লেগিওন ফ্রাইয়েস ইন্ডিয়েন

আজকে আজাদ হিন্দ ফৌজ সম্পর্কে যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লিখবো, সেটা সকলের মনঃপূত না হতে পারে। আমরা ছোটবেলা থেকে নেতাজি সুভাষ বসুকে ভারত-বাংলার স্বাধীনতাসংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা হিসাবে দেখে এসেছি। ব্যক্তিগতভাবে আমি জাতিগত, ধর্মীয় কোন জাতীয়তাবাদকে সুদৃষ্টিতে দেখি না। সে আমলের বৈশ্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয়তাবাদ হয়ত গ্রহণযোগ্য ছিল, কিন্তু আজাদ হিন্দ ফৌজের উৎপত্তি ও যুদ্ধকালীন কার্যক্রম অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। জাতীয়তাবাদের ও জাতীয় নেতাদের পূজো যারা করতে ভালবাসেন, তারা দয়া করে খোলা মন নিয়ে পড়ুন। নয়ত নাই পড়ুন।

আমার সংগ্রহের কয়েকটি ডাকটিকেট দিয়ে শুরু করি। প্রথম জোড়াটি ১৯৪২ সালের ক্রোয়েশিয়ার। বিভিন্ন স্লাভিক জাতির সমন্বয়ে গঠিত রাষ্ট্র ইউগোস্লাভিয়া দখলের পর নাৎসি বাহিনী ক্রোয়েশিয়া রাষ্ট্রকে ‘মু্ক্ত’ করে। সেদেশের সরকার গঠিত হয় উশতাসে নামক উগ্র জাতীয়তাবাদী একটি ক্রোয়েশীয় রাজনৈতিক দলের দ্বারা। তারা নাৎসিদের থেকেও অধিক জাতিগত হত্যা সংঘটন করে। উশতাসে সরকার নামে ‘স্বাধীন’ হলেও আদতে জার্মান তাঁবেদার ছিল।

নাৎসি তাঁবেদার রাষ্ট্র ক্রোয়েশিয়ার ডাকটিকেট, ১৯৪১-৪৩ সাল

সেরকম চেকোস্লোভাকিয়া রাষ্ট্রটিকেও জার্মানরা ত্রিখন্ডিত করে। সুডেটেনল্যান্ড খাস জার্মানির অন্তর্ভুক্ত হয়। বর্তমান চেকিয়ার বাকি অংশ হয় বোহেমিয়া-মোরাভিয়া নামক জার্মান প্রটেক্টরেট। আর স্লোভাকিয়া হয় ক্রোয়েশিয়ার মত চেকদের শাসন থেকে ‘স্বাধীনতাপ্রাপ্ত’। হ্লিংকা পার্টির উগ্র জাতীয়তাবাদী সরকার জার্মান রাষ্ট্রের পাপেট ছিল এবং তাদের সকল যুদ্ধাপরাধী কর্মকান্ডে হাত মেলায়। দ্বিতীয় ছবিতে স্লোভাকিয়ার স্ট্যাম্প।

নাৎসি তাঁবেদার রাষ্ট্র স্লোভাকিয়ার ডাকটিকেট, ১৯৩৯

তৃতীয় ছবির ডাকটিকেটগুলি বেশ দুর্লভ আর বেশির ভাগ সংগ্রহকারীর কাছে অপরিচিত। অপারেশন বারবারোসার মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নকে চকিত আক্রমণ করে বসে জার্মানি। সেটা ১৯৪১ সাল। স্তালিনের একাধিক শুদ্ধি অভিযানের কারণে সোভিয়েত সেনাদল ছিল অপিরপক্ব অফিসারদের নেতৃত্বে পরিচালিত। এদের অনেকে জার্মানদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। হিটলারের বর্ণবাদী থিওরিতে রাশান আর বেশিরভাগ স্লাভিক মানুষ নিচুস্তরে পরিগণিত। তাই এসকল যুদ্ধবন্দীদের বেশ অত্যাচার সহ্য করতে হয়। প্রায় অর্ধেকের মত যুদ্ধবন্দী ক্যাম্পে মৃত্যুমুখে পতিত হয়।

কিন্তু ‘৪২এ স্তালিনগ্রাদে হারার পর হিটলারের সভাসদরা তাঁকে রাজি করান যে এসকল যুদ্ধবন্দীদের নিয়ে একটি ‘লিবারেশন আর্মি’ বানালে সোভিয়েতবিরোধী প্রপাগান্ডায় কাজে দেবে। সোভিয়েত ইউনিয়নে সাধারণ রাশিয়ান মানুষ স্তালিনের ভয়ে প্রকম্পিত হত, যেমনটা হত সেদেশের জাতিগত সংখ্যালঘুরা।

জেনারেল ভ্লাসভ নামে এক রাশান অফিসার জার্মানদের সাথে আঁতাত করে ঠিক করেন যে, যুদ্ধবন্দীদের একাংশ নিয়ে একটি ‘মুক্তিবাহিনী’ গঠিত হবে, যারা রাশিয়া ও সোভিয়েত অধিকৃত অঞ্চল থেকে কমুনিস্ট শাসন উচ্ছেদের জন্যে জার্মানদের সহায়তা করবে। ডাকটিকেট দুটি এই ভ্লাসভ আর্মির ইস্যুকৃত।

রাশিয়ান “রাজাকার” ভ্লাসভ আর্মির ডাকটিকেট, ১৯৪৪

পরের তিনটি ছবিতে দেখিয়েছি নাৎসি জার্মানির ডাকটিকেটের গতানুগতিক বিষয়বস্তু, ডিজাইন ইত্যাদি। আর শেষ ডাকটিকেটগুলো ‘আজাদ হিন্দের’। ডাকটিকেটগুলির বিষয়বস্তু, ডিজাইন ও প্রিন্টিং একটু ভাল করে দেখুন।

নাৎসি জার্মানির ডাকটিকেট, ১৯৪৪
নাৎসি জার্মানির ডাকটিকেট, ১৯৪৫ ও ১৯৪১। ডানের টিকেটটির ডিজাইনার আক্সটার-হয়টলাস আজাদ হিন্দের ডাকটিকেটের নকশা করেন।
নাৎসি জার্মানির ডাকটিকেট, ১৯৪৪ ও ১৯৪৩। নিচের টিকেটটির ডিজাইনার আক্সটার-হয়টলাস আজাদ হিন্দের ডাকটিকেটের নকশা করেন।
আজাদ হিন্দের ডাকটিকেট, ১৯৪৩। জার্মানিতে নকশা করা। নাৎসি জার্মানির রাষ্ট্রীয় ছাপাখানায় মুদ্রিত।

এতগুলি ডাকটিকেট দেখানোর মূল লক্ষ্য এটা বোঝানো যে, জার্মান তাঁবেদার রাষ্ট্রগুলির সরকার থেকে শুরু করে এমনকি ডাকটিকেট ডিজাইন ও প্রিন্টিং পর্যন্ত ছিল নাৎসি আনুকূল্যের ওপর নির্ভরশীল। আমার দেখানো স্ট্যাম্পগুলির সকলের ডিজাইন ও বিষয়বস্তু প্রায় এক।

আজাদ হিন্দের ডাকটিকেটগুলি তার ব্যতিক্রম নয়। জার্মানির যে ডাকটিকেটগুলি দেখিয়েছি তার ডিজাইনার স্বামী-স্ত্রীযুগল আক্সটার-হয়টলাস। আবার এরাই আজাদ হিন্দের ডাকটিকেটেরও ডিজাইনার! আর এ টিকিটগুলো ছাঁপা হয়েছিল জার্মানির সরকারি প্রিন্টিং হাউজ রাইখসড্রুকারিতে। অর্থাৎ তাঁবেদার অন্যান্য সরকারগুলির থেকে এই ‘আজাদ হিন্দ’ খুব একটা আলাদা ছিল না।

পরে এ ডাকটিকেটের বিশাল পরিমাণ সুভাষ বসু ও তার অনুগত অফিসাররা নিয়ে যান জাপানে ও বার্মায়।

আজাদ হিন্দের যাত্রা শুরু ‘আজাদ হিন্দ’ হিসাবে নয়। উত্তর আফ্রিকায় তবরুক আর আল-আলামিনে ১৯৪০-৪১এর যুদ্ধের পর একটা বড় ব্রিটিশ সেনাদল জার্মান ও ইতালীয়দের যুদ্ধবন্দী হয়। এদের মধ্যে ছিল ব্রিটিশ ভারতের অনেক সৈন্য। প্রথমে ইতালিতে ও পরে জার্মানিতে স্থানান্তরিত হয় এরা।

ভ্লাসভ আর্মির মত ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডার অস্ত্র হিসাবে এই ভারতীয়দের ব্যবহারের বুদ্ধি আসে জার্মান ও ইতালীয়দের মাথায়। ইতালীয়রা ১৯৪২এ তিনশর মত ‘স্বেচ্ছাসেবক’ ভারতীয় সৈন্য নিয়ে গঠন করে বাতালিওনি আজাদ হিন্দুস্তান। কিন্তু যথেষ্ট কাঠখড় পুড়িয়ে প্রশিক্ষণ দেবার পরে এদের বিশ্বস্ততা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়ায় দলটিকে ভেঙে দেয়া হয়।

এখানে বলে রাখা ভাল, যুদ্ধবন্দীদের নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করাটা সাধারণত সামরিক বিবেচনায় ভাল নয়। কারণ যে মুহূর্তে তারা যুদ্ধক্ষেত্রে স্বদেশীদের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হবে, সে মুহূর্তে আবার দল পরিবর্তন করতে পারে। এরপরেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানরা বহুজাতিক ভাফেন এসএস নামে প্যারামিলিটারি বাহিনীতে ভিনদেশী স্বেচ্ছাসেবকদের জায়গা দেয়। এদের মধ্যে ছিল ডাচ, বেলজিয়ান, ডেনিশ, নরওয়েজিয়ান, ব্রতোঁ, তাতার, আর্মানী, আজারবাইজানী, জর্জিয়ান, লাটভিয়ান, এস্তোনিয়ান, ফিনিশ, প্রভৃতি জাতির সৈন্য। আরবদের নিয়ে সংগঠিত হয়েছিল লেগিওন ফ্রাইয়েস আরাবিয়েন — ফ্রী আরাবিয়ান আর্মি। সাধারণত ফ্রন্টলাইনে এদের ব্যবহার করা হত না, সিভিলিয়ান অধিকৃত এলাকাতেই বিভিন্ন কাজে লাগানো হত এদের।

মূল কথা হলো, ইন্ডিয়ান লিবারেশন আর্মির শুরুটা সুভাষ বসুর মাধ্যমে নয়। তাঁর সশস্ত্র সংগ্রামের লক্ষ্যের সাথে ভাগ্যক্রমে অক্ষবাহিনীর এসকল প্রপাগান্ডাধর্মী কর্মকান্ড মিলে যায়।

ইতালির মতই জার্মানরা ১৯৪১ নাগাদ উত্তর আফ্রিকা থেকে সাতাশ জন ভারতীয় যুদ্ধবন্দীকে উড়িয়ে নিয়ে আসে ফ্রী ইন্ডিয়ান আর্মির অফিসার বানানোর উদ্দেশ্যে। ধীরে ধীরে জার্মানিতে আফ্রিকা-ইউরোপ থেকে অধিকৃত প্রায় হাজার পনেরো ব্রিটিশ ভারতীয় যুদ্ধবন্দীর সমাবেশ গড়ে ওঠে। হিটলার অবশ্য এসএসপ্রধান হিমলারের ফ্রী ইন্ডিয়ান আর্মি আইডিয়াটাকে পছন্দ করেননি। তাঁর হিসাবে ভারতীয়রা অতীতে আর্য থেকে থাকলেও এখন মিশ্রিত নিচু শ্রেণীর জাত।

হিটলারকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে হিমলার ১৯৪২এর জানুয়ারি নাগাদ লেগিওন ফ্রাইয়েস ইন্ডিয়েন বলে একটা ছোটখাটো ‘স্বেচ্ছাসেবক’ সৈন্যদল গড়ে তোলেন। কিন্তু পক্ষপরিবর্তনে যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে তেমন একটা সাড়া মিলছিল না। জার্মান অধিনায়কত্বের পরিবর্তে দরকার হয়ে পড়ে বিশ্বাসযোগ্য ভারতীয় নেতৃত্ব। এখানেই নেতাজির সফল আবির্ভাব।

ব্রিটিশ ভারতীয় সিআইডির চোখে ধূলো দিয়ে নেতাজি কলকাতা থেকে দুঃসাহসিক এক যাত্রা করেন ১৯৪২এর শুরুতে। পুরো ভারত অতিক্রম করে আফগানিস্তানের সীমানা দিয়ে রাশিয়াতে ঢোকেন ছদ্মবেশে। তারপর নতুন নাম নিয়ে সোজা মস্কো। তাঁর যাত্রার ঠিকানা ছিল মস্কোই, জার্মানি নয়। তাঁর হিসাবে, স্বাধীন ভারতের জন্যে দরকার ছিল বিশ বছরের সমাজতন্ত্রী একনায়কতন্ত্র, ঠিক সোভিয়েত রাশিয়ার আদলে।

কিন্তু মস্কোতে সাড়া জাগাতে ব্যর্থ হন নেতাজি। সোভিয়েতরা তখন জার্মানদের নিয়ে ভীত। যেকোন মুহূর্তে আক্রমণ আসতে পারে। এমতাবস্থায় ব্রিটেন-আমেরিকার মত সম্ভাব্য মিত্রদের চটানোর কোন মানে হয় না। বিফলমনোরথ নেতাজিকে তারা বার্লিনমুখী ট্রেনে তুলে দেয়। কারণ জার্মানদেরই তখন প্রয়োজন ছিল সুভাষ বসুর মত কারো।

পাঠক হয়ত আঁচ করতে পারছেন, নেতাজি স্বদেশপ্রেম আর ব্রিটিশবিদ্বেষে এতটাই অন্ধ আর ‘দ্য এনেমি অফ মাই এনেমি ইজ মাই ফ্রেন্ড’ এ তত্ত্বে এতটাই মশগুল যে যুদ্ধকালীন রাজনীতির সাধারণ জ্ঞান হয় তাঁর বিলুপ্ত হয়েছে, নয়ত তিনি সজ্ঞানেই ব্রিটিশের তদকালীন শত্রু জার্মান-সোভিয়েতদের বাণিজ্যপণ্যে পরিণত হয়েছেন। যদি এ শত্রুরা সমঝোতার মাধ্যমে একটি যুদ্ধবিরতি ও শান্তিচুক্তি করে ফেলত তাহলে আজাদ হিন্দের কি হত? নানা কৌশলগত কারণেই ‘এনেমি অফ মাই এনেমি…’ এ তত্ত্বের এমন সাদাসিধা প্রয়োগ মূলত অকার্যকর।

যাহোক, এপ্রিল ‘৪২এ জার্মানিতে এসে পড়েন নেতাজি। হিটলারের সাথে দেখা করতে চেয়েও তা মেলে কয়েক মাস পর। এর মধ্যেই তাঁকে কাজে লাগিয়ে নেন হিমলার।

ফ্রী ইন্ডিয়ান লেজিওনে যোগ দেয়ার ব্যাপারে ব্রিটিশ ভারতীয় যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে সাড়া না মেলার মূল কারণ একমাত্র দেশী নেতৃত্বের অভাব নয়। এসকল সৈন্যদের অধিকাংশ বংশপরম্পরায় ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীতে সার্ভিস দিয়ে এসেছে। ব্রিটিশরাজের প্রতি ব্যক্তিগত আনুগত্যের যে শপথ তারা নিয়েছে, তা ভঙ্গ করা মিলিটারি কোড অফ অনারের পরিপন্থীও বটে। আর ভিনদেশী-অন্যভাষী জার্মানদেরই বিশ্বাস করার কি কারণ?

সুভাষ বসু একে একে প্রতিটা পিওডাব্লিউ ক্যাম্পে গিয়ে এসকল ভারতীয় সৈন্যদের স্বাধীনতার পক্ষে লড়ার জন্যে উদ্বেলিত করে তোলেন। ফ্রী ইন্ডিয়া সেন্টার বলে একটি রেডিও স্টেশনও শুরু হয়। নেতাজি ছিলেন অসাধারণ বক্তা। আর অনেক শিক্ষিত সৈন্যের কাছেও তাঁর নাম ছিল সুপরিচিত। শুধু এসকল কারণে নয়, যুদ্ধবন্দীশিবিরের করুণ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্যে আর নতুন সেনাদলে অফিসার পদবীর আশাতেও অনেকে সিদ্ধান্ত নেয় ব্রিটিশরাজের প্রতি আনুগত্যের শপথ ভাঙার। সুভাষ বসু ছিলেন তাদের এ সিদ্ধান্তের রেস্পন্সিবল পার্টি।

তবে ১৫ হাজার যুদ্ধবন্দীর মধ্যে শেষ পর্যন্ত শুরুতে কেবল তিন হাজার সৈন্য ফ্রী ইন্ডিয়ান লেজিওনে যোগ দেয়। নেতাজির আশা ছিল কমপক্ষে এক লাখ সৈন্যের একটি বাহিনী বানাবেন। তারপর জার্মানি থেকে যাত্রা করে সোভিয়েত এলাকার মধ্য দিয়ে আফগান ও ভারতের সীমানায় পৌঁছলে ভারতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জনবিদ্রোহ শুরু হয়ে যাবে। বলা বাহুল্য, এ ছিল নিতান্ত নাইভ একটি প্ল্যান।

ভারতের অবিসংবাদিত নেতা সুভাষ বসু ছিলেন না। গান্ধী-নেহরুর নেতৃত্বে কংগ্রেস ও অসহযোগিতা আন্দোলনের পক্ষে বেশ দৃঢ় জনসমর্থন ছিল। আর উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের বালুচ ও পাঠান জাত কিন্তু ব্রিটিশদের সেনাদলে বংশানুক্রমে বিশ্বস্ত সৈন্য যুগিয়ে এসেছে। তাদের মধ্যে নেতাজির নেতৃত্বে হুঁটহাঁট বিদ্রোহ শুরু হত কিনা, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। আর কিভাবে কার খরচের খাতা ভরিয়ে হাজার হাজার মাইল পেরোত এ বিশাল সেনাবহর সেটা মোটেও অবান্তর প্রশ্ন নয়। নেতাজির পরিকল্পনাগুলি ছিল বেশ জাঁকালো, কিন্তু বাস্তবতাবিবর্জিত। তার এসব পরিকল্পনায় পূর্ণ সমর্থন যোগানোটাও ছিল জার্মানদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব।

১৯৩৯এ যুদ্ধ শুরুর সাথে সাথে হোম রুলের পরওয়া না করে ব্রিটেনের পক্ষে ভারতের ব্রিটিশ রাজ জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। কষ্টার্জিত সংসদীয় ব্যবস্থা প্রায় রহিত করা হয়। এ টিকেটটির ব্যবহার ডাকপ্রেরনে হয়নি, হয়েছিল যুদ্ধের খরচ ওঠানোর বন্ডে। লাখে লাখে এ দামী টিকেটটি কেনেও অনেক ভারতবাসী, মূলত পাকিস্তানের এলাকাতে। ব্রিটিশদের প্রতি মুসলিম জনগোষ্ঠীর সমর্থন তুলনামূলক বেশি ছিল।

যা হোক অগাস্ট ‘৪২ নাগাদ মোটামুটি সাড়ে চার হাজারের একটা রেজিমেন্ট গড়ে ওঠে জার্মানিতে। তাদের ইউনিফর্ম ছিল জার্মান সেনাবাহিনীর ধাঁচে। আর ইনসিগনিয়া ছিল জাফরান-সাদা-সবুজ ট্রাইকালার স্ট্রিপের মাঝে শিকারে উদ্যত বাঘের ছবি। শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে তারা নেতাজির প্রতি নয়, হিটলারের প্রতি আনুগত্যের শপথ নেয়। শপথের কথাগুলি ছিল এমন: “I swear by God this holy oath that I will obey the leader of the German race and state, Adolf Hitler, as the commander of the German armed forces in the fight for India, whose leader is Subhas Chandra Bose.”

লেগিওন ফ্রাইয়েস ইন্ডিয়েনের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের কালার গার্ড। শিখ, মুসলিম ও হিন্দু ধর্মের সম্মিলিত। ভারতের তিনরঙা পতাকার মাঝে শিকারোদ্যত ব্যাঘ্র। ওপরে দেখানো আজাদ হিন্দের ডাকটিকেটের একটিতে এ চিত্র রয়েছে।
নাৎসি আর্মির প্রশিক্ষণে রত শিখ সৈন্য। হাতে এমজি-৩৪ অটোম্যাটিক। আজাদ হিন্দের ইন্সিগ্নিয়া দেখা যাচ্ছে ইউনিফরমে। ওপরে দেখানো একটি টিকেটে এ দৃশ্য মুদ্রিত হয়েছে।

নেতাজির অনুরোধ ছিল এ সৈন্যবাহিনী ইউরোপের যুদ্ধে ব্যবহৃত হবে না, হবে কেবল ভারতমুক্তির যুদ্ধে। এতে জার্মানরা যে খুব একটা খুশি হয়েছিল তা নয়। হিটলার নাকি আড়ালে বলেছিলেন, ফ্রি ইন্ডিয়ান আর্মি ইজ এ জোক। শুধু প্রপাগান্ডার খাতিরে বসিয়ে বসিয়ে এদের খাওয়ানো-পরানো আর প্রশিক্ষণ দেয়াটা তাঁর মনঃপূত হয়নি। তাঁকে বুঝিয়ে ঠান্ডা করেন হিমলার। শেষ পর্যন্ত সুভাষ বসুর সাথে একটি মোলাকাতেরও ব্যবস্থা করে দেন, কিন্তু হিটলার কোন প্রতিশ্রুতি সে মিটিংএ নেতাজিকে দেননি। নেতাজি এতে মনোক্ষুণ্ণ হন।

১৯৪২এ হিটলারের সাথে শেষ পর্যন্ত মোলাকাত হয় নেতাজির।

নেতাজির পছন্দের সোভিয়েতদেরকেও ততদিনে আক্রমণ করে বসেছেন হিটলার। স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধ চলছে। কিন্তু আফগান সীমানা পর্যন্ত জার্মান সেনাদের যাওয়া তো দূরের কথা, তার কৌশলগত তেমন কোন কারণও ছিল না। হিটলারের লক্ষ্য ছিল উরাল আর ককেশাস পর্যন্ত সম্পদশালী এলাকাটির দখল নেয়া। তাঁর প্ল্যানে মধ্য এশিয়া ও ইরান ছিল সুদূরের পরিকল্পনামাত্র। পারস্যের মধ্যে দিয়ে একটা রাস্তা থাকলেও তা ছিল অনেক প্রতিকূল।

বিষন্ন নেতাজির দিকে তখন অগ্রসর হয় জাপানিরা। ‘৪২ নাগাদ জাপানিদের হাতে সিঙ্গাপুর-মালয়-বার্মার ব্রিটিশ গ্যারিসনের পতন হয়েছে। তাদের হাতে হাজার চল্লিশেক ভারতীয় যুদ্ধবন্দী। এদের নিয়ে তৈরি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির নেতৃত্বে তখন জাপানপ্রবাসী রাসবিহারী বসু, কিন্তু তাদের দরকার ছিল আরো তরুণ ক্যারিসম্যাটিক নেতৃত্ব। সুভাষ বসু সে রোলপ্লে করতে রাজি হন।

ভারতের বার্মা সীমান্তে জাপানিসমর্থিত বড় সেনাদল নিয়ে স্বাধীনতাসংগ্রামের সফলতার সম্ভাব্যতা নেতাজির চোখে আরো বেশি ছিল। কিন্তু তাঁর যে আশা ভারতের সীমানায় এসে পৌঁছলেই জনবিদ্রোহের সূচনা হবে তাতে গুড়েবালি। ব্রিটিশরা যুদ্ধকালীন সংবাদের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ রেখেছিল শত্রুর প্রপাগান্ডা ছড়ানো বন্ধের জন্যে। এই সেনাদলের অস্তিত্বের কোন খবরই ভারতবাসী যুদ্ধকালীন সময়ে জানতে পারেনি। তাই সুভাষ বসুর সামরিক পন্থায় ভারতমুক্তির তেমন কোন বাস্তবতা ছিল না।

যাই হোক, ১৯৪৩এ সুভাষ বসু ফ্রী ইন্ডিয়া লেজিওনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জাপানমুখী সাবমেরিনে চড়ে বসেন। তাঁকে অনুসরণ করে কিছু সেনা অফিসার। কিন্তু অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হয় সাধারণ ভারতীয় সৈন্যরা। জার্মান এক অফিসারকে তাদের অধিনায়ক বানানো হয়, কিন্তু সৈন্যদের অভিযোগের মুখে তাকে অপসারণ করা হয়। শুধুমাত্র ভারতমুক্তির যুদ্ধে শামিল করা হবে এ কথা দেয়া সত্ত্বেও জার্মানরা রেজিমেন্টটিকে অধিকৃত নেদারল্যান্ডে আটলান্টিক ওয়াল নামক উপকূলীয় প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় স্থানান্তর করে।

ফেব্রুয়ারি ১৯৪৪এ আটলান্টিক ওয়ালে ফ্রী ইন্ডিয়ান আর্মি পরিদর্শনে ফীল্ড মার্শাল রোমেল।

এসময় ডাচ সাধারণ জনগণের কাছে বেশ জনপ্রিয় ছিল ভিনদেশী এ সৈন্যদল। ডাচ মেয়েরা পর্যন্ত ভারতীয় সৈন্যদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। কিছু ক্ষেত্রে বিবাহবন্ধনেও আবদ্ধ হয় কয়েক সৈন্য। অন্যান্য জার্মানদের মত ফ্রন্টলাইন যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়নি এই ভারতীয়রা। মোটামুটি আরামেই কাটে তাদের ১৯৪৩-৪৪। ডাচরা নিজেরাও অধিকৃত জনগোষ্ঠী হওয়ায় ব্রিটিশশাসিত পরাধীন ভারতীয়দের প্রতি তাদের যথেষ্ট সহানুভূতি ছিল। জার্মান প্রপাগান্ডার একটা ভূমিকাও ছিল এতে।

‘৪৩এর শীতের আগমনের সাথে সাথে আবার স্থানান্তর করা হয় ফ্রী ইন্ডিয়া লেজিওনকে। এবার ভাফেন এসএসের সরাসরি কমান্ডে তাদের অবস্থান হয় দক্ষিণ ফ্রান্সের আরামদায়ক উপকূলে। ‘৪৪এর জুনে ফ্রান্সের নর্মন্ডি উপকূলে যৌথবাহিনী সফলতার সাথে অবতরণ করে। শুরু হয় ফ্রান্সের স্বাধীনতাযুদ্ধ। সে সমরে না চাইলেও ভারতীয় সৈন্যরা জড়িয়ে যায়। জার্মান ডিভিশনগুলি সমানে পিছু হটতে শুরু করে। আর ফ্রন্টলাইনের পেছনে ফ্রেঞ্চ রেজিস্ট্যান্সের চোরাগোপ্তা গেরিলা হামলা বেড়ে যায়। ফ্রী ইন্ডিয়া লেজিওনের প্রথম লোকক্ষয় হয় এখানেই। ফরাসী পার্টিজানদের বিরুদ্ধে তখন কিছু যুদ্ধে শামিল হয় ভারতীয়রা।

ফ্রান্সে জার্মান সেনাবাহিনীর মিলিটারি ফাংশনে আজাদ হিন্দের শিখ অফিসারকে নাৎসি স্যালুট দিচ্ছে উপস্থিত জার্মানরা।
ভারতীয় সৈন্যদের একটি ছোট গ্রুপকে নির্দেশনা দিচ্ছে জার্মান অফিসার। ভারতীয় সৈন্যদের পরনে জার্মান সেনাবাহিনীর পোশাক, হেলমেট। ফ্রান্স, ১৯৪৪।

যে স্বাধীন ভারতের লক্ষ্যে এ সাড়ে চার হাজার সৈন্যের জার্মান সার্ভিসে যোগদান, তার থেকে এভাবে ক্রমে দূরে সরে যায় তারা। যে নেতার ব্যক্তিগত অনুরোধের কারণে বাপদাদার মিলিটারি কোড অফ অনার ভেঙে হিটলারের আনুগত্যের শপথ নিয়েছিল তারা, তাঁর কাছ থেকেও বহুদিন কোন খবর নেই। নেতৃত্বহীন, খুঁটিহীন, হতোদ্যম ভারতীয় সৈন্যদের মধ্যে নিয়মানুবর্তিতার অভাব দেখা দিতে শুরু করে। অনেকে মদ্যোপান শুরু করে। ফ্রান্সের প্রতিকূল সামরিক পরিবেশে ধর্ষণ ও শিশুহত্যার মত যুদ্ধাপরাধের অভিযোগও এদের বিরুদ্ধে ফরাসীরা করে যুদ্ধের পরে।

‘৪৫এর মে’তে যুদ্ধ শেষ হয়। নিরপেক্ষ সুইজারল্যান্ডে আশ্রয় নেবার ইচ্ছা থাকলেও ফ্রী ইন্ডিয়া আর্মি শেষমেশ ফরাসী ও মার্কিনদের হাতে বন্দী হয়। তাদেরকে ব্রিটিশদের হাতে সমর্পণ করা হয়। ভারতে প্রত্যাবর্তনের পর ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির পাশাপাশি লালকেল্লায় এদেরও বিচার হয়। কিন্তু ভারতে ততদিনে স্বাধীনতার পক্ষে গণআন্দোলন বেশ জোরেসোরে চলছে। লালকেল্লায় আজাদ হিন্দের রাষ্ট্রদ্রোহিতার বিচারের পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্রোহ করে বসে ভারতীয় নৌ ও বিমানবাহিনী। শেষ পর্যন্ত কিছুদিনের জেল ও ডিসঅনারেবল ডিসচার্জের শাস্তি দিয়ে আইএনএ ও ফ্রী ইন্ডিয়া লেজিওনের সকল অফিসার ও সৈন্যকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় ব্রিটিশরাজ। সুভাষ বসু এসবের আগেই তাইওয়ানে বিমানদুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছেন। যে সামরিক প্রক্রিয়ায় বিজয়ী সেনাবাহিনীর অধিনায়ক হিসাবে ভারতের মুক্তি আনার স্বপ্ন ছিল তাঁর, আজাদ হিন্দ ফৌজ তার থেকে পুরোপুরি ভিন্ন প্রক্রিয়ায় পরাজিত ও ‘রাজাকার’ আখ্যায়িত হয়ে স্বাধীনতাসংগ্রামকে প্রভাবিত করে।

আরেকটা ব্যাপার অনেক বাঙালী ভাবেন যে সুভাষ বসু তাঁর অনুগত সেনাদলে ধর্মীয়-জাতিগত সীমানা ভেঙে সব ছাঁপিয়ে ভারতীয় সাম্যবাদী-জাতীয়তাবাদী একটি অনুভূতি দাঁড়া করান। এটা যতটা না আদর্শবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা উচিত, তার থেকে বেশি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যাচাই করা জরুরী।

ব্রিটিশ ভারতীয় আর্মিতে ধর্মীয়-জাতিগত বিভাজনের অনেক যুক্তিসঙ্গত কারণ ছিল। একই ভাষার ব্যবহার, একই ধরনের খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি অনেক বড় প্র্যাক্টিকাল কারণ। ফ্রী ইন্ডিয়ান আর্মির অবস্থা সেরকম ছিল না। তারা সংখ্যাতেও ছিল কম, জাতিগত-ধর্মীয়ভাবে আলাদা করলে ছোট ইউনিটের কারণে সাংগঠনিক সমস্যা দেখা দিত। তাছাড়াও মনে রাখতে হবে যুদ্ধবন্দী হিসাবে তারা একটা প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন ছিল। সেখানে জাতিগত-ধর্মীয় বিরোধ তৈরির কোন অনুকূল অবস্থা ছিল না। খারাপ সিচুয়েশনে পড়লে বাঘে-মহিষেও এক ঘাঁটে জল খায়।

আর প্রতিকূল অবস্থা থেকে বেরুনোর সাথে সাথেই কিন্তু হিন্দু-মুসলিম বিরোধটা এই একই আর্মির মধ্যে দেখা গেছে। লালকেল্লার বিচারের সময় মুসলিম সৈন্যরা হিন্দুদের ওপর দোষ চাপায় জোরপূর্বক আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগদানে তাদের বাধ্য করার জন্যে। এ অভিযোগের সত্যাসত্য বের করা কঠিন। কিন্তু ভারতীয় ব্রিটিশ আর্মিতে যে ধর্মীয় বিরোধের সুযোগ ও স্থান ছিল না, তার পরিস্থিতি ঠিকই তৈরি হয় আজাদ হিন্দ ফৌজে। সে ব্যাপারে পরে কোনসময় বিস্তারিত বলবো।

সুভাষ বসুর জীবনী নিয়ে বাঙালী বহু পড়াশোনা করেছে, বিস্তর লেখালেখি করেছে। হিরো ওয়ারশিপের শেষ নেই!  কিন্তু পুরো কাহিনীটার বাস্তবধর্মী বিশ্লেষণ করতে হলে জার্মান-জাপানী দৃষ্টিভঙ্গিটা দেখাও জরুরী। আর সাধারণ সৈন্যদের দিকেও নজরটা বাঙালী দিয়েছে কম, যতটা না দিয়েছে নেতৃত্বের প্রতি। সে চেষ্টাটাই আজকে আমি করলাম জার্মান ফ্রী ইন্ডিয়ান লেজিওনের সংক্ষিপ্ত কাহিনীর মধ্য দিয়ে। পরে সুযোগ হলে বার্মার ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির কাহিনী ও জাপানী দৃষ্টিকোণ নিয়েও একটি বিশ্লেষণ করার আশা রাখি।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!