ঐ তারকাখচিত আচ্ছাদনের ঊর্ধ্বে এক স্নেহময় পিতা অবশ্যই আছেন!

Featured Video Play Icon

আস্তিক হোন কিংবা নাস্তিকই হোন, একথা অস্বীকার করা খুবই কঠিন যে, মানুষের মস্তিষ্কের জৈবরাসায়নিক কম্পোজিশনের মধ্যে মহান অবিনশ্বর কোন শক্তিতে বিশ্বাস আর ‘স্বর্গীয়’ অনুভবের ক্ষমতা মজ্জাগতভাবে প্রোথিত।


অর্গানাইজড রিলিজিয়ন মানুষের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহের জন্ম দিলেও ধর্ম অতীতের একেকটা সভ্যতাকে দিয়েছিল একক অবিভক্ত পরিচয়। আর সেসব ধর্মের লক্ষ্য ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়েছে প্রথমত সমসত্ত্ব গোষ্ঠীদের নিজেদের মধ্যে নৈতিকতা আর ন্যায়পরায়ণতার প্রতিষ্ঠায়। তারপর তাদের মূল্যবোধের সম্প্রসারণ হয়েছে অন্য জাত-ধর্মের মানুষকে নৈতিকতার ছত্রতলে এনে, এক ধর্মের বিশ্বাস প্রভাবিত করেছে অন্য ধর্মকেও।


রেনেসাঁস-পরবর্তী যুগের ইউরোপের মনীষীরা অন্যান্য জাতি, ভাষা আর ধর্ম — বিশেষত প্রাচ্যের ইসলাম, হিন্দু ও বৌদ্ধধর্ম — সম্পর্কে খুবই কৌতূহলী ছিলেন। তাঁদের জ্ঞান যত বাড়তে থাকলো, তত তাঁদের বোধোদয় হলো যে, একমাত্র খ্রীষ্টধর্মই যে মানুষের আত্মিক সকল চাওয়া-পাওয়ার একমাত্র উত্তর, এধরনের প্রাক-রেনেসাঁস ও রেনেসাঁসযুগীয় দৃষ্টিভঙ্গি খুবই সংকীর্ণ ও দাম্ভিকতাপূর্ণ


ফলশ্রুতিতে ভলতেয়ার-মঁতেস্কিউ-পেইনের মত চিন্তাবিদরা যীশুখৃষ্টের আধ্যাত্মিকতাবাদের সাথে প্রাচীন গ্রীস আর মধ্যযুগীয় ইসলামী মনীষীদের যুক্তিবাদী ধ্যানধারণার মিশ্রণের বীজ থেকে উৎপন্ন যে চারায় পানি ঢালা শুরু করলেন, সেটা হলো সার্বজনীন মানবতাধর্মের মতবাদ বা হিউম্যানিজম। আমেরিকার স্থপতিরা টমাস পেইনেরই চিন্তাশিষ্য ছিলেন। মার্কিন সংবিধানের প্রণেতা জেফারসন আর ‌অ্যাডামসের সংগ্রহে বাইবেলের পাশাপাশি তানাখ, কুরান আর গীতা ছিল।


এরকম এনলাইটেনমেন্টের যুগে জন্ম বীটোফেন আর শিলারের। নিচের ভিডিওতে প্রখ্যাত বার্লিন ফিলহার্মোনিক অর্কেস্ট্রা প্রয়াত কন্ডাক্টর হার্বার্ট ফন কারায়ানের পরিচালনায় পরিবেশন করছে বীটোফেনের নবম সিম্ফনির শেষ ‘কোরাল’ অংশটা। সাধারণত শুধুমাত্র বাদ্যযন্ত্র দিয়ে সিম্ফনি কম্পোজ করা হতো। বীটোফেনের নবম হলো সিম্ফনির জগতে কোরাল বা গণসঙ্গীতের প্রথম সফল সূচনা। কোরাল অংশে যে গানটা গাইছে বাস-তেনর-আলতো-সোপ্রানোরা, সেটা শিলারের লেখা কবিতা ‘আন ডি ফ্রয়ডা’ — ‘আনন্দের উদ্দেশ্যে’।


আমার কাছে এই সিম্ফনিটা প্রার্থনাসম! ২৪ মিনিটের হলেও একটু সময় করে শুনে দেখুন! ডাবল বাস্ আর হর্ন সেকশনের গম্ভীর মিউজিক দিয়ে শুরু। এ যেন পুরনো ঘুনেধরা সংকীর্ণ মনোভাবের হতোদ্যম নাভিশ্বাস। অথবা ধরতে পারেন নাপোলেওনের ধ্বংসযজ্ঞে বিধ্বস্ত ইউরোপের নানাজাতের মানুষের ক্লান্তি। তার পরে ক্লারিনেট-ভায়োলিন-ওবো এসে যোগ দিলো সেযুদ্ধে বিজয়ী বীরদের গাঁথা গাইতে, সেও সনাতন সাম্রাজ্যের শৌর্যিক মূল্যবোধেরই নমুনা। এমন সময় বাস সোলোয়িস্ট এসে ভেঙ্গেচুড়ে দিলেন সব: “ও ফ্রয়ন্ডা, নিশ্ট ডিজা ট্যোনা…” — বন্ধু, এ লহরী আর নয়, এসো আজ উৎফুল্লতার গান গাই!


তারপরে শিলারের কাব্য থেকে একে একে উচ্চারিত হলো সকল মানুষের ভ্রাতৃত্ব আর স্বর্গীয়তার ঘোষণা! সেখানে জাতপাত আর ধর্মের বিভাজন নেই, আছে কেবল মনুষ্যত্ব! প্রকৃতিমাতার স্তন্যপানে ভাল-মন্দ সকল জীবের সমাধিকার! বন্ধুত্বের প্রমাণ সেখানে মৃত্যু দিয়ে হলেও তা আনন্দের উচ্চতম শিখর! মানুষ ভাগ্যের কাছে হতদরিদ্র জিম্মি নয়, তার আছে ললাটলিখনকে খন্ডানোর অপরিসীম ইচ্ছাশক্তি! আর আছেন স্রষ্টা! “জাইড উম্শ্লুঙেন, মিলিওনেন! ডিজেন কুস ডের গানৎসেন ভেল্ট!” — কোটি জনতা আলিঙ্গনাবদ্ধ, এই চুম্বন সমগ্র বিশ্বের! ব্র্যুডের, উ্যবার্ম শ্টের্নেনৎসেল্ট, মুস আইন লিবের ফাটার ভো’নেন!” — ভাইয়েরা, ঐ তারকাখচিত আচ্ছাদনের ঊর্ধ্বে এক স্নেহময় পিতা অবশ্যই আছেন!


১৮২২এ এই সিম্ফনি লেখার আগে ১৮০০ সালের দিকে ত্রিশবছরবয়সী বীটোফেন বধির হতে শুরু করেন, আর সেই বেদনায় তাঁর মনে এসেছিল আত্মহননের চিন্তা। হয়ত তিনি সেই ললাটলিখনকে জয় করেই আরো সাতাশ বছর বেঁচে ছিলেন নবম সিম্ফনিসহ অনেক কালজয়ী স্বর্গীয় সুরলহরীর জন্ম দিতে!

কসাক নৃত্য ও তেভিয়ে

Featured Video Play Icon

১৮৮১ সালের কথা। রাশিয়ার ৎসার তখন দ্বিতীয় আলেকজান্ডার। এই সম্রাট ১৮৬১তে রুশদেশে ভূমিদাসপ্রথা বিলুপ্ত করার আদেশ জারি করেছিলেন। এ ছিল আমেরিকায় ক্রীতদাসপ্রথা উচ্ছেদের মত যুগান্তকারী ঘটনা, যদিও এই সংস্কার ছিল ‘উপর থেকে চাপানো’। গ্রামের চাষারা জমির আর সম্পত্তির মালিকানার অধিকার পেলো ঠিকই, কিন্তু সেই সাথে কপালে জুটলো করপ্রদানের দায়িত্ব। অনেকে মুক্তি পেয়ে গ্রাম ছেড়ে পাড়ি জমালো শহরের দিকে। রুশ শৈল্পিক বিপ্লবের হাওয়ায় তারা বনে গেল শ্রমিক-মজুর। নব্য শিল্পপতিরা তাদের যথেচ্ছ ব্যবহারের সুযোগ নেয়া শুরু করলো। ফলপ্রসূ চাষাদের পরবর্তী প্রজন্মের নব্যশিক্ষিত মধ্যবিত্ত ছাত্ররা গোপন বিপ্লবী সংগঠনে অংশ নেয়া শুরু করলো। আলেকজান্ডার প্রথমদিকে কিছুটা সংস্কার করলেও সাধারণ জনগণকে সাংবিধানিক ক্ষমতা দিতে ছিলেন চরম নারাজ। ১৮৮১ সালে তাঁকে তার মাসুল দিতে হলো নারোদনায়া ভোলিয়া (জনতার সংকল্প) নামের গুপ্ত সংগঠনের আততায়ীর বোমায় নিহত হয়ে।

প্রতিশোধস্বরূপ গুপ্ত সংস্থাগুলির নেতাদের গ্রেপ্তার করে ফাঁসিতে ঝোলানো হলো, এদের একজনমাত্র ছিল ইহুদী। উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর মতো, বাদবাকি জনগণের মনোযোগ আততায়ীদের ন্যায্য দাবিদাওয়া থেকে দূরে সরিয়ে সংখ্যালঘু ইহুদিদের বিরুদ্ধে জনমনে ঘৃণা আর সন্দেহ ছড়ানো শুরু হলো। তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে গ্রামছাড়া করলো তাদেরই শতবছরের পড়শী রাশিয়ার সংখ্যাগুরু অর্থডক্স খ্রীষ্টান স্লাভ জাতির মানুষেরা। অনেকে রুশদেশ ছেড়ে মার্কিনে পাড়ি জমায়, আর একটা ছোট অংশ — যারা হয়ত একটু বেশি ধার্মিক — তারা এসে হাজির হয়ে যায় তুর্কী ওসমানলি সাম্রাজ্যের অন্তর্গত প্যালেস্টাইন প্রদেশে। প্যালেস্টাইনে তখন সেফার্দী মাজহাবের যে ইহুদীরা ছিল তারা আরবীতেই কথা বলতো, পোশাক-আশাকও ছিল তুর্কীদের মতই। রাশিয়া আর পূর্ব ইউরোপের আশকেনাজি মাজহাবের ইহুদীরা তুরস্কের সেকেলে অভিবাসন আইনের সুযোগ নিয়ে জমিজমা কিনে থিতু হয়ে বসল। ইহুদিদের সংখ্যা এইভাবে রাতারাতি দ্বিগুণ হওয়া সত্ত্বেও সেসময় তারা তাদের আরব বেদুঈন পড়শীদের সাথে মোটামুটি শান্তিতেই বসবাস করত।

যাই হোক, তার পরে আরো অনেক জল গড়িয়ে গেছে, সে সবারই জানা। আমার উদ্দেশ্য ছিল নিচের ভিডিওটির একটা যথোপযুক্ত ভূমিকা দেয়া। এটি নেয়া হয়েছে ১৯৭১ সালের হিট মিউজিক্যাল ‘ফিডলার অন দ্য রুফ’ থেকে। কাহিনীর মূলচরিত্র তেভিয়ে ১৮৮০এর সময়কার রুশদেশের একটা ছোট গ্রাম আনাতিয়েফকার ইহুদী বাসিন্দা। তাদের পাশাপাশি স্লাভ রুশ অর্থডক্স খ্রীষ্টানদেরও বসবাস। তেভিয়ে একটা পানশালায় গেছে লেজার উল্ফ নামে এক বুড়ো কসাইয়ের সাথে। তেভিয়ে তার বড় মেয়ে ৎসাইতেলের মতামত না নিয়েই লেজার উল্ফের বিয়ের প্রস্তাব গ্রহণ করে ফেলেছে, এই ভেবে যে পাত্র বয়স্ক হলেও কসাইব্যবসার পয়সায় কন্যা সুখে থাকবে। (আসলে কি হয়েছিল শেষ পর্যন্ত, সেটাও মজার কাহিনী! জানতে হলে মুভিটা দেখুন — ইউটিউবে আছে।)

লেজার উল্ফ আনন্দের আতিশয্যে পানশালার সবাইকে শ্ন্যাপস খাওয়াচ্ছে, আর সবাই মিলে গান ধরেছে ল্যখাইম — যার অর্থ ‘জীবনের উদ্দেশ্যে’, জীবনে সুখ-দুঃখ যাই আসুক না কেন সবই জলীয়পান করে আনন্দ-উদযাপনের উপযুক্ত। ইহুদীদের নাচগানে বাগড়া দিলো পানশালার উল্টোপ্রান্তে জটলাবাধা রুশ কৃষকের দল। তারা নতুন যুগলের শুভকামনায় বালালাইকার সুরে গান আর কসাক নৃত্য শুরু করে দিল। নাচতে নাচতে দু’দলে ঠোকাঠুকি! সেই দৃশ্যের সন্দেহ আর সাবধানতা ভারি করে তুলেছে পানশালার বাতাস। রুশ চাষা বাউ করে তেভিয়েকে নিমন্ত্রণ করলো একত্রে নাচার জন্যে। কিন্তু ইহুদীদের যে খোদা ছাড়া কারো সামনে মাথানত করা নিষেধ! তেভিয়ে পাল্টা বাউ করলো ঠিকই, কিন্তু একটু তেরচা করে, যেন রুশী তার সরাসরি সামনে না পড়ে। অতঃপর বাড়ানো হাতটা লুফে নিলো, আর দু’দলে মিলে একাত্ম হয়ে গেল নাচতে নাচতে!

পুরো মিউজিক্যালটা দেখার মতো! তেভিয়েদের ট্র্যাডিশন্যাল সামাজিক-পারিবারিক আচার আর তাদের রাজনৈতিক অবস্থা কত দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে, সেটি আমাদের দেশ-সমাজ-ধর্মীয় পরিচয়ের বিবর্তনেরই যেন একটা প্রতিচ্ছবি। আর তার মধ্যে এই গানটা আমার প্রিয় সঙ্গত কারণেই!

গানের লিরিকস এখানে

লাচো দ্রোমঃ যাত্রা হোক শুভ

Featured Video Play Icon

জাত-বর্ণবিদ্বেষ, পরমতঅসহিষ্ণুতা পৃথিবীতে ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতিতে, ধর্মে, ভাষায় আর দেশে বিভক্ত মানুষ অনেক বেশি ট্রাইব্যাল হয়ে যাচ্ছে। একে অন্যের উপর আস্থা রাখতে পারছে না, সন্দেহ আর ভয় পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে ঘৃণায়।

ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্যে যখন ভয় হয়, তখন বিশ্বাস ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করি দেশ-বিদেশের সুরসঙ্গীত শুনে। মিউজিক সার্বজনীন মনুষ্যত্বের ভাষা। কথার মানে যে সবসময় বুঝতে লাগে তা না, সুরের মধ্যেই ভাবটা অর্ধেক প্রকাশিত হয়ে যায়। এভাবে শুনতে শুনতে দেশবিদেশের অনেক রকম এথনিক-ট্র্যাডিশন্যাল-ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিকের সাথে পরিচিত হয়েছি। সামনের দিনগুলিতে সেগুলির কয়েকটা ছোট ছোট বিশ্লেষণসহ শেয়ার করার আশা রাখি।

আজকের ভিডিওটা ‘লাচো দ্রোম’ নামের একটা ডকুমেন্টারি থেকে নেয়া। এতে রোমানিয়ার ‘তারাফুল হাইদুচিলর’ নামের একটা জিপসিদল ভায়োলিন, অ্যাকোর্ডিয়ন, বাঁশি, চিম্বালম নামে সন্তুরের মত একটা বাদ্যযন্ত্র — এসব দিয়ে একটা আনন্দঘন নাচের উপযোগী সঙ্গীত তুলেছে।

জিপসিদের ইতিহাসটা অবশ্য এরকম আনন্দময় ছিল না। প্রায় এক হাজার বছর আগে তারা পশ্চিম ভারত থেকে ইউরোপের দিকে যাত্রা শুরু করে — অনেকের হিসাবে আমাদের দেশের বেদেরা এদেরই একটা অফশুট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসিবাহিনী আর তাদের হাঙ্গেরীয়, রোমানিয়ান, স্লোভাক, ইউক্রেনীয় কট্টর জাতীয়তাবাদী দোসররা ইহুদিদের সাথে সাথে পূর্ব ইউরোপের রোমা জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেক জনগণকে এক্সটারমিনেশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে হত্যা করে। পরে রোমানিয়ার কম্যুনিস্ট ডিক্টেটর চওসেস্কুর সময়েও এরা অনেক নিপীড়নের শিকার হয়েছিল। স্পেইনের ফ্রাংকো সরকারও সেখানকার ফ্লামেংকো নৃত্যসঙ্গীতের পুরোধা হিতানো জিপসিদের ওপর অনেক অত্যাচার চালিয়েছে

ইউরোপের অনেক দেশে এখনো রোমানি বা জিপসিদের দেখা হয় অস্পৃশ্য পরদেশী হিসাবে (জিপসি শব্দটা তাদের পছন্দ না, রোমানি পলিটিক্যালি কারেক্ট)। যদিও তারা সেসব দেশে শ’ শ’ বছর ধরে বসবাস করছে, ঠিকানাবিহীন ভবঘুরে হবার কারণে তাদের অনেকের ভোটাধিকার বা সিটিজেনশিপের কাগজপত্র নেই। ইতালির নতুন অতিডানপন্থী সরকারের অভ্যন্তরীণবিষয়ক মন্ত্রী ও নর্দার্ন লীগের সেক্রেটারি মাত্তেও সালভিনি ক’দিন আগে বলেছেন যে রোমাদের শুমারি করে যাদের কাগজপত্র নেই তাদের দেশ থেকে বের করে দেয়া দরকার। সব জাতির জনগণের শুমারি না করে শুধু রোমাদের টার্গেট করে এ মন্তব্য কেন করা হয়েছে, সেটা ভেবে অনেকে সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার স্মৃতিচারণ করে ভীত।

এই ভিডিওটির সুরের মধ্যে তুর্কী ও ইহুদী ক্লেজমার ধাঁচের একটা প্রভাব আছে। পূর্ব ইউরোপে রোমানিরা এসেছিল তুরস্ক-মিশর হয়েই (জিপসি শব্দটার শব্দমূল ‘ঈজিপ্শীয়ান’)। আর পূর্ব ইউরোপের ইহুদীরা একসময় বলতে গেলে জিপসিদের মতই স্থাবরসম্পত্তিহীন ভবঘুরেই ছিল। অতএব ‘ফেলো ট্র্যাভেলার’ এই দুটো গ্রুপ পরস্পরের সঙ্গীত আর ভাষাকে প্রভাবিত করেছে।

 

যুক্তির যুগ এবং ইবনে রুশদের উত্তরাধিকার

 

দ্য এইজ অফ রীজন — মার্কিন-ইংরেজ দার্শনিক টমাস পেইনের একটি বইয়ের নাম। হিন্দুপুরাণে যেমন বর্তমান যুগকে বলে কলিযুগ, সে রকম পেইন অষ্টাদশ শতকের শেষে হাঁটে হাঁড়ি ভেঙ্গে বলে দিলেন বর্তমান হল গিয়ে যুক্তির যুগ। তাঁর বইটি সেসময় রক্ষণশীল খ্রীষ্টানরা ভালভাবে না নিলেও এ আসলে গোপন কোন কিছু ছিল না যে, নতুন একটা যুগে মানুষ ইতিমধ্যেই পদার্পণ করেছে, আর তাদের জীবন পরিবর্তিত হতে শুরু করেছে। গ্যালভানির জৈববিদ্যুৎ আর স্টেভেনসনের বাষ্পইঞ্জিন আবিষ্কারের পরপর পশ্চিম ইউরোপ তখন শিল্পবিপ্লবের জন্যে প্রস্তুত। যুক্তিবাদী চিন্তাধারাকে পিছু টেনে আটকে রাখার শক্তিগুলি আগের যুগে যেধরনের অত্যাচার করেছিল, তার কারণে তাদের ওপর মানুষের ভক্তি উঠে গিয়েছিল।

উন্নতির এ পর্যায়ে পৌঁছুতে কিন্তু অনেক চরাই-উৎরাই পেরোতে হয়েছে পশ্চিমা বিজ্ঞানীদের। পেইনের আগে এসেছিলেন রনেসঁস যুগের দাভিঞ্চি, গ্যালিলেও, নিউটন, দেকার্ত। তাঁদের সবাই যে ভাগ্যবান ছিলেন তা নয়, টাইকো ব্রাহে আর জোর্দানো ব্রুনোকে অগ্নিআহুতি দিতে হয়েছিল। এঁরা কেউই নাস্তিক ছিলেন না। ব্রুনো বিশ্বাস করতেন, যদি পুরো বিশ্ব শুধু একটা পৃথিবী নিয়ে হয়, তাহলে তার স্রষ্টা কল্পনার তুলনায় অতিক্ষুদ্র। তিনি বিশ্বাস করতেন, খোদা আর তাঁর সৃষ্টির মাহাত্ম্য তাদের অসীমতায়। বলা বাহুল্য, ক্যাথলিক চার্চ যা বাইবেলে পায় তার সাথে এসবের মিল নেই, অতএব ‘চড়াও ওকে শূলে!’

ইউরোপীয় সভ্যতার ‘আধুনিক’ হয়ে ওঠার পিছনে অন্যান্য অনেক সভ্যতার অবদান আছে। যেমন চীনাদের আবিষ্কার করা কাগজ-বারুদ তৈরির আর মুদ্রণের প্রক্রিয়াকে তারা শৈল্পিক রূপ দেয়। কিন্তু চীনাদের এসব উদ্ভাবন ছিল চাহিদাভিত্তিক আর হাজার বছরের ভুল করে করে শেখা প্রযুক্তির ফল। বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা যেতে পারে ট্রায়াল-এন্ড-এরর প্রক্রিয়া। এর থেকে দক্ষ হল, যুক্তিবাদের ওপর স্থাপিত বৈজ্ঞানিক পন্থা, অর্থাৎ একটি প্রাকৃতিক ঘটনা কেন ঘটে, তার পিছনে কি কি কারণ আছে, সেগুলি কি নিয়মে চলে, আর এই উপপাদ্যগুলি প্রমাণের জন্যে কি ধরনের পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ দরকার। আর এসবের উত্তর জানার ফলে আমরা পেতে পারি নতুন কোন প্রযুক্তি।

এই যুক্তিবাদী পদ্ধতি ইউরোপীয় মনীষীরা পেয়েছিলেন আরব মুসলিম ও ইহুদী বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে। আরবদের থেকে তারা জ্যোতির্বিদ্যা, রসায়ন, চিকিৎসা — এসব সংক্রান্ত অনেক তথ্য পেয়েছিলেন। কিন্তু সবচে’ বড় যে ধারণাটা আরবদের হাত ঘুরে ইউরোপীয়রা ফিরে পেয়েছিল, তা হল তাদেরই প্রাচীন গ্রীসের দার্শনিকদের যুক্তিবাদী চিন্তাধারা। অ্যারিস্টোটল, প্লেটো — এঁদের কোন লেখাই তখন ল্যাটিন বা গ্রীকে তারা পড়েনি, পড়েছিল আরবীতে। আর আরব মনীষীদের যারা এগুলিকে পুনর্জন্ম দিয়েছিলেন, তাঁরা ছিলেন ইসলামী স্বর্ণযুগের ধারক-বাহক। এদের মধ্যে ইবনে সিনা উল্লেখযোগ্য, তার পরেই ইবনে রুশদ। আর ইহুদী ধর্মাবলম্বী মুসা বিন মাইমুন, যার কারণে ইহুদী সমাজেও একটা দার্শনিক গতিশীলতা এসেছিল।

এদের মধ্যে ইবনে রুশদের লেখার মধ্য দিয়েই ইউরোপীয় আদি মনীষীরা যুক্তিবাদ শেখেন, আর তাঁকে এখনো বলা হয় সেক্যুলারিজমের জনক (সেক্যুলারিজমের অর্থ বাংলায় করে ধর্মনিরপেক্ষতা, এটা খুবই সংকীর্ণ অসম্পূর্ণ অনুবাদ)। তিনি ছিলেন আন্দালুসিয়ার রাজসভার কাজী আর মালিকী মতবাদের বিশেষজ্ঞ। তাঁর যুক্তিবাদের উদাহরণ দিই। মোমবাতি আলো দেয় কেন? এর উত্তরে তিনি ও তাঁর শিষ্যরা বলবেন যে, মোমে আছে দাহ্য পদার্থ, অগ্নির সংস্পর্শে আসলে রাসায়নিক বিক্রিয়া হয় আর তার থেকে উত্তাপ হয়, সে কারণে আলো। এ ঘটে খোদার করে দেয়া প্রাকৃতিক নিয়মেই, খোদাকে প্রতিটা মোমবাতি জ্বলার জন্য আলাদা করে আদেশ করতে হয় না, মোমবাতি জ্বলে ওঠো। আর এভাবে ক্রিয়াকারণ জানার মাধ্যমেই আমরা খোদাকে ভালভাবে জানতে পারি, আর তাঁর তৈরি করে দেয়া প্রাকৃতিক নিয়মাবলীকে ব্যবহার করতে পারি নিজেদের জীবনটাকে একটু সহজ করার জন্য। এই সামান্য ব্যাপারটাই হলো যুক্তিবাদ।

ইবনে রুশদের বিপরীতে সেসময় ছিল সনাতনী সুন্নী গোষ্ঠী আশারী, তাদের নেতার নাম সবাই একটু আধটু শুনেছেন — হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী। তিনি ইবনে রুশদের চিন্তাভাবনাকে সম্মান করতেন, কিন্তু ছিলেন সুফী অদৃষ্টবাদের প্রবক্তা। তিনি ইবনে সিনার যুক্তিবাদ খন্ডন করে একটি বই লিখেন। তাঁর হিসাবে মোমবাতি জ্বলে কারণ খোদা অপরিসীম শক্তিমান এবং এ জগতের কোন ঘটনা নেই তাঁর নির্দেশব্যতীত সংঘটিত হওয়ার। প্রতিটি মোমবাতিকে তিনিই ব্যক্তিগতভাবে আদেশ করেন প্রজ্জ্বলিত হওয়ার, তাতে সে জ্বলে। আর যদি তিনি আদেশ করেন কোনটিকে না জ্বলার, তাহলে শতবার আগুন দেয়ার পরও সে জ্বলবে না, আর তা হবে তাঁর একটি মুজিজা বা অলৌকিকতা।

আমরা আজ মসজিদে গাজ্জালীর নাম শুনি, কিন্তু ইবনে সিনা বা ইবনে রুশদের নয়। তাঁরাও তো প্রখ্যাত ফকীহ বা মুজাদ্দেদ (যার অর্থ কিন্তু সংস্কারক) ছিলেন। কেন শুনি না? কারণ, কার্যকারণ বুঝে বুঝে যদি খোদাকে জানতে-বুঝতে হয়, তাহলে তা অনেক কঠিন কাজ, আর প্রাকৃতিক নিয়মের বেড়ায় স্রষ্টা হয়ে যান দূরের কেউ। সাধারণ মানুষ এতকিছু বোঝে না, কষ্টও করতে চায় না। তারা ভাবতে পছন্দ করে স্রষ্টা অনেক নিকটে, আর সকলের অদৃষ্টলিখন করে দেয়া আছে, সে গন্ডি পেরোনো মানুষের অসাধ্য।

আজ মসজিদে ইবনে রুশদের বই শিক্ষা দেয়া হলে আমরা শিখতাম, মানুষকে খোদা ভাল-মন্দ যাচাইয়ের ক্ষমতা-স্বাধীনতা দুটোই দিয়েছেন, দিয়েছেন প্রকৃতির ওপর নিয়ন্ত্রণ আনার বুদ্ধি। একটি বড় গন্ডির মধ্যে মানুষ তার স্বাধীনতা খাটাতে পারে, তার কল্পনাপ্রতিভাকে কাজে লাগাতে পারে। যুক্তি দিয়ে যাচাই করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে কিসে তার লাভ।

আজ কি কেউ মসজিদে ইবন রুশদদের চিন্তাধারা শেখাচ্ছেন? জানতে পারলে আমায় বলবেন!

(লেখাটি শেষ করার পর জানতে পারি ইবনে রুশদের গতকাল ১৪ই এপ্রিল ছিল ৮৯২তম জন্মবার্ষিকী!)

শুভ নববর্ষ ১৪২৫

শুভ বাংলা নববর্ষ!

পহেলা বৈশাখ যারা মনে করেন ‘হিন্দুয়ানি অপসংস্কৃতি’, আশা করি তাদের জন্যে এই পোস্টটি কিছুটা শিক্ষামূলক হবে।

অনেকে বলেন রাজা শশাংকের সময়ে, সপ্তম শতকে, নাকি বঙ্গাব্দের যাত্রা শুরু। তা হতে পারে, কিন্তু সনাতনী হিন্দু জ্যোতিষশাস্ত্রের সাথে সে সময়কার সব ভারতীয় রাজত্বের হিসাবই ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল, সম্ভবত আলাদা করে বঙ্গাব্দ ব্যাপারটা ছিল না। এই অব্দের প্রচলনের মূল তাই অনেকে ধরেন আমাদের দেশের হিন্দু রাজ-রাজড়াদের ইতিহাসে প্রথিত।

কিন্তু সেটা প্রমাণ করা কষ্টসাপেক্ষ, আর রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট।

যেটুকু আমরা প্রমাণসহ বলতে পারি, সেটা হলো সম্রাট আকবরের সময় যখন দেখা গেল আরবী চান্দ্র হিজরী সন ধরে কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল প্রজাদের কর আদায় করা কঠিন (কারণ তাতে ঋতু ওলটপালট হয়ে যায়), তখন সম্রাটের নির্দেশে পুরনো মাসগুলি রেখেই সৌর সন তৈরি করা হয়। তাতে কৃষকদের সুবিধা হয় সময়মত কর দিতে, আর বাংলা সেসময় ভারতের অন্যতম কৃষিপ্রধান অঞ্চল ছিল।

অনেকে বলেন মঙ্গল শোভাযাত্রা এসব হিন্দু ঐতিহ্য। পুরোপুরি সত্য নয়, এর সাথে জড়িত বাংলার নবাব মুর্শিদকুলী খানের সময় প্রচলন করা রাজপুন্যাহের পহেলা বৈশাখের ‘করপ্রদানযাত্রা’। সকল প্রজারা তাদের যা যা বাৎসরিক কর দেয়ার মত আছে, তাই নিয়ে রাজা বা রাজকীয় প্রতিনিধির কাছে যেত, এরই জাতিস্মৃতি আমি মঙ্গল শোভাযাত্রার মধ্যে দেখতে পাই। এখনো চট্টগ্রামের পাহাড়ী অঞ্চলে এরকম রাজপুন্যাহ উৎসব হয়।

রাজপ্রতিনিধিরাও এসময় প্রজাদের আদর করে দু’বেলা আপ্যায়ন করতেন। এই আপ্যায়নের ঐতিহ্যটা মুর্শিদকুলী খান করতেন ইসলামী বা আরবী ঐতিহ্যের অতিথিপরায়ণতার খাতিরেই। এর জাতিস্মৃতি আমাদের রমনার বটমূল আর পান্তা-ইলিশ খাওয়ার মাঝে।

হিন্দুধর্মাবলম্বীরা অনেকে ধর্মীয়ভাবে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করেন, কিন্তু সেটা পরে এসেছে, কারণ যারা বণিক, তারা নতুন হালখাতা খুলতেন লক্ষ্মী-গণেশের আশীর্বাদ নিয়ে। অর্থাৎ নতুন বছরটা আগে এসেছে, পরে তার ধর্মীয় যোগাযোগ।

যারা চৈত্রসংক্রান্তির সাথে পহেলা বৈশাখকে জোড়া লাগানোর চেষ্টা করেন, তাদের জন্যে বলি যে এটা চৈত্রের শেষ দিনে পালন করা হলেও, এর সাথে স্প্রিঙ ইকুইনক্স বলে বহু প্রাচীনকাল থেকে পালিত আরেক পরব জড়িত। সেটার আসল তারিখ মার্চের ২০ হলেও সেটা কিভাবে চৈত্রের শেষে চলে আসল সে এক ঐতিহাসিক গবেষণার বিষয়।

আরো বলি যে এখনকার ইরান, যেটা কিনা ইসলামী গণপ্রজাতন্ত্র, তাদের নববর্ষ বা নওরোজ পালন হয় ঠিকঠাক মার্চের ২০ তারিখ। অর্থাৎ খাস চৈত্রসংক্রান্তিতে। এ তাদের প্রাক-ইসলামী ঐতিহ্য, কিন্তু কেউ সেটার ‘বিধর্মী’ শিকড় ঘাঁটাতে যায় না।

আপনার নববর্ষ আনন্দময় আর প্রাচুর্যপূর্ণ হোক!

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!