১৮৬০/৭০এর দশকের মধ্যে লাইবেরিয়ার সমাজ স্পষ্টত কয়েকটি স্তরে বিভক্ত হয়ে যায়। সবার ওপরে পলিটিকাল এলিট — যারা রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রীসভা, সেনেট, সরকারী কর্মকর্তা, গভর্নর, পুলিশপ্রধান প্রভৃতি উচ্চপদে গদ্দিনশীন। এরা নিজেদের মধ্যে বিয়েশাদী করে একটা আলাদা শাসকশ্রেণী তৈরি করে ফেলেছে।
মাঝের স্তরে এদের শাসনক্ষমতাকে খুঁটি দিতে দাঁড়িয়ে যায় ইন্টেলেকচুয়াল ও মার্ক্যান্টাইল এলিট — অনেকে স্থানীয় আফ্রিকান গোত্র থেকে আসা ‘ওয়ার্ড’, যারা পশ্চিমা সংস্কৃতি ও শাসনব্যবস্থাকে হিতকর হিসাবে গ্রহণ করে নেয়। বণিকদের অনেকেই রাজনীতিতে অংশ নিয়ে সফল হয়। আর এদের নিচের লেভেলে থাকে পরে আসা সম্বলহীন রিক্যাপচার্ড স্লেভ আর ক্যারিবিয়ান অভিবাসী। এদের অনেকে গ্রামাঞ্চলে পাড়ি জমায় অধিক সুযোগসুবিধার সন্ধানে।
আর সবার নিচে স্থানীয় গোত্রভিত্তিক উপজাতীয় জনসাধারণ। অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, কৃষিজীবী, শ্রমজীবী, এরা সবাই ওপরওয়ালাদের মেজাজমর্জির অধীন। লাইবেরিয়ার পঁচানব্বই শতাংশ এরাই। এদের বসতি আভ্যন্তরীণ ‘টেরিটোরিগুলোতে’। সরাসরি ভোটাধিকার এদের ছিল না। তাদের হয়ে আমেরিকো সরকারের শাসনব্যবস্থায় প্রতিনিধিত্ব করত রাজা আর গোত্রপতিরা। এ অনেকটা আপার্টহাইড সাউথ আফ্রিকার ‘স্বাধীন’ ব্ল্যাক হোমল্যান্ডের মত ব্যবস্থা।
এমন বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার প্রতিবাদ যে হয়নি তা নয়। ১৮৭০এর দশকে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি রো সংস্কারের প্রচেষ্টা চালান। কিন্তু মতবিরোধ বাঁধে অভিজাত সেনেটরদের সাথে। তার ওপর ইংল্যান্ড থেকে উন্নয়নের নামে কঠিন শর্তে ঋণ নিয়ে লেজেগোবরে অবস্থায় পড়েন রো আর তার দলবল। তার জের ধরে প্রেসিডেনশিয়াল টার্ম লিমিট নিয়ে বিরোধীদের সাথে গোলমাল বেঁধে যায়। গৃহযুদ্ধ বেঁধে যাবার মত অবস্থা দাঁড়ায়, শেষপর্যন্ত সেনেট ভোট নিয়ে রোকে সরিয়ে দেয়। ঘটনাচক্রে তাঁর মৃত্যুও ঘটে। অবসান হয় সংস্কার প্রচেষ্টার। সব ফিরে যায় আগের অবস্থায়।
আমেরিকার উত্তরপশ্চিমে লিউয়িস-ক্লার্ক অভিযানের মত লাইবেরিয়ান অভিযাত্রীদল ১৮৬০এর দশকে দেশের অভ্যন্তরে পাহাড়ী এলাকায় গিয়ে মান্দিঙ্গো গোত্রের কিছু উন্নত শহরের সন্ধান পায়। মধ্যযুগের মুসলিম সংহাই সাম্রাজ্যের এসকল উত্তরসূরীদের সাথে সোনা ও হাতির দাঁতের বাণিজ্য শুরু হয়। লোহার খনিও আবিষ্কৃত হয়। এ অভিযানের মূল উদ্দেশ্য ছিল অবশ্য লাইবেরিয়ার হয়ে আরও ভূমির রাষ্ট্রীয় মালিকানা দাবি করা। কিন্তু এসব অঞ্চল পরবর্তীতে ফরাসী আগ্রাসনের কবলে পড়ে আইভরি কোস্ট আর গিনির অংশ হয়ে যায়। এসময় লাইবেরিয়ার মূল মিত্র ছিল ব্রিটেন।
এসব বাজে অভিজ্ঞতা থেকে দেশের প্রতিরক্ষার জন্যে ১৯১০এর দশকে একটা ফ্রন্টিয়ার ফোর্স তৈরি করা হয়। তাদের প্রশিক্ষণের জন্যে মার্কিন থেকে আসেন কৃষ্ণাঙ্গ এক ক্যাপ্টেন। দাসের সন্তান এই অফিসার অবশ্য লাইবেরিয়ার ঘাপলাগুলি ঠিকই ধরে ফেলেন! যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাবার পর তিনি রিপোর্টে লেখেন যে, লাইবেরিয়ার বৈষম্যমূলক সমাজকে পরিবর্তন করতে হলে বাইরের হস্তক্ষেপ জরুরী।
নতুন তৈরি ফ্রন্টিয়ার ফোর্স শাসকশ্রেণীর স্বার্থোদ্ধারের অস্ত্রে পরিণত হতে বেশি সময় লাগে না। ১৯২৭ সালে অনুষ্ঠিত লাইবেরিয়ার নির্বাচনে যে কারচুপি হয়, তা গিনেস বুকে এখনো রেকর্ডধারী। একদলীয় শাসনের দুর্নীতি, সরকারী ক্ষমতার অপব্যবহার, ইত্যাদি নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। লাইবেরিয়ার নতুন রাষ্ট্রপতি চার্লস কিং নিজের একটা কাল্ট ইমেজ দাঁড়া করান। তিনি লাইবেরিয়ার রাষ্ট্রীয় আদর্শকে কৃষ্ণাঙ্গ জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তি থেকে দূরে সরিয়ে লাইবেরিয়ার রাষ্ট্রভিত্তিক জাতীয়তাবাদে নিয়ে যান। বিদেশী রাষ্ট্রদূতদের নিয়মিত বিলাসবহুল ভোঁজে নিমন্ত্রণ করে আন্তর্জাতিক সম্মাননা জোগাড় করা ছিল তাঁর কাজ। এসবের খরচপাতির টাকা অবশ্য আসত ধার করা পয়সায়।
সরকারী আয়ের আরেকটা উৎস ছিল আন্তর্জাতিক আদমপাচার ব্যবসা! পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলে ফার্নান্দো পো দ্বীপটি ছিল স্প্যানিশ কলোনি। ত্রিশের দশকে সেখানে কোকা প্ল্যান্টেশন গড়ে ওঠে। কিন্তু স্প্যানিশরা দ্বীপটির স্বল্প সংখ্যক আদিবাসীদের চেষ্টা করেও সেসব খামারে কাজে লাগাতে পারেনি। তারা শ্রমিক খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে যায় লাইবেরিয়াতে।
লাইবেরিয়ার নিজেরই গতরখাঁটা শ্রমিকের প্রয়োজন ছিল। তাই সরকার নিয়ম করে দেয় যে জনপ্রতি সরকারকে পাঁচ ডলার করে দিলে আর দেড়শ ডলার করে বন্ধক রাখলে ফার্নান্দো পোতে শ্রমিক পাঠানো যাবে। আর তার ওপর থাকবে সরকারী নজরদারি।
পরিবার ও দেহরক্ষীসহ প্রেসিডেন্ট কিং, নেদারল্যান্ডের হেগের পীস প্যালেসের সামনে, ১৯২৭। ঘটনাচক্রে এখানেই আইসিসির কোর্টে ঠিক পঁচাশি বছর পরে লাইবেরিয়ার আরেক রাষ্ট্রপতি চার্লস টেইলরের বিচার হয় যুদ্ধাপরাধের দায়ে।ফার্নান্দো পোয়ের কোকা খামারে বিদেশী শ্রমিক, সম্ভবত লাইবেরিয়া থেকে আগত, ১৯২০এর দশক।
সে ভাল কথা। কিন্তু ১৯২৯ সালে লাইবেরিয়ার এক প্রাক্তন রাজনীতিবিদ মার্কিনে এসে বিশাল এক গুমোর ফাঁস করে দেন! তিনি অভিযোগ করেন যে লাইবেরিয়ার আমেরিকো সরকার স্থানীয় গোত্রের মানুষদের নিয়ে আধুনিক দাসব্যবসা ফেঁদে বসেছে! তার অভিযোগের ভিত্তিতে লীগ অফ নেশনস তদন্ত কমিটি পাঠায় লাইবেরিয়াতে।
তদন্তের রিপোর্টে যা বেরুল, তাতে লাইবেরিয়ার শত বছরের দাসপ্রথাবিরোধী মানসম্মান সব ধূলোয় লুটিয়ে গেল। কমিটিতে ব্রিটিশ, মার্কিন ও লাইবেরিয়ান তদন্তকারী ছিলেন। তারা বের করেন যে, লাইবেরিয়ার কমপক্ষে তিনটি কাউন্টির গভর্নর ও সরকারী কর্মকর্তা ফ্রন্টিয়ার ফোর্সকে ব্যবহার করেছে স্থানীয় রাজা ও গোত্রপতিদের ওপর অত্যাচার ও জবরদস্তি করে শ্রমিক বাগানোর জন্য। এসব কাজে জড়িত এক প্রাক্তন কর্মকর্তা আবার বর্তমানের ভাইস প্রেসিডেন্ট ইয়ান্সি। শ্রমিক সরবরাহ থেকে সরকারের যে পয়সা পাবার কথা, সেটাও মাঝখান দিয়ে লোপাট করেছে এরা!
এসব আধুনিক যুগের ‘দাসদের’ তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে, সারি বেঁধে জাহাজে গাদাগাদি করে ওঠানো হয়। ফার্নান্দো পোতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে প্রায় বিনা মজুরীতে, যৎসামান্য খাবারে, দিনে বারো ঘন্টা করে কাজ করতে হত এসব শ্রমিকদের। কথা না শুনলে চাবুকপেটা আর জিঞ্জিরে বন্দী করে রাখত কোকাখামারের ফোরম্যানরা। আরো সব শারীরিক নির্যাতন পোহাতে হত এসকল ‘দাসদের’। ঠিক এমনটাই আমেরিকো-লাইবেরিয়ান এলিটদের পূর্বপুরুষকে ভোগ করতে হয়েছে মার্কিন শ্বেতাঙ্গ মনিবের হাতে!
লীগ অফ নেশনস কড়া কড়া সব শর্ত দেয় লাইবেরিয়ার সরকারকে। লাইবেরিয়ার সাধারণ মধ্যবিত্ত এ খবরে যারপরনাই হতবাক হয়ে যায়। এ কিনা তাদের ‘কৃষ্ণাঙ্গ প্রাক্তন দাসদের’ রিপাবলিক! প্রেসিডেন্ট কিং করেন পদত্যাগ। ফোর্সড লেবারসংক্রান্ত আদেশজারি হয়। কিন্তু এই স্ক্যান্ডালে জড়িত বেশির ভাগের পলিটিকাল কানেকশন থাকায় তারা সাজা ছাড়াই পার পেয়ে যায়। কিং ষাটের দশকে পর্যন্ত রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বপালন করেন।
লীগ অফ নেশন্সের লাইবেরিয়ার দাসপ্রথাসংক্রান্ত রিপোর্টের মুখবন্ধ, ১৯৩০সেপ্টেম্বর ১৯৩০এ জাতিসংঘের রিপোর্ট বেরুনোর পর, অক্টোবরে রাষ্ট্রপতি কিং আদেশবলে কন্ট্রাক্ট লেবার নিষিদ্ধ করেন। পদত্যাগ করেন ডিসেম্বরে।
কাগজে কলমে লীগ অফ নেশনসের সুপারিশ বাস্তবায়ন করে সে যাত্রা লীগের অধীন ম্যান্ডেট টেরিটরি হওয়া থেকে বেঁচে যায় লাইবেরিয়া। লাইবেরিয়ার সুধীসমাজ ছি ছি করলেও এরা দায়ী শত বছরের এই বৈষম্যমূলক সমাজকে জিইয়ে রাখার জন্যে। একদলীয় শাসনের অবক্ষয় ও দুর্নীতির ঐতিহ্য মূলত তাদেরই চোখ বুঁজে থাকার ফল।
এসব আন্তর্জাতিক স্ক্যান্ডালের মাঝে দূরদেশের দ্বীপে বন্দী স্বামী-বাবা-ভাই-ছেলেকে হারিয়ে শোকাহত, বিপর্যস্ত ওয়েদাবো উপজাতীয় কৃষ্ণাঙ্গিনীরা বাঁধে নিচের মত গান — তারা এ গান গাইতে থাকবে আরো পঞ্চাশ-ষাট বছর, আর শিখিয়ে যাবে পরবর্তী প্রজন্মকে।
“He [Yancy] caught our husbands and brothers,
Sail them to ‘Nana Poo [Fernando Poo]
And there they die!
And there they die!
Tell us,
Yancy, why?
Yancy, why?
Wedabo women have no husbands,
Yancy, why?
Wedabo women have no brothers,
Yancy, why?
Mothers, fathers, sons have died,
Waiting for the return.
Yancy, why?”
১৮৪৭ সালে আমেরিকো-লাইবেরিয়ানদের একাধিক উপকূলীয় কলোনি একত্রিত হয়ে সংবিধান প্রনয়ণের মাধ্যমে লাইবেরিয়া প্রজাতন্ত্রের স্বাধীনতা ঘোষণা করে।
এই ঘোষণার পেছনে এসিএস থেকে স্বাধীনতালাভের আদর্শগত অনুপ্রেরণা যতটা না ছিল, তার থেকে বেশি ছিল প্রয়োজন। কারণ, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত রাষ্ট্র না হওয়া পর্যন্ত লাইবেরিয়া তার বন্দর ও সাগরসীমায় বাণিজ্যজাহাজ থেকে শুল্ক আদায়ের চেষ্টা যদি চালায়, আন্তর্জাতিক আইনে তা হবে জলদস্যুতার শামিল!
এভাবে প্রয়োজনের তাগিদে চার রকমের মার্কিনবংশোদ্ভূত কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়ে লাইবেরিয়ার যাত্রা শুরু হয়: যাদের জন্ম মুক্তমানুষ হিসাবে, যারা নিজেদের স্বাধীনতা টাকার বিনিময়ে ফিরে পেয়েছে, যারা লাইবেরিয়াযাত্রার জন্যে মুক্তিপ্রাপ্ত, আর যারা ‘রিক্যাপচারড স্লেভ’ (২য় খন্ড দ্রষ্টব্য)।
১৮৫৭ সালে লাইবেরিয়ার সাথে সংযুক্ত হয় মেরিল্যান্ড রিপাবলিক নামে দক্ষিণের আরেক আমেরিকোঅধ্যুষিত কলোনি। বহির্শক্তির কোন হস্তক্ষেপ আর সাহায্য ছাড়াই একটা প্রশাসনিক কাঠামো দাঁড়া হয়ে যায়। প্রথম রাষ্ট্রপতি রবার্টস দক্ষতার সাথে ইউরোপীয় দেশগুলির সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। রাজনৈতিক জটিলতার কারণে মার্কিনদের স্বীকৃতি আসতে আরো দেরি হয়।
লাইবেরিয়ার প্রথম রাষ্ট্রপতি জে জে রবার্টস, ১৮০৯-১৮৭৬। জন্ম ভার্জিনিয়ার নরফোকে।লাইবেরিয়ার একটি আমেরিকো প্ল্যান্টেশন। আমেরিকার সাদার্ন স্টাইলে তৈরি। বিশাল খামারের মাঝখানে গেরস্তের বড় বাড়ি। বহু দাস, চাকর, শ্রমিক, এক্সটেন্ডেড ফ্যামিলি, ইত্যাদি।
নিয়মমত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে থাকে, যদিও পার্টি ছিল মোটে একটি, ঠিক যুক্তরাষ্ট্রের শুরুর মত। পরে দ্বিতীয় আরেকটি পার্টিও তৈরি হয়, তাদের নাম ট্রু হুইগ। শত বছরের বেশি সময় লাইবেরিয়ার রাজনীতির ওপর কর্তৃত্ব করে আমেরিকো কৃষ্ণাঙ্গদের এই পার্টি। বড় পদে আসীন ব্যক্তিরা অবশ্য গুটিকয় প্রভাবশালী পরিবারের সদস্য ছিল। এসকল পরিবার ছিল নিজেদের মধ্যে নানারকম আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ। এভাবে একটা শাসকশ্রেণী গড়ে ওঠে। এদের অনেকে ছিল ফ্রিমেসন।
লাইবেরিয়ার শাসনতন্ত্রে উল্লেখিত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বাধিকার আর আইনের শাসনের অঙ্গীকার মার্কিন ধাঁচে হলেও একটা ব্যাপারে বিশাল ফারাক ছিল। মার্কিনদেশের প্রতিষ্ঠাতারা যেখানে সাবধানতার সাথে ধর্মকে রাজনীতি থেকে পৃথক করে রাখেন, সেটা লাইবেরিয়ার রাজ্যপালরা করেননি। দাসত্বজীবনে যীশুখ্রীষ্টের বাণী তাদেরকে আশার আলো দেখিয়েছে। স্বভাবতই খ্রীষ্টান ঈশ্বর আর ধর্মের দয়াশীল চেহারা লাইবেরিয়ার শাসনতন্ত্রের পাতায় পাতায়।
লাইবেরিয়ার মনরোভিয়া গ্র্যান্ড মেসনিক লজ। প্রতিষ্ঠা ১৮৬৭ সালে। লাইবেরিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় পরিণত হয় রেফ্যুজি ক্যাম্পে।
সেই খ্রীষ্টান ঈশ্বরের অনুপ্রেরণা থেকেই আমেরিকোরা স্থানীয় কৃষ্ণাঙ্গ গোত্রগুলিকে সভ্য বানানোর অভিযানে নামে। দুর্গম এলাকায় মিশনারী স্কুল আর চার্চ তৈরি হয়। কোন জায়গায় বৈরিতার মুখোমুখি হয় এরা, আবার কোথাও দুর্বল গোত্রের রাজারা আমেরিকোদের প্রতিরক্ষা আশ্বাসের বিনিময়ে তাদের সন্তানাদিকে স্কুলে-চার্চে পাঠাতে শুরু করে।
শীঘ্রই ব্যাপারটা অন্যদিকে মোড় নিতে শুরু করে। সামন্তযুগের রীতি অনুযায়ী গোত্রপতিরা তাদের একটি সম্তানকে আমেরিকো কোন পরিবারের কাছে ‘বন্ধক’ রাখে, বা দত্তক দেয়। একে বলে ওয়ার্ড সিস্টেম। ভারতীয় উপমহাদেশে, ইউরোপে, ইন ফ্যাক্ট মধ্যযুগের যেকোন সভ্যদেশে এ রীতি প্রচলিত ছিল। পশ্চিম আফ্রিকার সভ্য জাতিগুলিও এর ব্যতিক্রম ছিল না।
এছাড়া গৃহপালিত চাকরের ব্যাপারটাও পশ্চিম আফ্রিকার সমাজে একেবারে বোনা, আমাদের দেশের মত। ধারদেনা শোধের জন্যে নিজ গোত্রের গরীব-গুর্বোদেরও গোত্রপতিরা আমেরিকো পরিবারগুলোর কাছে পাঠাতে শুরু করে। এসকল সারভ্যান্ট আর ওয়ার্ডদেরকে নিজেদের পরিবারের অংশ করে নেয় আমেরিকোরা। কোন ক্ষেত্রে গোত্রপতিরা আমেরিকোদের দাবি অনুযায়ী কোর্ভে লেবার অর্থাৎ বাধ্যতামূলক শ্রমিকের দলও পাঠায়।
এ শ্রমের অবশ্য ভীষণ দরকার ছিল আমেরিকোদের। আমেরিকোদের যে জনসংখ্যা, তাতে খেতখামারে একলা কাজ করে বেশি উৎপাদন সম্ভব নয়। ১৮৬২তে সিভিল ওয়ারের শুরুতে লিংকন লাইবেরিয়াকে স্বীকৃতি দিয়ে দেন। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে মুক্ত কালোদের অভিবাসন একেবারে শূন্যে গিয়ে ঠেকে। যুদ্ধের কারণে তো বটেই, এছাড়া খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই তখন কালোদের স্বাধিকারের রাস্তা তৈরি হচ্ছে। মার্কিন অভিবাসীদের অভাব পূরণ করে স্থানীয় কালো শ্রমিক আর ক্যারিবিয়ান থেকে আসা নতুন অভিবাসীরা।
কফি, তামাক, ধান, চিনি, তুলো, পামওয়েল ইত্যাদির প্ল্যান্টেশন গড়ে ওঠে আমেরিকান সাউথের ধাঁচে। পাম ওয়েল প্রেসের যন্ত্রও আবিষ্কার করেন লাইবেরিয়ার এক উদ্ভাবক। এসব কাঁচামাল ও শস্য রপ্তানির পাশাপাশি জাহাজশিল্প গড়ে ওঠে। এখনো ছোটদেশ লাইবেরিয়া সারা বিশ্বে জাহাজের ফ্ল্যাগ অফ কনভেনিয়েন্স ও রেজিস্ট্রেশনে অগ্রগণ্য একটি নাম।
লাইবেরিয়ার পতাকা এখনো সারা বিশ্বে জাহাজের ফ্ল্যাগ অফ কনভেনিয়েন্স হিসাবে সুপরিচিত।
এসব উন্নয়নের বিপরীতে স্থানীয় কালোরা আমেরিকোদেরই ক্রীতদাসে পরিণত হতে শুরু করে! দু’একটা অপ্রীতিকর ঘটনার পর সরকার আইন করে সেসব বন্ধ করার চেষ্টা করে। আইনানুযায়ী ঘরে ও খামারে কাজ করা কালোদের জামাকাপড় আর শিক্ষার ব্যাপারটা আমেরিকো গেরস্তকে দেখভাল করতে হবে। নাহলে বড় জরিমানা। আদতে যেটা দাঁড়াল, তা হলো আমাদের দেশের চাকরদের মত সামান্য খাদ্যবস্ত্র আর ধর্মশিক্ষা দিয়ে সোশাল সেগ্রেগেশন।
লাইবেরিয়া পরিদর্শনে আসা মার্কিন দূত যারা অ্যাবোলিশনিস্ট মুভমেন্টের সাথে জড়িত ছিলেন, তারা তাদের রিপোর্টে লাইবেরিয়ার এ শ্রমব্যবস্থাকে সরাসরি ‘স্লেভারি’ হিসাবে বর্ণনা করেন। আমেরিকোরা তাচ্ছিল্য করে স্থানীয় কালোদের ডাকত ‘বয়’ বলে, ঠিক যেমনটা সাদার্ন স্টেটগুলিতে তাদেরকে ডাকত শ্বেতাঙ্গরা! আর দেশের অভ্যন্তরের গোত্রগুলোর নাম তারা দেয় ‘অ্যাবোরিজিনি’! অ্যাবোরিজিনিদের যারা তাদের খামারে থাকত, তাদের প্রত্যেককে মাতৃভাষার নাম ছেড়ে গ্রহণ করতে হত পালক পরিবারের নাম। এটিও ঠিক মার্কিন দেশে গোলাম-মনিবের সম্পর্কের মত!
লাইবেরিয়ার গেরস্ত পরিবারের সাথে তাদের ‘ওয়ার্ড’ বা গৃহপালিত দাস, ঊনবিংশ শতকের শেষভাগ। দাসেদের বস্ত্র তুলনামূলক কম, কিন্তু মনিবরা ঠিকই ক্রান্তীয় এলাকার গরমের মধ্যেও মার্কিন ঘরানায় আচ্ছাদিত।
সব মিলিয়ে নতুন দেশ লাইবেরিয়া মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গদের মুক্তির স্বপ্নপূরণ করলেও এর মূল্য দিতে হয় তাদেরই স্বগোত্রীয়দের — হয় তাদের দাসের মত নিজেকে বিকিয়ে দিতে হয় নয়ত স্বকীয় পরিচয় পরিত্যাগ করে হতে হয় সভ্য ‘আমেরিকো’।
আফ্রিকায় দ্বিতীয় জাহাজ পাঠানোর আগেই পল কাফির মৃত্যু হয় ১৮১৭ সালে। তার পর কৃষ্ণাঙ্গ অভিবাসনের কল্যাণ প্রকল্প শুরু করে ১৮১৬তে স্থাপিত আমেরিকান কলোনাইজেশন সোসাইটি (এসিএস) নামে দাতব্য সংস্থাটি। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এক শ্বেতাঙ্গ এজেন্ট ও কিছু কৃষ্ণাঙ্গ বণিক পশ্চিম আফ্রিকা ঘুরে সিয়েরা লিওনের দক্ষিণে, বর্তমান মনরোভিয়ার কাছে একটি স্থান ঠিক করে আসে বসতিস্থাপনের জন্যে।
পেপার কোস্ট (‘মরিচ উপকূল’!) নামে এ এলাকাটি অবশ্য জনশূন্য ছিল না! সেখানে বসবাস করত মান্দে, গ্রেবো, ক্রু প্রভৃতি বিভিন্ন গোত্রীয় আফ্রিকান মানুষ। এসব ‘অসভ্য’ গোত্রের এক রাজার সাথে ক্রয়শর্তেই এসিএসের অভিযাত্রীরা ভবিষ্যত বসতির স্থান ঠিক করে। মার্কিনদের আগে স্প্যানিশ-পর্তুগীজ-ব্রিটিশ-ডাচ বণিকদের সাথেও এসকল গোত্রের মোলাকাত ও ব্যবসাবাণিজ্য চলেছে।
প্রথম ইংলিশ পিলগ্রিম অভিবাসীদের মেফ্লাওয়ার জাহাজে চড়ে আমেরিকাযাত্রার ঠিক দু’শ বছর পর, মার্কিন কালো ‘পিলগ্রিমদের’ একটা দল নিউইয়র্ক থেকে এলিজাবেথ জাহাজে করে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে লাইবেরিয়ার উপকূলে অবতরণ করে। সেটা ১৮২০ সাল।
এলিজাবেথ নামে এই জাহাজের ডাকনাম ‘ব্ল্যাক মেফ্লাওয়ার’। ১৮২০ সালে এতে করেই প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন কলোনিস্টরা লাইবেরিয়ায় এসে পৌঁছায়।
দুর্ভাগ্যবশত তাদের ঠিক করা এলাকাটি সভ্য মানুষের বসবাসোপযোগী ছিল না। ক্রান্তীয় এলাকার জলাজঙ্গলের অসুখবিসুখে নবাগতরা আক্রান্ত হয়, ঠিক ইংলিশ পিলগ্রিমদের মত। তাছাড়া সাথে নিয়ে আসা খাবারদাবারও দ্রুত ফুরিয়ে যেতে শুরু করে। এভাবে মৃত্যুমুখে পতিত হয় প্রথম আসা দলগুলির একতৃতীয়াংশ থেকে একচতুর্থাংশ।
অসুস্থতার কারণে আর আবাদযোগ্য জমির অভাবে এসকল অভিবাসী পরিবারগুলি এসিএসের দ্বারস্থ হয়। এসিএস তাদের সীমিত শক্তির মধ্যে যৎসামান্য সাহায্য করে। অনেকেই প্রাক্তন মনিব পরিবারদের কাছে খাদ্য আর ডাক্তারী সাহায্য চেয়ে চিঠি লেখে। অবস্থাপন্নরা সাহায্য পেয়ে বেঁচেবর্তে যায়।
স্থানীয় কালোদের সাথে রফা করে নতুন জমিজমা কেনার চেষ্টা করে মনরোভিয়ার কলোনি। সবসময় সেটা সাফল্যের মুখ দেখেনি। কোন ক্ষেত্রে জোরজবরদস্তি কিংবা ঠকবাজির আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় তারা। হ্যাঁ, জীবন বাঁচানোর তাগিদে তুতো ভাইদের বোকা বানাতে কসুর করেনি এসব মুক্তিপ্রাপ্ত দাসের বংশধররা!
মনরোভিয়ার কাছে ভার্জিনিয়া থেকে আগত কৃষ্ণাঙ্গদের সেটলমেন্ট, ১৮২০এর দশক।
গোলমাল বাঁধা শুরু করলে স্থানীয় রাজাদের নিয়ে সম্মেলন করে সেটলারদের পক্ষে রায় দেয় সে অঞ্চলের নেতৃস্থানীয় মান্দে গোত্রের অধিকর্তা। সেটা নেটিভরা মেনে নিলেও ভেতরে ভেতরে তারা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়। অর্থাৎ আমেরিকার কলোনাইজেশনের মধ্যভাগে সেই ইংলিশ পিলগ্রিমদের সাথে নেটিভদের সংঘাতের সমান্তরাল ইতিহাসের শুরু হলো।
এসকল জটিলতার সাথে যুক্ত হয় আরো বড় একটা সমস্যা। স্থানীয় আফ্রিকানরা বংশপরম্পরায় দাসবাণিজ্যে সরাসরি জড়িত! অন্তর্ঘাতী সংঘর্ষ থেকে বন্দী করা ভিন্নগোত্রীয় মানুষকে তারা স্বগৃহে দাস করে তো রাখতই, উপকূলীয় অঞ্চলে ইউরোপীয়-মার্কিন দাসব্যবসায়ীদের জাহাজেও সাপ্লাই দিত! ১৮২০/৩০এর দশকে ব্রিটিশ নৌবাহিনী পুরো পশ্চিম আফ্রিকা উপকূলে দাসবাণিজ্য বন্ধের জন্যে ঘেরাও দিলেও, তার ফাঁকফোঁকর গলে চোরাকারবারী বেআইনী দাসবাণিজ্য চলত। দাস সাপ্লাইয়ের বিনিময়ে লাইবেরিয়ার গোত্রগুলো পেত ইউরোপীয় অস্ত্র, নানাপ্রকার বিলাসদ্রব্য, ছাতা, চশমা, রঙবেরঙের সেমিপ্রেশাস রত্ন, ইত্যাদি।
নবাগত সেটলাররা যখন জানতে পারলো স্থানীয়দের এই শয়তানি কর্মকান্ডের কথা, তখন থেকে তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় সেসব জোর করে বন্ধ করতে। যুদ্ধ ছাড়া আর কোন গত্যন্তর ছিল না।
লাইবেরিয়ার আদিবাসী গ্রেবো জনগোষ্ঠীর সেরেমনিয়াল মুখোশ।১৮০৯এ ব্রিটিশ নৌবাহিনীর জাহাজ ব্রিস্ক দাসবাহী স্প্যানিশ জাহাজ এমানুয়েলাকে চ্যালেঞ্জ করছে।
সে যুদ্ধ যখন বাঁধল, হাজারে হাজারে স্থানীয় কৃষ্ণাঙ্গ ঘিরে ধরল মনরোভিয়ার শ’খানেক সেটলারকে, তখন একটিমাত্র কামানের গোলায় তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় মনরোভিয়াবাসী। বন্দুক স্থানীয়দেরও ছিল, কিন্তু সেটলারদের মত দ্রুত গোলাবর্ষণের প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ তাদের ছিল না।
এরকম অসম কয়েকটি যুদ্ধের পর হাল ছেড়ে উপকূলীয় অঞ্চল ছেড়ে দেয় আদিবাসীরা। সেটলাররা আবাদযোগ্য জমিজমা কিনে নেয় নামমাত্র মূল্যে। চাষাবাদের পাশাপাশি স্থানীয়দের সাথে ইউরোপীয়দের বাণিজ্যের মধ্যসত্ত্বভোগী হিসাবে জাঁকিয়ে বসে সেটলার পরিবারগুলো।
এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি মার্কিন থেকে আসা ‘আমেরিকোদের’। নিউইয়র্ক, মিসিসিপি, পেনসিলভানিয়া, লুইসিয়ানা, মেরিল্যান্ড, ভার্জিনিয়া, কেন্টাকি ইত্যাদি স্টেটগুলিতে এসিএসের মত কলোনাইজেশন সমিতি গড়ে ওঠে। বর্তমান লাইবেরিয়ার বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকায় গড়ে ওঠে তাদেরও বসতি।
ঊনবিংশ শতকের লাইবেরিয়াতে উপকূলীয় অঞ্চলে ‘আমেরিকোরা’ বসতি গেড়েছিল। অভ্যন্তরে ছিল আদিবাসী বহু গোষ্ঠীর বসবাস।
মার্কিন ফেডারেল সরকার এসব কলোনিকে সরাসরি সাহায্য দেয়া থেকে বিরত থাকে, কারণ সাম্রাজ্যবাদী অভিলাষের বিন্দুমাত্র চিহ্ন দেখানোটাও তার নৈতিকতার পরিপন্থী। কংগ্রেস শুধুমাত্র ‘রিক্যাপচার্ড স্লেভদের’ পুনর্বাসনের জন্যে খোরপোশ দিতে রাজি হয়। এরা হলো মার্কিন নেভি কর্তৃক চোরাকারবারী জাহাজ থেকে জব্দকরা দাসের দল, যারা মোটে দাসত্বশৃংখলে আবদ্ধ হয়েছে, ইংরেজী ভাষা-সভ্যতা জানা নাই। এদেরও নিবাস হয় বর্তমান লাইবেরিয়া।
শীঘ্রই লাইবেরিয়ার মুক্ত কালোরা নতুন দেশে তাদের অবস্থান পাকাপোক্ত করে নেয়। এসিএসের সাদা এজেন্টদের উপস্থিতি শিক্ষিত কালোদের মনঃপূত না হওয়ায় তারা নিজেদের মধ্য থেকে গভর্নর নিযুক্ত করার দাবি জানায়। এসিএস ক্রমে তাদের এসকল দাবি মেনে নেয়। কলোনিটি পরিণত হয় ‘কমনওয়েল্থে’, লিখিত হয় মার্কিন আদলের শাসনতন্ত্র। কর্মঠ কালোরা কৃষিকাজ ও বাণিজ্যের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে, রাজনৈতিক পরিচয় ও অবস্থানও মজবুত হয় তাদের।
ঊনবিংশ শতকের বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য লাইবেরিয়ান আমেরিকো ব্যক্তিত্বের স্থিরচিত্র।১৮২২এর আদিবাসীদের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষাযুদ্ধে একটি কামানের বদৌলতে বেঁচে যায় কালো সেটলাররা। সে কামান দেঁগেছিল নাকি মাটিল্ডা নিউপোর্ট বলে এক কৃষ্ণাঙ্গিনী। এই লেজেন্ডের সেলেব্রেশন ষাট-সত্তরের দশক পর্যন্ত চালু ছিল লাইবেরিয়া দেশটিতে।
বলা বাহুল্য, এসকল স্বাধিকার ও উন্নয়নের মুখ দেখে কেবল উপকূলের কলোনিগুলির ‘আমেরিকো’ গোষ্ঠী, যাদের সংখ্যা হাজারখানেকের বেশি ছিল না। তাদের স্বদেশী আদিবাসী ভাইদের সংখ্যা ছিল দশ লাখের ওপর। এদের শাসনতান্ত্রিক কোন অধিকার ছিল না, কারণ তারা কলোনির সদস্য নয়।
দূর থেকে এই স্বজাতি আমেরিকোদের ডাকতে শুরু করে ‘কালো শ্বেতাঙ্গ’!
জালিম ও মজলুমের কোন গাত্রবর্ণ নাই, জাতপাত নাই। মানুষ এমন একটা প্রাণী যে সামাজিক ঠিকই, কিন্তু কেবলমাত্র প্রাকৃতিক কিংবা কৃত্রিমভাবে তৈরি নিজস্ব আইডেন্টিটি গ্রুপের মধ্যে। পারিপার্শ্বিকতা ও প্রয়োজন তৈরি করে দেয় তার এই পরিচয়।
আফ্রিকার মানচিত্রে লাইবেরিয়ার স্থানলাইবেরিয়ার পতাকার অনুপ্রেরণা মার্কিন পতাকা
এ কথাগুলি মনে এল লাইবেরিয়া দেশটির কথা চিন্তা করে। ছোট করে শুরুতে বলি, ঊনবিংশ শতকে মার্কিন থেকে আগত মুক্তিপ্রাপ্ত কৃষ্ণাঙ্গ প্রাক্তন দাস ও দাসদের বংশধরদের আবাসস্থল হিসাবে দেশটির যাত্রা শুরু। তাদের শাসনতন্ত্র প্রায় হুবহু মার্কিন শাসনতন্ত্রের ভিত্তিতে লেখা, তিনটি প্রশাসনিক বিভাগ, মতপ্রকাশের-ধর্মপালনের স্বাধীনতা, ইত্যাদি।
আর গোড়াপত্তনের দেড়শ বছরের মাথায় লাইবেরিয়াতে হয়ে যায় দু’-দু’টি গৃহযুদ্ধ। ষোলটি জাতিগোষ্ঠী চিন্তাতীত নির্মমতার সাথে একে-অপরের ওপর চড়াও হয়। লাইবেরিয়ার যুদ্ধের খবর ঘাঁটালেই হত্যা-ধর্ষণের পাশাপাশি চোখে পড়বে চাইল্ড সোলজার, ব্লাড ডায়মন্ড, ইত্যাদি হেডলাইন। ১৯৮৯ থেকে শুরু করে ২০০৩ পর্যন্ত বিরতি দিয়ে দিয়ে গৃহযুদ্ধ হয়, আর তাতে প্রাণ হারায় নয় লাখেরও বেশি মানুষ। ২০০৩এ বেশ কিছু বাংলাদেশী সেনাসদস্যও সেদেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে যোগ দেয়, সেটা ছিল এযাবত জাতিসংঘের সর্ববৃহৎ শান্তিরক্ষা মিশন। মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রিপ্রাপ্ত চার্লস টেইলর নামক এক লাইবেরিয়ান ওয়ারলর্ড ও প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি হন হেগের আন্তর্জাতিক কোর্টে বিচারপ্রাপ্ত প্রথম কোন প্রাক্তন রাষ্ট্রনেতা।
কেন কিভাবে এ অধঃপতন তার কাহিনীই লিখতে বসেছি।
লাইবেরিয়ার স্বাধীনতাঘোষণার প্রাক্কালে কনস্টিটিউশনাল কনভেনশনে স্পষ্টভাবে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকদের আসল পরিচয় যে মার্কিন, তা উল্লেখ করা হয় (১৮৪৭)।লাইবেরিয়ান গৃহযুদ্ধের চাইল্ড সোলজারলাইবেরিয়ান গৃহযুদ্ধের চাইল্ড সোলজার
লাইবেরিয়া কনসেপ্টটার যাত্রাশুরু ১৮১০এর দশকে। ইংরেজ ও মার্কিনরা আন্তর্জাতিক দাসবাণিজ্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ১৮০৭ সালে। যেসকল কৃষ্ণাঙ্গ ইতিমধ্যে দক্ষিণের স্টেটগুলিতে ক্রীতদাস, তাদের মুক্তি আসে আরো পরে। কিন্তু উত্তরে তখন যথেষ্ট মুক্তিপ্রাপ্ত ও শিক্ষিত কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের বসবাস। সেসময় মিসৌরী নদী থেকে আটলান্টিক পর্যন্ত যে প্রায় ৯.৬ মিলিয়ন জনসংখ্যা, তাদের প্রায় ১.৭৫ মিলিয়ন কৃষ্ণাঙ্গ, আর এদের প্রায় ২৩০,০০০, অর্থাৎ ১৩ শতাংশ, মুক্ত মানুষ। এদের অনেকে ‘মুলাটো’ বা মিশ্রজাত। কারো বাবা কৃষ্ণাঙ্গ দাস, তো মা শ্বেতাঙ্গ আইরিশ ইনডেঞ্চারড সারভ্যান্ট — যার স্টেটাস ক্রীতদাসের থেকে এমন একটা উঁচুতে নয়। ১৮০০ শতকের শুরুতে মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গরা ছিল আমেরিকার ফাস্টেস্ট গ্রোয়িং ডেমোগ্রাফি।
মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গদের অনেকে ব্যবসাবাণিজ্যে সাফল্য পায়। এদের অনেকেই ছিল শিক্ষিত, কর্মঠ, অন্টরপ্রনরশিপে বিশ্বাসী, এমনকি অ্যাডাম স্মিথপড়া পুঁজিবাদী লোক। পল কাফি বলে এদের একজন, কৃষ্ণাঙ্গ তিমিশিকারী বণিক তিনি, ঠিক করেন যে কৃষ্ণাঙ্গদের আফ্রিকায় পুনর্বাসিত হওয়াটাই সমীচীন। সে লক্ষ্যে একটি জাহাজে করে প্রায় আশিজন মুক্তমানুষ পরিবারসহ আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে পশ্চিম আফ্রিকার সিয়েরা লিওনে এসে হাজির হয়। সিয়েরা লিওন ছিল ব্রিটিশ কলোনি, এবং ব্রিটিশরা এর গোড়াপত্তনই করে ব্রিটেনের মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গদের স্বেচ্ছাপুনর্বাসনের স্থান হিসাবে।
কাফির চিন্তাটা অবশ্য নতুন নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফাউন্ডিং ফাদাররাও ভেবেছিলেন, মালিকদের মৃত্যুর পর যেসকল ক্রীতদাস মুক্তি পাচ্ছে, কিংবা নিজেদের উপার্জনের মাধ্যমে স্বাধীনতা কিনে নিচ্ছে, তাদের স্বদেশে ফিরিয়ে দেয়াটাই উত্তম। আমেরিকায় যদি তারা থেকে যায়, তাহলে শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ দু’জাতের মধ্যে অত্যাচার ও অপব্যবহারের যে সম্পর্কের শত বছরের ইতিহাস, সেটা ফিরে ফিরে এসে রাষ্ট্রীয় সমস্যা তৈরি করবে। তাছাড়াও মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকাংশ সহায়-সম্বলহীন হওয়ার কারণে ভবিষ্যতে যে তারা আবার ক্রীতদাসে পরিণত হবে না, তারও গ্যারান্টি নেই।
জেফারসন-মনরো প্রমুখ গোপনে এ ব্যাপারে কথাবার্তা চালান, তাদের ইচ্ছে ছিল কৃষ্ণাঙ্গদের জন্যে কলোনিস্থাপনের। সেটা আমেরিকার নতুন ওহাইয়ো টেরিটরিতেও হতে পারে, কিংবা লাতিন আমেরিকা নতুবা আফ্রিকাতেও। এমনকি লিংকনও মধ্য আমেরিকা কিংবা হাইতিতে কৃষ্ণাঙ্গপুনর্বাসনের চিন্তা করেন। কিন্তু তাদের এসকল আইডিয়া নিয়ে বেশিদূর না আগানোর কারণ, ঐ ‘কলোনি’ শব্দটা! মার্কিনরা হবে কিনা তাদের প্রাক্তন মালিক ব্রিটেনের মত সাম্রাজ্যবাদী! এ ব্যাপারটা সে আমলে কারোরই মনঃপূত হয়নি।
এ অবস্থার একটা সুরাহা হয় আমেরিকান কলোনাইজেশন সোসাইটি (এসিএস) নামে একটি দাতব্য সংস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। সাদার্ন স্টেটগুলির কিছু নামীদামী ধর্মপরায়ণ ব্যক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় এটি শুরু হয়। এদের কারো কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি সত্যিকার সহানুভূতি, আবার কারো কারো জাতিগত মিশ্রণ নিয়ে অ্যালার্জি থাকায় তারা চান কৃষ্ণাঙ্গরা ‘ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাক!’
যে উদ্দেশ্যেই এসিএসের যাত্রা শুরু হোক না কেন, বেশ কিছু মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গ আইডিয়াটা গ্রহণ করে নেয়।
ছবির রৌপ্যমুদ্রাগুলি আব্বাসী খেলাফতের দিরহাম। মুদ্রার পিঠে খলীফার নামের পাশাপাশি আল্লাহ-রাসুলের নামে কালেমা লেখা। এ মুদ্রা খুব একটা দুর্লভ নয়। তবে এগুলি যে জায়গায় আবিষ্কৃত হয়েছে, সেটাই পিলে-চমকানো ব্যাপার! উৎপত্তিস্থল বাগদাদ কিংবা দামেস্ক থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মাইল উত্তরে, একাধিক পর্বত-সাগর-নদী পেরিয়ে সুইডেনের স্টকহোমের কাছে এক সমাধিঢিবির মধ্যে পাওয়া গেছে এগুলি।
ভাইকিং ‘নৌকাসমাধিতে’ কুফী হরফে আল্লাহ-আলীর নাম এম্ব্রয়ডার করা সিল্কের কাপড়ও নাকি পেয়েছেন বলছেন সুইডিশ গবেষকরা। আরেক জায়গায় একটা আংটিও পাওয়া গেছে যার গায়ে নাকি ‘আল্লাহর জন্যে’ আরবীতে খোদাই করা।
ভাইকিং আর আব্বাসী খেলাফতের মধ্যে দশম/একাদশ শতকে একটা যোগসূত্র যে থেকে থাকতে পারে, এটা অনেকের কল্পনাতীত। দুটি কালচারের মধ্যে হাজার হাজার মাইল দূরত্ব। অবশ্য প্রত্নতত্ত্ববিদরা এরকম উদাহরণ প্রায়শই পান। এর যৌক্তিক ব্যাখ্যাও রয়েছে।
সুইডেনের ভাইকিং সমাধিতে আবিষ্কৃত রেশমের কাপড়ে এম্ব্রয়ডার করে আল্লাহ ও আলী লেখা।সুইডেনের ভাইকিং সমাধিতে আবিষ্কৃত আংটিতে লিল্লাহ লেখা।
এরকম আরো ভূরি ভূরি উদাহরণ দিতে পারি। বঙ্গোপসাগরের তীরে পন্ডিচেরির কাছে তামিলনাড়ুর আরিকামেডুতে গ্রীক-রোমান ধাঁচের একটি বসতি আবিষ্কৃত হয়েছে। সেখানে পাওয়া গেছে রোমান অ্যাম্ফোরা — ওয়াইন সংরক্ষণ ও স্থানান্তরের জন্যে বড় বড় মাটির বোতল। আরো পাওয়া গেছে রোমান-গ্রীক ও ভারতীয় ডিজাইনে ছাঁপমারা মাটির পাত্র। আর সম্রাট অগাস্টাসের মুখাবয়বখচিত স্বর্ণমুদ্রা।
জাপানের সমাধিস্তূপে পাওয়া নীলরঙের কাঁচের থালা নিয়েও জাপানী রসায়নবিদরা অনেক গবেষণা করেছেন। কারণ এরকম নিদর্শন জাপানে আর পাওয়া যায়নি। তাদের রিসার্চ থেকে বেরিয়েছে যে, রোমান সাম্রাজ্যে এ ধরনের থালা ব্যবহৃত হত, আর সেসবে অ্যান্টিমোনির মত বিশেষ ধাতু যে যে পরিমাণ পাওয়া গেছে, তা একই অনুপাতে রয়েছে থালাটিতে। অর্থাৎ রোমের বিলাসদ্রব্য কিভাবে যেন এসে পড়েছে ছয় হাজার মাইল দূরে জাপানে।
তামিলনাড়ুর আরিকামেডুর কাছে পুদুক্কোটাইয়ে আবিষ্কৃত রোমান সম্রাট অগাস্টাসের মুদ্রা।জাপানের সামাধিস্তূপে আবিষ্কৃত রোমান কাঁচের থালি।
এতক্ষণ যেসব উদাহরণ দিলাম, তা বড়জোর এক হাজার থেকে দু’হাজার বছর আগের। এদের থেকেও পুরনো উদাহরণ হলো, প্রাচীন মিশরের তিন হাজার বছরের পুরনো মামির চুলে সিল্কের সুতোর আবিষ্কার। সে সময়ে একমাত্র চীনাদেরই আয়ত্ত ছিল সিল্ক তৈরির চাবিকাঠি। তার মানে দাঁড়াল, ছয় হাজার মাইল অর্থাৎ পৃথিবীর পরিধির প্রায় একচতুর্থাংশ পাড়ি দিয়ে এসে মিশরীয় অভিজাতদের শোভাবর্ধন করেছে রেশমী সুতো।
আজকের দুনিয়ার কথাই ভাবুন। বাংলাদেশে বসে ‘আই লাভ এনওয়াই’ টিশার্ট পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন আপনি। শার্টের আমদানি হয়ত মার্কিন মুল্লুক থেকে। আবার মার্কিন মুল্লুকের আইডিয়া কাজে লাগিয়ে বানানো শার্টটা খুব সম্ভব বাংলাদেশের গার্মেন্টশিল্পেরই প্রস্তুত। কোথাকার মাল কোথায় এসে পড়ল, অথচ আমরা আজ অবাক হই না।
চীনা সমাধিসৌধে আবিষ্কৃত রোমান পাত্র।
আজ থেকে তিন চার হাজার বছর আগেও একই কাহিনী ঘটেছে। আজকের পরিসরে না হলেও সেপরিমাণটা তুলনামূলকভাবে বড়ই। পরিমাণটারও উত্থানপতন হয়েছে।
আর বিভিন্ন সভ্যতার যে কর্মকান্ড এ ম্যাজিকটা যুগযুগান্তরে ঘটিয়েছে, তার নাম ট্রেড — বাণিজ্য। সোনা-রূপার তৈরি মুদ্রা কিংবা বুলিয়ন আবিষ্কারের বহু আগে থেকেই মানবজাতি একে অন্যের সাথে বাণিজ্যের মাধ্যমে যোগাযোগ করে আসছে। টাকার ব্যবহার না থাকলেও বার্টার বা বিনিময়ের মাধ্যমে বাণিজ্য চলেছে। আর সওদা আদানপ্রদানের পাশাপাশি চলেছে ধর্মীয়, দার্শনিক, প্রযুক্তিগত, ভাষা-সাংস্কৃতিক মতবিনিময়।
প্রাচীন মানুষ কৃষিকাজ শিখে থিতু হতে হতে শুরু হয় নগরসভ্যতার। সমষ্টিগত শ্রমের দক্ষ প্রয়োগের মাধ্যমে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা আসে মানুষের। কিন্তু বহু আদি নগরসভ্যতায় একটা সমস্যা খুঁজে পান প্রত্নতত্ত্ববিদরা। যদিও খাদ্যশস্য উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে বড় জনসংখ্যার ভরনপোষণ সম্ভব, তাতে খাদ্যের বৈচিত্র কমে যায়। সুষম পুষ্টির অভাবে আদি নগরবাসীরা ছিল শিকারী-সংগ্রহকারী যাযাবরদের থেকে শারীরিকভাবে দুর্বল। ফলে অনেক আদি নগর বহির্শত্রুর আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যায়।
কিন্তু দক্ষতা বাড়ানোর জন্যে যে কাজটা তারা সাধন করেছে তা হলো শ্রমের বিশেষায়িতকরণ। আদি নগরেই দেখা যায় একেকটি পাড়ার পেশা একেক রকম। কেউ কৃষক, কেউ কুম্ভকার, কেউ সূত্রধর। নগরের মধ্যেই আঞ্চলিক বাণিজ্যের যাত্রা শুরু। তারপরে খাদ্য থেকে শুরু করে অন্যান্য কাঁচামালের বৈচিত্র্যের জন্যে স্থানীয় আর সব জনবসতির সাথে আদানপ্রদান শুরু।
নব্যপ্রস্তরযুগের পরবর্তী ক্যালকোলিথিক যুগে, অর্থাৎ ব্রোঞ্জের আবিষ্কারের প্রাক্কালে বিশেষায়িত শ্রমের আবির্ভাবের সাথে সাথে বৈশ্বিক না হলেও আঞ্চলিক বাণিজ্যের শুরু। সেটা কমপক্ষে সাত/আট বাজার বছর আগের কথা। তারপর চার হাজার খ্রীষ্টপূর্বাব্দে মেসোপটেমিয়াতে গরুর মত ভারবাহী পশুকে পোষ মানানোর ফলে লং ডিসট্যান্স ট্রেডিংয়ের রাস্তা খুলে যায়।
মেসোপটেমিয়ার সুমেরীয়দের সাথে ময়েঞ্জোদারো-হরপ্পার যোগাযোগটা বৈদেশিক বাণিজ্যের সবচে প্রাচীন উদাহরণ। স্থল ও নৌপথে ভারতের মশলাপাতি ও সেমিপ্রেশাস রত্নরাজি এসে পৌঁছত উরের মত ইরাকের বড় শহরগুলিতে। হরপ্পান সভ্যতার টেরাকোটা সীল আর আবক্ষ মুর্তির মধ্যেও মেসোপটেমিয়ার সাংস্কৃতিক প্রভাব হুবহু দৃশ্যমান। এ বাণিজ্য তুঙ্গে ওঠে আড়াই হাজার খ্রীষ্টপূর্বাব্দে। আর প্রাক-আর্য হরপ্পান নগরগুলির পতনের পর এ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
ময়েঞ্জোদারোর এই মূর্তিটি কোন রাজার নয়, সম্ভবত অলিগার্কের। শিল্পে মেসোপটেমিয়ার সাংস্কৃতিক প্রভাব সুস্পষ্ট।ঊর শহরে আবিষ্কৃত কার্নেলিয়ান পাথরের নেকলেস। শিল্প দেখে মনে হয় সিন্ধু সভ্যতার থেকে আমদানি।
এরপর মিশরে পোষ মানে ভারবাহী গাধা, সে তিন হাজার খ্রীষ্টপূর্বে। তার পাশাপাশি নীলনদের নৌপথে চলে উত্তর-দক্ষিণ বাণিজ্য। কৃষিজমির দখল আর আঞ্চলিক নৌবাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণের খাতিরেই সম্ভবত মিশরে আবির্ভাব ঘটে প্রথম সাম্রাজ্য কিংবা কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার। শাসকদের কাজ হলো প্রজাদের কৃষিজমির ভাগবন্টন আর আঞ্চলিক বাণিজ্যের নিরাপত্তাবিধান আর যাত্রাপথের রক্ষণাবেক্ষণ। এসবের ব্যয়নির্বাহের জন্যে কর ধার্য হত। অর্থ দিয়ে না হলেও খাদ্যশস্য আর বাণিজ্যের ফেরির ভাগ দিয়ে সে কর পরিশোধিত হত। অর্থাৎ যেখানে মিষ্টির সুবাস, মাছির উৎপাত সেখানেই। তার মানে এই নয় যে, ইতিহাসে বাণিজ্যই সবসময় রাজা-সম্রাটদের জন্ম দিয়েছে।
ঊটও পোষ মানে তিন হাজার খ্রীষ্টপূর্বাব্দের আশপাশ দিয়ে। দক্ষিণ আরবের ইয়েমেন-ওমানের স্থলপথ, হর্ন অফ আফ্রিকার সোমালিয়া, লোহিত সাগরের নৌপথ ইত্যাদির যোগসাজশে প্রাচীন ভারতের সাথে যুক্ত হয় মিশর। ১২০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে ‘ব্রোঞ্জ এইজ কলাপ্সের’ আগ দিয়ে মিশরে সিডার কাঠ আমদানি হত লেবানন থেকে, সাইপ্রাস থেকে তামা-ব্রোঞ্জ, দক্ষিণ আরব থেকে সুগন্ধি, নুবিয়া থেকে সোনা, প্রভৃতি।
হিট্টাইট আর মিশরীরা ছিল সেযুগের সুপারপাওয়ার, আর সভ্য বিশ্বের হেন শহর নেই যাদের সাথে যোগাযোগ ছিল এ দু’য়ের। সিরিয়ার মিত্তানি মিত্রদের সাথে পত্রযোগাযোগের পান্ডুলিপি আবিষ্কৃত হয়েছে, যেগুলি পড়লে মনে হবে সে যুগের কূটনীতি এ যুগের থেকে এমন ভিন্ন কিছু ছিল না। সে সব পত্রে বিলাসদ্রব্যের বিনিময়ে কেউ চাইছে মিশরীদের প্রতিরক্ষা। কেউ পাঠাচ্ছে বিশাল উপঢৌকন, এ আশায় যে ভবিষ্যতে তার প্রতিদান পাওয়া যাবে। বিভিন্ন আদানপ্রদানের রশিদ এগুলি। পাওয়া গেছে মিশরের তেল-আল-আমারনাতে।
১৪২০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের মিশরী বাণিজ্যজাহাজ।চতুর্থ খ্রীষ্টপূর্ব শতকের ফীনিশীয় জাহাজ।
এরপর এক অন্ধকার যুগের সূচনা হয়ে, যাকে অনেক প্রত্নতত্ত্ববিদ নাম দিয়েছেন ‘ব্রোঞ্জ এইজ কলাপ্স’। ‘সীপিপল’ নামক অজানা জাতির আগ্রাসনে মধ্যপ্রাচ্যের সভ্য শহরগুলির একে একে পতন ঘটে। কমে আসে কূটনৈতিক যোগাযোগ। ভেঙে পড়ে কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা আর বড় সাম্রাজ্যগুলি। অর্থাৎ মাছিরা ঝেঁটিয়ে বিদায়। তাই বলে মিষ্টি আদানপ্রদান থেমে থাকেনি। এই অরাজকতার মধ্যেই উত্থান ঘটে নতুন এক বণিকজাতির, যাদের নাম ফীনিশিয়ান। এরা নতুন ধরনের দ্রুত জাহাজ নিয়ে বেরিয়ে পড়ে দিকে দিকে। দূরদূরান্তে স্থাপন করে বাণিজ্য কলোনি। বড় সাম্রাজ্যের জন্ম না দিলেও তাদের একটা বড় লেগ্যাসি আমরা এখনো বহন করে চলেছি, যার নাম অ্যালফাবেট।
পৃথিবীর অপর প্রান্ত চীনে অরাজকতার যুগশেষে দ্বিতীয় খ্রীষ্টপূর্ব শতকে নতুন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন সম্রাট শিহুয়াংদি। তার রাজদূত মরুভূমি-পর্বত পেরিয়ে মধ্য এশিয়ায় আসে যুদ্ধে কাজে লাগানোর মত দ্রুত ঘোড়ার খোঁজে। সে বাণিজ্য সম্পর্ক থেকেই শুরু হয় সিল্করোডের পূর্বভাগের।
ফারগানার ঘোড়া, এই ‘স্বর্গের’ ঘোড়ার জন্যেই চীনারা মধ্য এশিয়ার সাথে বাণিজ্যসম্পর্ক স্থাপন করে, যার থেকে সিল্করোডের শুরু।প্রাচীন রোমের অভিজাতদের কাছে চীনা রেশমের কাপড়ের বেশ কদর ছিল।চীনের সমাধিসৌধে আবিষ্কৃত বিজ্যান্টিন স্বর্ণমুদ্রায় সম্রাট কন্সট্যান্সের মুখাবয়ব।
আর রোমান সাম্রাজ্যও দ্বিতীয় খ্রীষ্টীয় শতকে ইরান ও মধ্য এশিয়ার মাধ্যমে যুক্ত হয় চীনের বাণিজ্যপথের সাথে। ইউরোপ থেকে যেত সোনা আর চীন থেকে রেশম। আর আজকের ট্রেড ওয়ারের শুরুও এই সময়ে। রোমান অভিজাতরা চীনা রেশমের জন্যে রাজ্যের স্বর্ণভান্ডার প্রায় নিঃশেষ করে ফেলে। সম্রাট টাইবেরিয়াস বাধ্য হয়ে সিল্কের ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। চীনও রেশমের গোপন প্রস্তুতপ্রণালী আগলে রেখেছিল, যাতে রোম সাম্রাজ্যের কারিগররা প্রতিযোগিতায় আবির্ভূত না হয়।
রোমানদের আগেই সম্ভবত গ্রীকরা বাণিজ্য কলোনি স্থাপন করেছিল ভারতের আরিকামেডুতে। পেরিপ্লাস অফ দ্য এরিথ্রেয়ান সী নামের গ্রীক পান্ডুলিপিতে এ বন্দরের উল্লেখ আছে। গ্রীকদের পরে রোমান সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে আসে এই বাণিজ্যবসতি। বহু দেশীবিদেশী বণিকদের স্থায়ী-অস্থায়ী নিবাস ছিল এই ভারতীয় শহরটি। আনুমানিক সময়কাল দ্বিতীয় খ্রীষ্টপূর্ব শতক থেকে সপ্তম খ্রীষ্টীয় শতক।
রোম, আর পরে বিজ্যান্টিন, সাম্রাজ্যের সাথে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথ যুক্ত ছিল। একে বলে ইনসেন্স রাউট। ইয়েমেনের স্থানীয় গাছের বাকল থেকে তৈরি হত দুটি সুগন্ধি, এগুলি দিয়ে এখনো আতর তৈরি হয়। এদের নাম ফ্রাংকিনসেন্স ও মাঢ়। রোমান দেবালয়ে পূজোর কাজে এদের ব্যবহার ছিল।
ইয়েমেন থেকে শুরু করে লোহিত সাগরের তীরের জেদ্দা, তারপর জর্দানের পেত্রা হয়ে মধ্যোপসাগরীয় বন্দরে এসে জাহাজে উঠত এই মালামাল। যীশুখ্রীষ্টের জন্মলগ্নে এগুলিই উপহার নিয়ে এসেছিলেন তিন মেজাই। তৃতীয় খ্রীষ্টপূর্ব শতক থেকে দ্বিতীয় খ্রীষ্টীয় শতকের মধ্যে এই ইনসেন্স রাউট উপকূলীয় আরব শহরগুলিকে সমৃদ্ধি এনে দিয়েছিল।
ইনসেন্স রাউটের অন্যতম স্থলবন্দর জর্দানের পেত্রা।
ইসলামী ঐতিহ্যে যদিও বলা হয় নবীজীর বাণিজ্যে হাতেখড়ি এই পথের মক্কা-সিরিয়া অংশে, তাতে একটা সমস্যা রয়েছে। গথদের হাতে ততদিনে রোমের পতন হয়েছে, আর বিজ্যান্টিনরা ঘোরতর খ্রীষ্টান। এসব সুগন্ধির বড় বাজার তখন আর নেই ইউরোপে।
রোমের পতনপরবর্তী সময় বিজ্যান্টিনরা চীনের সাথে সিল্করোডের মাধ্যমে বাণিজ্য করতে থাকে। চীনা সমাধিতে বিজ্যান্টিন মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। রাজনৈতিক শত্রু ইরানিদের পাশ কাটিয়ে মধ্য এশীয় সগডিয়ানদের মাধ্যমে সরাসরি সিল্কের বাজার পায় তারা। ভারত থেকেও মধ্য এশিয়ার মধ্য দিয়ে বৌদ্ধধর্ম পাচার হয়ে গেছে চীনে একই সময়ে। মধ্য এশিয়ার রাজ্যগুলি প্রকৃতার্থেই ছিল মানুষের মিলনমেলা।
ভাইকিংরা এ চিত্রে এসে যুক্ত হয় এরকম সময়েই। নবম/দশম খ্রীষ্টীয় শতকে সুইডিশ ভাইকিংরা ভলগা নদীর তীর ধরে লুটতরাজ করতে করতে অনেক দক্ষিণে ইউক্রেনের নভগরোদ আর কিয়েভ শহরে এসে পড়ে। সেখানকার স্লাভ জাতির মানুষ এই ‘রুস’দেরকে রাজা মানা শুরু করে। গোড়াপত্তন হয় প্রাচীন রাশিয়ার। এই ভাইকিংয়ের দল আরো দক্ষিণে কৃষ্ণসাগরের তীরে এসে টক্কর খায় বিজ্যান্টিনদের সাথে।
ততদিনে লুটতরাজ ছেড়ে ভাইকিংরা নতুন পেশা ধরেছে, বাণিজ্য আর ভাড়াটে সৈন্যগিরি। মার্সেনারি হিসাবে বিজ্যান্টিন সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাওয়া পড়ত তাদের। সে সুবাদে একটু বাণিজ্যও করে নিত। এভাবেই সম্ভবত আব্বাসী খেলাফতের সাথে তাদের যোগাযোগ। আর আব্বাসীদের চকচকে রূপার ধাতব মুদ্রার প্রতি তাদের ছিল বিশেষ টান। আরব পরিব্রাজক ইবনে ফাদলানও উত্তরের দেশে ভ্রমণ করে এসে ভাইকিংদের নৌকা-শেষকৃত্যের একটা বিবরণী লিখে গেছেন আরবীতে।
এ হলো মোটামুটি সভ্য দেশগুলির থেকে পাওয়া বাণিজ্যের লিখিত বিবরণী। নিরক্ষর অনেক দেশও যে বৈদেশিক বাণিজ্যে প্রাচীনকাল থেকে যুক্ত ছিল তার প্রমাণও প্রত্নতত্ত্ববিদরা পেয়েছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের ওয়েলসের চার হাজার বছরের পুরনো তামার খনি থেকে মধ্যোপসাগরীয় সভ্য দেশগুলোতে রপ্তানী। কর্নওয়ালের টিনের খনিও সেরকম তিন হাজার বছরের পুরনো। এ দুয়ের তামা আর টিন মিলে সভ্য দেশগুলিতে তৈরি হত ব্রোঞ্জের জিনিসপত্র।
বাল্টিক উপকূল থেকে দক্ষিণে রোম-গ্রীস পর্যন্ত বিস্তৃত অ্যাম্বার রোড তিন হাজার বছরের পুরনো। মধ্যোপসাগর ছাড়িয়ে মিশরের তুতানখামুনের মামির গয়নাতেও জায়গা করে নিয়েছিল বাল্টিকের অ্যাম্বার। সেটা সাড়ে তিন হাজার বছর আগের কথা। ভাইকিং-আরব বাণিজ্যের যেমন লিখিত বিবরণ নেই, ইউরোপের অধিকাংশ এলাকা তখন নিরক্ষর থাকার কারণে অ্যাম্বার রোডেরও তেমন কোন বিবরণী পাওয়া যায়না।
ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষও ছিল নিরক্ষর। কিন্তু তাতে বাণিজ্য থেমে থাকেনি। মূলত নৌপথে তারা চীন থেকে জেড পাথরের আমদানি-রপ্তানি করে গেছে। কমপক্ষে তিন হাজার বছর আগে এই সওদাগরির শুরু।
মিশরের ফারাও তুতানখামুনের ব্রেস্টপ্লেটের নিচের অংশের চারটি অ্যাম্বার পাথর এসেছে সুদূর বাল্টিক উপসাগর থেকে।ফিলিপাইনের জেড পাথরে তৈরি লিংলিং-ও গয়না রপ্তানি হত পুরো দক্ষিণপূর্ব এশিয়াতে।
আর সাব-সাহারান আফ্রিকার থেকে রোমান সাম্রাজ্য আর আরব খেলাফতে গেছে সোনা, লবণ, আর কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস।
পরবর্তী যুগে আরো বহু ট্রেড রুট বিশ্বের মানুষকে সংযুক্ত করেছে। পূর্ব আফ্রিকার জিরাফ বাঙ্গালার সুলতানের উপঢৌকন হিসাবে গিয়ে পৌঁছেছে চীনা সম্রাটের দরবারে। পশ্চিম আফ্রিকার আইভরি হ্যান্ডিক্রাফট শোভা বাড়িয়েছে পর্তুগীজ ডাইনিং টেবিলের। ইন্দোনেশিয়ার মশলা সোনার দরে বিক্রি হয়েছে হল্যান্ড-ইংল্যান্ডের বন্দরে। আমেরিকার আনারস, আলু, কোকো, রাবার, টমেটো, তামাক পাল্টে দিয়েছে বাকি বিশ্বকে।
পঞ্চদশ শতকে চীনা সম্রাটের জন্যে বাংলার সুলতান সাইফউদ্দিন উপঢৌকন পাঠান এই জিরাফ। বহন করে নিয়ে যায় খোজা সেনাপতি জংহোর জাহাজবহর। সাইফউদ্দিন জিরাফটি পান কেনিয়ার মালিন্দির রাজার কাছ থেকে, বাণিজ্যসূত্রে। চীনে জিরাফটি ব্যাপক সাড়া ফেলে, কারণ কাল্পনিক প্রাণী জিলিনের সাথে এর মিল। ফলে সম্রাটের শাসনক্ষমতা পাকাপোক্ত হয়।
শুধু যে বস্তু আর জ্ঞানের আদানপ্রদান হয়েছে তা নয়, মানুষের কাফেলা একেকসময় একেকমুখী হয়েছে। কখনো পরদেশেই রয়ে গেছে বিদেশী বণিক। হরপ্পান সভ্যতার একটি পরিবারের সমাধি আবিষ্কৃত হয়েছে ইরানে। ধরা যেতে পারে যে এরা ছিল সভ্যতার প্রথম ইমিগ্রান্ট। বিদেশ-বিভুঁইয়ে নিজেদের ছোট একটি কলোনি হয়ত তৈরি করেছিল তারা, যেমনটা করেছিল ফীনিশীয় (কার্থেজ), রোমান (মধ্য এশিয়া), গ্রীক (স্পেন), পারসিক (ইয়েমেন), চীনা (ইন্দোনেশিয়া), আরব (আফ্রিকা), আর রেনেসাঁস পরবর্তী যুগের অন্যান্য ইউরোপীয় জনগোষ্ঠী। এদের যাতায়াত কখনো ছিল বাধাহীন নিরাপদ, কারণ নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করেছে কোন না কোন বড় সাম্রাজ্য (প্যাক্স রোমানা — ইউরোপীয় বাণিজ্য, প্যাক্স মোঙ্গোলিকা — সিল্ক রোড, অধুনা প্যাক্স আমেরিকানা — বিশ্বব্যাপী মুক্তবাজার প্রতিষ্ঠার ক্রেডিট এদেরই প্রাপ্য)। আবার কখনো কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার অভাবে তা ছিল বিপৎসংকুল।
কিন্তু এটা মানতেই হবে, যতই বাধাবিপত্তি থাকুক, মানুষ একে অন্যের সাথে যোগাযোগ যখন একবার শুরু করেছে, তারপর আর থেমে থাকেনি। জোয়ার-ভাঁটা এসেছে সে বাণিজ্যে, কিন্তু নদীর প্রবাহের মত নতুন ধ্যানধারণা, ধর্মচিন্তা, শব্দভান্ডার এসে যুক্ত হয়েছে একেক সভ্যতায়।
লেখার শেষে এসে মনে হলো রবিঠাকুরের ‘তাসের দেশ’ গীতিনাট্য। সে কাহিনীতে রাজপুত্র আর সদাগর এসে হাজির নতুন দেশে। রাজপুত্র যেখানে দিনবদলের ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে, সেখানে সদাগর কিন্তু তুলনামূলকভাবে বাস্তববাদী। প্রচলিত নিয়মের সুবিধাভোগী সফল বণিকসমাজ। তাই তারা সাধারণত শান্তিকামীও।
অবাধ ও ন্যায্য বাণিজ্য আসলে বিশ্বশান্তির একটা বড় অনুঘটক। মধ্যপন্থায় ধীর কিন্তু স্থির সামাজিক পরিবর্তন যদি কোন প্রক্রিয়া আনতে পারে, তো সেই বাণিজ্য। সহিংস বিপ্লব তার পন্থা নয়। আলোকিত বিপ্লব যুগে যুগে যারা করে গেছেন, তাদের মূলে বণিকরাই ছিলেন চালিকাশক্তি। রেনেসাঁস শিল্পের পৃষ্ঠপোষকরা যেমন ছিলেন মেদিচির মত বণিক-ব্যাংকার পরিবার, তেমন মার্ক্যান্টাইল যুগের কলোনিয়াল এক্সপ্লয়টেশন থেকে হোমনেশনগুলির মধ্যবিত্ত শ্রেণী আরও সমৃদ্ধশালী ও বহির্মুখী হয়েছে, যার ফলশ্রুতিতে তাদের দর্শন থেকে এসেছে এজ অফ এনলাইটেনমেন্ট। তারপর আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা, গণতন্ত্র, বিজ্ঞানপ্রযুক্তি ইত্যাদি।
বাণিজ্যের হাত ধরে ঔপনিবেশিকতা-সাম্রাজ্যবাদের শুরু বলবেন অনেকে। কিন্তু সব দিক বিচার করে, সব ইতিহাস, লংটার্ম ইমপ্যাক্ট দেখে, আমার ব্যক্তিগত মতামত হল, ট্রেড ইজ নট এ জিরো-সাম গেম, ট্রেড ইজ এ পজিটিভ সাম গেম। সবার জন্যে মুক্তবাণিজ্যে আখেরে উইন-উইন।