সদাকা আর ৎজেদাকা

আমাদের কম্পানির সহপ্রতিষ্ঠাতা আরউইন জেকবস ছিলেন এমআইটি পাশ ইলেক্ট্রিকাল ইনজিনিয়ার আর অধ্যাপক, পরে অন্টরপ্রনর। বিলিওনিয়ার এই ভদ্রলোক ও তার পরিবার সান ডিয়েগোসহ ‌অনেক জায়গায় প্রচুর দানখয়রাত করেন। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া সান ডিয়েগোতে ১০০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি দান করেন, বিশ্ববিদ্যালয়টির কলেজ অফ ইনজিনিয়ারিংয়ে তার নাম অংকিত। সান ডিয়েগো সিম্ফনির পাবলিক রেডিও অনুষ্ঠানও হয় তার অনুদান ও নাম নিয়ে।

সান ডিয়েগোর এমন আরেক দানবীর আর্নেস্ট রেডি। এখানকার শিশু হাসপাতালে ১৪০ মিলিয়ন ডলার দান করেন। সে থেকে হাসপাতালের নাম রেডি চিলড্রেনস। ইউসিএসডির কলেজ অফ ম্যানেজমেন্ট একইভাবে তার দাননামধন্য। তিনি ধনী হয়েছেন ব্যাংকিং ও রিয়েল এস্টেট থেকে।

এ দুজনের কেউই পিতামাতার কাছ থেকে উচ্চশিক্ষার একটা লেগ্যাসি ছাড়া কোন পারিবারিক ধন নিয়ে যাত্রা শুরু করেননি। দুজনের মধ্যে আরেকটা কমন ব্যাপার হল তারা এসেছেন ইহুদী পরিবার থেকে।

এত বড় অবতারণা করলাম পোস্টের প্রথম ছবি কটি নিয়ে বলার জন্য। একটি ছবি ইসরাইলের মধ্যোপসাগরতীরবর্তী তেল আবিব-জাফা শহরের আল-বাহর মসজিদের প্রবেশদ্বারে তোলা। এ এলাকায় খুব কাছাকাছি চার-পাঁচটি মসজিদ। বেশ মানুষ হয়। ওয়েস্ট ব্যাংক থেকে গাড়ি আসছে উইকেন্ডে, নারী-পুরুষ নামাজ পড়ছে। নামাজের পর হেজাবপড়া মহিলাদের দেখা যাচ্ছে সাগরতীরে হাওয়া খেতে। মসজিদটি ১৬৭৫এ প্রতিষ্ঠিত হয়ে এখনো টিকে আছে। দানবাক্সে “সদাকার” আবেদন করা হয়েছে।

ইসলাম অনুসারে জাকাত ফরজ দান আর সদাকা ঐচ্ছিক। সাধারণত জনসাধারণের মঙ্গলের জন্যে সদাকার দানখয়রাত যায় মসজিদ, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল প্রভৃতিতে। দরিদ্র আত্মীয়-স্বজন পরিচিত-অপরিচিত যে কাউকে সে দানটি যে কোন সময় করা যায়, জাকাতের মত ধরাবাঁধা সময় নেই। তবে জাকাত-সদাকা গ্রহণযোগ্য হবার কিছু নিয়ম আছে, যথাযথ প্রাপক কিংবা উদ্দেশ্য থাকতে হবে। ইসলামের ইতিহাসবিদদের মতে অবশ্য সদাকা ও জাকাত উভয়েই নাকি আদি ইসলামী রাষ্ট্রে বাধ্যমূলক ছিল।

ওদিকে যারা রাব্বিনিকাল জুডাইজম অনুসরণ করেন, অর্থাৎ তোরা’র ওরাল ল’ মানেন, তারাও মুসলিমদের মত ৎজেদাকা বা সেদাকা নামে দানখয়রাত করেন। এটি অবশ্য জাকাতের মত ফরজ। ছবিতে যে ৎজেদাকা বাক্স দেখছেন, সেটি রাখা ওয়েস্টার্ন ওয়ালের কম্পাউন্ডে ঢোকার কাছে, জুয়িশ কোয়ার্টার থেকে নেমে আসা পাথরের সিঁড়ির ধারে। দরিদ্র পরিবারদের কল্যাণার্থে অর্থ সাহায্য চাওয়া হয়েছে। হিব্রুতে এমন দানবাক্সের নাম “পুশকা।” মসজিদের মত সিনাগগেও বাক্স চালাচালি করে অর্থসংগ্রহ হয়।

ইসলামের মত ইহুদী ধর্মেও সদাকা দেবার বিশেষ নিয়ম মানতে হয়। সবাই সদাকা পাবার যোগ্য নয়। প্রাচীন ইসরাইল ও জুদা’র ইহুদী গেরস্তরা ক্ষেত থেকে ফসল তোলার পর যেটা উদ্বৃত্ত থেকে যেত, সেটা দান করে দেয়াটা ছিল বাধ্যতামূলক। সে উদ্বৃত্ত যে দরিদ্র মানুষদের কাছে যাবে, ক্ষেত থেকে সেটা সংগ্রহের জন্যে তাদের খাটানোটাও ছিল কড়া বারণ। দান করতে হবে এমন মানুষকে যারা সে দানের মাধ্যমে ধীরে ধীরে স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে। দরিদ্রদের দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়া তো যাবেই না, বরং ৎজেদাকার প্রাপ্য টাকার মালিক আসলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পক্ষে খোদা স্বয়ং!

আরবী সদাকা আর হিব্রু ৎজেদাকা মূলে একই শব্দ। এদের উভয়ের অর্থ সদাচার। ইসলামী স্বর্ণযুগে গাজ্জালী-ইবনেরুশদের প্রায় সমসাময়িক ইহুদী মহামনীষী মুসা ইবনে মাইমুন বা মাইমনিডেস ৎজেদাকা ও অন্যান্য ধর্মাচার নিয়ে বেশ বিস্তারিত ব্যাখ্যা লিখে গেছেন। সে তালিকায় ৎজেদাকার মধ্যে পড়ে অর্থদান, সুদবিহীন ঋণ, দরিদ্রের কর্মসংস্থান, প্রভৃতি। দানটি হতে পারে স্বনামে কিংবা বেনামে, প্রাপক জানতে পারে কে দানটি দিচ্ছে, নাও জানতে পারে।

বর্তমান যুগের ইহুদীরা তাদের উপার্জনের একটা বড় অংশ দান করে দেয়, ৎজেদাকা নামে হোক বা না হোক। বিশেষ ধর্মীয় অনুষ্ঠানের দিনগুলিতে একাধিক দরিদ্র মানুষকে অর্থ বা অন্নদান একই কাতারে পড়ে। ৎজেদাকার জন্যে অর্থটিও বেশ বুঝেশুনে বরাদ্দ করতে হয়, যেন সেটি অগ্রহণযোগ্য উপায়ে অর্জিত না হয়।

জেকবস-রেডিদের দানখয়রাতকে তারা নিজেরা কেউ ৎজেদাকা/সদাকা দাবি করেনি। কিন্তু তারা যে পটভূমি থেকে উঠে এসেছেন, সেখানে অবশ্যই এমন দানখয়রাতের পরিবেশ দেখে এসেছেন। উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্যে ইহুদী পরিবারে যেমন উৎসাহ দেয়া হয়, তেমন বদান্যতাও শেখানো হয়। ইসলামেও এ দুটির মর্যাদা বেশ উচ্চে। বহু ধর্মপ্রাণ মুসলিম একই জীবনাচার অনুসরণ করেন। যারা ধর্মপরায়ণ ইহুদী ও মুসলিম, তাদের মধ্যে এ ব্যাপারে পার্থক্য খুব কম।

এডিটঃ আরো কিছু জায়গার ছবি দিলাম যারা দানখয়রাতের ওপর নির্ভরশীল কিংবা অনুদানে প্রতিষ্ঠিত। জেরুজালেমের মাকাস্সেদ ইসলামী চ্যারিটি হাসপাতাল, জুয়িশ কোয়ার্টারের ভোহল জাদুঘর, জাতিসংঘের পরিচালিত জেরুজালেম গার্লস স্কুল। প্রথমটি ফিলিস্তিনী স্বাস্থ্যসেবা চ্যারিটি, বহু হাসপাতাল আছে তাদের। দ্বিতীয়টিতে বহু মানুষ দানখয়রাত করেছে, যাদের উল্লেখযোগ্যদের নাম ফলকে লেখা। যাদের নাম দেখা যাচ্ছে তারা নিউ ইয়র্কের ইহুদী পরিবার। তৃতীয়টি জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠিত পশ্চিম তীরের বহু স্কুলের একটি। এদের ফান্ডিং আসে আমেরিকা, ইউরোপ, জাপান ও গাল্ফ আরব দেশগুলির সরকার থেকে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বের সকল দেশের মধ্যে মাথাপিছু অনুদানের হিসাবে এই আনরয়া প্রজেক্টের খরচ সর্বোচ্চ।

ইসরাইল ও জর্দান ভ্রমণঃ ভূমিকা

কাজের সুবাদে গত সপ্তাহ ঘুরে এলাম ইসরাইলের তেল আবিব। আর ব্যক্তিগত সময় কাটালাম পবিত্র শহর জেরুজালেম আর জর্দানের প্রাচীন পেত্রা নগরীর ধ্বংসাবশেষে। এ এক অনন্য অভিজ্ঞতা!

শুধু যে স্থানগুলি দেখা হল তা নয়, উপস্থিত ছিলাম একেবারে সঠিক সময়ে। সাথে ছিল কয়েকজন চীনা ও ভারতীয় সহকর্মী।

ডোম অফ দ্য রকের পাদদেশে ওয়েস্টার্ন ওয়ালে শুক্রবার মধ্যরাতে শুরু হয় ধর্মপ্রাণ ইহুদীদের প্রার্থনা। নতুন বছরের প্রথম দিন রোশ হাশানা’র আগমনের দিনখানেক আগ থেকেই সন্ধ্যার পর এখানে লোকসমাগম শুরু হয়। লাগোয়া সিনাগগে প্রার্থনা-বিলাপ চলে। কাগজে লেখা অনুশোচনার প্রার্থনা কেউ গুঁজে দেয় দেয়ালের পাথরের ফাঁকে ফাঁকে। বেশ আবেগঘন পরিবেশে ইসলামী মাহফিলের মত সুর করে “সেলিকোত” প্রার্থনা চলে। গত ২৬ তারিখ ছিল রোশ হাশানা। দশম দিন ইয়ম কিপ্পুরের সাথে আশুরার মিল উল্লেখযোগ্য। হাদীস ঘাঁটালে পাওয়া যাবে, এক সময় দুটো দিন একই ছিল।

শুক্রবার দুপুরে জুম্মার নামাজে অংশ নিলাম পবিত্র মসজিদুল আকসার কম্পাউন্ডে। হাজারে হাজারে মুসলিম জেরুজালেমের পুরনো শহরের অলিগলি বেয়ে এই প্রাচীন প্রান্তরে এসে প্রার্থনা করল, অনেকে খোলা আকাশের নিচে কড়া রৌদ্রের মধ্যে। বেশ কয়েকটি অজুর স্থান আছে। অবাক হতে পারেন যে ওয়েস্টার্ন ওয়ালের সামনেও এমন দুটো অজুখানা, ইহুদীরা প্রার্থনার আগে ব্যবহার করে। মসজিদুল আকসায় মহিলাদের নামাজের জন্য আলাদা করে বরাদ্দ কুব্বাত আস-সাখরার (ডোম অফ দ্য রক) উঁচু প্ল্যাটফর্ম। আগের রাতে দেখেছি ইহুদী মহিলাদের জন্যেও পাশে আলাদা পার্টিশন করা জায়গা বরাদ্দ। নামাজের পর পুরো কম্পাউন্ড প্রদক্ষিণ করলাম। হোটেলের রিসেপশনিস্ট যুগল যে আরব সেটা বুঝেছিলাম। তাদের জিজ্ঞেস করাতে তারাই সাহস যুগিয়েছিল যে শুক্রবারের নামাজে এখানে আসা সবচেয়ে নিরাপদ। ঢোকার সময় দু’দু’বার সূরা ফাতিহা পাঠ করে প্রমাণ দিতে হয়েছে যে আমি মুসলিম। তারপরেও বোধহয় পেছনে আঁঠার মত ফেঁউ লেগে ছিল। অমুসলিম সহকর্মীদের সাথে পরে আরেকবার ঢুকেছি। সেটা অন্য রাস্তায়, আরো মহা কড়া নিরাপত্তা। সে বিষয়ে পরে বলব। ওয়েস্টার্ন ওয়াল কম্পাউন্ডে ঢোকার সময়েও সিকুরিটি চেক পার করে যেতে হয়েছিল।

শুক্রবার বিকেলেই যীশু খ্রীষ্টের ক্রুশবহন করে চলার পথ ভিয়া দোলোরোসা ধরে একে একে চৌদ্দটা স্টেশনে চক্কর মারতে গিয়ে ভাগ্যক্রমে পেয়ে গেলাম ফ্রান্সিসকান ক্যাথলিক ফ্রায়ারদের দৈনিক শোভাযাত্রা। তাদের অনুসরণ করছে খ্রীষ্টান তীর্থযাত্রীর দল। মুসলিম কোয়ার্টারের অলিগলি বেয়ে একে একে নয়টি স্টেশন স্পর্শ করার পর শোভাযাত্রা গিয়ে ঢুকল খ্রীষ্টান ধর্মজগতের কেন্দ্র চার্চ অফ দ্য হোলি সেপালকারের ভেতর। চৌদ্দ স্টেশনের পাঁচটিই এর ভেতর। সেখানে ফ্রান্সিস্কান পাদ্রীদের প্রার্থনাগীতির অনুরনণ মনোমুগ্ধকর। খ্রীষ্টান ধর্মমতে যীশু খ্রীষ্টকে যে পাথরের সমাধিতে শায়িত করা হয়েছিল, তারপর সেখান থেকে তিনদিন পর পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠেছিলেন, সেই সেপালকারের সামনে চলল ধর্মগীতি। ওপরের লেভেলে গলগোথা টিলার ওপর যেখানে যীশু খ্রীষ্টকে রোমানরা ক্রুশবিদ্ধ করেছিল, সেখানেও গেলাম এর পর। ফ্রানসিস্কান মংকদের পর সেখানে এল আর্মেনিয়ান অর্থডক্স পাদ্রীদের দল, চলল তাদের প্রার্থনাগীতি। জেরুজালেম শহর নিয়ে তিন ধর্মের ঐতিহাসিক সংঘাতই যে শুধু হয়েছে তা নয়, চার্চ অফ দ্য হোলি সেপালকারের বিভিন্ন অংশের দখল নিয়েও নানা খ্রীষ্টান ধর্মমতের মাঝে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ইতিহাস আছে। এখন টাইম আর স্পেস শেয়ার করে স্থিতিশীলতা বজিয়ে রাখা হয়েছে।

সব মিলিয়ে ওয়ান্স ইন এ লাইফটাইম এক্সপেরিয়েন্স। সামনের দিনগুলিতে অল্প অল্প করে আরো তথ্য দেব। আপাতত ঐ তিনটি ধর্মাচার নিয়ে ‌ধারণ করা অল্প কটি ভিডিও শেয়ার করছি।

 

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!