ভারতীয় ভক্তিবাদ – ৩

Featured Video Play Icon

সাব আয়া একহি ঘাটসে, উৎরা একহি বাট, বীছ মে দুৰিধা পাড় গা’ই, হো গায়ি বারা বাট — সন্ত কবীরের পঞ্চদশ শতকের মলৰী ভাষায় গাওয়া ভজন। সবাই আসছিল একই ঘাট থেকে, সবার একই পথ, মাঝে পড়ল দ্বিধায় সকলে, হয়ে গেল বারো পথ।

কবীরের একশ’টি ভজন নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি ইংরেজী সংকলন বেরিয়েছিল ১৯১৫ সালে। সারা বিশ্বে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল সেটি। রবীন্দ্রনাথ যে কবীরকেই তুলে ধরেছেন, তাতে অবাক হবার কিছু নেই। রবীন্দ্রনাথের ব্রাহ্ম ধর্মবিশ্বাস কবীরের দর্শনের মতই নিরাকার একত্ববাদী। এখনও কবীরপন্থা বলে একটি ধর্মবিশ্বাস বহু ভারতীয় অনুসরণ করে।

আগেই বলেছি চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতক ভারতের জন্যে ক্রান্তিকাল। উত্তর ভারতে মুসলিম দিগ্বিজয় সম্পূর্ণ হলেও আগের সেই স্থিতিশীলতা নেই। দিল্লী সুলতানাতের মত বড় রাজ্য ভেঙে ভেঙে তৈরি হয়েছে অনেক সামন্ত রাজ্য। রাজনৈতিক ভাগ্য ও সামাজিক অধিকারের অবস্থা ক্রমপরিবর্তনশীল।

ইসলাম ধর্ম ভারতীয় স্থানীয় দর্শনগুলোর জন্যে একটা বড়সড় চ্যালেঞ্জ ছিল। ভারতে যে সময় ইসলামের আগমন, তখন মোটে বৌদ্ধধর্মকে সরিয়ে নতুন ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্মের প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়া চলছে। এর পুরোভাগে ছিল বেশ কিছু দক্ষিণ ভারতীয় ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় রাজবংশ, যাদের মধ্যে পড়ে বাংলার সেনরা।

ইসলাম শুধু রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, ছিল সামাজিক মূল্যবোধ ও আদর্শ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও ভারতীয় ধর্মগুলির প্রতিযোগী। অন্তত থিওরিতে ইসলামে জাতপাত নেই, সবার জন্যে খোদার করুণা সমান। বৌদ্ধ-জৈন ধর্মানুসারীদের বাদ দিলে ভারতীয় বর্ণপ্রথার জন্যে এ ছিল এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের মত সীমান্তবর্তী জায়গা, যেখানে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় বর্ণবাদে নিষ্পেষিত বহু প্রাক্তন বৌদ্ধ ও অসবর্ণ মানুষ রাষ্ট্র ও ধর্মের চোখে অস্পৃশ্য, তাদের জন্যে ইসলাম ছিল আকর্ষণীয় একটি বিকল্প।

যারা নিচু শ্রেণীর খেঁটে খাওয়া মানুষ, তাদের সকলে যে খারাপ অবস্থায় ছিল তা নয়। ইউরোপীয়দের আগমনের সাথে সাথে মার্কেট এক্সপানশন হয়েছে অনেক কুটিরশিল্পের। ব্রাহ্মণদের চোখে চন্ডাল হলেও নিম্নবর্ণের শূদ্ররা কিছুটা অর্থনৈতিক স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে। এ ধরনের নিম্ন মধ্যবিত্ত অত সহজে ধর্মান্তরিত হয়নি, হলেও তা হয়েছে নামে মাত্র। ইসলামগ্রহণ যদি নাও করে, নতুন ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু বর্ণপ্রথায় তাদের তেমন কোন সম্মানজনক স্থান নেই। অর্থাৎ, এরা না ঘরকা, না ঘাটকা। এরকম আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রাতিষ্ঠানিকতাবিরোধী প্রতিবাদ ছিল কেবল সময়ের ব্যাপার।

দরিদ্র তাঁতী পরিবারের কবীর সেই নিষ্পেষিত শ্রেণীরই প্রতিনিধি। তিনি মুসলিম ছিলেন না হিন্দু, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তাকে স্ব-স্ব ধর্মের সন্ত বানাতে হিন্দু-মুসলিম-শিখ সকলে এক পায়ে খাঁড়া। অথচ জীবদ্দশায় সম্ভবত তাকে হিন্দু-মুসলিম উভয়েরই গঞ্জনা সইতে হয়েছে।

কবীরের ভজন গবেষণা করে যতটুকু মনে হয়, মুসলিম পরিবারে বড় হলেও সে ধর্মের খুব বেশি জ্ঞান তার ছিল না। সম্ভবত তার পরিবার প্রথম বা দ্বিতীয় প্রজন্মের কনভার্ট। কিন্তু সাবালক বয়েসে কবীরের হাতেখড়ি বৈষ্ণব ভক্তিবাদের সমসাময়িক সাধক রামানন্দের হাত ধরে।

কবীরের দর্শনকে সহজিয়া বলা যেতে পারে। সহজ ভাষায় তিনি যেটা বলতে চেয়েছেন তা হলো, বাইরে দিয়ে ধার্মিক হয়ে কোন মোক্ষ নেই, অন্তরে থাকতে হবে ভক্তি। দেবমূর্তি তো কোন কথা বলে না, তাকে কেন পূজবো? ঈশ্বরের বাস সে তো মন্দির-কাবায় নয়, মানুষের অন্তরে। মুসলিম কাজী সে একদিকে কুরআন বাঁছে, আরেকদিকে কেড়ে নেয় গরীব মানুষের জমি। তেমন তিলকছাঁপা হিন্দু ব্রাহ্মণ যতই বেদপাঠ করুক না কেন, আত্মার মধ্যে যদি সেটা সে ধারণ না করে, তারও নেই পাপমোচন। অন্তর ভাল না হলে বাইরের পাকপবিত্রতার কোন মূল্য নেই।

দু’হাজার বছর আগে সনাতন ধর্মের বিরুদ্ধে গৌতমবুদ্ধের যে বিপ্লব, সে ছিল আর্য উচ্চবর্ণের ত্রুটিপূর্ণ দর্শনের বিরুদ্ধে আরেক উচ্চবর্ণেরই প্রগতিশীল প্রতিবাদ। আর কবীরের প্রতিবাদ একেবারে তৃণমূল থেকে, সকল প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মাচারের বিরুদ্ধে, তাদের দুর্নীতি-অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে। তার দর্শনে রয়েছে সাম্যবাদের ইউটোপিয়া, যেখানে কোন নিষ্পেষন নেই, জাতপাত নেই, সরকার-রাষ্ট্র নেই, কর নেই।

এভাবে কবীর ভারতীয় মানুষের মোহভঙ্গ হওয়া একটা বিশাল অংশের মন জয় করে নিতে সক্ষম হন। আর তার পথ ধরেই আবার হিন্দু ও মুসলিম ধর্মের ভারতীয় সিনক্রেটিজম-সিনথেসিসের বীজ বপন হয়। পরবর্তী সন্ত-সাধু সন্ন্যাসী-ফকির ইসলামের নামেই হোক, আর হিন্দু ধর্মের নামেই হোক, একই রকম হৃদয়গ্রাহ্য সার্বজনীন মানবিক ধর্মের বাণী প্রচার করে গেছেন।

কবীরপন্থার একটা বৈশিষ্ট্য অনেকান্তবাদ, অর্থাৎ মোক্ষলাভের উপায় কেবল একটি নয়, বহু — কিন্তু সকলের লক্ষ্য ঐ একই।

কবীরের ভক্তিবিপ্লব প্রসঙ্গে আরো দুটি জিনিস মাথায় এল, যা না বললে নয়। এক, মধ্যযুগের শেষে ইউরোপের আর্থ-সামাজিক অবস্থা এমন কিছু ভিন্ন ছিল না। ক্যাথলিক পাদ্রীকূলও ছিলেন মহা দুর্নীতিগ্রস্ত। সেখানেও খ্রীষ্টান জগতে কবীরের মতই এক জ্ঞানবিপ্লব সংঘটিত হয়, যার নাম প্রটেস্ট্যান্ট রিফর্মেশন। জার্মানির বেনেডিক্টবয়ার্ন মঠে খুঁজে পাওয়া রিফর্মেশনপূর্ব ত্রয়োদশ শতকের কারমিনা বুরানা নামের পান্ডুলিপি ঘাঁটালে একই রকম প্রতিবাদী ভক্তিবাদ চোখে পড়বে। এব্যাপারে এখানে আগে লিখেছি।

আর দুই, অধুনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভক্তিবাদ! হ্যাঁ, এ বস্তুও আছে। তার একটা ধারা সাদার্ন কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের থেকে এসেছে, যাকে বলে নিগ্রো স্পিরিচুয়াল। ওল্ড টেস্টামেন্টের গল্পগুলিকে সমসাময়িক দাসত্বশৃংখলের সাথে যুক্ত করে একটা খোদাভক্তি ও প্রতিবাদ সেখানে উঠে এসেছে। ওয়েড ইন ওয়াটার গানটা মনে আসল। এ গানটি বাপ্টিজমের রেফারেন্সে ভক্তিমূলক হলেও দ্বিতীয় আরেকটি অর্থ রয়েছে। পানিতে সাঁতরালে পলায়নপর দাসের গায়ে আর কোন গন্ধ থাকে না, মনিবের কুকুরও তাকে আর অনুসরণ করতে পারে না।

Let’s wade in the water,
Wade in the water,
Listen to me now, wade in the water.
I wanna know that you’re mine,
Because your love is so fine.

আরেকটি হলো শ্বেতাঙ্গ ইভানজেলিকাল খ্রীষ্টান মূলধারার ফোক গসপেল সঙ্গীত। এটিও সাউথের। এর উদাহরণ মনে হলো ও ব্রাদার হয়্যার আর্ট দাউ ছবির একটা গান:

As I went down in the river to pray
Studying about that good ol’ way
And who shall wear the robe & crown?
Good Lord show me the way

সুতরাং কবীরের ঐ অনেকান্তবাদ আসলে লার্জার কনটেক্সটে খুবই সত্য। পৃথিবীতে আজ ‘বারো’ পথ, কিন্তু সবার সেই একই ঘাট, একই পথ, একই গন্তব্য। কাহাঁ সে আয়া কাঁহা যাওগে, খাবার কারো আপনে তান কি, কোয়ি সাদগুরু মিলে তো ভেদ বাতাৰে, খুল যাৰে অন্তর খিড়কী…

ভারতীয় ভক্তিবাদ – ২

Featured Video Play Icon

মধুর সুর বোল রে কাগা, মীরা রো মন রাম সে লাগা — ষোড়শ শতকের ভারতীয় ভক্তিবাদের অন্যতম পথিকৃত মীরাবাঈয়ের রাজস্থানী ভজন। রাম এখানে ভগবানের নাম, আদতে শ্রীকৃষ্ণ। রাম-কৃষ্ণ উভয়েই ভগবান বিষ্ণুর অবতার।

মীরাবাঈ কৃষ্ণের প্রেমে মত্ত। তার এই বার্তার বাহক কাক — কাকের কর্কশ কন্ঠ কিভাবে মধুর হয় সেটা বুঝতে হয়ত আবার উলটপুরাণ ঘাঁটতে হবে! কৃষ্ণের প্রেমে মজাটাও এখানে আধ্যাত্মিক। মাওলানা রূমী যখন বলেন, আমি তোমার প্রেমে মত্ত হতে চা‌ই নীরবতায়, কারণ নীরবতায় নেই কোন প্রত্যাখ্যান — তখন তাতে সেই একই একতরফা প্রেম-ভক্তি ধরা পড়ে। এই প্রেম ঈশ্বরের সাথে ভক্তের।

কাওয়ালীতে যেমন প্রথমে একজন একটা লাইন গাওয়ার পর বাকিরা একসাথে তার জবাব দেয়, কীর্তনে ঠিক একই রকম কল এন্ড রেসপন্স রয়েছে। এসব ভজন-কীর্তন ভারতবর্ষে নতুন নয়। কীর্তনের উল্লেখ বেদে পর্যন্ত আছে। আর ষষ্ঠ-সপ্তম শতকে দক্ষিণ ভারত থেকে এই বৈষ্ণব-শৈব ভক্তিবাদ ধীরে ধীরে উত্তর ও পূর্ব ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। শুধু হিন্দু ধর্ম নয়, জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের ওপরও ভক্তিবাদ ও আধ্যাত্মিকতাবাদের একটা প্রভাব শুরু হয়, তাদেরও ভজন-কীর্তন রয়েছে।

তবে দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে ভারতে ইসলাম আসার সাথে সাথে ‌অনেক কিছু উল্টেপাল্টে যেতে থাকে। ইসলামে যে নিয়মিত দৈনিক প্রার্থনা, আর কোন যজ্ঞ বা নৈবেদ্যের ঝামেলা নেই, অর্থাৎ ঈশ্বরের সাথে একটা ব্যক্তিগত সম্পর্ক, এ ব্যাপারটা সম্ভবত হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মকে প্রভাবিত করে। আগের রিচুয়ালভিত্তিক মন্দির ও ব্রাহ্মণ্যকেন্দ্রিক ধর্মচর্চাকে টিকিয়ে রাখতে ভারতের জবাব হয় ঐ ভক্তিবাদ। তাতে মন্দির অপরিহার্য নয়। ভারতের সব মন্দির নতুন তুর্কী মুসলিম শাসকরা ধ্বংস করে ফেললেও ভক্তের মনের দৃঢ় নিষ্ঠা বিলুপ্ত করার সামর্থ্য তাদের নেই। অর্থাৎ কঠিন একটা সময়ে ভক্তিবাদের মাধ্যমে নতুন বাস্তবতার সাথে খাঁপ খাইয়ে নেয় ভারতীয় দর্শনগুলি।

মীরাবাঈ পঞ্চদশ শতকে একই রকম বাস্তবতার সম্মুখীন। মুসলিম-হিন্দু সংঘাত হয় যুদ্ধক্ষেত্রে নয়ত অন্য কোনভাবে দৃশ্যমান। দিল্লী সুলতানাত আফগানদের থেকে হাত বদলে এসেছে মুঘলদের হাতে। আগের শত্রুতা-মিত্রতার সম্পর্কগুলি পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। রাজপুত এলিট পরিবারের মীরাবাঈ সেসবের প্রতক্ষ্য সাক্ষী। হয়ত এসব চ্যালেঞ্জের মুখে তার কৃষ্ণভক্তি তাকে অবিচল থাকতে সাহায্য করেছে।

মীরাবাঈয়ের পাশাপাশি আরো বহু সন্ত-সাধক এ সময়ে ভক্তিবাদের চর্চা করেন। শিখ গুরু নানক একই সময়ের, একই ঘরানার। নবদ্বীপের শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু আর বৈষ্ণব পদাবলী বৈষ্ণবভক্তির বঙ্গীয় নমুনা। রাধা-কৃষ্ণের লীলা এদের জন্যে ঈশ্বরপ্রেম কিংবা আধ্যাত্মিকতার রূপক মাত্র। আবার গীতায় অর্জুন-শ্রীকৃষ্ণের যে গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক, তার সমান্তরাল ধরতে পারি শামসে তাব্রিজি আর মাওলানা রূমির পীর-মুর্শিদ সম্পর্ক, কিংবা নিজামুদ্দিন আউলিয়ার সাথে আমীর খসরুর সম্পর্ক। শুধু তফাত হল শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং বিষ্ণুর অবতার।

ইসলামী ভক্তিবাদের কাওয়ালী সঙ্গীতের সাথে একটা দৃশ্যমান পার্থক্য চোখে পড়ে এই ভজনের। সেটা হল মঞ্জিরা-করতালের ব্যবহার। মঞ্জিরা বাদ্যযন্ত্রটি আসলে বহু আদিকাল থেকে পাগান ধর্মগুলির সবটিতে ব্যবহৃত হয়েছে। সেটা তো হিন্দু ও রোমান পাগান মন্দিরে ব্যবহার হয়েছেই, ইসলামপূর্ব আরব পাগানরাও ব্যবহার করে থাকলে অবাক হব না। হয়ত সেকারণে করতালে আদিকাল থেকে মুসলিমদের অ্যালার্জি, আর ভজন-কীর্তন থেকে কাওয়ালীতে আসার পথে সেটি গায়েব হয়ে গেছে।

হিন্দু-মুসলিম সংঘাত যে ভারতবর্ষে বিভাজন তৈরির ব্রিটিশদের অধুনা পন্থা তা নয়, অতীত ঘাঁটালে বহু উদাহরণ চোখে পড়বে। তার প্রতিক্রিয়া হিসাবে মীরাবাঈয়ের আগের শতকেই আরেক ভক্তিবাদী সাধক কবির বহু ভজন লিখে গেছেন। তাতে উভয় ধর্মকেই প্রত্যাখ্যান করে সাধারণ মানুষের বোধগম্য সরল এক পন্থা উঠে এসেছে। তৃতীয় ‌অনুখন্ডে তার একটা উদাহরণ দিয়ে শেষ করব।

ভারতীয় ভক্তিবাদ – ১

Featured Video Play Icon

নুসরাত ফতেহ আলী খান আর তার ভাতিজা রাহাত বলিউডের মাধ্যমে খ্যাতির শীর্ষে উঠে আসলেও তাদের মূলধারা সুফী ভক্তিবাদী কাওয়ালী গান।

ভক্তিবাদের কথা উঠলে বাংলার সবাই বাউল গান চেনে। কিন্তু পুরো উপমহাদেশে ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে আছে নানারকম ভক্তিমূলক সাধনার গান। কাওয়ালী তার অন্যতম, যদিও বোধ করি ধর্মের সীমানা অতিক্রম করে খুব কম মানুষই এসব ভক্তিবাদকে একই ছায়াতলে দেখার চেষ্টা করবে।

গত রাতে নুসরাত ফতেহ আলীর সুদীর্ঘ হাক্ব আলী, আলী মওলা গানটা কয়েকবার মনোযোগ দিয়ে শুনতে শুনতে চলে গেলাম মীরাবাঈএর রাজস্থানী ভজনে, সেখান থেকে কবিরের নাথপন্থী না-হিন্দু না-মুসলিম পপুলিস্ট প্রাতিষ্ঠানিকতাবিরোধী ভজনে। এসব মিলিয়ে তিনটা অনুখন্ড লিখতে ইচ্ছে হল।

উত্তর ভারতে ইসলামের আগমনের সাথে সাথে বহু পারসিক-তুর্কী মুসলিম কর্মচারী ও সেনাপতি ভারতে আসেন। এদের সেকেন্ড থার্ড জেনারেশনের বংশধররা আমাদের মত অধুনা ইমিগ্র্যান্টদের স্টাইলে স্থানীয় ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে তাদের জাতিগত ঐতিহ্যের মিলন ঘটিয়ে জন্ম দেন নতুন এক সঙ্গীত ঘরানার, যার নাম হিন্দুস্তানী। আর দক্ষিণ ভারতের কর্নাটী সঙ্গীতে তখনও চলতে থাকে আদি ঘরানার ধারাবাহিকতা।

উত্তর ভারতের এই সুরকারদের মধ্যে সবচে অগ্রগণ্য আমীর খসরু। নিজামুদ্দিন আউলিয়ার সান্নিধ্যে সুফী ভক্তিবাদে শিক্ষা পান তিনি। প্রাচীন ভারতীয় সুরকলাকে সংস্কার করে নতুন রূপ দেন আমীর খসরু। এই কাওয়ালীর সুর ও বিষয়বস্তুর ঐতিহ্য আমীর খসরু পর্যন্ত ট্রেস করা যায়।

আলী মওলা গানটার মূল প্রতিপাদ্য ইসলামের অন্যতম হিরো হযরত আলীর গুণকীর্তন। এটা মূল ধারার সুন্নী ঐতিহ্যের সাথে খুব একটা যায় না। অর্থডক্স ইসলামে মানুষ হিসাবে যদি কাউকে অনুসরণ করা কর্তব্য সে একমাত্র হযরত মুহাম্মদ(সা)।

কিন্তু ইরানী জোরোয়াস্ত্রিয়ান ও শিয়া প্রভাবে হিরো ওয়ারশিপের যে ইন্দোআর্য ট্রাডিশন (তুলনা করুন শাহনামা-রামায়ণ-মহাভারতের সাথে), সেটা চলে এসেছে ভারতীয় ফোক ইসলামে। শিয়া ঐতিহ্য অনুযায়ী হযরত মুহাম্মদ(সা) নাকি গাদির খুম বলে বিদায়হজ্জ্বপরবর্তী এক ভাষণে সরাসরি আলীকে তার উত্তরাধিকারী ঘোষণা করে বলেন, যে কেউ আমাকে যদি মাওলা মানে, সে আলীকেও মাওলা মানে। মাওলা শব্দের অর্থ নিয়ে বহু বিতর্ক আছে। কিন্তু সুফী সাধনার পরিপ্রেক্ষিতে মাওলা মানে ধরতে পারি ইন্টারসেসর — অর্থাৎ যার কিনা উচ্চতর দৈব শক্তির কাছে কারো পক্ষে সুপারিশের ক্ষমতা রয়েছে।

অপরদিকে ইসলামী সাম্রাজ্যের চতুর্থ খলীফা হিসাবে আলী শক্তিরও একটি প্রতীক। তার তরবারি জুলফিকার খোদা-রাসুলের আশীর্বাদমন্ডিত, কিন্তু অত্যাচারী নয়, ন্যায়বিচারী। সেই লাইন ধরে আলী শেরে-ইয়াজদান — খোদার সিংহ। উল্লেখ্য, ইয়াজদান শব্দটা আরবী নয়, পুরনো ফারসীতে জোরোয়াস্ত্রিয়ান দেবতাদের নাম ছিল ‘ইয়াজাতা’। সেখান থেকে ইয়াজদান=খোদা।

তো এই গানটিতে ঘুরে ফিরে আলী, তার শক্তিমহিমা ও আধ্যাত্মিক গরিমার গুণকীর্তন হচ্ছে। পারসিককৃত ভারতীয় রাগ-সুরের ব্যবহারের পাশাপাশি কখনো কখনো ধুম-তানানা ধরনের অর্থহীন শব্দ ব্যবহার করে তাল দেয়া হচ্ছে। হয়তবা শব্দগুলোর লুক্বায়িত কোন অর্থ আছে, নয়ত সেগুলি আলীভক্ত শ্রোতার মনে একটা ইনটক্সিকেশন কিংবা ফানা তৈরির সহায়ক।

যারা নুসরাত ফতেহ আলীর গান বা কাওয়ালী পছন্দ করেন, তারা অবাক হতে পারেন যদি বলি কাওয়ালী আসলে ভারতীয় কীর্তন-ভজনের ঐতিহ্যেরই একটা এক্সটেনশন। দ্বিতীয় পর্বে দেব মীরাবাঈয়ের সেরকম একটা ভক্তির গান

হাইতি – ৫, দ্বিতীয় স্বাধীনতা: রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ১৯৩৪-

দুই দশকের মার্কিন দখলদারিত্বের শেষে দ্বিতীয়বার হাইতি স্বাধীন হয় ১৯৩৪ সালে। ততদিনে অনেক পাল্টে গেছে দেশটি। মার্কিন প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক প্রভাবে অবকাঠামোর উন্নতি হয়েছে। সামান্য হলেও স্থিতিশীলতা আর সমৃদ্ধির স্বাদ পেয়েছে শহুরে মানুষ। কিন্তু মফস্বল আর গ্রামাঞ্চলে পূর্বেকার সেনাশাসিত যে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা ছিল, দরকার পড়লে কেন্দ্রীয় সরকারের অবিচারের প্রতিবাদের উৎস ছিল যেটা, তা পুরোপুরি বিলুপ্ত। গ্রামের ক্ষমতার ভিত্তিগুলি বিনষ্ট হয়ে শহরগুলিতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত।

অর্থনৈতিক সুযোগের আশায় গ্রাম থেকে শহরমুখী হয়েছে বহু মানুষ। অনেকে দেশান্তরী। প্রাচীন লাকুভিত্তিক স্বাধীন গ্রাম্য সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। সংসদীয় ব্যবস্থার দুর্বলতার সুযোগে স্বাধীন হাইতির শাসক ও এলিট শ্রেণী রাজধানীভিত্তিক জন্দার্মসমর্থিত একনায়কতন্ত্র কায়েম করে। নতুন রাষ্ট্রপতি ভ্যাঁসঁ মার্কিন ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশের সাথে ভাল সম্পর্ক রেখে চলেন। আগের অন্যান্য মুলাটো নেতার মত তাঁরও বিশ্বাস ছিল, সিংহভাগ হাইতিবাসীর গণতন্ত্র বোঝা ও চর্চা করার মত শিক্ষা-সামর্থ্য নেই।

হাইতির প্রেসিডেন্ট স্তেনিও ভ্যাঁসঁর সাথে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ফ্রাংকলিন রোজাভেল্ট, ১৯৩৬

চেয়ারম্যান মাওয়ের সাথে সাক্ষাত করছেন হাইতির কম্যুনিস্ট পার্টির নেতা জাক স্তেফেন আলেক্সিস, ১৯৬৭

ভ্যাঁসঁর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে যে দলটি দাঁড়া হয়, তারা ছিল শহুরে বামপন্থী। এদের দৃষ্টিতে ভ্যাঁসঁ ছিলেন সাম্রাজ্যবাদী মার্কিনের হাতের পুতুল। ভ্যাঁসঁ নবগঠিত এই কম্যুনিস্ট পার্টিকে কড়াহাতে দমন করেন। একই সাথে চলে গ্রাম্য ভুডুবিরোধী সংস্কারাভিযান। প্রতিবেশী ডমিনিকান রিপাবলিকের একনায়ক ত্রুহিয়োর সাথে ভ্যাঁসঁর বন্ধুত্ব ছিল। ১৯৩৭ সালে দুই দেশের সীমান্তে ডমিনিকান সৈন্যরা হাইতিয়ান শ্রমিকদের ওপর গণহত্যা চালায়। ভ্যাঁসঁর নীরবতার প্রতিবাদে পোর্তোপ্র্যাঁসে জোরদার আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। এর জের ধরে ভ্যাঁসঁ গদি ছাড়েন ১৯৪১ সালে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে রাবারের প্রচুর চাহিদা থেকে লাভ করতে লেস্কো সরকার ক্ষুদ্র কৃষকদের জমিতে রাবারের গাছ বসায়। কিন্তু সে প্রকল্প লাভের মুখ দেখার আগেই যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। মার্কিন ঋণের বোঝা আর অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বামপন্থী ছাত্র-শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে দেশ ছেড়ে পালান লেস্কো। তার জায়গা নেন মার্কিনদের প্রস্থানপরবর্তী প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট এস্তিমে।

লেস্কো সরকারের আমলে ক্ষুদ্র কৃষিজমি ‌অধিগ্রহণ করে অলাভজনক সিসাল ও রাবার গাছ লাগানো হয়, ১৯৪৪

যুক্তরাষ্ট্রের পত্রিকায় হাইতির প্রেসিডেন্ট এনি লেস্কোর ছবি, ১৯৪৭

এস্তিমে সমাজতান্ত্রিক আদর্শে অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু করেন। বিদেশী কম্পানির মালিকানাধীন বড় ফলের বাগানগুলিকে রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়। এতে উল্টো লাভজনক ব্যবসাগুলি ধ্বংস হয়ে যায়। পর্যটনশিল্পে সরকারী বিনিয়োগও লাভের মুখ দেখেনি। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে ব্যর্থ এস্তিমের বিরুদ্ধে এক দফা বিপ্লবের পর সেনাশাসক মাগ্লোয়ার ক্ষমতায় আসেন ১৯৫০এ। মুক্ত বিদেশী বিনিয়োগের ফলে একটি স্বর্ণালী যুগের সূচনা হয়। কিন্তু ১৯৫৬ নাগাদ মাগ্লোয়ারকেও বিদায় নিতে হয়। নগর-অর্থনীতির উন্নতি হলেও কৃষিক্ষেত্রের করুণ হাল, মৃত্তিকার অবক্ষয়, বৃক্ষনিধন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদির ফলে গ্রাম্য জনসংখ্যার ক্রমাগত অবনতি হতে থাকে।

মাগ্লোয়ারের পর ক্ষমতার শূন্যতা পূরণ করতে তিন প্রতিদ্বন্দ্বীর আবির্ভাব ঘটে, একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী যার পরিকল্পনা হাইতিতে বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি, আরেকজন মার্কসবাদী, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের রাষ্ট্রায়ত্তকরণ তার লক্ষ্য। আর তৃতীয়জন — ফ্রঁসোয়া দ্যুভালিয়ে — মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষিত ডাক্তার, তিনি বিশ্বাস করতেন কৃষ্ণাঙ্গ জাতীয়তাবাদে। তার তত্ত্বে পশ্চিমা — অর্থাৎ শ্বেতাঙ্গ — ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও গণতন্ত্র আফ্রিকান সমাজসংস্কৃতিতে অচল। দ্যুভালিয়ের ব্যক্তিত্বপূজারী জঙ্গী কৃষ্ণাঙ্গরা কাগুলার নামে একটি আধাসামরিক বাহিনী গঠন করে। এরা রাস্তাঘাটে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে গুন্ডামি, বোমাবাজি, খুনখারাবি ইত্যাদি শুরু করে দেয়। দ্যুভালিয়ে সামরিক বাহিনীর মাঝেও সমর্থনের খুঁটি খুঁজে বের করেন।

হাইতির রাষ্ট্রপতি দ্যুমার্সে এস্তিমে, ১৯৪৬। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী প্রথম ‘নোয়ারিস্ট’ বা কৃষ্ণাঙ্গ জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রপতি।

এস্তিমে সরকারের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার পরিবর্তনের লক্ষ্যে ক্ষমতায় আসেন পরবর্তী রাষ্ট্রপতি পল মাগ্লোয়ার, ১৯৫০

প্রথমে বামপন্থীরা ক্ষমতায় গেলেও শীঘ্রই দ্যুভালিয়ের পক্ষে সেনা ও জনঅভ্যুত্থানে তারা অপসারিত হয়। ১৯৫৭ সালে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জবরদস্তি আর কারচুপির মাধ্যমে জয়ী হয়ে আসেন ‘ডক’ (ডক্টর) দ্যুভালিয়ে। নিজের ব্যক্তিত্বের কাল্ট ঘিরে সরকারের সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন দ্যুভালিয়ে। প্রতিবাদ নিয়ন্ত্রণে আনার জন্যে একরোখা নিপীড়নের আশ্রয় নেন তিনি। বিরোধীদলীয় নেতারা হয় নিরুদ্দেশ হয়ে যান, নয়ত আইনরক্ষীদের প্রহারে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকেন। ২০ থেকে ৬০ হাজারের মত মানুষকে হত্যা করে তাঁর প্রশাসন।

নতুন সংবিধান প্রনয়ণ করে সরকারী কর্মীদের ধর্মঘট বেআইনী ঘোষিত হয়। ক্রেওল ভাষাকে অফিশিয়াল মর্যাদা আর নারীদের ভোটাধিকার দেয়া হলেও, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার এতদিনের ভারসাম্য সেনেট বিলুপ্ত হয়। অনুগত লোকজনকে সংসদে মনোনীত করার ব্যাপারটাও গণভোটের মাধ্যমে আইনে পরিণত হয়। সারা দেশে স্বাধীন মতপ্রকাশ থমকে দাঁড়ায়। সামরিক বাহিনীর স্বাধীনতা খর্ব করতে সমান্তরাল আরেকটি বাহিনী গঠন করেন দ্যুভালিয়ে। জাতীয় নিরাপত্তা স্বেচ্ছাসেবকবাহিনী নামে এ সংগঠনটির সদস্যদের ডাকনাম ছিল ‘তঁতঁ মাকুত’, যার অর্থ ‘আংকল বুগিম্যান।’ সেনাবাহিনীর দ্বিগুণ লোকবল ছিল এদের। বিরুদ্ধমত নিষ্পেষণে এমন কোন অসাধ্য ছিল না, যেটা তঁতঁ মাকুত করত না। নতুন সংবিধানে নারীস্বাধীনতার কথা থাকলেও নারীবাদীদেরও ছাড় দেয়নি তঁতঁ মাকুত।

দ্যুভালিয়ে পরিবারতন্ত্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট ফ্রঁসোয়া ‘ডক’ দ্যুভালিয়ে, স্ত্রী সিমনসহ। কৃষ্ণাঙ্গ জাতীয়তাবাদের ধ্বজাধারী পাপাডকের স্ত্রী ছিলেন মুলাটো বা মিশ্রজাত। এ চিত্রে পাপাডকের পোশাক ভুডু মৃত্যুদেবতা বাওন সামদির মত সম্পূর্ণ কালো। এভাবে সাধারণ হাইতিবাসীর মনে ত্রাসের সঞ্চার করেন তিনি।

পাপাডকের পোষা আধাসামরিক বাহিনী তঁতঁমাকুতের অত্যাচারে সন্ত্রস্ত থাকত সাধারণ হাইতিবাসী, ষাটের দশকের ছবি।

মতবিরোধীদের ধরপাকড় ও নিরুদ্দেশ করে দেয়াতে জুড়ি ছিল না তঁতঁমাকুতদের, আশির দশকের ছবি।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলিরও রাজনীতিকরণ হয়। নিষিদ্ধ সংগঠনের কাতারে যেমন পড়ে বামপন্থী পার্টিগুলি, তেমন বয়স্কাউটদের মত নখদন্তহীন সংগঠনগুলিও। কার্নিভালে মনোরঞ্জনের জন্যে রাজনৈতিক ক্যারিকেচারের যে পুতুলখেলা এতদিন চালু ছিল, তার খেলিয়েরাও দ্যুভালিয়ে সরকারের শূলদৃষ্টিতে পড়ে জেলে নিক্ষিপ্ত হয়। কিছু মানুষ সুযোগ বুঝে তঁতঁ মাকুত আর দ্যুভালিয়ের নাম মুখে এনে বিভিন্ন জায়গায় সুবিধা বাগিয়ে নিতে শুরু করে। দ্যুভালিয়ের নিকটজনদের আত্মীয়তা দাবি করলে সাতখুন মাফ! মতবিরোধীদের দ্যুভালিয়ে সাম্রাজ্যবাদী-উপনিবেশবাদীদের দোসর আখ্যা দেন, আর নিজে হয়ে বসেন কৃষ্ণাঙ্গ ‘মানবতাবাদী’ আদর্শের সাষ্টাঙ্গ অবতার! ভুডু মৃত্যুদেবতা বাওন সামদির আদলে কালো স্যুট-হ্যাট পরে চলাফেরা শুরু করেন দ্যুভালিয়ে।

দ্যুভালিয়ের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি বেশ দোদুল্যমান ছিল। স্নায়ুযুদ্ধের সুযোগে আইজেনহাওয়ার প্রশাসনের কাছে কম্যুনিস্টবিরোধী সেজে দ্যুভালিয়ে অর্থ ও অস্ত্র সহায়তা বাগিয়ে নেন। কেনেডি অবশ্য দ্যুভালিয়েকে সরানোর পাঁয়তারা করেন। তাঁর ভয় ছিল, কিউবাতে বাতিস্তার নিপীড়নের কারণে কাস্ত্রোর কম্যুনিস্টরা যেভাবে বিজয়ী হয়, হাইতিও সেদিকে চলেছে। তাঁর পরিকল্পনা ছিল কিউবা ও হাইতিতে গেরিলা বাহিনী পাঠিয়ে দু’দেশেই একসাথে একনায়কতন্ত্রী সরকার উৎখাত। এতে মার্কিনদের অংশীদার হত ডমিনিকান রিপাবলিকের নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বোশের সরকার।

দ্যুভালিয়ে উল্টো কারচুপির নির্বাচন করে মেয়াদ এক দফা বাড়িয়ে নেন। প্রতিটি ভাষণে যুক্তরাষ্ট্রে কালোরা কিধরনের অবিচারের মধ্য দিয়ে যায় সেটা দেশবাসীকে স্মরণ করিয়ে দিতেন তিনি। তাতে কাজ হত ম্যাজিকের মত। কেনেডির মৃত্যু আর বোশের পতনের পর সে যাত্রা বেঁচে যান দ্যুভালিয়ে। মার্কিনদের সহায়তা ছাড়াই যখন একটি ছোট গেরিলাদল হাইতিতে আসে দ্যুভালিয়েকে উৎখাত করতে, তখন জনসাধারণ তাদের কোন সাহায্য করেনি। সেই অভিযান ব্যর্থ হয়, আর নিহত যোদ্ধাদের কাটা মুন্ডু জনসমক্ষে প্রদর্শিত হয়। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট হাইতির ব্যাপারে হাল ছেড়ে দেয় এই বলে যে, প্যারানয়েড পিপল ডিজার্ভ এ প্যারানয়েড প্রেসিডেন্ট।

১৯৬৭ সালে আরেকটি ‘গণভোট’ ডেকে নিজেকে আজীবন রাষ্ট্রপতি বানিয়ে নেন দ্যুভালিয়ে। সে ভোটে টিক মারার অপশন ছিল কেবল একটি! এরপর দ্যুভালিয়ে সরকার আর তঁতঁ মাকুত লাগামছাড়া আচরণ শুরু করে দেয়, যার মূল্য দিতে হয় সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বরেণ্য ব্যক্তিত্বদেরকে। বিশ্বকাপ ফুটবলের খেলোয়াড় গেইতেনসের পরিবারের অল্প কয়েক সদস্য দ্যুভালিয়েবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত ছিল। কিন্তু নিরুদ্দেশ করে দেয়া হয় গেইতেনসকেই। হাইতিবাসীর জন্যে গেইতেনস ছিলেন উদাহরণমাত্র। হাইতির মানুষ ক্যাথলিক প্রার্থনা লর্ডস প্রেয়ারকে কৌতুক করে পাল্টে দেয় এভাবে, ‘আওয়ার ডক হু আর্ট ইন দ্য প্যালে নাসিওনাল ফর লাইফ, হ্যালোড বি দাই নেইম বাই ফিউচার অ্যান্ড প্রেজেন্ট জেনারেশন।’

দ্যুভালিয়ে আমলে দুর্নীতি আর অরাজকতার কারণে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ে। হাইতির সমসাময়িক প্রবাদবাক্যে, দ্যুভালিয়ে অলৌকিক শক্তিবলে হাইতিকে শিখিয়েছেন খাদ্য ছাড়াই কিভাবে ক্ষুধানিবারণ করা যায়। ১৯৬১ থেকে ৬৭র মধ্যে রপ্তানী আয়ের ৩০ শতাংশ সংকোচন ঘটে। সরকারী গুন্ডা পোষার খরচ আসে ডমিনিকান রিপাবলিকের চিনি খামারে গরীব হাইতিবাসীদের গতর খাঁটা পরিশ্রমের রেমিট্যান্সে। এসকল শ্রমিক ছিল দাসের মতই। এদের বেতন যেত দ্যুভালিয়ে সরকারের হাত ঘুরে। ১৯৮১ সালে এভাবে ৩০ লক্ষ ডলার রেমিট্যান্স চলে যায় বিভিন্ন সরকারী কর্মকর্তার পকেটে। গ্রামাঞ্চলে তঁতঁ মাকুতের চাঁদাবাজি আর অপহরণের ভয় তো ছিলই।

১৯৬৯ সালে আরেক ‘গণভোটের’ মাধ্যমে পুত্র জঁক্লোদের রাষ্ট্রপতি হবার রাস্তা পরিষ্কার করেন দ্যুভালিয়ে। দ্যুভালিয়ে ডিন্যাস্টির বড়জনের ডাকনাম তখন দাঁড়াল ‘পাপা ডক’, আর তার ছেলে ‘বেবি ডক।’ ১৯৭১এ বাবার মৃত্যুর পর বিশ্বের কনিষ্ঠতম রাষ্ট্রপতি হন ১৯ বছরবয়েসী বেবিডক। মানুষ ভেবেছিল প্লেবয় মানসিকতার এ ছেলে বেশিদিন টিকবে না। কিন্তু রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের যে যন্তরমন্তর পাপাডক রেখে গেছেন, তার ওপর সওয়ার হয়েই বেবিডক থেকে যান ১৪ বছর!

১৯৬৯ সালে পুত্র জঁক্লোদকে নিজের উত্তরসূরী বানান পাপাডক। পুত্রের ডাকনাম হয় বেবিডক।

পোপ দ্বিতীয় জন পলের সাথে সস্ত্রীক বেবিডক, ১৯৮৩। পোপ হাইতির অবস্থার পরিবর্তনের আহ্বান জানান তার ভাষণে।

বেবিডকের শাসনামলে মুক্ত বাজার অর্থনীতির জোয়ার এসে পড়ে হাইতিতেও। বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়ার খাতিরে দ্যুভালিয়ে স্বদেশকে তাইওয়ান-সিঙ্গাপুর-হংকংয়ের সাথে তুলনা করতে শুরু করেন। আর্থিক প্রবৃদ্ধির ফলভোগী অবশ্য হয় তাঁরই অনুগত রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। রপ্তানি ব্যবসা মূলত ছিল সস্তা শ্রমে তৈরি পোশাক, পরচুলো ইত্যাদি। ধনী-দরিদ্র বৈষম্য ক্রমে বেড়েই চলে। গ্রামাঞ্চল থেকে আরেক দফা শহরমুখী জনসঞ্চারণ হয়। দাতব্য এনজিওর সংখ্যা এত বেড়ে যায় যে বিদেশী ত্রাণকর্মীরা হাইতির নাম দেয় রিপাবলিক অফ এনজিওস! স্থানীয় আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবস্থা বুঝে সে অনুযায়ী দীর্ঘস্থায়ী পদক্ষেপ নেয়ার মত জ্ঞান ছিল না এসব এনজিওর। তারও মাসুল দিতে হয় হাইতিকে।

হাইতির পেশাজীবী জনসংখ্যার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ পাপাডকের আমল থেকেই দেশান্তরী। দ্যুভালিয়ে আমলে প্রায় দশ লাখ মানুষ হাইতি ছাড়ে। আশির দশকে হাইতির বৈদেশিক উপার্জনের এক তৃতীয়াংশই আসত এদের রেমিট্যান্স থেকে। এসকল হাইতিয়ান মায়ামি-নিউইয়র্কের মত বড় শহর থেকে রেডিও ব্রডক্যাস্টের মাধ্যমে দ্যুভালিয়ে পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জিইয়ে রাখে।

১৯৮৫-৮৬ সালে বেবিডকের একনায়কতন্ত্র টলমল হয়ে ওঠে জঁবের্ত্রঁ আরিস্তিদ নামে এক ক্যাথলিক পাদ্রীর রাজনৈতিক উত্থানে। তার সাথে যুক্ত হয় ১৯৮৩ সালে হাইতিসফরে আসা পোপ দ্বিতীয় জন পলের পরিবর্তনের আহ্বান। রিগান প্রশাসনও সকল সমর্থন প্রত্যাহার করে। প্রতিবাদী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের একটি সমাবেশে তঁতঁ মাকুতের গুলিতে বাইস্ট্যান্ডার তিন ছাত্র মারা গেলে সারা দেশে বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়। এমনকি পাপাডকের ‘পোষা’ ভুডু পুরোহিতরাও বেবিডককে বলে দেন, বিদেহী দেশবাসীর আত্মারা দ্যুভালিয়ে দেশ ছাড়া পর্যন্ত শান্ত হবে না। দুই আমেরিকার কোথাও আশ্রয় না পেয়ে ফ্রান্সে নির্বাসনে চলে যান জঁক্লোদ।

ক্যাথলিক পুরোহিত জঁবের্ত্রঁ আরিস্তিদ হয়ে দাঁড়ান দ্যুভালিয়েবিরোধী আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ নেতা। ১৯৯১ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচক হন।

ফুটবল খেলোয়াড় জো গেইতেনস হাইতির নাগরিক হলেও যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে বিশ্বকাপে অংশ নেন ১৯৫০ সালে। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ১-০ গোলে অভূতপূর্ব মার্কিন বিজয়ের নায়ক ছিলেন তিনি। ১৯৬৪ সালে পাপাডকের তঁতঁমাকুতরা তাকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর তার কোন সন্ধান মেলেনি।

বাপছেলের আঠাশ বছরের পরিবারতন্ত্রের পর হাইতির গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার কিছু অবশিষ্ট ছিল না। বিপ্লবী জনতার সমর্থনে সেনাবাহিনী দেশশাসনের সাময়িক ভার নেয়। ৮৭তে নতুন সংবিধান প্রণীত হয়। নানারকম চেক-অ্যান্ড-ব্যালেন্সের পাশাপাশি নগর ও গ্রামের প্রশাসনব্যবস্থাকে সংস্কার করা হয়, ক্রেওল হয় ফরাসীর পাশাপাশি দ্বিতীয় জাতীয় ভাষা। তিন বছর শাসনের পর ১৯৯০ সালে প্রথম মহিলা অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রশাসনিক ক্ষমতা হস্তান্তর করে সেনা কাউন্সিল।

সুষ্ঠু নির্বাচনের পর আরিস্তিদ প্রেসিডেন্ট হলেও ৮ মাসের মাথায় সেনা অভ্যুত্থানের মুখে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। ১৯৯৪ সালে ক্লিনটন প্রশাসনের সহায়তায় আবার হাইতিতে ফিরে শাসনভার নেন তিনি। সেনাবাহিনীকে পুরোপুরি ভেঙে দেয়া হয়, তার জায়গা নেয় যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘপরিচালিত শান্তিরক্ষীবাহিনী। আরিস্তিদ ১৯৯৫এ শান্তিপূর্ণভাবে পরবর্তী সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ২০০০এ আরিস্তিদ আবার নির্বাচিত হন। কিন্তু তার ক্রমাগত স্বৈরাচারী মনোভাবের বিরুদ্ধে একটি আঞ্চলিক বিদ্রোহ শুরু হয়। আবার দেশত্যাগ করতে হয় আরিস্তিদকে। এই ডামাডোলে ২০০৪এ হাইতির স্বাধীনতার দ্বিশতবার্ষিকীর সকল আয়োজন ভন্ডুল হয়ে যায়।

১৯৮৬ সালে বেবি ডককে সফলভাবে উৎখাতের পর উচ্ছসিত জনতা

দ্যুভালিয়ে আমলে প্রচুর হাইতিবাসী স্বদেশ ছেড়ে নৌকায় করে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশে পাড়ি জমায়।

২০১০ সালে ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে হাইতি পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী সৈন্য আর এনজিওগুলো আবারও হাইতিকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে। ভূমিকম্পপরবর্তী কলেরা মহামারীতেও মারা যায় বহু মানুষ। সরকারের দুর্বলতার সুযোগে ২০১১তে আরিস্তিদ-দ্যুভালিয়ে দুজনই আকস্মিক এসে হাজির হন হাইতিতে। দ্যুভালিয়ে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার হন, মারা যান ২০১৪তে।

ভূমিকম্পের পর দশ বছর পেরিয়ে গেছে। হাইতির আইনশৃংখলা পরিস্থিতি আর অবকাঠামোর এখনও করুণ দশা। সাধারণ মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে সেখানে। এর মাঝেই এসেছে গেছে তিনজন রাষ্ট্রপতি আর একটি অস্থায়ী সরকার। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশন হাইতি ছেড়েছে মোটে দু’বছর আগে, তারা পেছনে ফেলে গেছে অগুনতি জারজ সন্তান। ভেনিজুয়েলার সাথে তেলচুক্তিতে দুর্নীতির প্রতিবাদ ২০১৮ থেকে এখন পর্যন্ত চলছে। কবে কিভাবে স্বাধীনচেতা হাইতিবাসীর প্রকৃত স্বনির্ভর ঐক্য ও স্বাধীনতা আসবে, এখনো সে প্রশ্নের জবাব সুদূরপরাহত। হাইতির ভাগ্যে শুধু দুটো জিনিসই তার থেকে বেশি নিশ্চিত — আরো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আর আরো বিপ্লব।

২০১০ সালের ভূমিকম্পের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী

২০১৮ সালে হাইতি সরকার ভেনেজুয়েলা থেকে তেল আমদানির একটি অসম চুক্তি করে। সারা দেশে তেল ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় হাইতিবাসী প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে। সে প্রতিবাদ এখনো চলছে। একসময় যে হাইতি মার্কিনসহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশের ঋণে হাবুডুবু খেত, এখন তার তলারটা কুড়োতে এসেছে ভেনেজুয়েলার মত ‘সমাজতান্ত্রিক’ ‘ভ্রাতৃত্বকামী’ দেশগুলি।

হাইতি – ৪, দখলদার মার্কিন, ১৯১৫-৩৪

বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ হাইতির একটি কালো অধ্যায় শুধু নয়, ঔপনিবেশিকতাবিরোধী আদর্শের ধ্বজাধারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্যেও একটা লজ্জাজনক সময়।

এ সময়ে হাইতির উত্তরের ‘দানব’ যুক্তরাষ্ট্র পরাশক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করছে। ইউরোপীয় শক্তিগুলো ক্রমশঃ আমেরিকা মহাদেশ থেকে হাত গুঁটিয়ে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পরদেশনীতির নির্দেশক হয়েছে মনরো ডক্ট্রিন, তার মূল লক্ষ্য দুই আমেরিকার নবজাত স্বাধীন দেশগুলি যেন আবার ইউরোপীয়দের পদানত না হয়। ১৯০১ সালে রাষ্ট্রপতি থিওডর (টেডিবিয়ার!) রোজাভেল্ট এতে যোগ করেন আরেকটি করোলারি। আমেরিকার স্বাধীন কোন দেশে অস্থিতিশীলতার কারণে যদি ইউরোপীয় হস্তক্ষেপের আশংকা দেখা দেয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র সেদেশের নিয়ন্ত্রণ নিজ হাতে তুলে নেবে।

মনরো ডক্ট্রিনের লেজুড় ধরে ১৮৯৮এ কিউবার স্বাধীনতাকামীদের স্প্যানিশবিরোধী যুদ্ধে মার্কিনরা অংশ নেয়। স্পেনের পরাজয়ের সাথে সাথে যুক্তরাষ্ট্রের এখতিয়ারে এসে পড়ে গুয়াম, ফিলিপাইনস, পোর্তোরিকো, কিউবা। নতুন সুযোগের সন্ধানে কাউবয় মানসিকতার মার্কিন ব্যবসায়ীরা এসব জায়গায় আসতে শুরু করে। স্বাধীনতার বদলে উল্টো নতুন মনিব পায় দেশগুলি।

সারা বিশ্বেই অবশ্য তখন সময়টা বেশ উত্তাল। ব্রিটেন ও জার্মানির মধ্যে নতুন প্রযুক্তির দূরপাল্লার কামান আর ড্রেডনট যুদ্ধজাহাজ নিয়ে আর্মস রেস চলছে। আফ্রিকার উপকূলের স্প্যানিশ আর ফরাসী বন্দরগুলিকে বিপন্ন করে তুলছে জার্মানদের নতুন নৌশক্তি। রুশরা মধ্য এশিয়া জয় করে আফগানিস্তানের সীমান্তে এসে ব্রিটিশ ভারতকে স্নায়ুচাপে রেখেছে। ইউরোপে তুরস্ক আর এশিয়ায় চীন, দুই সিক ম্যান ভেঙে প্রতি বছর নতুন স্বাধীন দেশ তৈরি হচ্ছে, তাদের কেউ সংযুক্ত হচ্ছে নবাগত আঞ্চলিক শক্তিগুলির সাথে।

১৯০২ সালে ঋণখেলাপি ভেনিজুয়েলার বন্দরগুলি অবরোধ করে ব্রিটিশ ও জার্মান জাহাজ। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় সে সমস্যার সমাধান হয়।

যুক্তরাষ্ট্রেরও বসে থাকার কোন অবকাশ ছিল না। ঊনবিংশ শতকে অস্ট্রিয়া-হাঙেরি মেক্সিকোতে এক তাঁবেদার সম্রাট বসিয়েছিল। মার্কিনসমর্থিত স্থানীয়রা তাদেরকে হঠায়। তারপর থেকে মেক্সিকোর আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে প্রায়শই নাক গলাত যুক্তরাষ্ট্র। জার্মানিও দক্ষিণ আমেরিকাতে সাম্রাজ্যবিস্তারের চেষ্টা চালায়। পানামায় খাল করার পরিকল্পনা পৃথিবীর অনেক পরাশক্তিরই ছিল। জার্মানরা সে চিন্তা থেকে ক্যারিবিয়ান ও মধ্য আমেরিকায় ঘাঁটি গাড়তে শুরু করে। তাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণের গোপন পরিকল্পনাও একটা ছিল। পুরো ব্যাপারটা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। জার্মানির সাবমেরিন বেস বানানো ঠেকাতেই মার্কিনরা ডেনিশ ওয়েস্ট ইন্ডিজ কিনে নেয় ডেনমার্কের কাছ থেকে। কলোম্বিয়া থেকে পানামা আলাদা দেশে পরিণত হয় মার্কিন ইন্ধনেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এসব কাজকর্ম দেখেশুনেই মেক্সিকোর তদকালীন রাষ্ট্রপতি পরফিরিও দিয়াজ বলেছিলেন, খোদা থাকেন আকাশ ‘পরে, আর মার্কিন আছে ঘাঁড়ের ‘পরে!

হাইতির অবস্থাও এসময় বেশি ভাল নয়। ১৯১১ থেকে ১৯১৫র মধ্যে এসেছে-গেছে ৭জন প্রেসিডেন্ট। হাইতির বন্দরগুলিতে প্রচুর জার্মান অভিবাসী বণিক। আমদানি-রপ্তানি ব্যবসার আশি ভাগ তাদের হাতে। দেশের সরকার ও এলিট শ্রেণীর ওপর তাদের টাকার বেশ প্রভাব। অন্যদিকে হাইতির ৭০% রপ্তানী বাণিজ্য মার্কিনের সাথে। জার্মান, মার্কিন ও ফরাসী ব্যাংকের কাছেও বিশাল ঋণ হাইতির। বছরে বছরে প্রশাসন পরিবর্তনের কারণে ঋণপরিশোধে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

অস্ট্রিয়া-হাঙেরির সম্রাট ফ্রানৎস ইয়োসেফের ছোট ভাই ম্যাক্সিমিলিয়ান হন মেক্সিকোর প্রথম সম্রাট (১৮৬৪-৬৭)। মার্কিন মনরো ডক্ট্রিনকে ইউরোপীয় পরাশক্তিগুলো শুরুতে তাচ্ছিল্য করত।

মার্কিন রাষ্ট্রপতি টেডি রোজাভেল্টের কার্টুনচিত্র, হাইতিসহ ক্যারিবিয়ান সাগরের দেশগুলি থেকে ঋণ আদায়ের জন্যে মুগুর নিয়ে টহল দিচ্ছেন, ১৯০২ সাল।

১৯১৪ সালে দুই বিবাদমান দলের সশস্ত্র বিরোধের মাঝে মার্কিন মেরিন সেনা পোর্তোপ্র্যাঁসে অবতরণ করে। সবার চোখের সামনে দিয়ে তারা জাতীয় ব্যাংক থেকে প্রায় পাঁচ লাখ ডলারের সোনা নিয়ে চলে যায়। এই ‘লুট’ ছিল অস্থিতিশীলতার মুখে কেবল মার্কিন ব্যাংকের হাইতিস্থিত রাষ্ট্রীয় শাখা থেকে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের শাখায় টাকা বিনিময়! হাইতির মানুষের জন্যে এ ছিল এক অশনিসংকেত।

১৯১৪তে বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্র হাইতিতে জার্মান প্রভাব ও বিপ্লবের আশংকা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে। ১৯১৫তে প্রেসিডেন্ট উলসন বলেন, হাইতিকে ‘ঠিকঠাক’ করার সময় এখনই। এর পরই হাইতির প্রেসিডেন্ট স্যাম ১৬৭জন রাজনৈতিক বন্দীর একতরফা মৃত্যুদন্ডাদেশ দেন। তার প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ জনতা স্যামকে সম্রাট দেসালিনের মত রাজপ্রাসাদ থেকে টেনে বের করে মেরে কেটে টুকরোটুকরো করে ফেলে। আর দেরি না করে ২০০০ মেরিনের একটি দল পাঠিয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। তারা পোর্তোপ্র্যাঁসে নেমে সরকারী ভবনগুলোর দখল নেয়। ধীরে ধীরে তারা ছড়িয়ে পড়ে প্রদেশগুলিতে।

হাইতির ব্যাপারে কড়ানীতির ঘোষণা করেন প্রেসিডেন্ট উইলসন, নিউ ইয়র্ক টাইমসের রিপোর্ট, ১৯১৫

রক্তাক্ত সংঘাত ছাড়াই হাইতির সম্পূর্ণ দখল নিয়ে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। হাইতির মানুষ সম্ভবত অবাক হয়নি। এমনটারই অপেক্ষায় ছিল অনেক শিক্ষিতজন ও ব্যবসায়ী। তাদের আশা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের কিছুদিনের কড়া শাসন হাইতিকে স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরিয়ে আনবে, জার্মান বণিকদের অশুভ প্রভাবও কমে যাবে। হাইতিদখলের তারিখটা ১৯১৫র ২৮শে জুলাই — বিশ্বযুদ্ধ শুরুর ঠিক এক বছর পূর্তির দিন।

দখলদার মার্কিন সেনাপতিদের সাথে সংলাপে বসেন হাইতির রাজনীতিবিদরা। তাদের মধ্যে সবচে বেশি সমর্থন ছিল বোবো বলে এক মার্কিনবৈরী নেতার। তাকে সরাসরি পদাসীন করার পরিবর্তে মার্কিন সেনাপ্রধান সেনেটরদের বললেন সংসদের নিয়মানুযায়ী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবে। বোবোর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মত আরেক রাজনীতিবিদ দার্তিনেগাভকে খুঁজে বের করল মার্কিনরা। সেনেটের ভোটে দার্তিনেগাভই জিতলেন।

হাইতির মার্কিনসমর্থিত প্রেসিডেন্ট দার্তিগেনাভ, মেরিনসেনাপরিবেষ্টিত, ১৯১৬

ধারের অংক কড়ায়গন্ডায় বুঝে নেয়ার লক্ষ্যে হাইতির শুল্ক ও রাজস্বের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ নেয় মেরিনরা। হাইতির সংসদ মার্কিন প্রশাসনকে সাংবিধানিক বৈধতা দেয়। গুরুত্বপূর্ণ সরকারী পদের নিয়োগ অনুমোদন আসতে হত স্বয়ং মার্কিন রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে। সারা দেশে মার্শাল ল’ জারি হয়, খর্ব হয় সাংবাদিকদের স্বাধীনতা। দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসার ওপর অন্যান্য বিদেশী রাষ্ট্রের মালিকানা নিষিদ্ধ করা হয়। এক সংবাদপত্র সম্পাদক যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে উইলসনের সাথে সাক্ষাত করে তাকে বলেন যে হাইতিকে ঠিক করার রাস্তা এটা নয়। কিন্তু কে শোনে কার কথা! মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ ক্ষমতায়নের নতুন নেতা বুকার টি ওয়াশিংটন পর্যন্ত মার্কিনের হাইতিদখল নিয়ে উচ্চাশা প্রকাশ করেন যে, এভাবেই দেশটির কৃষ্ণাঙ্গরা দ্রুত ‘সভ্য’ হয়ে উঠবে।

মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ শিক্ষাবিদ বুকার টি ওয়াশিংটন (১৮৫৬-১৯১৫), হাইতিতে মার্কিন দখলদারিত্ব সমর্থন করে বিবৃতি দেন।

মার্কিন প্রশাসন হাইতির সেনাবাহিনীকে নতুন করে ঢেলে সাজায়। নতুন প্রতিরক্ষাবাহিনীর নাম দেয়া হয় জন্দার্ম। বহু হাইতিয়ান সেনাসদস্য পালিয়ে পাহাড়ী অঞ্চলে গিয়ে গেরিলা সংগ্রাম চালাতে থাকে। এরা অবশ্য খাদ্যসহ অন্যান্য প্রয়োজনে আশপাশের গ্রামগুলোর ওপর লুটতরাজ চালাত। শীঘ্রই এদেরকে ‘ডাকাত’ আখ্যায়িত করে কঠোরভাবে দমন করে মেরিন সৈন্যরা। হাইতির মানুষ বছরের পর বছর বিপ্লব আর গৃহযুদ্ধে ক্লান্ত। মেরিনদের শুরুতে ভালভাবেই গ্রহণ করে নেয় তারা, এমনকি স্বদেশী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সাহায্যও করে অনেক ‘রাজাকার’।

কিন্তু মেরিনসেনাদেরও অত্যাচার শুরু হয়ে যায় এর পর। বিদ্রোহী ‘ডাকাত’ সন্দেহে নির্বিচারে ধরপাকড়, বিচারবহির্ভূত হত্যা, ধর্ষণ, ইত্যাদিতে জড়িয়ে পড়ে তারা। হাইতির মানুষের সংস্কৃতি তারা বুঝত না, তাদের ভুডু আচার আর ক্রেওল ভাষাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখত। বোয়াইয়েরের আমলের কোর্ভে দাসশ্রমের আইনেরও বেপরোয়া ব্যবহার করে মেরিন আর জন্দার্ম। গ্রামের জোয়ানদের লেবার ক্যাম্পে পাঠিয়ে অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ শুরু হয়। এসব শ্রমের বিনিময়ে মজুরি ছিল স্বল্প। দুয়েকটা জায়গায় ক্রীতদাসের মত গলায় দড়ি পরিয়ে এসব শ্রমিকদের কর্মস্থল নেয়া হয়েছিল।

বিদ্রোহী ক্যাকোদের সন্ধানে হাইতির পাহাড়ী এলাকায় অভিযান চালাচ্ছে মার্কিন মেরিন সেনারা, তাদের গাইড হাইতিবাসী কৃষ্ণাঙ্গ ছবির ডানপাশে, ১৯১৯

মার্কিন মেরিন ও হাইতির জন্দার্ম বিদ্রোহী দলগুলিকে পরাজিত করতে সমর্থ হয়, ১৯১৯

অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে হাইতির আধুনিকায়ন শুরু হয় মার্কিন শাসনামলে। হাইতির কোস্ট গার্ড তৈরি হয় মেরিনদের সহায়তায়। চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নতি হয় মার্কিন রেডক্রসের সাহায্যে। কয়েকটি কারিগরি প্রশিক্ষণ কলেজও শুরু হয়, সেসবে পড়াতেন মার্কিন থেকে মোটা বেতনে আনা অধ্যাপকের দল। সব মিলিয়ে হাইতির শহুরে মধ্যবিত্তের একটি মিশ্র অনুভূতি ছিল মার্কিন শাসন নিয়ে। উন্নয়নের ব্যাপারে মার্কিনদের প্রতি সমর্থন থাকলেও প্রদেশ ও গ্রামাঞ্চলের মানুষদের ওপর যে ধরনের জুলুম তারা প্রত্যক্ষ করে, তাতে অতীতে নিজেদের জুলুমেরই প্রতিফলন তারা দেখতে পায়। হীনমন্যতাবোধ থেকে নতুন একটি আত্মপরিচয়ের সূচনা হতে থাকে।

প্রাদেশিক প্রশাসনে সেনাশাসকদের যে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল, সেটা খর্ব করে কেন্দ্রীয় শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। স্থানীয় কর আদায়ের কাজটা এসে পড়ে মেরিনদের হাতে। কিন্তু যে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে প্রদেশে শাসক-শাসিতের সম্পর্ক ছিল আগে, তা পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার যে শক্তিটা ছিল প্রদেশগুলিতে, সেটা বিনষ্ট হয়ে যায়।

মার্কিন মেরিনদের প্রশিক্ষিত হাইতির নতুন প্রতিরক্ষাবাহিনী জন্দার্মের সদস্য, ১৯১৯

হাইতিতে মার্কিন মেরিন সেনাদল বিদ্রোহী কাকোদের বিরুদ্ধে অভিযানে স্থানীয় গাইডদের সহায়তা লাভ করে (ডান পাশে), ১৯১৫

মার্কিন উপদেষ্টাদের সাহায্যে নতুন একটি সংবিধানও প্রবর্তিত হয়। হাইতির সম্পত্তিমালিকানা শুধুমাত্র কালোদের অধিকার, সেই প্রাচীন সাংবিধানিক ধারাটি রহিত করা জন্যে সংসদে প্রস্তাব আনেন দার্তিনেগাভ। এতে সাড়া না পেয়ে তিনি সংসদ স্থগিত করেন। তারপর গণভোটের মাধ্যমে সংবিধানের এই ‘সেকেলে’ নিয়মগুলি পরিবর্তিত হয়। রাষ্ট্রপতি পদের মেয়াদও তুলে নেয়া হয়। সব মিলিয়ে ১৯১৮র সংবিধান হাইতির রাজনীতির চেক-অ্যান্ড-ব্যালান্সকে কয়েক দশক পিছিয়ে দেয়।

একই সময়ে হাইতিতে মার্কিন কম্পানিগুলোর প্রবেশ শুরু হয়। বিশেষ করে আখ-চিনি, আনারস আর অন্যান্য গ্রীষ্মমন্ডলীয় ফলমূলের চাষাবাদ ও রপ্তানির জন্যে জায়গাজমি তারা কিনতে শুরু করে। বিনিয়োগ বাড়ার সাথে সাথে রাস্তাঘাট ও রেললাইনও তৈরি শুরু হয়। কিন্তু এসব প্রকল্পের কারণে অনেক ক্ষুদ্র চাষী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেসব কম্পানিতে চাকরির সুযোগ এদেরকে দেয়া হলেও তারা সে কাজ করতে চাইত না। শ্রমের অভাবে মার্কিন কম্পানিগুলির ব্যবসা ক্রমে পরিত্যক্ত হয়। মার্কিন প্রশাসন চেষ্টা করেও হাইতির অর্থনৈতিক সম্ভাবনাগুলি পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করতে পারেনি। তবে পশ্চিমাঞ্চলে কফি চাষ ও রপ্তানির সুবাদে বেশ প্রবৃদ্ধি আসে।

মার্কিনবিরোধী স্বাধীনতাযোদ্ধা শার্লমেইন পেরল্তের মৃতদেহের ছবি মেরিনরা প্রকাশ করে হাইতির সংবাদপত্রে। তার স্মৃতি থেকেই এ চিত্রকর্ম ‘দ্য ক্রুসিফিকশন অফ শার্লমেইন পেরল্ত ফর ফ্রীডম ১৯৭০’ আঁকেন হাইতির শিল্পী ফিলোমে ওব্যাঁ।

হাইতির অবকাঠামো উন্নয়নের কাজে মেরিনরা গ্রামাঞ্চলের যুবকদের বাধ্যতামূলক কোর্ভে শ্রমে নিযুক্ত করে, ১৯২০

১৯২২ সাল নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ হাইতিতে মেরিনদের কার্যকলাপের ব্যাপারে প্রচুর খবর পেতে থাকে। হাইতিতে কোর্ভে দাসশ্রমের ব্যবহার আর বিদ্রোহীদের কঠোরভাবে দমনের ব্যাপারে মার্কিন সেনেট তদন্ত শুরু করে। এর রেশ ধরে হাইতির মার্কিন প্রশাসনের জবাবদিহিতা বাড়ানো হয়। ততদিনে বিদ্রোহ স্তিমিত হয়ে এসেছে।

কিন্তু যে দেশের মানুষ নিজেদের সরকারকেই বছরে বছরে উচ্ছেদ করে এসেছে, তাদের কতদিন দমিয়ে রাখা সম্ভব! ১৯২৯ সালে মার্কিনদেরই প্রতিষ্ঠিত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বৃত্তি কমানোর প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে পড়ে। তাদের আরো অনেক অভিযোগের মধ্যে ছিল মার্কিন অধ্যাপকদের স্থানীয় ভাষায় পড়ানোর অপারগতা, হাইতির কোষাগার থেকে তাদেরকে প্রদত্ত মোটা বেতন, স্থানীয় শিক্ষকদের নিচু পদ, ইত্যাদি।

মার্কিন রেড ক্রসের ডাক্তার-নার্সদের সহযোগিতায় হাইতির চিকিৎসাব্যবস্থার বেশ উন্নয়ন হয়, ১৯২৫

হাইতিতে মেরিনসেনাদের ক্ষমতার অপব্যবহারের খবর মার্কিন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতে শুরু করলে সেনেট এ ব্যাপারে একটি তদন্ত শুরু করে, নিউ ইয়র্ক টাইমসের রিপোর্ট, ১৯২১

একটি সমাবেশে গুলিবর্ষণে এক ছাত্রের মৃত্যু হলে সারা হাইতিতে জনবিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও মার্কিনদের নিন্দা শুরু হয়ে যায়। ১৯৩০ সংবিধানের বর্ধিত ভোটাধিকারে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ভ্যাঁসঁর বৈরী মনোভাব যুক্ত হয় তার সাথে। সমাজের সর্বস্তরে এরকম বিরোধের মুখে থেকে মার্কিনরা হাইতি ছাড়ার পাঁচ বছরের সময়সীমা নির্ধারণ করে। সে মেয়াদ উত্তীর্ণ হবার আগেই নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ১৯৩৪এ কেটে পড়ে মেরিনরা। তবে মার্কিন অর্থনৈতিক উপদেষ্টা থেকে যায় ১৯৪১ পর্যন্ত। ১৯৪৭এ সকল ঋণ পরিশোধিত না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণও মার্কিনদের হাতে থাকে।

১৯২৯ সালে ছাত্রবিক্ষোভের মুখে হাইতি ছাড়ার পরিকল্পনা ঘোষণা করে মার্কিন প্রশাসন

মার্কিন দখলে থাকা অন্যান্য দেশে মার্কিন সংস্কৃতি জনপ্রিয়তা পেলেও হাইতিতে সেরকমটা হয়নি। এর মূল কারণ হাইতিবাসীর আদিম সন্দেহপ্রবণ স্বভাব। যেমন, পোর্তোরিকো, কিউবা ইত্যাদি জায়গায় মার্কিন খেলা বেসবল এখনও জনপ্রিয়, কিন্তু হাইতিতে নয়। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ সঙ্গীত-বাদ্যের প্রভাব পড়ে অবশ্য। প্রথমদিকের গানবাজনায় মার্কিনদের প্রশংসা ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে যায় প্রতিবাদসঙ্গীতে। ভুডুচর্চার স্বাধীনতা না থাকায় প্রচুর হাইতিবাসী প্রতিবেশী দেশগুলিতে পাড়ি জমায়।

মার্কিনদের ওপরও হাইতির কম প্রভাব পড়েনি। ত্রিশের দশকের হলিউডি হরর ফিল্মে মামি, ড্রাকুলার পাশাপাশি জোম্বি বা অর্ধমৃত গোলামের যে ক্যারেক্টার বেশ জনপ্রিয় হয়, সেটা আসলে হাইতিরই রপ্তানি! ভুডু ম্যাজিকে মন্ত্র পড়ে সাইকেডেলিক গুণসম্পন্ন গাছের শেকড়-বাকর খাইয়ে শত্রুকে আজ্ঞাবহ দাসে পরিণত করার একটা মিথ প্রচলিত ছিল। এর ক্রেওল নাম জোনবি — জোম্বি নামটা সেখান থেকেই। হাইতিদখলের ইতিহাস মার্কিনরা ভুলে গেছে, কিন্তু এখনো রয়ে গেছে জোম্বি।

হাইতির ভুডু চর্চা সম্পর্কে মার্কিন জনসাধারণ এ সময় অবহিত হতে শুরু করে, তার প্রভাব পড়ে হলিউডি ছবিতেও। প্রথম জোম্বি মুভি ১৯৩২ সালের হোয়াইট জোম্বির দৃশ্য।

দখলদারিত্বের দুই দশকে হাইতির শিক্ষিত সমাজে ব্যাপক সোল-সার্চিং চলে। মার্কিন আমলে বৈদেশিক বাণিজ্য আর বিনিয়োগের পুরোদস্তুর স্বাদ পেয়েছে দেশের বিশাল একটা জনগোষ্ঠী। পেছন ফেরার কোন সম্ভাবনা আর নেই। স্বাধীনতাপরবর্তী রাষ্ট্রনেতারা সেকারণে মার্কিনদের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলেন।

দ্বিতীয় এ স্বাধীনতার তাৎপর্য কি হতে পারে সে নিয়ে কোন একক ধ্যানধারণা অবশ্য হাইতিবাসীর গড়ে ওঠেনি। তারা না পারে মার্কিন ধ্যানধারণা নিয়ে সামনে পা বাড়াতে, না পারে তাদের আগের অবস্থায় ফিরে যেতে। বলতে পারি, মার্কিনরা হাইতি ছেড়ে যাবার পর দেশটির মানুষদের অবস্থা দাঁড়ায় জোম্বির মত। নতুন আরম্ভ কিভাবে হবে সে প্রশ্নের জবাব সন্ধান করতে করতেই তারা তলিয়ে যেতে শুরু করে আরেক অতল গহ্বরে।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!