লাইবেরিয়া – ৩, স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রগঠন, ১৮৪০-১৮৬০

১৮৪৭ সালে আমেরিকো-লাইবেরিয়ানদের একাধিক উপকূলীয় কলোনি একত্রিত হয়ে সংবিধান প্রনয়ণের মাধ্যমে লাইবেরিয়া প্রজাতন্ত্রের স্বাধীনতা ঘোষণা করে।

এই ঘোষণার পেছনে এসিএস থেকে স্বাধীনতালাভের আদর্শগত অনুপ্রেরণা যতটা না ছিল, তার থেকে বেশি ছিল প্রয়োজন। কারণ, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত রাষ্ট্র না হওয়া পর্যন্ত লাইবেরিয়া তার বন্দর ও সাগরসীমায় বাণিজ্যজাহাজ থেকে শুল্ক আদায়ের চেষ্টা যদি চালায়, আন্তর্জাতিক আইনে তা হবে জলদস্যুতার শামিল!

এভাবে প্রয়োজনের তাগিদে চার রকমের মার্কিনবংশোদ্ভূত কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়ে লাইবেরিয়ার যাত্রা শুরু হয়: যাদের জন্ম মুক্তমানুষ হিসাবে, যারা নিজেদের স্বাধীনতা টাকার বিনিময়ে ফিরে পেয়েছে, যারা লাইবেরিয়াযাত্রার জন্যে মুক্তিপ্রাপ্ত, আর যারা ‘রিক্যাপচারড স্লেভ’ (২য় খন্ড দ্রষ্টব্য)।

১৮৫৭ সালে লাইবেরিয়ার সাথে সংযুক্ত হয় মেরিল্যান্ড রিপাবলিক নামে দক্ষিণের আরেক আমেরিকোঅধ্যুষিত কলোনি। বহির্শক্তির কোন হস্তক্ষেপ আর সাহায্য ছাড়াই একটা প্রশাসনিক কাঠামো দাঁড়া হয়ে যায়। প্রথম রাষ্ট্রপতি রবার্টস দক্ষতার সাথে ইউরোপীয় দেশগুলির সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। রাজনৈতিক জটিলতার কারণে মার্কিনদের স্বীকৃতি আসতে আরো দেরি হয়।

লাইবেরিয়ার প্রথম রাষ্ট্রপতি জে জে রবার্টস, ১৮০৯-১৮৭৬। জন্ম ভার্জিনিয়ার নরফোকে।
লাইবেরিয়ার একটি আমেরিকো প্ল্যান্টেশন। আমেরিকার সাদার্ন স্টাইলে তৈরি। বিশাল খামারের মাঝখানে গেরস্তের বড় বাড়ি। বহু দাস, চাকর, শ্রমিক, এক্সটেন্ডেড ফ্যামিলি, ইত্যাদি।

নিয়মমত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে থাকে, যদিও পার্টি ছিল মোটে একটি, ঠিক যুক্তরাষ্ট্রের শুরুর মত। পরে দ্বিতীয় আরেকটি পার্টিও তৈরি হয়, তাদের নাম ট্রু হুইগ। শত বছরের বেশি সময় লাইবেরিয়ার রাজনীতির ওপর কর্তৃত্ব করে আমেরিকো কৃষ্ণাঙ্গদের এই পার্টি। বড় পদে আসীন ব্যক্তিরা অবশ্য গুটিকয় প্রভাবশালী পরিবারের সদস্য ছিল। এসকল পরিবার ছিল নিজেদের মধ্যে নানারকম আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ। এভাবে একটা শাসকশ্রেণী গড়ে ওঠে। এদের অনেকে ছিল ফ্রিমেসন।

লাইবেরিয়ার শাসনতন্ত্রে উল্লেখিত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বাধিকার আর আইনের শাসনের অঙ্গীকার মার্কিন ধাঁচে হলেও একটা ব্যাপারে বিশাল ফারাক ছিল। মার্কিনদেশের প্রতিষ্ঠাতারা যেখানে সাবধানতার সাথে ধর্মকে রাজনীতি থেকে পৃথক করে রাখেন, সেটা লাইবেরিয়ার রাজ্যপালরা করেননি। দাসত্বজীবনে যীশুখ্রীষ্টের বাণী তাদেরকে আশার আলো দেখিয়েছে। স্বভাবতই খ্রীষ্টান ঈশ্বর আর ধর্মের দয়াশীল চেহারা লাইবেরিয়ার শাসনতন্ত্রের পাতায় পাতায়।

লাইবেরিয়ার মনরোভিয়া গ্র্যান্ড মেসনিক লজ। প্রতিষ্ঠা ১৮৬৭ সালে। লাইবেরিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় পরিণত হয় রেফ্যুজি ক্যাম্পে।

সেই খ্রীষ্টান ঈশ্বরের অনুপ্রেরণা থেকেই আমেরিকোরা স্থানীয় কৃষ্ণাঙ্গ গোত্রগুলিকে সভ্য বানানোর অভিযানে নামে। দুর্গম এলাকায় মিশনারী স্কুল আর চার্চ তৈরি হয়। কোন জায়গায় বৈরিতার মুখোমুখি হয় এরা, আবার কোথাও দুর্বল গোত্রের রাজারা আমেরিকোদের প্রতিরক্ষা আশ্বাসের বিনিময়ে তাদের সন্তানাদিকে স্কুলে-চার্চে পাঠাতে শুরু করে।

শীঘ্রই ব্যাপারটা অন্যদিকে মোড় নিতে শুরু করে। সামন্তযুগের রীতি অনুযায়ী গোত্রপতিরা তাদের একটি সম্তানকে আমেরিকো কোন পরিবারের কাছে ‘বন্ধক’ রাখে, বা দত্তক দেয়। একে বলে ওয়ার্ড সিস্টেম। ভারতীয় উপমহাদেশে, ইউরোপে, ইন ফ্যাক্ট মধ্যযুগের যেকোন সভ্যদেশে এ রীতি প্রচলিত ছিল। পশ্চিম আফ্রিকার সভ্য জাতিগুলিও এর ব্যতিক্রম ছিল না।

এছাড়া গৃহপালিত চাকরের ব্যাপারটাও পশ্চিম আফ্রিকার সমাজে একেবারে বোনা, আমাদের দেশের মত। ধারদেনা শোধের জন্যে নিজ গোত্রের গরীব-গুর্বোদেরও গোত্রপতিরা আমেরিকো পরিবারগুলোর কাছে পাঠাতে শুরু করে। এসকল সারভ্যান্ট আর ওয়ার্ডদেরকে নিজেদের পরিবারের অংশ করে নেয় আমেরিকোরা। কোন ক্ষেত্রে গোত্রপতিরা আমেরিকোদের দাবি অনুযায়ী কোর্ভে লেবার অর্থাৎ বাধ্যতামূলক শ্রমিকের দলও পাঠায়।

এ শ্রমের অবশ্য ভীষণ দরকার ছিল আমেরিকোদের। আমেরিকোদের যে জনসংখ্যা, তাতে খেতখামারে একলা কাজ করে বেশি উৎপাদন সম্ভব নয়। ১৮৬২তে সিভিল ওয়ারের শুরুতে লিংকন লাইবেরিয়াকে স্বীকৃতি দিয়ে দেন। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে মুক্ত কালোদের অভিবাসন একেবারে শূন্যে গিয়ে ঠেকে। যুদ্ধের কারণে তো বটেই, এছাড়া খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই তখন কালোদের স্বাধিকারের রাস্তা তৈরি হচ্ছে। মার্কিন অভিবাসীদের অভাব পূরণ করে স্থানীয় কালো শ্রমিক আর ক্যারিবিয়ান থেকে আসা নতুন অভিবাসীরা।

কফি, তামাক, ধান, চিনি, তুলো, পামওয়েল ইত্যাদির প্ল্যান্টেশন গড়ে ওঠে আমেরিকান সাউথের ধাঁচে। পাম ওয়েল প্রেসের যন্ত্রও আবিষ্কার করেন লাইবেরিয়ার এক উদ্ভাবক। এসব কাঁচামাল ও শস্য রপ্তানির পাশাপাশি জাহাজশিল্প গড়ে ওঠে। এখনো ছোটদেশ লাইবেরিয়া সারা বিশ্বে জাহাজের ফ্ল্যাগ অফ কনভেনিয়েন্স ও রেজিস্ট্রেশনে অগ্রগণ্য একটি নাম।

লাইবেরিয়ার পতাকা এখনো সারা বিশ্বে জাহাজের ফ্ল্যাগ অফ কনভেনিয়েন্স হিসাবে সুপরিচিত।

এসব উন্নয়নের বিপরীতে স্থানীয় কালোরা আমেরিকোদেরই ক্রীতদাসে পরিণত হতে শুরু করে! দু’একটা অপ্রীতিকর ঘটনার পর সরকার আইন করে সেসব বন্ধ করার চেষ্টা করে। আইনানুযায়ী ঘরে ও খামারে কাজ করা কালোদের জামাকাপড় আর শিক্ষার ব্যাপারটা আমেরিকো গেরস্তকে দেখভাল করতে হবে। নাহলে বড় জরিমানা। আদতে যেটা দাঁড়াল, তা হলো আমাদের দেশের চাকরদের মত সামান্য খাদ্যবস্ত্র আর ধর্মশিক্ষা দিয়ে সোশাল সেগ্রেগেশন।

লাইবেরিয়া পরিদর্শনে আসা মার্কিন দূত যারা অ্যাবোলিশনিস্ট মুভমেন্টের সাথে জড়িত ছিলেন, তারা তাদের রিপোর্টে লাইবেরিয়ার এ শ্রমব্যবস্থাকে সরাসরি ‘স্লেভারি’ হিসাবে বর্ণনা করেন। আমেরিকোরা তাচ্ছিল্য করে স্থানীয় কালোদের ডাকত ‘বয়’ বলে, ঠিক যেমনটা সাদার্ন স্টেটগুলিতে তাদেরকে ডাকত শ্বেতাঙ্গরা! আর দেশের অভ্যন্তরের গোত্রগুলোর নাম তারা দেয় ‘অ্যাবোরিজিনি’! অ্যাবোরিজিনিদের যারা তাদের খামারে থাকত, তাদের প্রত্যেককে মাতৃভাষার নাম ছেড়ে গ্রহণ করতে হত পালক পরিবারের নাম। এটিও ঠিক মার্কিন দেশে গোলাম-মনিবের সম্পর্কের মত!

লাইবেরিয়ার গেরস্ত পরিবারের সাথে তাদের ‘ওয়ার্ড’ বা গৃহপালিত দাস, ঊনবিংশ শতকের শেষভাগ। দাসেদের বস্ত্র তুলনামূলক কম, কিন্তু মনিবরা ঠিকই ক্রান্তীয় এলাকার গরমের মধ্যেও মার্কিন ঘরানায় আচ্ছাদিত।

সব মিলিয়ে নতুন দেশ লাইবেরিয়া মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গদের মুক্তির স্বপ্নপূরণ করলেও এর মূল্য দিতে হয় তাদেরই স্বগোত্রীয়দের — হয় তাদের দাসের মত নিজেকে বিকিয়ে দিতে হয় নয়ত স্বকীয় পরিচয় পরিত্যাগ করে হতে হয় সভ্য ‘আমেরিকো’।

লাইবেরিয়া – ২, কলোনাইজেশন, ১৮২০-১৮৪০

আফ্রিকায় দ্বিতীয় জাহাজ পাঠানোর আগেই পল কাফির মৃত্যু হয় ১৮১৭ সালে। তার পর কৃষ্ণাঙ্গ অভিবাসনের কল্যাণ প্রকল্প শুরু করে ১৮১৬তে স্থাপিত আমেরিকান কলোনাইজেশন সোসাইটি (এসিএস) নামে দাতব্য সংস্থাটি। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এক শ্বেতাঙ্গ এজেন্ট ও কিছু কৃষ্ণাঙ্গ বণিক পশ্চিম আফ্রিকা ঘুরে সিয়েরা লিওনের দক্ষিণে, বর্তমান মনরোভিয়ার কাছে একটি স্থান ঠিক করে আসে বসতিস্থাপনের জন্যে।

পেপার কোস্ট (‘মরিচ উপকূল’!) নামে এ এলাকাটি অবশ্য জনশূন্য ছিল না! সেখানে বসবাস করত মান্দে, গ্রেবো, ক্রু প্রভৃতি বিভিন্ন গোত্রীয় আফ্রিকান মানুষ। এসব ‘অসভ্য’ গোত্রের এক রাজার সাথে ক্রয়শর্তেই এসিএসের অভিযাত্রীরা ভবিষ্যত বসতির স্থান ঠিক করে। মার্কিনদের আগে স্প্যানিশ-পর্তুগীজ-ব্রিটিশ-ডাচ বণিকদের সাথেও এসকল গোত্রের মোলাকাত ও ব্যবসাবাণিজ্য চলেছে।

প্রথম ইংলিশ পিলগ্রিম অভিবাসীদের মেফ্লাওয়ার জাহাজে চড়ে আমেরিকাযাত্রার ঠিক দু’শ বছর পর, মার্কিন কালো ‘পিলগ্রিমদের’ একটা দল নিউইয়র্ক থেকে এলিজাবেথ জাহাজে করে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে লাইবেরিয়ার উপকূলে অবতরণ করে। সেটা ১৮২০ সাল।

এলিজাবেথ নামে এই জাহাজের ডাকনাম ‘ব্ল্যাক মেফ্লাওয়ার’। ১৮২০ সালে এতে করেই প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন কলোনিস্টরা লাইবেরিয়ায় এসে পৌঁছায়।

দুর্ভাগ্যবশত তাদের ঠিক করা এলাকাটি সভ্য মানুষের বসবাসোপযোগী ছিল না। ক্রান্তীয় এলাকার জলাজঙ্গলের অসুখবিসুখে নবাগতরা আক্রান্ত হয়, ঠিক ইংলিশ পিলগ্রিমদের মত। তাছাড়া সাথে নিয়ে আসা খাবারদাবারও দ্রুত ফুরিয়ে যেতে শুরু করে। এভাবে মৃত্যুমুখে পতিত হয় প্রথম আসা দলগুলির একতৃতীয়াংশ থেকে একচতুর্থাংশ।

অসুস্থতার কারণে আর আবাদযোগ্য জমির অভাবে এসকল অভিবাসী পরিবারগুলি এসিএসের দ্বারস্থ হয়। এসিএস তাদের সীমিত শক্তির মধ্যে যৎসামান্য সাহায্য করে। অনেকেই প্রাক্তন মনিব পরিবারদের কাছে খাদ্য আর ডাক্তারী সাহায্য চেয়ে চিঠি লেখে। অবস্থাপন্নরা সাহায্য পেয়ে বেঁচেবর্তে যায়।

স্থানীয় কালোদের সাথে রফা করে নতুন জমিজমা কেনার চেষ্টা করে মনরোভিয়ার কলোনি। সবসময় সেটা সাফল্যের মুখ দেখেনি। কোন ক্ষেত্রে জোরজবরদস্তি কিংবা ঠকবাজির আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় তারা। হ্যাঁ, জীবন বাঁচানোর তাগিদে তুতো ভাইদের বোকা বানাতে কসুর করেনি এসব মুক্তিপ্রাপ্ত দাসের বংশধররা!

মনরোভিয়ার কাছে ভার্জিনিয়া থেকে আগত কৃষ্ণাঙ্গদের সেটলমেন্ট, ১৮২০এর দশক।

গোলমাল বাঁধা শুরু করলে স্থানীয় রাজাদের নিয়ে সম্মেলন করে সেটলারদের পক্ষে রায় দেয় সে অঞ্চলের নেতৃস্থানীয় মান্দে গোত্রের অধিকর্তা। সেটা নেটিভরা মেনে নিলেও ভেতরে ভেতরে তারা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়। অর্থাৎ আমেরিকার কলোনাইজেশনের মধ্যভাগে সেই ইংলিশ পিলগ্রিমদের সাথে নেটিভদের সংঘাতের সমান্তরাল ইতিহাসের শুরু হলো।

এসকল জটিলতার সাথে যুক্ত হয় আরো বড় একটা সমস্যা। স্থানীয় আফ্রিকানরা বংশপরম্পরায় দাসবাণিজ্যে সরাসরি জড়িত! অন্তর্ঘাতী সংঘর্ষ থেকে বন্দী করা ভিন্নগোত্রীয় মানুষকে তারা স্বগৃহে দাস করে তো রাখতই, উপকূলীয় অঞ্চলে ইউরোপীয়-মার্কিন দাসব্যবসায়ীদের জাহাজেও সাপ্লাই দিত! ১৮২০/৩০এর দশকে ব্রিটিশ নৌবাহিনী পুরো পশ্চিম আফ্রিকা উপকূলে দাসবাণিজ্য বন্ধের জন্যে ঘেরাও দিলেও, তার ফাঁকফোঁকর গলে চোরাকারবারী বেআইনী দাসবাণিজ্য চলত। দাস সাপ্লাইয়ের বিনিময়ে লাইবেরিয়ার গোত্রগুলো পেত ইউরোপীয় অস্ত্র, নানাপ্রকার বিলাসদ্রব্য, ছাতা, চশমা, রঙবেরঙের সেমিপ্রেশাস রত্ন, ইত্যাদি।

নবাগত সেটলাররা যখন জানতে পারলো স্থানীয়দের এই শয়তানি কর্মকান্ডের কথা, তখন থেকে তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় সেসব জোর করে বন্ধ করতে। যুদ্ধ ছাড়া আর কোন গত্যন্তর ছিল না।

লাইবেরিয়ার আদিবাসী গ্রেবো জনগোষ্ঠীর সেরেমনিয়াল মুখোশ।
১৮০৯এ ব্রিটিশ নৌবাহিনীর জাহাজ ব্রিস্ক দাসবাহী স্প্যানিশ জাহাজ এমানুয়েলাকে চ্যালেঞ্জ করছে।

সে যুদ্ধ যখন বাঁধল, হাজারে হাজারে স্থানীয় কৃষ্ণাঙ্গ ঘিরে ধরল মনরোভিয়ার শ’খানেক সেটলারকে, তখন একটিমাত্র কামানের গোলায় তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় মনরোভিয়াবাসী। বন্দুক স্থানীয়দেরও ছিল, কিন্তু সেটলারদের মত দ্রুত গোলাবর্ষণের প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ তাদের ছিল না।

এরকম অসম কয়েকটি যুদ্ধের পর হাল ছেড়ে উপকূলীয় অঞ্চল ছেড়ে দেয় আদিবাসীরা। সেটলাররা আবাদযোগ্য জমিজমা কিনে নেয় নামমাত্র মূল্যে। চাষাবাদের পাশাপাশি স্থানীয়দের সাথে ইউরোপীয়দের বাণিজ্যের মধ্যসত্ত্বভোগী হিসাবে জাঁকিয়ে বসে সেটলার পরিবারগুলো।

এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি মার্কিন থেকে আসা ‘আমেরিকোদের’। নিউইয়র্ক, মিসিসিপি, পেনসিলভানিয়া, লুইসিয়ানা, মেরিল্যান্ড, ভার্জিনিয়া, কেন্টাকি ইত্যাদি স্টেটগুলিতে এসিএসের মত কলোনাইজেশন সমিতি গড়ে ওঠে। বর্তমান লাইবেরিয়ার বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকায় গড়ে ওঠে তাদেরও বসতি।

ঊনবিংশ শতকের লাইবেরিয়াতে উপকূলীয় অঞ্চলে ‘আমেরিকোরা’ বসতি গেড়েছিল। অভ্যন্তরে ছিল আদিবাসী বহু গোষ্ঠীর বসবাস।

মার্কিন ফেডারেল সরকার এসব কলোনিকে সরাসরি সাহায্য দেয়া থেকে বিরত থাকে, কারণ সাম্রাজ্যবাদী অভিলাষের বিন্দুমাত্র চিহ্ন দেখানোটাও তার নৈতিকতার পরিপন্থী। কংগ্রেস শুধুমাত্র ‘রিক্যাপচার্ড স্লেভদের’ পুনর্বাসনের জন্যে খোরপোশ দিতে রাজি হয়। এরা হলো মার্কিন নেভি কর্তৃক চোরাকারবারী জাহাজ থেকে জব্দকরা দাসের দল, যারা মোটে দাসত্বশৃংখলে আবদ্ধ হয়েছে, ইংরেজী ভাষা-সভ্যতা জানা নাই। এদেরও নিবাস হয় বর্তমান লাইবেরিয়া।

শীঘ্রই লাইবেরিয়ার মুক্ত কালোরা নতুন দেশে তাদের অবস্থান পাকাপোক্ত করে নেয়। এসিএসের সাদা এজেন্টদের উপস্থিতি শিক্ষিত কালোদের মনঃপূত না হওয়ায় তারা নিজেদের মধ্য থেকে গভর্নর নিযুক্ত করার দাবি জানায়। এসিএস ক্রমে তাদের এসকল দাবি মেনে নেয়। কলোনিটি পরিণত হয় ‘কমনওয়েল্থে’, লিখিত হয় মার্কিন আদলের শাসনতন্ত্র। কর্মঠ কালোরা কৃষিকাজ ও বাণিজ্যের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে, রাজনৈতিক পরিচয় ও অবস্থানও মজবুত হয় তাদের।

ঊনবিংশ শতকের বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য লাইবেরিয়ান আমেরিকো ব্যক্তিত্বের স্থিরচিত্র।
১৮২২এর আদিবাসীদের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষাযুদ্ধে একটি কামানের বদৌলতে বেঁচে যায় কালো সেটলাররা। সে কামান দেঁগেছিল নাকি মাটিল্ডা নিউপোর্ট বলে এক কৃষ্ণাঙ্গিনী। এই লেজেন্ডের সেলেব্রেশন ষাট-সত্তরের দশক পর্যন্ত চালু ছিল লাইবেরিয়া দেশটিতে।

বলা বাহুল্য, এসকল স্বাধিকার ও উন্নয়নের মুখ দেখে কেবল উপকূলের কলোনিগুলির ‘আমেরিকো’ গোষ্ঠী, যাদের সংখ্যা হাজারখানেকের বেশি ছিল না। তাদের স্বদেশী আদিবাসী ভাইদের সংখ্যা ছিল দশ লাখের ওপর। এদের শাসনতান্ত্রিক কোন অধিকার ছিল না, কারণ তারা কলোনির সদস্য নয়।

দূর থেকে এই স্বজাতি আমেরিকোদের ডাকতে শুরু করে ‘কালো শ্বেতাঙ্গ’!

লাইবেরিয়া – ১, শুরুর কথা, ১৮০০-১৮২০

জালিম ও মজলুমের কোন গাত্রবর্ণ নাই, জাতপাত নাই। মানুষ এমন একটা প্রাণী যে সামাজিক ঠিকই, কিন্তু কেবলমাত্র প্রাকৃতিক কিংবা কৃত্রিমভাবে তৈরি নিজস্ব আইডেন্টিটি গ্রুপের মধ্যে। পারিপার্শ্বিকতা ও প্রয়োজন তৈরি করে দেয় তার এই পরিচয়।
আফ্রিকার মানচিত্রে লাইবেরিয়ার স্থান
লাইবেরিয়ার পতাকার অনুপ্রেরণা মার্কিন পতাকা
এ কথাগুলি মনে এল লাইবেরিয়া দেশটির কথা চিন্তা করে। ছোট করে শুরুতে বলি, ঊনবিংশ শতকে মার্কিন থেকে আগত মুক্তিপ্রাপ্ত কৃষ্ণাঙ্গ প্রাক্তন দাস ও দাসদের বংশধরদের আবাসস্থল হিসাবে দেশটির যাত্রা শুরু। তাদের শাসনতন্ত্র প্রায় হুবহু মার্কিন শাসনতন্ত্রের ভিত্তিতে লেখা, তিনটি প্রশাসনিক বিভাগ, মতপ্রকাশের-ধর্মপালনের স্বাধীনতা, ইত্যাদি।

আর গোড়াপত্তনের দেড়শ বছরের মাথায় লাইবেরিয়াতে হয়ে যায় দু’-দু’টি গৃহযুদ্ধ। ষোলটি জাতিগোষ্ঠী চিন্তাতীত নির্মমতার সাথে একে-অপরের ওপর চড়াও হয়। লাইবেরিয়ার যুদ্ধের খবর ঘাঁটালেই হত্যা-ধর্ষণের পাশাপাশি চোখে পড়বে চাইল্ড সোলজার, ব্লাড ডায়মন্ড, ইত্যাদি হেডলাইন। ১৯৮৯ থেকে শুরু করে ২০০৩ পর্যন্ত বিরতি দিয়ে দিয়ে গৃহযুদ্ধ হয়, আর তাতে প্রাণ হারায় নয় লাখেরও বেশি মানুষ। ২০০৩এ বেশ কিছু বাংলাদেশী সেনাসদস্যও সেদেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে যোগ দেয়, সেটা ছিল এযাবত জাতিসংঘের সর্ববৃহৎ শান্তিরক্ষা মিশন। মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রিপ্রাপ্ত চার্লস টেইলর নামক এক লাইবেরিয়ান ওয়ারলর্ড ও প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি হন হেগের আন্তর্জাতিক কোর্টে বিচারপ্রাপ্ত প্রথম কোন প্রাক্তন রাষ্ট্রনেতা।

কেন কিভাবে এ অধঃপতন তার কাহিনীই লিখতে বসেছি।

লাইবেরিয়ার স্বাধীনতাঘোষণার প্রাক্কালে কনস্টিটিউশনাল কনভেনশনে স্পষ্টভাবে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকদের আসল পরিচয় যে মার্কিন, তা উল্লেখ করা হয় (১৮৪৭)।
লাইবেরিয়ান গৃহযুদ্ধের চাইল্ড সোলজার
লাইবেরিয়ান গৃহযুদ্ধের চাইল্ড সোলজার

লাইবেরিয়া কনসেপ্টটার যাত্রাশুরু ১৮১০এর দশকে। ইংরেজ ও মার্কিনরা আন্তর্জাতিক দাসবাণিজ্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ১৮০৭ সালে। যেসকল কৃষ্ণাঙ্গ ইতিমধ্যে দক্ষিণের স্টেটগুলিতে ক্রীতদাস, তাদের মুক্তি আসে আরো পরে। কিন্তু উত্তরে তখন যথেষ্ট মুক্তিপ্রাপ্ত ও শিক্ষিত কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের বসবাস। সেসময় মিসৌরী নদী থেকে আটলান্টিক পর্যন্ত যে প্রায় ৯.৬ মিলিয়ন জনসংখ্যা, তাদের প্রায় ১.৭৫ মিলিয়ন কৃষ্ণাঙ্গ, আর এদের প্রায় ২৩০,০০০, অর্থাৎ ১৩ শতাংশ, মুক্ত মানুষ। এদের অনেকে ‘মুলাটো’ বা মিশ্রজাত। কারো বাবা কৃষ্ণাঙ্গ দাস, তো মা শ্বেতাঙ্গ আইরিশ ইনডেঞ্চারড সারভ্যান্ট — যার স্টেটাস ক্রীতদাসের থেকে এমন একটা উঁচুতে নয়। ১৮০০ শতকের শুরুতে মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গরা ছিল আমেরিকার ফাস্টেস্ট গ্রোয়িং ডেমোগ্রাফি।

মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গদের অনেকে ব্যবসাবাণিজ্যে সাফল্য পায়। এদের অনেকেই ছিল শিক্ষিত, কর্মঠ, অন্টরপ্রনরশিপে বিশ্বাসী, এমনকি অ্যাডাম স্মিথপড়া পুঁজিবাদী লোক। পল কাফি বলে এদের একজন, কৃষ্ণাঙ্গ তিমিশিকারী বণিক তিনি, ঠিক করেন যে কৃষ্ণাঙ্গদের আফ্রিকায় পুনর্বাসিত হওয়াটাই সমীচীন। সে লক্ষ্যে একটি জাহাজে করে প্রায় আশিজন মুক্তমানুষ পরিবারসহ আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে পশ্চিম আফ্রিকার সিয়েরা লিওনে এসে হাজির হয়। সিয়েরা লিওন ছিল ব্রিটিশ কলোনি, এবং ব্রিটিশরা এর গোড়াপত্তনই করে ব্রিটেনের মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গদের স্বেচ্ছাপুনর্বাসনের স্থান হিসাবে।

পল কাফি, ১৭৫৯-১৮১৭
নিউ ইয়র্কের কলোনাইজেশন সোসাইটির মেম্বারশিপ সার্টিফিকেট, ১৮৩৭

কাফির চিন্তাটা অবশ্য নতুন নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফাউন্ডিং ফাদাররাও ভেবেছিলেন, মালিকদের মৃত্যুর পর যেসকল ক্রীতদাস মুক্তি পাচ্ছে, কিংবা নিজেদের উপার্জনের মাধ্যমে স্বাধীনতা কিনে নিচ্ছে, তাদের স্বদেশে ফিরিয়ে দেয়াটাই উত্তম। আমেরিকায় যদি তারা থেকে যায়, তাহলে শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ দু’জাতের মধ্যে অত্যাচার ও অপব্যবহারের যে সম্পর্কের শত বছরের ইতিহাস, সেটা ফিরে ফিরে এসে রাষ্ট্রীয় সমস্যা তৈরি করবে। তাছাড়াও মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকাংশ সহায়-সম্বলহীন হওয়ার কারণে ভবিষ্যতে যে তারা আবার ক্রীতদাসে পরিণত হবে না, তারও গ্যারান্টি নেই।

জেফারসন-মনরো প্রমুখ গোপনে এ ব্যাপারে কথাবার্তা চালান, তাদের ইচ্ছে ছিল কৃষ্ণাঙ্গদের জন্যে কলোনিস্থাপনের। সেটা আমেরিকার নতুন ওহাইয়ো টেরিটরিতেও হতে পারে, কিংবা লাতিন আমেরিকা নতুবা আফ্রিকাতেও। এমনকি লিংকনও মধ্য আমেরিকা কিংবা হাইতিতে কৃষ্ণাঙ্গপুনর্বাসনের চিন্তা করেন। কিন্তু তাদের এসকল আইডিয়া নিয়ে বেশিদূর না আগানোর কারণ, ঐ ‘কলোনি’ শব্দটা! মার্কিনরা হবে কিনা তাদের প্রাক্তন মালিক ব্রিটেনের মত সাম্রাজ্যবাদী! এ ব্যাপারটা সে আমলে কারোরই মনঃপূত হয়নি।

এ অবস্থার একটা সুরাহা হয় আমেরিকান কলোনাইজেশন সোসাইটি (এসিএস) নামে একটি দাতব্য সংস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। সাদার্ন স্টেটগুলির কিছু নামীদামী ধর্মপরায়ণ ব্যক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় এটি শুরু হয়। এদের কারো কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি সত্যিকার সহানুভূতি, আবার কারো কারো জাতিগত মিশ্রণ নিয়ে অ্যালার্জি থাকায় তারা চান কৃষ্ণাঙ্গরা ‘ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাক!’

যে উদ্দেশ্যেই এসিএসের যাত্রা শুরু হোক না কেন, বেশ কিছু মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গ আইডিয়াটা গ্রহণ করে নেয়।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!