বা বর্তমান ডিআর কংগোর একনায়ক প্রেসিডেন্ট মবুতুর সাথে। এদের মাথায় সিভিল রাইটস আন্দোলনের প্রতীকী টুপি।
১৯৭৩এর মনরোভিয়া।

এই সেনাবাহিনীর একটা দল ১৯৮০র এপ্রিলে দেশের ক্রান্তিলগ্নে রক্তাক্ত একটি ক্যুদেতা করে বসে। প্রেসিডেন্ট টলবার্টকে তার প্রাসাদে হত্যা করা হয়। জনসমক্ষে তার ক্যাবিনেটের তেরজন সদস্যকে মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা করে ফেলে সেনাসদস্যরা। সেটা দেখে স্থানীয় জনগণ আনন্দ-উল্লাস করে। স্যামুয়েল ডো বলে এক মাস্টার সার্জ্যান্ট হয়ে বসেন দেশের রাষ্ট্রপতি। তিনি হন স্থানীয় উপজাতীয় গোত্রগুলো থেকে নিযুক্ত প্রথম রাষ্ট্রপতি।

সংবিধান রহিত করে সামরিক শাসন জারি করেন ডো। বামপন্থী দলগুলির একটিকে নিজের আজ্ঞাবহ রাজনৈতিক দলে পরিণত করলেও আসলে তিনি ছিলেন মার্কিন আর সিআইএর সাথে বেশি ঘনিষ্ঠ। ক্রান উপজাতীয়রা এসময় তার পৃষ্ঠপোষকতায় সরকারী চাকরি থেকে শুরু করে সব জায়গায় অগ্রাধিকার পায়। একটি বিফল ক্যু সংঘটিত হয় তার বিরুদ্ধে। ১৯৮৫তে কারচুপির নির্বাচন করে ডো রাষ্ট্রপতির আসনে পাকাপোক্তভাবে বসেন।

লাইবেরিয়াতে ১৯৭৯ সালে চালের দাম নিয়ে রায়টে সত্তরের মত মানুষ পুলিশের গুলিতে মারা যায়।
১৯৮০তে ক্ষমতার দখল করে ক্রান উপজাতীয় সেনানায়ক স্যামুয়েল ডো
যুক্তরাষ্ট্রের পেন্টাগনের সামনে লাইবেরিয়ার রাষ্ট্রপতি ডো

এরও ফল যা হবার হলো। ১৯৮৯ সালে চার্লস টেইলর বলে আরেক ওয়ারলর্ড অন্যান্য উপজাতির সহায়তায় আইভরি কোস্ট থেকে বিদ্রোহীবাহিনী নিয়ে লাইবেরিয়াতে ঢোকেন। পুরো দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। টেইলর ডো’র সরকারকে হঠাতে সক্ষম হন। ডো’র ভাগ্যও হয় তার পূর্বসূরীর মত। তার নগ্ন মৃতদেহ প্রদর্শিত হয় জনপথে।

টেইলর হয়ে বসেন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু যে ‘ক্যান অফ ওয়ার্মস’ একবার খোলা হয়ে গেছে, তা আর বন্ধ করার উপায় নেই। টেইলরের বিরুদ্ধেও দু’তিনটি ভিন্নগোত্রীয় উপজাতি যুদ্ধ শুরু করে। ১৯৯৭ পর্যন্ত ত্রিমুখী প্রথম যুদ্ধটি চলার পর আবার ১৯৯৯এ শুরু হয় দ্বিতীয় গৃহযুদ্ধ। ২০০৩এ চার্লস টেইলর নাইজেরিয়ায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। তারপর জাতিসংঘের পীসকিপিং মিশনের মাধ্যমে দেশটিতে শান্তি আসে। সেটা এখনো চলছে।

মনরোভিয়া, ২০০৯
চার্লস টেইলর, আইসিসির ট্রিব্যুনালে বিচারকালে, ২০০৯
২০১৮ সাল পর্যন্ত লাইবেরিয়ার রাষ্ট্রপতি ছিলেন নোবেল শান্তিজয়ী এলেন জনসন সারলীফ

চৌদ্দ বছরের গৃহযুদ্ধের শুরুতেই যারা দেশটি ছেড়ে প্রথমে ভাগে, তারা হলো আমেরিকো পরিবারগুলি। দেড়শ বছর ধরে নানাভাবে যে দেশটিকে তারা শাসন করে এসেছে, তার থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে যেখানে আশ্রয় নেয় তারা, সে তাদের ক্রীতদাস পূর্বপুরুষদের মনিবের ভিটা আমেরিকা! ঈস্ট কোস্টের যেসব প্ল্যান্টেশন থেকে তাদের বাপদাদাদের মুক্তি ও লাইবেরিয়া যাত্রা, ভাগ্যচক্রে সেখানেই তারা ফিরে যায় দেড়শ বছর পর।

আর আমেরিকোরা পেছনে ফেলে রেখে যায় অন্ধকারে নিমজ্জমান একটি দেশ। ষোলটি যুধ্যমান উপজাতি, পনের হাজার শিশুসৈন্য, আড়াই থেকে নয় লাখ মৃত, ষাট থেকে নব্বই শতাংশ নারী জনসংখ্যা ধর্ষিত — এসব পরিসংখ্যান দিয়ে ঢাকা পড়ে যায় আমেরিকো ক্রীতদাসবংশধরদের অত্যাচারের কাহিনী, স্বজাতিকে অধিকারবঞ্চিত করার ইতিহাস, আর গণতান্ত্রিক প্রথার আড়ালে-আবডালে ক্ষমতালিপ্সা আর দুর্নীতির খেলা।

তাদের এই অধঃপতনের পেছনে কোন পশ্চিমা সরকার, কোন ঔপনিবেশিক শক্তির তেমন কোন হাত ছিল না। পুরো দেড়শ বছর ধরে মু্ক্ত দাসের বংশধররাই স্বাধীন দেশে নিজেদের পতন ডেকে এনেছে একটু একটু করে।

লাইবেরিয়া – ৪, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি, ১৮৬০-১৯৩০

১৮৬০/৭০এর দশকের মধ্যে লাইবেরিয়ার সমাজ স্পষ্টত কয়েকটি স্তরে বিভক্ত হয়ে যায়। সবার ওপরে পলিটিকাল এলিট — যারা রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রীসভা, সেনেট, সরকারী কর্মকর্তা, গভর্নর, পুলিশপ্রধান প্রভৃতি উচ্চপদে গদ্দিনশীন। এরা নিজেদের মধ্যে বিয়েশাদী করে একটা আলাদা শাসকশ্রেণী তৈরি করে ফেলেছে।

মাঝের স্তরে এদের শাসনক্ষমতাকে খুঁটি দিতে দাঁড়িয়ে যায় ইন্টেলেকচুয়াল ও মার্ক্যান্টাইল এলিট — অনেকে স্থানীয় আফ্রিকান গোত্র থেকে আসা ‘ওয়ার্ড’, যারা পশ্চিমা সংস্কৃতি ও শাসনব্যবস্থাকে হিতকর হিসাবে গ্রহণ করে নেয়। বণিকদের অনেকেই রাজনীতিতে অংশ নিয়ে সফল হয়। আর এদের নিচের লেভেলে থাকে পরে আসা সম্বলহীন রিক্যাপচার্ড স্লেভ আর ক্যারিবিয়ান অভিবাসী। এদের অনেকে গ্রামাঞ্চলে পাড়ি জমায় অধিক সুযোগসুবিধার সন্ধানে।

আর সবার নিচে স্থানীয় গোত্রভিত্তিক উপজাতীয় জনসাধারণ। অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, কৃষিজীবী, শ্রমজীবী, এরা সবাই ওপরওয়ালাদের মেজাজমর্জির অধীন। লাইবেরিয়ার পঁচানব্বই শতাংশ এরাই। এদের বসতি আভ্যন্তরীণ ‘টেরিটোরিগুলোতে’। সরাসরি ভোটাধিকার এদের ছিল না। তাদের হয়ে আমেরিকো সরকারের শাসনব্যবস্থায় প্রতিনিধিত্ব করত রাজা আর গোত্রপতিরা। এ অনেকটা আপার্টহাইড সাউথ আফ্রিকার ‘স্বাধীন’ ব্ল্যাক হোমল্যান্ডের মত ব্যবস্থা।

এমন বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার প্রতিবাদ যে হয়নি তা নয়। ১৮৭০এর দশকে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি রো সংস্কারের প্রচেষ্টা চালান। কিন্তু মতবিরোধ বাঁধে অভিজাত সেনেটরদের সাথে। তার ওপর ইংল্যান্ড থেকে উন্নয়নের নামে কঠিন শর্তে ঋণ নিয়ে লেজেগোবরে অবস্থায় পড়েন রো আর তার দলবল। তার জের ধরে প্রেসিডেনশিয়াল টার্ম লিমিট নিয়ে বিরোধীদের সাথে গোলমাল বেঁধে যায়। গৃহযুদ্ধ বেঁধে যাবার মত অবস্থা দাঁড়ায়, শেষপর্যন্ত সেনেট ভোট নিয়ে রোকে সরিয়ে দেয়। ঘটনাচক্রে তাঁর মৃত্যুও ঘটে। অবসান হয় সংস্কার প্রচেষ্টার। সব ফিরে যায় আগের অবস্থায়।

আমেরিকার উত্তরপশ্চিমে লিউয়িস-ক্লার্ক অভিযানের মত লাইবেরিয়ান অভিযাত্রীদল ১৮৬০এর দশকে দেশের অভ্যন্তরে পাহাড়ী এলাকায় গিয়ে মান্দিঙ্গো গোত্রের কিছু উন্নত শহরের সন্ধান পায়। মধ্যযুগের মুসলিম সংহাই সাম্রাজ্যের এসকল উত্তরসূরীদের সাথে সোনা ও হাতির দাঁতের বাণিজ্য শুরু হয়। লোহার খনিও আবিষ্কৃত হয়। এ অভিযানের মূল উদ্দেশ্য ছিল অবশ্য লাইবেরিয়ার হয়ে আরও ভূমির রাষ্ট্রীয় মালিকানা দাবি করা। কিন্তু এসব অঞ্চল পরবর্তীতে ফরাসী আগ্রাসনের কবলে পড়ে আইভরি কোস্ট আর গিনির অংশ হয়ে যায়। এসময় লাইবেরিয়ার মূল মিত্র ছিল ব্রিটেন।

এসব বাজে অভিজ্ঞতা থেকে দেশের প্রতিরক্ষার জন্যে ১৯১০এর দশকে একটা ফ্রন্টিয়ার ফোর্স তৈরি করা হয়। তাদের প্রশিক্ষণের জন্যে মার্কিন থেকে আসেন কৃষ্ণাঙ্গ এক ক্যাপ্টেন। দাসের সন্তান এই অফিসার অবশ্য লাইবেরিয়ার ঘাপলাগুলি ঠিকই ধরে ফেলেন! যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাবার পর তিনি রিপোর্টে লেখেন যে, লাইবেরিয়ার বৈষম্যমূলক সমাজকে পরিবর্তন করতে হলে বাইরের হস্তক্ষেপ জরুরী।

নতুন তৈরি ফ্রন্টিয়ার ফোর্স শাসকশ্রেণীর স্বার্থোদ্ধারের অস্ত্রে পরিণত হতে বেশি সময় লাগে না। ১৯২৭ সালে অনুষ্ঠিত লাইবেরিয়ার নির্বাচনে যে কারচুপি হয়, তা গিনেস বুকে এখনো রেকর্ডধারী। একদলীয় শাসনের দুর্নীতি, সরকারী ক্ষমতার অপব্যবহার, ইত্যাদি নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। লাইবেরিয়ার নতুন রাষ্ট্রপতি চার্লস কিং নিজের একটা কাল্ট ইমেজ দাঁড়া করান। তিনি লাইবেরিয়ার রাষ্ট্রীয় আদর্শকে কৃষ্ণাঙ্গ জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তি থেকে দূরে সরিয়ে লাইবেরিয়ার রাষ্ট্রভিত্তিক জাতীয়তাবাদে নিয়ে যান। বিদেশী রাষ্ট্রদূতদের নিয়মিত বিলাসবহুল ভোঁজে নিমন্ত্রণ করে আন্তর্জাতিক সম্মাননা জোগাড় করা ছিল তাঁর কাজ। এসবের খরচপাতির টাকা অবশ্য আসত ধার করা পয়সায়।

চার্লস ডি.বি. কিং (১৮৭৫-১৯৬১), লাইবেরিয়ার ১৭তম রাষ্ট্রপতি, ১৯২০-৩০।
লাইবেরিয়ার ডাকটিকেট রাষ্ট্রপতি চার্লস কিংয়ের ছবি, ১৯২৩।

সরকারী আয়ের আরেকটা উৎস ছিল আন্তর্জাতিক আদমপাচার ব্যবসা! পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলে ফার্নান্দো পো দ্বীপটি ছিল স্প্যানিশ কলোনি। ত্রিশের দশকে সেখানে কোকা প্ল্যান্টেশন গড়ে ওঠে। কিন্তু স্প্যানিশরা দ্বীপটির স্বল্প সংখ্যক আদিবাসীদের চেষ্টা করেও সেসব খামারে কাজে লাগাতে পারেনি। তারা শ্রমিক খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে যায় লাইবেরিয়াতে।

লাইবেরিয়ার নিজেরই গতরখাঁটা শ্রমিকের প্রয়োজন ছিল। তাই সরকার নিয়ম করে দেয় যে জনপ্রতি সরকারকে পাঁচ ডলার করে দিলে আর দেড়শ ডলার করে বন্ধক রাখলে ফার্নান্দো পোতে শ্রমিক পাঠানো যাবে। আর তার ওপর থাকবে সরকারী নজরদারি।

পরিবার ও দেহরক্ষীসহ প্রেসিডেন্ট কিং, নেদারল্যান্ডের হেগের পীস প্যালেসের সামনে, ১৯২৭। ঘটনাচক্রে এখানেই আইসিসির কোর্টে ঠিক পঁচাশি বছর পরে লাইবেরিয়ার আরেক রাষ্ট্রপতি চার্লস টেইলরের বিচার হয় যুদ্ধাপরাধের দায়ে।
ফার্নান্দো পোয়ের কোকা খামারে বিদেশী শ্রমিক, সম্ভবত লাইবেরিয়া থেকে আগত, ১৯২০এর দশক।

সে ভাল কথা। কিন্তু ১৯২৯ সালে লাইবেরিয়ার এক প্রাক্তন রাজনীতিবিদ মার্কিনে এসে বিশাল এক গুমোর ফাঁস করে দেন! তিনি অভিযোগ করেন যে লাইবেরিয়ার আমেরিকো সরকার স্থানীয় গোত্রের মানুষদের নিয়ে আধুনিক দাসব্যবসা ফেঁদে বসেছে! তার অভিযোগের ভিত্তিতে লীগ অফ নেশনস তদন্ত কমিটি পাঠায় লাইবেরিয়াতে।

তদন্তের রিপোর্টে যা বেরুল, তাতে লাইবেরিয়ার শত বছরের দাসপ্রথাবিরোধী মানসম্মান সব ধূলোয় লুটিয়ে গেল। কমিটিতে ব্রিটিশ, মার্কিন ও লাইবেরিয়ান তদন্তকারী ছিলেন। তারা বের করেন যে, লাইবেরিয়ার কমপক্ষে তিনটি কাউন্টির গভর্নর ও সরকারী কর্মকর্তা ফ্রন্টিয়ার ফোর্সকে ব্যবহার করেছে স্থানীয় রাজা ও গোত্রপতিদের ওপর অত্যাচার ও জবরদস্তি করে শ্রমিক বাগানোর জন্য। এসব কাজে জড়িত এক প্রাক্তন কর্মকর্তা আবার বর্তমানের ভাইস প্রেসিডেন্ট ইয়ান্সি। শ্রমিক সরবরাহ থেকে সরকারের যে পয়সা পাবার কথা, সেটাও মাঝখান দিয়ে লোপাট করেছে এরা!

কোকা বীন বহন করছে লাইবেরিয়ার দাসশ্রমিক, ১৯২০এর দশক।
ফার্নান্দো পোয়ের ১৯২৯এর ডাকটিকেটে স্পেনের রাজা আলফন্সোর ছবি।

এসব আধুনিক যুগের ‘দাসদের’ তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে, সারি বেঁধে জাহাজে গাদাগাদি করে ওঠানো হয়। ফার্নান্দো পোতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে প্রায় বিনা মজুরীতে, যৎসামান্য খাবারে, দিনে বারো ঘন্টা করে কাজ করতে হত এসব শ্রমিকদের। কথা না শুনলে চাবুকপেটা আর জিঞ্জিরে বন্দী করে রাখত কোকাখামারের ফোরম্যানরা। আরো সব শারীরিক নির্যাতন পোহাতে হত এসকল ‘দাসদের’। ঠিক এমনটাই আমেরিকো-লাইবেরিয়ান এলিটদের পূর্বপুরুষকে ভোগ করতে হয়েছে মার্কিন শ্বেতাঙ্গ মনিবের হাতে!

লীগ অফ নেশনস কড়া কড়া সব শর্ত দেয় লাইবেরিয়ার সরকারকে। লাইবেরিয়ার সাধারণ মধ্যবিত্ত এ খবরে যারপরনাই হতবাক হয়ে যায়। এ কিনা তাদের ‘কৃষ্ণাঙ্গ প্রাক্তন দাসদের’ রিপাবলিক! প্রেসিডেন্ট কিং করেন পদত্যাগ। ফোর্সড লেবারসংক্রান্ত আদেশজারি হয়। কিন্তু এই স্ক্যান্ডালে জড়িত বেশির ভাগের পলিটিকাল কানেকশন থাকায় তারা সাজা ছাড়াই পার পেয়ে যায়। কিং ষাটের দশকে পর্যন্ত রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বপালন করেন।

লীগ অফ নেশন্সের লাইবেরিয়ার দাসপ্রথাসংক্রান্ত রিপোর্টের মুখবন্ধ, ১৯৩০
সেপ্টেম্বর ১৯৩০এ জাতিসংঘের রিপোর্ট বেরুনোর পর, অক্টোবরে রাষ্ট্রপতি কিং আদেশবলে কন্ট্রাক্ট লেবার নিষিদ্ধ করেন। পদত্যাগ করেন ডিসেম্বরে।

কাগজে কলমে লীগ অফ নেশনসের সুপারিশ বাস্তবায়ন করে সে যাত্রা লীগের অধীন ম্যান্ডেট টেরিটরি হওয়া থেকে বেঁচে যায় লাইবেরিয়া। লাইবেরিয়ার সুধীসমাজ ছি ছি করলেও এরা দায়ী শত বছরের এই বৈষম্যমূলক সমাজকে জিইয়ে রাখার জন্যে। একদলীয় শাসনের অবক্ষয় ও দুর্নীতির ঐতিহ্য মূলত তাদেরই চোখ বুঁজে থাকার ফল।

এসব আন্তর্জাতিক স্ক্যান্ডালের মাঝে দূরদেশের দ্বীপে বন্দী স্বামী-বাবা-ভাই-ছেলেকে হারিয়ে শোকাহত, বিপর্যস্ত ওয়েদাবো উপজাতীয় কৃষ্ণাঙ্গিনীরা বাঁধে নিচের মত গান — তারা এ গান গাইতে থাকবে আরো পঞ্চাশ-ষাট বছর, আর শিখিয়ে যাবে পরবর্তী প্রজন্মকে।

“He [Yancy] caught our husbands and brothers,
Sail them to ‘Nana Poo [Fernando Poo]
And there they die!
And there they die!
Tell us,
Yancy, why?
Yancy, why?
Wedabo women have no husbands,
Yancy, why?
Wedabo women have no brothers,
Yancy, why?
Mothers, fathers, sons have died,
Waiting for the return.
Yancy, why?”

লাইবেরিয়া – ৩, স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রগঠন, ১৮৪০-১৮৬০

১৮৪৭ সালে আমেরিকো-লাইবেরিয়ানদের একাধিক উপকূলীয় কলোনি একত্রিত হয়ে সংবিধান প্রনয়ণের মাধ্যমে লাইবেরিয়া প্রজাতন্ত্রের স্বাধীনতা ঘোষণা করে।

এই ঘোষণার পেছনে এসিএস থেকে স্বাধীনতালাভের আদর্শগত অনুপ্রেরণা যতটা না ছিল, তার থেকে বেশি ছিল প্রয়োজন। কারণ, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত রাষ্ট্র না হওয়া পর্যন্ত লাইবেরিয়া তার বন্দর ও সাগরসীমায় বাণিজ্যজাহাজ থেকে শুল্ক আদায়ের চেষ্টা যদি চালায়, আন্তর্জাতিক আইনে তা হবে জলদস্যুতার শামিল!

এভাবে প্রয়োজনের তাগিদে চার রকমের মার্কিনবংশোদ্ভূত কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়ে লাইবেরিয়ার যাত্রা শুরু হয়: যাদের জন্ম মুক্তমানুষ হিসাবে, যারা নিজেদের স্বাধীনতা টাকার বিনিময়ে ফিরে পেয়েছে, যারা লাইবেরিয়াযাত্রার জন্যে মুক্তিপ্রাপ্ত, আর যারা ‘রিক্যাপচারড স্লেভ’ (২য় খন্ড দ্রষ্টব্য)।

১৮৫৭ সালে লাইবেরিয়ার সাথে সংযুক্ত হয় মেরিল্যান্ড রিপাবলিক নামে দক্ষিণের আরেক আমেরিকোঅধ্যুষিত কলোনি। বহির্শক্তির কোন হস্তক্ষেপ আর সাহায্য ছাড়াই একটা প্রশাসনিক কাঠামো দাঁড়া হয়ে যায়। প্রথম রাষ্ট্রপতি রবার্টস দক্ষতার সাথে ইউরোপীয় দেশগুলির সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। রাজনৈতিক জটিলতার কারণে মার্কিনদের স্বীকৃতি আসতে আরো দেরি হয়।

লাইবেরিয়ার প্রথম রাষ্ট্রপতি জে জে রবার্টস, ১৮০৯-১৮৭৬। জন্ম ভার্জিনিয়ার নরফোকে।
লাইবেরিয়ার একটি আমেরিকো প্ল্যান্টেশন। আমেরিকার সাদার্ন স্টাইলে তৈরি। বিশাল খামারের মাঝখানে গেরস্তের বড় বাড়ি। বহু দাস, চাকর, শ্রমিক, এক্সটেন্ডেড ফ্যামিলি, ইত্যাদি।

নিয়মমত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে থাকে, যদিও পার্টি ছিল মোটে একটি, ঠিক যুক্তরাষ্ট্রের শুরুর মত। পরে দ্বিতীয় আরেকটি পার্টিও তৈরি হয়, তাদের নাম ট্রু হুইগ। শত বছরের বেশি সময় লাইবেরিয়ার রাজনীতির ওপর কর্তৃত্ব করে আমেরিকো কৃষ্ণাঙ্গদের এই পার্টি। বড় পদে আসীন ব্যক্তিরা অবশ্য গুটিকয় প্রভাবশালী পরিবারের সদস্য ছিল। এসকল পরিবার ছিল নিজেদের মধ্যে নানারকম আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ। এভাবে একটা শাসকশ্রেণী গড়ে ওঠে। এদের অনেকে ছিল ফ্রিমেসন।

লাইবেরিয়ার শাসনতন্ত্রে উল্লেখিত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বাধিকার আর আইনের শাসনের অঙ্গীকার মার্কিন ধাঁচে হলেও একটা ব্যাপারে বিশাল ফারাক ছিল। মার্কিনদেশের প্রতিষ্ঠাতারা যেখানে সাবধানতার সাথে ধর্মকে রাজনীতি থেকে পৃথক করে রাখেন, সেটা লাইবেরিয়ার রাজ্যপালরা করেননি। দাসত্বজীবনে যীশুখ্রীষ্টের বাণী তাদেরকে আশার আলো দেখিয়েছে। স্বভাবতই খ্রীষ্টান ঈশ্বর আর ধর্মের দয়াশীল চেহারা লাইবেরিয়ার শাসনতন্ত্রের পাতায় পাতায়।

লাইবেরিয়ার মনরোভিয়া গ্র্যান্ড মেসনিক লজ। প্রতিষ্ঠা ১৮৬৭ সালে। লাইবেরিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় পরিণত হয় রেফ্যুজি ক্যাম্পে।

সেই খ্রীষ্টান ঈশ্বরের অনুপ্রেরণা থেকেই আমেরিকোরা স্থানীয় কৃষ্ণাঙ্গ গোত্রগুলিকে সভ্য বানানোর অভিযানে নামে। দুর্গম এলাকায় মিশনারী স্কুল আর চার্চ তৈরি হয়। কোন জায়গায় বৈরিতার মুখোমুখি হয় এরা, আবার কোথাও দুর্বল গোত্রের রাজারা আমেরিকোদের প্রতিরক্ষা আশ্বাসের বিনিময়ে তাদের সন্তানাদিকে স্কুলে-চার্চে পাঠাতে শুরু করে।

শীঘ্রই ব্যাপারটা অন্যদিকে মোড় নিতে শুরু করে। সামন্তযুগের রীতি অনুযায়ী গোত্রপতিরা তাদের একটি সম্তানকে আমেরিকো কোন পরিবারের কাছে ‘বন্ধক’ রাখে, বা দত্তক দেয়। একে বলে ওয়ার্ড সিস্টেম। ভারতীয় উপমহাদেশে, ইউরোপে, ইন ফ্যাক্ট মধ্যযুগের যেকোন সভ্যদেশে এ রীতি প্রচলিত ছিল। পশ্চিম আফ্রিকার সভ্য জাতিগুলিও এর ব্যতিক্রম ছিল না।

এছাড়া গৃহপালিত চাকরের ব্যাপারটাও পশ্চিম আফ্রিকার সমাজে একেবারে বোনা, আমাদের দেশের মত। ধারদেনা শোধের জন্যে নিজ গোত্রের গরীব-গুর্বোদেরও গোত্রপতিরা আমেরিকো পরিবারগুলোর কাছে পাঠাতে শুরু করে। এসকল সারভ্যান্ট আর ওয়ার্ডদেরকে নিজেদের পরিবারের অংশ করে নেয় আমেরিকোরা। কোন ক্ষেত্রে গোত্রপতিরা আমেরিকোদের দাবি অনুযায়ী কোর্ভে লেবার অর্থাৎ বাধ্যতামূলক শ্রমিকের দলও পাঠায়।

এ শ্রমের অবশ্য ভীষণ দরকার ছিল আমেরিকোদের। আমেরিকোদের যে জনসংখ্যা, তাতে খেতখামারে একলা কাজ করে বেশি উৎপাদন সম্ভব নয়। ১৮৬২তে সিভিল ওয়ারের শুরুতে লিংকন লাইবেরিয়াকে স্বীকৃতি দিয়ে দেন। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে মুক্ত কালোদের অভিবাসন একেবারে শূন্যে গিয়ে ঠেকে। যুদ্ধের কারণে তো বটেই, এছাড়া খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই তখন কালোদের স্বাধিকারের রাস্তা তৈরি হচ্ছে। মার্কিন অভিবাসীদের অভাব পূরণ করে স্থানীয় কালো শ্রমিক আর ক্যারিবিয়ান থেকে আসা নতুন অভিবাসীরা।

কফি, তামাক, ধান, চিনি, তুলো, পামওয়েল ইত্যাদির প্ল্যান্টেশন গড়ে ওঠে আমেরিকান সাউথের ধাঁচে। পাম ওয়েল প্রেসের যন্ত্রও আবিষ্কার করেন লাইবেরিয়ার এক উদ্ভাবক। এসব কাঁচামাল ও শস্য রপ্তানির পাশাপাশি জাহাজশিল্প গড়ে ওঠে। এখনো ছোটদেশ লাইবেরিয়া সারা বিশ্বে জাহাজের ফ্ল্যাগ অফ কনভেনিয়েন্স ও রেজিস্ট্রেশনে অগ্রগণ্য একটি নাম।

লাইবেরিয়ার পতাকা এখনো সারা বিশ্বে জাহাজের ফ্ল্যাগ অফ কনভেনিয়েন্স হিসাবে সুপরিচিত।

এসব উন্নয়নের বিপরীতে স্থানীয় কালোরা আমেরিকোদেরই ক্রীতদাসে পরিণত হতে শুরু করে! দু’একটা অপ্রীতিকর ঘটনার পর সরকার আইন করে সেসব বন্ধ করার চেষ্টা করে। আইনানুযায়ী ঘরে ও খামারে কাজ করা কালোদের জামাকাপড় আর শিক্ষার ব্যাপারটা আমেরিকো গেরস্তকে দেখভাল করতে হবে। নাহলে বড় জরিমানা। আদতে যেটা দাঁড়াল, তা হলো আমাদের দেশের চাকরদের মত সামান্য খাদ্যবস্ত্র আর ধর্মশিক্ষা দিয়ে সোশাল সেগ্রেগেশন।

লাইবেরিয়া পরিদর্শনে আসা মার্কিন দূত যারা অ্যাবোলিশনিস্ট মুভমেন্টের সাথে জড়িত ছিলেন, তারা তাদের রিপোর্টে লাইবেরিয়ার এ শ্রমব্যবস্থাকে সরাসরি ‘স্লেভারি’ হিসাবে বর্ণনা করেন। আমেরিকোরা তাচ্ছিল্য করে স্থানীয় কালোদের ডাকত ‘বয়’ বলে, ঠিক যেমনটা সাদার্ন স্টেটগুলিতে তাদেরকে ডাকত শ্বেতাঙ্গরা! আর দেশের অভ্যন্তরের গোত্রগুলোর নাম তারা দেয় ‘অ্যাবোরিজিনি’! অ্যাবোরিজিনিদের যারা তাদের খামারে থাকত, তাদের প্রত্যেককে মাতৃভাষার নাম ছেড়ে গ্রহণ করতে হত পালক পরিবারের নাম। এটিও ঠিক মার্কিন দেশে গোলাম-মনিবের সম্পর্কের মত!

লাইবেরিয়ার গেরস্ত পরিবারের সাথে তাদের ‘ওয়ার্ড’ বা গৃহপালিত দাস, ঊনবিংশ শতকের শেষভাগ। দাসেদের বস্ত্র তুলনামূলক কম, কিন্তু মনিবরা ঠিকই ক্রান্তীয় এলাকার গরমের মধ্যেও মার্কিন ঘরানায় আচ্ছাদিত।

সব মিলিয়ে নতুন দেশ লাইবেরিয়া মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গদের মুক্তির স্বপ্নপূরণ করলেও এর মূল্য দিতে হয় তাদেরই স্বগোত্রীয়দের — হয় তাদের দাসের মত নিজেকে বিকিয়ে দিতে হয় নয়ত স্বকীয় পরিচয় পরিত্যাগ করে হতে হয় সভ্য ‘আমেরিকো’।

লাইবেরিয়া – ২, কলোনাইজেশন, ১৮২০-১৮৪০

আফ্রিকায় দ্বিতীয় জাহাজ পাঠানোর আগেই পল কাফির মৃত্যু হয় ১৮১৭ সালে। তার পর কৃষ্ণাঙ্গ অভিবাসনের কল্যাণ প্রকল্প শুরু করে ১৮১৬তে স্থাপিত আমেরিকান কলোনাইজেশন সোসাইটি (এসিএস) নামে দাতব্য সংস্থাটি। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এক শ্বেতাঙ্গ এজেন্ট ও কিছু কৃষ্ণাঙ্গ বণিক পশ্চিম আফ্রিকা ঘুরে সিয়েরা লিওনের দক্ষিণে, বর্তমান মনরোভিয়ার কাছে একটি স্থান ঠিক করে আসে বসতিস্থাপনের জন্যে।

পেপার কোস্ট (‘মরিচ উপকূল’!) নামে এ এলাকাটি অবশ্য জনশূন্য ছিল না! সেখানে বসবাস করত মান্দে, গ্রেবো, ক্রু প্রভৃতি বিভিন্ন গোত্রীয় আফ্রিকান মানুষ। এসব ‘অসভ্য’ গোত্রের এক রাজার সাথে ক্রয়শর্তেই এসিএসের অভিযাত্রীরা ভবিষ্যত বসতির স্থান ঠিক করে। মার্কিনদের আগে স্প্যানিশ-পর্তুগীজ-ব্রিটিশ-ডাচ বণিকদের সাথেও এসকল গোত্রের মোলাকাত ও ব্যবসাবাণিজ্য চলেছে।

প্রথম ইংলিশ পিলগ্রিম অভিবাসীদের মেফ্লাওয়ার জাহাজে চড়ে আমেরিকাযাত্রার ঠিক দু’শ বছর পর, মার্কিন কালো ‘পিলগ্রিমদের’ একটা দল নিউইয়র্ক থেকে এলিজাবেথ জাহাজে করে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে লাইবেরিয়ার উপকূলে অবতরণ করে। সেটা ১৮২০ সাল।

এলিজাবেথ নামে এই জাহাজের ডাকনাম ‘ব্ল্যাক মেফ্লাওয়ার’। ১৮২০ সালে এতে করেই প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন কলোনিস্টরা লাইবেরিয়ায় এসে পৌঁছায়।

দুর্ভাগ্যবশত তাদের ঠিক করা এলাকাটি সভ্য মানুষের বসবাসোপযোগী ছিল না। ক্রান্তীয় এলাকার জলাজঙ্গলের অসুখবিসুখে নবাগতরা আক্রান্ত হয়, ঠিক ইংলিশ পিলগ্রিমদের মত। তাছাড়া সাথে নিয়ে আসা খাবারদাবারও দ্রুত ফুরিয়ে যেতে শুরু করে। এভাবে মৃত্যুমুখে পতিত হয় প্রথম আসা দলগুলির একতৃতীয়াংশ থেকে একচতুর্থাংশ।

অসুস্থতার কারণে আর আবাদযোগ্য জমির অভাবে এসকল অভিবাসী পরিবারগুলি এসিএসের দ্বারস্থ হয়। এসিএস তাদের সীমিত শক্তির মধ্যে যৎসামান্য সাহায্য করে। অনেকেই প্রাক্তন মনিব পরিবারদের কাছে খাদ্য আর ডাক্তারী সাহায্য চেয়ে চিঠি লেখে। অবস্থাপন্নরা সাহায্য পেয়ে বেঁচেবর্তে যায়।

স্থানীয় কালোদের সাথে রফা করে নতুন জমিজমা কেনার চেষ্টা করে মনরোভিয়ার কলোনি। সবসময় সেটা সাফল্যের মুখ দেখেনি। কোন ক্ষেত্রে জোরজবরদস্তি কিংবা ঠকবাজির আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় তারা। হ্যাঁ, জীবন বাঁচানোর তাগিদে তুতো ভাইদের বোকা বানাতে কসুর করেনি এসব মুক্তিপ্রাপ্ত দাসের বংশধররা!

মনরোভিয়ার কাছে ভার্জিনিয়া থেকে আগত কৃষ্ণাঙ্গদের সেটলমেন্ট, ১৮২০এর দশক।

গোলমাল বাঁধা শুরু করলে স্থানীয় রাজাদের নিয়ে সম্মেলন করে সেটলারদের পক্ষে রায় দেয় সে অঞ্চলের নেতৃস্থানীয় মান্দে গোত্রের অধিকর্তা। সেটা নেটিভরা মেনে নিলেও ভেতরে ভেতরে তারা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়। অর্থাৎ আমেরিকার কলোনাইজেশনের মধ্যভাগে সেই ইংলিশ পিলগ্রিমদের সাথে নেটিভদের সংঘাতের সমান্তরাল ইতিহাসের শুরু হলো।

এসকল জটিলতার সাথে যুক্ত হয় আরো বড় একটা সমস্যা। স্থানীয় আফ্রিকানরা বংশপরম্পরায় দাসবাণিজ্যে সরাসরি জড়িত! অন্তর্ঘাতী সংঘর্ষ থেকে বন্দী করা ভিন্নগোত্রীয় মানুষকে তারা স্বগৃহে দাস করে তো রাখতই, উপকূলীয় অঞ্চলে ইউরোপীয়-মার্কিন দাসব্যবসায়ীদের জাহাজেও সাপ্লাই দিত! ১৮২০/৩০এর দশকে ব্রিটিশ নৌবাহিনী পুরো পশ্চিম আফ্রিকা উপকূলে দাসবাণিজ্য বন্ধের জন্যে ঘেরাও দিলেও, তার ফাঁকফোঁকর গলে চোরাকারবারী বেআইনী দাসবাণিজ্য চলত। দাস সাপ্লাইয়ের বিনিময়ে লাইবেরিয়ার গোত্রগুলো পেত ইউরোপীয় অস্ত্র, নানাপ্রকার বিলাসদ্রব্য, ছাতা, চশমা, রঙবেরঙের সেমিপ্রেশাস রত্ন, ইত্যাদি।

নবাগত সেটলাররা যখন জানতে পারলো স্থানীয়দের এই শয়তানি কর্মকান্ডের কথা, তখন থেকে তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় সেসব জোর করে বন্ধ করতে। যুদ্ধ ছাড়া আর কোন গত্যন্তর ছিল না।

লাইবেরিয়ার আদিবাসী গ্রেবো জনগোষ্ঠীর সেরেমনিয়াল মুখোশ।
১৮০৯এ ব্রিটিশ নৌবাহিনীর জাহাজ ব্রিস্ক দাসবাহী স্প্যানিশ জাহাজ এমানুয়েলাকে চ্যালেঞ্জ করছে।

সে যুদ্ধ যখন বাঁধল, হাজারে হাজারে স্থানীয় কৃষ্ণাঙ্গ ঘিরে ধরল মনরোভিয়ার শ’খানেক সেটলারকে, তখন একটিমাত্র কামানের গোলায় তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় মনরোভিয়াবাসী। বন্দুক স্থানীয়দেরও ছিল, কিন্তু সেটলারদের মত দ্রুত গোলাবর্ষণের প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ তাদের ছিল না।

এরকম অসম কয়েকটি যুদ্ধের পর হাল ছেড়ে উপকূলীয় অঞ্চল ছেড়ে দেয় আদিবাসীরা। সেটলাররা আবাদযোগ্য জমিজমা কিনে নেয় নামমাত্র মূল্যে। চাষাবাদের পাশাপাশি স্থানীয়দের সাথে ইউরোপীয়দের বাণিজ্যের মধ্যসত্ত্বভোগী হিসাবে জাঁকিয়ে বসে সেটলার পরিবারগুলো।

এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি মার্কিন থেকে আসা ‘আমেরিকোদের’। নিউইয়র্ক, মিসিসিপি, পেনসিলভানিয়া, লুইসিয়ানা, মেরিল্যান্ড, ভার্জিনিয়া, কেন্টাকি ইত্যাদি স্টেটগুলিতে এসিএসের মত কলোনাইজেশন সমিতি গড়ে ওঠে। বর্তমান লাইবেরিয়ার বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকায় গড়ে ওঠে তাদেরও বসতি।

ঊনবিংশ শতকের লাইবেরিয়াতে উপকূলীয় অঞ্চলে ‘আমেরিকোরা’ বসতি গেড়েছিল। অভ্যন্তরে ছিল আদিবাসী বহু গোষ্ঠীর বসবাস।

মার্কিন ফেডারেল সরকার এসব কলোনিকে সরাসরি সাহায্য দেয়া থেকে বিরত থাকে, কারণ সাম্রাজ্যবাদী অভিলাষের বিন্দুমাত্র চিহ্ন দেখানোটাও তার নৈতিকতার পরিপন্থী। কংগ্রেস শুধুমাত্র ‘রিক্যাপচার্ড স্লেভদের’ পুনর্বাসনের জন্যে খোরপোশ দিতে রাজি হয়। এরা হলো মার্কিন নেভি কর্তৃক চোরাকারবারী জাহাজ থেকে জব্দকরা দাসের দল, যারা মোটে দাসত্বশৃংখলে আবদ্ধ হয়েছে, ইংরেজী ভাষা-সভ্যতা জানা নাই। এদেরও নিবাস হয় বর্তমান লাইবেরিয়া।

শীঘ্রই লাইবেরিয়ার মুক্ত কালোরা নতুন দেশে তাদের অবস্থান পাকাপোক্ত করে নেয়। এসিএসের সাদা এজেন্টদের উপস্থিতি শিক্ষিত কালোদের মনঃপূত না হওয়ায় তারা নিজেদের মধ্য থেকে গভর্নর নিযুক্ত করার দাবি জানায়। এসিএস ক্রমে তাদের এসকল দাবি মেনে নেয়। কলোনিটি পরিণত হয় ‘কমনওয়েল্থে’, লিখিত হয় মার্কিন আদলের শাসনতন্ত্র। কর্মঠ কালোরা কৃষিকাজ ও বাণিজ্যের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে, রাজনৈতিক পরিচয় ও অবস্থানও মজবুত হয় তাদের।

ঊনবিংশ শতকের বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য লাইবেরিয়ান আমেরিকো ব্যক্তিত্বের স্থিরচিত্র।
১৮২২এর আদিবাসীদের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষাযুদ্ধে একটি কামানের বদৌলতে বেঁচে যায় কালো সেটলাররা। সে কামান দেঁগেছিল নাকি মাটিল্ডা নিউপোর্ট বলে এক কৃষ্ণাঙ্গিনী। এই লেজেন্ডের সেলেব্রেশন ষাট-সত্তরের দশক পর্যন্ত চালু ছিল লাইবেরিয়া দেশটিতে।

বলা বাহুল্য, এসকল স্বাধিকার ও উন্নয়নের মুখ দেখে কেবল উপকূলের কলোনিগুলির ‘আমেরিকো’ গোষ্ঠী, যাদের সংখ্যা হাজারখানেকের বেশি ছিল না। তাদের স্বদেশী আদিবাসী ভাইদের সংখ্যা ছিল দশ লাখের ওপর। এদের শাসনতান্ত্রিক কোন অধিকার ছিল না, কারণ তারা কলোনির সদস্য নয়।

দূর থেকে এই স্বজাতি আমেরিকোদের ডাকতে শুরু করে ‘কালো শ্বেতাঙ্গ’!

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!