কসাক নৃত্য ও তেভিয়ে

Featured Video Play Icon

১৮৮১ সালের কথা। রাশিয়ার ৎসার তখন দ্বিতীয় আলেকজান্ডার। এই সম্রাট ১৮৬১তে রুশদেশে ভূমিদাসপ্রথা বিলুপ্ত করার আদেশ জারি করেছিলেন। এ ছিল আমেরিকায় ক্রীতদাসপ্রথা উচ্ছেদের মত যুগান্তকারী ঘটনা, যদিও এই সংস্কার ছিল ‘উপর থেকে চাপানো’। গ্রামের চাষারা জমির আর সম্পত্তির মালিকানার অধিকার পেলো ঠিকই, কিন্তু সেই সাথে কপালে জুটলো করপ্রদানের দায়িত্ব। অনেকে মুক্তি পেয়ে গ্রাম ছেড়ে পাড়ি জমালো শহরের দিকে। রুশ শৈল্পিক বিপ্লবের হাওয়ায় তারা বনে গেল শ্রমিক-মজুর। নব্য শিল্পপতিরা তাদের যথেচ্ছ ব্যবহারের সুযোগ নেয়া শুরু করলো। ফলপ্রসূ চাষাদের পরবর্তী প্রজন্মের নব্যশিক্ষিত মধ্যবিত্ত ছাত্ররা গোপন বিপ্লবী সংগঠনে অংশ নেয়া শুরু করলো। আলেকজান্ডার প্রথমদিকে কিছুটা সংস্কার করলেও সাধারণ জনগণকে সাংবিধানিক ক্ষমতা দিতে ছিলেন চরম নারাজ। ১৮৮১ সালে তাঁকে তার মাসুল দিতে হলো নারোদনায়া ভোলিয়া (জনতার সংকল্প) নামের গুপ্ত সংগঠনের আততায়ীর বোমায় নিহত হয়ে।

প্রতিশোধস্বরূপ গুপ্ত সংস্থাগুলির নেতাদের গ্রেপ্তার করে ফাঁসিতে ঝোলানো হলো, এদের একজনমাত্র ছিল ইহুদী। উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর মতো, বাদবাকি জনগণের মনোযোগ আততায়ীদের ন্যায্য দাবিদাওয়া থেকে দূরে সরিয়ে সংখ্যালঘু ইহুদিদের বিরুদ্ধে জনমনে ঘৃণা আর সন্দেহ ছড়ানো শুরু হলো। তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে গ্রামছাড়া করলো তাদেরই শতবছরের পড়শী রাশিয়ার সংখ্যাগুরু অর্থডক্স খ্রীষ্টান স্লাভ জাতির মানুষেরা। অনেকে রুশদেশ ছেড়ে মার্কিনে পাড়ি জমায়, আর একটা ছোট অংশ — যারা হয়ত একটু বেশি ধার্মিক — তারা এসে হাজির হয়ে যায় তুর্কী ওসমানলি সাম্রাজ্যের অন্তর্গত প্যালেস্টাইন প্রদেশে। প্যালেস্টাইনে তখন সেফার্দী মাজহাবের যে ইহুদীরা ছিল তারা আরবীতেই কথা বলতো, পোশাক-আশাকও ছিল তুর্কীদের মতই। রাশিয়া আর পূর্ব ইউরোপের আশকেনাজি মাজহাবের ইহুদীরা তুরস্কের সেকেলে অভিবাসন আইনের সুযোগ নিয়ে জমিজমা কিনে থিতু হয়ে বসল। ইহুদিদের সংখ্যা এইভাবে রাতারাতি দ্বিগুণ হওয়া সত্ত্বেও সেসময় তারা তাদের আরব বেদুঈন পড়শীদের সাথে মোটামুটি শান্তিতেই বসবাস করত।

যাই হোক, তার পরে আরো অনেক জল গড়িয়ে গেছে, সে সবারই জানা। আমার উদ্দেশ্য ছিল নিচের ভিডিওটির একটা যথোপযুক্ত ভূমিকা দেয়া। এটি নেয়া হয়েছে ১৯৭১ সালের হিট মিউজিক্যাল ‘ফিডলার অন দ্য রুফ’ থেকে। কাহিনীর মূলচরিত্র তেভিয়ে ১৮৮০এর সময়কার রুশদেশের একটা ছোট গ্রাম আনাতিয়েফকার ইহুদী বাসিন্দা। তাদের পাশাপাশি স্লাভ রুশ অর্থডক্স খ্রীষ্টানদেরও বসবাস। তেভিয়ে একটা পানশালায় গেছে লেজার উল্ফ নামে এক বুড়ো কসাইয়ের সাথে। তেভিয়ে তার বড় মেয়ে ৎসাইতেলের মতামত না নিয়েই লেজার উল্ফের বিয়ের প্রস্তাব গ্রহণ করে ফেলেছে, এই ভেবে যে পাত্র বয়স্ক হলেও কসাইব্যবসার পয়সায় কন্যা সুখে থাকবে। (আসলে কি হয়েছিল শেষ পর্যন্ত, সেটাও মজার কাহিনী! জানতে হলে মুভিটা দেখুন — ইউটিউবে আছে।)

লেজার উল্ফ আনন্দের আতিশয্যে পানশালার সবাইকে শ্ন্যাপস খাওয়াচ্ছে, আর সবাই মিলে গান ধরেছে ল্যখাইম — যার অর্থ ‘জীবনের উদ্দেশ্যে’, জীবনে সুখ-দুঃখ যাই আসুক না কেন সবই জলীয়পান করে আনন্দ-উদযাপনের উপযুক্ত। ইহুদীদের নাচগানে বাগড়া দিলো পানশালার উল্টোপ্রান্তে জটলাবাধা রুশ কৃষকের দল। তারা নতুন যুগলের শুভকামনায় বালালাইকার সুরে গান আর কসাক নৃত্য শুরু করে দিল। নাচতে নাচতে দু’দলে ঠোকাঠুকি! সেই দৃশ্যের সন্দেহ আর সাবধানতা ভারি করে তুলেছে পানশালার বাতাস। রুশ চাষা বাউ করে তেভিয়েকে নিমন্ত্রণ করলো একত্রে নাচার জন্যে। কিন্তু ইহুদীদের যে খোদা ছাড়া কারো সামনে মাথানত করা নিষেধ! তেভিয়ে পাল্টা বাউ করলো ঠিকই, কিন্তু একটু তেরচা করে, যেন রুশী তার সরাসরি সামনে না পড়ে। অতঃপর বাড়ানো হাতটা লুফে নিলো, আর দু’দলে মিলে একাত্ম হয়ে গেল নাচতে নাচতে!

পুরো মিউজিক্যালটা দেখার মতো! তেভিয়েদের ট্র্যাডিশন্যাল সামাজিক-পারিবারিক আচার আর তাদের রাজনৈতিক অবস্থা কত দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে, সেটি আমাদের দেশ-সমাজ-ধর্মীয় পরিচয়ের বিবর্তনেরই যেন একটা প্রতিচ্ছবি। আর তার মধ্যে এই গানটা আমার প্রিয় সঙ্গত কারণেই!

গানের লিরিকস এখানে

লাচো দ্রোমঃ যাত্রা হোক শুভ

Featured Video Play Icon

জাত-বর্ণবিদ্বেষ, পরমতঅসহিষ্ণুতা পৃথিবীতে ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতিতে, ধর্মে, ভাষায় আর দেশে বিভক্ত মানুষ অনেক বেশি ট্রাইব্যাল হয়ে যাচ্ছে। একে অন্যের উপর আস্থা রাখতে পারছে না, সন্দেহ আর ভয় পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে ঘৃণায়।

ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্যে যখন ভয় হয়, তখন বিশ্বাস ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করি দেশ-বিদেশের সুরসঙ্গীত শুনে। মিউজিক সার্বজনীন মনুষ্যত্বের ভাষা। কথার মানে যে সবসময় বুঝতে লাগে তা না, সুরের মধ্যেই ভাবটা অর্ধেক প্রকাশিত হয়ে যায়। এভাবে শুনতে শুনতে দেশবিদেশের অনেক রকম এথনিক-ট্র্যাডিশন্যাল-ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিকের সাথে পরিচিত হয়েছি। সামনের দিনগুলিতে সেগুলির কয়েকটা ছোট ছোট বিশ্লেষণসহ শেয়ার করার আশা রাখি।

আজকের ভিডিওটা ‘লাচো দ্রোম’ নামের একটা ডকুমেন্টারি থেকে নেয়া। এতে রোমানিয়ার ‘তারাফুল হাইদুচিলর’ নামের একটা জিপসিদল ভায়োলিন, অ্যাকোর্ডিয়ন, বাঁশি, চিম্বালম নামে সন্তুরের মত একটা বাদ্যযন্ত্র — এসব দিয়ে একটা আনন্দঘন নাচের উপযোগী সঙ্গীত তুলেছে।

জিপসিদের ইতিহাসটা অবশ্য এরকম আনন্দময় ছিল না। প্রায় এক হাজার বছর আগে তারা পশ্চিম ভারত থেকে ইউরোপের দিকে যাত্রা শুরু করে — অনেকের হিসাবে আমাদের দেশের বেদেরা এদেরই একটা অফশুট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসিবাহিনী আর তাদের হাঙ্গেরীয়, রোমানিয়ান, স্লোভাক, ইউক্রেনীয় কট্টর জাতীয়তাবাদী দোসররা ইহুদিদের সাথে সাথে পূর্ব ইউরোপের রোমা জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেক জনগণকে এক্সটারমিনেশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে হত্যা করে। পরে রোমানিয়ার কম্যুনিস্ট ডিক্টেটর চওসেস্কুর সময়েও এরা অনেক নিপীড়নের শিকার হয়েছিল। স্পেইনের ফ্রাংকো সরকারও সেখানকার ফ্লামেংকো নৃত্যসঙ্গীতের পুরোধা হিতানো জিপসিদের ওপর অনেক অত্যাচার চালিয়েছে

ইউরোপের অনেক দেশে এখনো রোমানি বা জিপসিদের দেখা হয় অস্পৃশ্য পরদেশী হিসাবে (জিপসি শব্দটা তাদের পছন্দ না, রোমানি পলিটিক্যালি কারেক্ট)। যদিও তারা সেসব দেশে শ’ শ’ বছর ধরে বসবাস করছে, ঠিকানাবিহীন ভবঘুরে হবার কারণে তাদের অনেকের ভোটাধিকার বা সিটিজেনশিপের কাগজপত্র নেই। ইতালির নতুন অতিডানপন্থী সরকারের অভ্যন্তরীণবিষয়ক মন্ত্রী ও নর্দার্ন লীগের সেক্রেটারি মাত্তেও সালভিনি ক’দিন আগে বলেছেন যে রোমাদের শুমারি করে যাদের কাগজপত্র নেই তাদের দেশ থেকে বের করে দেয়া দরকার। সব জাতির জনগণের শুমারি না করে শুধু রোমাদের টার্গেট করে এ মন্তব্য কেন করা হয়েছে, সেটা ভেবে অনেকে সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার স্মৃতিচারণ করে ভীত।

এই ভিডিওটির সুরের মধ্যে তুর্কী ও ইহুদী ক্লেজমার ধাঁচের একটা প্রভাব আছে। পূর্ব ইউরোপে রোমানিরা এসেছিল তুরস্ক-মিশর হয়েই (জিপসি শব্দটার শব্দমূল ‘ঈজিপ্শীয়ান’)। আর পূর্ব ইউরোপের ইহুদীরা একসময় বলতে গেলে জিপসিদের মতই স্থাবরসম্পত্তিহীন ভবঘুরেই ছিল। অতএব ‘ফেলো ট্র্যাভেলার’ এই দুটো গ্রুপ পরস্পরের সঙ্গীত আর ভাষাকে প্রভাবিত করেছে।

 

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!