দুই দশকের মার্কিন দখলদারিত্বের শেষে দ্বিতীয়বার হাইতি স্বাধীন হয় ১৯৩৪ সালে। ততদিনে অনেক পাল্টে গেছে দেশটি। মার্কিন প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক প্রভাবে অবকাঠামোর উন্নতি হয়েছে। সামান্য হলেও স্থিতিশীলতা আর সমৃদ্ধির স্বাদ পেয়েছে শহুরে মানুষ। কিন্তু মফস্বল আর গ্রামাঞ্চলে পূর্বেকার সেনাশাসিত যে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা ছিল, দরকার পড়লে কেন্দ্রীয় সরকারের অবিচারের প্রতিবাদের উৎস ছিল যেটা, তা পুরোপুরি বিলুপ্ত। গ্রামের ক্ষমতার ভিত্তিগুলি বিনষ্ট হয়ে শহরগুলিতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত।
অর্থনৈতিক সুযোগের আশায় গ্রাম থেকে শহরমুখী হয়েছে বহু মানুষ। অনেকে দেশান্তরী। প্রাচীন লাকুভিত্তিক স্বাধীন গ্রাম্য সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। সংসদীয় ব্যবস্থার দুর্বলতার সুযোগে স্বাধীন হাইতির শাসক ও এলিট শ্রেণী রাজধানীভিত্তিক জন্দার্মসমর্থিত একনায়কতন্ত্র কায়েম করে। নতুন রাষ্ট্রপতি ভ্যাঁসঁ মার্কিন ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশের সাথে ভাল সম্পর্ক রেখে চলেন। আগের অন্যান্য মুলাটো নেতার মত তাঁরও বিশ্বাস ছিল, সিংহভাগ হাইতিবাসীর গণতন্ত্র বোঝা ও চর্চা করার মত শিক্ষা-সামর্থ্য নেই।
ভ্যাঁসঁর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে যে দলটি দাঁড়া হয়, তারা ছিল শহুরে বামপন্থী। এদের দৃষ্টিতে ভ্যাঁসঁ ছিলেন সাম্রাজ্যবাদী মার্কিনের হাতের পুতুল। ভ্যাঁসঁ নবগঠিত এই কম্যুনিস্ট পার্টিকে কড়াহাতে দমন করেন। একই সাথে চলে গ্রাম্য ভুডুবিরোধী সংস্কারাভিযান। প্রতিবেশী ডমিনিকান রিপাবলিকের একনায়ক ত্রুহিয়োর সাথে ভ্যাঁসঁর বন্ধুত্ব ছিল। ১৯৩৭ সালে দুই দেশের সীমান্তে ডমিনিকান সৈন্যরা হাইতিয়ান শ্রমিকদের ওপর গণহত্যা চালায়। ভ্যাঁসঁর নীরবতার প্রতিবাদে পোর্তোপ্র্যাঁসে জোরদার আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। এর জের ধরে ভ্যাঁসঁ গদি ছাড়েন ১৯৪১ সালে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে রাবারের প্রচুর চাহিদা থেকে লাভ করতে লেস্কো সরকার ক্ষুদ্র কৃষকদের জমিতে রাবারের গাছ বসায়। কিন্তু সে প্রকল্প লাভের মুখ দেখার আগেই যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। মার্কিন ঋণের বোঝা আর অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বামপন্থী ছাত্র-শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে দেশ ছেড়ে পালান লেস্কো। তার জায়গা নেন মার্কিনদের প্রস্থানপরবর্তী প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট এস্তিমে।
এস্তিমে সমাজতান্ত্রিক আদর্শে অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু করেন। বিদেশী কম্পানির মালিকানাধীন বড় ফলের বাগানগুলিকে রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়। এতে উল্টো লাভজনক ব্যবসাগুলি ধ্বংস হয়ে যায়। পর্যটনশিল্পে সরকারী বিনিয়োগও লাভের মুখ দেখেনি। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে ব্যর্থ এস্তিমের বিরুদ্ধে এক দফা বিপ্লবের পর সেনাশাসক মাগ্লোয়ার ক্ষমতায় আসেন ১৯৫০এ। মুক্ত বিদেশী বিনিয়োগের ফলে একটি স্বর্ণালী যুগের সূচনা হয়। কিন্তু ১৯৫৬ নাগাদ মাগ্লোয়ারকেও বিদায় নিতে হয়। নগর-অর্থনীতির উন্নতি হলেও কৃষিক্ষেত্রের করুণ হাল, মৃত্তিকার অবক্ষয়, বৃক্ষনিধন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদির ফলে গ্রাম্য জনসংখ্যার ক্রমাগত অবনতি হতে থাকে।
মাগ্লোয়ারের পর ক্ষমতার শূন্যতা পূরণ করতে তিন প্রতিদ্বন্দ্বীর আবির্ভাব ঘটে, একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী যার পরিকল্পনা হাইতিতে বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি, আরেকজন মার্কসবাদী, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের রাষ্ট্রায়ত্তকরণ তার লক্ষ্য। আর তৃতীয়জন — ফ্রঁসোয়া দ্যুভালিয়ে — মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষিত ডাক্তার, তিনি বিশ্বাস করতেন কৃষ্ণাঙ্গ জাতীয়তাবাদে। তার তত্ত্বে পশ্চিমা — অর্থাৎ শ্বেতাঙ্গ — ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও গণতন্ত্র আফ্রিকান সমাজসংস্কৃতিতে অচল। দ্যুভালিয়ের ব্যক্তিত্বপূজারী জঙ্গী কৃষ্ণাঙ্গরা কাগুলার নামে একটি আধাসামরিক বাহিনী গঠন করে। এরা রাস্তাঘাটে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে গুন্ডামি, বোমাবাজি, খুনখারাবি ইত্যাদি শুরু করে দেয়। দ্যুভালিয়ে সামরিক বাহিনীর মাঝেও সমর্থনের খুঁটি খুঁজে বের করেন।
প্রথমে বামপন্থীরা ক্ষমতায় গেলেও শীঘ্রই দ্যুভালিয়ের পক্ষে সেনা ও জনঅভ্যুত্থানে তারা অপসারিত হয়। ১৯৫৭ সালে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জবরদস্তি আর কারচুপির মাধ্যমে জয়ী হয়ে আসেন ‘ডক’ (ডক্টর) দ্যুভালিয়ে। নিজের ব্যক্তিত্বের কাল্ট ঘিরে সরকারের সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন দ্যুভালিয়ে। প্রতিবাদ নিয়ন্ত্রণে আনার জন্যে একরোখা নিপীড়নের আশ্রয় নেন তিনি। বিরোধীদলীয় নেতারা হয় নিরুদ্দেশ হয়ে যান, নয়ত আইনরক্ষীদের প্রহারে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকেন। ২০ থেকে ৬০ হাজারের মত মানুষকে হত্যা করে তাঁর প্রশাসন।
নতুন সংবিধান প্রনয়ণ করে সরকারী কর্মীদের ধর্মঘট বেআইনী ঘোষিত হয়। ক্রেওল ভাষাকে অফিশিয়াল মর্যাদা আর নারীদের ভোটাধিকার দেয়া হলেও, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার এতদিনের ভারসাম্য সেনেট বিলুপ্ত হয়। অনুগত লোকজনকে সংসদে মনোনীত করার ব্যাপারটাও গণভোটের মাধ্যমে আইনে পরিণত হয়। সারা দেশে স্বাধীন মতপ্রকাশ থমকে দাঁড়ায়। সামরিক বাহিনীর স্বাধীনতা খর্ব করতে সমান্তরাল আরেকটি বাহিনী গঠন করেন দ্যুভালিয়ে। জাতীয় নিরাপত্তা স্বেচ্ছাসেবকবাহিনী নামে এ সংগঠনটির সদস্যদের ডাকনাম ছিল ‘তঁতঁ মাকুত’, যার অর্থ ‘আংকল বুগিম্যান।’ সেনাবাহিনীর দ্বিগুণ লোকবল ছিল এদের। বিরুদ্ধমত নিষ্পেষণে এমন কোন অসাধ্য ছিল না, যেটা তঁতঁ মাকুত করত না। নতুন সংবিধানে নারীস্বাধীনতার কথা থাকলেও নারীবাদীদেরও ছাড় দেয়নি তঁতঁ মাকুত।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলিরও রাজনীতিকরণ হয়। নিষিদ্ধ সংগঠনের কাতারে যেমন পড়ে বামপন্থী পার্টিগুলি, তেমন বয়স্কাউটদের মত নখদন্তহীন সংগঠনগুলিও। কার্নিভালে মনোরঞ্জনের জন্যে রাজনৈতিক ক্যারিকেচারের যে পুতুলখেলা এতদিন চালু ছিল, তার খেলিয়েরাও দ্যুভালিয়ে সরকারের শূলদৃষ্টিতে পড়ে জেলে নিক্ষিপ্ত হয়। কিছু মানুষ সুযোগ বুঝে তঁতঁ মাকুত আর দ্যুভালিয়ের নাম মুখে এনে বিভিন্ন জায়গায় সুবিধা বাগিয়ে নিতে শুরু করে। দ্যুভালিয়ের নিকটজনদের আত্মীয়তা দাবি করলে সাতখুন মাফ! মতবিরোধীদের দ্যুভালিয়ে সাম্রাজ্যবাদী-উপনিবেশবাদীদের দোসর আখ্যা দেন, আর নিজে হয়ে বসেন কৃষ্ণাঙ্গ ‘মানবতাবাদী’ আদর্শের সাষ্টাঙ্গ অবতার! ভুডু মৃত্যুদেবতা বাওন সামদির আদলে কালো স্যুট-হ্যাট পরে চলাফেরা শুরু করেন দ্যুভালিয়ে।
দ্যুভালিয়ের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি বেশ দোদুল্যমান ছিল। স্নায়ুযুদ্ধের সুযোগে আইজেনহাওয়ার প্রশাসনের কাছে কম্যুনিস্টবিরোধী সেজে দ্যুভালিয়ে অর্থ ও অস্ত্র সহায়তা বাগিয়ে নেন। কেনেডি অবশ্য দ্যুভালিয়েকে সরানোর পাঁয়তারা করেন। তাঁর ভয় ছিল, কিউবাতে বাতিস্তার নিপীড়নের কারণে কাস্ত্রোর কম্যুনিস্টরা যেভাবে বিজয়ী হয়, হাইতিও সেদিকে চলেছে। তাঁর পরিকল্পনা ছিল কিউবা ও হাইতিতে গেরিলা বাহিনী পাঠিয়ে দু’দেশেই একসাথে একনায়কতন্ত্রী সরকার উৎখাত। এতে মার্কিনদের অংশীদার হত ডমিনিকান রিপাবলিকের নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বোশের সরকার।
দ্যুভালিয়ে উল্টো কারচুপির নির্বাচন করে মেয়াদ এক দফা বাড়িয়ে নেন। প্রতিটি ভাষণে যুক্তরাষ্ট্রে কালোরা কিধরনের অবিচারের মধ্য দিয়ে যায় সেটা দেশবাসীকে স্মরণ করিয়ে দিতেন তিনি। তাতে কাজ হত ম্যাজিকের মত। কেনেডির মৃত্যু আর বোশের পতনের পর সে যাত্রা বেঁচে যান দ্যুভালিয়ে। মার্কিনদের সহায়তা ছাড়াই যখন একটি ছোট গেরিলাদল হাইতিতে আসে দ্যুভালিয়েকে উৎখাত করতে, তখন জনসাধারণ তাদের কোন সাহায্য করেনি। সেই অভিযান ব্যর্থ হয়, আর নিহত যোদ্ধাদের কাটা মুন্ডু জনসমক্ষে প্রদর্শিত হয়। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট হাইতির ব্যাপারে হাল ছেড়ে দেয় এই বলে যে, প্যারানয়েড পিপল ডিজার্ভ এ প্যারানয়েড প্রেসিডেন্ট।
১৯৬৭ সালে আরেকটি ‘গণভোট’ ডেকে নিজেকে আজীবন রাষ্ট্রপতি বানিয়ে নেন দ্যুভালিয়ে। সে ভোটে টিক মারার অপশন ছিল কেবল একটি! এরপর দ্যুভালিয়ে সরকার আর তঁতঁ মাকুত লাগামছাড়া আচরণ শুরু করে দেয়, যার মূল্য দিতে হয় সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বরেণ্য ব্যক্তিত্বদেরকে। বিশ্বকাপ ফুটবলের খেলোয়াড় গেইতেনসের পরিবারের অল্প কয়েক সদস্য দ্যুভালিয়েবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত ছিল। কিন্তু নিরুদ্দেশ করে দেয়া হয় গেইতেনসকেই। হাইতিবাসীর জন্যে গেইতেনস ছিলেন উদাহরণমাত্র। হাইতির মানুষ ক্যাথলিক প্রার্থনা লর্ডস প্রেয়ারকে কৌতুক করে পাল্টে দেয় এভাবে, ‘আওয়ার ডক হু আর্ট ইন দ্য প্যালে নাসিওনাল ফর লাইফ, হ্যালোড বি দাই নেইম বাই ফিউচার অ্যান্ড প্রেজেন্ট জেনারেশন।’
দ্যুভালিয়ে আমলে দুর্নীতি আর অরাজকতার কারণে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ে। হাইতির সমসাময়িক প্রবাদবাক্যে, দ্যুভালিয়ে অলৌকিক শক্তিবলে হাইতিকে শিখিয়েছেন খাদ্য ছাড়াই কিভাবে ক্ষুধানিবারণ করা যায়। ১৯৬১ থেকে ৬৭র মধ্যে রপ্তানী আয়ের ৩০ শতাংশ সংকোচন ঘটে। সরকারী গুন্ডা পোষার খরচ আসে ডমিনিকান রিপাবলিকের চিনি খামারে গরীব হাইতিবাসীদের গতর খাঁটা পরিশ্রমের রেমিট্যান্সে। এসকল শ্রমিক ছিল দাসের মতই। এদের বেতন যেত দ্যুভালিয়ে সরকারের হাত ঘুরে। ১৯৮১ সালে এভাবে ৩০ লক্ষ ডলার রেমিট্যান্স চলে যায় বিভিন্ন সরকারী কর্মকর্তার পকেটে। গ্রামাঞ্চলে তঁতঁ মাকুতের চাঁদাবাজি আর অপহরণের ভয় তো ছিলই।
১৯৬৯ সালে আরেক ‘গণভোটের’ মাধ্যমে পুত্র জঁক্লোদের রাষ্ট্রপতি হবার রাস্তা পরিষ্কার করেন দ্যুভালিয়ে। দ্যুভালিয়ে ডিন্যাস্টির বড়জনের ডাকনাম তখন দাঁড়াল ‘পাপা ডক’, আর তার ছেলে ‘বেবি ডক।’ ১৯৭১এ বাবার মৃত্যুর পর বিশ্বের কনিষ্ঠতম রাষ্ট্রপতি হন ১৯ বছরবয়েসী বেবিডক। মানুষ ভেবেছিল প্লেবয় মানসিকতার এ ছেলে বেশিদিন টিকবে না। কিন্তু রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের যে যন্তরমন্তর পাপাডক রেখে গেছেন, তার ওপর সওয়ার হয়েই বেবিডক থেকে যান ১৪ বছর!
বেবিডকের শাসনামলে মুক্ত বাজার অর্থনীতির জোয়ার এসে পড়ে হাইতিতেও। বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়ার খাতিরে দ্যুভালিয়ে স্বদেশকে তাইওয়ান-সিঙ্গাপুর-হংকংয়ের সাথে তুলনা করতে শুরু করেন। আর্থিক প্রবৃদ্ধির ফলভোগী অবশ্য হয় তাঁরই অনুগত রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। রপ্তানি ব্যবসা মূলত ছিল সস্তা শ্রমে তৈরি পোশাক, পরচুলো ইত্যাদি। ধনী-দরিদ্র বৈষম্য ক্রমে বেড়েই চলে। গ্রামাঞ্চল থেকে আরেক দফা শহরমুখী জনসঞ্চারণ হয়। দাতব্য এনজিওর সংখ্যা এত বেড়ে যায় যে বিদেশী ত্রাণকর্মীরা হাইতির নাম দেয় রিপাবলিক অফ এনজিওস! স্থানীয় আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবস্থা বুঝে সে অনুযায়ী দীর্ঘস্থায়ী পদক্ষেপ নেয়ার মত জ্ঞান ছিল না এসব এনজিওর। তারও মাসুল দিতে হয় হাইতিকে।
হাইতির পেশাজীবী জনসংখ্যার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ পাপাডকের আমল থেকেই দেশান্তরী। দ্যুভালিয়ে আমলে প্রায় দশ লাখ মানুষ হাইতি ছাড়ে। আশির দশকে হাইতির বৈদেশিক উপার্জনের এক তৃতীয়াংশই আসত এদের রেমিট্যান্স থেকে। এসকল হাইতিয়ান মায়ামি-নিউইয়র্কের মত বড় শহর থেকে রেডিও ব্রডক্যাস্টের মাধ্যমে দ্যুভালিয়ে পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জিইয়ে রাখে।
১৯৮৫-৮৬ সালে বেবিডকের একনায়কতন্ত্র টলমল হয়ে ওঠে জঁবের্ত্রঁ আরিস্তিদ নামে এক ক্যাথলিক পাদ্রীর রাজনৈতিক উত্থানে। তার সাথে যুক্ত হয় ১৯৮৩ সালে হাইতিসফরে আসা পোপ দ্বিতীয় জন পলের পরিবর্তনের আহ্বান। রিগান প্রশাসনও সকল সমর্থন প্রত্যাহার করে। প্রতিবাদী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের একটি সমাবেশে তঁতঁ মাকুতের গুলিতে বাইস্ট্যান্ডার তিন ছাত্র মারা গেলে সারা দেশে বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়। এমনকি পাপাডকের ‘পোষা’ ভুডু পুরোহিতরাও বেবিডককে বলে দেন, বিদেহী দেশবাসীর আত্মারা দ্যুভালিয়ে দেশ ছাড়া পর্যন্ত শান্ত হবে না। দুই আমেরিকার কোথাও আশ্রয় না পেয়ে ফ্রান্সে নির্বাসনে চলে যান জঁক্লোদ।
বাপছেলের আঠাশ বছরের পরিবারতন্ত্রের পর হাইতির গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার কিছু অবশিষ্ট ছিল না। বিপ্লবী জনতার সমর্থনে সেনাবাহিনী দেশশাসনের সাময়িক ভার নেয়। ৮৭তে নতুন সংবিধান প্রণীত হয়। নানারকম চেক-অ্যান্ড-ব্যালেন্সের পাশাপাশি নগর ও গ্রামের প্রশাসনব্যবস্থাকে সংস্কার করা হয়, ক্রেওল হয় ফরাসীর পাশাপাশি দ্বিতীয় জাতীয় ভাষা। তিন বছর শাসনের পর ১৯৯০ সালে প্রথম মহিলা অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রশাসনিক ক্ষমতা হস্তান্তর করে সেনা কাউন্সিল।
সুষ্ঠু নির্বাচনের পর আরিস্তিদ প্রেসিডেন্ট হলেও ৮ মাসের মাথায় সেনা অভ্যুত্থানের মুখে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। ১৯৯৪ সালে ক্লিনটন প্রশাসনের সহায়তায় আবার হাইতিতে ফিরে শাসনভার নেন তিনি। সেনাবাহিনীকে পুরোপুরি ভেঙে দেয়া হয়, তার জায়গা নেয় যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘপরিচালিত শান্তিরক্ষীবাহিনী। আরিস্তিদ ১৯৯৫এ শান্তিপূর্ণভাবে পরবর্তী সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ২০০০এ আরিস্তিদ আবার নির্বাচিত হন। কিন্তু তার ক্রমাগত স্বৈরাচারী মনোভাবের বিরুদ্ধে একটি আঞ্চলিক বিদ্রোহ শুরু হয়। আবার দেশত্যাগ করতে হয় আরিস্তিদকে। এই ডামাডোলে ২০০৪এ হাইতির স্বাধীনতার দ্বিশতবার্ষিকীর সকল আয়োজন ভন্ডুল হয়ে যায়।
২০১০ সালে ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে হাইতি পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী সৈন্য আর এনজিওগুলো আবারও হাইতিকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে। ভূমিকম্পপরবর্তী কলেরা মহামারীতেও মারা যায় বহু মানুষ। সরকারের দুর্বলতার সুযোগে ২০১১তে আরিস্তিদ-দ্যুভালিয়ে দুজনই আকস্মিক এসে হাজির হন হাইতিতে। দ্যুভালিয়ে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার হন, মারা যান ২০১৪তে।
ভূমিকম্পের পর দশ বছর পেরিয়ে গেছে। হাইতির আইনশৃংখলা পরিস্থিতি আর অবকাঠামোর এখনও করুণ দশা। সাধারণ মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে সেখানে। এর মাঝেই এসেছে গেছে তিনজন রাষ্ট্রপতি আর একটি অস্থায়ী সরকার। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশন হাইতি ছেড়েছে মোটে দু’বছর আগে, তারা পেছনে ফেলে গেছে অগুনতি জারজ সন্তান। ভেনিজুয়েলার সাথে তেলচুক্তিতে দুর্নীতির প্রতিবাদ ২০১৮ থেকে এখন পর্যন্ত চলছে। কবে কিভাবে স্বাধীনচেতা হাইতিবাসীর প্রকৃত স্বনির্ভর ঐক্য ও স্বাধীনতা আসবে, এখনো সে প্রশ্নের জবাব সুদূরপরাহত। হাইতির ভাগ্যে শুধু দুটো জিনিসই তার থেকে বেশি নিশ্চিত — আরো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আর আরো বিপ্লব।