সুফী জিকির

তিনারিওয়েন বলে মালির একটা ব্যান্ড আমার বেশ পছন্দ। ২০১০এ ফিফা বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এরা গান করেছিল। পশ্চিম আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ মিউজিকাল ট্রাডিশনেই অধিকাংশ মার্কিন জনরের উৎপত্তি।

তিনারিওয়েনের সদস্যরা অবশ্য কালো নয়, তারা বেরবের বা তুয়ারেগ নামক একটি মিশ্র জাতের। ইউরোপীয় বা মেডিটেরানিয়ান জনগোষ্ঠীতে প্রাচীন বেরবের জিন রয়েছে। অর্থাৎ প্রাগৈতিহাসিক ইউরোপকে জনধ্যুষিত করেছিল এদের পূর্বপুরুষদের একটি অংশ।

আলহাসান আগ তুহামি বলে তিনারিওয়েনের এক গায়ক অদ্ভূত এক চরিত্র। নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে লম্ফজম্প দিয়ে দর্শকদের মাতিয়ে রাখে। কখনো মনে হয়, সেই করতে করতে ঘোরের মধ্যে চলে গেছে আলহাসান।

ভদ্রলোকের সাথে ঠিক এক বছর আগে একটা কনসার্টে মোলাকাত হয়, ফরাসীতে কিছু বাতচিতও চলে। এথনিক মিউজিকে আগ্রহ থাকাতে এধরনের কনসার্টের সুযোগ মিললে হাতছাড়া করি না।

আলহাসান আর তার সঙ্গীরা কৃষ্ণাঙ্গপ্রধান মালিতে স্বজাতির স্বাধীনতার জন্যে প্রথমে অস্ত্র ধরেছিল, পরে গীটার। ছোটবেলা কেটেছে রেফ্যুজি ক্যাম্পগুলিতে। চাদ নামের একটি দেশে গন্ডগোল পাকাতেও লিবিয়ার গাদ্দাফি এদেরকে ব্যবহার করে।

মালির কৃষ্ণাঙ্গদের মত তুয়ারেগরাও মুসলিম। কিন্তু আরবদের সাথে তাদের ভাষা-কালচার মেলে বেশি। আরব দিগ্বিজয়ের যুগে তুয়ারেগরা ‘মাওয়ালি’ বা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন সামরিক অভিযানে উমাইয়্যা খেলাফতকে সহায়তা করে। তাদের একজন তারেক ইবনে জিয়াদ, স্পেন অভিযানের সফল সেনানায়ক। অবশ্য উত্তর আফ্রিকার অধিকাংশ জনগণ তখনও মুসলিম হয়নি। সেটি হয়েছে অনেক পরে। আমাদের দেশের মতই সুফী সাধকদের সংস্পর্শে এসে।

আলহাসান যে গানের তালে তালে তিড়িংবিড়িং লাফ দিয়ে ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছে, এটাও আসলে তাদের সুফী ঘরানার একটা ব্যাপার। রুমির ‌অনুসারী তুর্কী-ইরানী মাওলানা সেক্ট যেমন সেমা নৃত্য করে ঈশ্বরের নিকটবর্তী হবার প্রচেষ্টায়, সেরকম উত্তর আফ্রিকার সুফীরাও গানবাজনার তালে তালে শরীর দোলানোর মাধ্যমে ‘ফানা’ বা সেল্ফ-অ্যানাইহিলেশনের একটা অনুভূতির জগতে চলে যায়।

তিনারিওয়েনের আলহাসানের তিড়িংবিড়িং

 

মরক্কোর গানাওয়া সুফী সেক্টটির সদস্যদেরও ফেজ-মারাকেশ-এসাউইয়া শহরের রাস্তাঘাটে কারাকেব নামের করতাল আর সিন্তির বাদ্যযন্ত্র নিয়ে সম্মোহনী ট্র্যান্স মিউজিক করতে দেখা যায়। বাদ্যের সাথে তারা মাথাটিকে এমনভাবে দোলায় যাতে ফেজটুপির টিকলিটি সমানে ঘুরতে থাকে। বলা বাহুল্য, এরও লক্ষ্য ট্র্যান্স বা মন্ত্রাচ্ছন্ন অবস্থায় পৌঁছনো, যেটাকে রুমির মত কবিরা বলেছেন খোদাপ্রেমের মদে মাতাল হওয়া।

মরক্কোর গানাওয়া সুফী মিউজিক

সুফী তরিকাগুলির এধরনের রিচুয়ালের ধর্মীয় ভিত্তি জিকর বা খোদাকে স্মরণ করা। মূলধারাতে জিকির ফরজ নয়, কিন্তু আমাদের দেশের মুসলিম কেউ যদি কখনো জিকিরে অংশ না নিয়ে থাকে তাহলে অবাক হবো। এ প্রক্রিয়ায় আলো-আঁধারিতে একদল মানুষ জোরে জোরে আল্লাহর বিভিন্ন নাম পাঠ করতে থাকে। কখনো নবীজীর প্রশংসাসূচক দরূদ। কখনো সাধু-সন্ত-সাহাবীদের নাম। পুরো ব্যাপারটিতে একটা আধ্যাত্মিক অনুভূতি আসে, যেটা মনপ্রাণকে হাল্কা করে দেয়। মূলধারায় অবশ্যই নামাজ-রোজার গুরুত্ব জিকিরের থেকে ‌অনেক বেশি।

কিন্তু সুফীদের মধ্যে জিকিরের গুরুত্ব পঞ্চস্তম্ভের সমপরিমাণ। ভারতীয় উপমহাদেশের বাউল-কাওয়ালী-ধামাল এগুলির কথা না হয় না বললাম। সাবসাহারান আফ্রিকার নাইজেরিয়া, সুদান, সোমালিয়া — এসব দেশগুলিতেও তিড়িংবিড়িংকরা সুফী দলের দেখা মেলে। মিশরে রয়েছে মাওলানাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত তান্নুর। সিরিয়া আর আরবের অন্যান্য স্থানে সেমার পাশাপাশি চলে হাধরা। সেখানে কালিমা-দরূদ-জিকিরের সঙ্গত হয় দারবুকা-ড্রাম, কখনো নে নামক তুর্কী বাঁশি। মাথায় পাগড়ি আঁটা শ্মশ্রুমন্ডিত সুফীরা তার তালে তালে শরীর সামনে পিছে করে।

তুরস্কের সেমা

নাইজেরিয়ার কানোর তিড়িংবিড়িং জিকির

সিরিয়ার নকশবন্দী হাধরা

 

সিরিয়ার আলেভী সেমা আরেক অদ্ভূত জিনিস। শিয়া মিস্টিক এ গ্রুপটা সেদেশে সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। এদের ছেলে ও মেয়েরা একসাথে সেমা নৃত্যে অংশ নেয়। জিকির চলে আলী ও অন্যান্য শিয়া সন্তদের নামে। কুর্দীসমাজেও একইরকম মহিলা-পুরুষ মিশ্রিত সেমা করে থাকে। ইরাকের কুর্দী নারী যোদ্ধাদের ছবি খবরে প্রায় আসে। এদের জেন্ডার রোল বহু হাজার বছর ধরে সমানুপাতিক।

সিরিয়া-তুরস্কের আলেভী সেমা

ককেশাসের রুশ প্রজাতন্ত্র চেচনিয়া ও ইঙ্গুশেতিয়ার মানুষও মূলত সুফী মুসলিম। এদের জিকির আতা’য়ী দেখলে মূলধারার মুসলিমরা মূর্ছা যাবে। কলেমা পড়তে পড়তে দু’স্তরে গোল হয়ে দাঁড়ানো মানুষগুলি ড্রামের তালে বানরের মত দু’পায়ে লাফায়, আর হাতে তালি দেয়। মাঝে দলনেতার ইঙ্গিত অনুযায়ী চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। সে ঘোরার দ্রুততা কখনো বাড়ে, কখনো কমে। কারো কিন্তু ছন্দপতন নেই, পুরো দলটি যেন হয়ে গেছে একটিমাত্র দেহ। চেচেন মহিলারাও ভিতরঘরে বসে আলাদা জিকির করে।

চেচনিয়ার জিকির আতা’য়ী

সুফীদের ছোঁয়া কিন্তু পূর্বে বাংলাদেশে এসে শেষ হয়নি। ইন্দোনেশিয়া ও চীনে কখনো কোন মুসলিম সৈনিক পদার্পণ করেনি। সেসকল স্থানে ইসলাম গেছে সুফী মতবিশ্বাসের ওপর ভর করে। বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে এরাও জিকিরে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যায়।

ইন্দোনেশিয়ার সুফী দরূদ-জিকির

চীনের সুফী জিকির

 

বিশ্বের অন্যান্য অনেক ধর্মেও আধ্যাত্মিকতাবাদ রয়েছে। খ্রীষ্টানধর্মের উৎপত্তিই গ্নস্টিক আর ডায়োনাইসিয়ান মিস্টিসিজমের মধ্যে। ইহুদীদের রয়েছে কাবালা। তিব্বতী তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মে মন্ত্রপাঠ আর ভূত তাড়ানোর নাচের মধ্যে একই বিষয়। বর্তমানকালের খ্রীষ্টান ইভানজেলিস্ট অনেক গ্রুপকেও দেখা যায় নাচগান করতে করতে একটা একস্ট্যাটিক স্টেটের মধ্যে চলে যায়। তাতে নাকি ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীও সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরে। সত্যমিথ্যা বলা মুশকিল।

যাই হোক, অন্য ধর্মের আধ্যাত্মিকতাবাদে সুফী জিকিরের কোন সমান্তরাল খুঁজে পেলাম না। একমাত্র যেটার সাথে মিলল তা হলো নামিবিয়া-বতসওয়ানার বুশম্যান বা খয়সান জনগোষ্ঠীর হিলিং সেরেমনি। এরা বহু প্রাচীন এক জাত। ইউরোপীয়দের সংস্পর্শে আসার আগে এরা হাজার বছর ধরে প্রস্তর যুগেই আটকে ছিল। এদের ধর্মবিশ্বাস অ্যানিমিস্ট, অর্থাৎ প্রকৃতির বিভিন্ন বস্তু-প্রাণীর স্পিরিট আর পূর্বপুরুষদের আত্মার শক্তিতে এরা বিশ্বাসী। ট্রাইবের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে ভূত তাড়ানোর হিলিং সেরেমনি হয়। সেখানে এরা লাইন ধরে মাটিতে পদাঘাত করতে করতে মন্ত্রপাঠ করে। তাদের নেতৃত্ব দেয় মেডিসিনম্যান বা শামান। মন্ত্রপাঠ করতে করতে একসময় ঘোরের মধ্যে চলে যায় শামান। তার মুখ থেকে তখন অবোধ্য সব কথা বের হতে থাকে। সারারাত এরকম অনুষ্ঠানের পরদিন অসুস্থ ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলে বলে সে সুস্থ হয়ে গেছে।

নামিবিয়ার খয়সান হীলিং সেরেমনি

‌একইরকম ব্যাপার আলাস্কা-আমেরিকার নেটিভদের কালচারে রয়েছে। উদ্দেশ্য একই, হীলিং।

এটা অবাক করার মত ব্যাপার নয়। মানুষ দলগতভাবে হাজার হাজার বছর ধরে এ ধরনের রিচুয়াল করে আসছে। গ্রুপ সাজেশনের মত একটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার এর মধ্যে আছে। মুসলিম জিকির নিয়ে গবেষণা করা বিজ্ঞানীরা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করেছেন যে, জিকিররত মানুষদের হৃদস্পন্দন একে অপরের সাথে সিনক্রনাইজড হয়ে যায়। এক সাথে উত্থানপতন হয়। পুরো এক্সপেরিয়েন্সটা থেকে একটা পরিপূর্ণতা নিয়ে ফেরে অংশগ্রহণকারীরা। অর্থাৎ এর থেরাপিউটিক একটা ভ্যালু রয়েছে। এটাকেই হয়ত রুমির মত সুফীরা বলেছেন ডিভাইন ইনটক্সিকেশন।

সুফীদের এসব নাচগানবাদ্য অবশ্য মূলধারার অনেকের যেমন পছন্দ নয়, তেমন প্রগতিশীলদেরও নয়। বিশের দশকে তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক আইন করে সুফী অনেক দরগা বন্ধ করে দেন। কারণ তারা নাকি পশ্চাদমুখী। শুধু পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্যে বেঁচে থাকে সেমা সেরেমনি। বর্তমানকালের সৌদী-সালাফীদেরও এসব অপছন্দ। সে ধারাটির পয়সা ঢালার কারণে যেসব দেশে সুফী ইসলাম ছিল মূলধারা, তারা এখন কোনঠাঁষা হয়ে গেছে। ব্যাপারটা ইন্দোনেশিয়া থেকে মরক্কো পর্যন্ত সত্য। তবে কুরআন-হাদীসে এ ভাবে জিকির করার কোন ইনস্ট্রাকশন আসলেই নেই।

যেভাবে এসকল রীতি রিজিওনাল ইসলামে এসেছে, তাকে বলে সিনক্রেটিজম। ধর্মপ্রচারকরা দেশে দেশে গিয়ে একটা কমন থীম বের করে সেটার ইসলামীকরণ করেছেন। তাতে স্থানীয়দের আদি ধর্মবিশ্বাস থেকে ইসলামে প্রবেশের পথ পরিষ্কার হয়ে গেছিল। সাধারণ মানুষ গভীর ধর্মতত্ত্ব বোঝে না, কিন্তু জিকির বা হিলিং সেরেমনির সোশাল-পারসোনাল বেনেফিটগুলি ঠিকই বোঝে। যদি সুফী ধর্মপ্রচারকরা বতসওয়ানাতে পৌঁছতেন, তাহলে খয়সান জনগোষ্ঠী গা-টা ঢেকেঢুকে খোদারসুলের নামেই জিকির করত।

অর্থাৎ মুসলিম লোকাল সংস্কৃতিগুলির ওপরের স্তরটাকে ঘষে তুলে ফেললে যেটা দেখি, সেটা অনেক প্রাচীন একটা সাবস্ট্রেট। আর পূর্ব থেকে পশ্চিমে সে সাবস্ট্রেট একই। প্রস্তরযুগের মানুষ যে অ্যানিমিস্ট শামানিজমে বিশ্বাস করত, সেটাই এই সাবস্ট্রেট। মানুষ হিসাবে আমাদের ফিজিকাল-সাইকলজিকাল ক্যারেক্টারের খুব একটা রূপান্তর হয়নি। সেই পরিচয়ে নাচগানবাদ্য এন্টারটেইনমেন্ট নয়, বরং প্রকৃতি আর আত্মাদের বশে আনার প্রচেষ্টার ম্যাজিক।

লাস্কো গুহার শিকারের চিত্র সেই একই ম্যাজিক। গুহাচিত্র অবশ্য গুহাতেই রয়ে গেছে, কিন্তু এসকল জিকির-হিলিং সেরেমনি গুহা থেকে আমাদের সাথেই বেরিয়ে এসেছে। আর এখনো বহাল তবিয়তে বেঁচে রয়েছে আমাদের ধর্ম-সংস্কৃতিতে।

আফ্রিকার দাসবাণিজ্য

হাতির দাঁতে বানানো অসাধারণ এ মুখোশটি প্রদর্শিত হচ্ছে নিউ ইয়র্কের মেট মিউজিয়ামে। তৈরির স্থান পশ্চিম আফ্রিকার বেনিন সাম্রাজ্য, কাল আনুমানিক ১৫২০। মডেল, সাম্রাজ্যের অধিকর্তার (ওবা) রাণীমাতা স্বয়ং। মাতৃকুলীন সমাজব্যবস্থায় তাঁর অপরিসীম প্রভাব ছিল, যেটা নিখুঁতভাবে উঠে এসেছে তাঁর প্রতিচ্ছবিতে।

হাতির দাঁতে তৈরি বেনিনের রাণীমাতার আদলে মুখোশ, নিউ ইয়র্ক মেট মিউজিয়াম, ষোড়শ শতক।

ঊনবিংশ শতকে ইউরোপীয়দের ধারণা ছিল আফ্রিকার মানুষ উন্নত সভ্যতা স্থাপনের উপযুক্ত নয়। এ চিন্তার মূলে দাসপ্রথা আর বহু শতক পূর্বের দু’জাতের সমতাপূর্ণ সম্পর্কের বিস্মরণ। তারপর আবিষ্কৃত হয় কিছু অসাধারণ ব্রোঞ্জ মূর্তি, আর বেনিন রাজ্য থেকে লুটতরাজ করে ব্রিটিশরা নিয়ে আসে এরকম কিছু প্রাচীন নিদর্শন। এসব মন্দ কাজের ভাল প্রতিফলও আসে। পশ্চিমা গবেষকরা ত্রিশের দশক থেকে নতুন করে আফ্রিকার প্রাচীন ইতিহাস উদ্ঘাটনের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

ফিরে আসি মুখোশ প্রসঙ্গে। একটু খেয়াল করে দেখলে মুখোশের চারধারে একটা অদ্ভূত জিনিস চোখে পড়বে। রাণীমাতার কোঁকড়ানো চুলের একেকটি বিনুনি কিন্তু চুল নয়! অদলাবদলি করে মাডফিশ নামে এক মাছের প্রতিকৃতি, আর এক পর্তুগীজ নাবিকের শ্মশ্রুমন্ডিত মুখাবয়ব! (২য় ছবি)

বেনিনের রাণীমাতার মুখোশের ডিটেইল।

আইবেরিয়ান উপদ্বীপে মুসলিম শাসনের অবক্ষয়ের মধ্যে উত্থান স্বাধীন পর্তুগাল রাজ্যের। চতুর্দশ শতকে আরব প্রযুক্তি সম্বল করে একটি নাবিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেন প্রিন্স হেনরি দ্য ন্যাভিগেটর। নতুন নতুন দূরপাল্লার সব জাহাজ তৈরি শুরু হয়। সেগুলি নিয়ে আটলান্টিকের তীর ধরে দক্ষিণে যাত্রা শুরু করে তারা। মূল লক্ষ্য, ইতালির জেনোয়িজ আর তুরস্কের অটোমানদের একচেটিয়া প্রাচ্যদেশীয় বাণিজ্যের বিকল্প পথ বের করা।

সেই অভিযানের প্রথম পর্ব আমেরিকা-ভারত নয়, ছিল আফ্রিকার আবিষ্কার। ১৪৬০ থেকে শুরু করে ১৪৯০এর দশক পর্যন্ত পর্তুগীজরা একে একে কাবো ভের্দে দ্বীপপুঞ্জ, সেনেগাল, গাম্বিয়া, সিয়েরা লেওন, নাইজেরিয়া, বেনিন প্রভৃতি অধুনা আফ্রিকান দেশগুলির উপকূলে অবতরণ করে।

এসব সাবসাহারান দেশগুলি মোটেও অনুন্নত ছিল না, কোন কোনটি ছিল পুরোদস্তুর সাম্রাজ্য। এদের মধ্যে মালি, বেনিন, সোনিনকে, মালিনকে ইত্যাদির নাম উল্লেখযোগ্য। কিছু কিছু জাতি সাক্ষর ছিল যেমন মালির তিমবাক্তু ইসলামী-আরবী সংস্কৃতির ধ্বজাধারী ছিল। আর বেনিন-নাইজেরিয়ার রাজ্যগুলি সাক্ষর না হলেও কাঠ, আইভরি, ব্রোঞ্জ শিল্পে অগ্রসর ছিল।

পর্তুগীজদেরকে এসব জাতি প্রথমে ভেবেছিল তাদের মৃত পূর্বপুরুষদের প্রত্যাবর্তিত আত্মা হিসাবে। তাদের ধর্মে সাগর ছিল জীবিত-মৃতের মধ্যে পৃথককারী পর্দা। পর্তুগীজদের শ্বেত বর্ণও তাদের সে ধারণার সাথে মিলে যায়। অর্থাৎ প্রথম সে মোলাকাতে আমেরিকার অ্যাজটেক-ইংকাদের মত শ্বেতাঙ্গদের দৈবশক্তির প্রতিনিধি হিসাবে ভাবার যথেষ্ট কারণ ছিল।

তারপর ধীরে ধীরে যত সময় গেছে দু’জাতির মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রগাঢ় হয়েছে। পর্তুগীজ বণিকরা বেনিন, সাপি, কোংগো রাজ্যে তৈরি আইভরি বা হোয়াইট গোল্ড নিয়ে স্বদেশে বিক্রি করেছে। বিনিময়ে আফ্রিকার রাজ্যগুলি কিনেছে পর্তুগীজ আগ্নেয়াস্ত্র।

আজকে অনেকে আফ্রিকান বলতে একটি অভিন্ন জাতি ভেবে থাকলে ভুল ভাববেন। বিভিন্ন ভাষাপরিবারের বিভিন্ন গোষ্ঠী কালের পরিক্রমায় এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তরিত হয়েছে। এদের মধ্যে সংঘাতও হয়েছে। উপকূলীয় রাজ্যগুলির জন্যে অভ্যন্তরের সাম্রাজ্যগুলিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যে বন্দুক ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

বিনি পর্তুগীজ সল্ট সেলারে চিত্রিত হয়েছে ইউরোপীয় যোদ্ধা, ষোড়শ শতক, ম্যুজে দ্য কে-ব্রঁলি

এছাড়াও পর্তুগালে ছিল সোনা, মরিচ ও রকসল্টের বিশাল চাহিদা। সেগুলিরও সাপ্লাই আসে পশ্চিম আফ্রিকার উপকূল থেকে। ৩য় ছবির বেনিন আইভরিতে তৈরি সল্টসেলারটিতে পর্তুগীজ যোদ্ধাকে চিত্রিত করা হয়েছে।

আরো যে রসদটির যোগান দেয় পর্তুগীজদের নেটিভ দোসররা তা হলো কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস। আটলান্টিকের দাসবাণিজ্যের শুরু কিন্তু এটা নয়। আফ্রিকার রাজ্যগুলিতে আগে থেকেই দাসপ্রথা ছিল। ভিন্নজাতের শত্রুদের পরাজিত করে দাস বানিয়ে তাদের গতর খাঁটানো হত। তাছাড়াও উত্তরের ‘বারবারি কোস্টের’ মুসলিম রাজ্যগুলি দাসব্যবসা করত। একই রকম অবস্থা বিরাজমান ছিল ভারত মহাসাগরের উপকূলে। সেখানে জানজিবার দ্বীপ ছিল আরবে দাস রপ্তানির ঘাঁটি।

পর্তুগীজ-স্প্যানিশ ও পরবর্তীকালের ব্রিটিশ-ফরাসী-ডাচরা কিন্তু চাইলেই হৈচৈ করে আফ্রিকান দাস ধরে নিয়ে যেতে পারত না। আফ্রিকার অভ্যন্তর অঞ্চলে ঢোকার সাধ্য তাদের ছিল না। কারণ জলাজঙ্গলের ম্যালেরিয়া ও অন্যান্য রোগশোককে তারা ভীষণ ভয় পেত। আর কম লোকবল নিয়ে বিশাল সেনাশক্তির সাম্রাজ্যগুলির মোকাবিলা করার সাহস-সামর্থ্যও তাদের ছিল না। আফ্রিকার কলোনিয়ালাইজেশন তুলনামূলক অধুনার ইতিহাস — মোটে ঊনবিংশ শতকের শেষভাগ। ততদিনে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়েছে।

ঊনবিংশ শতকের পশ্চিমাদের মত মধ্যযুগীয় পর্তুগীজরা যে কৃষ্ণাঙ্গ মানেই দাস এরকম মনোভাব পোষণ করেনি। বরং তারা নিজেদের পড়শী গ্রানাদার মুসলিম রাজ্যগুলিতে দেখেছে শ্বেতাঙ্গ খ্রীষ্টানদের ধরে দাস বানানো হয়েছে। কোন ক্ষেত্রে অনেক ইউরোপীয় দেশে ঋণগ্রস্তরাও দাসে পরিণত হত। অপরদিকে তুরস্ক ও উত্তর আফ্রিকার সুলতানরাও দরিদ্র শ্বেতাঙ্গ দেশগুলি থেকে ক্রীতদাস পাচার করত। তাদের অনেকে ছিল সেক্সুয়াল স্লেভ যাদের স্থান হত সুলতানের হারেমে — ছেলে-মেয়ে দুইই।

অর্থাৎ পর্তুগীজদের সাথে প্রথম মোলাকাতের পর আফ্রিকার একাধিক প্রভাবশালী রাজ্যই তাদের দাস সাপ্লাই দিয়েছে। আর কৃষ্ণাঙ্গ মানেই দাস এটাও ইউরোপে ছিল না। ৪র্থ ও ৫ম ছবিতে রেনেসাঁস যুগে অংকিত চিত্রকর্মে বনেদী কৃষ্ণাঙ্গ দুই ব্যক্তির ছবি দিয়েছি। সত্যি বলতে একটা সময় দাস আর বনেদীবংশ মিলে কৃষ্ণাঙ্গরা লিসবন শহরের জনসংখ্যার দশ শতাংশ হয়ে যায়।

১৫৭০ থেকে ১৫৮০র মধ্যে আঁকা এ ছবিতে পর্তুগালের লিসবন বন্দরের দৈনন্দিন দৃশ্য দেখানো হয়েছে। কৃষ্ণাঙ্গ ঘোড়সওয়ারের পাশাপাশি আরো বেশ কিছু কসমোপলিটান ব্যাপারস্যাপার চলে এসেছে।

১৫২০/২৫এ ডাচ চিত্রকর ইয়ন মোশতারতের আঁকা পোরট্রেট অফ অ্যান আফ্রিকান ম্যান।

দাসবাণিজ্যে জোয়ার আসতে শুরু করে আমেরিকার আবিষ্কার ও স্প্যানিশদের প্রতিপত্তি বাড়ার সাথে সাথে। একটি ত্রিমুখী বাণিজ্যের সূচনা হয় ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে। আফ্রিকা থেকে ‘কাঁচামাল’ নিয়ে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে খালাস। সে ‘কাঁচামালের’ শ্রমে উৎপন্ন চিনি, রাম ও অন্যান্য মূল্যবান দ্রব্য নিয়ে ইউরোপের বাজারে বিক্রি। তারপর ইউরোপের বন্দুক ও ফিনিশড গুডস নিয়ে আফ্রিকায় যাত্রা, বিনিময়ে আবার ‘কাঁচামাল’ জাহাজে উঠানো।

আফ্রিকান শ্রমের এরকম এবিউজ হয়ত হত না যদি না কিছু রাজনৈতিক পরিবর্তন পশ্চিম আফ্রিকার রাজ্যগুলিকে ওলটপালট করে দিত। প্রাচীন মালি সাম্রাজ্য ভেঙে তৈরি ছোট ছোট রাজ্যগুলির সাথে নতুন বড় সাম্রাজ্যগুলির সংঘাতের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। সপ্তদশ শতকে ঘানার আশান্তি সাম্রাজ্য বেশ প্রতাপশালী হয় ওঠে। কৃষিতে কিছু উন্নত প্রযুক্তি আবিষ্কারের ফলে তারা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠে। জনসংখ্যা বিস্ফোরণের ফলে তারা উত্তরে ও পশ্চিমে মালিংকে রাজ্যগুলির সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এর ফলশ্রুতিতে যুদ্ধলব্ধ দাসদের একটা বিশাল বাজার তৈরি হয়।

একই ঘটনা ঘটে আরেকটু পূর্বে। নবাগত দাহোমে জাতি মূল জনগোষ্ঠী এদোদের ওপর শাসন কায়েম করে। সে ব্যবস্থায় বিজিতরা ছিল দাস। দাহোমের উপকূলেও দাসরপ্তানিকেন্দ্র গড়ে ওঠে।

অর্থাৎ আফ্রিকার পলিটিকাল ল্যান্ডস্কেপ ছিল আটলান্টিক দাসব্যবসার বিশাল আকারের অন্যতম বড় কারণ। ব্রিটিশ-ফরাসী-ডাচরা হয় সেই মার্কেটের এন্ড ইউজার। যদি আফ্রিকান মিডলম্যানরা বলত দাস সাপ্লাই বন্ধ, তাহলে ইউরোপীয়দের পক্ষে শ্রম আমদানির উপায় হত হয় ইনডেনচার্ড সার্ভিচ্যুড — যেটার শিকার দাসপ্রথাপরবর্তীকালে দরিদ্র আইরিশ-স্কটিশ-ইংলিশরা হয়েছে। নয়ত পেইড লেবার।

ঊনবিংশ শতকের শুরুতে ব্রিটিশ আর মার্কিনরাই আবার প্রথম দাসব্যবসার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে শুরু করে। প্রথমে নিজেদের বন্দরে ক্রীতদাস রপ্তানি নিষিদ্ধ করে এই শতকের প্রথমভাগে। এরপর ব্রিটিশরা জোরপূর্বক স্প্যানিশ-পর্তুগীজ জাহাজে হামলা চালিয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের মুক্ত করত। ব্রিটিশ-ফরাসীরা উত্তর আফ্রিকার বারবারি কোস্টের সুলতানদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয় সেসব রাজ্যের জলদস্যুতা আর শ্বেতাঙ্গ নাবিকদের ধরে দাস বানানোর প্রতিশোধ হিসাবে। (৬ষ্ঠ ছবি)

অষ্টাদশ শতকের প্রথমভাগে উত্তর আফ্রিকার আলজেরিয়ার তুর্কিসমর্থিত দা’ইয়ির রাজ্যে শ্বেতাঙ্গ দাসত্বের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় দেশগুলি শোরগোল তোলে। ব্রিটিশ এক কাপ্তানের বর্ণনা সম্বলিত এই পুস্তিকাটি প্রকাশিত হয় তখন। ১৮১৬ সালে ব্রিটেন ও ফ্রান্স আলজিয়েরস আক্রমণ করে।

উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি নতুন দাস রপ্তানি বন্ধ হলেও মার্কিনদের স্বদেশে এতদিনে যেসব কৃষ্ণাঙ্গ দাসের আগমন হয়েছে, তাদের দাস বংশধরদের মুক্তির কোন ব্যবস্থা হয়নি। তার জন্যে তাদের অপেক্ষা করতে হয় আরো কয়েক দশক ও একটি যুদ্ধের জন্য। পশ্চিমা ও পশ্চিমাশাসিত দেশগুলির মধ্যে সবচে’ শেষে দাসপ্রথা রহিত হয় পর্তুগীজ ব্রাজিলে — ১৮৮০র দশকে।

আরব দেশগুলিতে দাসবাণিজ্য চলে ত্রিশের দশক পর্যন্ত। প্রকারান্তরে এখনো তা চলছে। ৭ম ছবিতে মক্কার এক বণিকের পাশে তার শ্বেতাঙ্গ দাসকে দেখা যাচ্ছে। তার চেহারাতে পূর্ব ইউরোপীয় স্লাভিক ছাঁচ দৃশ্যমান। এরা অটোমান সাম্রাজ্যে পরিচিত ছিল সিরকাসিয়ান হিসাবে।

মক্কার হেজাজী সওদাগরের সাথে তার শ্বেতাঙ্গ সিরকাসিয়ান দাস, ১৮৮৬-৮৭

আফ্রিকান আমেরিকানদের বেদনাময় ইতিহাস এখনো মার্কিন রাজনীতিতে অহরহ আসে। এই বিতর্কে কতটা হিস্টরিকাল কনটেক্সট টানা হয় তা খুবই প্রশ্নসাপেক্ষ। এতে কোন সন্দেহ নেই, মার্কিনদের দাসপ্রথার ক্ষণস্থায়ী ও তুলনামূলক অধুনা ইতিহাসে এর আগের একাধিক শতকের ব্রিটিশ-ফরাসী-ডাচ-স্প্যানিশ-পর্তুগীজ ইতিহাস ঢাকা পড়ে গেছে।

আরো ঢাকা পড়ে গেছে আটলান্টিক দাসব্যবসার কৃষ্ণাঙ্গ মদদকারীদের ইতিহাস। পোস্ট কলোনিয়াল আফ্রিকার প্রথম স্বাধীন দেশ ঘানা। তার প্রথম প্রেসিডেন্ট কয়ামে ন্ক্রুমা প্যান-আফ্রিকান জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা (৭ম ছবিতে চে গেবারার সাথে)। তার হাত ধরেই আরো বহু সাবসাহারান দেশ স্বাধীন হয়। সেসব দেশের স্কুল কারিকুলামে পড়ানো হয় প্রাচীন আফ্রিকান দেশগুলির প্রতিপত্তি-অগ্রগতির কথা। বলা হয়, শ্বেতাঙ্গ ঔপনিবেশিক শক্তিদের অত্যাচারের কথা। সবই খাঁটি কথা। কিন্তু শুধু চেপে যাওয়া হয় ন্ক্রুমার স্বগোষ্ঠী আশান্তিরাই যে ছিল অন্যতম মদদকারী দাসরপ্তানীকারী রাজ্য সে কথা। চেপে যাওয়া হয় পশ্চিম আফ্রিকার এলিট বংশগুলির কথা, যারা দাসব্যবসা করে স্বদেশে বিপুল ধনসম্পত্তির মালিক হয়ে পরবর্তী প্রজন্মকে ভাল একটি ভবিষ্যত দিয়ে গেছে।

কিউবার বিপ্লবী চে গেবারার সাথে ঘানার প্রেসিডেন্ট কওয়ামে ঙ্ক্রুমা, ১৯৬৫। চে সে যাত্রায় আটটি আফ্রিকান দেশ সফর করে বাছবিচার করেন কোন কোনটিতে বিপ্লবের উর্বর ক্ষেত্র রয়েছে।

২০১৯এ ওয়াল স্ট্রীট জার্নালে একটি সাড়াজাগানো আর্টিকেল লিখে আফ্রিকান জাতীয়তাবাদীদের রোষের শিকার হন আদাওবি নওয়াউবানি নামের এক নাইজেরিয়ান পুরস্কারবিজয়ী লেখক। আজকের পলিটিকাল ক্লাইমেটে কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর অবিচার নিয়ে যারা সঙ্গত কারণেই সোচ্চার, আশা করি সেটা করার পাশাপাশি মুদ্রার এপিঠটাও তারা একটু উল্টে দেখবেন। আদাওবির লেখাটি পড়তে নিচের ছবিতে ক্লিক করুন।

সজ্ঞান সমাধিচর্চা

বিগত কয়েকটি পোস্টে বলছিলাম আদি মানুষের ধর্মবিশ্বাস আর কল্পনাশক্তির কিভাবে বিকাশ হল, তার একটা সম্ভাব্য কাহিনী। আগুনের আবিষ্কার সেই কাহিনীর কেন্দ্রবিন্দু।

অবশ্য আগুন এই প্রক্রিয়ার একমাত্র নিয়ামক হয়ত নয়, আর মানুষ এক-দুই জেনারেশনে হঠাৎ করে ‘মানুষ’ হয়ে ওঠেনি। লাখখানেক বছর তো লেগেছেই। কবে কিভাবে তার ঊর্বর মস্তিষ্কে প্রাচীন ধর্মবিশ্বাসের উদয়, তার সঠিক নির্দেশক নির্ধারণ করা কঠিন। কারণ মৌখিক ভাষা কোন ফসিল রেখে যায় না। ঠিক তেমন সঙ্গীতনৃত্য আর প্রার্থনারীতিরও কোন প্রত্যক্ষ নিদর্শন উদ্ঘাটন সম্ভব নয়।

সেকারণে নৃতত্ত্ববিদরা দু’ধরনের বাস্তব প্রমাণের মাধ্যমে মানুষের উদ্ভাবনী ক্ষমতার আরম্ভকাল নির্ধারণ করেন। পাথরের অস্ত্র যদি হয় মানুষের প্রযুক্তিগত বিবর্তনের প্রমাণ, তাহলে তার কল্পনাশক্তি বিকাশের প্রমাণ মেলে মূর্তশিল্পে আর সমাধিতে।

সেকারণে চারটি ছবি দিয়েছি। এগুলির তিনটি সভ্যতাপূর্ব মানববসতিতে প্রাপ্ত সমাধির চিত্র, আর একটির কথা পরে বলছি। ব্যাখ্যা করার আগে বলে নেই, এদের দু’টি শিকাগোর ফীল্ড মিউজিয়াম আর ওয়াশিংটনের স্মিথসোনিয়ান ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্টরিতে প্রদর্শিত। একটি স্টকহোমের মিউজিয়াম অফ ফার ঈস্টার্ন অ্যান্টিকুইটিজে। আরেকটি জার্মানির উল্ম মিউজিয়ামে।

কোভিড মহামারিতে এসকল মিউজিয়াম বন্ধ হয়ে রয়েছে বহুদিন। দর্শক সমাগম নেই। তাই আয়ের উৎস এদের সংকুচিত। ব্যয়বহুল রক্ষণাবেক্ষণ তো বটেই, যেসব গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা এ সকল জাদুঘরের কর্মীরা দেশেবিদেশে করে থাকেন, সেগুলিও স্থগিত। যদি আপনি মিউজিয়াম ভালবাসেন আর মনে করেন যে ভবিষ্যত প্রজন্মের এসকল কাহিনী জানা জরুরী, দয়া করে নিচে দেয়া লিংকে গিয়ে ফীল্ড মিউজিয়ামে কিছু দান করুন। ১২০ বছর আগে শিকাগোর এক কোটিপতির অনুদানের মাধ্যমে মিউজিয়ামটির শুরু। এ মুহূর্তে ক্রাউডফান্ডিং ছাড়া এদের উপার্জনের খুব বেশি রাস্তা নেই।

শিকাগোর ফীল্ড মিউজিয়ামের মূল গ্যালারী।

মূল কথায় ফিরে আসি। ছবিতে দেখানো সমাধিগুলির প্রথমটি মিশরের নাকাদা-বাদারি কালচারের। মৃতদেহটি মরুভূমির শুষ্ক আবহাওয়া আর ন্যাট্রন লবণের কারণে সম্ভবত প্রাকৃতিকভাবেই মামিতে পরিণত হয়েছে। সময়কাল প্রায় সাড়ে চার হাজার খ্রীষ্টপূর্ব, অর্থাৎ গিজার পিরামিডের থেকেও দু’হাজার বছরের পুরনো।

দ্বিতীয় ছবির কংকালটি আবিষ্কৃত হয়েছিল জর্দানের ডেডসীর কাছে বাবেজজারাতে। এটি সাড়ে তিন হাজার খ্রীষ্টপূর্বের। আর তৃতীয় ছবিটি আরো দূরের চীনের বানপো গ্রামের প্রস্তরযুগীয় সমাধি। সেটাও প্রায় সাড়ে তিন হাজার খ্রীষ্টপূর্বের।

মিশরের নাকাদা-বাদারি কালচারের সমাধি।

বাব-এজ-জারার প্রস্তরযুগীয় সমাধি।

চীনের বানপো গ্রামের প্রস্তরযুগীয় সমাধি।

তিনটি ভিন্ন স্থানের সমাধির ধরন প্রায় একই রকম। মাটিতে অথবা পাথরে ওভাল শেপের একটা গর্ত করে তাতে ‘ফিটাল পজিশনে’ (মাতৃগর্ভে যেভাবে থাকে শিশু) মৃতদেহটিকে শোয়ানা হয়েছে। মুখটা কোন বিশেষ দিকে ফেরানো। কোন ক্ষেত্রে সাথে দেয়া হয়েছে রঙীন নুড়ি, পাথরের অস্ত্র, আর মাটির পাত্রভরা খাবার। অর্থাৎ মানুষ ইতিমধ্যে পরকাল বলে একটা কিছু আছে সে বিশ্বাস করা শুরু করেছে। পরপারের যাত্রায় যা যা লাগতে পারে, তা প্রিয়জনের সমাধিতে দিয়ে দিয়েছে।

আজকের দৃষ্টিতে বিচার করলে মনে হতে পারে এ আর এমনকি ব্যাপার। কিন্তু মাথায় আবার প্রস্তরযুগীয় মস্তিষ্কটি ফিট করুন। কেন হঠাৎ করে মনে হলো আপনার, যে মৃতদেহটিকে সমাহিত করতে হবে, সাথে দিতে হবে প্রয়োজনীয় সব বস্তু? কেন অন্য জানোয়ারের মত মৃতদেহটি ফেলে রেখে চলে গেলেন না? আপনার পশুমনোবৃত্তিটির পরিবর্তন কেন কিভাবে হলো?

এই যে একে অন্যের জন্যে কেয়ার করার ব্যাপারটা, সেটা শিম্পাঞ্জি ছাড়াও অন্যান্য আরো কিছু প্রাণীর মধ্যে আছে, যাদের মধ্যে হাতিও পড়ে। আফ্রিকার হাতিরা নাকি মৃত্যুকালে তাদের ‘নির্ধারিত’ কবরস্থানে গিয়ে অপেক্ষা করে। বিপুলসংখ্যক হাতির কংকাল সেসব জায়গায় আবিষ্কৃত হয়েছে। হতে পারে এর মধ্যে একটা প্রাকৃতিক ব্যাপার রয়েছে। স্বল্প উন্নত মস্তিষ্কের প্রাণীও হয়ত বুঝতে পারে যে, মৃতদেহ পচনশীল, তার থেকে যে গন্ধ ও জীবাণু ছড়ায় তা জীবিতদের জন্য স্বাস্থ্যকর নয়।

এরকম ন্যাচারাল ইন্সটিংক্ট থেকে হয়ত প্রাচীন মানুষ মৃতদেহ কবর দেয়া শুরু করে। কুরআনে হাবিল-কাবিলের কাহিনীটাও অনেকটা সেরকম। কাবিল হাবিলকে হত্যা করার পর খোদার পাঠানো দাঁড়কাকের দেখাদেখি কবর খুঁড়ে ভাইকে সমাহিত করে। অর্থাৎ প্রকৃতি থেকে শেখার একটা ক্লু রয়ে গেছে গল্পটাতে।

তিনতোরেত্তোর ছবিতে হাবিল-কাবিলের কাহিনী, ১৫৫০-৫৩।

কিন্তু সমাধির সাথে সাথে অন্যান্য বস্তু দেয়ার চিন্তাটা কেন মানুষের মাথায় এল? উত্তর খুব সোজা। আদি মানুষ কল্পনার জগতে ভেবেছে তাদের পূর্বপুরুষেরা মৃত নয়, সীমানা পেরিয়ে অন্য একটি স্থানে প্রবেশ করেছে মাত্র। সেখানেও তাদের দৈহিক চাহিদা থাকবে। জীবিতদের দায়িত্ব সেসব পূরণের যথোপযুক্ত বন্দোবস্ত করা।

আদিম মানুষ কবে থেকে সজ্ঞানে এ ধরনের সমাধি দেয়া শুরু করেছে, তা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। ২০১৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার রাইজিং স্টার কেভ সিস্টেমে এক প্রাচীন প্রজাতির হোমিনিডের ফসিল আবিষ্কৃত হয়, যার নাম দেয়া হয় হোমো নালেদি। খননকার্যের এক পর্যায়ে কেভ সিস্টেমের খুব গভীরে আবিষ্কৃত হয় বেশ কয়েকটি দেহাবশেষ। সরু সুরঙ্গের মধ্যে দিয়ে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় এসকল মৃতদেহের এখানে এসে পড়াটা সহজ নয়। হিংস্র কোন প্রাণীও যে টেনে এনে এখানে ফেলবে তাও সম্ভব নয়। সব মিলিয়ে তিন লাখ বছরের পুরনো এই দেহাবশেষগুলিকে গুহার গভীরে ‘কবর’ দেয়া হয়েছে বলে কিছু নৃতত্ত্ববিদের ধারণা। এখনো এ নিয়ে বাকবিতন্ডা চলছে।

প্রস্তরযুগীয় ‘জার’ সমাধি, নিয়াহ কেভ, সারাওয়াক।

এর সাথে আবার মেলে মালয়েশিয়ার সারাওয়াকের গুহাবাসী হোমো সেপিয়েন্সদের সমাধি। এগুলি ‌অবশ্য তুলনামূলক নতুন, মোটে সাড়ে তিন হাজার খ্রীষ্টপূর্বের। বাঁশের তৈরি ঝাঁকিতে করে ফীটাল পজিশনে বসিয়ে মৃতদেহ তারা রেখে আসত গুহার টয়াইলাইট জোনে, অর্থাৎ যেখানে আলোর শেষ আর আঁধারের শুরু। পরবর্তীতে যারা মারা যেত, তাদের কবর হত তাদের প্রয়াত পূর্বপুরুষদের সাথে। এভাবে পারিবারিক গোরস্তান গড়ে উঠেছিল গুহার অভ্যন্তরে। এই টয়াইলাইট জোনই হয়ত পরবর্তীকালের ধর্মবিশ্বাসের ‘পাতাল’ — আন্ডারওয়ার্ল্ড। স্বর্গ-নরকের থেকেও ‘পাতালের’ কনসেপ্ট বেশি পুরনো।

দেড় লাখ বছর আগের হোমো নেয়ান্ডারটালেনসিসের বিশাল এক বসতি ক্রোয়েশিয়ার ক্রাপিনাতে আবিষ্কৃত হয়েছে। এর মধ্যে বেশ কিছু সমাধিও রয়েছে। ৫২ হাজার বছর আগের একটি নেয়ান্ডারটাল কবরও ফ্রান্সে আবিষ্কৃত হয়েছে। তবে নেয়ান্ডারটালের যথেষ্ট কল্পনাশক্তি ছিল কিনা তা নিয়ে এখনো বিতর্ক রয়েছে। এসব কবরে কোন সমাধিবস্তু পাওয়া যায়নি। একমাত্র ইরাকের শানিদার গুহায় নেয়ান্ডারটাল কবরে ফুলের পোলেন পাওয়া গেছিল, যদিও প্রত্নতত্ত্ববিদরা পরে বলেছেন সেটি নাকি অন্য প্রাণীর কাজ।

ইজরায়েলের কাফজা গুহায় আবিষ্কৃত প্রস্তরযুগীয় দ্বৈত সমাধি।

সন্দেহাতীতভাবে সবচে’ প্রাচীন মানবসমাধি ৯২ হাজার বছরের পুরনো। ইজরায়েলের কাফজা গুহাতে মা-মেয়ের একত্রিত কবর আবিষ্কৃত হয়েছে। সমাধিদ্রব্য হিসাবে পাওয়া গেছে রঙকরা ফোঁড়া ঝিনুক, যেগুলি সম্ভবত সুতোয় বেঁধে গলায় নেকলেস হিসাবে পড়া হত। আরো পাওয়া গেছে রেড ওকার। একধরনের পাথর গুঁড়িয়ে এই রংটি তৈরি হত। গুহাচিত্রে যেমন এর ব্যবহার ছিল, তেমন সমাহিত মৃতদেহের মুখমন্ডল রঙীন করতেও। অর্থাৎ এ কবরটির নিঃসন্দেহে ‘কালচারাল রিচুয়াল’ তাৎপর্য রয়েছে।

প্রায় এক লাখ বছর আগে এদের হোমো সেপিয়েন্স পূর্বপুরুষ আফ্রিকা থেকে প্রথম মধ্যপ্রাচ্যে পদার্পণ করে। কিন্তু দশ-বিশ হাজার বছরের মধ্যে বসতি বিলীন হয়ে যায়। সত্তর হাজার বছর আগে দ্বিতীয় চেষ্টার পর হোমো সেপিয়েন্স লেভান্ট ও আরবে স্থায়ী আবাস বাঁধতে সক্ষম হয়। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে এশিয়া, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকায়। আর মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপে এসে তাদের মোলাকাত হয় অতি দূর সম্পর্কের কাজিন নেয়ান্ডারটালদের সাথে। এমনটা অসম্ভব নয় যে দুই প্রজাতি একে অন্যের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করেছে।

স্পেনের মালত্রাভিয়েসো গুহার প্রস্তরযুগীয় শিল্প।

সমাধির সাথে সাথে যদি মূর্তশিল্পের দিকে নজর দিই, তাহলেও একটা ট্রান্সফর্মেশন ধরা পড়ে কেভ পেন্টিংয়ের শুরুতে। স্পেনের মালত্রাভিয়েসো গুহায় আবিষ্কৃত হয়েছে ৬৪,০০০ বছরের প্রাচীনতম গুহাচিত্র। এগুলির মূল বিষয়বস্তু শিকারের জন্তুজানোয়ার। এঁকেছে নেয়ান্ডারটাল কাজিনরা। মডার্ন হিউম্যানের আঁকা গুহাচিত্রও প্রায় সমসাময়িক। ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার বছরের পুরনো চিত্রগুলো ইন্দোনেশিয়া আর ইউরোপে আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব আঁকারও রিচুয়াল সিগনিফিক্যান্স রয়েছে, যেটা বিগত লেখায় বলেছি।

জার্মানিতে আবিষ্কৃত সিংহমানবের মূর্তি।

একই সময়কালের আরও যে অদ্ভূত নিদর্শনটি জার্মানিতে আবিষ্কৃত হয়েছে তার নাম লোভেনমেনশ বা লায়নম্যান ফিগার। মানুষের দেহের ওপর সিংহের মাথা লাগানো আইভরির তৈরি এই ছোট্ট ‘পুতুলটি’ ৩৫ থেকে ৪০ হাজার বছরের পুরনো। মানুষের এহেন কল্পনাশক্তির এর থেকে প্রাচীন কোন নমুনা এখনো পাওয়া যায়নি।

অন্য পশুপাখির যে ক্ষমতা রয়েছে — কিন্তু মানুষের নেই — তা দিয়ে কোন অসাধ্য সাধনের ‘ম্যাজিক’ করতে চেয়েছে হয়ত সেকালের মানুষ। যেসব বিশেষ পশুকে মানবরূপ দেয়া হয়েছে, তাদের বলা যেতে পারে অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যানিম্যাল স্পিরিট। যেমন আমার লক্ষ্য যদি হয় আকাশে দেখা উজ্জ্বল একটি নক্ষত্রে পৌঁছনো, যেখানে রয়েছে আমার প্রয়াত পূর্বপুরুষ, তাহলে আমার দরকার ঈগলের মত কোন পাখির সাহায্য।

ধরুন আমি-আপনি একটি প্রস্তরযুগীয় ক্লানের সদস্য। দলটির জন্যে ক্রান্তিকাল চলছে। শিকারীদল বার বার বিফল হয়ে ফিরে আসছে। মাংসের অভাবে বুনো ফলমূল খেয়ে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। এহেন অবস্থায় ক্লানের প্রধান হিসাবে আপনি পুরোপুরি দিগহারা। শীতের তুষারপাত সমাগত প্রায়। আপনাদের হাতে দু’টি রাস্তা। এলাকাটি ছেড়ে আরো দূরে পাড়ি জমানো যেখানে শিকার জুটতেও পারে নাও পারে। নয়ত আরো একটিবার শিকারের প্রচেষ্টা করে শীতকালটি কাটিয়ে তারপর স্থানান্তর। যুবাবয়সে বয়োবৃদ্ধদের উপদেশ কাজে দিত। কিন্তু তাদের কেউ আর জীবিত নেই। আমাকে তাই আপনি নির্দেশ দিলেন মৃত পূর্বপুরুষদের উপদেশগ্রহণের জন্যে তাদের সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা করতে।

যজ্ঞ করে একটি ঈগল শিকার করে তার পালক ও চঞ্চু দিয়ে মুখোশ বানালাম। তারপর দলবল নিয়ে, সাইকিডেলিক ওষধি শেকড়ে আগুন লাগিয়ে তার ধোঁয়া ফুঁকে, মন্ত্র পড়ে, দৌড়ঝাঁপ করলাম। তারপর হয়ত সে রাতে সত্যি সত্যি স্বপ্নে দেখলাম আমি নক্ষত্রমন্ডলে হারানো পিতা-পিতামহের সাথে পুনর্মিলিত হয়েছি। ট্রাইবের সবার অবশ্য এ বিশেষ শক্তি থাকবে না। আমার মত যার যার থাকবে, তাদের নাম ওঝা, মেডিসিনম্যান, শামান, ইত্যাদি। আর এই প্রক্রিয়ায় যে প্রাণীর স্পিরিট আমাকে সাহায্য করলো, সেটি ঈগল। আর আমার যজ্ঞে ব্যবহারের জন্যে এরকম একটা ঈগলম্যান মূর্তি কল্পনা থেকে বানিয়ে ফেলা কোন ব্যাপারই না।

বুঝতেই পারছেন আদিম মানুষের কল্পনাশক্তির দৌড় কতদূর!

প্রিয়জনকে সমাহিত করার মাধ্যমে মানুষ প্রমাণ করেছে যে শুধু পাথরের অস্ত্র তৈরিতে তার উদ্ভাবনী ক্ষমতা সীমাবদ্ধ নয়। চিন্তা করে দেখুন যে আজ থেকে ত্রিশ লাখ বছর আগে মানুষের পূর্বপুরুষ পাথরের অস্ত্র ব্যবহার শেখে। কিন্তু সে প্রযুক্তির সম্মুখ বিবর্তন পরবর্তী বিশ লাখ বছরেও তেমন একটা হয়নি।

তারপর এল আগুন, সাথে জীবনযাত্রার একটা পরিবর্তন। আর বিগত এক লাখ থেকে পঞ্চাশ হাজার বছরের মধ্যে এল আমাদের ইমাজিনেশন-ভিজুয়ালাইজেশনের ক্ষমতা। প্রস্তরাস্ত্রের টেকনোলজি আবিষ্কার করেও মানুষ তাতে আটকে ছিল লাখ লাখ বছর। আর কল্পনাশক্তির আল্টিমেট ইভল্যুশনের পঞ্চাশ হাজার বছরের মধ্যে আমরা বর্তমান বিশ্বের অধিবাসী।

ইমাজিনেশন আর ম্যাজিক-স্পিরিট-শামানিজম, সোজা ভাষায় রিলিজাস বিলিফ সিস্টেমের যে পাওয়ার অফ সাজেশন, সেটা মানবজাতিকে এমন একটা সম্মুখমুখী ঘাত দিয়েছে যার শক্তি এখনো ফুরোয়নি।

যতই বিজ্ঞানপ্রযুক্তি পড়ে জ্ঞানী হোন না কেন, যে শিকড় থেকে এই শক্তিটি মানুষ আহরণ করেছে, সেই স্পিরিচুয়াল-ম্যাজিকাল-রিলিজাস বিলিফ সিস্টেমটাকে অবজ্ঞা করবেন না!

ফীল্ড মিউজিয়ামে দানের লিংক:

জেসমিন ফুল

Featured Video Play Icon

মোলিহোয়া, জেসমিন ফুল, নামের এই চীনা গানটা আমার বেশ পছন্দ।

খুঁজে খুঁজেও অনেক আগে দেখা অন্য আরেকটা ক্লাসিকাল অর্কেস্ট্রা সংস্করণ পেলাম না। আজকাল চীনা সরকারের দাপটে গুগল-অ্যাপল সবাই ‘সংবেদনশীল’ ইন্টারনেট পাতা পরিষ্কার করতে ব্যস্ত। এ যেন আরেক কালচারাল রেভোল্যুশন!

কেন জেসমিন ফুল গানটার ভাল সংস্করণটা পেলাম না, এ ভাবতেই মনে পড়ল ২০১১তে তুনিসিয়াতে যে আরব স্প্রিংয়ের বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল, তার নাম দেয়া হয়েছিল জেসমিন বিপ্লব। আর তার কিছুমাত্র ছোঁয়া চীনেও লেগেছিল।

গণতন্ত্রের দাবিতে কিছু চীনা যে ইন্টারনেটভিত্তিক বিক্ষোভ শুরু করেছিল, তার অন্যতম মাস্কট হিসাবে তারা এই জেসমিন ফুল গানটাকে ব্যবহার করার চেষ্টা চালায়। গানটা খুবই জনপ্রিয়। কিন্তু এর মধ্যে বিক্ষোভ-বিপ্লবের নামমাত্র নেই।

গানটির বিষয়বস্তু হলো জেসমিন ফুলের সুগন্ধ-সৌন্দর্যের কাব্যিক বর্ণনা।

তাহলে কেন এ গান চীনের কমুনিস্ট সরকারের টনক নড়ালো? কেন গানটির শিরোনামের চীনা অক্ষরগুলি সেদেশের মোবাইল সেটে ফিল্টার করে নিষিদ্ধ করা হলো ২০১১তে? শুধু তাই না, এমনকি জেসমিন কালচারাল ফেস্টিভাল নামে একটি আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক সম্মেলনও সে বছর বাতিল করে দেয়া হয়।

বুঝাই, ধৈর্য ধরুন।

মোলিহোয়ার উৎপত্তি চীনের চিং সাম্রাজ্যের শাসনামলে, অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি। যে কাব্যের মাধ্যমে ফুলের সৌন্দর্য বর্ণনা করা হচ্ছে, তার বিলাসিতা কেবল অবস্থাপন্ন বনেদী পরিবারদের পক্ষেই সম্ভব। যেকোন দেশের সংস্কৃতিতে ধনাঢ্য জমিদারী পরিবার কিংবা বণিকগোষ্ঠী যে পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকায় থাকে, সেটা আমাদের বাংলা সংস্কৃতির ইতিহাসেও ষোল আনা সত্য।

মোলিহোয়া গানটা একসময় চিং সাম্রাজ্যের বেসরকারী জাতীয় সঙ্গীতও ছিল এবং পশ্চিমেও ধীরে ধীরে অপেরা পীসের মাধ্যমে জনপ্রিয়তা পায়। আমি যোগাযোগটা ঠিক জানি না, কিন্তু আন্দাজ লাকমে অপেরার ফ্লাওয়ার ডুয়েট (ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের বিজ্ঞাপনের মিউজিক ছিল) হয়তবা, হয়তবা…. মোলিহোয়া দিয়ে প্রভাবিত।

সে যাই হোক, বিংশ শতকের শুরুর ভাগে চিং সাম্রাজ্যের পতন হয়। নানা ওয়ারলর্ডের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। সে যুগের অবসান ঘটান কোমিনতাং পার্টির জাতীয়তাবাদী নেতা চিয়াংকাইশেক

কিন্তু তাঁর শাসনামলেই চীন হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রথম ক্যাজু্য়ালটি — ১৯৩৯এ যুদ্ধের অফিশাল শুরুর আগেই। একদিকে উত্তরপশ্চিমে মাওয়ের কম্যুনিস্ট গেরিলা, আরেকদিকে উত্তরপূর্বে জাপানের আগ্রাসন।

তারপরও চীনের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তখন অনেক পরিবর্তন আসে। অনেক ছাত্র মার্কিন-ইউরোপ থেকে নতুন ধ্যান-ধারণা নিয়ে এসে চীনা সংস্কৃতিকে আধুনিক রূপ দেন।

মার্কিনদের দীর্ঘকালীন সহযোগিতা আর মাওয়ের সাথে চুক্তি করে জাপানীদের ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হন চিয়াংকাইশেক (সোভিয়েতদের মাঞ্চুরিয়া দখল একেবারে শেষের সুবিধাবাদী ঘাত।)

যুদ্ধচলাকালীন সময়েই মাও তার লংমার্চ বিপ্লব ইত্যাদি শুরু করেন। ১৯৪৯এ কোমিন্তাংওয়ালাদের তাইওয়ানে ভাগিয়ে দিয়ে মেইনল্যান্ডে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন কায়েম হয়।

প্রথম বিশ-পঁচিশ বছর কম্যুনিস্ট শাসনামলে ধেঁয়ে ধেঁয়ে ভারিশিল্পের বিস্তার, শিক্ষা-চিকিৎসাক্ষেত্রের উন্নতি সাধিত হয়। নিঃসন্দেহে তা ছিল সমাজতন্ত্রী পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ফসল, এর বিপরীতে কী মূল্য দিতে হয়েছিল, তা না বললাম।

ষাটের দশকে মাওয়ের মাথায় ভূত চাপে যে যত দুনিয়ার ইউরোপীয় সংস্কৃতি উচ্ছেদ করতে হবে। প্রতিষ্ঠা করতে হবে চীনা গণমানুষের সংস্কৃতি। সব পুরাতনের ধ্বংস করে গড়তে হবে নতুন ইন্সটিটিউশন।

ষাটের দশকে কালচারাল রেভোলুশনের সময় ধ্বংস করা হয় বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্মের পুরনো পাণ্ডুলিপি আর মূর্তি।

তাঁর নামে দাঁড়িয়ে গেলো বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্টিজান পাইওনিয়ার ছাত্রগোষ্ঠী। চললো মবরুল। তারা যেখানেই পশ্চিমা কিছু কিংবা চীনা চিংযুগের বা সামন্তযুগের কিছু পেলো, সব পুড়িয়ে-গুঁড়িয়ে ধ্বংস করে ফেলল। পান্ডুলিপিহীন হলেন গবেষক, যন্ত্রবিহীন বাদ্যযন্ত্রী, ভগ্নমন্দিরের নিচে ভগ্নহৃদয় পুরোহিত।

 

কালচারাল রেভোলুশনে নিগৃহীত হন শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের মানুষ

এসময়ে চিংযুগের অনেক চীনা সঙ্গীতের লিপি হারিয়ে যায় বা ধ্বংস করে ফেলা হয়। কেউ কেউ মাটিতে পুঁতে লুকিয়ে ফেলে। কিছু অনেক পরে বেরিয়েছে আবার, বেশিরভাগই বেরোইনি।

বলা বাহুল্য, ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৬এর এই নৈরাজ্যকর সময়ে প্রচুর মানুষ বিনা কারণে বিনা বিচারে শুধু মাত্র পশ্চিমা চর বা কোমিন্তাং-চিংদরদী ইত্যাদি রাজাকারী অভিযোগের সন্দেহে প্রাণ হারায়। অনেক গবেষকের হিসাবে সে সংখ্যা প্রায় দু’কোটি।

চীনা সঙ্গীতের রাতারাতি পরিবর্তন ঘটে। আগে পশ্চিমা কিংবা চিং প্রভাবে ‘শিল্পের খাতিরেই ছিল শিল্প’। এখন আর্ট হয়ে দাঁড়ালো ‘উচ্চতর লক্ষ্য অর্জনের হাতিয়ার’, তথা নিষ্পেষিত জনগণের নামে মাও ও কম্যুনিস্ট পার্টির গুণকীর্তন। আর তাও যদি না হয়, লোকসঙ্গীতকে তুলে ধরা হলো অপেরা ফর্মে — এ যেন এক ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। ‘ওহে গ্রাম্যবালিকা, কোথা যাও একটু দাঁড়াও…’ ইত্যাদি হলো অপেরা-অর্কেস্ট্রার বিষয়বস্তু। নয়ত, ‘আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা, ক্ষেতে কাজ করি চল’, নয়ত টাইগার টিলার মাথায় দাঁড়িয়ে চেয়ারম্যান মাওয়ের লাল বই নিয়ে লাফালাফির স্মৃতিচারণ।

তো এসবের মধ্যে মোলিহোয়ার মত স্বল্প কিছু পুরনো গান বেঁচে রয়েছিল। কারণ, এসব গানের কথায় নেই কোন সম্রাট-বুর্জোয়ার নাম, নেই বিদ্রোহ-বিক্ষোভের আভাষ। শুধুই একটি নিষ্পাপ ফুলের গুণকীর্তন।

আর ঠিক এ কারণেই নিষ্পেষক কমুনিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের প্রতীক হিসাবে ২০১১তে এ গানটি বেঁছে নেয়া হয়। সে বিপ্লব বেশি দূর যায়নি। কারণ, রাষ্ট্রের হাতে মোবাইল-ইন্টারনেটের সকল কলকব্জা। টের পাওয়া মাত্রই মোলিহোয়ার যাত্রাভঙ্গ।

এখনও হংকংশিনজিয়াংয়ে স্বগোত্রীয়-অন্যগোত্রীয়দের ওপর একই কলকব্জা শানিয়ে তাদের জায়গামত পুরো দিচ্ছে কমুনিস্ট রাষ্ট্র। যারা রাষ্ট্রের সুফলভোগী তাদের কোন বিকার নেই। কোন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না, কবে জেসমিন ফুল মোলিহোয়ার মুক্তি আসবে চীনে।

মুঘল চিত্রশিল্পে ইউরোপীয় প্রভাব

আজকে লিখছি মুঘল আমলের চিত্রকর্মের ওপর ইউরোপীয় প্রভাব নিয়ে। ব্রিটিশ কলোনিয়াল আমলের বহু আগ থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশে যে পর্তুগীজ, স্প্যানিশ, ওলন্দাজদের আগমন ঘটেছে, আর সে বাণিজ্যের ফলে স্বভাবতই নতুন ধ্যানধারণার মুক্তবিস্তার হয়েছে, সে ইতিহাস আজ ঢাকা পড়ে গেছে শুধুমাত্র ঊনবিংশ-বিংশ শতকের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার রাজনৈতিক ইতিহাসের পুরু প্রলেপে। আমার বিচারে সেটা ইউরোপীয় প্রভাব পরিপূর্ণ ন্যায়সঙ্গত মূল্যায়নের পথে একটা অন্তরায়।

মুঘল আমলে অংকিত এই চিত্রে কাগজের ওপর রঙ ও সোনার ব্যবহার। নবাব পরিচারকসহ প্রাতভ্রমণে বেরিয়েছেন। ১৭৩০-৪০। ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ এশিয়ান আর্ট।

প্রথম ছবিটা স্মিথসোনিয়ান মিউজিয়ামের ফ্রিয়ার গ্যালারি অফ আর্টে সংরক্ষিত। মোটরগাড়ির ব্যবসা করে বড়লোক এক শিল্পপতি চার্লস ফ্রিয়ার বিশের দশকে তাঁর সমস্ত এশিয়ান আর্ট দান করে দেন স্মিথসোনিয়ানকে। এমনকি সেগুলি রাখার জন্যে দালান বানানোর খরচটাও দিয়ে দেন। ওয়াশিংটন ডিসিতে এ মিউজিয়াম দেখার সৌভাগ্য হয় আমার। বাকি ছবিগুলোর অনেকগুলিও একই স্থানে সংরক্ষিত।

মূল কথায় ফিরে আসি। প্রথম ছবিটি ১৭৩০-৪০এ আঁকা। অশ্বারোহী এক নবাব ফুল শুঁকতে শুঁকতে পরিচারকসহকারে প্রমোদভ্রমণ করছেন। ছবিটি উল্লেখযোগ্য এ কারণে যে, এতে অনেকখানি রিয়ালিজম ও ন্যাচারালিজম উঠে এসেছে, যা মুঘলপূর্ববর্তী আমলে দেখা যায়নি। পার্স্পেকটিভ, ডেপথ অফ ফীল্ড, ধর্মীয় ও পৌরাণিক সাবজেক্ট ছেড়ে দৈনন্দিন কার্যকলাপকে ফুঁটিয়ে তোলা — এসবই ভারতীয় শিল্পকলায় নতুন ব্যাপারস্যাপার। পারসিক শিল্পীদের অনুপ্রেরণায় মুঘল চিত্রকলা প্রথম প্রথম সনাতনই ছিল। ন্যাচারালিস্টিক ছবি না আঁকার কারণ, অনেক শিল্পরসিক বলেন, ইসলাম ধর্মের বিধিনিষেধ যে একেবারে প্রাণবন্ত ছবি আঁকা হলে খোদার ওপর খোদকারি করার প্রচেষ্টা হবে সেটা, আর ফলাফল জাহান্নামের আগুন!

এখন বলি রিয়ালিজমে রূপান্তরের পিছনে ইউরোপীয় মিশনারী ও মুঘলদের অবদানের কথা।

সম্ভবত বিজাপুরের শিল্পী ফররুখ বেগের আঁকা এই চিত্রে মাতা মেরি ও যীশু। ১৫৮০-১৬১৯। ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ এশিয়ান আর্ট।

১৫৪২ সালে গোয়াতে এসে উপস্থিত হন সেন্ট ফ্রান্সিস জাভিয়ের। তাঁর লক্ষ্য ছিল সেখানকার পর্তুগীজ খ্রীষ্টানদের বিপথগামী হওয়া থেকে রক্ষা করা, আর তার লেজুড় ধরে নেটিভদের কাছে ধর্মপ্রচার। গোয়ার পার্শ্ববর্তী রাজ্য বিজাপুর ছিল আদিলশাহী সুলতানদের শাসিত। সেখানেও মিশনারীদের কার্যক্রম বিস্তার পায়। এর সাথে সাথে চলে আসে ধর্মীয় চিত্রকলা। যেমন, দ্বিতীয় ছবিটা বিজাপুরের ফররুখ বেগের আঁকা মাতা মেরী ও যীশুর ছবি। এ যতটা না ধর্মবিশ্বাস থেকে আঁকা, তার থেকে বেশি নতুন বিষয় নতুন ভঙ্গি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা। ফররুখ বেগ অবশ্যই এ ছবির নাম ম্যাডোনা অ্যান্ড চাইল্ড দেননি, কিন্তু বিষয়বস্তু রেনেসাঁস যুগের ম্যাডোনা অ্যান্ড চাইল্ডের সাথে পুরোপুরি মিলে যায়। তৃতীয় ছবিটিও সেরকম মুঘল আমলে করা হোলি ফ্যামিলির চিত্রায়ন। ফররুখ বেগ পরবর্তীতে সম্রাট আকবরের শিল্পকলা কর্মশালার সদস্য হন।

ইউরোপীয় চিত্রের অনুকরণে ভারতীয় শিল্পী এঁকেছেন হোলি ফ্যামিলির ছবি। সপ্তাদশ শতক। ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ এশিয়ান আর্ট।

সম্রাট আকবর ছিলেন সকল প্রকার চিত্রকলা ও স্থাপত্যশিল্পের পৃষ্ঠপোষক। তার আমলে মুঘল সাম্রাজ্য সর্বোচ্চ শৈল্পিক শিখরে ওঠে। আকবর একই সাথে ছিলেন নানা ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে আগ্রহী, আর সুফীবাদে বিশ্বাসী। এমনকি প্রচলিত ধারার চিত্রকলার পরিবর্তনের ব্যাপারেও তাঁর মতামত ছিল বেশ প্রগতিশীল। বিশেষ করে, তাঁর মতে চিত্রকররা যদি লাইফলাইক ছবি আঁকেও, তাদের অবশ্যই এই অনুধাবন অবশ্যম্ভাবী যে, তাদের ন্যুনতম ক্ষমতা নেই স্রষ্টার মত জড় বস্তুতে জীবন দেবার। একার্থে, এভাবে চিত্রকর্মের মাধ্যমে মানুষের পক্ষে আত্মগরিমা পরিত্যাগ করে স্রষ্টার অপার মহিমার প্রত্যক্ষদর্শী হওয়া সম্ভব। সুতরাং চিত্রকর্ম ধর্মীয় দিক থেকেও শিক্ষণীয় একটি কাজ। এ ছিল আকবরের সুফী ঘরানার চিন্তা।

সুফী ধর্মানুরাগী আকবর নতুন রাজধানী ফতেপুর সিক্রিতে ইবাদতখানা বলে একটি সম্মেলনকেন্দ্র বানিয়ে সেখানে মুসলিম-সুফী-হিন্দু-শিখ-জৈন-বৌদ্ধ প্রভৃতি ধর্মের গুরুদের আমন্ত্রণ জানান। গোয়ার পর্তুগীজ জেসাইটরাও বাদ পড়লো না নিমন্ত্রণ থেকে। তারা আকবরের ধর্মীয় ঔদার্যের ব্যাপারে ভালমতই জানত। দু’জন পাদ্রী আকবরের ইবাদতখানায় গেলেন আলোচনায় অংশ নিতে। তাদের আশা, আকবর কোন না কোনভাবে যীশুর দেবত্ব মানবেনই।

সে আশা গুঁড়ে বালি। আকবর তাদের থাকার জায়গা দিলেন, নিয়মিত তাদের সাথে আলোচনা করলেন। এমনকি, একটি বিদ্রোহ দমনের যুদ্ধেও এদের একজনকে নিয়ে গেলেন। আকবরের বহু কৌতূহল নিবৃত করার পরও পাদ্রীদের লক্ষ্য বিফল হলো। আকবর নিজেরই এক সুফী তরিকা চালু করলেন, দ্বীন-ই-ইলাহী নামে। তাতে যীশু নয়, স্বয়ং আকবরই একরকম দেবত্বের আসনে আসীন!

কিন্তু যে তিন-চার বছর জেসাইট পাদ্রীরা আকবরের দরবারে কাটালেন, সে সময়ের মধ্যে তারা বহু মেরী-যীশুর ছবি, রেনেসাঁস শিল্পীদের মাস্টারপীসের প্রতিলিপি, ইত্যাদি আকবরকে স্বাড়ম্বরে দেখিয়েছেন। আকবরও সেসব দেখতে যাবার সময় নিজের শিল্পীগোষ্ঠীকে সাথে নিতে ভোলেননি। তাঁরাই সেসব দেখে এসে আঁকা শুরু করলেন নতুন ধরনের ছবি। সেসবে যীশুর জায়গা নিলেন মুঘল সম্রাট নিজেই।

তুলনার জন্য চতুর্থ ও পঞ্চম ছবি দিলাম। এগুলি চতুর্দশ শতকের প্রাকরেনেসাঁস যুগের ইতালীয় চিত্রকর জোত্তো দি বোন্দোনের আঁকা ফ্রেস্কো। প্রথমটি যীশুর জন্মের চিত্র, দ্বিতীয়টি মৃত্যুর। দু’টিততেই লক্ষ্য করুন, আকাশে ফেরেশতার দল, আর পবিত্র আলোকচ্ছটা বা হেলো যীশু-মেরী প্রমুখের মাথার চারদিকে।

১৩২০ সালের আশপাশ দিয়ে আঁকা জোত্তো দি বোন্দোনের অ্যাডোরেশন অফ দ্য মেজাই। মেট মিউজিয়াম

১৩০৫ সালের আশপাশ দিয়ে জোত্তো দি বোন্দোনের আঁকা দ্য ল্যামেন্টেশন অফ ক্রাইস্ট। স্ক্রোভেনি চ্যাপেল

এর সাথে মেলান ষষ্ঠ ছবিটি, যাতে সম্রাট আকবরের মাথার চারপাশেও সেই একই আলোকচক্র। আর ওপরে ছবির ফ্রেমে দুই ফেরেশতা (ইতালীয় ভাষায় পুত্তি)। সন্দেহাতীতভাবে রেনেসাঁস আর্টের প্রভাব!

এই স্টাইল যে শুধু সম্রাটের ছবির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়। সাত নম্বর ছবিটিতে এক মোল্লার ছবিতেও একই ব্যাপার।

১৬৫০ সালের দিকে মুঘল সম্রাট আকবরের ছবি, মাথার চারপাশে ইউরোপীয় ধাঁচে হেলো।ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ এশিয়ান আর্ট।

উনবিংশ শতকে মুঘল চিত্রকরদের আঁকা এক সুফি সাধকের ছবি। ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ এশিয়ান আর্ট।

পরবর্তী সম্রাট জাহাংগীরের সময় ভারতে ব্রিটিশদের আনাগোনা শুরু হয়ে যায়। রেনেসাঁস আর্টের সাথে কিছুটা হলেও এসে মিলে উত্তর ইউরোপীয় প্রভাব। আট নম্বর ছবিটি বাদশা জাহাংগীরের। এতে দেখানো হয়েছে সম্রাট ইংল্যান্ডের রাজা জেমসের বন্ধুতার প্রস্তাব পাশে ফেলে এক সুফী সন্তের নিকট থেকে পুস্তক গ্রহণ করছেন। ‘হেলো-পুত্তিও’ আছে জায়গামতই। জেমসের পোশাক-আষাকও নিখুঁত ইংরেজ।

১৬১৫ থেকে ১৬১৮এর মধ্যে শিল্পী বিচিত্রের আঁকা ছবিতে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গির দরবারে সুফি সন্তদের স্বাগত জানাচ্ছেন। নিচে বাম কোনায় ইংরেজ রাজা জেমস অপেক্ষমান। ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ এশিয়ান আর্ট।

নয় নম্বর ছবিটি ইংল্যান্ডের রাণী প্রথম এলিজাবেথের। এতে রাণী হাতে নিয়েছেন রাজদন্ড আর ‘গ্লোবাস ক্রুসিজের’। এই ব্রহ্মাণ্ডগোলক  বা সেলেস্টিয়াল অর্ব হলো বিশ্বব্রহ্মান্ডের রূপক, আর ক্রসটি যীশুর। অর্থাৎ এলিজাবেথ হলেন যীশুর স্বর্গীয় রাজক্ষমতার লৌকিক প্রতিনিধি। শুধু এলিজাবেথ নয়, বহু ইউরোপীয় রাজরাজড়াদের একইরকম পোর্ট্রেট ছবি আছে।

এর সাথে মিলান দশ নম্বর ছবিটিকে। জাহাংগীর বসে আছেন চেয়ারে, এ কিন্তু পুরোপুরি ইউরোপীয় ভঙ্গিমার চেয়ার। তার ওপর, জাহাংগীরের হাতে সেই সেলেস্টিয়াল অর্ব। ব্রহ্মান্ডের প্রতীক।

আনুমানিক ১৬০০ সালে নাম-না-জানা শিল্পীর আঁকা ইংল্যান্ডের রাণী প্রথম এলিজাবেথ। হাতে গ্লোবাস ক্রুসিজের। ইংল্যান্ডের ন্যাশনাল পোরট্রেট গ্যালারী।

মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর ইউরোপীয় ঘরানার চেয়ারে বসে আছেন, হাতে ব্রহ্মাণ্ড-গোলক। সপ্তদশ শতকের প্রথমভাগ।

লেখা শেষ করি তিনটি মুঘল ছবি দিয়ে। এ তিনটিতেই রেনেসাঁস আর্টের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য পুরোপুরি দৃশ্যমান। এক, আলোছায়ার খেলা, এমনকি কালো পটভূমিতেও সঠিক রং ব্যবহার করে রাতের দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। আর দুই, পারস্পেক্টিভ, ফোরগ্রাউন্ড-ব্যাকগ্রাউন্ডের ইলিউশন। একটিতে নৈশকালীন হরিণশিকারের দৃশ্য, আরেকটিতে ইব্রাহীম ইবনে আদম বল্খী নামক এক আদি সুফির ধ্যানের দৃশ্য, তাঁর আহারাদির ব্যবস্থা করছে ফেরেশতার দল।

আর শেষ ছবিটিতে আকবরের স্কেচ। লিওনার্দো দা ভিঞ্চির করা বলেও ভুল হয়ে যেতে পারত কারো! অর্ধনিমিলিত চোখে আকবর বিভোর হয়ে কিছু একটা পর্যবেক্ষণ করছেন। চেহারায় খুব প্রশান্তির ছাপ। জুলফি-গোঁফ খুব পরিচর্যা করে স্কেচ করা।

রাতের আঁধারে হরিণ শিকারের দৃশ্য, এঁকেছেন মুঘল শিল্পী মীর কালান খান। অষ্টাদশ শতক।ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ এশিয়ান আর্ট।

বলখের সুলতান ইব্রাহিম ইবনে আযাম জঙ্গলে ধ্যান করছেন, তার জন্যে খাদ্য নিয়ে এসেছে ফেরেশতার দল। মুঘল মিনিয়েচার, অষ্টাদশ শতকের প্রথমভাগ। ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ এশিয়ান আর্ট।

মুঘল শিল্পীদের আঁকা মহামতি আকবরের স্কেচ, আনুমানিক ১৬০৫ সাল।

ফার্সী-তুর্কীদের চিত্রকর্মও এসময় নানাভাবে ইউরোপীয় আর্ট দিয়ে প্রভাবিত হয়েছিল। মুঘলদের যাত্রা যদিও শুরু ইরানী-মধ্য এশীয় ঐতিহ্যের ছত্রছায়ায়, খুব দ্রুত তারা ভারতীয় আর ইউরোপীয় উপাদান গ্রহণ করে, আর জন্ম দেয় নতুন একটি ধারার, যা পরে বিভিন্ন স্থানীয় রাজা ও নবাবদের শিল্পরস আর রুচিকে প্রভাবিত করে।

সুতরাং, কলোনিয়ালিজমের দোষ দেবার পরেও বেশকিছু পজিটিভ ব্যাপারে ইউরোপীয়দের সামান্যতম ক্রেডিট না দিলেই নয়!

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!